সপ্তম অধ্যায় । অসম্পূর্ণ মহাকাব্য
ইসাস প্রান্তরের যুদ্ধে বোঝা গেল, গ্রিসকে গোলাম করবার ক্ষমতা পারস্যের আর কোনওদিন হবে না।
দরায়ুস পালিয়ে গেলেন বটে, কিন্তু তাঁর পরিবারবর্গ হল আলেকজান্ডারের হাতে বন্দি। কিন্তু আলেকজান্ডার তাঁদের সঙ্গে এমন ভদ্র ব্যবহার করলেন যে, তাঁরা সবাই মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সেকালে বিজেতার কাছে বিজিত এমন শিষ্ট ব্যবহার প্রত্যাশা করত না।
ঐশ্বর্যে পারস্য ছিল অতুলনীয়, গ্রিস স্বাধীন হলেও তার কাছে এ হিসাবে একান্ত নগণ্য ছিল। চাষার ছেলে রাজার প্রাসাদে ঢুকলে যেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, দরায়ুসের বিচিত্র পটমণ্ডপে প্রবেশ করে তার সোনার থালাবাটি ও অন্যান্য পাত্রের স্তূপ, বহুমূল্য আসবাব ও কারুকার্যকরা কার্পেট প্রভৃতি দেখে আলেকজান্ডার হতভম্ব হয়ে গেলেন। অভিভূতকণ্ঠে বললেন, ‘রাজা বলতে কী বোঝায়, এইবারে বুঝতে পারছি!’
জয়লাভ করেও আলেকজান্ডার কিন্তু দরায়ুসের অনুসরণ করতে পারলেন না। তাঁর পিছনে ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের বিপুল আর এক অংশ—সিরিয়া ও মিশর প্রভৃতি নিয়ে যা গঠিত। পিছন দিকে এত বড় শত্রু-সাম্রাজ্য রেখে তিনি পারস্যের দিকে অগ্রসর হতে সাহস করলেন না—এবং রণনীতিতে অভিজ্ঞ অন্য কেহই যা করতেন না। প্রাচ্যভূমির দিকে অগ্রসর হতে গেলে যে সিরিয়া প্রভৃতি দেশ নিজের অধিকারভুক্ত রাখা উচিত, সেই প্রাচীন কালেই তরুণ আলেকজান্ডার তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। বহুকাল পরে আঠারো শতাব্দীতে ফরাসি দিগবিজয়ী নেপোলিয়নও এই সত্য বুঝে ভারতবর্ষ বিজয়ের বাসনা নিয়ে আলেকজান্ডারেরই পায়ে চলা পথে পথিক হয়েছিলেন—যদিও তিনি সিরিয়া পার হবার সুযোগ পাননি।
অল্পবিস্তর চেষ্টার পর সিরিয়া আলেকজান্ডারের হস্তগত হল। প্রাচীন সভ্যতার লীলাক্ষেত্র মিশর, পারসিদের শাসন যন্ত্রের চাপে আর্তনাদ করছিল, তার জন্যে আলেকজান্ডারকে আর লড়াই করতে হল না। নবীন গ্রিক দিগবিজয়ীকে সে মুক্তিদাতা বলে অভ্যর্থনা করে সিংহদ্বার খুলে দিলে। আলেকজান্ডার নিজের নামে এখানে যে নগর প্রতিষ্ঠা করলেন, সেই আলেকজেন্দ্রিয়া আজও পৃথিবীর অন্যতম প্রধান নগরী রূপে বিখ্যাত হয়ে আছে। গ্রিসের অধঃপতনের পরে শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে এথেন্সের স্থানগ্রহণ করেছিল, আলেকজেন্দ্রিয়াই।
আলেকজান্ডারের কল্পনাতীত সাফল্য দেখে এতদিন পরে গ্রিসের প্রধান সম্ভ্রান্ত রাষ্ট্র এথেন্সেরও চোখ ফুটল। এথেন্সও দূত প্রেরণ করে অভিনন্দন জানালে যে—আলেকজান্ডারই হচ্ছেন এশিয়ার বিরুদ্ধে গ্রিসের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা!
