সপ্তম পরিচ্ছেদ । মহাবিচারকের বিচার
বোম্বেটে দ্বীপে যদি ভালো গণৎকার থাকত তাহলে নিশ্চয়ই সে বলত, ‘লোলোনেজ, সাবধান! এবারের যাত্রা শুভ নয়!’
কিন্তু সে-কথা সে কানে তুলত কিনা, সন্দেহ! নিয়তির সূত্র তাকে বাইরে টানছে! সে অনেক পাপ করেছে, এবারে প্রতিক্রিয়ার সময় এসেছে!
ভবিষ্যৎ ভাববার সময় তার ছিল না, বর্তমানের ঔজ্জ্বল্যে সে অন্ধ! বোম্বেটে দ্বীপে তার চেয়ে বড় নাম আজ আর কারুর নেই,—সবাই তাকে ভয় করে সম্মান করে শ্রদ্ধা করে, যেন যে নরদেবতা! যেমন তার শক্তি, তেমনই ঐশ্বর্য!
কিন্তু তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে স্থির থাকতে দিলে না। তাই আবার সে যেদিন সমুদ্রযাত্রা করবে বললে, সেদিন সারা দেশে আনন্দ ও উৎসাহের বন্যা বইল! এবারে আর লোকজনের জন্যে তাকে একটুও মাথা ঘামাতে হল না, লোলোনেজের সঙ্গী হয়ে বিপদে পড়তেও লোকের এত আগ্রহ যে, তার দরজার সামনে উমেদার আর ধরে না। যত লোক সে চায়, তার চেয়ে ঢের বেশি লোক এসে তার কাছে ধরনা দিয়ে পড়ল।
লোলোনেজ নতুন করে ছয়খানা জাহাজ সাজালে। এবারে তার সঙ্গীর সংখ্যা হল সাতশত, এর মধ্যে তিনশোজন আগের বারেও তার সঙ্গে গিয়েছিল।
লোলোনেজ বললে, ‘এবারে আমি নিকারাগুয়া জয় করতে যাব।’
আবার সমুদ্র! বাংলায় সমুদ্রের আর এক নাম ‘রত্নাকর’ এবং এই বোম্বেটেদের পক্ষে সমুদ্র রত্নাকরই বটে!
কিন্তু এবারে রত্নের এখনও দেখা নেই! তার উপরে অনুকূল বায়ুর অভাব, বোম্বেটেদের জাহাজগুলো যেন অগ্রসর হতেই নারাজ! এইভাবে কিছুদিন কাটাবার পরেই খাদ্যাভাব উপস্থিত হল। তখন বাধ্য হয়েই বোম্বেটেরা প্রথম যে বন্দর দেখতে পেলে সেইখানেই জাহাজ নোঙর করল।
সমুদ্র থেকে একটা নদী ডাঙার মধ্যে গিয়ে ঢুকেছে, নাম তার জাগুয়া। তার তীরে তীরে অসভ্য ও দরিদ্র লাল মানুষ বা রেড ইন্ডিয়ানের বাস। বোম্বেটেরা নৌকোয় চড়ে সেই নদীর ভিতরে গেল এবং রেড ইন্ডিয়ান বেচারাদের পালিত পশু ও অন্যান্য মালপত্তর নিঃশেষে কেড়ে নিলে—নিজেদের খাদ্যাভাব দূর করবার জন্যে।
কেবল তাইতেই খুশি হল না। তারা স্থির করলে, যতদিন না অনুকূল বাতাস বয় ততদিন তারা আর বাহির সমুদ্রে যাবে না, এই দেশের যত শহর আর গ্রাম লুট করে সময় কাটাবে আর পকেট পূর্ণ করবে।
