আট
এইদিন দুপুরের পর বিজুদা ছাড়া পেলেন হাসপাতাল থেকে। মাথায় আঘাত পেয়ে কিছু সময়ের জন্য সংজ্ঞাহীন হলেও পরে ঘোরটা কেটে গেলে সুস্থ হন। তবে মাথায় চোট লাগার জন্য ব্যান্ডেজ একটা বাঁধতেই হল। এরজন্য তিনি অবশ্য কাতর নন।
হলিডে হোমে ফিরে এসে সব্যসাচীর খবরটা শুনে দারুণ উত্তেজিত হলেন বিজুদা। তাঁরই ভাইঝির খোঁজে গিয়ে ছেলেটি দুষ্কৃতীদের কবলে পড়েছে শুনে যেমনি বিচলিত হলেন তেমনি আঁশঙ্কিত হলেন অন্য ব্যাপারে। অর্থাৎ সেই যে সেই জিনিসটা, যেটাকে পাবার জন্য এত কিছু সেটা কি সব্যসাচীর কাছেই ছিল? নাকি রেখে গেছে অন্য কোথাও? কে জানে? তবু স্নেহাংশুবাবুকে বললেন, আচ্ছা, বাইরে যাবার আগে ও কি কোনও কিছু রেখে গেছে আপনাদের কাছে? স্নেহাংশুবাবু বললেন, আমি তো কিছু বলতে পারব না ভাই, আমি ছিলামই না বাড়িতে। আপনাদের জন্যই হাসপাতাল-পুলিশ এইসব করছিলাম। ওর মাকে একবার জিজ্ঞেস করুন তো?
সরমা বললেন, না, সেরকম কিছুই রেখে যায়নি ও। জিনিসটা কী?
বিজুদা বললেন, যদি অনুমতি দেন তা হলে আমি একবার ঘরের ভেতরটা
দেখব? ওটা খোয়া গেলে কিন্তু আমার সমস্ত পরিকল্পনাই ভেস্তে যাবে। বেশ তো দেখুন। কিন্তু আমাদের ছেলেটাকে আমরা কি আর কখনও ফিরে পাব?
আমার ভাইঝি লিপির সম্বন্ধেও ওই একই দুশ্চিন্তা আমার। ওকেও কী ফিরে পাব আমরা?
এমন সময় পাণ্ডা লিঙ্গরাজ মিশ্র এসে হাজির হলেন।
এলেন সাধনবাবুও। বললেন, ওইখানে ওদের যাওয়াটাই ভুল হয়েছে। এই ঘটনার পর ওদিকে কেউ যায়?
বাপি ম্লানমুখে দাঁড়িয়েছিল অদূরে। বলল, আমরা তো গেছি লোকনাথে। মনে করুন আমরা না জেনেই গেছি। বিপদ হবে বুঝব কী করে?
বাঃ। মেয়েটাকে নিয়ে মারুতিটা যে ওইদিকে গেছে তা তোমরা জানতে না? কেন জানব না? মারুতিটা ওই পথেই গেছে। কিন্তু লোকনাথে গেছে এমন কোনও প্রমাণ কি ছিল আমাদের কাছে? তা ছাড়া লোকনাথ দেবস্থান। তার ধারেকাছে কোনও মারুতিকে আমরা দেখিওনি।
মিশ্রজি বললেন, আমি তো বলেছিলাম কয়েকজন ছেলেকে সঙ্গে দিচ্ছি। কিন্তু যেমন তোমরা শুনলে না তার ফল ভোগ করো এবার। বেশি লোকজন সঙ্গে থাকলে এই কাণ্ডটা হত না!
স্নেহাংশুবাবু বললেন, আর এখন এইসব বলে লাভ নেই। মিশ্রজি আমার ছেলেও বড় অবাধ্য। এত জেদ যে তা বলবার নয়। বুকের ভেতর একফোঁটা ভয়ডর নেই।
মিশ্রজি বললেন, তবু আপনি কিন্তু ঘাবড়াবেন না বাবু। আমার বেশ কিছু লোকজনকে আমি নজর রাখতে বলেছি ওইসব অঞ্চলে। যত দূরেই ওরা হোক না কেন, পুরী ছেড়ে পালাতে হচ্ছে না বাছাধনদের।
সরমা বললেন, কিন্তু যদি ওরা মেরেই ফেলে ছেলেটাকে?
