সপ্তম। হৈম সংঘ
১৩৭০-১৩৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চেঙ্গিজ খাঁয়ের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মহাসাম্রাজ্যের অধিকাংশই মানচিত্রের উপর থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু তৈমুরের সাম্রাজ্যের উত্তরে ও পূর্বে চেঙ্গিজের বংশধররা তখনও বিরাট এক ভূভাগের উপরে শাসনদণ্ড পরিচালনা করতেন। একে ডাকা হত ‘হৈম সংঘ’ নামে।
কেবল এর শাসনকর্তারা ছিলেন মোগলবংশীয়। অধীন জাতিদের মধ্যে নানাদেশীয় যাযাবরদের সঙ্গে ছিল অসংখ্য রুশীয়, বুলগেরীয়, আর্মেনিয়ান ও বেদে প্রভৃতি। আধুনিক রুশিয়ার অধিকাংশই ছিল এই হৈম সংঘের অধীনে।
শাসক সম্প্রদায় বা মোগলরা ছিল অর্ধ পৌত্তলিক। তাদের তৈমুরের তাতারদের জাত-ভাই বলা যায়। তাদের প্রধান দুই নগর ছিল ভোল্গা নদীর তীরবর্তী সরাই এবং কাস্পিয়ান সাগর তটস্থ অস্ট্রোকান। সুদীর্ঘ দেড় শত বৎসর কাল ধরে ইউরোপের শিয়রে তারা জেগেছিল দারুণ দুঃস্বপ্নের মতন। পূর্ব-ইউরোপ তাদের হস্তগত ছিল তো বটেই, তার উপর তারা পোল্যান্ডেও এসে হানা দিয়েছিল।
মস্কোর রাজকুমার মিট্রি একবার মাত্র দেড় লক্ষ রুশীয় সৈন্য নিয়ে এই মোগলদের আক্রমণ করে হারিয়ে দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু এ সৌভাগ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
এই সময়ে মোগল সম্রাট ছিলেন উরুস খাঁ।
উরুস খাঁয়ের এক নিকট আত্মীয়ের নাম তোক্তামিস। সম্ভবত সিংহাসনের পথ নিষ্কণ্টক করবার জন্যেই একদিন তিনি উরুস খাঁয়ের পুত্রকে হত্যা করে তৈমুরের কাছে পালিয়ে গেলেন।
মোগলদের দূত তৈমুরের কাছে গিয়ে জানালে, ‘পূর্ব ও পশ্চিমের প্রভু মহামহিমময় উরুস খাঁ আমাকে পাঠিয়েছেন। তৈমুর, হয় তুমি তোক্তামিসকে আমাদের হাতে সমর্পণ করো, নয় করো অস্ত্রধারণ!’
তৈমুরের চোখে জাগছে তখন পৃথিবী বিজয়ের স্বপ্ন। তিনি বুঝলেন এ স্বপ্ন সফল করতে গেলে মোগলদের সঙ্গে একদিন-না-একদিন তাঁকে শক্তিপরীক্ষা করতে হবেই। এ সুযোগ তিনি ছাড়লেন না।
তৈমুর বললেন, ‘দূত, তোক্তামিস আমার আশ্রিত। তাঁকে আমি ত্যাগ করব না। উরুস খাঁকে জানিয়ো, আমি অস্ত্রধারণ করতে প্রস্তুত।’
দূত ফিরে গেল। তৈমুর তোক্তামিসকে ‘পুত্র’ বলে ডাকলেন। এবং হৈম সংঘের মোগলদের কাছ থেকে দুটি শহর কেড়ে নিয়ে তোক্তামিসের হাতে সমর্পণ করলেন। উপরন্তু তাঁকে অনেক সৈন্যসামন্ত, অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ-সম্পত্তিও উপহার দিতে ভুললেন না।
তোক্তামিস হৈম সংঘের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেন, কিন্তু পরাজিত হলেন।
তৈমুর আবার তাঁকে নতুন সৈন্য দিলেন। তোক্তামিস আবার করলেন যুদ্ধযাত্রা। কিন্তু আবার হেরে ভূত হয়ে, কোনওরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে এলেন তৈমুরের কাছে।