তারা গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর লুট করতে করতে পুয়ের্টো কাভাল্যো মূল গ্রন্থের এই নামটি সম্ভবত ভুল। মধ্য আমেরিকার সমুদ্র উপকূলে পুয়ের্টো কাভাল্যে নামে কোনও বন্দরের সন্ধান পাওয়া যায়নি। দক্ষিণ আমেরিকার ভেনেজুয়েলা প্রদেশের সমুদ্র উপকূল ওই নামের একটা সমৃদ্ধিশালী বন্দর আছে। কিন্তু লোলোনেজ এবার এ অঞ্চলে আসেনি। খুব সম্ভব, সে হন্ডুরাজ উপসাগরের মুখে পুয়ের্টো কর্টেজ বন্দরে বাহিনী রেখে ভিতরে প্রবেশ করেছিল কর্টেজ বন্দর থেকে প্রায় ৩৬ মাইল ভিতর দিকে সান পেড্রো বা সেন্ট পিটার শহর এখনও বিদ্যমান রয়েছে। আমাদের পুস্তকের মানচিত্রে অনবধানতা বশত কর্টেজ বন্দর ও সেন্ট পিটার শহর দেখানো হয়নি। নামে এক বন্দরে এসে হাজির হল। সেখানে স্পানিয়ার্ডদের একটা আস্তানা ও একখানা বড় জাহাজ ছিল। তারা তৎক্ষণাৎ জাহাজখানা দখল করে স্পানিয়ার্ডদের আস্তানা লুটে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
এর মধ্যে তারা কত লোককে বন্দি করেছে, কত বন্দিকে অকথ্য যন্ত্রণা দিয়েছে ও কত বন্দিকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে, তার আর সংখ্যা হয় না। লোলোনেজের প্রকৃতি অতি ভয়ংকর! কারুর জিভ সে নিজের হাতে টেনে বার করে ফেলে, কারুকে বা স্বহস্তে কেটে খণ্ড খণ্ড করে! যেখান দিয়ে তার দল পথ চলে সেখানটাই যেন ধু-ধু শ্মশান হয়ে যায়! যেন সে নরদেহে প্রলয়কর্তা, যথেচ্ছভাবে ধ্বংস করাই তার একমাত্র কর্তব্য! স্পানিয়ার্ডদের কাছে সে যেন সাক্ষাৎ যম!
লোলোনেজের সঙ্গে আছে এখন তিনশো বোম্বেটে,—বাকি লোকজন ও জাহাজগুলি সে তার সহকারী মোসেস ফ্যান ফিন নামে এক ওলন্দাজের তত্বাবধানে সমুদ্র উপকূলে রেখে এসেছে। প্রায় ছত্রিশ মাইল পথ হেঁটে লোলোনেজ সান পেড্রো বা সেন্ট পিটার শহরের কাছাকাছি একটা বনের ধারে এসে পড়ল।
তার অত্যাচারে পাগলের মতো হয়ে স্পানিয়ার্ডরা বনের মধ্যে অপেক্ষা করছিল। বোম্বেটেদের দেখেই তারা গুলিবৃষ্টি আরম্ভ করলে। এখানে রীতিমতো একটা লড়াই হয়ে গেল এবং দুই পক্ষেই অনেক লোক হত ও আহত হল। তারপর স্পানিয়ার্ডরা পৃষ্ঠভঙ্গ দিলে। শত্রুদের যারা জখম হয়েছিল তাদের কারুর উপরেই বোম্বেটেরা দয়া করলে না—একে একে সবাইকে পরলোকের পথে পাঠিয়ে দেয়।
যারা বন্দি হল তাদের ডেকে লোলোনেজ বললে, ‘এই বনের ভিতর দিয়ে শহরে যাওয়ার আর কোনও ভালো রাস্তা আছে?’
তারা বললে, ‘না।’
লোলোনেজ আবার গর্জন করে বললে, ‘ভালো চাস তো এখনও বল!’
