সব্যসাচীর গোয়েন্দাগিরি – ৯

নয়

কৈশোর আর যৌবনের এই যে সন্ধিক্ষণ, এই বয়সটাই কিন্তু মারাত্মক। এই বয়সটায় মন চঞ্চল হয়। রক্তে উত্তেজনা থাকে। তার ওপর একটু যদি জেদি হয়তো কথাই নেই।

সব্যসাচীর এই ব্যাপারটায় জয়ার মন এমনভাবে তোলপাড় করছিল যে, তা বলবার নয়। বিশেষ করে বিজুদাকে কতকগুলো অপ্রিয় কথা বলে এসে মন ওর আরও বেশি উত্তাল হয়ে উঠল। সে ঠিক করল কেউ কিছু করুক-না করুক সে নিজেই খুঁজে বার করবে সব্যসাচীকে। কিন্তু কীভাবে?

বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রসাধন করতে করতেই মনস্থির করল জয়া। বাড়ির সবাই সি-বিচে বেড়াতে যাচ্ছে।

জয়া বলল, আজ আর আমি কোথাও যাব না। শুধু ছাদে বসে সমুদ্র দেখব। তোমরা যাও।

মামি বলেন, ঘরের চাবিটা তা হলে রাখ তোর কাছে?

না না। ও তোমরা নিয়ে যাও। আমি কোথায় হারিয়ে ফেলব তার ঠিক কী? তা ছাড়া এখন ভাল লাগছে না, একটু পরে যদি মন চায় তো যেতেও পারি। মামা বললেন, তা হলে ঘরে থেকেই বা করবিটা কী? সবাই যেমন একসঙ্গে যাই তেমনিই যাই চল।

না মামা, আমার কিছু ভাল লাগছে না। তা ছাড়া আমার যেন কেমন ভয় করছে।

তা হলে থাক। দেখিস যেন অন্য কোনও মতলব করিস না।

মামা, মামি, দিদিমা সবাই চলে গেলে জয়া ধীরে ধীরে নীচে নামল। প্রচণ্ড জেদের কাছে ওর ভয়ভীতি সবকিছুই হার মেনেছে। সূর্য অস্ত যেতে এখনও অনেক দেরি। ও ঠিক করল এই সুযোগে ও একাই চেষ্টা করবে সব্যসাচীকে খুঁজে বার করতে। এই তদন্তের কাজ শুরু করবে সেই মোহানার দিক থেকে। জয়া তৈরিই ছিল।

সবাই চলে গেলে ও ধীরে ধীরে পথে নামল। তারপর আপন মনেই এগিয়ে চলল মোহানার দিকে।

সমুদ্রের গা বেয়ে দীর্ঘ পথ চলে গেছে সেই পাখাগুলো পার হয়ে দূরে বহুদূরে। সেইপথে ও খানিক যেতেই দেখল এক জায়গায় দুটি ছেলে নতুন একটি সাইকেল রেখে একপাশে বালিয়াড়িতে বসে কীসব গল্প করছে।

জয়া মতলব একটা এঁটে সেই ছেলেগুলোর পাশ দিয়ে একবার সমুদ্রে নামল। তারপর পায়ের পাতাদুটি ভিজিয়ে বালিতে পা ঘষে উঠে এল ওপরে। এদিক সেদিক ঘুরল।

অল্পবয়সি ছেলেদুটি এই নির্জন সৈকতে এমন একটি ফুটফুটে কিশোরীকে দেখে স্বাভাবিকভাবেই চোখ মেলে তাকাল তার দিকে। হয়তো বা ভালও লাগল ওকে।

জয়াও ওদের দিকে তাকাল। তাকিয়ে হাসল একটু।

ছেলেদুটিরও অল্প বয়স। তাই জয়ার সৌজন্যতায় অভিভূত হল। একটি ছেলে খুব ভদ্রভাবেই বলল, তুমি একা কেন? তোমার সঙ্গে আর কেউ নেই?

জয়া হেসে বলল, কে বললে আমি একা? আমার দুই বন্ধুও তো আছে এখানে।

কোথায় তারা?