এমনি সময়ে উরুস খাঁয়ের মৃত্যু হল এবং তোক্তামিস যুদ্ধে হেরেও লাভ করলেন হৈম সংঘের সিংহাসন।
রাজধানী সরাই শহরে গিয়ে তোক্তামিস প্রথমেই মস্কো ও রুশিয়ার রাজাদের কাছ থেকে কর চেয়ে পাঠালেন।
এরই দুই বছর আগে মিট্রির নায়কতায় রুশীয়রা হয়েছিল যুদ্ধে জয়ী। তারা কর দিতে রাজি হল না।
মোগলরা বাঁধভাঙা বন্যার মতন রুশিয়ার উপরে ভেঙে পড়ল। রুশিয়ার গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর দিগবিদিকব্যাপী অগ্নিশিখায় পুড়ে ছাই হয়ে গেল—লক্ষ লক্ষ লোক হল হত ও আহত এবং মস্কো হল তোক্তামিসের হস্তগত। সমগ্র রুশিয়া রক্তাক্ত হয়ে আবার মোগলদের অধীনতা স্বীকার করলে।
তোক্তামিস এখন আর পলাতক ও পরের গলগ্রহ নন—হচ্ছেন অর্ধ ইউরোপ-এশিয়ার সম্রাট! তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতার কোনওই মূল্য নেই।
সমরখন্দের আশ্চর্য ঐশ্বর্য স্বচক্ষে দেখবার সুযোগ তাঁর হয়েছে। সেখানে তৈমুরের আশ্রয়ে বেশ কিছুকাল বাস করে তিনি যে বিলাসিতার আস্বাদ পেয়েছেন, মোগল-সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেও তা ভুলতে পারলেন না।
তৈমুর তখন রাজধানী থেকে বহুদূরে—কাস্পিয়ান সমুদ্রের তীরে।
ঠিক সাত দিনে নয় শত মাইল পার হয়ে রাজধানী সমরখন্দ থেকে এক অশ্বারোহী বার্তাবহ এসে উপস্থিত!
কী খবর? না, তোক্তামিসের মোগলবাহিনী সমরখন্দের অনতিদূরে এসে হাজির হয়েছে!
তৈমুর বিদ্যুৎ-বেগে তখনই যুদ্ধযাত্রা করলেন।
তৈমুরের পুত্র ওমর শেখ প্রাণপণে যুদ্ধ করেও মোগলদের কাছে হেরে গিয়েছেন, তাতার সৈন্যেরা পলাতক। শত্রুরা বোখারা পর্যন্ত এসেছে—সেখানকার রাজপ্রাসাদ পুড়িয়ে দিয়েছে। সুযোগ দেখে উরগঞ্জের সুফিরা এবং চিরশত্রু জাট-মোগলরা আবার বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।
কিন্তু ঘটনাক্ষেত্রে তৈমুরের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্য পরিবর্তন!
তোক্তামিস সদলবলে সরে পড়লেন। সুফি জাটদের দেশ প্রায় সমভূমিতে পরিণত করে তৈমুর সেখানকার বাসিন্দাদের বন্দি করে সমরখন্দে নিয়ে এলেন।
তৈমুর বললেন, ‘নিমকহারাম তোক্তামিস অকারণে আমার রাজ্য আক্রমণ করেছে—আমার প্রজাদের উপরে অত্যাচার করেছে। এর প্রতিশোধ চাই।’
আমির-ওমরাওরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী প্রতিশোধ সম্রাট?’
‘আমি তোক্তামিসকে দমন করব, তার রাজ্য আক্রমণ করব।’
‘সম্রাট, সে যে অসম্ভব। তোক্তামিসকে ধরতে হলে হাজার হাজার মাইল ব্যাপী মরুভূমির মধ্যে ছুটে বেড়াতে হবে। সে যে কোথায় লুকিয়ে আছে কেউ তা জানে না। আমাদের উচিত, আবার তার দেখা না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা।’
‘কীসের জন্যে অপেক্ষা করব? বিশ্বজয়ের সময় এসেছে এখন আর অপেক্ষা নয়। তাঁবু ওঠাও! যাত্রা করো!’
