ছয়
জয়া এল। লঘু ছন্দে ধীর পায়ে। এখন ওকে দেখে একবারও মনে হল না এই মেয়েটা সেই দস্যি-দামাল বা রণচণ্ডী মেয়ে বলে। কত শান্ত এবং ধীর। ওর চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। জানার আগ্রহ।
ও আসতেই সব্যসাচী বলল, চলো, ছাদে চলো। অনেক কথা আছে। ওরা পা টিপে টিপে ওপরে উঠল।
সিঁড়ির দরজায় শিকলটা তুলে দিয়ে সব্যসাচী বলল, শুনেছ তো? শুনেছি। তবু তোমার মুখেও শুনতে চাই। কী ব্যাপার বলো? সব্যসাচী এক এক করে সব কথা খুলে বলল জয়াকে।
জয়া চোখদুটো কপালে উঠিয়ে বলল, মেয়েটাকে ওরা নিয়ে গেল অথচ তুমি দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে দেখলে একটুও বাধা দিতে পারলে না?
সেই পরিস্থিতি ছিল না। তা ছাড়া আমি তখন চেঁচিয়ে লোকজন জড়ো করার চেষ্টা করছিলাম।
তোমার সামনে থেকে আমাকেও যদি কেউ ওইভাবে তুলে নিয়ে যেত, তুমি তা হলে চেয়ে চেয়ে দেখতে?
না। মেরে মুখ ফাটিয়ে দিতাম। অবশ্য তার আগেই যদি ওরা আমাকে কবজা করতে না পারে।
এখন তা হলে কী করবে ঠিক করেছ?
কিছু ভেবে পাচ্ছি না। তার কারণ আমার মা আর একমুহূর্ত থাকতে চাইছেন না এখানে। হয়তো আজই চলে যাব আমরা।
জয়া হতাশ হয়ে বলল, সে কী!
অথচ এই ঘটনার প্রত্যক্ষ্যদর্শী হিসেবে এখন আমার এখানে থাকাটা খুবই দরকার।
তার চেয়েও যেটা বেশি দরকার সেটার কথা তো বললে না?
লিপিকে উদ্ধার করা। এই তো?
নিশ্চয়ই। তুমি যখন বলছ লিপিকে নিয়ে দুষ্কৃতীদের গাড়িটা মোহানার দিকে গেছে তখন মনে হয় সেই ঝাউবনেই ওকে ওরা নিয়ে গিয়ে রাখবে। কালকের সেই লোক দু’জন, নিশ্চয়ই এদেরই দুষ্টচক্রের লোক।
ঠিক বলেছ তুমি। তবে জয়া, আমার যেন কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে! আমার মনের মধ্যে নিম্নচাপ উঠেছে একটা। কাল থেকে আজ পর্যন্ত যা যা ঘটে গেল তাতে কোনও ঘটনার সঙ্গেই কোনওটাকে আমি সাজিয়ে উঠতে পারছি না। ওই ছেলেটির উবে যাওয়া, হঠাৎ করে তাকে মোহানার কাছে আবিষ্কার করা, সবই যেমন রহস্যময়, তেমনি রহস্যময় তাকে হত্যার চেষ্টা করেও হত্যা না করা। আজকের ভোরে বিজুদার ওপর আক্রমণ, লিপিহরণ, তার চেয়েও বেশি রহস্যময় যেটা, সেটা হল বিজুদা একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট কিন্তু ওই নোংরা জঘন্য স্বভাবের দুষ্কৃতীদের তিনি চিনলেন কী করে? কথাবার্তা শুনে মনে হল যেন কতদিনের পরিচিত। তা ছাড়া এইসব ক্রাইমের ব্যাপারেও তাঁর কৌতূহল খুব। আমার কাছ থেকে কুরে কুরে অনেক কথাই জানতে চাইছিলেন। এমনকী একটু বেলায় কালকের ওই ঘটনাস্থলে যেতেও চাইছিলেন তিনি। বলো কী !
এবার বলো তো, বিজুদার সম্বন্ধে আমি কোন ধারণাটা করব?
