নয়
বাসু-সাহেব নিউ আলিপুরে ফিরে এসে দেখলেন রানী দেবী একা বসে টি. ভি. দেখছেন। সুজাতা নার্সিংহোমে; কৌশিক তার সঙ্গে দেখা করতে গেছে, এখনো ফেরেনি। বিশে তার ঘরে একটা অসময়ের ‘বেড়াল ঘুম’ দিচ্ছে।
বাসু বললেন, তুমি আবার বড় একা হয়ে পড়েছ, তাই নয়? রানী বললেন, এ তো ‘টেম্পরারি ফেজ’। কষ্ট না করলে কি কেষ্ট পাওয়া যায়?
—কেষ্ট?
—হ্যাঁ, কেষ্টঠাকুরই তো! ননীচোরা! দুদিন পরেই এসে যাবে!
বাসু বললেন, ভুল ধারণা তোমার! কৌশিকের মেয়ে হবে। রানী বললেন, আমি কৌশিকের বাচ্চার কথা বলছি থোড়াই!
—তবে কার কথা বলছ?
—সুজাতা যে চুন্নুমুন্নু বাচ্চাটাকে নিয়ে আসবে তার কথা!
আহারাদি সেরে বিশ্রাম নিতে যাবার আগে বাসু-সাহেব মিস্টার রবিন মাইতির চেম্বারে একটা ফোন করলেন। শুনলেন, সাহেব আজ আদালতে আসেননি। তাঁর শরীর খারাপ। অগত্যা অ্যাডভোকেট সাহেবের বাড়িতে ফোন করলেন। সেখানে খবর পাওয়া গেল, মাইতি- সাহেব বাড়ি নেই—কোথায় গেছেন বাড়ির লোক জানে না।
.
সন্ধ্যা-নাগাদ দু’দুটো ফোন এল। একটা কৌশিকের। জানাল, পরদিন সকালে সিজারিয়ান করার আয়োজন হচ্ছে। কৌশিকের ফিরতে দেরি হতে পারে। দ্বিতীয় টেলিফোনটা এল নিখিল দাশের। জানতে চাইল, সে দেখা করতে চায়। আসতে পারে কিনা?
বাসু বললেন, বাট উই আর নট নাউ ইন দ্য সেম বোট, ব্রাদার!
—না, স্যার! আপনার ওই ধারণাটা ভুল। আপনি অনুমতি করলে আমরা দুজন এসে দেখা করতে চাই।
—দুজন? কাকলিও আসছে? এস, এস! রানু খুব একা হয়ে পড়েছে। কাকলি এলে একটু গল্পগুজব করতে পারবে।
নিখিল বুঝতে পারে—তার বাজারদর একেবারে পড়ে গেছে। সে কিছু উচ্চবাচ্য করে না।
.
সন্ধ্যার পর এল ওরা দুজন। বাসু-সাহেব ততক্ষণে তাঁর শিভ্যাস-রিগাল-এর বোতলটা বার করে নিজের ঘরে জমিয়ে বসেছেন—সোডা, বরফ কিউব, আর স্ন্যাক্স্ নিয়ে। নিখিল কফির কাপ হাতে এসে বসল সেখানে। কাকলি রানী দেবীর কাছে।
নিখিল আত্মপক্ষ সমর্থনের উদ্দেশে বললে, আমার আর কোনো উপায় ছিল না, স্যার। অতবড় খবরটা আমাকে জানাতেই হলো; আর আমার ‘বস’ যা অর্ডার করবেন তা তো আমাকে মানতে হবে?
—বাই অল মীন্স্! সেজন্য আমি তো তোমার দোষ ধরছি না। আমি শুধু বলছিলাম, আমরা এখন টেনিস-কোর্টের দু’প্রান্তে। মাঝখানে টাঙানো আছে অলক্ষ্য একটা নেট। এতদিন ছিলাম পার্টনার!
নিখিল সসঙ্কোচে বললে, এখন কিন্তু শকুন্তলা দেবীকে ছাড়া আর কাউকে চিন্তা করা যাচ্ছে না।
—তুমি তাই মনে কর?
—নয় কি? আমরা যখন টেনিস কোর্টের একই প্রান্তে পার্টনার হিসাবে খেলছিলাম, স্যার, তখন আমরা তিনটি বিকল্প সমাধানের কথা ভেবেছিলাম। আত্মহত্যা, পাণ্ডুরঙ আর মিস্ রায়। আত্মহত্যার থিয়োরি ধোপে টিকল না। শুধু সুইসাইডাল নোট নেই, বা ঘরের চাবিটা আমরা খুঁজে পাইনি বলে নয়—সে ক্ষেত্রে পিস্তলটা ডান হাতে চলে আসার কোনো ব্যাখ্যা নেই। পাণ্ডুরঙকে আমরা মার্ডারার বলতে পারছি না তিন-তিনটি কারণে। প্রথম কথা : সে আট-দশ বছর ধরে রীতা বিদ্যার্থীকে চেনে—ফলে নিশ্চয় জানে, সে লেফট্-হ্যান্ডেড। কেসটাকে সে আত্মহত্যা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে কিছুতেই পিস্তলটা ডান হাতে গুঁজে দিত না— বিশেষত গুলিটা যখন ঘটনাচক্রে কপালের বাঁদিকে লেগেছে। তাছাড়া দগ্ধাবশেষ সিগারটা ওর মতো পাকা অপরাধজীবী ওখানে ফেলে রেখে যেত না। বাকি থাকল শকুন্তলা। তার মোটিভটা আমরা জানি। সে বুঝে নিয়েছিল—’আত্মহত্যা’ হিসাবে কেসটাকে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। কারণ কোনো ‘সুইসাইডাল-নোট’ নেই। তাই হত্যাপরাধটা কায়দা করে পাণ্ডুরঙের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। নিচের ঘর থেকে সিগারের স্টাম্পটা উপরের ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। ঘটনাচক্রে নজরে-পড়া তার জামার কাফ-লিংকের ঝিনুকের টুকরোটাও দ্বিতলে নিয়ে যায়।
বাসু বলেন, কিন্তু শকুন্তলাও তো আট-দশ বছর ধরে জানে যে, রীতা বেঁয়ো। সে কেন ভুল করে ওর ডান হাতে পিস্তলটা গুঁজে দেবে?
—ভুল করে নয়, স্যার, ইচ্ছে করে! যাতে পুলিশ পাণ্ডুরঙের সন্ধান করে। দেখুন, মহিলাটি কেমন ধীরে ধীরে তিল-তিলে আমাদের দৃষ্টি ওই মদ্র লোকটির দিকে আকৃষ্ট করেছে! তার গাড়ির নম্বর সরবরাহ করেছে. সবচেয়ে বড় কথা : রীতা যে লেফট্-হ্যান্ডার এ তথ্যটা গোপন রাখতে ওর সংগ্রহে রাখা নেগেটিভটা উল্টো করে প্রিন্ট করে আমাদের ভুল পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছে! জেনে-শুনে মিথ্যে বলেছে যে, রীতা ডান হাতে লিখত!