তারা বললে, ‘আর রাস্তা নেই।’
লোলোনেজের মগজে শয়তান জেগে উঠল। সামনেই যে স্পানিয়ার্ড দাঁড়িয়েছিল, ঘাড় ধরে তাকে কাছে টেনে আনলে—যেন সে তারই মতো মানুষ নয়, তুচ্ছ একটা বলির পশু মাত্র! ফস করে খাপ থেকে চকচকে তলোয়ার খানা বার করে ফেললে এবং সেই হতভাগ্য স্পানিয়ার্ডের বুকের ভিতরে তরোয়ালের ডগা ঢুকিয়ে দিয়ে মস্ত একটা ছিদ্রের সৃষ্টি করলে—তার মর্মভেদী আর্তনাদে কিছুমাত্র কান না পেতেই! তারপর সেই তখনও জীবন্ত দেহের ছ্যাঁদা করা বুকের মধ্যে নিজের হাত ঢুকিয়ে দিলে এবং তার নৃত্যশীল, তপ্ত ও রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ডটা সজোরে ছিনিয়ে নিয়ে নিজের মুখে পুরে পরম উপাদেয় খাদ্যের মতো কচমচ করে চিবোতে চিবোতে বললে, ‘বল কোথায় রাস্তা আছে? নইলে তোদের হৃৎপিণ্ডও আমার খাবার হবে!’—
গল্পের রাক্ষস কি আজ মানুষমূর্তিতে সমুখে দেখা দিয়েছে? না এ ভূত-প্রেত, পিশাচ? বন্দিদের হৃৎপিণ্ডও যেন মহা আতঙ্কে বুকের ভিতরেই মূর্ছিত হয়ে পড়ল। শিউরোতে শিউরোতে তারা প্রায় রুদ্ধস্বরে বললে,—’আমরা পথ দেখিয়ে দিচ্ছি, আমরা পথ দেখিয়ে দিচ্ছি!’
রক্তমাখা ওষ্ঠাধর ফাঁক করে হা হা হা হা করে অট্টহাসি হাসতে হাসতে লোলোনেজ বললে, ‘পথে এসো বাবা, পথে এসো! কোথায় পথ?’
কিন্তু কোথায় পথ? গভীর অরণ্য, গাছের পর গাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের পায়ের তলায় কাঁটাঝোপ আর জঙ্গল,—অজগর সাপ ও জাগুয়ার বাঘ ছাড়া সেখান দিয়ে আর কেউ আনাগোনা করে না। বন্দিরা ভয়েই পথের নাম মুখে এনেছিল, আসলে সেখানে কোনও পথ ছিল না!
দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে লোলোনেজ বললে, ‘পথ নেই? আচ্ছা, স্পানিয়ার্ড কুত্তারাই এজন্যে শাস্তিভোগ করবে!’ লোলোনেজের শাস্তি—না জানি সে কী ভয়ানক!
এদিকে ও অঞ্চলের স্পানিয়ার্ডরা বুঝলে, এই দুর্ধর্ষ ও পাপিষ্ঠ বোম্বেটেদের জব্দ ও কাহিল করবার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, বনের ভিতরে অতর্কিতে বারবার আক্রমণ করা! এমনই বারংবার আক্রমণের ফলে বোম্বেটেরা সত্যসত্যই মহা জ্বালাতন হয়ে উঠল এবং তাদের সংখ্যাও ক্রমেই কমে আসতে লাগল! কিন্তু বাধা পেয়েও শেষপর্যন্ত তারা সেন্ট পিটার শহরের কাছাকাছি এসে পড়ল।
এবার বিষম যুদ্ধ আরম্ভ হল। এ যুদ্ধে স্পানিয়ার্ডরা বড় বড় কামানও ব্যবহার করতে ছাড়লে না। কিন্তু যেই তারা কামান ছোড়ে, লোলোনেজের আদেশে বোম্বেটেরা অমনি মাটির উপরে শুয়ে পড়ে, তারপর গোলাগুলো তাদের পার হয়ে শূন্য দিয়ে চলে গেলেই, তারা চোখের নিমেষে উঠে পড়ে শহরের দিকে এগিয়ে যায় এবং হই হই রবে বোমার পর বোমা ছুড়তে থাকে! বোমা ছুড়ে বহু শত্রু নিপাত করেও একবার স্পানিয়ার্ডদের প্রবল আক্রমণে চোখে সরষেফুল দেখতে দেখতে বোম্বেটেরা ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে এল। কিন্তু লোলোনেজের দৃপ্ত বাক্যে উত্তেজিত হয়ে আবার তারা ফিরে দাঁড়িয়ে তেড়ে গেল!