বেজে উঠল তূরী ভোঁ-ভোঁ-ভোঁ, দামামা ডিমি-ডিমি-ডিমি! উড়ল নিশান, ছুটল অশ্বারোহী, কাঁপল পৃথিবীর প্রাণ! কাতারে কাতারে তাতারের দল চলল এক বিস্ময়কর কীর্তি স্থাপন করতে।
বুদ্ধিমান আমির-ওমরাওরা সভয়ে ভাবলেন, তাঁরা আজ যাত্রা করেছেন বিরাট এক শ্মশানের দিকে—যেখানে বাস করে কেবল মৃত্যু, মড়ক ও দুর্ভিক্ষ!
তাঁদের ধারণা নিতান্ত ভ্রান্ত নয়। তৈমুরের কয়েক শতাব্দী পরে এই ভয়াবহ পথে পা বাড়িয়ে নেপোলিয়ন বিজয়ী হয়েও তাঁর বিরাট বাহিনীকে রেখে গিয়েছিলেন রুশিয়ার তুষার-সমাধির মধ্যে!
পিটার দি গ্রেট রুশিয়ারই সম্রাট। ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দে এই পথে তুর্কিদের বিরুদ্ধে তিনি মস্ত একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। তাদের একজনও ফিরে যায়নি।
তারও এক শতাব্দী পরে আর একদল রুশীয় সৈন্য কাউন্ট পেরোভস্কির অধীনে এই পথে যাত্রা করে। বিনা যুদ্ধেই অধিকাংশ সৈন্য হারিয়ে সেবারেও কাউন্টকে হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়।
আর আজও বিজ্ঞানের এই সর্বাঙ্গীন উন্নতির যুগে রুশিয়ার তুষার-মরুর মধ্যে দুর্ধর্ষ জার্মানদের যে কী হাহাকার করতে হয়েছে, আমাদের কারুর তা শুনতে বাকি নেই।
সুতরাং আমির-ওমরাওরা অকারণে ভয় পাননি।
কিন্তু তৈমুর ফিরলেন না। তাঁর তিনটি মূলমন্ত্র ছিল।
প্রথম : নিজের রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ করব না।
দ্বিতীয় : আত্মরক্ষা নয়, আক্রমণ করা।
তৃতীয় : যত শীঘ্র সম্ভব, শত্রুর উপরে গিয়ে পড়া।
তৈমুর বলতেন, ‘যথাস্থানে যথাসময়ে দশ হাজার লোক না পেলে দশজন লোক নিয়েও হাজির হওয়া ভালো! শত্রুরা পূর্ণশক্তি সঞ্চয় করবার আগেই তাদের আক্রমণ করা উচিত।’
তৈমুরের আগে আলেকজান্ডার ও তৈমুরের পরে নেপোলিয়নও এই যুদ্ধরীতির অনুসরণ করেছিলেন।
তোক্তামিস যুদ্ধ করবেন নিজের দেশে। তাঁকে রুশীদের জন্যে ভাবতে হবে না এবং তাঁর সৈন্য তৈমুরের তুলনায় অসংখ্য। কিন্তু তবু তৈমুর ভয় পেলেন না—ছুটে চললেন ঝড়ের মতন। তৈমুর অগ্রসর হন, তোক্তামিস যুদ্ধ করেন না, খালি পিছিয়ে যান; এবং পিছিয়ে যেতে যেতে সমস্ত গ্রাম, শহর, খাদ্য, শস্য পুড়িয়ে দিয়ে যান; অর্থাৎ নেপোলিয়নের সময়ে এবং গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মান আক্রমণের দিনে রুশীয়রা যে প্রথা অবলম্বন করেছে এবং এখন পৃথিবীর সমস্ত সামরিক জাতিই যে প্রথার উপকারিতা বুঝতে পেরেছে, তার প্রথম সৃষ্টি হয় সেই তৈমুরের যুগেই চতুর্দশ শতাব্দীতে।
