তিন
সাধারণত যা হয় অর্থাৎ কিনা দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর সবাই একটু শুয়ে ঘুমোয়। বিশেষ করে সারারাত ট্রেন জার্নির পর ঘুম একটু আসেই চোখে। কিন্তু সব্যসাচীর চোখে ঘুম নেই।
মা-বাবা দু’জনেই শুয়ে ঘুমোচ্ছেন দেখে, ও একটু এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়ল। আসলে দিবানিদ্রা ওর হয় না। হবেই বা কেন? সারাটা দুপুর তো স্কুলেই সময় কাটে। ছুটির দিন ঘরে বসে বই পড়ে। বুক সেলফ ঠাসা বই ওর। পাণ্ডব গোয়েন্দার সব ক’টি খণ্ডই ওর আছে। আর আছে দুর্দান্ত একটা অ্যাডভেঞ্চারের বই, সোনার গণপতি হিরের চোখ।
সব্যসাচী বিছানা থেকে উঠে পা টিপে টিপে এসে দরজা খুলে বারান্দায় এল। তারপর আলতো করে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে এক্কেবারে ছাদের ওপর।
শীতের ঝলমলে রোদ্দুরে কী ভাল যে লাগল ছাদটা। ওই তো দূরে সমুদ্রের নীল জলরাশি কী সুন্দর দেখতে লাগছে। সব্যসাচী একভাবে সেইদিকে তাকিয়ে রইল।
হঠাৎ মুখের ওপর কীসের একটা আলো এসে পড়ল।
কী জোরালো সেই আলো। মনে হল কাচ বা অন্যকিছুর ওপর প্রতিফলিত হয়ে আলোটা ওর মুখে এসে লাগছে।
ও চোখদুটো বুজে একটু সরে দাঁড়াল।
সাময়িক বিরতি। তারপরে আবার। বেশ বোঝা গেল কেউ ইচ্ছে করেই করছে
এই কাণ্ডটা। কিন্তু সব্যসাচী বার বার চেষ্টা করেও দেখতে পেল না তাকে। আয়নায় রোদ্দুর ধরে অপরের মুখের ওপর ফেলা, এটা একটা দারুণ অসভ্যতা। অমার্জনীয় অপরাধ এটা। কিন্তু কী আর করা যাবে? যে করছে সে করেই লুকিয়ে পড়ছে। আবার—আবার সেই প্রতিফলন।
সব্যসাচী দেখল এ সেই পাকলুর কাণ্ড। সেই ডানপিটে মেয়েটির কীর্তি। সামনের হলিডে হোমের ছাদে দাঁড়িয়ে এই কাজ করছে, আর লুকিয়ে পড়ছে। শুধু এইবারেই যা লুকিয়ে পড়ল না।
সব্যসাচী রেগে ওর দিকে তাকালে ও দুষ্টুর মতো মিষ্টি হাসল।
মেয়েটির ব্যবহারের উপযুক্ত জবাব দেবার এই সুযোগ। এ সুযোগ হেলায় হারাল না সব্যসাচী। সে কোনওরকম প্রশ্রয় না দিয়ে বারান্দায় নেমে এল। ওর মুখের দিকেও তাকাবে না সে।
কিন্তু কী জ্বালা। বারান্দাতেও সেই একই উপদ্রব।
ও এবার দারুণ রেগে ঘরে ঢুকে গেল। তারপর হঠাৎ কী মনে হতেই সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে নীচে নেমে রাস্তা পার হয়েই সামনের হলিডে হোমে। কাউকে কোনও কথা না বলে তর তর করে একেবারে ছাদে।
মেয়েটি তখনও আলশের ধারে ঝুঁকে ওকে খুঁজছে।
ও একেবারে পেছনদিক থেকে গিয়েই শক্ত করে চেপে ধরল ওর হাতদুটো। মেয়েটি দারুণ ভয় পেয়ে ঘুরে তাকাল ওর দিকে।
সব্যসাচী বলল, ঘুঘু দেখেছ, কিন্তু ফঁাঁদ দেখনি। এইসব বদ অভ্যাস তোমার কতদিনের?
