সাত
ওরা যখন সেই মর্মান্তিক দুঃসংবাদটা নিয়ে ফিরে এল, ওদিকে তখন আর এক নাটক। পার্থ নামের সেই ছেলেটা, মোহানার বালিয়াড়ি থেকে যাকে উদ্ধার করা হয়েছিল, তাকে ঘিরে তখন দারুণ রহস্য জমে উঠেছে।
পুলিশ অফিসাররা বারবার জেরা করেও কোনও সদুত্তর পাছেন না তার কাছ থেকে।
একজন অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক করে বলো, কীভাবে ওরা কিডন্যাপ করল তোমাকে?
পার্থ বলল, বিশ্বাস করুন, আমি কিচ্ছু মনে করতে পারছি না।
মিথ্যে কথা। আসলে তুমি মনে করবার চেষ্টাই করছ না। সত্যি করে বলো, তুমি কি আদৌ জলে পড়েছিলে?
পাৰ্থ কিছুক্ষণ মাথা হেঁট করে বসে থেকে বলল, জলে তো পড়েছিলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।
সবই মনে আছে তোমার। কিন্তু তুমি যে কোনও কারণেই হোক চেপে যাচ্ছ। সত্যি কথাটা বলতে চাইছ না। পরে অবশ্য তুমি সংজ্ঞাহীন হয়েছিলে ঠিকই, তখনকার কথা তোমার মনে না থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু আগের কথা ভুলে যাবার কারণটা কী?
পার্থর বাবা-মা বললেন, শুধু শুধু ওকে কেন কষ্ট দিচ্ছেন স্যার? আমাদের তো কোনও অভিযোগ নেই। আজ রাতের গাড়িতে আমাদের রিজার্ভেশন করা আছে। আমরা চলে যাব।
রিজার্ভেশন করা থাকলে সেটা ক্যানসেল করে দিন। আজ আপনাদের কোনও অবস্থাতেই যাওয়া হবে না।
সে কী! তা হলে আমরা থাকব কোথায়? খাব কী? টাকা-পয়সা যা এনেছিলাম তার সবই তো শেষ।
বেশ তো, আপনার যদি এইরকম অবস্থা হয়ে থাকে তা হলে চলে যান আপনারা। ছেলেটাকে রেখে যান পুলিশের হেফাজতে।
বাবা-মা দু’জনেই অফিসারের হাতদুটি জড়িয়ে ধরে বললেন, প্লিজ, আপনি আমাদের এর থেকে অব্যাহতি দিন।
সম্ভব নয়। কারণ ছেলের জবানবন্দির ওপর আমাদের তদন্তের অনেক কিছু নির্ভর করছে। ইতিমধ্যে আমরা এই সমস্ত অঞ্চল তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনওরকম সন্দেহজনক কিছু পাইনি। এর পরেও আজ ভোরে প্রকাশ্য রাজপথ থেকে একটি কিশোরী উধাও গেল। একজনকে হত্যার চেষ্টা করা হল। কিন্তু কেন? কী উদ্দেশে? এটা একটা পর্যটন কেন্দ্র। লক্ষ লক্ষ নরনারী এখানে আসেন অবসর বিনোদনে। অপরাধ সব সময় সর্বত্র ঘটতে পারে। কিন্তু তাকে দমন করবার জন্যই তো আমরা। আপনারা যাদের শিকার, আপনাদের কাছ থেকে তাদের কথা যদি কিছুমাত্র জানতে না পারি তা হলে ধরব কাদের? আর অপরাধী যদি ধরা না পড়ে, তা হলে তো এইভাবে রোজই এক-একজন করে উধাও হতে থাকবে। চুরি ছিনতাই খুন রাহাজানি ঘটতে থাকবে দিনের পর দিন।
পার্থর বাবা-মা তখন পার্থকে বললেন, ঠিক করে বল, কী থেকে কী হল। কোনও ভয় নেই তোর। তুই সত্যি কথা না বললে হয়তো তোকে এখানে রেখে দিয়েই চলে যেতে হবে আমাদের। না হলে এঁরা তোকে ছাড়বেন না।
পার্থ জড়িয়ে ধরল ওর মাকে, আমি কিচ্ছু জানি না মা, সত্যি বলছি আমার পক্ষে কোনও কিছুই বলা সম্ভব নয়।
পুলিশ অফিসার গর্জে উঠলেন, তার মানে তুমি সব জান। এবার বলো তো বাছাধন কাদের পাল্লায় তুমি পড়েছিলে?
পার্থ বলল, আমি যখন সমুদ্রের ধারে অল্প অল্প ফেনার ওপর দিয়ে ছুটোছুটি করছিলাম তখন হঠাৎই একটা বড় ঢেউ এসে পড়ায় আরও অনেকের সঙ্গে আমি মুখ থুবড়ে পড়ে যাই। আর ঠিক তখনই মনে হল কে যেন আমার গলা টিপে আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে। আমার ঘাড়ে গলায় নখের দাগ বসিয়ে দিচ্ছে। তারপর?