বাসু কোনও জবাব দিলেন না।
নিখিল তাগাদা দেয়, আপনি কিছু বললেন না যে?
—বলব নিখিল, যখন মাইতি সওয়াল করতে উঠবে।
—মাইতি? রবিন মাইতি?
—না গো! তোমাদের পাবলিক প্রসিকিউটার নিরঞ্জন মাইতি-সাহেব!
—কিন্তু কী করে করবেন, স্যার? শকুন্তলা তো আপনাকে কোনও রিটেইনার দেয়নি। আপনাকে সে তো তার ডিফেন্স কাউন্সেল বলে স্বীকার করে নেয়নি?
বাসু জবাব দিলেন না। টেলিফোনটা ক্র্যাড্ল্ থেকে তুলে নিয়ে ডায়াল করলেন রবিন মাইতির বাড়িতে। ও-প্রান্তে সাড়া দিলেন শ্রোতা : মাইতি স্পিকিং
বাসু বললেন, গুড আফটারনুন মিস্টার মাইতি। আমি নিউ আলিপুর থেকে পি. কে. বাসু, কাউন্সেলার কথা বলছি। আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?
—বিলক্ষণ! আদালত পাড়ায় আপনাকে না চেনে কে? আপনি কী রীতা বিদ্যার্থীর মার্ডার কেসটার বিষয়ে বলতে চান?
—না। আমি শকুন্তলা রায়ের ডিফেন্স-ব্যবস্থার বিষয়ে কথা বলতে চাই।
—ইটস অল দ্য সেম। একই প্রসঙ্গ। শুনলাম, মিস্ রায় আপনাকে কাউন্সেলার হিসাবে নিয়োগ করতে অস্বীকার করেছেন? কথাটা সত্যি?
—হ্যাঁ তাই। আপনি এত তাড়াতাড়ি তা জানলেন কেমন করে?
—আমি ল-য়ের প্র্যাকটিস ছাড়াও রাজনীতি করে থাকি, স্যার! কিন্তু আমাকে আপনি ‘তুমি’ বলেই কথা বলবেন।
—বলব। যখন পরিচয়টা আর একটু ঘনিষ্ঠ হবে। আপাতত আমরা দুজন আইনজীবী হিসাবে কথা বলছি তো?
—বলুন স্যার? আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
—শকুন্তলার আইন-পরামর্শদাতা হিসাবে আমাকে স্বীকার করে।
—তা কেমন করে হয়? শকুন্তলা নিজেই যখন প্রত্যাখ্যান করেছে।
—কিন্তু কেন করেছে, তা তো আপনি জানেন, মিস্টার মাইতি! কী? জানেন না?
-–আয়াম সরি! না, আমি জানি না; জানতে চাইও না। তাছাড়া আমি কোন্ অধিকারে আপনাকে এনগেজ করব? শকুন্তলার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?
—এমপ্লয়ী এবং এমপ্লয়ারের সম্পর্ক। সেটা অন্তত আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। সে যে স্কুলে বাংলা পড়ায়, আপনি সেই স্কুলের গভর্নিং-বডির সভাপতি
—আয়াম সরি, স্যার! কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করছে সে! আমি তাকে সাহায্য করার কে? করুণাময় ঈশ্বরের ইন্একজরিব্লু জাস্টিস্’-এ আমি বিশ্বাস করি—তাঁর ন্যায়নিষ্ঠ বিচারে আমার আস্থা আছে!
—এতটা ঈশ্বরবিশ্বাসী হলে আপনি আইন পড়তে গেলেন কেন? ল প্র্যাকটিস করেন কেন? ঈশ্বরের বিচারেই সন্তুষ্ট থাকতে পারলেন না কেন?
—সরি স্যার! আপনি বয়ঃজ্যেষ্ঠ, সিনিয়ার ল-ইয়ার। এ নিয়ে আপনার সঙ্গে তর্ক করব না। কিন্তু আপনি কি ঈশ্বরের অপক্ষপাত ন্যায়নিষ্ঠ বিচারে সন্দেহ করেন?
—আপনি করেন না? আপনার মনে কখনো কি এ নিয়ে প্রশ্ন জাগে না? আপনি কি কখন কোথাও দেখেননি—’তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে/কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে!’ সক্রেটিকে যারা হেমলক পানে বাধ্য করেছিল সেই আদিম কাল থেকে শুরু করে আজও যারা চটকলের শ্রমিক ভিখারি পাশওয়ানকে পরিকল্পিতভাবে হাফিজ করে….
—সরি, স্যার! আমি আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারব না। আপনি দয়া করে আমাকে মার্জনা করবেন!
বাসু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, অল-রাইট! তাই করব। আপনাকে মার্জনাই করব। জ্যাঠাইমার নির্দেশে আপনার আচরণে আমি ক্ষুদ্ধ হব না।
—জ্যাঠাইমা! কার জ্যাঠাইমা?
—রমেশের!
—রমেশ? সরি স্যার! ঠিক বুঝলাম না!
—আয়াম ইকোয়ালি সরি, স্যার! বাঙলায় এম. এ পাশ কোনও ব্যক্তি যদি পল্লীসমাজের রমেশের জ্যাঠাইমাকে না চিনতে পারেন, তাহলে আমি নাচার!
বাসু ক্র্যাডলে টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলেন। নিখিল একতরফা কথা শুনেছে। তবু বুঝতে তার কোনও অসুবিধা হয়নি। বলে, রবিন মাইতিও আপনাকে ‘রিটেইন’ করতে রাজি হলেন না?
বাসু জবাব দিলেন না। গ্লাসে আরও এক পেগ ঢাললেন।
নিখিল উঠে দাঁড়ায়। বলে, বুঝতে পারছি, এসব আলোচনা এখন আপনার ভাল লাগছে না। আমি চলি, স্যার?
মদ্যপানরত মানুষটি হঠাৎ কাতর কণ্ঠে বলে ওঠেন, উড য়ু ডু মি আ ফেভার, দাশ? নিখিল তৎক্ষণাৎ নিচু হয়ে ওঁর পদধূলি নিয়ে বলে, এসব কী বলছেন, স্যার? আপনি তো হুকুম করবেন
—আমি ওই মেয়েটির সঙ্গে কাল সকালে একবার দেখা করতে চাই। ওর কাউন্সেলার হিসাবে নয়। একজন কোর্ট-অফিসার হিসাবে। অফ কোর্স, তোমার উপস্থিতিতে। আইনজীবী হিসাবে প্র্যাকটিস্ শুরু করার আগে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তার মর্যাদা রাখতে। তুমি রাজি আছ?