এরপর এই পৃথিবীতে আলেকজান্ডারের পরমায়ু ছিল মাত্র সাত বৎসর! কিন্তু কী বিচিত্র, কী অদ্ভুত ও কী অসাধারণ ঘটনার ধারার সঙ্গে প্রবাহিত হয়ে গিয়েছে এই সাতটি বৎসরের প্রত্যেকটি দিন! সাত বৎসরের মধ্যে পৃথিবীর আর কোনও মানুষ সভ্যতার ইতিহাসে এমন চিরস্মরণীয় পরিবর্তন আনতে পারেনি।
এইবারে আলেকজান্ডার নিশ্চিন্ত হয়ে আবার পারস্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। পারস্যের খ্যাতি, প্রতিপত্তি ও অদ্বিতীয়তার মূলে তিনি প্রচণ্ড আঘাত করেছেন বটে, কিন্তু এখনও সে ধূলিসাৎ হয়নি, এখনও সে মৃত নয়।
এদিকে দরায়ুসও বুঝতে পেরেছেন, আলেকজান্ডার হচ্ছেন অপরাজেয়। অন্তত তাঁকে দমন করতে পারে পারস্যের এমন শক্তি নেই। তাড়াতাড়ি তিনি সন্ধির প্রস্তাব করে পাঠালেন। ইউফ্রেটেস নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আলেকজান্ডারের হাতে তিনি নিজের কন্যা ও প্রচুর অর্থ সমর্পণ করতে চাইলেন। অন্য যে-কোনও লোক এ শর্তে রাজি হয়ে যেত—কিন্তু আলেকজান্ডার সে লোক নন।
প্রধান সেনাপতি পার্মেনিয়ো বললেন, ‘রাজা, আমি যদি আলেকজান্ডার হতুম, তাহলে এই প্রস্তাবেই সায় দিতুম।’
আলেকজান্ডার বললেন, ‘ঠিক। আমি যদি পার্মেনিয়ো হতুম, এ প্রস্তাবে নিশ্চয়ই নারাজ হতুম না!’
দরায়ুস তখন আবার যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হবার জন্যে বিপুল আয়োজন করলেন। তখনও তাঁর সাম্রাজ্য ছিল বহুজনপূর্ণ ও বহুদূরবিস্তৃত। সাম্রাজ্যের নানা প্রদেশ থেকে নানাজাতীয় সৈনিক এসে দরায়ুসের পতাকার তলায় সমবেত হল—এমনকী, ভারত থেকে কয়েক হাজার ভারতীয় ধনুকধারী সৈনিক পর্যন্ত। এবারে যুদ্ধের আয়োজন হল আর এক বিখ্যাত প্রাচীন সভ্যতার ক্ষেত্রে—অর্থাৎ বাবিলনে। টাইগ্রিস নদীর নিকটে গৌগামালা নামক স্থানে দরায়ুস তাঁর শিবির স্থাপন করলেন।
আলেকজান্ডারের সৈন্যসংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ হাজার। কিন্তু পারসিদের সংখ্যা তার চেয়ে এত বেশি ছিল যে, রণপ্রবীণ সেনাপতি পার্মেনিয়ো পর্যন্ত ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি বললেন, ‘রাজা, দিনের আলোয় শত্রুদের সংখ্যা দেখলে গ্রিকরা হতাশ হতে পারে। তার চেয়ে রাতের অন্ধকারে আমরা আক্রমণ করব, আমাদের সৈন্যরা কিছু বুঝতে পারবে না।’
আলেকজান্ডার বললেন, ‘তা হয় না। আমি বিজয়গৌরব চুরি করতে চাই না।’
রাত্রির তিমিরাবগুণ্ঠন ভেদ করে ফুটে উঠল পারস্যশিবিরের হাজার হাজার আলোকমালা এবং সেখান থেকে বায়ু তরঙ্গে ভেসে আসতে লাগল সাগর গর্জনের মতন গম্ভীর কোলাহল। সেখানে দাঁড়ালে চোখ আর কান দুই-ই অভিভূত হয়।
এই যুদ্ধের উপরে গ্রিসের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। আলেকজান্ডার ছিলেন অদৃষ্টবাদী। জ্যোতিষীদের আনিয়ে নিজের ভাগ্যগণনা করলেন। ফল হল সন্তোষজনক। তখন দেবতার উদ্দেশে পূজা নিবেদন করে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি নিশ্চিন্ত শিশুর মতো।