আমি দু’হাত দিয়ে তার গলাটা ছাড়াবার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ দেখি আমার চুলের মুঠি ধরে টানছে কে। আমি ক্রমশ গভীর সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চললাম। কয়েক ঢোক জলও ঘিটে ফেলেছি তখন। তারপরই জীবনের আশা আর নেই দেখে ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছি।
কিন্তু তুমি ওখান থেকে অতদূরে গেলে কী করে?
একসময় আমার মনে হল আমাকে যেন একটা জেলে ডিঙিতে উঠিয়ে নিয়ে এল কেউ।
পুলিশ অফিসার বললেন, তার মানে-জ্ঞান হারিয়েও তুমি মনে করতে পারলে তোমাকে কেউ জেলে ডিঙিতে উঠিয়ে নিল। এরপরে অজ্ঞান অবস্থায় থেকে আর কী মনে করতে পারলে শুনি?
আর কিছু মনে করতে পারছি না।
এইবার পুলিশ অফিসার একটু নরম সুরে বললেন, শোনো পার্থ। আমাদের মনে হচ্ছে তুমি ইচ্ছে করেই কিছু গোপন করছ। ভয় কী তোমার? তোমার শত্রুদের যদি আমরা ধরি তাতে কি তুমি খুশি হবে না? তোমাকে নিয়ে যা হচ্ছিল তাতে তোমার জীবন চলে যাচ্ছিল। আমরা কথা দিলাম, তাদের সবাইকে আমরা ধরব, আর কঠিন শাস্তি দেব।
পার্থ বলল, না। আমি আর কোনও কিছু লুকব না। সব বলব আপনাদের। সবাই উদ্গ্রীব হয়ে শুনতে লাগলেন পার্থর কথা !
পার্থ বলল, সেদিন জলে আমি নিজের থেকে পড়ে যাইনি। খুব বড় ঢেউটা যখন আসে ঠিক তখনই হুড়মুড়িয়ে অনেকে পড়ে গেলেও, আমার মনে হল কে যেন আমাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিল। তারপর হঠাৎই মনে হল কেউ আমাকে ঢেউয়ের তালে তালে উঠিয়ে নামিয়ে দূরে কোথাও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি চেঁচাতে গিয়েও পারলাম না। ঢক ঢক করে খানিকটা লোনা জল খেয়ে ফেললাম। এরপর লোকটা আমাকে টেনেহিঁচড়ে একটা জেলেডিঙিতে উঠিয়ে নিল। লোকটা সাধারণ লোক নয়, নুলিয়াও নয়। মাঝি বা জেলে বলেই মনে হল। ডিঙিতে উঠিয়ে আমার ঘাড়-গলা টিপে ধরে রইল, আর নৌকোটা চলে গেল মাঝসমুদ্রে। অনেক পরে নৌকো যখন ডাঙায় ফিরে এল তখন আমি ক্লান্ত, অবসন্ন। আমাকে নিষ্ঠুরভাবে টেনেহিঁচড়ে ওরা একটা নদীর মোহানার কাছে নিয়ে এল। কী নির্জন সেই জায়গাটা। সেখানে চারজন লোক বসে বসে জটলা করছিল। আমাকে তাদের সামনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল ওরা। তারপর কিছু টাকা নিয়ে চলে গেল। লোকগুলো নেশাগ্রস্ত ছিল। ওদেরই একজন আমার গলা টিপে মারতে এল সেখানেই। আর একজন বলল, এখনই মারিস না একে। দুধের বাচ্চা। ক্ষীর-ননী খেয়ে মানুষ। পারাদ্বীপের কাছে কোথাও নিয়ে গিয়ে রেখে আসি চল। তারপর ঠিকমতো তালিম দেওয়া যাবে। বাবা পুলিশ অফিসার। ছেলে হোক পকেটমার। মাঝে মধ্যে ছেলেকে দিয়ে একটা করে চিঠি লিখিয়ে ওর বাবার কাছে পাঠিয়ে দেব। আর একজন বলল, অত ঝক্কি ঝামেলা পোহাবে কে? ছেলেকে মেরেই বাপের প্রতিশোধ নিতে হয়। মার, মেরে ফেল শয়তানের বাচ্চাকে। লোকটা এমনভাবে আমার গলা টিপে ধরল যে আর একটু হলেই আমি মরে যেতাম। এমন সময় হঠাৎ একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর বলে উঠল, এই এই, করছিস কী? কাকে মারছিস? রং টার্গেট। এ তো সে নয়। এ যে পার্থ।
পুলিশ অফিসার সবিস্ময়ে বললেন, স্ট্রেঞ্জ! লোকটা তোমার নাম বলল ! তার মানে তোমাকে চেনে?