—তাই হবে, স্যার!
.
লোহার জালতির এ-প্রান্তে খুনের আসামী, অপর প্রান্তে তার আইনজীবী, আর শ্রুতিসীমার বাইরে অথচ দৃষ্টসীমার ভিতরে প্রহরী—এই প্রচলিত দৃশ্যটি এখানে রূপায়িত হলো না। কারণ পি. কে. বাসু, বার-অ্যাট-ল খুনী-আসামীর পক্ষে নিযুক্ত হননি। নিখিল বাসু- সাহেবকে তার অফিস ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো। একটু পরে একজন মহিলা পুলিশ শকুন্তলাকে নিয়ে এলেন এ-ঘরে। নিখিল শকুন্তলাকে বলল, আপনি ওই চেয়ারটায় বসুন।
মহিলা পুলিশকে আদেশ দিল, আপনি বাইরে অপেক্ষা করুন। এঁকে আবার হাজতে নিয়ে যেতে হবে, কথাবার্তা শেষ হলে।
বাসু ধীরে-সুস্থে পাইপটা ধরালেন। শকুন্তলা নতনেত্রে চেয়ারে বসেই আছে। বাসু বললেন, শোন শকুন্তলা-মা, তুমি আমাকে ওকালতনামা দিতে অস্বীকার করেছ—কেন করেছ, তা আমি এতক্ষণে বুঝতে পেরেছি। কারণ কাল রাত্রে আমি মিস্টার মাইতিকে অনুরোধ করেছিলাম, তোমাদের স্কুলের গভর্নিং-বডির প্রেসিডেন্টে হিসাবে এমপ্লয়ীর তরফে আমাকে এম্প্লয় করতে—
শকুন্তলা মুখ তুলে তাকাল। বললে, তিনি রাজি হননি তো?
—জাস্ট এ মিনিট, মিস্ রয়! তুমি এখন কোনও কথা বলবে না। কোনও প্রশ্নের জবাব দেবে না। তোমার নাম কী, অথবা দেওয়াল-ঘড়িতে কটা বাজে—এ জাতীয় প্রশ্নেরও জবাব দেবে না। তোমাকে এখানে ডাকা হয়েছে শুনতে, স্রেফ শুনতে। তোমার কথা বলা বারণ। যতক্ষণ না তোমার স্বার্থ দেখতে কোনও আইনজীবী উপস্থিত হচ্ছেন। অ্যাম আই ক্লিয়ার?
গ্রীবা সঞ্চালনে শকুন্তলা জানাল : সে বুঝতে পেরেছে।
বাসু আবার শুরু করেন, তবু ভুল করে তুমি যে প্রশ্নটা করে ফেলেছ তার জবাব আমি দেব—তোমার তা জানা থাকা দরকার বলেই দেব। সেক্ষেত্রে নিজের ডিফেন্স ব্যাপারে তুমি তোমার পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারবে। হ্যাঁ, তোমার অনুমান ঠিকই। মিস্টার মাইতি রাজি হননি। কেন হননি, তা তুমিও জান, আমিও জানি
নিখিল এই পর্যায়ে বাসু-সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে, আপনি যা বলবেন তা কি আমি টেপ-রেকর্ড করতে পারি?
—না! আদালতে যা বলার তা আমি পৃথকভাবে আদালতেই বলব। এখন যা বলছি—বিবেকের নির্দেশে, কোর্ট-অফিসার হিসাবে, তা শুধু শকুন্তলার শ্রুতির জন্য। তোমার উপস্থিতিটা আমাকে বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হচ্ছে—এই যা।
নিখিল বলে, অলরাইট, স্যার। আপনি শুরু করুন।
বাসু পাইপটা মুখ থেকে সরিয়ে বলেন, শোন কুন্তলা-মা। প্রথমেই যে কথাটা বলব তা তোমাকে আগেও জনান্তিকে বলেছি। আজ মিস্টার দাশের সামনে তার আমি পুনরুক্তি করছি : রীতা কার গুলিতে মারা গেছে তা জানতে পেরেছে তিনজন। একজন রীতা নিজে—কিন্তু সে আর কথা বলবে না। দ্বিতীয়জন আমি, যুক্তি-পরম্পরায় অনিবার্য সিদ্ধান্তে। তৃতীয়জন : তুমি!..আমি তোমার পক্ষের আইনজীবী নই। ফলে যা বলছি, তার দায়দায়িত্ব আমার—তোমার নয়। তুমি আমার কোনো কথায় প্রতিবাদ বা সমর্থনসূচক কিছু বলবে না।…
তোমাদের তিনজনের কী সম্পর্ক তা মিস্টার দাশ এবং আমি, আমরা দুজনেই জানি। তুমি তোমার জবানবন্দিতে বলেছিলে—মিস্টার মাইতি তোমার বাড়িতে আগে অনেকবার এসেছেন। ইদানীং আসেন না। অপিচ, নিখিলের প্রশ্নের জবাবে তুমি আরও বলেছিলে, গত সাত-দশদিনের মধ্যে তিনি এসেছেন কি না তা তুমি জান না—কারণ এসে থাকলেও তোমার জ্ঞাতসারে আসেননি। অপরপক্ষে, মিস্টার মাইতি বলেছিলেন বিশেষ কারণে, তিনি রীতা বিদ্যার্থীর বাড়িতে যেতেন না, বা বাড়িতে ফোন করতেন না। এ থেকেই ত্রিকোণাকৃতি জ্যামিতিক সমস্যার স্বরূপটা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম…
—ঘটনা হচ্ছে এই : তুমি রীতা বিদ্যার্থীকে চিনতে স্কুলজীবন থেকে। তোমার স্বীকৃতিমতে তুমি জানতে যে, রীতা— বাস্টার্ড। তার শুধু পিতৃপরিচয় নয়, মাতৃপরিচয়ও নেই। রীতাও ন্যাচারালি জানত যে, তুমি জানতে। ফলে, তোমার বাড়িতে থাকতে শুরু করার পর রীতার কাছে যখন পাণ্ডুরঙ টাকা আদায় করা শুরু করল, তখন রীতা স্বভাবতই তোমার সঙ্গে পরামর্শ করেছিল। এ দুনিয়ায় তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যার সঙ্গে সে মন খুলে এ বিষয়ে পরামর্শ করতে পারত। কিন্তু সমস্যাটা জটিল হয়ে উঠল যখন মাইতির সঙ্গে রীতার অন্তরঙ্গতা ঘটল। রীতার উপার্জন এমন কিছু নয় যে, ব্ল্যাকমেলার লাখ-বেলাখ আদায় করতে পারে; কিন্তু রীতা বিদ্যার্থী যদি মাইতি-পরিবারের ঘরণী হয়, তখন পাণ্ডুরঙের জ্যাকপট লাভ হবে। রীতার মুশকিল হলো এই যে, এবার সে তোমার পরামর্শ বা সাহায্য চাইতে পারল না। বাধা : রবিন মাইতি। এই নির্মম মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে—নির্জনতার সুযোগে, উপবাসী মেয়েটি ক্ষণিক উত্তেজনায় আত্মহত্যা করে বসল। নিজের পিস্তলে! নিজের ব্রেন স্ম্যাশ্ করে।
নিখিল বলে ওঠে, কিন্তু কোন হাতে?
