পাঁচ
সে রাত্রে বাবা-মায়ের কোলের কাছে শুয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোলেও ভোরবেলা সাগর যাত্রীদের কলরবে ঘুমটা ভেঙে গেল। সব্যসাচী ধীরে ধীরে শয্যা ত্যাগ করে বাইরে বারান্দায় আসতেই দেখল কত লোক চলেছে দলে দলে।
বারান্দায় আলো জ্বলছে।
ওদের পাশের ঘরেই সেই চাপদাড়ি যুবক, তাঁর ভাইঝিকে নিয়ে সূর্যোদয় দেখতে যাবেন বলে বেরোচ্ছেন। সব্যসাচীকে এইভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, আরে! কী ব্যাপার! গুড বয় যে! এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ? যাবে তো চলো।
সব্যসাচী বলল, বাবা-মা দু’জনেই ঘুমোচ্ছেন।
তুমি তো ঘুমিয়ে নেই।
সব্যসাচী যুবকের মুখের দিকে তাকিয়ে এক মিনিট। বলেই ঘরে গিয়ে সোয়েটারটা গায়ে দিয়ে, গলায় মাফলার জড়িয়ে মাকে ডাকল, মা।
সরমা বিস্মিত হয়ে বললেন, কী হল?
আমি সমুদ্রে যাচ্ছি।
না। সাহস তো কম নয়! আমাদের সঙ্গে ছাড়া কোখাও যাবে না তুমি। আমি একা একা যাচ্ছি না। পাশের ঘরের দাদাও যাচ্ছেন, ওনার সঙ্গেই যাচ্ছি। , যাচ্ছ যাও। বেশি দেরি করবে
স্নেহাংশুবাবু পাশ ফিরে শুতে গিয়ে বললেন না কিন্তু। আর জলে নামবে না একদম।
সব্যসাচী জুতোটা পায়ে দিয়েই বেরিয়ে এল।
সরমাও এলেন।
যুবক হাসিমুখে বললেন, ভয় নেই। আপনার ছেলে আমার সঙ্গেই যাচ্ছে। ভাইঝি আছে সঙ্গে। রোদ উঠলেই ফিরে আসব আমরা।
সরমা বললেন, আসলে দস্যি ছেলে তো। তাই কোথাও যেতে চাইলে ভয় করে। তবে আপনি যখন আছেন…।
আমার ভাইঝি লিপিও আছে।
পিঠের ওপর লম্বা বেণী দোলানো কিশোরী লিপি মিষ্টি করে হাসল সরমার দিকে চেয়ে।
সরমাও হেসে বললেন, সাবধানে যেয়ো।
ওরা তিনজনে নীচে নেমে এল।
একদল গোরু তখন টুং টাং করে গলার ঘণ্টি নেড়ে চরতে যাচ্ছে। গোরুগুলো চলে গেলে ওরা ধীর পায়ে এগোতে লাগল।
ওরা স্বর্গদ্বারের পথ না ধরে হলিডে হোমের সামনের পথ ধরেই চলল। একেবারে নবনির্মিত রাজপথের ওপর এসে দাঁড়াল তিনজনে।
ডানদিকের পথটা চলে গেছে সেই পাখাগুলো ছাড়িয়ে মোহানার দিকে। বাঁদিকের পথ স্বর্গদ্বারে। সামনে সমুদ্র।
এতক্ষণ তিনজনেই চুপচাপ ছিল। এবার তিনজনেই সরব হল। যুবক বললেন, তুমি তো সাংঘাতিক ছেলে হে?
সব্যসাচী বলল, কেন?
আবার জিজ্ঞেস করছ কেন? কী কীর্তিটা করলে বাবা কাল? কী করেছি? কিছুই না।
কাল সকালে তোমার সঙ্গে কথাই বলেই বুঝেছি তুমি সাধারণ ছেলে নও। তা হলে কি অসাধারণ ?
লিপি বলল, শুধু তাই নয়, অসামান্য। তুমি তো এখন হিরো। সব্যসাচী হেসে লিপির দিকে তাকিয়ে বলল, বলো কী!
ছিপছিপে পাতলা চেহারার শ্যামাঙ্গী কিশোরী বলল, কাল সারাটা দুপুর আর বিকেল আমরা তোমাদের কথাই আলোচনা করছিলাম। তোমার সঙ্গে ওই যে মেয়েটি ছিল, কী যেন নাম?