হ্যাঁ। বলল, অপদার্থ শ্যামাটা করেছে কী! কাকে ধরে এনেছে! এ যে পার্থ, আমার—।
পুলিশ অফিসার বললেন, চুপ করলে কেন? বলো? বলো কে সে? বলে ফেলো?
আমার মেজমামা সন্দীপ।
ঘরের মধ্যে বোমা ফাটলেও বুঝি এতটা চমকাত না কেউ।
পার্থর বাবা বললেন, সন্দীপ! সে এখানে কী করে এল? তুই ভুল দেখিসনি তো বাবা? আজ পাঁচ বছর ধরে পুলিশ তাকে খুঁজছে। সদর স্ট্রিট এলাকার একটি ব্যাঙ্ক-ডাকাতির কেসে সে ফেরার। তোর দিদা ওই ছেলের জন্য আত্মঘাতী হল। পুলিশ অফিসার বললেন, তারপর কী হল?
ওরা বলল, তোর ভাগনা! তা হলে তো আরও বিপদ। এ যদি তোর কথা বলে দেয়, তা হলে সবাই আমরা ধরা পড়ে যাব। একে কোনওমতেই বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। ওকে মরতে দে সন্দীপ। মামা বললেন, না। প্রাণ থাকতেও একাজ আমি করতে দেব না। আমি কথা দিচ্ছি ও আমাদের কথা কাউকে বলবে না। আমিও কথা দিলাম, সত্যি বলছি, আমার মা-বাবা ভাই-বোনেদের সবাইকার দিব্যি, আমি প্রাণ থাকতে একথা কাউকে বলব না, দয়া করে আমাকে মেরো না তোমরা। ওরা তবুও বলল, শত্রুর শেষ রাখতে নেই রে। আমাদের মনেও মায়ামমতা থাকতে নেই। আমরা শ্মশানের কুকুর। মড়ার মাংস ছিঁড়ে খাওয়াই আমাদের পেশা। বলেই আমার গলায় এত জোরে চাপ দিল যে আমাতে আর আমি নেই তখন। একজন আমাকে মৃত ভেবে ছুড়ে নদীর খাড়িতে ফেলে দিল।
আমার মামা তখন বজ্রমুষ্ঠিতে চেপে ধরেছে তাদের একজনের গলা। কিন্তু ধরলে কী হবে। ওরা তিনজন, মামা একা। পারবে কেন ওদের সঙ্গে? তারপর কী হল?
ওরা আমার চোখের সামনেই মামাকে খুন করে ওইখানেই পুতে ফেলল। তারপর চলে যাবার সময় বলে গেল, যদি ছেলেটা বেঁচে থাকে আর পুলিশের কানে তোলে এইসব কথা তা হলে যে যেখানে আছে ওর, সব ক’টারই এই হাল করব। এই দৃশ্য দেখার পর সেই যে আমি জ্ঞান হারালাম তারপরে আমাকে উদ্ধার করল সব্যসাচী। ওর ঋণ আমি কখনও শোধ করতে পারব না।
পার্থর জবানবন্দি শেষ হতেই স্নেহাংশুবাবু এসে উদ্বিগ্ন হয়ে পুলিশ অফিসারকে বললেন, আমার সব্যসাচীও ওদের শিকার হয়েছে স্যার। প্লিজ, একটু কিছু করুন। আমার ওই একটিই মাত্র ছেলে।
স্নেহাংশুবাবুর সঙ্গে বাপিও ছিল।
ওর মুখে সব কথা শুনে পুলিশ সব কিছু লিখেটিখে নিয়ে পার্থকে সঙ্গে করে মোহানার দিকে গেলেন। এক গাড়ি পুলিশ সহ পার্থর বিবরণ যে মিথ্যে নয় তা বোঝাই গেল। শুধু ওর কথা মিথ্যে প্রমাণ করবার জন্য দুষ্কৃতীরা সন্দীপের লাশ শেষরাতেই তুলে নিয়ে গিয়েছিল সেখান থেকে। বালির অবস্থান দেখেই তা বোঝা গেল। কিন্তু কোথায় লুকল ওরা লাশটাকে? বুকে বালির বস্তা বেঁধে গভীর সমুদ্রে ফেলে দিল? কে জানে? আরও রহস্য এই, সে কোন পুলিশ অফিসার? যার ছেলেকে হত্যার জন্য দুষ্কৃতীরা এতবড় একটা ফাঁদ পেতেছিল? কিন্তু এ কথার উত্তর কে দেবে? সমুদ্রে তরঙ্গ আছে। গর্জন আছে। মহা প্রলয়ের দুর্বার শক্তিও আছে তার, কিন্তু সমুদ্রের তো ভাষা নেই। মানুষের পাপপুণ্যের সাক্ষী হতে পারে সে, সাক্ষী দিতে পারে না। বালুচরও তাই। মূকবধির হয়ে তরঙ্গের আঘাত সয়, কাউকে আঘাত করতে পারে না।