শুনুন মা, শুধু শুধু খুনের ঝুঁকি গুন্ডাবদমাশরাও নেয় না। ওরা ওর কাছ থেকে ওদের জিনিস পেয়ে গেলেই ছেড়ে দেবে।
সাধনবাবু বললেন, আমিও আমার দু’জন ছেলেকে পাঠিয়েছি। ওদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে। তা ছাড়া এখানকার পুলিশও খুব একটা অলস নয়। মুখে ভান দেখায় যেন কোনও কিছু করবার অবকাশই নেই তাদের, কিন্তু ভেতরে ভেতরে দারুণ সক্রিয়।
সরমা বললেন, তাই যেন হয়। ছেলেটাকে যেন ওরা উদ্ধার করতে পারে। বাপি বলল, আসলে আমার মনে হয় ওরা ওকে ধরবার জন্য অনেকক্ষণ থেকেই ওত পেতে ছিল। হয়তো ভেবেছে ও বিজুদারই কেউ। হতে পারে।
এদিকে বিজুদা ঘরে ঢুকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পেলেন না সেই জিনিসটা, যেটা তিনি বিপদ বুঝে সব্যসাচীর কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন। তাই ম্লানমুখে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, আচ্ছা বাপি, সেই মেয়েটাকে একবার ডাকিয়ে আনা যায় না?
কার কথা বলছেন?
ওই যে সেই মেয়েটা, যে কাল ওর সঙ্গে মোহানার দিকে গিয়েছিল।
বাপি বলল, জয়ার কথা বলছেন? ওই ওদিকে সামনের বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখুন, মেয়েটা আপনমনে কী যেন ভাবছে। বলেই একটা হাঁক দিল, জয়া! একবার এইদিকে আসবে?
জয়া বিষণ্ণ বদনে বাপির দিকে তাকিয়ে বলল, কেন?
বিজুদা একবার ডাকছেন তোমাকে।
জয়া এলে বিজুদা বললেন, জয়া, আমরা সবাই জানি সব্যসাচীর সঙ্গে তোমার একটা দারুণ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাই জিজ্ঞেস করছি ও তোমার কাছে কোনও কিছু জমা রেখেছে কী? বা কোনও কিছুর ব্যাপারে কিছু কি বলেছে তোমায়?
বলেছে।
তুমি কি জানো সেটা কোথায় আছে?
জানি। ওর কাছেই আছে সেটা।
বিজুদা হতাশ হয়ে বললেন, সর্বনাশ হয়েছে তা হলে।
সরমা বললেন, আমার ছেলের জীবনের চেয়েও আপনার কাছে ওই জিনিসটার গুরুত্ব দেখছি খুব।
আমাকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ, আমার কাছে দুটোরই গুরুত্ব অনেক।
তাই যদি হয়, তা হলে ওই মূল্যবান জিনিসটাকে নিয়ে অত ভোরে আপনি পথেই বা নেমেছিলেন কেন?
আসলে কলকাতা থেকে আমার পিছু নিয়ে ওরা যে এখান পর্যন্ত আসবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
জয়া বলল, এবার আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি কি? নিশ্চয়ই পারো।
সব্যসাচীর মুখে সকালের ঘটনাটা শুনে আমার যা মনে হয়েছে তা হল এই, ওই দুষ্কৃতীরা আপনার পূর্ব পরিচিত।
অবশ্যই।
শুধু তাই নয়, আপনার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও ছিল তাদের। তাও ঠিক।
আপনি তা হলে কে? আপনি তা হলে কী?
