দশ
এবারে সব্যসাচীর কথায় আসা যাক। বেচারি সব্যসাচী। বাপিকে জয়ার মান ভাঙাবার জন্য ভেতরে পাঠিয়ে মন্দিরের বাইরে গিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। হঠাৎ মনে হল পেছন দিক থেকে কে যেন মুখে একটা রুমাল চাপা দিয়ে টেনে নিল ওকে। তারপর চোখের সামনে সবই যেন অন্ধকার।
না। ক্লোরোফর্ম বা ওই জাতীয় কোনও রাসায়নিকের প্রভাবে ও চোখে অন্ধকার দেখেনি। আসলে কালো কাপড় দিয়ে ওরা ওর মুখ ঢেকে দিয়েছিল। আর সেই রুমালের মিষ্টি গন্ধ নাকে যেতেই নিশ্বাস বন্ধ করেছিল সে। গোয়েন্দা গল্প পড়ে পড়ে ওর ভেতরটা এমনই তৈরি ছিল যে ও জানত এই অবস্থায় কী করতে হয়। পাণ্ডব গোয়েন্দার বাবলু বিলু ভোম্বল কিংবা বাচ্চু বিচ্ছু অথবা সোনার গণপতি হিরের চোখের বিল্টু তিন্নি শুভঙ্কর মউ ওর আদর্শ হয়ে উঠেছে।
তাই দম বন্ধ করে দু’-একবার ছটফট করার ভান করে স্থির হয়ে রইল।
ওরা ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে চলল কোথায় যেন। মন্দিরের পেছন দিকের একটা মাঠে সকালের সেই মারুতিটা রাখা ছিল। ওরা তাইতে করে নিয়ে চলল ওকে।
সব্যসাচীর প্যান্টের পকেটে তখনও ছিল সেই মূল্যবান জিনিসটা। ও ভাবল, এবার নিশ্চয়ই ওরা সার্চ করে কেড়ে নেবে জিনিসটা। কিন্তু সেটা যে ওর কাছেই আছে তা কি জানতে পেরেছে ওরা?
কিন্তু না। ওরা কিছুই করল না ওর।
সব্যসাচী সজ্ঞানে থেকেও অজ্ঞান হওয়ার ভান করে শুনতে লাগল ওদের কথাবার্তা।
মারুরিতে দু’জন ছিল। একজন বলল, তোমরা কি ভুলের পর ভুল করে যাবে? আমি বারবার বলেছিলাম এটাকে স্টেটের বাইরে পাচার করে দাও, কিন্তু শুনলে না। এখন—।
এখন কী? পুলিশের চোখের সামনে দিয়ে এই গাড়ি নিয়ে উধাও হয়ে যাব, পুলিশও টেরও পাবে না।
ওইরকম চালাকি করতে গেলে ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকতে হয়। কিন্তু এইসব ফাঁকা জায়গায় বিপদের সম্ভাবনা যে কত তা কি তোমাদের বুঝিয়ে বলতে হবে?
সেটা অবশ্য ঠিক। এখন ছেলেটাকে যথাস্থানে পৌঁছে দিয়েই এটাকে একটা ট্রাকে উঠিয়ে ঢাকাঢুকি দিয়ে পাচার করা হবে।
কিন্তু ছেলেটাকে কিডন্যাপ করার আদৌ কি কোনও প্রয়োজন ছিল?
না। তবে যে মুহূর্তে শুনতে পেলাম ছেলেটি এইদিকে এসেছে তখনই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।
তার মানে পুলিশ এবং তদন্তকারী গোয়েন্দাদের ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দেওয়া হল যে আমরা এই অঞ্চলেরই আশপাশে আছি।
এছাড়া কোনও উপায় ছিল না।
কেন, আসল মালটিকে ধরে আনলে ক্ষতিটা কী ছিল?
ক্ষতি ছিল বইকী। তার কাছ থেকে ওই জিনিসটা কি উদ্ধার হত তা হলে? এখন এই ছেলেমেয়েদুটোকে আটকে রেখে ওকে বাধ্য করাব জিনিসটা আমাদের হাতে তুলে দিতে।
প্রথম লোকটি এবার দারুণ রেগে বলল, তা হলে কেন ওই দুর্ঘটনা ঘটালে। লোকটা যদি মরেই যেত?
আপদ চুকে যেত তা হলে।
ও। লোকটা মরে গেলে জিনিসটার পা গজাত আর সেটা হেঁটে এসে আমাদের পকেটে ঢুকত, তাই না?
দ্বিতীয় লোকটি এ কথার কোনও উত্তর দিল না। গাড়ি এসে থামল একটা বনময় প্রান্তরে।
গাড়িতে দু’জনই মাত্র লোক ছিল। একজন ছিল চালকের আসনে, আর একজন সব্যসাচীর কাছে। ওরা গাড়ি থেকে নেমে ছোট্ট একটি টিলার পাশ দিয়ে ওকে কাঁধে নিয়ে এগিয়ে চলল। তারপর একটি পুরনো ধরনের বাড়ির কাছে এসে থামল।
ভেতর থেকে কে যেন একজন বেরিয়ে এসে বলল, এটা আবার কে? সম্ভবত বিজুর ভাইপোটাইপো কেউ হবে।
সবই তা হলে আন্দাজের ওপর চলছে? এদিকের খবর জানো তো, বীর সিং শ্যামাকে জ্যান্ত কবর দিয়েছে।
ওর অপরাধ?
সামান্য একটু ভুল। তদন্তকারী অফিসার মি. ভারতীর ছেলে শুভমের বদলে অন্য একটি ছেলেকে ধরে এনে সমস্ত পরিকল্পনাকে ভেস্তে দেওয়ার ফল। শ্যামা নেই!