জয়া।
ভারী মিষ্টি মেয়েটি।
তোমার সঙ্গে আলাপ আছে?
না। দেখেছি এইমাত্র।
আজই আলাপ করিয়ে দেব।
কথা বলতে বলতেই ওরা স্বর্গদ্বারের দিকে এগোতে থাকল। স্বর্গদ্বার এই সময়ে বেশ জমজমাটি হয়। অবশ্য এই সময় বললে ভুল হবে। সর্বক্ষণ। আসলে ওই জায়গাটার আকর্ষণই আলাদা।
খানিক গিয়ে এক জায়গায় থমকে দাঁড়াল ওরা।
চায় কফি বাবু।
ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। সামনের বেঞ্চিতে এক নববিবাহিত তরুণ-তরুণী বসে আছে।
চা-ওয়ালা ওদের দেখতে পেয়েই বলল, চায় কফি—।
যুবক বললেন, চা না কফি, কোনটা?
লিপি বলল, আমরা কী বলব?
যা হোক বলো।
সব্যসাচী বলল, কফি।
যুবক বললেন, ঠিক বলেছ। কফির গন্ধ ছাড়া সি-বিচে বসে এইসব দোকানের চা খেলেই বমি উঠে আসবে।
লিপি নাক সিঁটকে বলল, ছোটকা !
যুবক হেসে আর একটি বেঞ্চি টেনে নিয়ে লিপি ও সব্যসাচীকে দু’পাশে বসিয়ে নিজে মাঝখানে বসলেন।
চা-ওয়ালা কফি করতে লাগল।
আকাশ তখনও অনন্ত নক্ষত্রে ভরা।
সমুদ্রের নীল জল অবিরাম ঢেউ নিয়ে তোলপাড় করছে। মাঝে মাঝে এক ঝাঁক মানুষ, কখনও বা দু’-একজন, লঘু পায়ে চলে যাচ্ছে সামনে দিয়ে।
যুবক দূরের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একসময় বললেন, সব্যসাচী, কাল তুমি যা করেছ তার তুলনা হয় না। তবে একটা কথা, তুমি কী এর মধ্যে অন্য কিছুর গন্ধ পাওনি?
সব্যসাচী বলল, রহস্যের গন্ধ পেয়েছি।
কীরকম একটু শুনতে পারি কি?
এই যেমন ধরুন, ছেলেটিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে দুষ্কৃতীদের কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে তা ভেবে পাচ্ছি না।
আর কিছু?
অত লোকের চোখের সামনে ওরা কীভাবে কিডন্যাপ করল ছেলেটাকে? জলে জলে অতদূর নিয়ে যাওয়াও বড় সহজ কথা নয়, আর বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে নিয়ে গেলেও লক্ষ জনতার ভিড়ে ধরা পড়বার ভয় ছিল। তার চেয়েও বড় কথা, ছেলেটিকে অপহরণ করেও তাকে ওরা ওইভাবে ফেলে রেখে গেল কেন? ওকে ওরা গলা টিপে মারতে গিয়েছিল। কিন্তু সে কাজেও ওরা সফল হয়নি।
তুমি ঠিক জান?
আমি স্বচক্ষে দেখেছি ওর গলার পাশে কালসিটে আর নখের দাগ।
এমনও তো হতে পারে, মারতে গিয়ে মমতার বশে হয়তো না-মেরে ছেলেটাকে মৃত ভেবেই ফেলে রেখে চলে গেছে ওরা।
অসম্ভব। খুন যারা করে আর অপহরণ যাদের পেশা, ওইসব মায়ামমতার ব্যাপার স্যাপারগুলো তাদের ভেতরে থাকেই না। অন্ধকারেই রইল?
ব্যাপারটা তা হলে রহস্যের হয়তো। তবে রহস্য এখানে একটা নয়। আরও আছে।
কীরকম?
