সব্যসাচীর গোয়েন্দাগিরি – ৪

চার

ভিজে বালির ওপর দিয়ে পথ চলতে চলতে একসময় ওরা বালিয়াড়ি পার হয়ে পাকা রাস্তায় উঠল।

নির্জন পথ। মাঝে মাঝে দু’-একটা পোড়ো বাড়ি চোখে পড়ল। কোনও কোনও জায়গায় অবশ্য হলিডে হোম অথবা ওই ধরনের কিছু যাত্রীনিবাস গড়ে উঠছে।

কিন্তু পথের যে শেষ হয় না।

সব্যসাচী বলল, আর কতদূর?

জয়া বলল, কী করে জানব? আমি কি গেছি কখনও? সেই জন্যই তো ডেকে আনলাম তোমাকে। এত দূরের পথ কি একা আসা যায়?

আমার কিন্তু খুব ভয় করছে।

কীসের ভয়! ভূতের?

না, তা নয়। কী নির্জন দেখছ না। মাঝি, মাল্লা, নুলিয়া, জেলে কেউ নেই এখানে। কাউকে যে কিছু জিজ্ঞেস করব সে সম্ভাবনাও নেই।

না থাক। এসেছি যখন জায়গাটা না দেখে ফিরছি না।

যেতে যেতে একসময় পিচ ঢালা পাকা রাস্তাটা শেষ হয়ে গেল। তখন ওরা এমন এক জায়গায় এসে পড়ল যে জায়গাটাকে একটা মরুভূমি বললেও ভুল হয় না। বাঁদিকে সমুদ্রকে বাদ দিলে সত্যি সত্যিই সেটা যেন একটা মরুভূমি। এইখানে হঠাৎ কয়েকজন কাঠুরিয়ার সঙ্গে ওদের দেখা হয়ে গেল। তারা মাথায় ঝাউকাঠের বোঝা নিয়ে স্বর্গদ্বারের দিকে যাচ্ছিল।

সব্যসাচী জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, নদী যেখানে সাগরে মিশেছে সে জায়গাটা আর কতদূরে গো ?

তারা থমকে দাঁড়িয়ে বলল, এমন অবেলায় সেখানে গিয়ে কী করবে? আর একটু পরে সূর্য ডুবলেই তো সন্ধে হয়ে যাবে।

কেন যাওয়া যাবে না?

যাবে না কেন? যাবে আর আসবে। একদম দেরি কোরো না। জায়গাটা খুব খারাপ।

জয়া বলল, কিন্তু কতদূরে?

এই তো এসে গেছ।

ওরা বালির ওপর দিয়ে খানিক এগোতেই দেখতে পেল কী সুন্দর ঘন নীল জলের একটা নদী সমুদ্রে এসে মিশেছে।

সব্যসাচী লাফিয়ে উঠল, ওঃ কী সুন্দর এই জায়গাটা।

জয়া বলল, কেন যে লোকে স্বর্গদ্বারের বালি কামড়ে পড়ে থাকে তা কে জানে? এই তো বেড়াবার উপযুক্ত জায়গা।

সব্যসাচী বলল, জয়!

জয় নয়, জয়া।

ওই হল। ওই দেখো তোমার পাহাড়।

পাহাড় কোথায়? ওটা তো দেখছি উঁচু বালিয়াড়ির ওপরে একটা ঘন ঝাউবন। যদি সকালের দিকে আসতাম তা হলে যেভাবেই হোক নদী পার হয়ে চলে যেতাম ওখানে।

জয়া হঠাৎ আনন্দে চিৎকার করে উঠল, সব্যসাচী! পেয়েছি পেয়েছি পেয়েছি। কী

পেয়েছ?

যা কেউ পায় না। আস্ত একটা শাঁখ। তাও আবার জ্যান্ত।

সব্যসাচী ছুটে গেল, কই দেখি?

জয়া শাঁখটাকে হাতে করে ছুড়ে দিল ওর দিকে। বলল, সাবধানে দেখবে কিন্তু। এরা খুব কামড়ে দেয়।

পঞ্চমুখী শাঁখ। খুব একটা বড় নয়। তবে নেহাত ছোটও নয়। খুঁজতে খুঁজতে আরও অনেক ছোট ছোট শাঁখ মিলল। সেই সঙ্গে রংবাহারি অজস্র ঝিনুক। ওরা যে কী করবে তা ভেবে পেল না। সমুদ্র তার এত সম্পদ যে ওদের জন্যে থরে থরে সাজিয়ে রাখবে এখানে তা কে জানত? কিন্তু মুশকিল হল এত সব ওরা নিয়ে যাবে কী করে? ওরা যে কিচ্ছু আনেনি। এমনকী কারও কাছে একটা রুমাল পর্যন্ত নেই।

জয়া বলল, কী করি বলো তো? এ জিনিস ছেড়ে গেলে সারারাত আমি ঘুমোতে পারব না।

আমিও কি পারব ভেবেছ?