এই তো আমার সামনেই বসে আছে। আমার সঙ্গে কথা বলছে। ছেলেদুটি আরও খুশি হল, তুমি খুব ভদ্র মেয়ে তো। কোনও মেয়ের কাছ থেকে এমন মার্জিত ব্যবহার আমরা কখনও পাইনি। কোথায় উঠেছ তুমি? জয়া একটা বাড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই যে, ওই বাড়িটাতে ওরে ব্বাবা। ওদের তো গলাকাটা রেট। তা পুরীতে এত জায়গা থাকতে ওখানে উঠলে কেন?

তা বলতে পারব না। আমার দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে এসেছি।

একজন বলল, বাদাম খাবে? যদি খাও তো নিয়ে আসি।

জয়া বলল, কোথায় কতদূরে আনতে যাবে?

ওই তো। ওই চা-দোকানটায় পাওয়া যায়।

যাও। তবে ভাই একটা কথা। তোমাদের এই সাইকেলটার ওপর আমার কিন্তু দারুণ লোভ। আসলে আমি সাইকেল ছাড়া একদম থাকতে পারি না। আর পুরীতে এসে ওই দূরে কত কী দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু যেতে পারছি না, তাই খুব মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

একটি ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বেশ তো, এ আর এমন কথা কী? কোথায় কতদূরে যেতে চাও বলো, আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।

ডবল ক্যারি করতে পারবে?

আমরা তো দু’জনে একই সাইকেলে এসেছি।

তা হোক, আমি একা একটু চেপে দেখতে চাই। একা সাইকেলে বসে প্যাডেল করতে দারুণ ভাল লাগে আমার। যা তোমার ইচ্ছা।

তোমরা তা হলে বাদাম কিনে আনো, আমি ততক্ষণে একপাক একটু ঘুরে আসি।

একজন বাদাম কিনতে গেল।

অন্যজন জয়ার সঙ্গে এল পিচ রাস্তায়। এসে বলল, তুমি কিন্তু বেশিদূরে যেয়ো না। এক পাক ঘুরেই চলে এসো। তারপর আমি তোমাকে সাইকেলে চাপিয়ে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাব, যেখানে গেলে আর তুমি ফিরতেই চাইবে না।

জয়া চোখদুটো বড় বড় করে বলল, সত্যি! বলেই সাইকেলে চেপে বসল। তারপর বলল, শোনো, আমার যদি ফিরে আসতে দেরি হয়, তা হলে কিন্তু আমার খোঁজ কোরো তোমরা।

দেরি হবে কেন? বেশিদূর যেয়ো না। ওই মুখ পর্যন্ত গিয়েই চলে এসো।

বলা যায় না, যদি কোনও বিপদে পড়ি।

এখানে কারও কোনও বিপদ হয় না। এ তোমাদের কলকাতা নয়। তুমি নির্ভয়ে যেতে পারো।

না। ওই মোহানার দিকটা খুব নির্জন তো।

তুমি মোহানায় গেছ? ওদিকে মোহানা আছে তুমি জানলে কী করে? নদীর ওপারে যে উঁচু বালিয়াড়িটা আছে ওখানটা কিন্তু ভীষণ নির্জন। তুমি তো সবই জান দেখছি।

তারও ওপারে যে ঝাউবন সেটা কিন্তু আরও রহস্যময়। ওদিকে খবরদার যেয়ো না। শোননি কাল ওখানে কী হয়েছে?

সেইজন্যই তো ওইদিকে যাচ্ছি। আমি চাই কারও কোনও হিম্মত থাকে তো আমার কিছু করুক।

শোনো, ওরকমটি কোরো না। প্লিজ, কী নাম তোমার?

আমার নাম মহিষাসুরমর্দিনী। ছাড়ো, পথ ছাড়ো। বলেই ছেলেটিকে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত সাইকেল নিয়ে উধাও হয়ে গেল জয়া।

ছেলেটি চেঁচাতে লাগল, এই শোনো— শোনো—।

ওর অপর বন্ধুটি ততক্ষণে বাদাম নিয়ে ফিরে এসেছে। বলল, ঘণ্টা? কী হল রে

হবে আর কী? দিব্যি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আমার ঘণ্টায় বারোটা বাজিয়ে চলে গেল।

সে কী !

