সব্যসাচীর গোয়েন্দাগিরি – ২

দুই

জানুয়ারি মাসের নির্মেঘ আকাশ থেকে নরম রোদ যখন গলে গলে পড়ে, চারদিক তখন ঝলমল করে। কী সুন্দর, কী মিষ্টি, কী অপূর্ব। হলিডে হোমের বারান্দা থেকে পথের দৃশ্য দেখতে দেখতে দূরের সমুদ্রের দিকে তাকাল সব্যসাচী। সমুদ্র এখান থেকে দেখা যায়, তবে বালুচরে ঢেউ ভেঙে পড়ার দৃশ্য নজরে আসে না। অথচ হলিডে হোমের সামনে দিয়েই সমুদ্রে নামার পথ। কিন্তু অদূরে একটি একতলা বাড়ি এমনই বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে-সেটার জন্য ঢেউ দেখা অসম্ভব।

সব্যসাচী সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠল।

এবার সমুদ্রকে বহুদূর পর্যন্ত আরও ভাল করে দেখা যাচ্ছে। নজরে আসছে আশপাশের অনেক গাছপালার সবুজ দৃশ্য। আর দূরে একটা মন্দির। দুরন্ত হাওয়ায় পত পত করে লম্বা ফিতের মতো ধ্বজা উড়ছে তার। ওটা নিশ্চয়ই পুরীর মন্দির। টি ভি-তে সিনেমায়, খবরের কাগজে, ক্যালেন্ডারের পাতায় কত ছবিই তো দেখেছে ওই মন্দিরের। ও মন্দির কি চিনিয়ে দিতে হয়?

সব্যসাচী দু’হাত জোড় করে প্রণাম করল।

ছাদের মাঝখানে সতরঞ্চি বিছিয়ে পাজামা আর স্যান্ডো গেঞ্জিপরা এক যুবক কতকগুলো খাতাপত্তর নিয়ে কী যেন লেখালিখি করছিলেন। যুবকের গায়ের রং ফর্সা। চাপ দাড়ি। একটু ছিপ ছিপে লম্বাটে ধরনের চেহারা। যুবক একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন সব্যসাচীকে। তারপর নস্যির ডিবে থেকে নস্যি বার করে এক টিপ নিয়ে আবার কাজে মন দিলেন।

সব্যসাচী ভাল করে লক্ষ করল যুবককে। কেমন যেন গম্ভীর আর ভারিক্কি বলে মনে হল। তবুও সে যুবকের কাছে গিয়ে বলল, আপনি নিশ্চয়ই দু’নম্বর ঘরে আছেন?

তোমরা তিন নম্বরে উঠেছ তাই না?

আপনি কী করে জানলেন?

সাধন বলছিল।

সাধন কে?

সাধন নয়, সাধনদা। এখানকার কেয়ার টেকার।

সব্যসাচী জিভ কেটে বলল, স্যরি। উনি তো আমার সাধনদাই হবেন।

খুব ভাল ছেলে।

কে? আমি, না সাধনদা?

তুমি ভাল ছেলে একথা এখনই বলি কী করে? দু’চার দিন থাক। দেখি, তবে তো! ক’দিন থাকবে তোমরা?

জানি না। বাবার তো এক সপ্তাহের ছুটি। ফেরার রিজার্ভেশন পাইনি আমরা, তাই যে কোনওদিন চলে যেতে পারি।

আসতে-না-আসতেই চলে যাবার কথা বলতে নেই। কোনারক, ভুবনেশ্বর যাবে নিশ্চয়ই? ঠিক বলতে

পারব না।

যদি যাও, বাবাকে বলবে মিশ্রজির ছেলের দোকানে যোগাযোগ করতে। সামনেই গুমটি ওদের। ওরাই বাসের ব্যবস্থা করে দেবে।

সব্যসাচী ছাদের চারপাশ একবার ঘুরে নিয়ে বলল, আপনি একা এসেছেন বুঝি?

যুবক মুখ মুচকে সামান্য একটু হেসে বললেন, পৃথিবীতে সবাই একা আসে, একাই যায়।

কে বলল! যমজ ভাইরা তো একা আসে না। আর বাস খাদে পড়লে সবাই তো একসঙ্গেই যায়।

যুবক কিছুক্ষণ অবাকচোখে তাকিয়ে রইলেন সব্যসাচীর দিকে। তারপর বললেন, তুমি অত্যন্ত ব্রিলিয়ান্ট ছেলে তো! কী নাম তোমার? আমার নাম সব্যসাচী।

থাক কোথায়?