যদি তুমি কিছু মনে না করো, একটা কথা বলব?

বলো।

তুমি তো ছেলে। ভেতরে গেঞ্জি একটা পরে আছ নিশ্চয়ই। তা এক কাজ করো না, তোমার জামাটা খুলে ওর মধ্যেই মুড়ে নাও। আমি মেয়ে। আমার পক্ষে ওই ভাবে কিছু নেওয়ার অসুবিধে আছে। তাও যদি বুদ্ধি করে চুড়িদারটা পরে আসতাম তা হলেও না হয় হত। কিন্তু ফ্রক পরেই যে কাল করেছি।

সব্যসাচী বলল, ঠিক আছে। আমি আমার জামার মধ্যেই সব নেব। তুমি আরও কুড়োও। আমি বরং ওই বালিয়াড়ির ওপরটায় উঠে গিয়ে একটু দেখি ওগুলো নিয়ে যাবার মতো কোনও কিছু পাই কিনা।

কী পাবে ওখানে?

দেখে মনে হচ্ছে এখানে মড়াটড়া পোড়ানো হয়। কোনও কলসি বা পলিপ্যাক জাতীয় কিছু যদি পাই তো মন্দ কী?

দেখো তবে। কিন্তু মড়াদের জিনিসপত্তর কিছু যেন নিয়ো না। ওরা ভারী বদ। স্বপ্নে দেখা দিয়ে সব কিছু ফেরত চায়। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে ভয় দেখায়।

সব্যসাচী ওর কথায় হেসে উঠে বলল, তোমার মুণ্ডু। বলেই একটা কলসি নিয়ে এসে কুড়নো ঝিনুক শামুক শাঁখ কড়িগুলো তার মধ্যে পুরে নিল।

তারপর নদীর একটা খাড়ি যেখানে বালিয়াড়ির মধ্যে ঢুকেছে সেইখানে উঁচু একটা বালির ঢিবিতে উঠে চারপাশ দেখেই কেমন যেন উৎফুল্ল হয়ে নেমে এল। জয়া তখনও এক মনে ঝিনুক কুড়িয়ে চলেছে।

সব্যসাচী বলল, জয়া! একবার ওই বালির ঢিবিতে ওঠো।

কেন, কী আছে ওখানে?

ওখানে কিছুই নেই। যা আছে তা এই নদীটার ওপারে। কী

সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য সেখানকার। না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না।

তুমি কি ওপারে যেতে চাও?

যদি তুমিও যাও।

জয়া এবার মিলনমুখী নদীর জলধারার দিকে তাকিয়ে বলল, নদীর এখানে গভীরতা খুব কম। হয়তো হাঁটু জল। কিন্তু মোহানার নদী। পার হতে পারবে তো?

খুব পারব। এতদূর যখন এসেছি তখন ওপারটা না দেখে কি যাওয়া ঠিক? ওপারে গিয়ে ওই বালিয়াড়ির উঁচুতে উঠে আরও ওপারে কী আছে দেখে তবেই ফিরব।

বেলা পড়ে আসছে কিন্তু।

আসুক না। যাব আর আসব।

আর কথা নয়।

দু’জনেই তখন নেমে পড়ল জলে। ওঃ সে কী টান জলের। তেমনি ঠান্ডা। দু’জনে দু’জনকে ধরে টলমল করতে করতে বহু কষ্টে নদীটা পার হল।

ওপারে গিয়ে যখন পৌছল তখন যেন বিশ্বজয়ের আনন্দ ওদের মনে।

নদীটা এইদিক দিয়েই বয়ে আসছে।

এখানে একটা বাঁক আছে। সেই বাঁকের মুখে গিয়ে ওরা দেখল কী দারুণ নির্জন আর অনবদ্য প্রকৃতির বুক চিরে বয়ে আসছে নদীটা। ঘন নীল তার জলের রং। কত সামুদ্রিক পাখি উড়ছে সেই নদী আর বালিয়াড়ির মাঝখানে। ওরা দু’জনে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল সেই নদীর গতিপথের দিকে। তারপর বালিয়াড়ি পার হয়ে ওপরের ডাঙায় উঠতে লাগল।

খানিক এসেই ওদের চক্ষুস্থির। কত ঝিনুক-কড়ি যে এখানে ছড়ানো আছে, তা কে জানে। দেখে চোখ কপালে উঠল ওদের।