তা হলে শোনো, তোমার ওই বিজুদা লোকটিও কিন্তু খুব একটা সুবিধের নয়। চাপদাড়ির আড়ালে ওর চেহারাটা দেখেছ? দেখলেই একটা রগচটা গুন্ডা বলে মনে হয়।
তা হয়। কিন্তু…।
কোনও কিন্তু নেই এর মধ্যে। তিনি তোমাকে মিথ্যে পরিচয় দিয়েছেন। তা ছাড়া এমন কী জিনিস ওনার কাছে থাকতে পারে, যেটার জন্য ওরা হন্যে হয়ে পুরী পর্যন্ত এসেছে? নিশ্চয়ই কোনও স্মাগলিং-এর ব্যাপারে জড়িত আছেন উমি।
জিনিসটা যে কী তা কিন্তু আমিও দেখিনি। সেটা আমার কাছেই আছে। বার করো তো, দেখি। তা হলেই বুঝব ব্যাপারটা কী।
সব্যসাচী ওর প্যান্টের পকেট থেকে যে জিনিসটা বার করল তা দেখে অবাক হয়ে গেল দু’জনেই। কী আশ্চর্য! এর জন্যে এত?
সব্যসাচী জিনিসটা জয়ার হাতে দিল।
জয়া সেটা অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। তারপর সব্যসাচীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু বুঝতে পারলে?
না।
আমার মনে হয় এইটাই হচ্ছে ওই দুষ্কৃতীদের তুরুপের তাস।
কিন্তু এর তো কোনও আর্থিক মূল্যই নেই।
তা হয়তো নেই। তবু ওটা খুব যত্নে রাখো তোমার কাছে। জিনিসটার মূল্য তোমার আমার কাছে না থাকলেও ওদের কাছে আছে। তাই তো বিজুদা ওটা সুকৌশলে পাচার করেছেন তোমার হাতে।
এমন সময় ছাদের দরজায় ঠক ঠক শব্দ।
সব্যসাচী দরজা খুলে দিতেই সরমা উঠে এলেন ছাদে। তারপর জয়াকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, ওমা! তুমি কখন এলে?
এই একটু আগে এসেছি মাসিমা।
ছাদের দরজায় শিকল দিয়ে কী করছিলে তোমরা?
সব্যসাচী বলল, কিছু না। কালকের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। দরজাটা হাওয়া লেগে বার বার খুলে যাচ্ছিল তাই—।
যাকগে। নীচে এসে যদি কিছু খেতে চাস তো খেয়ে নে। পাণ্ডা ঠাকুর এসেছেন। তোর বাবা ফিরে এলেই মন্দিরে যাব একবার। তারপর আর এখানে নয়।
জয়া ও সব্যসাচী মুখ চাওয়া-চায়ি করল। তারপর দু’জনেই নেমে এল দোতলায়।
পাণ্ডা লিঙ্গরাজ মিশ্র বারান্দার বেঞ্চিতে চুপচাপ বসেছিলেন।
ওপাশের এক নম্বর ঘরের যাত্রীরা এত কাণ্ডর পর আজ মন্দিরে যাবেন কি যাবেন না ভেবে পা ঘষতে লাগলেন। কেন না পাশাপাশি দুটি ঘরের বাসিন্দাদের নিয়ে যা হয়ে গেল, তারপরে কোথাও আর যাবার ইচ্ছে নেই। বিশেষ করে লিপির ব্যাপারটায় বিচলিত সবাই।
সরমা মিশ্রজিকে চা করে দিলেন।
সব্যসাচী ও জয়াকেও খেতে দিলেন হালুয়া, টোস্ট।
মিশ্রজি বললেন, আপনারা কি সত্যিই চলে যাবেন মা?
হ্যাঁ বাবা। মাস ছয়েক বাদে যাত্রা পরিবর্তন করে আবার আসব।
কিন্তু পুরীতে এসে জগবন্ধুকে দর্শন না করে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? কখনওই না। সত্যিকারের মহাপাতক না হলে এমন দুর্মতিও হয় না কারও। তবু যাবেন?
হ্যাঁ। মন আমার এখানে আর একদম মানছে না।
মিশ্রজি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মন যদি না চায় তা হলে অবশ্য থাকার কথা বলব না। কিন্তু কী করে যাবেন তাই ভাবছি। রিজার্ভেশন তো পাবেন না। অথচ এমনি সাধারণ বগিতে বসে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারি না।
কেন, নীলাচলে যাই যদি?