কলকাতার বেহালায়।

আমি তো ম্যানটনে থাকি।

আমরা থাকি পড়ুই দাস পাড়া রোডে। নবপল্লীর কাছে।

এমন সময় দোতলা থেকে মায়ের গলা শোনা গেল, খোকা! খোকা! সব্যসাচী সাড়া দিল, যাই মা। তারপর বলল, মা ডাকছেন। এখন আসি, কেমন? পরে আপনার সঙ্গে কথা বলব। বলেই তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল দোতলায়।

মা বললেন, কীরে! ওপরে কী করছিলি?

কিছু না। চারদিকের দৃশ্য দেখছিলাম।

নে। কিছু খেয়ে নে। নিয়ে চল সমুদ্রের ধার থেকে একটু ঘুরে বাজার করে নিয়ে আসি।

মাসি কাছেই ছিল। বলল, না না। রান্না করে যদি খেতে চান, তা হলে আগে বাজার করে নিয়ে আসুন। তারপরে যেখানে ইচ্ছে যান। আর যদি হোটেলে খান, তা হলে আলাদা কথা। ছোট্ট বাজার এখানকার। এখুনি সব শেষ হয়ে যাবে।

স্নেহাংশুবাবু বললেন, আমার মতে আজ আর রান্নার ঝামেলা না করে হোটেলে খেলেই হয়।

সরমা বললেন, হোটেলে খাব কেন? এখানে যখন এমন চমৎকার ব্যবস্থা রয়েছে, তখন শুধু শুধু হোটেলে বেশি পয়সা দিয়ে বাজে খাবার খেয়ে লাভ কী? আগে ঘুরে গিয়ে দেখি চলো, কোথায় কী পাওয়া যায়, তারপর যা হয় হবে। স্নেহাংশুবাবু বললেন, যা তোমার ইচ্ছা।

এরপর সবাই মিলে জলযোগ পর্ব শেষ করে বাইরে এলেন।

হলিডে হোম থেকে বেরিয়ে ডানদিকে দু’পা যেতেই চোখে পড়ল জমজমাট বাজার। কত আনাজপত্তর, শাক-সবজি কত কী। মাছ-মাংস-ডিম সবই পাওয়া যায়। প্রত্যেক দোকানে কেরোসিনও আছে। তাদের কাছ থেকে চাল, ডাল, তেল, নুন, মশলা কিনলেই তারা প্রয়োজন মাফিক কেরোসিন দেবে।

সরমা প্রথমেই একটা ভাঙড় মাছ কিনলেন। একদম টাটকা। তারপর কিছু কাঁচা আনাজ। একটা টাকা দিতেই মাছ কেটে বেছে দিল ওরা।

স্নেহাংশুবাবু সেগুলো চট করে হলিডে হোমে রেখে এসে সরমা ও সব্যসাচীকে নিয়ে বেড়াতে চললেন সমুদ্রের দিকে।

সমুদ্রের ঢেউ যত না তোলপাড় করে, সব্যসাচীর মন তার চেয়েও অনেক বেশি তোলপাড় করে সমুদ্রের কাছে যাবার জন্য। যদিও রিকশায় বসেই সমুদ্রদর্শন হয়ে গেছে, তবুও পায়ের পাতায় সাদা সাদা ফেনাগুলো মাখবার জন্য মনপ্রাণ যেন উতলা হয়ে উঠল।

যেতে যেতে একসময় একটি ভাঙা বাড়ির আড়াল সরে যেতেই চোখে পড়ল সমুদ্র। একটা পিচ বাঁধানো রাস্তা দূরের দিকে চলে গেছে। সেখানে সারি সারি কতকগুলো স্তম্ভের ওপর পাখা লাগানো। সব্যসাচী বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ওগুলো কীসের পাখা?