জয়া তো সব ভুলে আবার শুরু করল ঝিনুক কুড়োতে।

সব্যসাচী বলল, শোনো জয়া, বেশি লোভ কোরো না। কাল বরং আমরা আবার আসব। সঙ্গে একটা ব্যাগ নিয়ে আসব। আর তখনই আমরা লুটে নেব এই কুবেরের ভাণ্ডার।

জয়া বলল, কালকের কথা কাল। আজ আমি এগুলোকে ছেড়ে যেতে পারব না।

প্লিজ। আর দেরি করলে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। এখনই সন্ধে হয়ে আসছে

তা হলে চলে এসো তুমি।

আমি যে ওপরে উঠে একটু দেখতে চাই।

আমিও যে এগুলো সব কুড়োতে চাই।

তুমি তা হলে তোমার কাজ করো, আমি বরং প্রকৃতি দেখি।

সুবুদ্ধি হোক তোমার।

সব্যসাচী ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে লাগল। চারদিকে কত কাঁটাগাছ এখানে।

ছোটখাটো ঝোপঝাড়। ওপরটা ঠিক যেন পাহাড়ের মতো উঁচু।

ওপরে উঠেই মুগ্ধ হয়ে গেল সব্যসাচী। সে কী অনন্ত সৌন্দর্য সেখানে। কী বিশাল ঝাউবন। ঘন থেকে ঘনতর হয়ে দিগন্তে মিলিয়ে গেছে। আর কী ভয়াবহ নির্জনতা চারদিকে।

সব্যসাচী মুগ্ধ চোখে চারদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ কী দেখে যেন চমকে উঠল। সে চোখদুটো বড় বড় করে অবাক বিস্ময়ে সেইদিকে চেয়ে থেকে ডাকল, জয়া! শিগগির একবার এদিকে এসো। খুব তাড়াতাড়ি।

কিন্তু আমার এই জিনিসগুলো?

ওগুলো ওখানে পড়ে থাক। আগে এসো তুমি।

এক মিনিট। এখুনি যাচ্ছি।

সব্যসাচীর ডাক শুনে দ্রুতপায়ে বালিয়াড়ির ওপরে উঠল জয়া। খুব তাড়াতাড়ি কি ওঠা যায় ? বালিতে পা হড়কে ওপরে ওঠার সে কী কষ্ট। সূর্য তখন অস্তাচলে।

লাল রঙের সূর্যটা সমুদ্রের জলের ওপর বসে পড়েছে দিগন্তে তখন সে কী রঙের খেলা তখন।

রংবাহারি মেঘ। রঙিন আকাশ। রঙে রাঙা চারদিক।

সেই সঙ্গে দিগন্ত জুড়ে বিভীষিকা।

কেন না সন্ধে হয়ে আসছে তখন। সমুদ্রের গর্জন দ্বিগুণ হচ্ছে। সেই জনমানবহীন প্রান্তরের নিস্তব্ধ নির্জনতায় ওরা যা দেখল তা রীতিমতো ভয়ের এবং বিস্ময়ের।

কী দেখল ওরা?

ওরা দেখল ঝাউবনে নয়, নদীগর্ভে নয়, নদী আর বালিয়াড়ির মাঝামাঝি একটা অংশে যেখানে অনেক বুনো ঘাস, শন, কাঁটাঝোপ ঠিক সেইখানে, দশ বারো বছরের একটি বালকের দেহ অনড় হয়ে পড়ে আছে। দেখে বেশ ভদ্রঘরের ছেলে বলেই মনে হল।

সব্যসাচী বলল, এ নিশ্চয়ই সে।

জয়া বলল, কে ও?

সকালবেলা সমুদ্রতীর হতে নিখোঁজ হয়েছিল যে ছেলেটি।

কী করে জানলে?

মনে হয়।

সে কী করে এখানে আসবে?

জানি না। শুনেছি সমুদ্র নাকি যাদের টেনে নেয় তাদের মৃতদেহ ফেলে দেয় অনেক দূরে।

তাই বলে এতদূরে?