দিনের পর দিন, হপ্তার পর হপ্তা! চলেছে তাতার সৈন্যশ্রেণি এবং তাদের সঙ্গে চলেছে এমন সব প্রকাণ্ড শকট, যেগুলোর এক-একখানা চাকাই হচ্ছে মানুষের মাথার সমান উঁচু! এইসব গাড়ির ভিতরে আছে আবশ্যকীয় সমস্ত জিনিস এবং খাদ্যদ্রব্য—ময়দা, বার্লি ও শুকনো ফলমূল প্রভৃতি। প্রত্যেক সৈন্যের সঙ্গে আছে দুটো করে ঘোড়া। প্রত্যেক সৈনিকই অশ্বারোহী।
রীতিমতো মরুভূমি—বালিয়াড়ির পর বালিয়াড়ি, ঝোড়ো হাওয়া সেই মরু-সাগরে সৃষ্টি করে বালুকার তরঙ্গ! বেজে ওঠে সাতফুট লম্বা তাতার তূরী, তারই সঙ্কেত ধ্বনি শুনে সৈন্যরা তাঁবু ফেলে বা তাঁবু তোলে।
মরু-বালুকার পর এল বৃক্ষহীন তৃণপ্রান্তরের দেশ। এ প্রান্তর যেন অনন্ত—কোথাও ছায়া নেই, আশ্রয় নেই, লোকালয় নেই—এমনকী শত্রুও নেই।
মাঝে মাঝে শত্রুর চিহ্ন দেখা যায়। উট, ঘোড়া বা মানুষের পায়ের দাগ, নির্বাপিত আগুনের চিহ্ন বা মানুষের মাংসহীন কঙ্কাল।
প্রত্যেক সৈনিকের বরাদ্দ ছিল মাসে ষোলো সের ময়দা। কিন্তু অবশেষে ফুরিয়ে গেল ময়দা। ঘোড়াদের ঘাসের অভাব হল না বটে, কিন্তু মানুষরা মূল কুড়িয়ে বা পাখির ডিম সংগ্রহ করে কোনওরকমে বেঁচে রইল মাত্র।
আমির-ওমরাওরা মাথা নেড়ে বিষণ্ণভাবে বলতে লাগলেন, ‘এ আমরা আগেই জানতুম! এখন আর ফিরে যাওয়ারও উপায় নেই—এইবারে সবাইকে মরতে হবে অনাহারে।’
তৈমুরের মুখে কিন্তু চিন্তার রেখা নেই। তিনি দেখলেন, এই মালভূমিতে গাছপালা নেই বটে, কিন্তু পাঁচ-ছয়-সাত ফুট উঁচু এক জাতের তৃণ আছে।
তখন তাঁর হুকুমে এক লক্ষ সৈন্য ত্রিশ মাইল জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে বিপুল এক মণ্ডলের সৃষ্টি করলে এবং ক্রমেই এগিয়ে এসে তারা মণ্ডলের আকার ছোট করে আনতে লাগল। তখন এক লক্ষ লোকের গগনভেদী চিৎকারে তূরী-ভেরি-দামামার ধ্বনিতে ভয় পেয়ে সেই সুদীর্ঘ তৃণদলের ভিতর থেকে আত্মপ্রকাশ করতে লাগল পালে পালে খরগোশ, মৃগ, বরাহ, নেকড়ে, ভালুক ও ‘এলফ’ বা মহিষের মতন বড় বড় হরিণ! ক্ষুধার্ত তাতারদের সেই সাংঘাতিক মণ্ডলের মধ্যে থেকে একটি মাত্র খরগোশও বাইরে পালাতে পারলে না!
খাদ্যের দুর্ভাবনা দূর হল তৈমুরের অদ্ভুত বুদ্ধিবলে। মাংস ভালো ভাবে রক্ষা করতে পারলে এখন বেশ কিছুকাল আহার্যের অভাব হবে না। শত্রুরা তাদের অনাহারে মারতে চায়, কিন্তু তৈমুরের প্রতিভা ব্যর্থ করে দিলে তাদের সেই অপচেষ্টা!
তৈমুর বললেন, ‘সৈন্যগণ, আজ তোমাদের ছুটি। খাও-দাও, আমোদ করো!’
সারি সারি তাঁবু পড়ল। বহুদিন পরে সৈনিকরা পেট ভরে খেয়ে হাসিখুশি নাচ-গানে মেতে উঠল।
পরদিনেই আবার ছয় ফুট বড় ডঙ্কা গম্ভীর স্বরে বেজে উঠে সকলকে জানিয়ে দিলে—’আর বিশ্রাম নয়—যাত্রা করো, যাত্রা করো, যাত্রা করো!’
এইবার সামনে আছে আর এক ভয়ানক দেশ, লোকে যার নাম রেখেছে ‘ছায়াচরের মুল্লুক’।