বাসু ধমকে ওঠেন : সাইলেন্স! মিস্টার দাশ! দয়া করে মনে রাখবেন আপনি আমার জবানবন্দি নিচ্ছেন না। আইনের নির্দেশে আপনার উপস্থিতি আমরা দুজন মেনে নিয়েছি মাত্ৰ আমরা দুজন—একজন বক্তা, একজন শ্রোতা!
নিখিল চুপ করে গেল। বাসু ফের শুরু করেন :
—কুন্তলা-মা, আমি বুঝতে পারি দ্বৈরথ-সমরে পরাজিত হয়ে তুমি কী প্রচণ্ডভাবে মর্মাহতা হয়েছিলে। তুমি জান-কবুল লড়ে না গেলে ওই লোকটা পরপর দুবার ইলেকশনে জিততে পারত না। ওর ওই যে রবরবা, তার মূলে তোমার গোপন একনিষ্ঠ পরিষেবা! অথচ লোকটা—পদকর্তাদের ভাষায় ‘আমার বঁধুয়া আবাড়ি যায় আমারি আঙিনা দিয়া….’
পাইপের আগুনটা নিভে গিয়েছিল। আবার একটি অগ্নিশিখার সাহায্যে সেটাকে প্রজ্বলিত করে উনি শুরু করেন :
—কিন্তু গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষণ বর্ণনায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে দশ-বিশটা শ্লোক অর্জুনকে শুনিয়েছিলেন—যার নির্যাস রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ক্ষণিকা কাব্যে বিশেষ দুটি পংক্তিতে….
আত্মসংযম হারিয়ে শকুন্তলা প্রশ্ন করে বসে, আপনি সেসব কথা….
—সাইলেন্স! তোমার কথা বলা বারণ, শকুন্তলা!…তুমি সেই মন্ত্রে বিশ্বাস কর : “মনেরে আজ কহ যে/ভালোমন্দ যাহাই আসুক ‘সত্য’রে সও সহজে!”—তুমি বুদ্ধিমতী, বিচক্ষণ, স্থিতপ্রজ্ঞ, তাই বুঝেছিলে জীবনে ভালো ও মন্দ দুটোই থাকে। রীতার ওই সোনালী চুল, ওই দুধে-আলতা গায়ের রঙ ঈশ্বর তোমাকে দেননি; তুমি শরৎবাবুর শ্যামলা সাধারণ মেয়ে। তেমনি ওই মেয়েটি জীবনে পিতার স্নেহ পায়নি, মাতার আদর পায়নি—ওর মা তোমার মায়ের মতো কোনোদিন ওর বিষয়ে চিন্তা করেনি : “ইচ্ছে হয়ে ছিলি মনের মাঝারে!” সে মায়ের জঠরে বাস করেছে অভিশাপরূপে। জন্মের পর আঁতুড়ঘরে তুমি দেখেছ ‘জগো হাসে, তু রোয়’। আর ও দেখেছে : আঁস্তাকুড়ের পূতিগন্ধময় পরিবেশ। ভালো আর মন্দ—মন্দ আর ভালো—পাল্লা সমান-সমান। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ‘ইনএক্জরের্ জাস্টিস্’! তুমি শান্তমনে রীতাকে ক্ষমা করে দিলে—সে তোমার শত্রু হয়ে গেল না। বন্ধুই রইল। তোমার এই মহানুভবতায় আমি মুগ্ধ, কুন্তলা-মা।
—কালীপূজার আগের দিন যখন তুমি ভদ্রেশ্বর যাও, তখনি তুমি জানতে : পরদিন বিকেলবেলা পাণ্ডুরঙ আসবে পাঁচ হাজার টাকা আদায় করতে। রীতা তোমার মতো স্থিতধী নয়। মনের ক্ষেদে সে হয়তো বলে বসেছিল—’এভাবে তোর জীবনে কাঁটা হয়ে বেঁচে থেকে আমার কী লাভ বল, কুন্তলা? এর চেয়ে আমার বরং মরে যাওয়াই উচিত।’ এই জাতীয় কথা সে বলেছিল কি বলেনি আমি জানি না, কিন্তু ওর উদ্ভ্রান্ত চোখে তুমি মৃত্যুকামনার একটা কালো ছায়া দেখতে পেয়েছিলে। তাই সোমবার ভোররাতে ফিরে এসেছিলে কলকাতায়। বান্ধবীর প্রতি দুশ্চিন্তায়, আশঙ্কায়। ছাত্রীদের খাতা দেখার তাগিদে নয়।
—বেলা দশটা নাগাদ এসে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতর ঢুকলে তুমি। একতলার কেউ নই। হয়তো তুমি জোর গলায় ডেকেছিলে : রীতা? রীতা!…তোমার নজর হয়েছিল একতলায় স্টিল আলমারির নবে কোনও চিঠি নেই। সুটকেসটা রেখে তুমি দোতলায় উঠে গিয়েছিলে। রীতার শয়নকক্ষের দরজাটা হাট করে খোলা। ভিতরে পদার্পণ করেই বজ্রাহত হয়ে গেলে তুমি। চাপ-চাপ রক্তের মধ্যে পড়ে আছে রীতা। দেহে যে প্রাণ নেই তা এক নজরেই বোঝা যায়। ওর বাঁ-হাতে পিস্তল, ডানমুঠিতে ‘সুইসাইডাল-নোট’। সে কী লিখেছিল তা আমি জানি না। হয়তো লিখেছিল, ‘তুই আমাকে ভালবেসে আশ্রয় দিয়েছিলি আর আমি কৃতঘ্নের মতো তোর ধন কেড়ে নিতে যাচ্ছিলাম। হয়তো নিতামও—কিন্তু তা এই বেজম্মার বরাতে লেখা নেই। তোর ধন তোকেই ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম।’ এই জাতীয় কিছু…
নিখিল আর আত্মসংযম করতে পারল না। প্রশ্ন করে বসে, ওর ডানহাতেই যে ‘সুইডাইডাল নোটটা’ ছিল—