স্নেহাংশুবাবু বললেন, আমিও ঠিক জানি না। তবে মনে হয়, এগুলো ঘোরার ফলেই বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে এখানে।

ওরা রাস্তাটা পার হয়ে সমুদ্রবেলায় নামল। সেখানে বালির ওপর কত পরিত্যক্ত নৌকো রয়েছে দেখল। সেগুলোর মধ্যে কোনও কোনওটিতে মেরামতির কাজও চলছে।

সব্যসাচী হঠাৎ একটি ঢেউকে বালুচরে আছড়ে পড়তে দেখে ‘হুরররে’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। তারপর একছুটে একেবারে জলের কাছে।

সরমা চেঁচিয়ে বললেন, বেশি জলে যাস না খোকা। তোর অভ্যেস নেই। সব্যসাচী সে কথার উত্তর না দিয়ে অল্প জলেই তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাগল।

হঠাৎ একটি মেয়ে ওর পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলে গেল, জাস্ট লাইক এ মাংকি।

রাগে মাথাটা গরম হয়ে উঠল সব্যসাচীর। ওর চেয়েও কম বয়স মেয়েটির। এত সাহস তার! সেও তাই চেঁচিয়ে বলল, তুমি একটি আউলনী।

মেয়েটি এবার ফিরে এসে রেগে ওর মুখোমুখি হয়ে বলল, তার মানে? আউলনীটা আবার কোন শব্দ? কোনও ডিকসেনারিতে তো নেই।

আউল মানে কী? প্যাঁচা তো? তা হলে আউলনী মানে?

প্যাচানী।

তুমি একটি প্যাঁচানী।

আমি প্যাচানী? আমাকে প্যাঁচার মতন দেখতে? জান সবাই আমার ফেস কাটিং-এর কত প্রশংসা করে?

তুমি জান, আমাকেও সবাই রাজপুত্তুর বলে।

তুমি রাজপুত্তুরই তো।

তা হলে কেন আমাকে তুমি বাঁদরের সঙ্গে তুলনা করলে?

কেন করব না? তোমার কি বোঝা উচিত ছিল না, আমি তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই?

কী করে বুঝব? আমি কি তোমাকে কখনও দেখেছি?

আমি কিন্তু দেখেছি তোমাকে।

কী করে দেখলে?

একটু আগে তুমি যখন এই রাজপুত্তুরের মতো চেহারা নিয়ে বোকা বোকা মুখ করে ছাদে ঘুরছিলে, তখনই দেখেছি। আমি তোমার সামনের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখছিলাম। কিন্তু তুমি একবারও আমার দিকে তাকালে না। এতে আমার মনে দুঃখ হয় না বুঝি?

সব্যসাচী হেসে ফেলল এবার। বলল, ওঃ এই কথা? তা হলে ঠিক আছে, আমার কথা আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি।

আমার কথাও আমি ফিরিয়ে নিলাম তা হলে। যাকগে, তোমরা তো এই একটু আগে এলে। ঢেউ খেতে আসবে কখন?

এখন বাড়ি ফিরে মা রান্নাবান্না শেষ করলেই আসব।

আমরাও তাই। বারোটা একটা হবে। ওই সময়ে এসো, আমরা দু’জনে একসঙ্গে ঢেউ খাব কেমন? আমার এখন খুব সাহস হয়ে গেছে। আমরা তিনদিন এসেছি। কত ঢেউ যে খেয়েছি তার ঠিক নেই। তোমাকে আমি ঢেউ খাওয়া শিখিয়ে দেব। C

কিন্তু আমার যে খুব ভয় করবে। জলকে আমার দারুণ ভয়।

সাঁতার জান না বুঝি?

না। তা ছাড়া সাঁতার জানলেও এই মহাসমুদ্রে সাঁতার কাটবে কে? আমিও সাঁতার জানি না। একদিন শুধু নুলিয়া ধরে নেমেছিলাম। তারপরেই ভয়টা কেটে গেছে। কোথা থেকে এসেছ তোমরা? ?

বেহালা থেকে। তুমি

তানপুরা থেকে।

তানপুরা! সেটা আবার কোথায়?

সেটাও আছে মশাই। লিলুয়ার পরে যেমন হালুয়া আছে, বেহালার পরেই তেমনি তানপুরা আছে। বড়িশার নাম শুনেছ? বড়িশা চণ্ডীতলা? আমি সেই চণ্ডীতলার মেয়ে। সবাই আমাকে রণচণ্ডী বলে।

বলো কী! আমরা তো প্রতিবছর মেলার সময় ওখানে ঠাকুর দেখতে যাই। আমিও প্রতিবছর মেলার সময় ওখানে আমার বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে বেড়াই। ভলেন্টিয়ার হই। ফাংশনে গান গাই। যাকগে, আমার মামা, মামি, দিদিমা ওরা অনেকটা এগিয়ে গেছে। আমি এখন আসি, কেমন?