তা হলে তো আজ নয়, কাল যেতে হবে। নীলাচল তো এখনই ছাড়বার সময় হয়ে গেছে। আর একটা গাড়ি অবশ্য আছে, ধৌলি এক্সপ্রেস। ভুবনেশ্বর থেকে দুপুর দুটোয় ছাড়ে। সেটায় গেলে আজই রাত্রি দশটার মধ্যে হাওড়ায় পৌঁছতে পারবেন। কিন্তু সে গাড়িতে গেলেও এখুনি বেরিয়ে পড়তে হয়।
সরমা বললেন, দেখি ওর বাবা আসুক, কী বলেন। কোথায় গেছেন উনি?
থানায়। সেখান থেকে হাসপাতালে।
মিশ্রজি বললেন, দেখুন, আমরা এতদিন এখানে বাস করছি কিন্তু এই ধরনের উপদ্রব কখনও দেখিনি। শুনিওনি কখনও। আপনাদের নিয়ে যা কিছু হচ্ছে সবই কিন্তু বাইরের লোকেদের কাজ কারবার। মাঝে মধ্যে এখানেও যে ঝুট ঝামেলা কিছু হয় না তা নয়, সে সব চ্যাংড়া মস্তানদের ব্যাপার। ওরকম সব জায়গাতেই হয়। আবার মিটেও যায়।
দরজার সামনেই সিঁড়ির গায়ে একটি ছোট্ট ঘর আছে। সেই ঘরে থাকে এই বাড়ির মালিকের বড় ছেলে। ডাক নাম বাপি। ভাল নাম অমরনাথ। অত্যন্ত রূপবান সুশ্রী, বিনয়ী যুবক। ওর ছেলেবেলাটা কেটেছিল অন্ধ্রের পুত্তাপতিতে সত্য সাইবাবার আশ্রমে। সে এতক্ষণ সব শুনছিল। এবার এগিয়ে এসে সব্যসাচীকে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটিকে নিয়ে ওরা কোনদিকে গেল বলতে পারবে?
হ্যাঁ। সব্যসাচী বারান্দা থেকেই পথ দেখিয়ে দিল।
মিশ্রজি গুম হয়ে কী যেন চিন্তা করতে লাগলেন।
বাপি বলল, এবার বুঝেছি ওরা কোথায় গেছে।
মিশ্রজি বললেন, ওই ঝাউবনেই ঢুকবে ওরা। না হলে ওই যে পুরনো ভাড়া বাড়িগুলো আছে ওরই যে কোনও একটাতে গিয়ে জুটবে। আমি দশ-বারোটা ছেলেকে সঙ্গে দিচ্ছি। যাও তো একবার দেখো তো গিয়ে কী ব্যাপার।
বাপি বলল, ওইদিকেই যাবে না ওরা। গেলে ওরা লোকনাথের দিকে যাবে। ওখানকার জঙ্গলই ওদের উপযুক্ত পরিবেশ।
তাই যাও। গিয়ে একটা খোঁজখবর নাও।
বাপি বলল, এক মিনিট। আমাকে একবার আসতে দিন। বলেই জামাটা গায়ে দিয়ে নীচে নামল।
সব্যসাচী বলল, আমি আপনার সঙ্গে যাব বাপিদা?
সরমা ছুটে এলেন, খবরদার বলছি। একদম বেরোবি না ঘর থেকে।
মিশ্রজি বললেন, আপনি কেন অযথা ভয় পাচ্ছেন মা? কোনও ভয় নেই। আর কোনও বিপদ হবে না। ওসব যখন হয় তখন আপনা থেকেই হয়। এখন সব জানাজানি হয়ে গেছে। সবাই সতর্ক। থানা-পুলিশ হচ্ছে। ওরা এখন প্যাচার মতো লুকোবে। এখন আমরা ওদের দেখে ভয় পাব না, ওরা ভয় পাবে আমাদের দেখে।
সব্যসাচী তখন একদম নীচে।
জয়াও আর ওপরে না-থেকে পিছু নিল ওর।
বাপি বলল, সাইকেল চাপতে পার?
সব্যসাচী বলল, হ্যাঁ।
জয়া বলল, আমিও পারি।
বাপি বলল, তুমিও যাবে নাকি?
