সত্য-শিক্ষা
তোরণে তোরণে ভৈরব-বিষাণ বাজিয়া উঠিয়াছে – ‘জাগো পুরবাসী!’ দিকে দিকে মঙ্গল শঙ্খে তাহারই প্রতিধ্বনি উঠিয়া আমাদের রক্তে রক্তে ছায়ানটের নৃত্যরাগ তুলিয়াছে। এই যে আমাদের জীবনের উন্মাদ নট-নৃত্য, এ শুধু বিশ্বের কল্যাণ-মুক্তিতে নয়, এই মুক্তি-যুগে আমরাও আমাদের ভাবী সিংহ-দ্বারের পূর্বতোরণে নহবতের বাঁশি শুনিয়াছি বলিয়া। তাই আর আমরা শুধু দার্শনিকের ভিতরের যুক্তিতে সন্তুষ্ট নই, এখন চাই বাইরের ব্যবহারিক জীবনে মুক্তি। এই ‘আজাদি’র সাড়া না পাইলে আমাদের জীবনে আজ এমন তরুণের উচ্ছৃঙ্খলতা, সবুজের স্বেচ্ছাচারিতা দেখা দিত না। রক্তনিশান লইয়া আজ আমাদের নূতন করিয়া যাত্রা শুরু; এই শোভাযাত্রার দুর্মদ অগ্রযাত্রী আমাদের যে কিশোর আর তরুণের দল, সর্বাগ্রে তাহাদিগেরই অন্তরে বাহিরে ‘আজাদি’র নেশা জমাইয়া তুলিতে হইবে। কারণ, ইহাদের মৃত্যুবিদ্রোহে অলস ভীরু জীবন পথযাত্রীর বুকে সাহস সঞ্চর হইবে। আমরা কিন্তু আমাদের এই উন্মুক্ত উদার প্রাণগুলির চারিপাশে নিত্য বন্ধন-বাধা সৃজন করিয়া তাহাদিগের উচ্ছল গতিকে অচল করিতেছি। তাই বিজাতির বিভিন্ন শৃঙ্খল কাটিয়া জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার কথা শুনিয়া আমরা আজ এত আনন্দধ্বনি করিতেছি। যাহাতে এই জাগরণ-যুগের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ এই জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বাহিরে না হইয়া অন্তরে হয়, সেই জন্যই আমরা এ-সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করিতেছি। আজ ইংরাজের সহযোগিতা বর্জন করিতেছি বলিয়াই যে রাগের মাথায় যেন-তেন-প্রকারেণ দুই-একটা ঠাটকবাজিগোছ জাতীয় স্কুল-কলেজ দাঁড় করাইয়া সরিয়া পড়িতে হইবে, তাহা নয়; অসহযোগিতার মৌসুম না আসিলেও জাতীয়তার দিক দিয়া আমাদের জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। বিজাতীয় অনুকরণে আমরা ক্রমেই আমাদের জাতীয় বিশেষত্ব হারাইয়া ফেলিতেছি। অধিকাংশ স্থলেই আমাদের এই অন্ধ অনুকরণ হাস্যাস্পদ ‘হনুকরণে’ পরিণত হইয়া পড়িয়াছে। পরের সমস্ত ভালো-মন্দকে ভালো বলিয়া মানিয়া লওয়ায়, আত্মা, নিজের শক্তি ও জাতীয় সত্যকে নেহাতই খর্বই করা হয়। নিজের শক্তি, স্বজাতির বিশেষত্ব হারানো মনুষ্যত্বের মস্ত অবমাননা। স্বদেশের মাঝেই বিশ্বকে পাইতে হইবে, সীমার মধ্যেই অসীমের সুর বাজাইতে হইবে। তাই, এই সহযোগিতা বর্জনের দিনে ‘খোশখবর কা ঝুটা ভি আচ্ছা’ স্বরূপ আমাদের দীর্ঘ পরিপোষিত আশার কার্যে পরিণত হইবার কথা শুনিয়া গভীর তৃপ্তি অনুভব করিতেছি।
জাতীয় বিশেষত্বের উপর ভিত্তি করিয়া আমাদের ভাবী দেশসেবকের চরিত্র ও জীবন গঠিত হইবে, বিদেশের বিজাতীর বিষাক্ত বাষ্প লাগিয়া তাহাদের মঞ্জরিত জীবন-পুষ্প শুকাইয়া যাইবে না, বলপ্রয়োগে তাহাদিগকে মিথ্যা স্বজাতি-স্বদেশে-অনাস্থা শিখাইয়া আত্মশক্তিকে অবিশ্বাসী অলস অকেজো করিয়া তোলা হইবে না, – ইহা কী কম সুখের কথা! তাহারা শিখিবে দেশের কাহিনি, জাতির বীরত্ব, ভ্রাতার পৌরুষ, স্বধর্মের সত্য – দেশের ভাইয়ের কাজ হইতে – তাহারা শিখিবে বীরের আত্মোৎসর্গ, কর্মীর ত্যাগ ও কর্ম, নির্ভীকের সাহস, দেশের উদাহরণে উদ্বুদ্ধ হইয়া, – ইহা কী কম আনন্দের কথা! তাই আবার বলিতেছি, শুধু হুজুগে মাতিলে চলিবেনা, গলাবাজির চোটে স্টেজ ফাটাইয়া তুলিলে হইবে না, – আমরা দেখিতে চাই কোন্ নেতার চেষ্টায় কোন্ দেশ-সেবকের ত্যাগে কতটা জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হইল। আমরা দেখিতে চাই, আমাদের কতগুলি তরুণের বুকে এই মহাশিক্ষার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হইল! আমরা দেশ-সেবক চিনিব ত্যাগে, বক্তৃতায় নয়। আমরা দেখিতে চাই কবির ভবিষ্যদ্বাণী – ‘আসিবে সে দিন আসিবে’ গান দিকে দিকে বৈতালিক-কণ্ঠে বিঘোষিত হইতেছে, – ‘দিন আগত ওই!’