সপ্তম। নায়কের মঞ্চে প্রবেশ
প্রভাত কাল। থানেশ্বরের রাজপ্রাসাদ।
আজ থেকে কিঞ্চিদধিক তেরোশো পঞ্চাশ বৎসর আগেকার কথা বলছি। বর্তমানের পটে সেদিনকার আর্যাবর্তের আলোকচিত্র একেবারেই ঝাপসা হয়ে গিয়েছে বটে, কিন্তু আজও অপরিবর্তিত হয়ে আছে সেদিনকার দৃশ্যমান প্রকৃতি।
নির্মল নীলাকাশ, জ্যোতির্ময় প্রভাত-সূর্য, সোনালি কিরণ-বন্যা, মুক্তকণ্ঠ গানের পাখি, স্নিগ্ধ সমীরণ-হিন্দোলায় ছন্দে ছন্দে আন্দোলিত শ্যামলতা। প্রকৃতি বর্ণনা করতে বসলে আজকের লেখকও এর চেয়ে নতুন কিছু দেখাতে পারবেন না।
রাজকুমার হর্ষবর্ধন আপন মনে করছিলেন কাব্য রচনা।
কৃপাণ এবং লেখনী, এই দুটিই হর্ষবর্ধনের কাছে ছিল সমান প্রিয়। বালক বয়স থেকে ভালোবাসতেন তিনি কবিতাকে এবং পরিণত বয়সে এই কাব্যানুরাগ তাঁর খ্যাতিকে কতখানি অমর করে তুলেছিল, সেটা আমরা দেখতে পাব যথাসময়েই। হর্ষবর্ধনের নিজের সৃষ্ট কাব্যালোকের মধ্যে আজও তাঁর মনের কথা উত্তপ্ত ও জীবন্ত হয়ে আছে বিশ্বসাহিত্যের মধ্যে।
হর্ষবর্ধন সেদিন কবিতা রচনা করছিলেন। কিন্তু প্রথম শ্লোকটি শেষ করতে না করতেই হঠাৎ বিঘ্ন উপস্থিত হল।
পরিচারক এসে জানালে সেনাপতি সিংহনাদ দ্বারদেশে অপেক্ষা করছেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তিনি দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছেন।
হর্ষবর্ধন সচমকে বললেন, ‘দুঃসংবাদ? কী দুঃসংবাদ?’
‘আমি জানি না প্রভু!’
‘বেশ, সেনাপতিকে এখানে আসতে বলো।’
সেনাপতি সিংহনাদ ঘরের ভিতর এসে দাঁড়ালেন! তাঁর মুখ চোখ উদ্ভ্রান্তের মতো।
‘কী ব্যাপার সেনাপতি?’
সিংহনাদ প্রায়-অবরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন,
‘দেব দেবভূয়ং গত নরেন্দ্রে দুষ্টগৌড়ভুজঙ্গজগ্ধজীবিতে চ।
রাজ্যবর্ধনে বৃত্তেহস্মিন মহাপ্রলয়ে ধরণীধারণায়াধুনাত্বং শেষঃ।’
হর্ষবর্ধনের বুকের মধ্য দিয়ে যেন উল্কাগতির প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেল, খসে পড়ল তাঁর হাত থেকে লেখনী! আড়ষ্ট কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন, ‘সেনাপতি, কী বললেন? দুষ্ট গৌড়ভুজঙ্গের দংশনে মহারাজা রাজ্যবর্ধন স্বর্গে প্রস্থান করেছেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ দেব!’
‘গৌড়ভুজঙ্গ? মগধবঙ্গের রাজা শশাঙ্ক? সেই গৌড়াধম হত্যা করেছে আমার দাদাকে?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ দেব! কেবল তাকেই হত্যা নয়, সেই দুরাচারের কবলে পড়ে আমাদের সাত হাজার সৈন্য একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।’
‘আর আমার দিদি রাজশ্রী? তাঁর খবর কী? দাদা তো তাঁকেই উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন।’
‘থানেশ্বরের রাজকন্যার কথা কেউ সঠিক বলতে পারছে না। কেবল এইটুকু জানা গিয়েছে যে তিনি এখন আর বন্দিনী নন। কিন্তু মহারাজা রাজ্যবর্ধনও তাঁর সন্ধান পাননি। লোকের মুখে প্রকাশ, রাজকন্যা নাকি বিন্ধ্য পর্বতের কোথায় গিয়ে আত্মগোপন করে আছেন।’
হর্ষবর্ধন আবার কী জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলেন, এমন সময়ে ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়ালেন তাঁর ভ্রাতৃ-সম্পর্কীয় ভণ্ডি ও আরও কয়েকজন মন্ত্রী।
ভণ্ডি বললেন, ‘কুমার হর্ষবর্ধন, রাজ্যের চারিদিকে বিষম আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে, থানেশ্বরের সিংহাসন আবার শূন্য। মহারাজা রাজ্যবর্ধনের শোচনীয় অকালমৃত্যু। আমাদের সকলকেই স্তম্ভিত করে দিয়েছে বটে, কিন্তু এখন আমাদের আত্মহারা হওয়ার বা শোক করবারও অবকাশ নেই। হর্ষবর্ধন, রাজ্যের মঙ্গলের জন্যে এখনই তোমাকে মুকুট ধারণ করতে হবে।’
হর্ষবর্ধন বেগে উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর দুই বিস্ফারিত চক্ষে ঠিকরে উঠল আগুনের ফিনকি। দৃপ্তকণ্ঠে তিনি বললেন, ‘মুকুট? আমি এখন মুকুট ধারণ করব? ছার এই মুকুট! আমার অত্যাচারিতা অভাগিনি বিধবা সহোদরা নিরুদ্দেশ, আমার দাদার—থানেশ্বরের মহারাজাধিরাজের পবিত্র মৃতদেহ নিয়ে এখন হয়তো কাড়াকাড়ি করছে শকুনি-গৃধিনীর দল, এই সময়ে মুকুট ধারণ করব আমি? আপনারা জ্যেষ্ঠ, আপনারা জ্ঞানী, কিন্তু এ কী বলছেন আপনারা! মুকুট এখন আমার কাছে তুচ্ছাদপি তুচ্ছ, এখন আমার কাম্য কেবল প্রতিহিংসা—প্রতিহিংসা—প্রতিহিংসা! আজ আপনারা সকলে আমার এই প্রতিজ্ঞা শুনে রাখুন, যত দিন না দিদি রাজশ্রীকে উদ্ধার করতে পারছি, যতদিন না আমার দাদার শত্রুদের শাস্তিবিধান করতে পারছি, ততদিন আমি দক্ষিণ হস্ত দিয়ে অন্নগ্রহণ করব না!’