তবে না তো কী? আপনারা দু’জনে যাবেন আর আমি বসে থাকব এখানে? ওটি হচ্ছে না।
বাপি নিজের সাইকেলটা নিয়ে আর একটা সাইকেল জোগাড় করে আনল। সব্যসাচী বলল, না জয়া, তুমি এসো না। আবার যদি নতুন করে কোনও বিপদ এসে হাজির হয় তা হলে কিন্তু যা তা ব্যাপার ঘটে যাবে তোমাকে নিয়ে।
অভিমানিনী জয়া তখন এক কথাতেই চুপ। একবার শুধু ক্রুদ্ধ চোখে সব্যসাচীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বলল, বেশ, তোমরাই যাও। বলে আর কারও দিকে না তাকিয়ে সোজা ওদের হলিডে হোমে ঢুকে গেল।
বাপি বলল, দারুণ রেগেছে মনে হচ্ছে।
সব্যসাচী বলল, এই মেয়ে বড় হলে দিনকে রাত করে দেবে।
ওরা সাইকেল নিয়ে ওদের হলিডে হোমের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা ডানদিকে সোজা চলে গেছে, সেই পথে খানিক গিয়েই বাঁদিকে বাঁক নিল। তারপর আবার ডানদিকে বেঁকে কিছু পথ যেতেই কী সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখতে পেল ওরা। কত যে ছোট ছোট ঘরবাড়ি হয়েছে সেখানে, তার যেন শেষ নেই।
বাপি বলল, তোমার বাবাকে বলো না এইখানে একটা বাড়ি কিনতে। এক-দু’কাঠা জায়গার মধ্যে কী সুন্দর সব বাড়ি দেখেছ?
সব্যসাচী বলল, ভারী মনোরম! তবে কিনা আমরা বছরে একবার কি দু’বার হয়তো আসব। তার জন্যে স্টেটের বাইরে একটা প্রপার্টি রাখার কোনও যুক্তি আছে কি?
ওরে ব্বাবা। তুমি এইটুকু ছেলে অথচ তোমার খুব বৈষয়িক জ্ঞান রয়েছে দেখছি।
যেতে যেতেই হঠাৎ এক জায়গায় ব্রেক কষল বাপি।
সব্যসাচী বলল, কী হল?
ওই যে দেখছ ডানদিকের পথটা মাঠের দিকে নেমে গিয়ে ঘন সবুজের মধ্যে মিশে গেছে, ওই পথেই লোকনাথ। এখন এইখানেই একটু খোঁজখবর নিতে হবে। তবে খুব সাবধান। আমি যাকে যা জিজ্ঞেস করবার করব। তুমি কিন্তু কারও কথার কোনও উত্তর দেবে না। কেমন?
সব্যসাচী বলল, ঠিক আছে।
বাপি বলল, চলো, ওই দোকানটায় গিয়ে একটু চা খাওয়া যাক। কিছু খবরাখবর ওইখান থেকেই পাব।
ওরা সাইকেল থেকে নেমে একটা চায়ের দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। মাটির ঘর। পাতার ছাউনি। জায়গাটা নিরিবিলি বলে খদ্দেরও কম। তাই ভিড় নেই।
ওরা সাইকেল রেখে দোকানে ঢুকেই সর্বাগ্রে প্লাস্টিকের ওয়াটার পটে রাখা জল নিয়ে ঢক ঢক করে খেল। তারপর বাপি বলল, তোর সেই ছেলেটাকে দেখছি না কেন রে বুলবুল?
চা-ওয়ালার নাম বুলবুল। বলল, আর বলিস না ভাই। সেই যে দু’দিনের ছুটি নিয়ে গেল আর এল না।
অসুখবিসুখ করেনি তো?
কে জানে? তবে শুনেছি ওর বাবার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।
বাপি বলল, তোর এখানে খাবার কী আছে? পিঁয়াজিটিয়াজি হবে কিছু? লঙ্কার বড়া?
গরম চপ হবে। দেব?
দে। আর দু’কাপ চা।
বুলবুল দুটো করে চপ ওদের দিকে এগিয়ে চা করতে লাগল। চা ছাকতে ছাঁকতেই বলল, এদিকে কোথায় যাবি?
ভাবছি একবার লোকনাথে গেলে কেমন হয়? ভাগনাটা এসেছে কাল, তাই ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি।
আর একটু সকালে আসতে পারতিস।
সকালবেলা ওদিকে একটু ঝামেলা হয়ে গেল।
ওঃ হো। শুনেছি কাদের নাকি একটা মেয়ে চুরি হয়েছে।
কার মুখে শুনলি?