এবার আর ধমক দিলেন না বাসু-সাহেব। বললেন, না। ডানহাতের মুঠিতেই যে ছিল, তা বলতে পারব না। হয়তো টেবিলের উপর কাগজ-চাপায় রাখা ছিল। কিন্তু সুইসাইডাল নোট যে সে একটা লিখেছিল, এটা নিশ্চিত। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি—ওর পাইলট পেন-এ বেশি কালি আসে। তাই ওর টেবিলে আছে ব্লটিং পেপারের প্যাড। অথচ আশ্চর্য! উপরের ব্লটিং পেপারটা ধবধবে সাদা! কী করে হয়? যদি রীতা দু’একদিন আগে ব্যবহৃত ব্লটিং কাগজটা বদলে থাকে তবে ছিন্নবিচ্ছিন্ন অবস্থায় তা ওর ছেঁড়া কাগজের ড্রামে আমি খুঁজে পেতাম। তা পাইনি। সারা বাড়িতে সেই ব্যবহৃত ব্লটিং পেপারটা নাপাত্তা। তার একমাত্র হেতু : কেউ সেটা পুড়িয়ে ফেলেছে। কেন?—কারণ ‘সুইসাইডাল নোট’ লেখার পর রীতা তা ‘ব্লট’ করেছিল। আয়নার সামনে ধরলে হয়তো কিছু কিছু পড়া যেত। সে সুযোগ আমাদের দেয়নি শকুন্তলা।…রীতার টেবিলে বাঁদিকে ছিল পেন-হোল্ডারে পাইলট কলমটা, ডান দিকে ঐ শৌখিন কৃত্রিম খাগের কলম আর ডেট-ক্যালেন্ডার। রীতা যদি ডান হাতে লেখার অভ্যস্ত হতো, তাহলে পেন-হোল্ডারটা টেবিলের ডানদিকে থাকার কথা!…
—রীতাকে আবার বাঁচানো যাবে না; কিন্তু রীতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তুমি বদ্ধপরিকর হলে, শকুন্তলা। রীতার বাঁ-হাত থেকে পিস্তলটা নিয়ে, আঁচলে মুখে, ডান হাতে গুঁজে দিলে। তুমি বুঝতে পেরেছিলে, এভাবেই পুলিসকে বোঝাতে পারবে এটা আত্মহত্যার কেস নয়—ওইভাবে ডান হাতে পিস্তল ধরে কেউ নিজের বাঁ-কানের উপরে গুলি করতে পারে না। করলেও তার নিজের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পিস্তলে থাকবে। রীতা যে ‘লেফ্-হ্যান্ডার’ ছিল এটা যাতে আমরা বুঝতে না পারি তাই ফটোগ্রাফটা তুমি তখনি সরিয়ে ফেলেছিলে। রিভার্স প্রিন্ট করে দুদিন পরে আবার টাঙিয়ে দিয়েছিলে। বোকা মেয়ে। তুমি ভেবে দেখনি যে, রীতার অফিসের অনেকেই জানে যে, রীতা লেফ্ট্-হ্যান্ডার! একতলা থেকে আধপোড়া চুরুটের টুকরোটা আর নিতান্ত ঘটনাচক্রে কুড়িয়ে পাওয়া কাফ-লিংকের ঝিনুকের টুকরোটা তুমি উপরের ঘরে নিয়ে যাও। প্রতিটি জানলা ভিতর থেকে ছিটকানি দিয়ে দাও যাতে পুলি আন্দাজ করে হত্যাকারী এটাকে আত্মহত্যার কেস বলে সাজাতে চেয়েছে। দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে নেমে এসে একতলায় কিচেনেটে ওই ব্লটিং পেপার আর মৃত্যুকালীন স্বীকারোক্তিটা তুমি পুড়িয়ে ফেলেছিলে। তারপর পুলিশে ফোন করেছ।
—এছাড়া সমস্যার দ্বিতীয় কোনো সমাধান নেই। পাণ্ডুরঙের পক্ষে ফটোটা রিভার্স-প্রিন করে ওখানে টাঙিয়ে দেওয়া সম্ভবপর নয়। সে ব্ল্যাকমেলার, কিন্তু মার্ডারার নয়!
বাসু-সাহেব থামলেন।
শকুন্তলা এতক্ষণ নিশ্চুপ শুনে গেছে। এখন হঠাৎ বলতে শুরু করে, জানি না কী করে বুঝেছেন, কিন্তু আপনার …
বাসু ধমকে ওঠেন, কতবার এক কথা বলব? তোমার না এখানে কথা বলা মানা?
দ্বিগুণ জোরে শকুন্তলা চিৎকার করে ওঠে, না! আমাকে বলতে দিতে হবে! খুনের অপরাধে আমাকে ফাঁসি দিতে চান, দেবেন; কিন্তু স্বাধীন ভারতীয় নাগরিকের বাকস্বাধীনতা আপনি কেড়ে নিচ্ছেন আইনের কোন ধারায়?
নিখিল বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বলল, প্লিজ স্যার!
বাসু কোনও সাড়াশব্দ দিলেন না।
শকুন্তলা দৃঢ়কণ্ঠে বলল, জানি না, কী করে আপনি কোন কথা জেনেছেন। মায় ক্ষণিকার ওই উদ্ধৃতিটা পর্যন্ত। তবে আমি স্বীকার করব—প্রায় অলৌকিকভাবে আপনি বাস্তব ঘটনা- পরস্পরার বর্ণনা করে গেছেন। আমি জানি, আপনি বুঝতে পেরেছেন, কেন আমি ডিফেন্স দেব না। রীতু অভিমানে আত্মহত্যা করতে পারে, আমি পারি না? শুধুমাত্র একটি অনুমান ওঁর সত্যি নয়। একটি ভুল উনি করেছেন।
বাসু চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন। কথা বললেন না।
নিখিল কিন্তু থামল না। বললে, কোনটা?
—রীতার লেখা শেষ চিঠিখানি, যাকে আপনারা ‘সুইসাইডাল নোট’ বলছেন—হ্যাঁ, তাই তো বাস্তবে—ওটা আমি পুড়িয়ে ফেলিনি। সযত্নে লুকিয়ে রেখেছি। আপনারা খুঁজে পাননি।
—কোথায়?
লাফ দিয়ে উঠে পড়ে নিখিল!
