সত্য
কোনো সমাজে নেংটো মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেলে, ওই সমাজে পোশাক পরিধানই অশ্লীল হয়ে ওঠে। বনের মধ্যে হঠাৎ যদি কোনো পশু চাদর পরে ঘোরাফেরা শুরু করে, তাহলে পশুসমাজ তা ভালোভাবে নেবে বলে মনে হয় না। চাদর পরাকে তারা গণ্য করবে বৈপ্লবিক ও অসামাজিক কর্মকাণ্ড একইভাবে কোনো সমাজে মিথ্যুক ও দালালের সংখ্যা বেড়ে গেলে, ওই সমাজে সত্য উচ্চারণ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। সত্য হয়ে ওঠে তখন এক অপরিচিত আগন্তুক। তাকে বরণ করতে হয় নিঃসঙ্গ কাকের ভাগ্য।
সত্যের মিনমিনে গলা মিথ্যের হাসির দুর্গ ভেদ করে এখন আর আমাদের কানে সহজে পৌঁছোয় না। চোখ ফোলা বধূর মতো তার গোঙানি মিইয়ে রয় বাতাসে। সত্যের মাজা দালালেরা এমনভাবে ভেঙে দিয়েছে যে, সে আর কিছুতেই দাঁড়াতে পারছে না সোজা হয়ে। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা হয়ে উঠেছে বাঁকা কাঁচির মতো। ঘাস-গুল্ম ছাড়া কিছুই কাটতে পারছে না।
সত্য তার জুতোজোড়া গুছাতে যে-সময় নেয়, মিথ্যা সে-সময়ে পৃথিবী ভ্রমণ করে ফেলে— এরকম একটি কথা মার্ক টোয়াইন দুঃখ করে বলেছিলেন। তবে অনেক দেশেই সত্য এখন আর তার জুতোজোড়া গুছানোর সময়ও পাচ্ছে না। এ জন্য মাঝেমধ্যেই সে খালি পায়ে বেরিয়ে পড়ে মিথ্যের ভিড়ে; যদিও ওই ভিড় ঠেলে, বেশিদূর এগিয়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। সত্যের নাম শুনলে এখন আর কেউ আমাদেরকে মাইক ভাড়া দিতে চায় না।
কিছুদিন আগে সত্যকে আমি কোদাল দিয়ে আঘাত করেছিলাম। ভেবেছিলাম, বরাবরের মতোই এবারও আমার কোদালটিই ভেঙে যাবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে, ঘুণে খাওয়া কাঠের মতো সত্য নিজেই ভেঙে পড়লো মর্মর করে। সত্যের এমন ভঙ্গুর শরীর আমি আর দেখিনি।
সত্যকে ঢিল মারলেই পাওয়া যায় লোভনীয় পুরস্কার। সত্যের মাথা ফাটিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন সুবিধা, এমন মানুষের সংখ্যা বিশ্বে কোটি কোটি। শীত এলে, ঘুমোনোর জন্য সত্য একটি ভালো কম্বলও পায় না। কোথাও জামা-কাপড় ছাড়া সত্য উপস্থিত হলে, সেখানে হুলস্থুল লেগে যায়, কে কার আগে সত্যের পিঠে একটি বাড়ি মারবে— এ নিয়ে। চড় মেরে সত্যের মুখ ঘুরিয়ে দেয়ার কৌশল, আমাদের চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না।
সত্যের মৃত্যু নেই— এ কথাটি সত্য নয়। বঙ্গোপসাগরের পাড়ে সত্য এখন বিলুপ্তির পথে। প্রতিদিন সত্যের লাশ মাড়িয়ে শিশুরা এগিয়ে যাচ্ছে তাদের কবরের দিকে। তারা জানে, তাদের ও সত্যের কবর, আমরা খুঁড়ে রেখেছি একই গোরস্থানে।