তখন স্পানিয়ার্ডদের সব সাহস ও শক্তি ফুরিয়ে গিয়েছে!
সাদা নিশান হাতে করে শত্রুদূত এসে জানালে, ‘আমরা শহরের ফটক খুলে দিচ্ছি—কিন্তু এই শর্তে যে, দু-ঘণ্টার ভিতরে আমাদের উপরে কেউ কোনও অত্যাচার করতে পারবে না।’
আর বেশি লোকক্ষয় করতে না চেয়ে লোলোনেজ এই শর্তেই রাজি হয়ে গেল। শহরের ফটক খুলল। বোম্বেটেরা সার বেঁধে ভিতরে গিয়ে ঢুকল।
লোলোনেজ আজ একটু ভদ্রতার পরিচয় দিলে। ঠিক দুটি ঘণ্টা সে লক্ষ্মীছেলের মতো হাত গুটিয়ে চুপটি করে বসে রইল। শত্রুরা দামি জিনিসপত্তর নিয়ে দলে দলে সরে পড়ছে দেখেও নিজের শয়তানিকে সে চেপে রাখলে! হঠাৎ তার এ সাধুতা, এ দুর্বলতা কেন? এ অনুতাপ কি অন্তিমকালের হরিনামের মতো?
ঠিক দু-ঘণ্টার জন্যে সৎপ্রবৃত্তির আনন্দ উপভোগ করে কুম্ভকর্ণ আবার ভীম হুঙ্কারে জেগে উঠল—’লুট করো! বন্দি করো! হত্যা করো! দু-ঘণ্টা কাবার!’ যারা তখনও পালাতে পারেনি তারা এবং শহরে তখনও যা অবশিষ্ট ছিল সমস্তই বোম্বেটেদের হস্তগত হল। কিন্তু সে এমন বেশিকিছু নয়! স্পানিয়ার্ডরা সন্ধির দু-ঘণ্টার রীতিমতো সদ্ব্যবহার করেছে!
বোম্বেটেরা দিনকয় নগরেই বাস করলে, এবং এ কয়দিন তাদের স্বভাবগত নিষ্ঠুরতার, কদর্যতার ও ভীষণতার পরিচয় দিতে কিছুমাত্র ত্রুটি করলে না। এখান থেকে যাত্রা করবার দিনে তারা শহরেও আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেল। সেই সাংঘাতিক দেওয়ালি উৎসব শেষ হলে পর দেখা গেল, আগে যেখানে শহর ছিল এখন সেখানে পড়ে রয়েছে শুধু বিরাট একটা ভস্মের পাহাড়!
সেন্ট পিটার শহর ধ্বংস করে লোলোনেজ খোশমেজাজে সমুদ্রতীরে ফিরে এল। তার দলের যে সব লোক জাহাজ ও নৌকো নিয়ে সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল, তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সে আবার নতুন শিকারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল।
দু-একদিন পরে গুয়াটেমালা নদীর মোহানায় এসে বোম্বেটেরা খবর পেলে যে, স্পানিয়ার্ডদের একখানা জাহাজ সেখানে এসে উপস্থিত হবে। তারা সেই জাহাজের অপেক্ষায় দলে দলে সেখানে পাহারা দিতে লাগল। কোনও দল সাগরের বুকে ছোট ছোট দ্বীপে কাছিম ধরতে গেল। কোনও দল গেল সেখানকার রেড ইন্ডিয়ান ধীবরদের উপরে অত্যাচার করতে।
সেখানকার রেড ইন্ডিয়ানরা তখন একশো বছর ধরে স্পানিয়ার্ডদের অধীনে বাস করে আসছে। স্পানিয়ার্ডদের চাকর-বাকর দরকার হলে তারাই এসে কাজকর্ম করে দিয়ে যায়। স্পানিয়ার্ডরা তাদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দিয়েছিল।