বেলায় আসছ তো?

বয়ে গেছে। ল্যাদারুশ ছেলেদের সঙ্গে আমি মিশি না। বলেই একটা ভেংচি কেটে দৌড়ে পালাল মেয়েটা।

ততক্ষণে স্নেহাংশুবাবু ও সরমা এসে পড়েছেন।

সরমা বললেন, কেরে মেয়েটা?

জানি না। ও বলল, ও নাকি একটা রণচণ্ডী। বড়িশায় থাকে।

কী বলছিল তোকে?

কিছুই না। এমনি আলাপ হল। আমাদের সামনের হলিডে হোমে উঠেছে ওরা। বেশ দেখতে তো মেয়েটিকে। ভারী ফুটফুটে। ঠিক যেন প্রজাপতির মতো পাখা মেলে উড়ে গেল, তাই না?

স্নেহাংশুবাবু বললেন, প্রজাপতি, চামচিকে কত কী-ই তো দেখলে। এখন ঢেউ দেখো, ঢেউ দেখো। যা দেখলে কাজ হবে। ওই দেখো, কত বড় একটা ঢেউ কীভাবে ছুটে আসছে।

বলতে বলতেই একরাশ ফেনা নিয়ে ঢেউটা এসে এমন ভাবে আছড়ে পড়ল পায়ের কাছে যে জামাকাপড় সব ভিজে গেল। শুধু কী তাই, কত লোক যে উলটে পালটে পড়ল তার আর হিসেব নেই। সব্যসাচীও তিড়িংবিড়িং করছিল। কিন্তু উয়ের ধাক্কায় বালির ওপর এক আছাড়। তারপর জলের টানে হড় হড় করে নেমেও গেল খানিকটা। ভাগ্যে স্নেহাংশুবাবু সময়মতো ধরে ফেলেছিলেন। না হলেই হয়েছিল আর কী।

এমন সময় হঠাৎ এক জায়গা থেকে প্রচণ্ড একটা শোরগোল উঠল। কী হল কে জানে? সবাই ছুটল সেইদিকে। সব্যসাচীও ছুটল।

সরমা চেঁচিয়ে বললেন, খোকা ফিরে আয়। যাস না।

কিন্তু কে শোনে কার কথা।

সব্যসাচী গিয়ে দেখল এক জায়গায় এক ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা এবং তাঁদের ছেলেমেয়েরা বালির ওপর আছাড়কাছাড় করছে। বহু লোক জড়ো হয়ে তাঁদের ঘিরে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে।

কয়েকজন নুলিয়া হই হই করে ছুটল জলের দিকে।

ব্যাপার কী? না, এই পরিবারেই একটি ছোট ছেলে সমুদ্রতীরে কয়েকজনের সঙ্গে ছুটোছুটি করে খেলা করছিল। হঠাৎ করে একটি বড় ঢেউ এসে পড়ায়, সবাই বেসামাল হয়ে গেলে ছেলেটি হাতছাড়া হয়ে যায়। তারপর আর দেখা যাচ্ছে না তাকে। তার মায়ের সে কী কান্না। সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে সেই কান্নার স্বর যেন বালুচর কাঁপিয়ে দেয়।

নুলিয়ারা জলে নেমে জল তোলপাড় করে।

অন্যান্য স্নানার্থীরাও শুরু করে খোঁজাখুঁজি। কিন্তু না, সকলের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়।

সমুদ্র যে চোখের পলকে কোথায় নিয়ে গেল তাকে, তা কে জানে? ভিড় বাড়ে। পুলিশ আসে।

জেলেরা নাও নিয়ে জলে নামে। কিন্তু নিখোঁজের খোঁজ দিতে পারে না কেউ। ফলে বাধ্য হয়েই আশা ছেড়ে দিতে হয়।

এমন একটা মর্মান্তিক খবর শুনে কারই বা মাথার ঠিক থাকে? সরমা তাই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেন সব্যসাচীকে।

স্নেহাংশুবাবু বললেন, সময়মতো না ধরলে আমার ছেলেটাও তলিয়ে গিয়েছিল আর কী!