এই তো নিয়ম। আমার খুব ভয় করছে কিন্তু। চলে এসো এখন থেকে। সে কী! ছেলেটার কাছে গিয়ে একবার দেখবে না? কী দেখব? দেখবার কী আছে? ওটা তো একটা মড়া। আমরা ফিরে গিয়ে ওর মা-বাবার খোঁজ করে খবর তো একটা দিতে পারব। জয়া দারুণ ভয় পেয়ে বলল, আমি যাব না। তুমি যাও। সব্যসাচী এক-পা দু’-পা করে এগিয়ে গেল ছেলেটির কাছে। তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা ছেলেটিকে চিৎ করে দিতেই, ওর মনে হল ছেলেটা একটা

দীর্ঘশ্বাস ফেলল যেন।

শুধু তাই নয়, একবার একটু চোখ মেলে তাকিয়েই চোখটা বুজে নিল।

জয়া ওপর থেকেই হেঁকে বলল, সব্যসাচী! তোমাকে এখনও বলছি তুমি চলে এসো। না হলে কিন্তু তুমি মরবে।

সব্যসাচী ছেলেটির কাছ থেকে সরে না এসেই বলল, তুমি মিছেই ভয় পাচ্ছ জয়া। ছেলেটা মরেনি।

ভীত সন্ত্রস্ত জয়া বলল, কী করে বুঝলে?

তুমি একবার এসে দেখো।

আমার দারুণ ভয় করছে, আমি যাব না। উঃ কী বিপদেই যে পড়লাম। ভয় পাবার কিছু নেই। এখানে তুমি একা নও। আমি তো আছি। ছেলেটা একটা শ্বাস ফেলল।

সে কী !

চোখ মেলে তাকাল।

মানে!

তার মানে ও বেঁচে আছে।

কেমন যেন কান্নাধরা গলায় জয়া বলল, ও বেঁচে নেই সব্যসাচী। এই রকম অবস্থায় ও যে কী তা কি তোমাকে বলে দিতে হবে?

ওসব কিছু নয়, তুমি কি ভাবছ ও মরে ভূত হয়েছে? পাগলি কোথাকার। এসো, নেমে এসো এখানে। এসে হাত লাগাও।

কী করতে চাও তুমি ওকে নিয়ে?

কিছু না। আমরা দু’জনে মিলে ওকে ধরাধরি করে একটু পরিষ্কার জায়গায় বালির ওপর শোয়াব

তুমি কী ! তোমাকে কি দানোতে ভর করেছে?

সব্যসাচী মনে মনে হেসে ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে ওকে আর ভালও করে পরীক্ষা করতে লাগল। যদি আবার একবার ওর দিকে চোখ মেলে চায় সেই আশায়। ওর বুকের জামা সরিয়ে বুকে হাত দিয়ে দেখল গা ঠান্ডা কি না। মড়াদের গা তো ঠান্ডা হয়। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারল না ও।

জয়া হেঁকে বলল, সব্যসাচী! এখনও বলছি তুমি চলে এসো।

একটু দাঁড়াও।

তা হলে থাকো তুমি ওকে নিয়ে। আমি পালাই। এই বলেই পিছু

ফিরল সে।

সব্যসাচী ব্যাকুল হয়ে বলল, না না, এরকম কোরো না। আজ সকালে ওর মা-বাবার কান্না শোননি তো? বাবা জগন্নাথের অসীম দয়া যে, ছেলেটা বেঁচে আছে। এসো আমরা দু’জনে মিলে ওকে সুস্থ করি।

কিন্তু কাকে বলা? জয়া তখন বালিয়াড়ির ওপর থেকেই উধাও।

সব্যসাচী চিৎকার করে বলল, জয়া, তুমি যেয়ো না। তুমি চলে গেলে একা একা আমারও এখানে ভয় করবে। তা ছাড়া এইভাবে কাউকে ফেলে রেখে চলে যেতে নেই। তুমি চলে গেলে একা আমি বিপদে পড়ে যাব। মনে রেখো তোমাকে একটা নদী পার হতে হবে।

সব্যসাচীর সে কথার কোনও উত্তরই দিল না জয়া।

সব্যসাচী খুব ভয় পেয়ে গেল তখন।

হাজার হলেও সেও ছেলেমানুষ তো। এই অন্ধকারে সে যে কী করবে তা ভেবে পেল না।

এমন সময় ছেলেটি একবার মা বলে ডেকে উঠল যেন।

ছেলেটি কি সত্যিই জীবিত? না, মরে ভূত হয়ে অমন করছে? কে জানে তা। সে তখন খুব জোরে জোরে চেঁচাতে লাগল, জয়া! জয়া! জয়া ফিরে এসো, জয়া !

এমন সময় ঝাউবনের দিক থেকে দুটো টর্চের আলো এসে গায়ে পড়ল ওর।

কারা যেন হেঁকে বলল, কে? কে ওখানে?

সব্যসাচী ভয়ে ভয়ে বলল, আমি।

আমিটা কে?