এ তো দেখছি আর এক ফুলনদেবী।

এখন তা হলে উপায়?

যেভাবেই হোক, মোহানা অব্দি যেতেই হবে আমাদের। বারোশো টাকার সাইকেল, এটাকে তো উদ্ধার করতেই হবে।

কিন্তু সে তো অনেক দূরের পথ।

তবুও যেতে হবে ভাই।

ওরা দ্রুত পা চালিয়ে মোহানার দিকে যেতে যেতেই একটা অটো দেখতে পেল।

জয়া তখন অনেক অনেক দূরে চলে গেছে।

ওরা অটোর চালককে বলল, শোনো ভাই, ওই যে মেয়েটা যাচ্ছে, তুমি যত শিগগির পারো আমাদের দু’জনকে ওর কাছে পৌঁছে দাও। একদম দেরি কোরো না।

চালক ওদের দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল, ওইসব ধান্দাবাজির কাজ আমি করি না ভাই। মতলবটা কী তোমাদের?

সে তুমি বুঝবে না। যা টাকা লাগে আমরা দেব।

তোমাদের মতন ফুটো ক্যাপ্তেন আমি অনেক দেখেছি। পঞ্চাশটি টাকা আগে বার করো, তারপর যাচ্ছি।

পঞ্চাশ টাকা আমরা এখনই কোথায় পাব? আমাদের বাড়ি চলো, আমরা ঠিক দেব। ওই মেয়েটা আমাদের সাইকেল নিয়ে পালাচ্ছে।

ওইসব মেয়েটেয়ের ঝামেলায় আমি নেই। তোমরা অন্য রাস্তা দেখো। না ।

হলে আমি পুলিশ ডাকব। ভাগো এখান থেকে।

ছেলেদুটি হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল অটো চলে গেল অন্যদিকে।

সূর্য তখন জলে নামলেও মেয়েটি একেবারেই ডুব।

ওরা দু’জনে জোরে জোরে পা চালিয়ে এগিয়ে চলল। পাখাগুলো যেখানে শেষ হয়েছে তার ওধারে আর পথ নেই। শুধু বালি বালি আর বালি। ওরা দেখল সেই বালির ওপর একটি পোস্টের গায়ে ওদের সাইকেলটা রয়েছে বটে, কিন্তু মেয়েটির কোনও চিহ্নও নেই।

তবুও ওরা মোহানার দিকে এগোল। খানিক যাবার পর এক জায়গায় বালির ওপর মেয়েটির সোনালি চটির একপাটি পড়ে থাকতে দেখল। আরও খানিকটা গিয়ে দেখতে পেল আর এক পাটি।

নদীর কাছে গিয়ে ওরা দেখল মোহানার নদী সমুদ্রের জোয়ারে ফুলছে। সে কী ভীষণ বেগ তার। জলও যে কত তা কে জানে? কিন্তু মেয়েটি! মেয়েটি কোথায় গেল? সে কী সত্যিই মেয়ে? না কোনও জাদুকরী? তা যদি না হয়, তা হলে এই ভয়ংকর নির্জনে সে অমন ভোজবাজির মতন অদৃশ্য হয় কী করে?

ঘণ্টার সঙ্গে ওঁর যে বন্ধুটি ছিল তার নাম কাঁসর। সে চিৎকার করে বলল, আরে ও চাঁদবদনি! তুমি যেখানেই থাক ফিরে এসো। আমাদের সাইকেল আমরা পেয়েছি। আমরা তোমাকে কিছুটি বলব না। তুমি না এলে আমরা কিন্তু বিপদে পড়ে যাব। তোমার সঙ্গে যদি কেউ আমাদের কথা বলতে দেখে থাকে তা হলে সে কিন্তু পুলিশের কাছে আমাদের নামই বলবে।