না। তার চেয়েও মারাত্মক খবর, বীরাপ্পানের দল আইনজীবী জয়শংকরপ্রসাদকে কিডন্যাপ করেছে এবং পুলিশের সন্দেহ ওটা আমাদেরই কাজ।
সেই মেয়েটা এখন কোথায়?
ওকে এখানেই রাখা হয়েছে।
ছেলেটাকে তা হলে কী করব?
আপাতত জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত এইখানেই রাখো, দিনের বেলা কিছু করতে যেয়ো না। রাত্রিবেলা ওর পরিচয় জেনে ছেড়ে দিয়ে এসো দূরে কোথাও।
সব্যসাচী কানখাড়া করে শুনল সব। ওর অভিনয়ে কেউ জানতেও পারল না ও সচেতন আছে বলে। ওরা ওকে নীচের তলার একটি ঘরে তক্তাপোশের বিছানায় শুইয়ে মুখের ঢাকা সরিয়ে যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল। অবশ্য যাবার আগে দরজায় শিকল দিয়ে যেতে ভুলল না।
ওরা চলে যেতেই উঠে বসল সব্যসাচী। যা ভেবেছে তাই। তক্তাপোশেই একপাশে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে লিপি। মেয়েটা কেমন বিশ্রীরকমের বেঁকে কাত হয়ে শুয়ে আছে। দেখে মনে হয় ওষুধের প্রভাবে আচ্ছন্ন ভাবটা হয়তো একবার কেটেছিল, পরে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।
সব্যসাচী উঠে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করে দেখতে লাগল এখান দিয়ে পালাবার কোনও পথ পায় কি না। কিন্তু না। এই ঘরটি এতই ছোট যে, এই ঘরে দেওয়াল ছাড়া কিছু নেই।
একটা আলোবাতাস আসার মতন ব্যবস্থা আছে। দেওয়ালের উপরিভাগে মোটা মোটা লোহার রড দিয়ে ভেন্টিলেটারের মতো করা। তাতে পাল্লা নেই। কিন্তু সেটা এমনই উঁচুতে যে সব্যসাচী চেষ্টা করেও তার নাগাল পেল না। তাই প্রাকৃতিক অবস্থান চোখে না দেখেও অনুমান করা গেল। অর্থাৎ ঘরটা নীচের তলায় হলেও ঠিক আন্ডারগ্রাউন্ডে নয়। জায়গাটা উঁচুনিচু হওয়ার জন্য সামনের দিক থেকে যেটা একতলা বলে মনে হয় আসলে সেটাই দোতলা। এটা হল নীচের তলায়। বাড়িটা বহু পুরনো। এককালে হয়তো কোনও বড়লোকের বাগানবাড়ি ছিল। এই ঘরটা এত ছোট যে এখানে হয়তো ঘুঁটেকয়লা ইত্যাদি রাখা হত। কিন্তু মুশকিল যেটা, সেটা হল, ওই একটি মাত্র দরজাকে ভেঙে না বেরোতে পারলে এখান থেকে পালানো অসম্ভব।
সব্যসাচী অকারণেই ঘরময় পায়চারি করল। একপাশে ছোট একটি টি-টেবিলে কয়েকটা মাখনটোস্ট রাখা ছিল। আর ছিল এক কলসি জল। লিপির জন্যই রেখেছিল নিশ্চয়ই। ও খায়নি। ওষুধের প্রভাবে ও এখনও আচ্ছন্ন হয়ে আছে।
বেল৷ তো এখন অনেক হয়েছে। ওরা কি ওর জন্যও কিছু আনবে না? খিদেও পেয়েছে ওর। কলসিটা তুলে দেখল জল বেশ ভরতি আছে। ও দ্বিধা না করে দুটো টোস্ট চিবিয়ে খেয়ে ঢক ঢক করে জল খেল এক গেলাস। তারপর পকেটের জিনিসটা বার করে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল সেটাকে। কী এটা? কী আছে এর ভেতরে? বিজুদা কেন এটাকে লুকিয়ে রাখছেন। ওই দলের সঙ্গে কী সম্পর্ক বিজুদার? দুর্ঘটনায় বিজুদার আঘাত কতটা মারাত্মক? জয়া আর বাপিদা কি ওর খোঁজ করছে? নাকি ফিরে গিয়ে খবর দিয়েছে ওর বাবা-মাকে? কিছুই ভেবে পেল না সব্যসাচী।
দরজার পাল্লার কাঠ পুরনো। তবে বেশ মজবুত। ও দু’-একবার টেনে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু না। ওদিক থেকে শিকল থাকার জন্য একটুও ফাঁক করতে পারল না।
ও আবার লিপির কাছে এল। ওকে একটু টেনে ধরে সোজা করে শুইয়ে দিল। কী জ্বালা। মেয়েটা যদি সজ্ঞানে থাকত, তা হলেও ওর সঙ্গে কথা বলে সময় কাটত। কিন্তু এমনই আচ্ছন্ন যে—।
হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেহটাকে টান করে পাশ ফিরে শুল লিপি। সব্যসাচী ওর মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে আস্তে করে ডাকল, লিপি! লিপি! তন্দ্রার ঘোরেই লিপি একবার সাড়া দিল, উঁ।