—চলুন! এখনি সেটা বার করে দিতে হবে।
ব্যবস্থা করতে নিখিল প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। দু’-খানা গাড়ি চাই তার। এক্ষুণি। একটা প্রিজন ভ্যান, একটা রেডিও-ফিট করা জিপ। এছাড়া একজন মহিলা পুলিশ।
নির্জনতার সুযোগে বাসু মেয়েটিকে বলেন, রীতা জীবনযুদ্ধে হার স্বীকার করে নিয়েছে। হয়তো যে-সম্পদের জোরে রীতা তোর মুঠি থেকে মাইতিকে ছিনিয়ে নিয়েছিল—ওর সেই দুধে-আলতা রঙ, ওর সেই সোনালী চুল, নীল চোখ—এই সবকিছুকেই সে অভিসম্পাত মনে করত। আন্তরিক ঘৃণা করত!
শকুন্তলা অবাক হয়ে বলে, আপনি তাও জানেন?
—নারে কুন্তলা, জানি না। আন্দাজ করি। কারণ রীতা জানত এসব কিছুই সে ইচ্ছা বিরুদ্ধে পেতে বাধ্য হয়েছে, ওর ব্যভিচারী বাপের কাছ থেকে! ওর মাকে হয়তো হতভাগী ক্ষমা করতে পেরেছিল–হয়তো কুমারী-মা গত্যন্তর-বিহীন হয়ে তার প্রথম সন্তানকে এভাবে রাস্তায় ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছিল। লোকলজ্জায় হতভাগিনী কর্ণজননী কুন্তীর মতো। কিন্তু ওর সোনালী-চুল বেড়াল-চোখো বাপ? যে একটি কুমারী মেয়ের সর্বনাশ করে পালিয়ে গেছিল? না, তাকে ওই হতভাগিনী কোনোদিন ক্ষমা করতে পারেনি। আয়নার যতবার নিজের মেমসাহেবের মতো মুখটা দেখেছে ততবারই সেই ব্যভিচারী অচেনা বাপের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছে। আর তাই মিশনারী প্রতিষ্ঠানের দয়ায় মানুষ হয়ে ওঠা সত্ত্বেও সে ক্রিশ্চিয়ান থাকেনি। আর্যমিশনের মাধ্যমে হিন্দুধর্মে দীক্ষা নিয়েছে। অসুরের রক্তে রাঙা খর্পরধারিণীর পূজার দিনে সে নিষ্ঠাভরে উপবাস করে!
…রীতার কথা থাক। সে তো আজ মান-অভিমানের বাইরে। কিন্তু তুই কেন এভাবে হার মেনে নিবি, কুন্তলা-মা? রীতার অভিমান ছিল গোটা দুনিয়ার বিরুদ্ধে—সে অভিমান করার অধিকার ছিল হতভাগিনীর। তোর তো তা নয়! তুই চোখের সামনে হাতচাপা দিয়ে দুনিয়াটাকে অস্বীকার করতে চাইছিস্। কিন্তু কার বিরুদ্ধে তোর এ অভিমান? সে কি তোর অভিমানের যোগ্য? তোর জীবনে কে ওই রবিন মাইতি? যাকে তুই দু’দুবার নির্বাচনে জিতিয়ে দিয়েছিস? সে তোদের বন্ধু? হ্যাঁ, উৎসবের দিনে, যখন সে ইলেকশান জিতে পার্টি থ্রো করে—কিন্তু ব্যসনে? রাজদ্বারে? রীতার শ্মশানযাত্রী কি হয়েছিল সে? সে তোদের বন্ধু! মাই ফুট!
শকুন্তলা বিহ্বলের মতো বলে, তাহলে আমি…আমি এখন কী করব?
—ওই স্কুলের চাকরি থেকে এখনি ইস্তাফা দে! অন্য স্কুলে নতুন করে জীবন শুরু কর। যতদিন তা না পাচ্ছিস্ প্রাইভেট টুইশানি কর—নিদেন পুরানো খবরের কাগজের ঠোঙা বানিয়ে দোকানে-দোকানে ফিরি করে তোর সংসার চালা। দুনিয়া অনেক বড় রে! জীবন অনেক মহান! তোর মতো স্থিতপ্রজ্ঞের অভিমানের যোগ্য কি ওই রাজনীতি-ব্যবসায়ী হাম্বা হরিদাস পাল?
শকুন্তলা উঠে এসে ওঁর পায়ের ধুলো নিল। অস্ফুটে বলল, রীতার ক্ষেত্রে আমি পারিনি; কিন্তু আমার ক্ষেত্রে আপনি পেরেছেন!…না! আত্মহত্যা আমি করব না!
তখনই ফিরে এল নিখিল। বলল, ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আসুন মিস্ রয়, চলুন দেখিয়ে দেবেন কোথায় লুকানো আছে রীতা বিদ্যার্থীর শেষ স্বীকারোক্তি।
তারপর বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বলল, আপনিও আসছেন তো, স্যার?
বাসু বলেন, না হে! আমাকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দাও। আমি বাড়ি যাব। আজ সকালে সুজাতার সিজারিয়ান হবার কথা।
.
ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গেট খুলে বাগানে ঢুকলেন।
নজর হলো বিশে বাগানের একান্তে গুতি হাতে কী যেন টিপ্ করছে। বাসু-সাহেব পিছন থেকে হাঁকাড় দেন : অ্যাই বিশে!
বিশ্বনাথ চমকে এদিকে ফেরে।
বাসু-সাহেব ধমকে ওঠেন, সেদিন বললাম না, গুতি দিয়ে পাখি মারা খারাপ! কোনোদিন মারবি না।
—পাখি মারচিনি তো, দাদু!
—তবে কী টিপ করছিলি এতক্ষণ?
—আদলা ইঁট! ওই দ্যাখেন কেনে! সামনে রইচে। অ্যাক্কেরে গুতি মারা ছাড়ি দিলে টিপ্ খারাপ হয়ি যাবে না?
বাসু স্বীকার করলেন, কারেক্ট! ফোঁস করায় দোষ নেই। ছোবল না মারলেই হলো। তা তোর দিদা কোথায়?
—বাইরের ঘরে।
বাসু এগিয়ে গেলেন সেদিকে। দেখলেন, রানী বসে আছেন তন্ময় হয়ে। জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে। কোলের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকা কোনও গল্পের বই নেই। টি. ভি.টা বন্ধ। টু-ইন-ওয়ান চলছে না। রানী দেবী টের পাননি কর্তার আগমন। খুব কাছাকাছি এসে বাসু বলেন, তুমি তন্ময় হয়ে কী করছ?
রানী চমকে এদিক ফিরে বলেন, কখন এলে?
—এই তো! কিন্তু তুমি একা বসে বসে কী করছিলে?