যেমন ধরুন…।
সাসপেন্সে রেখ না, বলে ফেলো।
স বা সাচীর গো য়ে দাগিরি
চা-ওয়ালা কফি নিয়ে এল, আপনাদের কফি।
ওরা তিনজনেই কফি নিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কফি খেতে লাগল। খেতে খেতেই সব্যসাচী বলল, আমার মনে হয় ওই জায়গায়, ওই নির্জনতার আড়ালে অপরাধ জগতের কালোছায়াও কিছুটা প্রভাব বিস্তার করেছে।
তার মানে নিশ্চয়ই তুমি আরও এমন কিছু দেখেছ বা অনুভব করেছ যাতেই তোমার এইরকম ধারণা হয়েছে।
ঠিক তাই। অবশ্য এই ব্যাপারে আমি এখনও কিছু স্পষ্ট করে বলতে পারব না, তবে ওই জায়গাটায় পুলিশের একটু নজর রাখা উচিত।
যুবক বললেন, কাল সি-বিচ থেকে ছেলেটি উধাও হবার পর, ওর মা-বাবার সঙ্গে কথা বলে আমি জেনেছি, ওদের কোনও শত্রু ছিল না। ফলে আমিও এটাকে দুর্ঘটনা বলেই মনে করেছিলাম। কিন্তু তুমি যা বলেছ, তাতে তো মনে হচ্ছে এটা একটা সংগঠিত দলের কাজ।
সব্যসাচী বলল, দলের কাজ তো বটেই। না হলে এইরকম দুঃসাহসিক অপহরণ কী করে সম্ভব।
অপহরণে পরের ব্যাপারটাই তো রহস্যময়।
আমার মনে হয় রং টার্গেট !
লিপি এতক্ষণে কথা বলল, রং টার্গেট?
হ্যাঁ, যে কারণে মারতে গিয়েও ওরা মারেনি ছেলেটাকে। যখনই বুঝতে পেরেছে শিকার গ্রহণে গলদ রয়ে গেছে। তখনই ওরা বিদায় নিয়েছে। কিন্তু ওরা কারা? আর ওদের শিকারই বা কে ছিল? সেটা না জানতে পারলে…।
যুবক বললেন, তোমার ভেতরে দেখছি ঝানু গোয়েন্দার বীজ রয়েছে। লিপি হেসে বলল, তুমি তা হলে এই ব্যাপারে একটু গোয়েন্দাগিরি করবে নাকি?
সব্যসাচী হেসে বলল, থাকব ক’দিন তাই জানি না।
যুবক কফি খাওয়া শেষ করে বললেন, একটু
আমাকে ওই জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে?
সব্যসাচী বলল, ওরে বাবা। সে অনেকদূরের পথ।
ভয় নেই। হাঁটতে হবে না। একটা অটো করব।
তা হলে আমি রাজি।
বেলায় রোদ উঠলে তুমি
শুধু তুমি আর আমি যাব। কেমন?
লিপি বলল, ওই দেখো ছোটকা, আকাশটা কেমন লাল হচ্ছে। যুবক বললেন, চলো, স্বর্গদ্বারে যাওয়া যাক। বলে কফির দাম মিটিয়ে এগিয়ে চললেন দু’জনের মাঝখানে।
ওরা ভোরের অস্পষ্টতায় পথ হাঁটতে লাগল।
সব্যসাচী যেতে যেতেই বলল, যদি কিছু মনে না করেন তো বলি, আপনার সঙ্গে এমন পরিচয় হল, অথচ আপনার নামটাই জানা হল না। এরপরে আবার দেখা হলে কী বলে ডাকব আপনাকে?
যুবক হেসে বললেন, ঠিক। নামটা তো জানা দরকার। আমার নাম হচ্ছে বি রায়। অর্থাৎ বিজয় রায়। সবাই আমাকে বিজুদা বলে ডাকে। তুমিও তাই ডাকবে।
সব্যসাচী বলল, আচ্ছা বিজুদা, আপনি যে অত খাতাপত্তর দেখছিলেন, ওগুলো কীসের খাতা?
ওসব আমার ক্লায়েন্টদের হিসেবনিকেশের খাতা।
আপনি কি চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট?
বিজুদা হেসে বললেন, ঠিক ধরেছ। বলে একটা সিগারেট বার করে ধরাবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
প্রচণ্ড সামুদ্রিক হাওয়ায় দেশলাইয়ের কাঠি কিছুতেই যখন জ্বলল না। তখন হঠাৎ কোথা থেকে একটা লাইটারসুদ্ধু হাত এগিয়ে এল তাঁর মুখের দিকে।
বিশাল শরীর এক বীভৎস চেহারা লোক, বয়সে বিজুদারই মতন, সেই
লাইটার বিজুদার মুখের কাছে ধরে এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। বিজুদা সিগারেট ধরিয়ে কঠিন চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী ব্যাপাররে! তুই এখানে?