একবার উঠে বসো। চেয়ে দেখো আমি কে? আমি সব্যসাচী। লিপি অবচেতন মনেই একটু হেসে আবার ঘুমোতে লাগল।
সব্যসাচী ওর হাতদুটো নিয়ে নাড়াচাড়া করল একটু। চোখ টেনে দেখল। কপালের ওপর হাত বুলিয়ে অবিন্যস্ত চুলগুলো ঠিক করে দিল। তবুও লিপির ঘুম আর ভাঙে না। সত্যি, কারা পাপ করে, কারা শাস্তি পায়। হঠাৎ বাইরে কার যেন পায়ের শব্দ।
সব্যসাচী এক মুহূর্তও দেরি না করে তক্তপোশের বিছানায় দেহটা এলিয়ে দিয়ে ঘুমের ভান করল। কে যেন একজন এল। চোখটা বুজে থাকায় চেহারাটা দেখা গেল না। সে এসে ওদের গায়ের কাছে ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখল। অর্থাৎ ওরা সজ্ঞানে কি অজ্ঞানে দেখল তাই। তারপর টেবিলের ওপর কী সব নাড়াচাড়া করে আবার চলে গেল দরজায় শিকল দিয়ে।
সে চলে যেতেই সব্যসাচী উঠে বসল। তারপর টেবিলের কাছে গিয়ে দেখল দুটো প্লেটে ওদের দু’জনের জন্য সামান্য কিছু ভাত আর বেগুনপোড়া রেখে গেছে। রাগে সব্যসাচীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, কচুপোড়া খাও অনামুখোরা।
হঠাৎ ওর কানে দূরাগত কিছু ঘণ্টার ধ্বনি ভেসে এল। তার মানে এই নির্জনে নিশ্চয়ই কোথাও কোনও আশ্রম অথবা দেবস্থান আছে।
সব্যসাচীর মাথায় এবার বুদ্ধি এল একটা। কলসি থেকে এক গেলাস জল নিয়ে একটু একটু করে ঝাপটা দিতে লাগল লিপির মুখে।
এই ওষুধেই কাজ হল। দু’-একবার জলের ঝাপটা দিতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে
বসল লিপি। কেমন যেন ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল, আমি কোথায়? তোমরা আমাকে কেন এখানে নিয়ে এসেছ? আমাকে ছেড়ে দাও। সব্যসাচী হঠাৎ ওর মুখ চেপে ধরে বলল, চু—উ—প।
এতক্ষণে ঘোর কাটল লিপির। চোখের সামনে সব্যসাচীকে দেখে সবিস্ময়ে বলল, সব্যসাচী তুমি! তুমি এখানে কেন? ওরা কী তোমাকেও ধরে এনেছে এখানে?
হ্যাঁ। তবে বলতে পারো আমি নিজেই ধরা দিয়েছি।
তুমি ধরা দিয়েছ?
ওরা তোমাকে গুম করল। তোমার কাকা, বিজুদাকে হত্যার চেষ্টা করল। আমি এই খবর হলিডে হোমে পৌঁছে দিলে তোমার বাবা-মা সবাই ছুটোছুটি করছেন। থানা-পুলিশ হচ্ছে। ইতিমধ্যে বাপিদা আর আমি তোমার খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। লোকনাথ মন্দিরের কাছে ওরা আমাকে আচমকা তুলে নিল। তারপর এইখানে এই ঘরে—।
লিপি এবার উঠে বসল।
সব্যসাচী বলল, শোনো, ওরা আমাদের দু’জনের জন্য সামান্য কিছু খাবার রেখে গেছে। আগে খেয়ে নিই এসো। পরে এখান থেকে পালাবার একটা মতলব করা যাবে।
কীভাবে কী করবে?
সেটা ঠিক করব পরে। আপাতত পেটায় নমো করা
যাক।
ওরা আর বাক্যব্যয় না করে বেগুনপোড়া দিয়ে মোটা চালের ভাত বেশ গোগ্রাসেই খেয়ে নিল। তারপর কলসির জলেই মুখহাত ধুয়ে সেই জল আকণ্ঠ পান করে তক্তপোশে এসে বসল দু’জনে।
সব্যসাচী বলল, দেখো লিপি, এই মুহূর্তে তোমার আমার দু’জনেরই জীবন বিপন্ন। কয়েকটি কথার তুমি ঠিক ঠিক উত্তর দাও। তুমি নেহাতই ছেলেমানুষ নও। আগে বলো কোন ক্লাসে পড় তুমি?
আমি ক্লাস নাইনে পড়ি।
এবার বলো তো, তোমার কাকা অর্থাৎ বিজুদা লোকটি কেমন? কী করেন? তাঁর সঙ্গে এই দলের এত বিরোধ কেন? তোমার কাকার দেওয়া একটা মূল্যবান জিনিস আমার কাছে এখনও আছে। এটার ব্যাপারে তুমি কী কিছু জান?
লিপি বলল, সব বলব তোমাকে। কিন্তু এত কাগুর পরও ওই জিনিসটা তোমার কাছ থেকে খোয়া যায়নি কী ভাগ্যিস।
আসলে ওদের কথাবার্তা শুনে আমার মনে হয়েছিল আমাদের দু’জনকে আটকে রেখে মুক্তিপণ হিসেবে ওই জিনিসটা ওরা তোমার কাকার কাছ থেকে আদায় করতে চায়।
সেজন্য তো আমাকে ওরা গুম করেছে। কিন্তু তোমাকে নিয়ে এল কেন?