—প্রতীক্ষা! ‘কিং’স্ কামিং’! কৌশিক বলে রেখেছে কোনো খবর হলেই টেলিফোন করবে। তাই টেলিফোনটার কাছাকাছি বসে আছি।
বাসু বলেন, বুঝলাম। ‘দে অসো সার্ভ হু ওলি সিট্ অ্যান্ড ওয়েট।’
রানী হাসলেন। বললেন, সরি, স্যার। দ্যাটস্ এ মিসকোট।
—সরি, ম্যাডাম! দ্যাটস্ নট্ আ মিসকোট, বাট আ মডিফায়েড কোটেশন। মিল্টন অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন—তাই লিখেছিলেন হু ওলি স্ট্যান্ড অ্যান্ড ওয়েট!’ তুমি ঈশ্বরের আশীর্বাদে চক্ষুষ্মতী। তাই তোমার ক্ষেত্রে পরিবর্তিত পংক্তিটা হবে—হু ওলি সিট অ্যান্ড ওয়েট!’
ঠিক তখনই বেজে উঠল টেলিফোন। বিশে দৌড়ে এসে সেটা তুলবার অবকাশ পেল না। রানীই হাত বাড়িয়ে যন্ত্রটা তুললেন। তারপর বাসু-সাহেবকে যন্ত্রটা হস্তান্তরিত করে বললেন, তোমাকে খুঁজছে—
বাসু আত্মঘোষণা করতে ও-প্রান্ত থেকে নিখিল জানাল সে করুণাময়ী থেকে ফোন করছে। রীতা বিদ্যার্থীর সুইসাইডাল নোটটা পাওয়া গেছে। তার স্বাক্ষর স্থানীয় ব্যাঙ্ক মিলিয়ে দেখেছে। রীতারই সই। ফলে বাসু-সাহেবের মক্কেল মিস্ শকুন্তলা….
বাধা দিয়ে বাসু বললেন, এত তাড়াতাড়ি তুমি ভুলে গেলে নিখিল? মিস্ শকুন্তলা রায় আমার মক্কেল নন। তুমি আমার দু’দুটো শর্তই মেনে চলেছ, কিন্তু…
—কী শর্ত দুটো ছিল, স্যার?
—এক নম্বর, তুমি ভুল লোককে অ্যারেস্ট করবে—তা তুমি করেছ। দ্বিতীয় শর্তটা ছিল, যাকে অ্যরেস্ট করবে সে যেন অদ্যভক্ষ্যধনুর্গুণ না হয়। সে শর্তটাও তুমি মেনেছ। কিন্তু আমার পোড়া কপাল! তাই রান্না-করা কৈ-মাছ কড়াই থেকে পিছলে পালিয়ে গেল!
নিখিল হাসতে হাসতে বলে, ওদিকের কোনো খবর আছে? সুজাতার?
—না! আমরা দুজন শবরীর প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছি! তা, তোমরা কি শকুন্তলাকে মুক্তি দিয়েছে?
—অফ্ কোর্স! সে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
—দাও! তার আগে বলতো হে—পাণ্ডুরঙকেও কি তোমরা রিলিজ করে দিয়েছ?
—ইয়েস, স্যার! যে চার্জে তাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছিল সে অপরাধ পাণ্ডুরঙ করেনি। ব্ল্যাকমেলিং-এর চার্জ তার বিরুদ্ধে আমরা এখনো ফ্রেম করিনি। সেটা প্রমাণ করাও শক্ত…
বাসু বাধা দিয়ে বললেন, আমি একমত নই, নিখিল। তোমরা ছেড়ে দিলেও আমি তাকে সহজে ছাড়ব না। আইন যাই বলুক, আমার দৃষ্টিতে রীতার মৃত্যুর জন্য পাণ্ডুরঙ পুরোপুরি দায়ী। সে তাকে আত্মহত্যায় বাধ্য করেছিল। কৌশিক আর সুজাতা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসুক। তারপর আমি ব্যবস্থা নেব। শকুন্তলা প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল বন্ধুর তরফে। আমার প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা নেই; কিন্তু ওই হতভাগিনী মেয়েটাকে মৃত্যুর দিকে যে ঠেলে দিয়েছে তাকে অত সহজে আমি ছাড়তে পারি না।
–সে তো পরের কথা স্যার। নিন মিস্ রায়ের সঙ্গে কথা বলুন।
শকুন্তলা বলল, আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে যাব।আপনাকে আমি চিনতাম না। বাঙলা বই আমি গোগ্রাসে গিলি; কিন্তু গোয়েন্দা কাহিনী বাদে। এখন যখন চিনেছি…
বাসু বললেন, দু’-চারদিন বাদে, কুন্তলা-মা। আমাদের বাড়িতে…
—হ্যাঁ, শুনেছি! ঠিক আছে। আপনার নাতি নার্সিংহোম থেকে এসে জাঁকিয়ে বসুক।
বাসু বললেন, নাতি নয় গো। নাতনি!
.
বাসু-সাহেব টেলিফোনটা নামিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে সেটা আবার বেজে উঠল। এবার অ্যাডভোকেট রবিন মাইতি। বাসু আত্মঘোষাণ করতেই মাইতি বললেন, আয়াম এক্সট্রিমিলি সরি, স্যার…
বাসু ওঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এ-কথা তো আপনি আগেই জানিয়েছেন মিস্টার মাইতি—যখন আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন আপনার এপ্লয়ীর তরফে আমাকে ওকালতনামা দিতে!
—না, না, না! আপনি বুঝছেন না। তখন আমার জানা ছিল না—রীতা সুইসাইড করেছে। সেটা জানার পর, কুন্তলা সসম্মানে মুক্তি পেয়েছে এ খবর পাওয়ার পর—আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে যাব। বলুন স্যার, কখন আপনার সময় হবে?
— শ্যাল হ্যাভ টু কাম থ্রু প্রপার-চ্যানেল!
—থ্রু প্রপার-চ্যানেল, স্যার?
—নিশ্চয়। যে মেয়েটা আপনাকে দু’-দুবার ইলেকশান জিতিয়ে দিয়েছে—তার মাধ্যমে আপনাকে আসতে হবে। আমি এখন ‘বিজি’ আছি। পরে কথা বলবেন।
লাইনটা কেটে দিলেন বাসু-সাহেব। রানী বললেন, নার্সিংহোমে একটা ফোন করে দেখ তো?
বাসু নির্দেশমতো ফোন করলেন। কৌশিককে হাতের কাছে পাওয়া গেল না; কিন্তু চিফ- মেট্রন জানালেন—সুজাতাকে এখনো ও.টি.তে নিয়ে যাওয়া হয়নি।
লাইনটা কেটে দিয়ে বাসু আবার সল্ট লেকে ফোন করলেন, শকুন্তলাকে জানাতে যে, রবিন মাইতি ওঁকে ফোন করেছিল। শকুন্তলা সব শুনে বলল, আপনার পরামর্শটা আমি পুরোপুরিই গ্রহণ করেছি, দাদু! এইমাত্র ক্যুরিয়ার সার্ভিসে আমার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিলাম।
বাসু বলেন, সে কি! এত তাড়াহুড়া করার কী ছিল?