আপনারা আমাকে চিনবেন না। আমি সব্যসাচী। একবার আসুন না এখানে। আমার খুব ভয় করছে।

দু’জন লোক দ্রুতপায়ে হেঁটে এসে বলল, কে তুমি! এমন অসময়ে এখানে তুমি কী করছ?

সব্যসাচী বলল, আমি এখানে ছিলাম মোহানা দেখতে। জয়া নামে একটি মেয়েও ছিল আমার সঙ্গে। মেয়েটি হঠাৎ খুব ভয় পেয়ে আমাকে ফেলে পালিয়ে গেল।

ভয় পেয়ে?

হ্যাঁ, ভয় পেয়ে।

লোক দু’জন পরস্পরের দিকে তাকাল, কেন ভয় পেল কেন? কিছু কি দেখেছ তোমরা?

সব্যসাচী তখন সকালের ঘটনাটা বলল ওদের। তারপর দেখিয়ে দিল ছেলেটাকে। দিয়ে বলল, মনে হয় ও বেঁচে আছে। কিন্তু মেয়েটা ভাবল ও বুঝি মরে ভূত হয়েছে, তাই ভয়ে পালিয়ে গেল।

আর কিছু দেখনি তো? বলে ওরা এগিয়ে গেল ছেলেটির কাছে। গিয়ে কী সব দেখেটেখে বলল, রাখে হরি তো মারে কে? সমুদ্রের গ্রাস থেকে এইভাবে কেউ বাঁচে না। তবে মজার ব্যাপার এই, ছেলেটি প্রাণে বাঁচলেও ওর বড়ি তো এখানে আসবার কথা নয়। আসেও যদি সে-দেহে প্রাণ থাকবে না। মনে হয় দেহটা কেউ বয়ে এনেছে।

সব্যসাচী বলল, সে কী! কে আনবে?

কে আনবে বা আনতে পারে সেটা তদন্তের ব্যাপার। হয়তো ছেলেটি সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে গিয়ে জেলেদের জালে আটকে যায়। তাই জাল ধরে জ্ঞান হারিয়েও প্রাণে বাঁচে। পরে জেলেরা ওকে এইখানে নিরাপদ জায়গায় এনে মড়া মনে করে ফেলে রেখে চলে যায়।

এটা কি ওদের উচিত হল?

কখনই না। হয়তো পুলিশি ঝামেলার ভয়ে ওরা এড়িয়ে গেছে ব্যাপারটাকে। তা ছাড়া এমনও হতে পারে, ছেলেটি আদৌ সমুদ্রে তলায়নি। জলে পড়ার পরই সুকৌশলে ওকে অপহরণ করেছে কেউ।

কী বলছেন আপনারা? অপহরণ!

হ্যা, অপহরণ। ছেলেটির বাবা-মায়ের ওপর হয়তো রাগ ছিল কারও। তাই কিডন্যাপ করে জলে জলেই টেনে আনার পর ছেলেটির অবস্থা খারাপ দেখে এইখানেই ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।

সব্যসাচী বলল, উঃ, কী সাংঘাতিক।

ঠিক আছে, তুমি বসো। আমরা দেখছি ওর কী ব্যবস্থা করতে পারি। এই বলে ওরা দু’জনে নানারকম কসরত করল ছেলেটিকে নিয়ে। ওর পেট থেকে জল বার করে ওকে সুস্থ করবার চেষ্টা করতে লাগল।

আর সব্যসাচী? সে উঁচু একটা বালিয়াড়ির ওপর বসে কত কী ভাবতে লাগল। বেশি করে ভাবতে লাগল কথা। মড়া দেখে ভূতের পেয়ে যে মেয়ে পালাতে পারে, সে এই আবিল অন্ধকারে একা এই দীর্ঘপথ কী করে যাবে, তা সে ভেবে পেল না। তবু দুঃখ এই, মেয়েটা কী স্বার্থপর। সঙ্গীকে এইভাবে একা রেখে কেউ পালায়? ওর কি হৃদয় বলেও কিছু নেই? নাকি ওর প্রকৃতিই এইরকম? আর এই লোক দু’জন? এরাও তো রহস্যময়। এই নির্জনে অন্ধকারে কী করছিল এরা? এমন পরিষ্কার বাংলায় কথা বলছে যে বোঝাই যাচ্ছে এরা বাঙালি। তা হলে? ওই অন্ধকার ঝাউবনে এই অসময়ে কেউ থাকে? তাও এই গভীর নির্জনে?