হয়তো ওরা আমাকেও তোমাদের পরিবারের কেউ বলে মনে করেছিল। তা যাকগে, এখন আসল কথাটা বলো।
লিপি বলল, শোনো তবে, আমার কাকা বরাবরই একটু ডানপিটে এবং একরোখা ধরনের। বাবার মুখে শুনেছি কাকার মনের মধ্যে সবসময়ই কেমন যেন একটা বিদ্রোহী সত্তা কাজ করত। অন্যায় উনি কখনও বরদাস্ত করতেন না। এখনও করেন না। কারও মধ্যে কোনও বেয়াদপি দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে পিটিয়ে ঠান্ডা করে দিতেন। আসলে কাকার চেহারাটাও তো ভারিক্কি।
সব্যসাচী বলল, বিশেষ করে চাপ দাড়ির আড়ালে ওনাকে অত্যন্ত কঠিন পুরুষ বলেই মনে হয়।
অথচ ভেতরে উনি শিশুর মতো সরল।
এই ধরনের লোকেরা এইরকমই হয়।
তবে কাকার একটা ব্যাপারে আমি কিন্তু অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। কোন ব্যাপারে?
কাকা বরাবরই লেখাপড়ায় খুব ভাল। আমার কাকা ইংলিশে অনার্স এবং একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট।
বলো কী!
হ্যাঁ। সত্যিই উনি একজন আদর্শবাদী যুবক। বিয়ে করেননি। আমাকেও অত্যন্ত ভালবাসেন। বলতে গেলে ওই কাকার আদরেই আমি মানুষ। তা কাকা একসময় যে দলের সঙ্গে মিশতেন সেটা একটা রাজনৈতিক দল। সেই দলের জন্য উনি নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছিলেন। কিন্তু পরে যখন বুঝলেন দল বিভ্রান্ত এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে এমন কোনও জঘন্য কাজ নেই, যা তারা করতে পারে না, তখনই উনি সতর্ক হন এবং ওদের এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। কাকা আমার কাছে এক বিস্ময়। একজন ব্যাড টেম্পারমেন্টের মানুষ লেখাপড়ায় কী করে যে এত ভাল হয়, তা আমার ধারণারও বাইরে।
তারপরে বলো।
এইবারে যা বলব সেটা তুমি মন দিয়ে শোনো। তোমার কি মনে আছে বেশ কিছুদিন আগে রামেরাম আগরওয়ালা নামে কলকাতার একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি খুন হন?
হতে পারে। আমার মনে নেই।
ওই দলটি এই শিল্পপতিকে নানাভাবে ব্ল্যাকমেল করে। ইতিপূর্বে নিজের ব্যবসার সুরক্ষার খাতিরে মাঝেমধ্যেই প্রচুর টাকা ডোনেশান হিসেবে ওই দলটির হাতে তুলে দিয়েছেন তিনি। পরে বিরক্ত হয়ে তিনিও হাত গুটিয়ে নেন। ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে আমার কাকার যোগাযোগ ছিল। কাকা রামেরামবাবুর ব্যবসার কাগজপত্তর দেখতেন। ইনকাম ট্যাক্সের হিসেব রাখতেন। আর এই দলকে কীভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায় সে সম্পর্কেও পরামর্শ দিতেন। ইতিমধ্যে ওই দলের পাণ্ডারা আমার কাকাকে বেশ কয়েকবার হুমকি দিয়েছে। আর ওই ব্যবসায়ীকেও শাসিয়েছে তাদের সঙ্গে অসহযোগিতা করলে পরিণাম ভাল হবে না বলে। হলও তাই।
উঃ কী সাংঘাতিক।
আমার কাকা ওদের চেয়েও সাংঘাতিক। তাঁর বুদ্ধির চালে ফেঁসে গেল ওরা। দলের যারা রাঘববোয়াল তারা বুদ্ধি করে কোনওরকমে টিকে থাকলেও ছুটকোছাটকারা গা ঢাকা দিল। কাকা বুদ্ধি করে ওই ব্যবসায়ীকে সবসময় তাঁর ঘরে আসা-যাওয়া করত যারা তাদের কথাবার্তা টেপ করে রাখার পরামর্শ দিতেন। ফলে যে যখন যা বলে হুমকি দিত সবই ধরা আছে তাতে। বিশেষ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত এমন কিছু মানুষের কথাবার্তা টেপ করা আছে যা প্রকাশ হলে অনেকেরই মুখোশ এমনভাবে খুলে যাবে যে কেলেঙ্কারি রাখবার জায়গা থাকবে না। সেইসব টেপের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো অবশ্য আর একটি ক্যাসেটে বন্দি হয়ে আমার কাকার কাছে আছে। এবং সেই ক্যাসেটই এখন তোমার কাছে রয়েছে। ওই ক্যাসেট আদালতে পেশ করলে কী হবে আর কী যে হবে না তা কল্পনাও করা যাবে না। বিশেষ করে ওই ক্যাসেটে রামেরামজির মৃত্যুকালীন জবানবন্দিও ধরা আছে। দুষ্কৃতীরা সেদিন রাতে যখন তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে আসে, তখনই উনি তাদের চিনতে পারেন এবং টেপ চালিয়ে কয়েকজনের নাম ধরে চেঁচান। ওরা তাঁকে গুলি করে পালায়। আর রামেরামজি তাঁর শেষ কথাগুলো টেপ করে রাখেন। ঘটনাক্রমে আমার কাকা সে রাতে সেখানে গিয়ে পড়লে সেই ক্যাসেটটি তিনি উদ্ধার করেন। ইতিমধ্যে ওই ব্যবসায়ীর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে দু’জন জেল পলাতক। এরাও আবার এদেরই আর একটি বিরুদ্ধ দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
সব্যসাচী সবিস্ময়ে বলল, এ যে দেখছি রীতিমতো গোয়েন্দা গল্পের প্লট।
ইতিমধ্যে ওই মামলার তদন্তকারী ইনস্পেক্টর মি. ভাগবকে ওরা টাকা দিয়ে কেনবার চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি ওদের টোপ গেলেন না। ওই মামলার প্রখ্যাত আইনজীবী জয়শংকরপ্রসাদও ওদের আক্রমণের বলি হন। সম্প্রতি এই জয়শংকরের কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
স্ট্রেঞ্জ। কিন্তু একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না এই পুরীতে কলকাতার ওই হত্যাকাণ্ড বা তার পরবর্তী ঘটনাবলীর বদলাবদলির ব্যাপারস্যাপারগুলো এমন নাটকীয়ভাবে ঘটছে কী করে?