কিছুকাল তারা খ্রিস্টধর্মের নিয়ম পালন করে। কিন্তু স্পানিয়ার্ড প্রভুদের অধার্মিকের মতো ব্যবহার ও হিংস্র আর পশু-প্রকৃতি দেখে খ্রিস্টধর্মে বোধহয় তাদের ভক্তি চটে যায়। তখন আবার তারা পিতৃ-পিতামহের ধর্মকে ফিরে ফিরতি গ্রহণ করে।
হিন্দুদের নাকি তেত্রিশ কোটি দেবতা আছে। কিন্তু তাদের দেবতাদের ‘সেনসাস’ কখনও নেওয়া হয়েছিল কি না জানি না। তবে রেড ইন্ডিয়ান দেবতারাও দলে খুব হালকা হবেন বলে মনে হয় না। কেননা তাদের ঘরে ঘরে নতুন নতুন দেবতার রকম-বেরকম লীলাখেলা দেখা যায়।
তাদের দেবতা নির্বাচনের একটা পদ্ধতির কথা বলি।
পরিবারের মধ্যে যে মুহূর্তে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে, তারা তখনই তাকে নিয়ে বনের ভিতরে মন্দিরে গিয়ে উপস্থিত হয়।
মেঝের উপরে মণ্ডলাকারে খানিকটা জায়গা খুঁড়ে তার মধ্যে পুরু করে ছাই বিছিয়ে দেয়। তারপরে সেই ছাইয়ের উপরে নবজাত শিশুকে শুইয়ে রেখে চলে আসে। মন্দিরের চারিদিকের সব দরজা খোলা থাকে। তার কাছে আর জনপ্রাণীও যায় না। যে-কোনও হিংস্র জন্তু মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু কোনও মানুষ আসবার হুকুম নেই। সারারাত এইভাবে কেটে যায়।
সকালে শিশুর পিতা ও অন্যান্য আত্মীয়েরা আবার মন্দিরের ভিতরে আসে। অনেক সময়ে দেখা যায়, হিংস্র জন্তুর আক্রমণে বা অন্য কারণে শিশুর মৃত্যু হয়েছে। অনেক সময়ে দেখা যায়, জীবন্ত ও অক্ষত শিশুকে। তখন সকলে ছাইয়ের উপরে কোনও জন্তুর পদচিহ্ন আছে কিনা পরীক্ষা করে। পদচিহ্ন যদি না থাকে, তবে সেই শিশুকে আবার সেখানে একলা রাত্রিবাস করতে হয়। আর পদচিহ্ন যদি থাকে তবে পরখ করে দেখা হয়, সেগুলো কোনও জন্তুর পদচিহ্ন।
যে জন্তুর পদচিহ্ন সেখানে থাকবে, সেই জন্তুই হবে শিশুর দেবতা,—তার সারাজীবনের উপাস্য!
এখন আবার বোম্বেটেরা কী করছে দেখা যাক।
প্রায় তিনমাস পরে খবর এসেছে, স্পানিয়ার্ডদের জাহাজ বন্দরে দেখা দিয়েছে। সবাই সেইদিকে ছুটল।
বড় যে সে জাহাজ নয়, প্রকাণ্ড আকার, উপরে অনেক সৈন্যসামন্ত, বিয়াল্লিশটা কামান!
কিন্তু এসবের দিকে লোলোনেজ একটুও ভ্রূক্ষেপ করলে না, সে ভয়ের ধার ধারে না।
বোম্বেটেরা একজোট হয়ে জাহাজখানাকে আক্রমণ করলে এবং জাহাজের একশো তিরিশজন সৈন্যও তাদের বাধা দেওয়ার জন্যে কম চেষ্টা করলে না, তবু শেষকালে জিত হল বোম্বেটেদেরই। কিন্তু এত পরিশ্রম ও লোকক্ষয়ের পরে জাহাজ দখল করেও বোম্বেটেরা হতাশ হয়ে পড়ল। তার ভিতরে লুট করবার মতো বিশেষ কিছুই নেই।
লোলোনেজ তখন পরামর্শসভা আহ্বান করলে। সে বললে, ‘এইবারে আমি গুয়াটেমালার দিকে যেতে চাই। তোমাদের মত কী?’