ঘণ্টা আর কাঁসর চেঁচিয়েই সারা হল। ওদের কথাতে সাড়াও দিল না কেউ, এলও না।

ওরা তখন ভয়ে ভয়ে পিছু হাঁটল।

যেতে যেতে ঘণ্টা বলল, ভয় তো অন্য কাউকে নয়, কাল করলাম অটো ডেকে।

কাঁসর বলল, এখন মানে মানে কেটে পড়ি চল।

ওরা খানিক এসেই অন্য পথ ধরে অন্য দিকে উধাও হয়ে গেল।

ওরা চলে যাবার পর একটি ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল জয়া। তারপর ওর চটিদুটো হাতে নিয়ে নদী পার হবার বৃথা চেষ্টা না করে ধীরে ধীরে বালিয়াড়ির গা বেয়ে এগিয়ে চলল, নদীটা যেদিক থেকে বয়ে এসেছে সেইদিকে। খানিক যাওয়ার পর নদীটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেইখানে আসতেই দেখল কয়েকজন নিম্নশ্রেণীর মেয়েপুরুষ এক জায়গায় বসে জটলা করছে। একপাশে বাঁশের একটি খুঁটির সঙ্গে বাঁধা আছে ছোট্ট একটি পানসি। ও ধীরে ধীরে সেটার ওপর উঠে বাঁধনটা খুলে দিতেই পানসিটা স্রোতের বেগে ভেসে চলল তির তির করে। বেশিদূরে অবশ্য গেল না। খানিক গিয়ে পানসিটা একটু কাত হতেই ও লাফিয়ে পড়ে জলে। তারপর ভিজে সপ সপ করে হাঁটু জল পার হয়ে যখন ডাঙায় উঠল তখন মনে হল এ কী করল সে? এখানে সে কেন এল? সব্যসাচীর খোঁজে এইখানে আসার দরকারটাই বা ছিল কী তার? সে কী পাগল হয়ে গেছে? এখন এই অন্ধকারে সাপ-শেয়াল, নয়তো কোনও বন্যজন্তুর পেটে যেতে হবে তাকে। চারদিকে সামুদ্রিক বাতাসের দীর্ঘশ্বাস। ঘন ঝাউবনের কান্না। নিশাচর পাখিদের ডাক। শুধু অন্ধকার— অন্ধকার— আর অন্ধকার।

হঠাৎ সেই অন্ধকারে ঝাউবনের ভেতর থেকে কারা যেন বেরিয়ে এল এক এক করে।

ওরা এসে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল ওকে। একসঙ্গে অনেকগুলো টর্চের আলো ওর ওপরে পড়ল।

জয়া সভয়ে তাকাল তাদের মুখের দিকে। কিন্তু এই অন্ধকারে কারও মুখই ভাল করে দেখতে পেল না সে।

ওদের একজন জিজ্ঞেস করল, কে তুমি! এখানে কী জন্য এসেছ? জয়া বলল, আমি এখানে আত্মহত্যা করতে এসেছি।

আত্মহত্যা করতে? এতদূরে? কেন সমুদ্রে কী জলের অভাব ছিল?

না। যদি কেউ আমাকে উদ্ধার করে সেই ভয়ে আমি এইখানে চলে এসেছি। কিন্তু এখানে নদীতে ঝাঁপ দিয়েও মরণ হল না। ওপার থেকে একটা পানসি নিয়ে ভেবেছিলাম মাঝসমুদ্রে ভেসে যাব। কিন্তু ফল হল উলটো। পানসিটা ভেসে চলল অন্যদিকে।

তা তো যাবেই। এখন তো জোয়ারের সময়।

তাই আমি মনের দুঃখে নদীতে ঝাঁপ দিই। কিন্তু এমনই কপাল যে নদীতে জল বেশি নেই। তাই বেঁচে গেলাম।

জল আছে। তবে কিনা তুমি নিশ্চয়ই ডাঙার কাছে উলটে ছিলে। বলে জয়ার পোশাকে হাত দিয়ে বলল, আরে সত্যিই তো। তুমি তো দেখছি ভিজে গেছ।

এইবার ভারিক্কি চেহারার একজন এগিয়ে এসে বললেন, কিন্তু কেন তুমি আত্মহত্যা করতে চাও। এমন ফুটফুটে চেহারা তোমার। টাটকা ফুলের মতো মেয়ে তুমি। এ জীবন নষ্ট করবে কেন?