শুনলাম তুই পুরী বেড়াতে এসেছিস। তাই বেনারসে গিয়ে কী করব বল? তার মানে আমার খোঁজেই এসেছিস?
তাই তো মনে হয়।
কোনও লাভ হবে না কিন্তু।
লাভ লোকসানের হিসেব পরে হবে। এখনও সময় আছে, ওটা ভালয় ভালয় ফিরিয়ে দে।
তোর কি ধারণা ওটাকে আমি সঙ্গে করে এনেছি?
শুধু তাই নয়, হয়তো এখনও তোর কাছেই আছে!
বিজুদা হাসলেন। বললেন, বুদ্ধু কোথাকার। রাস্তা ছাড়।
এটা কিন্তু আমার কথার জবাব হল না।
বিজুদা সিগারেটে একটা টান দিয়ে ধোঁয়াটা লোকটার মুখের ওপর ছেড়ে বললেন, এই তোর জবাব।
বলার সঙ্গে সঙ্গেই লোকটা বিজুদার চোয়াল লক্ষ্য করে মারল এক ঘুসি। কিন্তু বিজুদা তৈরিই ছিলেন। তাই ঘুসিটা চোয়ালের কাছ পর্যন্ত আসবার আগেই শক্ত মুঠিতে ধরে ফেললেন কবজিটাকে। তারপর সজোরে একটা মোচড় দিয়ে বললেন, ক্রাইম করতে গেলে হাতটাকে একটু ভাল করে তৈরি করতে হয়। এমন মেয়েলি হাতে কী করে কী করবি?
ঠিক সেই সময় আশপাশ থেকে আরও কয়েকজন এসে
কোথা থেকে একটি মারুতি গাড়িও এসে হাজির হল সেখানে
ঘিরে ফেলল ওদের। ।
একজন চোখের পলকে লিপিকে উঠিয়ে নিল সেই গাড়িতে। আর একজন বলল, এবার দিবি নিশ্চয়ই?
বিজুদা বললেন, যদি ভাল চাস তো মেয়েটাকে নামিয়ে দে।
ওরা হেসে বলল, গিভ অ্যান্ড টেক।
ওদিকে লিপি ভয়ে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠতেই ওরা শক্ত করে ওর মুখ চেপে ধরল।
একজন বলল, টু শব্দটি কোরো না। তা হলে এই ননীর শরীর খাস্তার গজা
হয়ে যাবে। যেমন আছ তেমনি থাকো।
সব্যসাচী সেই মুহূর্তে জনারণ্যে ছুটে গিয়ে প্রচণ্ড হাঁকডাক শুরু করেছে, কে কোথায় আছেন, শিগগির আসুন। ডাকাত ডাকাত।
হই হই করে অনেক লোক ছুটে এসেছে তখন। কিন্তু এলে কী হবে? ততক্ষণে
যা হবার তা হয়ে গেছে।
অর্থাৎ লিপিকে নিয়ে মারুতি হাওয়া।
আর দু’হাতে পেট চেপে বসে পড়েছেন বিজুদা।
সব্যসাচী ছুটে গিয়ে বিজুদাকে ধরল, কী হল বিজুদা! কী হল আপনার? ছুরিটুরি মেরেছে নাকি ওরা?
বিজুদা কী একটা জিনিস চকিতে সব্যসাচীর হাতে দিয়ে বললেন, এটাকে সাবধানে রাখিস। কাউকে কিছু বলিস না। এখানে না থেকে ঘরে যা তুই। না হলে তোর বাবা-মা চিন্তা করবেন।
কিন্তু আপনার কী হল?
তেমন কিছু না।
আরও অনেক লোক যারা এসেছিল, সবাই মিলে ধরাধরি করে তুলল বিজুদাকে।
দুষ্কৃতীদের একজন বিজুদার তলপেটে বুট দিয়ে এমন একটা লাথি মেরেছে
যে মারাত্মক লেগেছে সেটা। তারই যন্ত্রণায় ছটফট করছেন বিজুদা।
জনতার ভেতর থেকে কেউ কেউ বলল, আপনাকে কী আমরা বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়ে আসব দাদা?