অনেকেই বললে, ‘আমরা এইবার এ দেশ ছেড়ে ফিরে যেতে চাই।’
লোলোনেজ বললে, ‘কিন্তু আমি ফিরব না।’
তারা বললে, ‘কিন্তু আমরা ফিরব।’
যারা এ কথা বললে তাদের অধিকাংশই হচ্ছে নতুন লোক—লোলোনেজের পূর্ব অভিযানে তারা তার সঙ্গে ছিল না। গত অভিযানের ফল দেখে তারা ভেবেছিল বোম্বেটের জীবন হচ্ছে অত্যন্ত রঙিন, গাছ নাড়া দিলে যেমন ফল ঝরে, রাশি রাশি মোহর ঝরাও বুঝি তেমনই সহজ! কিন্তু তাদের লাখ টাকার স্বপ্নঘোর আজ ছুটে গেছে।
তারা দলে রইল না। লোলোনেজের দলকে একেবারে হালকা করে দিয়ে বেশিরভাগ বোম্বেটেই কয়েকখানা জাহাজ নিয়ে সরে পড়ল। বনে বনে কাঁটাঝোপে ঘুরে, অনাহারে অল্পাহারে অনিদ্রায় কষ্ট পেয়ে ও স্পানিয়ার্ডদের গরম গরম গুলি খেয়ে খেয়ে তাদের শখ ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে এসেছিল!
দল খুব ছোট হয়ে গেল, অন্য কেউ হলে এখানে আর থাকত না, কিন্তু একগুঁয়ে লোলোনেজ গ্রাহ্যও করলে না। সিংহের মতন তার মেজাজ—নিষ্ঠুর, গর্বিত, অদম্য! সমুদ্রের কিনারে কিনারে বনের ভিতর দিয়ে বোম্বেটের দল চলেছে। খাদ্যাভাব হওয়াতে তারা বানর মেরে তারই মাংস ভক্ষণ করতে লাগল—তবু অজানার নেশায় পথ চলা তাদের থামল না। কিন্তু তখনও লোলোনেজ আন্দাজ করতে পারেনি, তার পাপের পেয়ালা কানায় কানায় ভরে উঠেছে!
যেখান দিয়ে তারা যাচ্ছে সেখানকার রেড ইন্ডিয়ানরাও যে শান্ত ছেলে নয়, একদিন তার প্রমাণ পাওয়া গেল। আগেই বলেছি, বোম্বেটেরা রেড ইন্ডিয়ানদেরও ওপরে কম নিষ্ঠুর ব্যবহার করেনি, সুতরাং তারাও তাদের বাগে পেলে ছেড়ে কথা কয় না।
বোম্বেটেদের দলে একজন ফরাসি ও একজন স্পানিয়ার্ড ছিল।
একদিন তারা দলছাড়া হয়ে খাদ্য বা অন্য কিছুর খোঁজে বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন সময়ে দেখতে পেলে, একদল সশস্ত্র রেড ইন্ডিয়ান তাদের দিকে ছুটে আসছে!
