আমাদের ‘সবজান্তা’ দুলিরামের বাবা কোন একটা খবরের কাগজের সম্পাদক । সেই জন্য আমাদের মধ্যে অনেকেরই মনে তাহার সমস্ত কথার উপরে অগাধ বিশ্বাস দেখা যাইত । যে কোন বিষয়েই হোক, জার্মানির লড়াইয়ের কথাটাই হোক আর মোহনবাগানের ফুটবলের ব্যাখ্যাই হোক, দেশের বড় লোকদের ঘরোয়া গল্পই হোক, আর নানারকম উৎকট রোগের বর্ণনাই হোক, যে কোন বিষয়ে সে মতামত প্রকাশ করিত । একদল ছাত্র অসাধারণ শ্রদ্ধার সঙ্গে সে সকল কথা শুনিত । মাস্টার মহশয়দের মধ্যেও কেহ কেহ এ বিষয়ে তাহার ভারি পক্ষপাতী ছিলেন । দুনিয়ার সকল খবর লইয়া সে কারবার করে, সেইজন্য পণ্ডিত মহাশয় তাহার নাম দিয়াছিলেন ‘সবজান্তা’ । আমার কিন্তু বরাবরই বিশ্বাস ছিল যে, সবজান্তা যতখানি পাণ্ডিত্য দেখায়, আসলে তাহার অনেকখানি উপরচালাকি । দু-চারটি বড়-বড় শোনা কথা আর খবরের কাগজ পড়িয়া দু-দশটা খবর- এইমাত্র তাহার পুঁজি, তারই উপর রঙচঙ দিয়া নানারকম বাজে গল্প জুড়িয়া সে তাহার বিদ্যা জাহির করিত ।
একদিন আমাদের ক্লাশে পণ্ডিত মহাশয়ের কাছে সে নায়েগ্রা জলপ্রপাতের গল্প করিয়াছিল । তাহাতে সে বলে যে, নায়েগ্রা দশ মাইল উঁচু ও একশত মাইল চওড়া ! একজন ছাত্র বলিল, “সে কি করে হবে ? এভারেস্ট সবচেয়ে উঁচু পাহাড়, সে-ই মোটে পাঁচ মাইল ।” সবজান্তা তাকে বাধা দিয়া বলিল, “তোমরা তো আজকাল খবর রাখ না !” যখনই তার কথায় আমরা সন্দেহ বা আপত্তি করিতাম, সে একটা কিছু যা তা নাম করিয়া আমাদের ধমক দিয়া বলিত, “তোমরা কি অমুকের চেয়ে বেশি জানো ?” আমরা বাহিরে সব সহ্য করিয়া থাকিতাম, কিন্তু এক এক সময় রাগে গা জ্বলিয়া যাইত । সবজান্তা যে আমাদের মনের ভাবটা বুঝিত না, তাহা নয় । সে তাহা বিলক্ষণ বুঝিত এবং সর্বদাই এমন ভাব প্রকাশ করিত যে, আমরা তাহার কথা মানি বা না মানি, তাহাতে কিছুমাত্র আসে যায় না । নানারকম খবর ও গল্প জাহির করিবার সময় মাঝে মাঝে আমাদের শুনাইয়া বলিত, “অবশ্যি কেউ কেউ আছেন, যাঁরা এসব কথা মানবেন না ।” অথবা “যাঁরা না পড়েই খুব বুদ্ধিমান তাঁরা নিশ্চয়ই এ-সব উড়িয়ে দিতে চাইবেন”- ইত্যাদি । ছোকরা বাস্তবিক অনেক রকম খবর রাখিত, তার উপর বোলচালগুলিও বেশ ছিল ঝাঁঝালো রকমের, কাজেই আমরা বেশি তর্ক করিতে সাহস পাইতাম না ।
তাহার পরে একদিন, কি কুক্ষণে, তাহার এক মামা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হইয়া আমাদেরই স্কুলের কাছে বাসা লইয়া বসিলেন । তখন আর সবজান্তাকে পায় কে ! তাহার কথাবার্তার দৌড় এমন আশ্চর্য রকম বাড়িয়া চলিল, যে মনে হইত বুঝি বা তাহার পরামর্শ ছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পুলিশের পেয়াদা পর্যন্ত কাহারও কাজ চলিতে পারে না । স্কুলের ছাত্র মহলে তাহার খাতির ও প্রতিপত্তি এমন আশ্চর্য রকম জমিয়া গেল যে, আমরা কয়েক বেচারা, যাহারা বরাবর তাহাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করিয়া আসিয়াছি- একেবারে কোণঠাসা হইয়া রহিলাম । এমন কি আমাদের মধ্য হইতে দু-একজন তাহার দলে যোগ দিতেও আরম্ভ করিল ।