পরদিন যুদ্ধ আরম্ভ হলে দেখা গেল, ঘনব্যূহ ভেদ করবার জন্যে পারসিরা একরকম অস্ত্র-কণ্টকিত রথ আবিষ্কার করেছে। একে পারসিদের সংখ্যা এত বেশি যে, গ্রিক সৈন্যসীমার দুই পাশ ছাড়িয়ে তাদের ব্যূহ অনেক দূরে ছড়িয়ে পড়েছে, তার উপরে আবার এই নূতন আবিষ্কারের বিভীষিকা! গ্রিকরা রীতিমতো চাঞ্চল্য প্রকাশ করতে লাগল।
কিন্তু আলেকজান্ডার অচঞ্চল। রথ ছুটতে পারে সমতলক্ষেত্রে। তাঁর ডান পাশে ছিল অসমোচ্চ পাহাড়ে জমি, অস্ত্র-কণ্টকিত রথের গতিরোধ করবার জন্যে তিনি সৈন্য সমাবেশ করলেন সেইখানে। এবং পারসিরাও তাঁর অভিপ্রায় বুঝে গ্রিকদের বামপার্শ্বস্থ সমতল ক্ষেত্রে সরে এল।
দরায়ুস, আলেকজান্ডারের কৌশল ধরে ফেলে গ্রিকদের ডান পাশ আক্রমণ করবার জন্যে পাঠিয়ে দিলেন অশ্বারোহী সৈন্যদের। বর্শা ও তরবারি নিয়ে পারসি অশ্বারোহীরা আকাশে বাতাসে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে এসে পড়ল গ্রিকদের উপরে, হই হই রবে! খড়েগ খড়েগ ঝনঝন সংগীত—সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমক! হাজার হাজার বর্শা ফলক উঠল এবং নামল—শত শত গ্রিকদেহ ফুঁড়ে বেরিয়ে এল রক্ত ফোয়ারা! গ্রিকদল পশ্চাৎপদ—পারসিদের বিজয় হুঙ্কার।
আলেকজান্ডার চিৎকার করে বললেন, ‘গ্রিসের ছেলে তোমরা, পিছিয়ে এসো না—এগিয়ে যাও! ভুলো না, এই পারসি বর্বররা একদিন গ্রিক দেবতাদের মন্দির কলঙ্কিত করেছিল—আজ তার প্রতিশোধ নাও!’
গ্রিকরা আবার ফিরে দাঁড়াল—এবারে পারসিরা হল পশ্চাৎপদ!
অস্ত্র-কণ্টকিত রথ ছুটে আসতে লাগল গ্রিকদের বাম পাশের সমতল ক্ষেত্রের উপর দিয়ে। রথ আর রথ আর রথ—কত রথ! তাদের গাত্র-সংলগ্ন ধারালো অস্ত্রগুলো মুখ বাড়িয়ে আছে যেন ঘনব্যূহের নরদেহগুলোকে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে দেবার জন্যে! কিন্তু গ্রিক ধনুক থেকে ছুটতে লাগল শোঁ শোঁ শব্দে ঝাঁকে ঝাঁকে বাণ এবং আঠারো ফুট লম্বা বর্শাগুলো আন্দোলিত হতে লাগল ঘন ঘন! কত রথ অচল! তবু ছুটে আসে অন্য রথ! তখন ঘনব্যূহের সৈন্যরা হঠাৎ দুই পাশে সরে গেল এবং সামনে গলিপথ বেয়ে ভিতরে গিয়ে ঢুকল রথগুলো! অমনি ঘনব্যূহের দুইপাশ আবার এক হয়ে বন্ধ করে দিলে পথ এবং চারিপাশ থেকে আক্রান্ত রথগুলো হল চূর্ণবিচূর্ণ।
আগেই বলা হয়েছে, পারসি ফৌজের অধিকাংশ সরে এসেছিল গ্রিকদের বাম পার্শ্বে। ফলে তাদের মধ্যভাগ দুর্বল হয়ে পড়ল।
তীক্ষ্ণচক্ষু আলেকজান্ডার তা লক্ষ করেই তাঁর প্রধান সৈন্যদল দিয়ে প্রচণ্ড বেগে পারসিদের মধ্যভাগ আক্রমণ করলেন।
ফল হল সাংঘাতিক। পারসিদের অশ্বারোহী দল পশ্চাৎপদ, পারসিদের অস্ত্র-কণ্টকিত রথগুলো অচল বা চূর্ণবিচূর্ণ এবং পারসিদের দুর্বল মধ্যভাগ বিধ্বস্ত! এরপর তাদের আর কোনও আশা রইল না।
ওই দেখা যায় সম্রাট দরায়ুসের সমুজ্জ্বল রথ! কিন্তু কী দুর্গতি তার! চারিদিকে তাঁর হত বা আহত নরদেহের স্তূপ—সামনে, পিছনে, দক্ষিণে, বামে কোনওদিকে তাঁর নড়বার উপায় নেই। অচল-রথের অসহায় সম্রাট, আর তাঁর রক্ষা নেই!
আলেকজান্ডার নিজের অশ্বারোহীদের ডেকে সম্রাটকে বন্দি করবার হুকুম দিতে যাবেন, সেইসময় বামপার্শ্ব থেকে পার্মেনিয়োর জরুরি আবেদন এল—’আমি আর শত্রুদের রুখতে পারছি না—সৈন্য পাঠান, সৈন্য পাঠান!’