—ছিল না? আপনি জানেন না? হঠাৎ যদি মনের এই দৃঢ়তাটা হারিয়ে যায়? সামনা- সামনি দাঁড়িয়ে যদি প্রত্যাখ্যান করতে না পারি?
—কিন্তু তুমি তো তাহলে হঠাৎ বেকার হয়ে গেলে। এখন কী করে সংসার চালাবে?
–যেটুকু জমেছে তাই খরচ করে। তারপর হয়তো পুরানো কাগজের ঠোঙা বানাব—আপনি চিন্তা করবেন না, দাদু!
.
বিকেলবেলায় এল প্রত্যাশিত ফোনটা। নার্সিংহোম থেকে।
সুজাতার সিজেরিয়ান নির্বিঘ্নে হয়েছে। মা ও সন্তান দুজনেই ভাল আছে। এইমাত্র ও.টি থেকে সুজাতাকে কেবিনে নিয়ে যাওয়া হলো।
বাসু বলেন, কিন্তু…ইয়ে…নাতি না নাতনি?
কৌশিক বললে, সুজাতা আপনাকে এখনি চলে আসতে বলছে! আপনি কি ব্যস্ত?
—নিশ্চয় নয়। আমি এখনি আসছি। কিন্তু আমি জানতে চাইছিলাম..
কৌশিক লাইনটা কেটে দিল।
বাসু স্বগেতোক্তি করলেন : ইডিয়েট!
রানী বলেন, বলল না? কি গো?
—না! মামুর সঙ্গে মশ্করা হচ্ছে!
উনি আবার নার্সিংহোমে ডায়াল করতে যাচ্ছিলেন। বাধা দিলেন রানী। বললেন, নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। তুমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলেই যাও না বাপু। স্বচক্ষে দেখে আমাকে একটা ফোন কর। আমি এখানেই ঠায় বসে থাকব। নার্সিংহোম তো দশ-মিনিটের ড্রাইভ।
বাসু যে বেশে ছিলেন সেই পোশাকেই রওনা দিলেন। শুধু বাড়ির চটিটা বদলে জুতো পরে।
বাসু রওনা হবার একটু পরেই আবার টেলিফোন বাজল। কৌশিকই করছে। জানতে চাইল, মামু রওনা হয়েছেন?
–হ্যাঁ; কিন্তু আসল কথাটা তাঁকে বললে না কেন?
—আমরা দুজন বাজি ধরেছি। বাচ্চার মুখটুকু শুধু খোলা থাকবে। মামুকে বলতে হবে নাতি না নাতনি!
—কিন্তু আমাকেও বলবে না?
—ওমা! আপনাকে বলব না কেন? সুজাতার…
.
সুজাতা কেবিনে শুয়েছিল। তার গলা পর্যন্ত একটা চাদর। সাদা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে তাকে। মুখে তৃপ্তির হাসি। মাথার কাছে একটা ফুলদানিতে একগুচ্ছ গোলাপ। পাশেই একটা বেবিকটে শুয়ে আছে সুকৌশলীর সংসারে নবাগত/নবাগতা শিশুটি।
বাসু এগিয়ে এসে সুজাতার মাথায় হাত রাখলেন। সুজাতা খুশির হাসি হাসল। বাসু এবার ভাগ্নের দিকে ফিরে বললেন, বাঁদরামো হচ্ছিল কেন? ভাইটাল ইনফরমেশনটা দিচ্ছিলে না কেন?
কৌশিক বলে, আমরা যে দুজন বাঝি ধরে বসে আছি. আপনি ঠিকমতো আন্দাজ করতে পারবেন কি পারবেন না। আমি বলেছি পারবেন না, সুজাতা বলেছে পারবেন। বলুন মামু—আপনার সংসারে কে এসেছে? চুন্নুমুন্নু নাতনি, না নাতি?
বাসু ঝুঁকে পড়ে সদ্যোজাত শিশুটিকে দেখলেন। তাঁকে দেখে বাচ্চাটা একগাল হাসল। বাসু বললেন : এঃ! রানুরই জিত হলো। রানু বলেছিল নাতি; আমি বলেছিলাম নাতনি! এ তো ছেলে!
কৌশিক ছেলেমানুষের মতো হাততালি দিয়ে ওঠে : ফেল! মামু ফেল! সুজাতাও হেরে গেছে—
বাসু-সাহেব কুঞ্চিত ভ্রূভঙ্গে বলেন, নাতনি?
কৌশিক জবাব দেয় না। ঝাঁকি-দর্শনের ভঙ্গিতে কম্বলটা তুলে নিয়েই আবার চাপা দেয়। বাচ্চাটার ডায়াপার পরানো নেই!
বাসু বললেন, তাহলে তো আমিই জিতলাম! রানুকে বলেছিলাম….
কৌশিক বাধা দিয়ে বলে, সে তো না দেখে ব্লাইন্ডফোল্ড ফোরকাস্ট! কিন্তু স্বচক্ষে দেখে…
সুজাতাও বাধা দিয়ে বলে, আপনি মেয়েটার একটা সুন্দর নাম দিন, মামু।
বাসু বলেন, আমি কেন? তোমরা দুজনে মিলে ওকে পয়দা করতে পারলে, আর নামটা দিতে পারবে না?
সুজাতা রলে, না! আমরা দুজনে মিলে একটা গোয়েন্দা সংস্থাও তৈরি করেছিলাম। কিন্তু নামকরণটা করেছিলেন আপনি : সুকৌশলী! এবারও নামটা আপনাকেই দিতে হবে।
—বেশ তো, দেব। আগে রানুর সঙ্গে কনসাল্ট করি। তবে আমি ‘ডিভিশন অব লেবারে’ বিশ্বাস করি। ভালো নাম, মানে পোশাকী নামটা আমরা দুই বুড়ো-বুড়ি দেব। কিন্তু ডাকনামটা তোমরা স্থির করবে।
সুজাতা বলে, ডাকনাম তো স্থির হয়েই আছে। আমরা দুজনেই স্থির করে রেখেছিলাম যদি মেয়ে হয় তবে তার ডাকনাম হবে…
—’ডাকনাম হবে’?
— মিঠু!
বাসু হাসলেন। সে হাসি বেদনার। সে হাসি আনন্দের। চোখ থেকে চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে কাচটা মুছতে মুছতে বলছেন, তিন দশক পরে আবার আমার সংসারে ফিরে এল ‘মিঠু’! ছিল কিশোরী মেয়ে, ত্রিশ বছর পরে হয়ে গেল সদ্যফোটা ফুটফুটে নাতনি!