আসলে ওই ব্যবসায়ী রামেরাম আগরওয়ালার একটি হোটেল আছে রাজধানী ভুবনেশ্বরে। সেইটার ব্যাপারেও কিছু কাজ ছিল। সম্বলপুরের কাছে টিটলাগড় এবং বেরহামপুরের কাছে পলাশাতেও তদন্তের ব্যাপার ছিল একটু। আমাদের পুরী আসার আর এক কারণ ছিল আমার কাকার এই ব্যাপারে কিছু তদন্ত এবং খাতাপত্তরের কাজ করা। সেই তদন্তকারী ইনস্পেক্টর মি. ভার্গবও তাঁর ছেলেবউ নিয়ে এখানে এসেছেন। এসেছিলেন জয়শংকরপ্রসাদ। তবে ভুবনেশ্বরে না থেকে তাঁদের কাজকর্ম এই পুরীতে বসেই করতে চেয়েছিলেন। আমাদের এই হলিডে হোমে থাকার মেয়াদ শেষ হলে আমরা অন্যত্র চলে যেতাম। সেই মর্মে ঘরও বুক করা আছে।
সব্যসাচী ওর পকেট থেকে চামড়ার খাপে মোড়া বস্তুটা বের করে বলল, বুঝেছি। এই তা হলে সেই ক্যাসেট, যার জন্য এত। ভগবান রক্ষে যে এতকাণ্ডতেও হাতছাড়া হয়নি জিনিসটা।
এখন আমাদের চেষ্টা করতে হবে এটা যেন কোনওরকমেই হাত ছাড়া না হয়। সব্যসাচী বলল, তোমার মুখে সব শুনে আমার ভুল ধারণাটা ভাঙল। আমি কিন্তু তোমার কাকাকে অন্যরকম ভেবেছিলাম।
স্বাভাবিক। কিন্তু সব্যসাচী, এখন আমাদের এখান থেকে পালাবার কী হবে? সব্যসাচী বলল, আক্রমণ। আক্রমণ ছাড়া পথ নেই।
কীভাবে আক্রমণ করবে? কাকে করবে?
যে লোকটা আমাদের খাবার দিতে আসবে তাকে। ওই লোককে কবজা করতে না পারলে এখান থেকে আমাদের পালানো অসম্ভব।
আমরা কি পারব ওকে কবজা করতে?
পারতেই হবে। একাজে আশাকরি সফল হব আমরা। কেন না লোকটা একাই আসে এবং দু’হাতে খাবার নিয়ে। ও যখন ঘরে ঢুকবে তখন ওর দু’হাতে থাকবে খাবার। আমরা শিকল খোলার শব্দ পেলেই দু’জনে দরজার দু’পাশে লুকিয়ে পড়ব। তারপর আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ঘাড়ে।
লিপির মুখে হাসি ফুটল এবার।
সব্যসাচী বলল, আর দু’চার ঘণ্টা। বেলা গড়িয়ে আসছে। সন্ধেবেলা কিংবা সন্ধের পর রাতের খাবার নিয়ে আসবে ও। তখনই পালাব আমরা।
তুমি পথ চেন? কোথায় কোনদিকে যাব কিছু ঠিক করতে পারবে?
এই ঘরের বাইরে যদি একবার যেতে পারি তা হলে আর আমাদের ধরে কে? কিন্তু মুশকিল হল আমরা কোথায় আছি কীভাবে আছি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি যদি হেঁট হই তুমি আমার কাঁধে পা দিয়ে উঠে বাইরেটা একবার দেখে নিতে পারবে?
লিপি বলল, যদি পড়ে যাই? তার চেয়ে তুমি বরং আমার কাঁধে ওঠো। সব্যসাচী বলল, আমার ভার তুমি রাখতেই পারবে না। যদি তোমাকে সামান্য একটু চাগিয়ে ধরি?
তা হলে অবশ্য হতে পারে।
বলেই কী মনে হতে সব্যসাচী বলল, দাঁড়াও, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। এই টি-টেবিলটাকে কাজে লাগানো যাক। বলে টেবিলটাকে টেনে আনল সব্যসাচী। কিন্তু না। তাতে উঠেও কোনও লাভ হল না। ওপরের ফাঁকটা তখনও নাগালের বাইরে।
লিপি বলল, তুমি আমাকে একটু তুলে ধরো। তা হলেই বাইরেটা দেখতে পাব আমি।
সব্যসাচী তাই করল। লিপিকে একটু তুলে ধরতেই লোহার রডগুলো ধরে ওর কাঁধে ভর করে উঠে দাঁড়াল লিপি। তারপর বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, কী নির্জন। চারদিকে বন-জঙ্গল। আর বালির পাহাড়। সমুদ্র নেই?
না। সমুদ্র তো দেখতে পাচ্ছি না।
এবার তা হলে নেমে এসো।
লিপি নামলে সব্যসাচী বলল, তুমি কি পারবে একটু কষ্ট করে আমাকে একবার তুলে ধরতে?