অবস্থাটা শেষটায় এমন দাঁড়াইল যে, ইস্কুলে আমাদের টেকা দায় ! দশটার সময় মুখ কাঁচুমাচু করিয়া ক্লাশে ঢুকিতাম আর ছুটি হইলেই, সকলের ঠাট্টা-বিদ্রূপ হাসি-তামাশার হাত এড়াইবার জন্য দৌড়িয়া বাড়ি আসিতাম । টিফিনের সময়টুকু হেডমাস্টার মহাশয়ের ঘরের সামনে একখানা বেঞ্চের উপর বসিয়া অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো পড়াশুনা করিতাম ।
এইরকম ভাবে কতদিন চলিত জানি না, কিন্তু একদিনের একটা ঘটনায় হঠাৎ সবজান্তা মহাশয়ের জারিজুরি সব এমনই ফাঁস হইয়া গেল যে, তাহার অনেকদিনের খ্যাতি ঐ একদিনেই লোপ পাইল- আর আমরাও সেইদিন হইতে একটু মাথা তুলিতে পারিয়া হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলাম । সেই ঘটনার গল্প বলিতেছি ।
একদিন শোনা গেল, লোহারপুরের জমিদার রামলালবাবু আমাদের স্কুলে তিন হাজার টাকা দিয়াছেন- একটা ফুটবল গ্রাউন্ড ও খেলার সরঞ্জামের জন্য । আরও শুনিলাম, রামলালবাবুর ইচ্ছা সেই উপলক্ষে আমাদের একদিন ছুটি ও একদিন রীতিমত ভোজের আয়োজন হয় ! কয়দিন ধরিয়া এই খবরটাই আমাদের প্রধান আলোচনার বিষয় হইয়া উঠিল । কবে ছুটি পাওয়া যাইবে, কবে খাওয়া এবং কি খাওয়া হইবে, এই সকল বিষয়ে জল্পনা চলিতে লাগিল । সবজান্তা দুলিরাম বলিল, যেবার সে দার্জিলিং গিয়াছিল, সেবার নাকি রামলালবাবু তাহাকে কেমন খাতির করিতেন, তাহার আবৃত্তি শুনিয়া কি কি প্রশংসা করিয়াছিলেন, এ বিষয়ে সে স্কুলে আগে এবং পরে, সারাটি টিফিনের সময় এবং সুযোগ পাইলে ক্লাশের পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকেও নানা অসম্ভব রকম গল্প বলিত । ‘অসম্ভব’ বলিলাম বটে, কিন্তু তাহার চেলার দল সে সকল কথা নির্বিচারে বিশ্বাস করিতে একটুও বাধা বোধ করিত না ।
একদিন টিফিনের সময় উঠানের বড় সিঁড়িটার উপর একদল ছেলের সঙ্গে বসিয়া সবজান্তা গল্প আরম্ভ করিল- একদিন আমি দার্জিলিঙে লাটসাহেবের বাড়ির কাছেই ঐ রাস্তাটায় বেড়াচ্ছি, এমন সময় দেখি রামলালবাবু হাসতে হাসতে আমার দিকে আসছেন, তাঁর সঙ্গে আবার একটা সাহেব । রামলালবাবু বলিলেন, “দুলিরাম ! তোমার সেই ইংরাজি কবিতাটা একবার এঁকে শোনাতে হচ্ছে । আমি এর কাছে তোমার সুখ্যাতি করছিলাম, তাই ইনি সেটা শুনবার জন্য ভারি ব্যস্ত হয়েছেন !” উনি নিজে থেকে বলছেন, তখন আমি আর কি করি ? আমি সেই ‘ক্যাসাবিয়াংকা’ থেকে আবৃত্তি করলুম । তারপর দেখতে দেখতে ভিড় জমে গেল ! সবাই শুনতে চায়, সবাই বলে, ‘আবার কর ।’ মহা মুশকিলে পড়ে গেলাম, নেহাত রামলালবাবু বললেন, তাই আবার করতে হল ।