এই তো একটু আগে কে যেন বলল, ভোরে আমি যখন সবে উনুনে আঁচ দিচ্ছি, তখন হঠাৎ দেখি একটা লাল রঙের মারুতি এইদিক দিয়ে ছুটে গেল। একটা অল্পবয়সি মেয়েকে সবাই মিলে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। তা আমি ভাবলাম বোধহয় কোনও ট্যুরিস্টের মেয়ে। অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাই হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। তারপরই শুনি এই কাণ্ড। এমন ব্যাপার জানলে তো বাধা দিতাম। তবে মুখে বলছি বটে, কাজে হয়তো পারতাম না। যা জোরে এল ওরা, কিছু ভাবনা চিন্তা করবার আগেই উধাও হয়ে গেল।
বাপি বলল, তা হলে ঠিকই দেখেছ তুমি।
তার আধ ঘণ্টা পরেই এল একটা পুলিশের গাড়ি। ওরা খোঁজখবর নিলে আমি কিন্তু ঝামেলার ভয়ে বলেই দিলাম কিছু দেখিনি।
কী ভুল করলে বলো তো?
কী করি ভাই, কথায় বলে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ধরলে অগুণতি। তা ছাড়া সত্যিকথা বলতে কী, কোলাব্যাঙ আর পুলিশ এই দুটোকেই আমি ভয় পাই। একবার হল কী আমার দিদিশাউড়ির একটা—
বাপি চপে কামড় দিয়েই বলল, বাঃ। বেড়ে হয়েছে তো? দেব নাকি আর একটা?
দাও দাও।
সব্যসাচী বলল, আমাকে নয়, আমার এতেই হবে।
চপ খেয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে ওরা দোকানের বাইরে এসে দূরের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে রইল।
বুলবুল বলল, যাবে তো যাও। সাইকেল যখন আছে, তখন বেশি সময় লাগবে
না। কত লোক পুরী আসে, কিন্তু জানে না বলে অনেকেই লোকনাথ না দেখে ফিরে যায়। তোমরা যাও, দর্শন করো। প্রার্থনা করো বাবার কাছে। বাবা সকলের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন।
সব্যসাচী চাপা গলায় বাপিকে বলল, তা হলে যাওয়া যাক চলো।
গিয়ে আমরা কী করব?
একটু খুঁজেপেতে দেখব কোথাও যদি কোনও হদিস পাওয়া যায় ওর।
আমি বলি কী, আমরা বরং কিছু লোকজন নিয়েই ওদিকে যাই। মিশ্রজি তো কয়েকজনকে সঙ্গে দেবেন বলেছেন। দলবল দেখলে ওরাও ঘাবড়ে যাবে খুব। আমাদেরও সুবিধে হবে।
সব্যসাচী বলল, লোকজন দেখলে ওরা যদি সতর্ক হয়ে যায়? তার চেয়ে চলো যেমন আমরা যাচ্ছি তেমনি দু’জনেই যাই।
বাপি কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বলল, এসো তা হলে। তোমার কথাই থাক!
ওরা সেই অনবদ্য প্রাকৃতিক পরিবেশের ভেতর দিয়ে দ্রুত সাইকেল চালিয়ে লোকনাথের দিকে চলল। আজ বে-বার। তাই যাত্রী সংখ্যা অনেক কম। নেই বললেই হয়। যাই হোক, ওরা একসময় প্রশস্ত রাজপথে এসে পড়ল। এখানটাও নির্জন। বাপি বলল, এই পথটা জগন্নাথের মন্দিরে গিয়ে মিশেছে। অনেকে মন্দিরের কাছ থেকেও রিকশায় চেপে এখানে আসে।
ওরা সেই রাজপথ ধরে বাঁদিকে খানিকটা যেতেই দেখতে পেল, পথটা সেখানে দু’ভাগ হয়ে গেছে। বাঁদিকের পথ গেছে লোকনাথে। ডানদিকেরটা ল্যাংটা বাবার আশ্রমে। মস্ত সাধক তিনি। এখন দেহাবসান হয়েছে। নির্জন জায়গায় ছোট্ট একটি টিলা পাহাড়ে তাঁর আশ্রম। চমৎকার পরিবেশ।