এ আর এমন কী? খুব পারব।
সত্যিই পারল। ছিপছিপে চেহারা হলে কী হবে। শরীরে শক্তি রাখে বেশ। সব্যসাচীকে ধরে সামান্য একটু চাগিয়ে তুললেই বিপর্যয়। সবসুদ্ধু হুড়মুড়িয়ে পড়ল দু’জনে। পুরনো টেবিলের পায়াটা ভেঙে গিয়েই এই কেলেঙ্কারি। আর ঠিক তখনই দরজা খোলার শব্দ।
সেই শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই লিপি আর সব্যসাচী দু’জনেই ছুটে এল দরজার দু’পাশে। দিনের আলো এখনও আছে। তাই পালাতে অসুবিধে হবে না ওদের। কোনওরকমে একবার শুধু বেরোতে পারলে হয়। যদিও পড়ে গিয়ে দারুণ চোট পেয়েছে দু’জনেই। তবু ওরা তৈরি।
একজন নয়, দু’জন এল ওরা।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই ওদের সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল সব্যসাচী। তারপর লিপিকে নিয়ে বাইরে বেরিয়েই ঘরের দরজায় শিকল দিয়ে ছোট্ট একটা পাঁচিল টপকে লাফিয়ে পড়ল পাশের বালিয়াড়িতে।
কাজুবাদামের বন যেখানে আরও গভীর, ওরা দু’জনে প্রাণপণে ছোটা শুরু করল সেইদিকে। ছুটতে ছুটতে সন্ধে হয়ে এল। কতদূরে একটা পাতার ঘর দেখা যাচ্ছে। ওরা সেই ঘরখানাই ওদের নিরাপদ আশ্রয় ভেবে এগিয়ে চলল।
ঘরের কাছে গিয়ে দেখল বালির ওপরে তালপাতার ছোট্ট একটা ঝোপড়ি এটা। কোনও ভিখিরির ডেরা ছিল বোধহয়।
এখন এ ঘর কাজে লাগে না, তাই পরিত্যক্ত। তবে আপাতত একটা রাত এখানে কাটানো যায়।
লিপি বলল, সব্যসাচী! আর আমি পারছি না। আমার মনে হয় আজকের রাতটা আমাদের এইখানেই কাটিয়ে দেওয়া উচিত।
সব্যসাচী বলল, এখানে এক রাতও নয়। সাময়িকভাবে কিছুটা সময় আমরা এখানে বিশ্রাম নিতে পারি। কেন না বনের মধ্যে ঘর। ওরা যদি রাতের অন্ধকারে আমাদের খুঁজতে বেরোয় তা হলে সহজেই ধরা পড়ে যাব আমরা। তাই বলি একটু বিশ্রাম নিয়ে অন্ধকারেই পালাই চলো।
লিপি বলল, যা তুমি বলবে। এখন তুমিই আমার বন্ধু, আমার অভিভাবক।
আমার সব। তোমার দেখা না পেলে এই বিপদে কী যে করতাম, কিছু ভেবে পাচ্ছি না। কিন্তু সব্যসাচী, ওই বেগুনপোড়া দিয়ে দুটো শুকনো ভাত খেয়ে পেট তো ভরেইনি, উপরন্তু তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। একটু জলের কি ব্যবস্থা করা যায়?
এখন চোখের জলই আমাদের একমাত্র সম্বল। এই সৈকতমরুতে জল কোথায়? তবে দূরে কয়েকটা ছোট ছোট নারকোলগাছ দেখা যাচ্ছে। দেখি যদি কোনও একটা গাছে উঠে হাত বাড়িয়ে দু’–একটা ডাব পাড়তে পারি।
তাই যাও। আমি বরং এইখানে বসে হাঁফ ছাড়ি একটু। এই বলে ঘরের ভেতর থেকে একটা ধুলো পড়া ময়লা শতরঞ্জি নিয়ে এসে বালির ওপরে পেতে বসে রইল লিপি।
সব্যসাচী গেল ডাব পেড়ে আনতে।
লিপি বসে বসে বালিতে কত আঁকিবুকি কাটল। নাম লিখল দু’জনের। বালির ঘর করল। ও যখন এইসব নিয়ে ব্যস্ত তখন হঠাৎই বুকটা কেঁপে উঠল ওর। দেখল ভারী বুট পায়ে দীর্ঘদেহী একজন একটু একটু করে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। লিপি তার মুখের দিকেও তাকাতে পারল না। মনে হল ওর মধ্যে ও যেন আর নেই।
এদিকে কিছু সময়ের মধ্যে ডাব নিয়ে যখন ফিরে এল সব্যসাচী তখন লিপিকে না দেখে দারুণ অবাক হয়ে গেল। সূর্য তখন অস্তাচলে। প্রকৃতির যবনিকা ক্রমশ ধূসর হয়ে আসছে। চারদিকে আবছায়া। কিন্তু যার জন্য আনা সে কই? ও দেখল বালির ওপর বেশ বড় বড় হরফে ওদের নাম লেখা। একটা বালির ঘর অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ও ছুটে সেই ঘরের ভেতরে গিয়ে ঢুকল। কিন্তু না, লিপি সেখানেও নেই। তা হলে গেল কোথায় মেয়েটা? ও চিৎকার করে ডাকল লিপি। তুমি কোথায়?
কেউ সাড়া দিল না। ওর ডাকের কোনও প্রত্যুত্তরও ভেসে এল না কোথাও থেকে। ও বালির ওপরে লক্ষ করে দেখল মোটা সোলের জুতোর ছাপ। আর সেই সঙ্গে বালির ওপর দিয়ে কাউকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো একটা দাগ। ডাবগুলো বালির ওপর ফেলে দিয়ে সেই পদচিহ্ন ধরেই এগিয়ে চলল সব্যসাচী। শেষপর্যন্ত লিপিটা আবার ধরা পড়ে গেল?