বেশ কিছুক্ষণ পরে ওরা ডাকল, এই যে খোকা! কী যেন নাম বললে তোমার? সব্যসাচী না কী! এদিকে এসো।

সব্যসাচী ওদের কাছে যেতেই বলল, যা ভেবেছি তাই। ছেলেটি সমুদ্রগ্রাসে পড়েনি। ওকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। ওর গলায় ঘাড়ে চারদিকে মানুষের নখের দাগ। ওর গলা টিপে মেরে ফেলবার চেষ্টা করেছিল কেউ। কিন্তু পারেনি। সব্যসাচী শিউরে উঠল, তা হলে?

তা হলে আর কী, এ যাত্রায় বেঁচে গেল ছেলেটি। কিন্তু মুশকিল হল। এই দীর্ঘ পথ ওকে তুমি নিয়ে যাবে কী করে?

ওর জ্ঞান ফিরেছে?

হ্যাঁ। কিন্তু পথ হাঁটার ক্ষমতা ওর নেই।

একটা কিছু উপায় আপনারা বার করুন।

কী তাই তো ভাবছিরে ভাই। ওকে আর তোমাকে নিয়েই যে এখন সমস্যা। করা যায়।

আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমি ঠিক যেতে পারব। কিন্তু আপনারা কি পারবেন দূরের ওই পাখাগুলোর কাছ পর্যন্ত আমাদের একটু পৌঁছে দিতে?

অসম্ভব। আমরা এখুনি চলে যাব। ওই দেখো আমাদের ডিঙি বাঁধা। সাগরে

এখন জোয়ার এসেছে। তাই উজান বেয়ে চলে যাব এখুনি। আমরা!

কিছু তো করার নেই আমাদের। চলেই যাচ্ছিলাম, এমন সময় তোমরা এলে। আমরা দূর থেকে অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ করছিলাম তোমাদের। সন্ধের জন্যও অপেক্ষা করছিলাম। মেয়েটা তোমাকে ফেলে রেখে কীভাবে চলে গেল তাও দেখলাম। এখন বিদায় নিতে হবে আমাদের।

সব্যসাচী বলল, আমি তা হলে একা থাকব?

তোমরা তো দু’জন। এই দেখো উঠে বসেছে ছেলেটা। সব্যসাচী বলল, বেশ। ও একটু সুস্থ না-হওয়া পর্যন্ত বসেই থাকি তা হলে। বেশিক্ষণ বসতে হবে না। লোকজন এখুনি এসে যাবে। সব্যসাচী সবিস্ময়ে বলল, কোথা থেকে আসবে লোকজন?

ওরা হেসে বলল, দেখই না কোথা থেকে আসে। তোমার সঙ্গী সেই মেয়েটি নিশ্চয়ই কিছুদুরে গিয়ে চেঁচামেচি করে তোমার এবং এই ছেলেটির কথা বলবে সকলকে। আর তখনই লোকজন ছুটে আসবে হই হই করে।

সব্যসাচী হতাশার সুরে বলল, তা হলে তো ভালই হয়। কিন্তু ও মেয়ে কি আমাদের কথা বলবে কাউকে? হয়তো চেপেই যাবে ব্যাপারটা।

ওরা হাসল, তা কেন? ওই—ওই আসছে। ওই দেখো দূরে, বহু দূরে

বহুলোক। কতকগুলো টর্চ একসঙ্গে নিভছে জ্বলছে।

সব্যসাচী সেইদিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, তাই তো।

ওরা বলল, তা হলে চলি আমরা? বিদায় বন্ধু বিদায়।

কিন্তু আপনাদের পরিচয়? এই বিপদে এইভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন আপনারা, অথচ আপনাদের পরিচয় তো জানা হল না।

ওরা হো হো করে হেসে বলল, পরিচয় জানবার দরকার নেই আমাদের। আমরা খুব খারাপ লোক। আমাদের কথা কিন্তু কাউকে বোলো না। বেশ বলব না।

লোক দু’জন ডিঙি নিয়ে জোয়ারের স্রোতে ভেসে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। আর সব্যসাচী দেখল একদল লোক টর্চের আলো ফেলে ক্রমশ ওদের দিকে এগিয়ে আসছে।

ওদের সঙ্গে জয়াও আছে নিশ্চয়ই।

হঠাৎ জয়ার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। দূর থেকেই চেঁচিয়ে ডাকছে সে, স—ব্য সা—চী—ই—।

সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসে সেই স্বর কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে যেন।

সব্যসাচীও মুখের দু’পাশে হাত রেখে ওর ডাকে সাড়া দিল, আমি এ— খা— নে—এ।

কোথায় তুমি–ই–ই।

এই তো এ—খা—নে—।

সব্যসাচী ছেলেটিকে বলল, তুমি কি আমার সঙ্গে একটু আসতে পারবে ভাই? কতদূরে?