ছুটে কাছে এসে তারা যে আদর করে তাদের কোলে টেনে নেবে না, বোম্বেটেরা এটুকু বেশ বুঝতে পারলে। তারাও তরোয়াল বার করলে, কিন্তু দুখানা তরবারি দ্বারা এত লোককে ঠেকানো সোজা কথা নয়। তখন তারা পদযুগলের ওপরে নির্ভর করাই উচিত মনে করলে।
ফরাসি বোম্বেটের পদযুগল এমন সুপটু ছিল যে, তিরের মতন সে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু স্পানিয়ার্ড ভায়া পায়ের কাজ ভালো করে শেখেনি, রেড ইন্ডিয়ানরা তাকে ধরে ফেললে।
দু-চারদিন পরে অন্যান্য বোম্বেটেদের সঙ্গে সেই ফরাসি আবার সঙ্গীর খোঁজে ঘটনাস্থলে এসে হাজির হল।
দেখা গেল, সেখানে একটা অগ্নিকুণ্ড রয়েছে, কিন্তু তার ভেতরে আগুন নেই। খানিক তফাতে পড়ে রয়েছে কতকগুলো হাড়। বোম্বেটেরা আন্দাজ করলে, স্পানিয়ার্ড ভায়ার দেহে ‘রোস্ট’ বানিয়ে রেড ইন্ডিয়ানরা উদর পরিতৃপ্ত করেছে! অবশ্য এ অনুমান ভুল হতে পারে। কিন্তু স্পানিয়ার্ডকে আর পাওয়া যায়নি।
এদিকে লোলোনেজের অবস্থা কেমন দাঁড়িয়েছে দেখুন। দলের অনেকে তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় সে শক্তিহীন হয়ে পড়েছে। বিপদের ওপর বিপদ! রেড ইন্ডিয়ানরা স্পানিয়ার্ডদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পিছনে লেগেছে। বোম্বেটেদের তারা বুঝেছে। এই হতচ্ছাড়া বোম্বেটেগুলো হচ্ছে কলেরা বসন্ত ও প্লেগের মতো সমস্ত মানুষ জাতেরই শত্রু! এদের উচ্ছেদ না করতে পারলে শান্তি নেই!
দিনের পর দিন তাদের সঙ্গে লড়ে লড়ে বোম্বেটেদের অধিকাংশই মারা পড়ল। তবু লোলোনেজ ফেরবার নাম মুখে আনে না!
কিন্তু শেষটা ফিরতে হল। এবার ফিরে লোলোনেজ তার সত্যিকার স্বদেশে গেল—অর্থাৎ নরকে; এবং সেই মহাপ্রস্থানের দৃশ্য লোলোনেজেরই উপযোগী।
ডেরিয়েন প্রদেশের রেড ইন্ডিয়ানরা একদিন বোম্বেটেদের ক্ষুদ্র দলকে আক্রমণ করলে। তাদের বেশির ভাগ মারা পড়ল, কতক পালাল, কতক বন্দি হল। বন্দিদের ভিতরে ছিল লোলোনেজ স্বয়ং! হাজার হাজার বন্দির রক্তে যার হাত এখনও ভিজে আছে, সেই লোলোনেজ আজ বন্দি!
এমন বন্দিকে যেভাবে অভ্যর্থনা করতে হয়, রেড ইন্ডিয়ানরা তাই করলে। তারা আগে লোলোনেজকে একটা গাছের গুঁড়িতে বাঁধলে। তারপর তার সমুখে বড় অগ্নিকুণ্ড জ্বাললে।
কেউ হয়তো জীবন্ত লোলোনেজের নাক কেটে নিয়ে আগুনে ফেলে দিলে। কেউ কেটে নিলে কান। কেউ কাটলে জিভ। কেউ কাটলে হাত এবং কেউ বা পা। এইভাবে ক্রমে ক্রমে তার ভয়াবহ মৃত্যু ঘটল। তার দেহের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যখন পুড়ে ছাই হয়ে গেল, রেড ইন্ডিয়ানরা তখন সেই ছাইগুলো নিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দিলে—যাতে এই অমানুষিক মানুষের কোনও ঘৃণিত স্মৃতিই পৃথিবীকে আর কলঙ্কিত না করতে পারে!
তার পাপসঙ্গীদেরও ওই দুর্দশাই হল। কেবল একজন অনেক সাধ্যসাধনার পর কোনও গতিকে শেষটা মুক্তি পেয়েছিল; বোম্বেটেদের এই শোচনীয় পরিণামের কথা প্রকাশ পায় তার মুখেই।
লোলোনেজের পরিণামই আভাস দেয় যে, জীবের শিয়রে হয়তো সত্যই কোনও অদৃশ্য মহাবিচারকের দৃষ্টি সর্বদাই সজাগ হয়ে আছে!