হাত ছাড়ো বলছি। আমার গায়ে হাত দেবার সাহস তোমার কী করে হল? ঠিক যেমন করে আমার মুখের ওপর আলো ফেলার দুঃসাহস হয়েছে তোমার।
মেয়েটি আর কোনও উত্তর দিতে পারল না। কিছু সময় নীরব থেকে বলল,
তুমি খুব শক্ত করে ধরেছ আমাকে, ছাড়ো।
সব্যসাচী হাত ছেড়ে সরে দাঁড়াল।
মেয়েটি বলল, তুমি সমুদ্রে এলে না কেন?
কী করে যাব? আমার বাবা-মা কেউ যে গেলেন না।
কেন গেলেন না?
আসলে ওই ছেলেটির ব্যাপারে মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল তাই। কিন্তু তুমি তখন আমাকে চিনেও অমন না চেনার ভান করে চলে এলে যে?
তুমি একটা রামবুদ্ধু। আমার মামা ছিলেন না? মামা অত্যন্ত কড়া লোক। কারও সঙ্গে বেশি কথা বলা একদম পছন্দ করেন না। বিশেষ করে সমবয়সি ছেলেদের সঙ্গে কথা বললে মামা মারাত্মক খাপচুরিয়াস।
তোমার বাবা-মা আসেননি?
না। আমার মা নেই। বাবা আবার বিয়ে করেছেন। তাই আমি মামার বাড়িতে মানুষ।
সব্যসাচী এবার একটু নরম হয়ে স্নেহভরা গলায় বলল, আমার ব্যবহারের জন্য তুমি কিন্তু কিছু মনে কোরো না। আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম তোমার ওপর।
রাগটা হঠাৎ পড়ে গেল কেন? আমার মা নেই, বাবা থেকেও নেই, এই সব শুনে?
উঁহু। তা হলে তো তোমাকে দয়া দেখাতে হয়। আসলে তুমি খুব সহজ, সরল।
আর কী?
ভীষণ ছেলেমানুষ।
মেয়েটি খিল খিল করে হেসে উঠল। তারপর বলল, তুমি আর থেক না এখানে। আমার মামা যদি ওপরে উঠে আসেন আর তোমার সঙ্গে কথা বলছি দেখতে পান তা হলে কিন্তু রেগে যাবেন খুব। তুমি বরং তোমাদের ছাদে চলে যাও, আমি এখানে থাকি।
সব্যসাচী বলল, যা তুমি বলবে। বলেই চলে আসতে যাচ্ছিল।
মেয়েটি হঠাৎ ছুটে এল ওর দিকে। বলল, কী বললে তুমি? যা আমি বলব? এখন যদি আমি বলি তুমি সমুদ্রের ধারে গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করো, তাই তুমি করবে?
সব্যসাচী বলল, নিশ্চয়ই করব।
তোমার মা-বাবা বকবে না?
ওরা এখন ঘুমোচ্ছেন।
তা হলে এক কাজ করো, তুমি এই পাশের রাস্তাটা দিয়েই সমুদ্রে চলে যাও। আমি এদিকটা একটু ম্যানেজ করেই যাচ্ছি। দেরি হলে রাগ কোরো না যেন। তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে আমার।
মেয়েটির কথায় ঘাড় নেড়ে সব্যসাচী হলিডে হোমের বাইরে এল। তারপর গৌরবাটশাহীর পথ ধরে সোজা সমুদ্রতীরে। শীতকাল হলে কী হয়, কী চড়া রোদ এখানে। তবুও ও বালিয়াড়ির ওপরে পড়ে থাকা একটা কালো রঙের আধভাঙা জেলেডিঙির পাশে গিয়ে চুপ করে বসে রইল।
এই মেয়েটিকে কেন কে জানে খুব ভাল লেগেছে ওর। কী সুন্দর গোলাপি আভা মেয়েটির। আর ভারী মিষ্টি ওর মুখ। শুধু একটু যা চঞ্চল প্রকৃতির।
তা হোক, এমন একটি মিষ্টি মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলে ক্ষতি কী?