সেই ছেলেটির মা তখন চিৎকার করছেন, বাবা জগন্নাথ! কৃপা করো। হে সমুদ্রনারায়ণ! আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও। ও তো কোনও দোষ করেনি বাবা। আনন্দে নেচে নেচে তোমার কোলে খেলা করছিল। দয়া করে ওকে ফিরিয়ে দাও। তুমি অনন্ত—তুমি অপার— তুমি মহৎ— তুমি উদার। তুমি তো কারও কিছুই নাও না। তবে কেন ওকে অমন করে টেনে নিলে? হয় তুমি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও, না হলে আমাকেও তুমি নাও।

শোকার্ত জননীর বিলাপ কি এইভাবে কান পেতে শোনা যায়? তাই সব্যসাচীকে নিয়ে সমুদ্রতীর থেকে আবার হলিডে হোমে ফিরে এলেন স্নেহাংশুবাবু ও সরমা। কারও মুখে কথা নেই। কী কথাই বা বলবেন?

অনেক পরে স্নেহাংশুবাবু বললেন, এবারের জার্নিটাই আমাদের খারাপ। এক তো সকালে রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে ছেলেটা একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসল। তার ওপর এই এক দৃশ্য। প্রথম দিনেই মনটা গেল বিষিয়ে।

তাই না তাই।

সব্যসাচী বলল, বাবা! আমরা আজ সমুদ্রে স্নান করতে যাব না?

না বাবা। এইসব দেখেশুনে আজ আর নয়।

কত লোক তো স্নান করছে।

করবেও। দিঘায়, পুরীতে এসব হামেশা হয়। তবে কিনা আজই স্বচক্ষে এই দৃশ্য দেখার পর মন চাইছে না।

ওই ছেলেটাকে আর পাওয়া যাবে না?

নিশ্চয়ই যাবে। তবে জীবিত অবস্থায় নয়। তাও কখন কোনখানে যে ডেড বডি মিলবে ওর, তা কে জানে?

সরমা বললেন, আমার কিন্তু আর একদমই মন চাইছে না এখানে থাকতে। আজকের দিনটা এখানে থেকে কাল একটা রিকশা নিয়ে যা যা দেখবার দেখে পরশু সকালেই নীলাচল ধরে চলে যাই চলো।

সব্যসাচী ব্যথা পেয়ে বলল, সে কী মা। এত আশা নিয়ে এখানে এসে চলে যাবে তোমরা?

সরমা বললে, হ্যাঁ বাবা। কেন জানি না, আমার মনটা কেবলই কু-গাইছে। স্নেহাংশুবাবু দু’হাতের ভরে মাথা রেখে চুপ চাপ বসে রইলেন।

ছোট্ট ঘটনা। হামেশাই হয়।

তবু ছেলেটির সমুদ্রগ্রাসের খবর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র।

মুহূর্তের জন্য, কিছুসময়ের জন্য, হয়তো বা দু’চার ঘণ্টার জন্য সাবধান হবে সবাই। তারপর সবাই সব কিছু ভুলে যাবে। আবার আনন্দে উদ্দাম হয়ে, উত্তাল তরঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বে সবাই। এই সমস্ত ঘটনা তুচ্ছ মনে হবে তখন। এই বিষাদের সুর রেখাপাতও করবে না কারও মনের কোণে। হঠাৎ কানে এলে কেউ হয়তো বলে বসবে, অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট। কী আর করা যাবে। অমন কত হয়।

সময়ের নিয়মই এই। সময়ের ধর্মই এই।

স্নেহাংশুবাবু বাথরুমে গেলেন। সকাল সকাল স্নানটা সেরে নিতে হবে।

সরমা ঢুকলেন রান্নাঘরে।

সব্যসাচী অনেক বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে এক-পা দু’-পা করে নীচে এল। সেই দামাল মেয়েটা তখন ওর বাড়ির লোকেদের সঙ্গে হলিডে হোমে ফিরছে। এই মুহূর্তে কী স্মার্ট মেয়েটি। আড়চোখে একবার ওর দিকে তাকিয়ে দেখল বটে, তবে এমন ভান করল যেন চেনেই না।

সব্যসাচী মনে মনে ভাবল এর জবাব ও অবশ্যই দেবে। পাশাপাশি হেঁটে গেলে ফিরেও তাকাবে না ওর দিকে।