জয়া বলল, আমি জীবনে সুখী নই। আমার মা নেই, বাবা নেই। মামা-মামির কাছে মানুষ। তারা আমাকে দু’বেলা দু’মুঠো পেট ভরে খেতেও দেয় না। আমার লেখাপড়া ছাড়িয়ে দিয়েছে। এখন শুনছি একটা আধবুড়ো লোকের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে।

সঙ্গে সঙ্গে দলের একজন রুখে দাঁড়াল, নেভার। বলেই বলল, নিয়ে আসব ওর মামা-মামিকে?

কখনও না। এই দুনিয়ায় যারা পিতৃমাতৃহীন তাদের সবার জীবনেই এই একই নাটক। কতজনকে টেনে আনবে? আজ আমরাও যদি বাবা-মায়ের আশ্রয়ে থেকে সৎ শিক্ষা পেয়ে নিজেদের মানুষ করতে পারতাম তা হলে কী এই জীবন বেছে নিতে হত আমাদের? আমরা খুনি, আমরা ডাকাত, পুলিশের ভয়ে আমরা বনে-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকি। এর মূলেও তো সেই একই ভবিতব্য। রাস্তার ছেলে আমরা, রাস্তায় মানুষ হয়েছি। বাবা-মা কে তাও জানি না। চোখেও দেখিনি তাদের।

মেয়েটাকে নিয়ে তা হলে কী করবে?

আর যাই করি মরতে ওকে দেব না।

কিন্তু ওকে রাখবে কোথায়?

এমন সময় টর্চের আলো ফেলে দু’জন লোক সেখানে এসেই জয়াকে দেখে চমকে উঠল, এ কী! তুমি এখানে?

জয়া কিন্তু চিনতে পারল না তাদের। বলল, আপনারা?

তুমি আমাদের চিনবে না। তোমার নাম তো জয়া? ঠিকই বলেছেন আপনি।

তুমি এখানে কী করতে এসেছ? কে পাঠিয়েছে তোমাকে? সঙ্গে আর কে আছে?

ভারিক্কি চেহারা বললেন, রঘু! তুমি একে চেন? মেয়েটা এখানে আত্মহত্যা করতে এসেছিল।

বাজে কথা। ও যা বলবে তাই বিশ্বাস করতে হবে নাকি? বলেই বলল, পুলিশকে তোমরা কী বলেছ আমাদের নামে?

আপনাদের তো চিনিই না। কাজেই বলবটা কী?

সেই ছোকরাকে তো চেন? সে নিশ্চয়ই বলেছে? বলো হ্যা কি না? জয়া বলল, বুঝেছি। সব্যসাচী তা হলে আপনাদের কথাই বলছিল কাল। সেই রহস্যময় দু’জন।

কিন্তু তুমি এখানে কেন?

আমি সব্যসাচীর খোঁজে এসেছি। বলুন তাকে আপনারা কোথায় লুকিয়েছেন?

ভারিক্কি চেহারা দারুণ রেগে বললেন, ওরে শয়তান মেয়ে। তুমি তা হলে স্পাইগিরি করতে এসেছ এখানে? এই কে আছিস, এখুনি এই বালির মধ্যে দশ হাত গর্ত খুঁড়ে পুঁতে ফ্যাল মেয়েটাকে।

হঠাৎ কোথা থেকে একটা গুলির শব্দ হতেই একজন লোক বুকে হাত চেপে লুটিয়ে পড়ল সেখানে। মুহূর্তের মধ্যে সব ফাঁকা। জয়াও সেই সুযোগে দৌড় দিল গভীর জঙ্গলের দিকে।

