উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

সপ্তদশ। বিশ্বাসঘাতকের পরিণাম

সপ্তদশ। বিশ্বাসঘাতকের পরিণাম

অর্জুনাশ্ব সকলকে সম্বোধন করে বললে, ‘বন্ধুগণ, চিনসম্রাট উত্তরাপথে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করার জন্যে আবার একদল লোক পাঠিয়েছে, এ কথা তোমরা সকলেই জানো। কিছুদিন আগে এইরকম এক প্রতারক প্রচারক এসে কেবল হর্ষবর্ধনের ধর্মনাশই করেনি, রাজার যোগ্য উপঢৌকন হস্তগত করে আবার স্বদেশে পলায়ন করেছে। এবারের চৈনিক প্রচারকও যথেষ্ট মূল্যবান সামগ্রী উপহার পেয়েছে। তারাও পলায়ন করতে চায়। কিন্তু এবারে আমরা তাদের বাধা দেব, তাদের হত্যা করব আর তাদের সমস্ত সম্পত্তি লুণ্ঠন না করে ছাড়ব না। হিন্দুর সম্পত্তি অহিন্দুর হস্তগত হবে, এ অন্যায় আমি প্রাণ থাকতে সহ্য করতে পারব না। বন্ধুগণ, সৈন্যগণ, অগ্রসর হও। জয় দেবাদিদেব মহাদেবের জয়!’

চৈনিক দূত ওয়াং-হিউয়েন-সি ও তাঁর সঙ্গীগণ তখন তিরিশ জন দেহরক্ষী নিয়ে তিরহুতের কাছে গিয়ে পড়েছেন। এত শীঘ্র দেশে ফেরবার ইচ্ছা তাঁদের ছিল না, কিন্তু এই সুদূর বিদেশে প্রবীণ পৃষ্ঠপোষক হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর আর তাঁদের ভারতের থাকবার ভরসা হয়নি।

আচম্বিতে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো অর্জুনাশ্ব তার দলবল নিয়ে চৈনিক দূতমণ্ডলীর উপরে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিদেশিরা এই অতর্কিত আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না, তাঁরা একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেন। দেহরক্ষীরা মারা পড়ল এবং সমস্ত সম্পত্তি লুণ্ঠিত হল বটে, কিন্তু ওয়াং-হিউয়েন-সি তাঁর জন কয় সঙ্গী নিয়ে কোনওরকম পলায়ন করে নেপালে গিয়ে উপস্থিত হলেন।

নেপাল তখন তিব্বতের বিখ্যাত বৌদ্ধরাজা স্রং-স্যান গ্যাম্পোর অধীন। তিনি লাসা নগরের প্রতিষ্ঠাতা এবং তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠা হয় তাঁরই চেষ্টায়। রাজা গ্যাম্পো বিবাহ করেছিলেন চিনসম্রাটের এক কন্যাকে।

তাঁর শ্বশুরের প্রেরিত দূতমণ্ডলীর উপরে বিশ্বাসঘাতক অর্জুনাশ্বের অত্যাচারের কথা শুনে রাজা গ্যাম্পো অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন, বললেন, ‘রাজদূত, আমি যদি আপনাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করি তাহলে আপনি কি নিজের অপমানের প্রতিশোধ নিতে পারবেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ, আমার হস্ত অস্ত্রধারণ করতেও সক্ষম।’

‘উত্তম। আপনার সঙ্গে যাবে আমার বাছা-বাছা বারো শত সেরা সৈনিক! তার উপরে থাকবে সাত হাজার নেপালি অশ্বারোহী। হিমালয় ছেড়ে নেমে যান আবার সমতল ক্ষেত্রে, চিনসম্রাটের মানরক্ষা আর ধার্মিক হর্ষবর্ধনের হত্যাকারীর শাস্তি বিধান করুন।’

অর্জুনাশ্ব তখনও তিরহুত পরিত্যাগ করেনি। গুপ্তচর মুখে সে ওয়াং-হিউয়েন-সির পুনরাগমনের সংবাদ পেয়ে রীতিমতো ভীত হয়ে উঠল, কারণ সে বেশ বুঝল যে, তার অধীনে যারা অস্ত্র ধরবে তারা সংখ্যায় বেশি থাকলেও যুদ্ধে দক্ষ সুশিক্ষিত তিব্বতি, নেপালি সৈন্যদের সমকক্ষ নয়। সে তাড়াতাড়ি বাগমতী নদীর তীরবর্তী দুর্গের ভিতর গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলে।

কিন্তু পূর্ণ হয়ে উঠেছে তখন অর্জুনাশ্বর বিষের পাত্র। মাত্র তিন দিনের চেষ্টার পর ওয়াং-হিউয়েন-সি দুর্গের মধ্যে প্রবেশ করলেন সদলবলে। অসভ্য জাতের অশিক্ষিত সৈন্যদের নিয়ে অর্জুনাশ্ব দুর্গ ছেড়ে পলায়নের চেষ্টা করলে। কিন্তু তার দশ হাজার সৈন্য বাগমতী নদীর গর্ভে লাভ করল সলিলসমাধি এবং তিব্বতিদের তরবারির মুখে উড়ে গেল তিন হাজারের মুণ্ড।

অর্জুনাশ্ব পালিয়ে গেল, কিন্তু তখনও পরিতৃপ্ত হল না তার রাজ্যলিপ্সা। তাড়াতাড়ি নতুন সৈন্য সংগ্রহ করে আবার সে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হল। কিন্তু ভগবান মুখ তুলে তাকালেন না তার মতো প্রভুহন্তা বিশ্বাসঘাতকের প্রতি। এবারেও সে হেরে গেল। যুদ্ধে তার কত লোক মারা পড়েছিল সে হিসাব জানবার তো উপায় নেই। কিন্তু তিব্বতি ও নেপালিরা এক হাজার শত্রুর মুণ্ডচ্ছেদ করেছিল এবং বন্দি করেছিল বারো হাজার লোক। অর্জুনাশ্বও ধরা পড়ল সপরিবারে। বিজয়ী তিব্বতিদের হস্তে আত্মসমর্পণ করলে ভারতের পাঁচশত আশিটি প্রাকারবেষ্টিত নগর।

ওয়াং-হিউয়েন-সি এবারে অর্জুনাশ্বকেও ছাড়লেন না, তাকে বন্দি করে নিয়ে গেলেন সুদূর চিন দেশে। ছুটে গেল তার সাম্রাজ্যের লিপ্সা।

হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মগধবঙ্গের অধিপতি শশাঙ্কর উত্তরাধিকারী (মাধবগুপ্ত বা আদিত্যসেন) আবার স্বাধীনতা অর্জন করেছিলেন। তার পর কেবল মগধবঙ্গ নয়, উত্তরে পশ্চিমে দক্ষিণেও রাজ্যের পর রাজ্য করল আপন আপন স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা। আর্যাবর্ত আবার ডুবে গেল অন্ধযুগের বিস্মৃতির মধ্যে। তাকে সূর্যের আলোকে আমন্ত্রণ করবার জন্যে আর কোনও চন্দ্রগুপ্ত, আর কোনও সমুদ্রগুপ্ত, আর কোনও হর্ষবর্ধন এসে দাঁড়াননি ‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে!’