যে পারসি সৈন্যরা গ্রিকদের বাম পাশে ছিল, তারা তখনও ভয়াবহ বিক্রমে যুদ্ধ করছিল, তাদের ঠেকাতে পারছিল না গ্রিকরা।
যে গ্রিক অশ্বারোহীরা বিশৃঙ্খল পারসিব্যূহের মধ্যভাগে গিয়ে দরায়ুসকে বন্দি করতে পারত, তখন তাদের ছুটে যেতে হল পার্মেনিয়োকে সাহায্য করতে।
সেই ফাঁকে সচল-রথ থেকে লাফিয়ে পড়ে একটা ঘোড়ায় চড়ে দরায়ুস তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেলেন। আলেকজান্ডার মহা আক্রোশে পার্মেনিয়োকে দিতে লাগলেন অভিশাপ! তাঁর অভিযোগ হচ্ছে, পারসিদের মধ্য ও বাম ভাগ যখন বিধ্বস্ত হয়েছে তখন তারা তো শক্তিহীন! দরায়ুসকে বন্দি করতে পারলে তাদের বাকি সৈন্যরা কতক্ষণ আর লড়াই করতে পারত? পার্মেনিয়ো আমার মুখের গ্রাস কেড়ে নিলেন!
সম্রাট পলাতক শুনে যেসব পারসি সৈন্য তখনও লড়াই করছিল তারাও অদৃশ্য হল কে কোথায়!
নেমে এল অন্ধ-রাত্রির তিমির যবনিকা, ঢেকে গেল পৃথিবীর বীভৎস রক্ত চিত্র, জেগে রইল কেবল আসন্ন মৃত্যুর কাতর ক্রন্দন।
দরায়ুসের সঙ্গে সঙ্গে সেই কালো রাত্রির অন্ধকারে পালিয়ে গেলেন পারস্যের সৌভাগ্যলক্ষ্মী।
বাবিলন আলেকজান্ডারের হস্তগত। কিন্তু এখনও অক্ষত আছে নিজ পারস্য ও মিডিয়া—যেখান থেকে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে পারসি সাম্রাজ্য! তার উপরে দরায়ুস এখনও নাগালের বাইরে! সুতরাং কর্তব্য এখনও অসমাপ্ত।
আলেকজান্ডার আবার অগ্রসর হলেন। আবার এখানে-ওখানে দুই-একটা ছোটখাটো যুদ্ধের পর পারস্যের বৃহৎ নগর সুসা এবং তার রাজধানী পার্শেপোলিস তাঁর হস্তগত হল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পেলেন যুগে যুগে সঞ্চিত পারসি রাজভাণ্ডারের অতুল ঐশ্বর্য। আরও পেলেন সেইসব লুণ্ঠিত দ্রব্য, সম্রাট ক্সের্ক্সেস গত যুগে যা এথেন্স থেকে কেড়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
তারপর দরায়ুসকে অধীনতা স্বীকার করবার জন্যে তিনি কিছুদিন সময় দিলেন। কিন্তু দরায়ুস এতখানি মাথা নোয়াতে রাজি হলেন না, একবেতানার (বর্তমান হামাদান) প্রাসাদে অচলের মতন বসে বসে ফেলতে লাগলেন দীর্ঘশ্বাস। এরপর এখানেও আর একবার যুদ্ধের চেষ্টা হল। কিন্তু আলেকজান্ডারের আগমন সংবাদ পেয়েই দরায়ুসের সমস্ত সাহস উবে গেল, আবার তিনি পলায়ন করলেন।
আলেকজান্ডার আজ পারস্যে অদ্বিতীয়। পারস্যের রাজসিংহাসন এখন তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছে। পারস্য আর কোনওদিন গ্রিসের প্রভু হবার জন্যে স্পর্দ্ধা প্রকাশ করবে না। তিনি পিতৃকৃত্য পালন করেছেন।
পরিষদবর্গ বললে, ‘রাজা, এখনও পূর্ণ প্রতিশোধ নেওয়া হয়নি।’
—’আরও কী প্রতিশোধ নিতে চাও?’
—’রাজা, ভুলে যাবেন না, তৃতীয় দরায়ুসের পূর্বপুরুষ ক্সের্ক্সেস আমাদের পবিত্র এথেন্স নগরীকে সমর্পণ করেছিল অগ্নিশিখার মধ্যে। তারই প্রতিশোধ চাই! আমরাও পুড়িয়ে ছাই করব ক্সের্ক্সেসের প্রাসাদকে!’