সব্যসাচীর বুকের ভেতরটা যেন ক্ষোভে ফেটে পড়তে লাগল। একসময় অন্ধকার এমন ঘনিয়ে এল যে পদচিহ্নও আর নজরে এল না। শুধু বন-জঙ্গল আর তারই বুক চিরে বয়ে আসা এক নদী ওর নজরে এল। এটা সেই নদী নয়তো? যে নদীর মোহানায় এই কাহিনির প্রথম পর্বর সূত্রপাত হয়েছিল? সব্যসাচী নিঃশব্দে নদীর ধারে ধারে এগিয়ে চলল। একবার কোনওরকমে মোহানায় পৌঁছতে পারলে হলিডে হোমের পথ ঠিকই খুঁজে নেবে ও।
এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ আসার পর এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল ও। দেখল চার-পাঁচজন লোক চারদিকে টর্চের আলো ফেলে কী যেন খুঁজছে। নিশ্চয়ই সব্যসাচীর খোঁজ করছে ওরা। সব্যসাচী ধরা পড়বার ভয়ে একটা কাজুগাছের মোটা ডালে বসে পাতার আড়ালে লুকিয়ে রইল। ভাগ্যে এই গাছগুলো একটু বেঁটেখাটো হয়।
সব্যসাচী অনেকক্ষণ ধরে স্থির হয়ে বসে থেকে সেই লোকগুলোর গতিবিধি লক্ষ করতে লাগল। ও যখন বসে বসে নিজেকে আড়াল করে ওদের কীর্তিকলাপ দেখছে ঠিক তখনই দেখতে পেল একটা ছোট নৌকোয় চেপে মুখে কালো কাপড় বাঁধা দু’-চারজন সশস্ত্র লোক এইদিকে আসছে। ওদের প্রত্যেকেরই হাতে পাইপ গান, পিস্তল ইত্যাদি।
ভয়ে বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগল ওর। তার চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার যেটা সেটা হল ওরা একে একে সবাই এসে হাজির হল ও যে গাছে ছিল সেই গাছেরই নীচে।
ওদের চাপা কথাবার্তা ও শুনতে পেল।
জল্লাদের মতো চেহারার একজন বলল, বীরাপ্পান আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেরে ভাল্লা। সমস্ত সোনা নিয়ে সে গা ঢাকা দিয়েছে। আমি নিজে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেই সোনার হদিস পাইনি।
তা হলে জানেমন, ওর জন্যে একটা বুলেট আমাদের খরচ করতেই হবে, এই তো?
ইয়া আল্লা। মার কা বদলা মার হ্যায়, খুন কা বদলা খুন। দেখলে না জয়শংকরপ্রসাদের হাল ক্যায়শা কর দিয়া হামনে? একেবারে গলা পর্যন্ত বালিতে পুঁতে এমনভাবে রেখে এসেছি যে সারারাত ধরে শেয়াল-কুকুরে ছিড়ে খাবে ওকে। শিবেটা বেশি দরদ দেখাচ্ছিল বলে একটা গুলিতে ওরও মুখ আমি বন্ধ করে এলাম।
কিন্তু এদিককার খবর?
বীরসিংও পুলিশের তাড়া খেয়ে ভাগছে। ওর লোকজনরা লুকোবার জন্য ইঁদুরের গর্ত খুঁজছে। আমরাও অবশ্য না-লড়ে বাঁচব না। হয়তো আজকের রাতই আমাদের শেষরাত। শয়তান বিজুটা নিজেই এবার ফিল্ডে নেমেছে। ইনস্পেক্টর ভাগবকে নিয়ে শিকার করতে আসছে আমাদের। কিন্তু ও জানে না যে ওরাই এখন আমাদের শিকার।
সব্যসাচী সব শুনে শিরদাঁড়া টান করে স্থির হয়ে রইল। তা হলে একটু আগে যাদের উপস্থিতি ওর ভয়ের কারণ হয়েছিল তারা তা হলে পুলিশের লোক? আর তাদের পুরোভাগে ছিলেন ইনস্পেক্টর ভার্গব ও বিজুদা! ভগবান রক্ষে যে ওর সঙ্গে ওদের দেখা হয়নি। তা যদি হত, তা হলে কিছুতেই এই গাছের আশ্রয়ে ওকে থাকতে হত না আর টেরও পেত না এই দুষ্কৃতীদের মতলব। কিন্তু এখন কীভাবে কী করা যায় ?