সব্যসাচী অনেকক্ষণ বসে থাকার পরও যখন মেয়েটি এল না তখন সে মনে মনে অত্যন্ত রেগে গেল। এত ফাজিল কেউ হয়? নিশ্চয়ই ওকে সমুদ্রে পাঠিয়ে ওর ধৈর্য পরীক্ষা করবার জন্য এই কীর্তি করেছে সে। এরপর হতাশ হয়ে, বিরক্ত হয়ে যখন ও ফিরে যাবে তখন আবার হয়তো আয়নার রোদ ওর মুখে ফেলে খিল খিল করে হাসবে।
খুব রেগে গেছ তো ল্যাদারুশবাবু?
সব্যসাচী ঘুরে তাকিয়ে দেখল মেয়েটি ওর ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে ওকে এই কথা বলছে।
সব্যসাচী বলল, এত দেরি হল যে?
ওমা দেরি কোথায়? তুমি চলে আসার পরই তো আমি এলাম।
মিথ্যে কথা বলবার জায়গা পাওনি? আমি ঠায় ওইদিকে চেয়ে বসে আছি। মাঝে মাঝে সমুদ্রও দেখছিলে। বালিতে হিজিবিজি কাটছিলে
কিন্তু এর ফাঁকে তুমি এলে কখন?
অনেকক্ষণ। আমি তো ওইপথে আসিনি। এসেছি হরিদাস স্বামীর সমাধিমন্দিরের পাশ দিয়ে। আমি কখন যে এসে এখানে দাঁড়িয়েছি তা তুমি টেরও পাওনি।
কেন ওদিক দিয়ে এলে কেন?
তুমি যখন বোকার মতো এদিকে তাকিয়ে থাকবে, আমি তখন অন্যদিক থেকে এসে তোমাকে চমকে দেব বলে।
সব্যসাচী বলল, তুমি একটি হাড়বজ্জাত মেয়ে।
মেয়েটি বলল, তুমি খুব রেগেছ। নাও, আমার দিদিমার তৈরি কুলের আচার খাও।
মেয়েটি একটা পলিপ্যাকের মধ্যে করে আনা কুলের আচার বের করে সব্যসাচীকে দিল। তারপর দু’জনে দু’জনের দিকে চেয়ে একটু একটু করে সেই আচার খেতে লাগল।
সব্যসাচী বলল, এবার বলো কেন ডেকেছিলে। তুমি না বলেছিলে আমার সঙ্গে অনেক কথা আছে, কী সে কথা?
মেয়েটি বলল, তার আগে বলো তোমার নাম কী? নামটাই তো জানা হল না। আমার নাম সব্যসাচী। তোমার নাম?