সামান্য একটু পথ। ওই যে ওরা যেখান থেকে ডাকছে আমাদের।

তুমি আমাকে ধরে থাকলে পারব।

সত্যসত্যই ছেলেটির তখন উঠে দাঁড়ানোরও ক্ষমতা

নেই। তবু সব্যসাচী ওকে হাত ধরে টেনে তুলল। কিন্তু দু’-এক পা গিয়েই ধপাস।

সব্যসাচী বলল, এক কাজ করো ভাই, আমার গলাটা আঁকড়ে ধরো তুমি। আমি তোমাকে এইটুক পথ পিঠে করেই বয়ে নিয়ে যাই।

ছেলেটি বলল, তোমার কষ্ট হবে না?

হলেই বা করবটা কী? তোমাকে তো এইভাবে এখানে ফেলে রেখে আমি চলে যাব না। গেলে অনেক আগেই যেতে পারতাম।

সব্যসাচী ছেলেটিকে বহু কষ্টে তুলে দাঁড় করাল। তারপর ওর হাত দুটি কাঁধের দু’পাশ দিয়ে টেনে ধরে বয়ে নিয়ে চলল ওকে। কিন্তু সামান্য পথ এসেই হাঁফিয়ে পড়ল। এসব কী ওর মতো ছেলের কাজ? কত শক্তি রাখতে হয় দেহে। ছেলেটি বলল, এভাবে তুমি আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না ভাই। তোমার কষ্ট হবে।

তা হলে তুমি যাবে কী করে? এইখানে এইভাবে তো সারারাত থাকা যাবে না। তা ছাড়া আমারও মা-বাবা চিন্তা করবেন।

সারারাত হয়তো থাকব না। কেন না সমুদ্রের হাওয়ায় এখন আমি একটু যেন সুস্থ বোধ করছি।

তা হলে এক-পা দু’-পা করে এগিয়ে এসো।

ছেলেটি সব্যসাচীর কাঁধে ভর করে, হাত ধরে কাঁপা কাঁপা পায়ে এগোতে লাগল।

কী জোরে হাওয়া বইছে তখন।

গভীর সমুদ্র অন্ধকার।

অথচ আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র মহানীলে চুমকির মতো চিকমিক করছে। প্রকৃতির এ এক অনবদ্য রূপ।

দূর থেকে স্বর্গদ্বারের আলোর রোশনাই দেখে ওদের মনে হল ওখানে যেন আজ উৎসবের রাত।

সব্যসাচী যেতে যেতেই বলল, আর একটু কষ্ট করে এসো। ওই দেখো, কারা সব আসছে।

অনেকগুলো টর্চের আলো তখন এসে পড়েছে ওদের গায়ে। জয়ার সঙ্গে প্রায় দশ বারোজন লোক।

জয়া তো ছুটে এসেই জড়িয়ে ধরল সব্যসাচীকে।

সব্যসাচীর চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। এত লোকের সামনে এ কী! মেয়েটা কি হাফ পাগলি, না ফুল ম্যাড?

সব্যসাচী ওর হাত ছাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, ছাড়ো ছাড়ো। কী হচ্ছে। লোকে কী বলবে?

জয়া বলল, সব্যসাচী! তুমি আমাকে ভুল বোঝনি তো?

না। তবে তোমার ব্যবহারে দুঃখ পেয়েছি। আমাকে ওই ভাবে একা ফেলে পালিয়ে গেলে কেন?

তার আগে বলো তুমি কি আমার কথা শুনেছিলে?

আমি ছেলেটার মধ্যে প্রাণের স্পন্দন দেখেছিলাম।

আমি দেখেছিলাম ভূত। আসলে ভূতকে আমার দারুণ ভয়। আমি মড়া বয়ে নিয়ে যাওয়াও দেখতে পারি না।

সে কী!

তাই তুমি যেই বললে, ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, চোখ মেলে তাকাল, তখন আমার কী ভয় যে হল, তা তোমাকে কী বলব। তোমাকে আমি বার বার বললাম পালিয়ে আসতে, কিন্তু তুমি এলে না।

তোমার ডাকে চলে গেলে পালাতে হয়তো পারতাম! কিন্তু ছেলেটাকে তো বাঁচাতে পারতাম না।

অন্যান্য লোকজন যারা এসেছিল, মানে জয়া ডেকে এনেছিল যাদের, তারা বলল, এই বুঝি সেই ছেলেটি?

হ্যাঁ। এই সেই।

আমার নাম পার্থ।

তুমি এখানে এলে কী করে?