আমি আমিই।
না। নিশ্চয়ই ওই দলের লোকেদের সঙ্গে আপনার কোনও হিচ হওয়ায় আপনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন, অথবা কোনওকারণে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন ওদের সঙ্গে। তাই ওরা ছায়ার মতো অনুসরণ করছে আপনাকে। আসলে আপনি নিজেই একটি বাজে লোক। আপনার কুকর্মের জন্য একটি ছেলে এবং মেয়ের জীবন এখন বিপন্ন।
জয়ার মতো অল্পবয়সি একটি মেয়ের কাছে এইরকম জেরার মুখে রীতিমতো ঘাবড়ে গেলেন বিজুদা। তাই ওর কথার কী যে উত্তর দেবেন কিছু ভেবে পেলেন না। তবে তিনি চটলেন না, বা উত্তেজিতও হলেন না। শুধু হেসে বললেন, আমার সম্বন্ধে তুমি অনেক কিছুই ধারণা করেছ দেখছি।
সরমা বললেন, ওই একই ধারণা তো আমারও। ও যা বলল তার পরিষ্কার উত্তর আপনার কাছ থেকে আমরা প্রত্যেকেই আশা করছি।
বিজুদা বললেন, তা হলে শুনুন, ব্যাপারটা যখন থানা পুলিশের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁচেছে তখন কোনও রহস্যই আর গোপন থাকবে না। তবুও এখনই এই ব্যাপারে কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কেন না বিষয়টি ক্রমশ প্রকাশ্য।
বিজুদার এই কথার উত্তরে কেউ কিছু না বললেও জয়া বলল, চালাকি করে আপনি কিন্তু পার পাবেন না। আপনার মুখোশ আমি খুলবই। বলে কারও দিকে না তাকিয়ে রাগি-রাগি মুখে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে।
জয়ার তেজস্বিতায় হতবাক সকলেই।
বিজুদাও ওর ব্যবহারে এবং কথাবার্তায় একটু অপমান বোধ করলেও অন্তরের দৃঢ়তায় তা প্রকাশ করলেন না। অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে কারও সঙ্গে কোনও কথা না বলে, একবার নিজের ঘরে ঢুকে কী সব খুটখাট করে পোশাকটা পরিবর্তন করলেন। তারপর বারান্দায় এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে এক-পা এক-পা করে নেমে এলেন নীচে।
বিজুদার মা বারান্দার কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে বললেন, এই অবেলায় কোথায় চললি বিজু ?
বিজুদা বললেন, তুমি আবার বেরিয়ে এলে কেন? ভেতরে যাও। আমার আসতে দেরি হবে।
সরমা তখন এতই রেগেছেন যে আস্তে করে বললেন, আর তুমি এসেছ! তবে পালিয়ে বাঁচবে না তুমি। আমি ঠিক গিয়ে পুলিশকে বলব সব কথা। কী এমন জিনিস, যেটার জন্য এত?
হঠাৎ একটি পুলিশের গাড়ি এসে থামল হলিডে হোমের সামনে। একজন সাব ইনস্পেক্টর ওপরে উঠে এসে স্নেহাংশুবাবুকে বলেন, আপনাকে এখুনি একবার থানায় আসতে হবে স্যার।
স্নেহাংশুবাবু আশান্বিত হয়ে বললেন, কোনও খবরটবর?
ইনস্পেক্টর সরমার দিকে একবার তাকিয়ে স্নেহাংশুবাবুকে বললেন, নীচে আসুন, বলছি।
স্নেহাংশুবাবুর বুক কাঁপতে লাগল।
সরমা বললেন, ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? যা বলার আমাকেও বলুন। ইনস্পেক্টর সে কথায় কান না দিয়ে চাপা গলায় স্নেহাংশুবাবুকে কী যেন বললেন ফিস ফিস করে। তারপর দু’জনেই গাড়িতে উঠে বসলেন।
সরমা একবার সব্যসাচী বলে অস্ফুট আর্তনাদ করে বারান্দাতেই জ্ঞান হারালেন। কী যে হল ব্যাপারটা কেউ কিছু বুঝতেও পারল না।