হঠাৎই ওরা সতর্ক হল। দেখা গেল সেই টর্চের আলো ঘুরেফিরে আবার এইদিকেই আসছে।
ওরা বলল, রেডি হো যাও। আর এক কদম এগোলেই আলোর মুখ লক্ষ্য করে ফায়ার। তার আগে গাছের গুঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়ো সবাই।
সব্যসাচী যে গাছের পাতার আড়ালে ছিল ঠিক তার নীচেই ছিল একজন। লোকটার হাতে ছিল পাইপগান। সেটা সে চাগিয়ে ধরে আলোর দিকে তাগ করতেই সব্যসাচী নিজের জীবনে পরোয়া না করে আচমকা লাফিয়ে পড়ল তার ঘাড়ে।
লোকটা বিকট চিৎকার করে হুমড়ি খেয়ে পড়তেই ওর পাইপগান চলে এল সব্যসাচীর হাতে। জীবনে কখনও এই যন্ত্র হাতে নেয়নি সে। তবুও সেটাকে বাগিয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, হ্যান্ডস আপ। বলেই একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।
ওদিক থেকে তখন ছুটে এসেছে পুলিশের গুলি।
একজন আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ল।
সব্যসাচী ওর আক্রমণে পড়ে যাওয়া লোকটার পেটে পাইপগানের নল ঠেকিয়ে বলল, নড়েছ কী মরেছ।
ওদিক থেকে বিজুদার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, এখনও যদি বাঁচতে চাস তো ধরা দে ভাল্লা। এখানে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে চারদিকে আমরা ছড়িয়ে আছি। আর তোদের পালাবার কোনও পথই খোলা নেই।
গাছের আড়াল থেকে কে যেন বলল, আমরা তোদের মেরে নিজেরা মরতে এসেছি বিজু। কাজেই পালানোর প্রশ্নই ওঠে না।
বিজুদা সত্যিই সাংঘাতিক। ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চতুর বেড়ালের মতো এসে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লেন একজনের ঘাড়ে। বাকি ছিল একজন। সে তখন উপায়ন্তর না দেখে বিজুদাকে লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপল টিস্যুম।
চাপা একটা আর্তনাদ ভেসে এল বিজুদার দিক থেকে। তবে সে আর্তনাদ বিজুদার নয়। বিজুদা শুধু হেসে বললেন, তোদের দলের লোককেই শেষ পর্যন্ত খুন করলি? আমি তো জানি, এই ভুলটাই করে বসবি তোরা, তাই ওকে ধরেই আমার বুকের কাছে রেখেছিলাম।
অন্যান্য পুলিশ গিয়ে তখন সেই লোকটিকে ধরে ফেলল।
সব্যসাচী তখন গাছের আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করে বলল, বিজুদা! আমি একটাকে ধরে আছি। মরা ইঁদুরের মতো পড়ে আছে ব্যাটা। ধরো একে। সব্যসাচীর গলা শুনেই ছুটে এলেন বিজুদা, সব্যসাচী তুমি! তুমি এখানে কী করে এলে? লিপি কোথায়?
আমি লিপিকে নিয়ে পালিয়ে আসছিলাম। লিপি আবার ওদের খপ্পরে পড়ে যায়।
পড়লেও পালাতে পারবে না। এখন চলো, আগে তোমাকে তোমার বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসি। আর একটা কথা, সেই জিনিসটাকে তুমি কি রক্ষা করতে পেরেছ?
নিশ্চয়ই। সেটা এখনও আমার কাছে।
বিজুদা সানন্দে সব্যসাচীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর দারুণ উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন, মি. ভার্গব ! এই সেই সব্যসাচী। ওর কাছে এখনও আছে সেই অমূল্য ধন।
সব্যসাচী ক্যাসেটটা বিজুদাকে দিয়ে দিল।
পুলিশ তখন হত-আহত চারজন দুষ্কৃতীকে বেঁধে ফেলেছে।
এমন সময় হঠাৎ একজন কনস্টেবল ছুটতে ছুটতে এসে বলল, স্যার, ওই দেখুন কারা আসছে।
সবাই দেখল মশালধারী একজন মাল্লার সঙ্গে বীরদর্পে এগিয়ে আসছেন প্রখ্যাত আইনজীবী জয়শংকরপ্রসাদ ও সেই দস্যিদামাল ভীষণ জেদি ও একরোখা মেয়েটা, যার নাম জয়া। জয়া এসেই অন্তরের আবেগে সব্যসাচীর হাত দুটো মুঠো করে ধরল। তারপর সে কী কান্না তার।
অনেক পরে কান্না থামলে বালিয়াড়ি ও বনাঞ্চল্ পেরিয়ে ওরা একসময় পুলিশের গাড়িতে চেপে যখন থানায় এল তখন আর এক চমক। দেখল লিঙ্গরাজ মিশ্রর একজন পোষাগুন্ডা লিপিকে উদ্ধার করে জমা দিয়েছে পুলিশের হাতে। সব্যসাচীর বাবা-মা, জয়ার মামা সবাই ছিলেন থানায়।
স্নেহাংশুবাবু সব্যসাচীকে বুকে জড়িয়ে বললেন, কাল দুপুরে পুলিশের গাড়িতে করে একটি কিশোরের লাশ সনাক্ত করতে গিয়েছিলাম। ভাগ্যে সেটা তুই নয়। ওঃ কী ভয় যে পেয়েছিলাম।
বিজুদা বললন, আপনার এই ছেলেটি কিন্তু বড় হলে একজন ঝানু গোয়েন্দা হবে।
সকলের শুভেচ্ছায় তাই যেন হয়।
লিপি বলল, জানো তো কাকা, আমরা যেখানে বন্দি ছিলাম সব্যসাচী না-থাকলে সেখান থেকে কখনওই বেরোতে পারতাম না।
জয়শংকরপ্রসাদ বললেন, আর এই যে মেয়েটি, জয়া! এ না-থাকলে আমিও প্রাণে বাঁচতাম না।
বিজুদা বললেন, এখন তা হলে আর কোনও ভয় বা আতঙ্ক নেই। অল কোয়ায়েট অন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। দুষ্কৃতীরা যে যেখানেই থাকুক ধরা পড়বে। পুলিশ অফিসার বললেন, এখন একটু চা-পর্ব সেরে বাসায় ফিরতে চান নিশ্চয়ই?
বিজুদা বললেন, কখনওই না। চা-পর্ব এখন থাক। আপনারা আমাদের স্বর্গদ্বারে পৌঁছে দিন। আজ আমরা মনের আনন্দে এবং নির্ভয়ে নতুন দিনের সূর্য ওঠা দেখব।
বিজুদার প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে সবাই পুলিশের গাড়িতে স্বর্গদ্বারে এলেন। ভোর হতে তখনও একটু দেরি ছিল। তবু সমুদ্রসৈকতে যাত্রীর অভাব ছিল না।