এমন সময় কে যেন পিছন হইতে জিজ্ঞাসা করিল, “রামলালবাবু কে ?” সকলে ফিরিয়া দেখি, একটা রোগা নিরীহগোছের পাড়াগেঁয়ে ভদ্রলোক সিঁড়ির উপর দাঁড়াইয়া আছেন । সবজান্তা বলিল, “রামলালবাবু কে, তাও জানেন না ? লোহারপুরের জমিদার রামলাল রায় ।” ভদ্রলোকটি অপ্রস্তুত হইয়া বলিলেন, “হ্যাঁ, তার নাম শুনেছি, সে তোমার কেউ হয় নাকি ?” “না, কেউ হয় না, এমনি খুব ভাব আছে । প্রায়ই চিঠিপত্র চলে ।” ভদ্রলোকটি আবার বলিলন, “রামলালবাবু লোকটি কেমন ?” সবজান্তা উৎসাহের সঙ্গে বলিয়া উঠিল, “চমৎকার লোক । যেমন চেহারা তেমনি কথাবার্তা, তেমনি কায়দা-দুরস্ত । এই আপনার চেয়ে প্রায় আধ হাত খানেক লম্বা হবেন, আর সেই রকম তাঁর তেজ । আমাকে তিনি কুস্তি শেখাবেন বলেছিলেন, আর কিছুদিন থাকলেই ওটা বেশ রীতিমত শিখে আসতাম ।” ভদ্রলোকটি বলিলেন, “বল কি হে ? তোমার বয়স কত ?” “আজ্ঞে এইবার তেরো পূর্ণ হবে ।” “বটে ! বয়সের পক্ষে খুব চালাক তো ! বেশ তো কথাবার্তা বলতে পার ! কি নাম তোমার ?” সবজান্তা বলিল, “দুলিরাম ঘোষ । রণদাবাবু ডেপুটি আমার মামা হন ।” শুনিয়া ভদ্রলোকটি ভারি খুশি হইয়া হেডমাস্টার মহাশয়ের ঘরের দিকে চলিয়া গেলেন ।
ছুটির পর আমরা সকলেই বাহির হইলাম । ইস্কুলের সম্মুখেই ডেপুটিবাবুর বাড়ি । তার বাহিরের বারান্দায় দেখি, সেই ভদ্রলোকটি দুলিরামের ডেপুটিমামার সঙ্গে গল্প করিতেছিলেন । দুলিরামকে দেখিয়াই মামা ডাক দিয়া বলিলেন- “দুলি, এদিকে আয়, এঁকে প্রণাম কর- এটি আমার ভাগ্নে দুলিরাম ।” ভদ্রলোকটি হাসিয়া বলিলেন, “হ্যাঁ, এর পরিচয় আমি আগেই পেয়েছি ।” দুলিরাম আমাদের দেখাইয়া খুব আড়ম্বর করিয়া ভদ্রলোকটিকে প্রণাম করিল । ভদ্রলোকটি আবার বলিলেন, “আমার পরিচয় জানো না বুঝি ?” সবজান্তা এবার আর ‘জানি’ বলিতে পারিল না, আম্তা আম্তা করিয়া মাথা চুলকাইতে লাগিল । ভদ্রলোকটি তখন বেশ একটু মুচকি মুচকি হাসিয়া আমাদের শুনাইয়া বলিলেন, “আমার নাম রামলাল রায়, লোহারপুরের রামলাল রায় ।”
দুলিরাম অনেকক্ষণ হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর মুখখানা লাল করিয়া হঠাৎ এক দৌড়ে বাড়ির ভিতর ঢুকিয়া গেল । ব্যাপার দেখিয়া ছেলেরা রাস্তার উপর হো হো করিয়া হাসিতে লাগিল । তার পরের দিন আমরা স্কুলে আসিয়া দেখিলাম- সবজান্তা আসে নাই, তাহার নাকি মাথা ধরিয়াছে । নানা অজুহাতে সে দু-তিনদিন কামাই করিল, তারপর যেদিন স্কুলে আসিল, তখন তাহাকে দেখিবা মাত্র তাহারই কয়েকজন চেলা “কিহে, রামলালবাবুর চিঠিপত্র পেলে ?” বলিয়া তাহাকে একেবারে ঘিরিয়া দাঁড়াইল । তারপর যতদিন সে স্কুলে ছিল, ততদিন তাহাকে খেপাইতে হইলে বেশি কিছু করা দরকার হইত না, একটিবার রামলালবাবুর খবর জিজ্ঞাসা করিলেই বেশ তামাশা দেখা যাইত ।