বিজুদা বললেন, আমি নিজেই যেতে পারব। তারপর সব্যসাচীর দিকে.তাকিয়ে বললেন, লিপিকে ওরা কোনদিকে নিয়ে গেল রে? মোহানার দিকে।
একটা সাইকেল রিকশা আসছিল। সেটাকে দাঁড় করিয়ে বিজুদা সব্যসাচীকে ধরে অতিকষ্টে উঠে বসলেন তাইতে। তারপর সকলের কাছে বিদেয় নিয়ে এগিয়ে যেতে বললেন রিকশাটাকে।
আকাশ তখন ফর্সা হয়েছে।
সমুদ্রস্নান সেরে রক্তিম সূর্য একটু একটু করে উদয় হচ্ছে। হাজারও জনতার জোড়া জোড়া চোখের দৃষ্টি তখন সেই উদয় মুহূর্তের দিকে। আকাশ জুড়ে তখন রঙের খেলা।
হঠাৎ ও কী!
একটা অ্যামবাস্যাডার যেন দ্রুত ছুটে আসছে ওদের দিকে। হ্যাঁ তাই তো। গতিবেগ দেখে স্পষ্টই বোঝা যায় মতলব ভাল নয় ওটার।
রিকশাওয়ালাও ভয় পেয়ে গেল তাই দেখে।
বিজুদা চেঁচিয়ে বললেন, সব্যসাচী লাফিয়ে পড়।
শুধু বলার অপেক্ষা। সব্যসাচী চলন্ত রিকশা থেকেই লাফিয়ে পড়ল বালির ওপর।
বিজুদা নামতে পারলেন না।
মোটর এসে রিকশার একদিকের চাকায় ধাক্কা দিতেই পথের ধারে ছিটকে পড়ল রিকশাটা। বিজুদাও কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়লেন।
বিজুদার মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে। প্রচণ্ড আঘাতে বিজুদা প্রাণহীন কি সংজ্ঞাহীন তা বোঝা যাচ্ছে না।
মোটর থেকে নেমে দু’জন লোক গিয়ে সার্চ করতে লাগল বিজুদাকে।
পথচারী যারা ছিল তারা সবাই তখন ছুটে এল বিজুদাকে সাহায্য করতে। দুষ্কৃতীরা বীরবিক্রমে জনতার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েই রিভলভার তাগ করল। ব্যস। ওতেই যথেষ্ট। একেবারে ভিড় ফাঁকা। সবাই পেছু হটল ভয়ে।
জনতা পেছু হটলে দুষ্কৃতীরা গাড়ি নিয়ে চলে গেল পুরী হোটেলের দিকে। আর সব্যসাচী কী করবে কিছুই ভেবে পেল না। রিকশা থেকে লাফিয়ে পড়ায় ওকেও লেগেছে খুব।
ও দেখল কয়েকজন লোক পাঁজাকোলা করে তুলে নিল বিজুদাকে। তারপর বাবুনি পার্কের বেঞ্চিতে নিয়ে গিয়ে শোয়াল। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মনে আনন্দ দেবার জন্য এই বাবুনি পার্কটা সম্প্রতি গড়ে উঠেছে এখানে। একেবারে স্বর্গদ্বারের গায়ে সুন্দর পরিবেশে।
কয়েকজন লোক পাশের একটি লজ থেকে অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করল।
পুলিশও এল একটু পরে।
পুলিশের একজন ইনস্পেক্টর জিজ্ঞেস করলেন, এনার সঙ্গে কেউ ছিল না? সব্যসাচী বলল, আমি ছিলাম।
ইনস্পেক্টর বললেন, গাড়িটার নম্বর মনে আছে?
হ্যাঁ। এ বি সি ডি এক দুই তিন চার…। এইরকম আবার নম্বর হয় নাকি? এইসব গাড়ির নাম্বার প্লেট থাকে? বুঝেছি। কোথায় উঠেছ তোমরা? কৃষ্ণানন্দ ধাম, হলিডে হোমে।
উনি তোমার কে হন?