—’উত্তম! তার আয়োজন করো।’
দলে দলে লোক ছুটে এল জ্বলন্ত মশাল হাতে করে। তাদের পুরোভাগে গিয়ে দাঁড়ালেন আলেকজান্ডার—তাঁরও হাতে নৃত্যশীল অগ্নিশিখা এবং মাথায় জড়ানো ফুলের মালা।
ধূ ধূ করে জ্বলে উঠল সেই জগতে অতুলনীয় বিরাট প্রাসাদ—হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে লাগল তার বর্ণবিচিত্র। কারুকার্যে কমনীয় উচ্চ ভিত্তি, ফেটে চৌচির হয়ে যেতে লাগল। তার দর্পণের মতন মসৃণ শিলাস্তম্ভগুলো, অগ্নিবেত্রাঘাতে বিদীর্ণ হয়ে যেন আর্তরব করতে লাগল ওস্তাদ শিল্পীদের হাতে গড়া প্রস্তরমূর্তিরা! একটা বৃহৎ সভ্যতার বহুযুগব্যাপী শিল্পসাধনার আদর্শ গড়াগড়ি দেয় বুঝি ধুলায়!
আলেকজান্ডার তরুণ যুবক ছাড়া কিছুই নন, বন্ধুদের প্ররোচনায় হঠাৎ তিনি আত্মবিস্মৃত হয়েছিলেন। এখন হঠাৎ আবার কী ভেবে অনুতপ্ত কণ্ঠে চিৎকার করে হুকুম দিলেন—’না, না! নিবিয়ে ফ্যালো, নিবিয়ে ফ্যালো—আগুন নিবিয়ে ফ্যালো!’
আগুন নিবল বটে—কিন্তু প্রাসাদের অনেকখানি গ্রাস করে। আজ প্রত্নতাত্বিকরা আবার আবিষ্কার করেছেন প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ।
কিন্তু কী ভেবে আলেকজান্ডার আগুন নেবাবার আদেশ দিয়েছিলেন? পারস্যের প্রভু হয়ে কি তাঁর মনে হঠাৎ নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত জেগেছিল? না, দিগবিজয়ে বেরুবার আগেই মানস নেত্রের সামনে তিনি নিজের সে অপূর্ব পরিকল্পনা দেখতে পেয়েছিলেন, আবার তারই ছবি আচম্বিতে তাঁর মনে পড়ে গেল?
জোর করে কিছু বলা যায় না। কারণ, আলেকজান্ডারের নিজের মুখের কথা সেদিন কেউ শোনেনি।
কিন্তু আর একদিনের ঘটনা নিয়ে আলোচনা করলে যেন এই রহস্যের ভিতরটা অস্পষ্টভাবে দেখা যায়!
একদিন আলেকজান্ডার পথে যেতে যেতে দেখলেন, মস্ত একটি পাথরের মূর্তি গড়াগড়ি যাচ্ছে।
শুনলেন, এ হচ্ছে ক্সের্ক্সেসের প্রস্তরমূর্তি।
আলেকজান্ডার সেই ভূপতিত মূর্তির উপরে উঠে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন।
তারপর বললেন, ‘আমার কী করা উচিত? তুমি গ্রিসকে আক্রমণ করেছিলে বলে তোমাকে কি এই পথের ধুলোতেই শুইয়ে রাখব? না, তোমার অসীম সাহস আর শক্তিকে মর্যাদা দেবার জন্যে আবার তোমাকে তুলে দাঁড় করিয়ে দেব?’
মনে মনে যেন এই সমস্যা পূরণের জন্যেই তিনি মৌন হয়ে রইলেন। তারপর আর কিছু না বলে প্রস্থান করলেন।
পারস্য বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই আলেকজান্ডার দেখতে হয়তো পেয়েছিলেন নিজের জন্যে একটি বিশেষ পথ। এখনও এ নতুন পথে চলেনি আর পথিক। সে পথের শেষে ছিল এমন একটি মিলনক্ষেত্র, প্রতীচ্য যেখানে দাঁড়াতে পারে প্রাচ্যের হাত ধরে।
এই হচ্ছে আধুনিক ঐতিহাসিকদের অনুমান। এমন অনুমানের কোনও সঙ্গত কারণ আছে কি না, পরে আমরা তাও দেখবার চেষ্টা করব। তবে জোর করে কিছু বলা যায় না। কারণ, আলেকজান্ডারের স্বল্পস্থায়ী জীবন হচ্ছে অসম্পূর্ণ মহাকাব্য।