বাপি সব্যসাচীকে বলল, চলো, আগে আমরা লোকনাথে যাই। সেখানে কোনও খোঁজখবর না-পেলে তারপর ল্যাংটা বাবার আশ্রমে যাব। যা আপনি বলবেন।
ওরা দ্রুত সাইকেল চালিয়ে লোকনাথের পথ ধরল। খানিক যাবার পরই দেখতে পেল একদল ভিখারি পথের দু’ধারে সারিবদ্ধ ভাবে হাত পেতে বসে আছে।
সামনেই একটি মন্দির দেখা যাচ্ছে। লোকনাথ মহাদেবের মন্দির। দর্শনার্থী নেই বললেই হয়। একদম ফাঁকা।
ওদের দেখে দু’–একজন পাণ্ডা কোমড় বেঁধে এগিয়ে এলেও, বাপিকে চিনতে পেরে পিছিয়ে গেল।
একপাশে সাইকেল আর জুতো রেখে বাপি বলল, মন্দিরে যখন এসেছি আর তুমিও প্রথম এলে তখন দর্শন না করে ফিরে যাওয়া নয়। আগে মন্দিরের কাজটা সেরে নিই, তারপর শুরু হোক খোঁজখবর নেওয়া।
ওরা মন্দিরের প্রাঙ্গণে এসে পাশের কুণ্ডে হাত-পা ধুয়ে সামান্য একটু পূজার ডালি নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করল। কী অপূর্ব রম্যস্থান। মন্দিরে প্রবেশ মাত্রই ভক্তিতে যেন দেহমন আপ্লুত হয়ে ওঠে। শুধু কী বাবা লোকনাথ? কত দেবতাই তো রয়েছে এখানে।
হঠাৎ একদল যাত্রী কোথা থেকে এসে ফাঁকা জায়গাটা ভরিয়ে দিল। সেই যাত্রীদের মধ্যে এমনই একজন ছিল যাকে দেখে বিস্ময়ের অন্ত রইল না সব্যসাচীর।
নাটমন্দিরে যে বিশাল পেতলের ঘণ্টাটা ছিল, সেটার চেন ধরে টেনে টেনে বাজিয়েই চলেছে সে। তার দুটো চোখেই যেন আগুন। আগুন শুধু চোখে কেন? মনে হল সে নিজেই যেন স্ফুলিঙ্গ একটি।
বিস্মিত সব্যসাচী বলল, এ কী জয়া! তুমি এখানে? তুমি কী করে এলে?
জয়া সে কথার কোনও উত্তরই না দিয়ে হাতের ফুলমালাটা নিয়ে ঢুকে গেল মন্দিরের ভেতরে। শুধু যে গেল তা নয়, সব্যসাচীর দিকে ফিরেও তাকাল না একবার।
সব্যসাচী তখন ওর মান ভাঙাতে না গিয়ে খুঁজতে লাগল বাপিকে। বাপিদা! বাপিদা!
বাপি মন্দিরের বাইরের কলে একটু প্রসাদ মুখে দিয়ে জল খাচ্ছিল। বলল, কী হল! ভয় পেল নাকি? আসলে ভিড় দেখে আমি বেরিয়ে এলাম।
সে বেশ করেছ। কিন্তু কে যে এক কাণ্ড হয়েছে।
কী হয়েছে?
সেই মা চণ্ডী এসে হাজির হয়েছেন এখানে। ভীষণ রেগেছে।
কে! কার কথা বলছ তুমি?
জয়া। জয়া এসেছে।
জয়া এসেছে! কোথায় সে?
মন্দিরের ভেতরে। তুমি যাও বাপিদা, ওর মান ভাঙাও। আমাকে দেখলেই ফেটে পড়বে ও।
বাপি কোনওদিকে না তাকিয়ে সোজা ঢুকে গেল মন্দিরের ভেতরে। তারপর একসময় রাগি মেয়েটার হাত ধরে টানতে টানতে যখন বেরিয়ে এল, সব্যসাচীর পাত্তা নেই। কোথায় গেল ছেলেটা!
ওরা মন্দিরের বাইরে এল। কুণ্ডের পাশের সিঁড়ি বেয়ে চত্বরের বাইরে যেখানে ওদের জুতো, সাইকেল রাখা ছিল, সেখানেও এল। কিন্তু না, সব্যসাচীর পাত্তা নেই। বাপি-জয়া দু’জনেই চেঁচিয়ে ডাকল, স-ব্য-সা-চী-ই। তুমি যেখানেই লুকিয়ে থাক চলে এসো।
কিন্তু আসবে কে?
ঘণ্টা কাবার হল। মন্দির দর্শনার্থী শূন্য হল। শুধুমাত্র ওরা দু’জন আর দু’-চারজন পাণ্ডা ছাড়া কেউ কোথাও নেই। চোখের পলকে যেন ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেল ছেলেটা।
ওদের দু’জনেরই চোখেমুখে আতঙ্ক একটা ঘনিয়ে এল।