আমার নাম আন্নাকালী।
ধ্যাত। তোমার মতো মেয়ের ওই নাম হয় নাকি? ঠিক করে বলো।
আমার নাম জয়া।
হ্যাঁ। এই তোমার ঠিক নাম। আমি যতগুলো এই নামের মেয়ে দেখেছি তারা সবাই ভীষণ খেয়ালি হয়। ডানপিটে হয়।
সব্যসাচীর কথা শেষ হতেই ফোঁস করে উঠল জয়া। বলল, ওরে চোরাবালি। তুমি তা হলে অনেক মেয়ের সঙ্গেই মিশেছ। যাও খোকন ঘরে যাও। যে সব ছেলে মেয়েদের সঙ্গে বেশি মেশে আমি তাদের পাত্তা দিই না।
সব্যসাচী বলল, বাঃ রে। আমার কাকিমার মেয়ের নাম জয়া। সে ড্যাং-গুলি খেলে মাথা ফাটিয়েছিল। আমার পাশের বাড়ির বকুলদির ছোট বোন জয়া। সে একবার পেয়ারাগাছের ডাল থেকে লাফিয়ে পড়ে পা ভেঙেছিল। আর আমার মামার বাড়ি হরিপালের যে কাজের মেয়েটা, সে পাড়ার একটা ছেলেকে ঝাঁটা দিয়ে এমন পিটিয়েছিল যে সেই থেকে তার নামই হয়েছিল রায়বাঘিনী।
জয়া তখন আপন মনেই কোনওদিকে না তাকিয়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চলেছে।
সব্যসাচী যেতে যেতে বলল, কী ব্যাপার! কথা বলছ না কেন? তুমি কি আমার ওপর রাগ করলে? আমি কিন্তু জয়া নামের আরও একটি মেয়েকে জানি, যে খুব কথায় কথায় মাথাগরম করে, যে খুব ভ্যাংচায়, যে আয়নায় রোদ্দুর ধরে ছেলেদের মুখে ফেলে।
জয়া রাগত অথচ হাসি হাসি মুখে ঘুরে তাকিয়ে বলল, উঃ। একটান! কী সব বকে চলেছ পাগলের মতো? তোমার টেপ রেকর্ডারটা একটু থামাবে? টেপ রেকর্ডার?
হ্যা। তোমার ওই মুখটা একটু বন্ধ করো। সমুদ্রের ডাক শোনো। জলের ভাষা বোঝো।
ও আমি বুঝতে পারব না। কিন্তু তুমি আমাকে কী জন্যে ডেকেছিলে সেটা তো কই বললে না?
জয়া এবার থমকে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে সব্যসাচীর মুখের দিকে তাকাল। তারপর ওর চোখে চোখ রেখে বলল, ওঃ হো। কেন ডেকেছিলাম বলো তো? সেটা তুমিই জানো।
জয়া উল্লসিত হয়ে বলল, হ্যাঁ মনে পড়েছে। তুমি আমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবে?
কোথায়?
সেখানে একা যেতে আমার সাহস হচ্ছে না।
কতদূরে সে জায়গাটা ?
জানি না। তবে দূর আছে। এই যে দেখছ পথটা সোজা দূরের দিকে চলে গেছে—সারিবদ্ধ পাখার সারি, ওই দিকে।
সব্যসাচী সেইদিকে চেয়ে থেকে বলল, এই পথটা সকাল থেকে কেন জানি না আমাকেও টানছে।
কাল থেকে আমাকেও। ওই দেখো, দূরে বহুদূরে আবছা কালো মতো কী যেন একটা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওটা একটা পাহাড়। কে যেন একজন সকালেই বলছিল ওই জায়গাটা নাকি ভারী সুন্দর। ওখানে একটা নদী এসে মিলেছে সমুদ্রে।
তার মানে মোহানা।
তাই হবে। যাবে ওদিকে? আমার সকাল থেকে কেবলই মনে হচ্ছিল মনের মতো একজন সঙ্গী পেলে ওখানেই যাই।
সব্যসাচী বলল, ফিরতে দেরি হয় যদি?
কী আর হবে? না হয় একটু বকুনি খাব।
চলো তবে।
কুলের আচার খাওয়া শেষ হয়েছে। ওরা দু’জনেই তখন চটচটে এঁটো হাতটা কদমে দূরের দিকে এগিয়ে চলল।
সমুদ্রের জলে ধুয়ে ভিজে বালি মাড়িয়ে জোর পশ্চিমি রোদ তখন ওদের মুখের ওপর।
চারদিকে তখনও কত লোক। কত স্নানার্থী।
কত জেলে জাল ফেলে মাছ ধরছে।
কত সামুদ্রিক পাখি ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার ওপর। মরা কাছিমের পচা গন্ধ নাকে আসছে।
জগৎ পারাবারের তীরে এই দুই কিশোরকিশোরী তখন প্রাণের জোয়ারে যেন ভেসে চলেছে এক অজানার উজানে। ওদের মনে আনন্দ আর ধরে না।