জানি না। সমুদ্রে পড়ে গিয়ে হঠাৎ ভেসে গেলাম। তারপর হল, কিছুই আমার মনে নেই।

একটু কিছু মনে পড়ছে না?

না। চোখ মেলেই আমি আমার এই বন্ধুটিকে দেখলাম।

তুমি কি আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে?

কীভাবে যে কী

না। আপনারা আমাকে একটা গাড়ি করে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করুন। আমার যে কী হচ্ছে তা আপনাদের বলে বোঝাতে পারব না। আমাকে আমার মা-বাবার কাছে নিয়ে চলুন।

সবাই তখন অসুস্থ ছেলেটিকে বয়ে নিয়েই চলল লোকালয়ের দিকে। বেশিদূর অবশ্য যেতে হবে না।

খানিক যাবার পর পাকা রাস্তায় উঠলে কিছু-না-কিছু মিলবেই। সবার পেছনে পরস্পরের হাত ধরে চলল জয়া ও সব্যসাচী। জয়া বলল, আজ যা বাড়িতে হবে না।

সব্যসাচী বলল, আমারও।

এতক্ষণে ওরা নিশ্চয়ই আমাদের খোঁজে চারদিক তোলপাড় করছে। পুলিশে খবর দিয়েছে।

মনে হয় তাই। আমার বাবা-মা, আর তোমার মামা-মামি সবাই একজোট হয়ে হয়তো ঘরবার করছেন।

একজন ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী ভাই?

এই ভাবে কথা বলতে বলতে ওরা বেশ খানিকটা এগিয়ে যাবার পর, এখানকার ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের একটি গাড়ি দেখতে পেল। ওদের সহযোগী মানুষজন যারা ছিল তারা সবাই গিয়ে ওদের বিপদের কথাটা খুলে বলল গাড়ির ড্রাইভারকে।

এক কথায় কাজ।

ড্রাইভার সব্যসাচীকে, জয়াকে, পার্থকে এবং সেই সঙ্গে আরও দু’জনকে তুলে নিলেন গাড়িতে। তারপর বললেন, যাবার আগে থানায় একটা ফোন করে যাই। তা হলে স্বর্গদ্বারে পৌঁছলেই ছেলেটির বাবা-মায়ের সন্ধান পেয়ে যাব। এই বলে ড্রাইভার ফোন করে এসে গাড়িতে স্টার্ট দিলেন।

সঙ্গে আরও যেসব লোকজন ছিল তারা হাত নেড়ে বিদায় জানাল সবাইকে।

ফাঁকা রাস্তা ধরে কিছু সময়ের মধ্যেই ওরা এসে পৌঁছল স্বর্গদ্বারে। শুধু পুলিশ নয়, পার্থর বাবা-মা, জয়ার মামা, সব্যসাচীর মা-বাবা সবাই হাজির সেখানে।

সরমা তো হারানিধি ফিরে পাওয়ার মতো বুকে জড়িয়ে ধরলেন সব্যসাচীকে। স্নেহাংশুবাবু বললেন, কী চিন্তা যে হয়েছিল আমার। তবে তোমরা যে একটি ছেলের জীবন রক্ষা করতে পেরেছ তাতে তিরস্কার নয়, তোমাদের দু’জনকেই পুরস্কার দেব আমি। কী চাই বলো।

জয়ার মামা বললেন, আমার তরফ থেকেও একটা পুরস্কার ঘোষণা করলাম আমি।

পার্থর বাবা-মা বললেন, না না। ওদের দু’জনকে তো আমরাই পুরস্কার দেব। এই ছেলেকে যে ফিরে পাব তা আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। বাবা জগন্নাথ আমাদের ডাক শুনেছেন।

কিন্তু কীভাবে কী হল?

সব্যসাচী দুপুর থেকে সন্ধে পর্যন্ত আগাগোড়া সমস্ত ঘটনার কথাই বলল সকলকে।

পুলিশও সব শুনল।

সব্যসাচী কিন্তু ভুলেও সেই দু’জনের কথা বলল না কাউকে। পুলিশ যখন পার্থর মা-বাবা ও পার্থকে নিয়ে ব্যস্ত, ওরা তখন যে যার ঘরে ফিরে এল।

সবার মনেই আনন্দ। বিশেষ করে এই সময়টুকুর মধ্যে জয়ার মামা ও স্নেহাংশুবাবুর রীতিমতো বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠায় সব্যসাচী খুশি হল খুব। কেন না এরপর থেকে ওদের মেলামেশায় বা ঘুরে বেড়ানোর ব্যাপারে মনে হয় কোনও বাধা-বিপত্তি আর আসবে না।