কেউ না। বেড়াতে এসে এখানেই পরিচয়। ভদ্রলোকের নাম বি রায়। ওনার ভাইঝিকে দুষ্কৃতীরা নিয়ে গেছে।
ততক্ষণে অ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে।
পুলিশের সাহায্য নিয়ে সবাই মিলে ধরাধরি করে স্ট্রেচারে শুইয়ে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দিল বিজুদাকে।
সব্যসাচী ফিরে এল হলিডে হোমে।
এই দুঃসংবাদটা যে কী করে দেবে লিপির বাবা-মাকে তা সে ভেবে পেল না। ওদের সঙ্গে তো ভাল করে পরিচয়ই হয়নি। ওরা কতজন এসেছেন তাও জানে না। শুধু পাশের ঘরে আছেন এইটুকুই জানা আছে।
চারদিক রোদে ঝলমল করছে। এখন সাগর ফেরা যাত্রীদের ঘরে ফেরার, বাজার করার পালা।
স্বর্গদ্বারের ওই ঘটনাটা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে তখন।
মা-বাবা দু’জনেই অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দায়। আরও কারা যেন আছে।
সব্যসাচী কারওদিকে না তাকিয়ে দোতলায় উঠে সোজা ঘরে ঢুকে বিছানার ওপর বসে পড়ল।
সরমা বললেন, কী হল! তুই একা এলি যে?
স্নেহাংশুবাবু বললেন, কী সব যেন গোলমাল শুনলাম। তুই কিছু শুনেছিস? তোমরা কী শুনেছ তা জানি না। তবে খুব একটা খারাপ ব্যাপার ঘটে গেছে। কীরকম।
সব্যসাচী সব কথা খুলে বলল বাবা-মাকে।
স্নেহাংশুবাবু বললেন, সে কী! তোর কোনও চোটটোট লাগেনি তো? সব্যসাচী বলল, না। তবে অল্পবিস্তর ব্যথা পেয়েছি। সরমা বললেন, আর এক মুহূর্ত এখানে নয়, আজই আমি চলে যাব এখান থেকে।
স্নেহাংশুবাবু বললেন, আর থাকলে আরও বিপদ হবে। তবে এই খবরটা তো এখনি পৌঁছে দিতে হবে ওদের। পাশাপাশি ঘর যখন, ওদের সঙ্গে থেকে খোঁজখবরও নিতে হবে একটু।
আমি কিন্তু আজই যাব।
যাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। প্রাথমিক ব্যবস্থাটা তো করি আগে।
স্নেহাংশুবাবু পাশের ঘরের যাত্রীদের ডেকে সব বলতেই সেখানে কান্নার রোল উঠল। বিজুদার দাদা-বউদি মেয়ের শোকে দারুণ বিচলিত হয়ে পড়লেন। চরম এক বিপদের আশঙ্কায় কী যে করবেন কিছু ঠিক করতে পারলেন না।
বিজুদার বৃদ্ধা মা ডাক ছেড়ে কাঁদতে লাগলেন।
কেয়ার টেকার সাধনবাবু ছুটে এলেন। নীচের তলার যাত্রীরা এল। আরও অনেকে এলেন। সবাই একজোট হয়ে বিজুদার খোঁজে এবং ঘটনার বিবরণ জানাতে থানায় চললেন প্রথমে।
কী থেকে কী হল, কেন হল, কেউ কিছুই ভেবে পেলেন না।
সব্যসাচীও সব কথা সকলকে খুলে বললেও সেই গোপন জিনিসটা যেটা বিজুদা ওর কাছে গচ্ছিত রেখেছেন সেটার কথা বলল না কাউকেই। সেটা যে কী, তা সে ও জানে না। বিজুদার মতন লোকের সঙ্গে ওই দলটার যে কী সম্পর্ক থাকতে পারে ভেবে পেল না ও। সবকিছুই যেন ঘন রহস্যের ধোঁয়াশায় ভরে যেতে লাগল।
ও মুখহাত ধুয়ে বারান্দায় এসে বসতেই, মা চা-জলখাবার এনে ওকে দিলেন। সামনের হলিডে হোমের বারান্দা থেকে জয়া ওকে ইশারা করতে লাগল। সব্যসাচী একবার এদিক সেদিক তাকিয়ে হাতছানিতে ডাকল ওকে।
জয়াও বিষয়টার গুরুত্ব বুঝে আর ওকে বাইরে আসতে বলল না। ইশারায় ওকে ছাদে যেতে বলে সরে গেল বারান্দা থেকে। তার মানে একটু পরেই ও আসবে। ওর এখন সত্যিই আসা দরকার। না হলে যে হাঁফিয়ে উঠবে ও। একেবারে চুপচাপ এই অস্বস্তিকর পরিবেশে কি থাকা যায়?