ছুট— ছুট— ছুট।

ছুটতে ছুটতে এক জায়গায় বালিতে পা হড়কে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জয়া। তারপরই যা দেখল তা দেখেই মূর্ছা গেল সে। জয়া দেখল বালির স্তূপের মধ্য থেকে ধড়হীন একটা মুণ্ড উঁকি মারছে। কী করুণ সেই মুখ। মুখটা ভাবলেশহীন চোখে ওর দিকে তাকিয়ে একবার শুধু বলল, জল। একটু জল।

কিছুক্ষণ আচ্ছন্নর মধ্যে থাকার পর আবার যখন সংবিৎ ফিরে পেল জয়া,

লোকটি তখনও বলছে, জল। আমাকে একটু জল দেবে? বড্ড তেষ্টা। জয়া প্রথমে খুব ভয় পেল। লোকটাকে ভূত ভেবে শিউরে উঠল সে। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কে আপনি?

আমি জয়শংকর প্রসাদ। আমাকে তুমি উদ্ধার করো। ওরা আমাকে হাত-পা বেঁধে বালির সঙ্গে পুঁতে রেখেছে।

জয়া হাতের কাছে যা পেল তাই দিয়েই বালি সরাতে লাগল। তারপর একসময় যখন টেনেহিঁচড়ে উদ্ধার করল তাকে তখন দেখল, পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এক রূপবান যুবক সে।

জয়শংকর জয়াকে আদর করে বলল, আজ থেকে তুমি আমার ছোট বোন। কী নাম তোমার?

আমার নাম জয়া।

তবে তো ভালই হল। জয়া আর জয়শংকর। কী চমৎকার নামের মিল দেখেছ? কিন্তু এই অন্ধকারে তুমি এখানে কীভাবে এলে? ওরা কি তোমাকে চুরি করে এনেছিল?

জয়া বলল, আমার কথা পরে বলব আপনাকে। আপনার তো খুব জল তেষ্টা পেয়েছে। এখন চলুন কোথাও যদি একটু জল পাই তো দেখি।

জয়শংকর জয়াকে অবলম্বন করে ধীরে ধীরে যেদিকে দু’চোখ যায় সেদিকে এগিয়ে চলল।

একটু পরেই একদল পুলিশ এসে তোলপাড় করতে লাগল চারদিক। তাদের সঙ্গে সেই কাঁসর-ঘণ্টাও ছিল। তারাই পুলিশে খবর দিয়ে ডাকিয়ে এনেছে পুলিশকে।

পুলিশ অফিসার সঙ্গের কনস্টেবলদের বললেন, আর খুঁজে লাভ নেই। আপাতত ডেড বডিটাকে মর্গে পাঠাও। কাল সকালে এসে দিনের আলোয় আর একবার দেখা যাবে।

হঠাৎ একজন কনস্টেবল ছুটে এসে বলল, ওই দেখুন স্যার, ওখানকার বালিটা কীরকম খাবলানো। তার মানে ওখানে নিশ্চয়ই কিছু লুকনো ছিল।

সেই যে সেই ছেলেটা, কী যেন নাম? পার্থ না কী? ওর মামার ডেড বডিও থাকতে পারে। শেয়াল-কুকুরে টেনে তুলেছে হয়তো।

একবার একটু দেখব নাকি স্যার?

কোনও লাভ নেই। তবু বলছ যখন দেখো।

কয়েকজন কনস্টেবল টর্চের আলোয় চারদিক দেখে বলল, নাঃ। কিছুই পাওয়া গেল না এখানে।

তা হলে আর সময় নষ্ট না করে ফিরে চলো।

সবাই চলে গেলে জায়গাটা কেমন যেন এক শূন্যতায় ভরে উঠল। একটা শেয়াল গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে এমন একটা হাঁক দিল যে একসঙ্গে অনেকগুলো শেয়াল ডেকে উঠল একজোটে, হু-হু-হুক্কা-হুয়া-হুয়া-হুয়া-হুয়া। সেইসঙ্গে তীব্র থেকে তীব্রতর হল সমুদ্রের ডাক। ওঃ সে কী গর্জন। যেন কান পাতাও দায়।