সকল কাঁটা ধন্য করে – ৮

আট

কলবেল-এর আওয়াজ শুনে কেষ্টার-মা দরজা খুলে দিল। বলল, অ! আপনেরা! আমি বলি অ্যাত্তসকালে কে এল জ্বালাতে…

নিখিল জানতে চায়, তোমার বড়দিমণি আছেন?

—আছেন। এখন তো ইস্কুলের ছুটি গো। আসেন, বসেন। আমি খপর দিই।

বাসু আর নিখিল গিয়ে বসলেন বৈঠকখানায়। একটু পরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল শকুন্তলা। হাতে তার সেদিনের সংবাদপত্র। বোধকরি শয়নকক্ষে সেটাই পড়েছিল এতক্ষণ। ভাঁজ করে সেন্টার-টেবিলের নিচের তাকে সেটাকে রেখে দিয়ে বসে। হাত তুলে নমস্কার করে বলে, কোনও হদিস হলো? কেন রীতা এভাবে আত্মহত্যা করল?

নিখিল বলে, বলছি। সব কথাই আজ খুলে বলব। তার আগে দু’একটা তথ্য জানাই, এবং জেনে নিই। যে মদ্রদেশীয় লোকটির গাড়ির নম্বর আপনি লিখে রেখেছিলেন তার সন্ধান পাওয়া গেছে। অনুমান করবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, লোকটা মাস-মাস রীতা দেবীর কাছ থেকে ‘ব্ল্যাকমেল’-এর টাকা আদায় করতে আসত।

শকুন্তলার ভ্রূকুঞ্চন হলো। বললে, ব্ল্যাকমেইল! কী ব্যাপারে? রীতার মতো শান্ত স্বভাবের মেয়ে কোনো অপরাধ করে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এটা বিশ্বাসই হয় না।

নিখিল বলে, সেইটাই আমার প্রথম প্রশ্ন, মিস্ রায়। আপনি রীতা দেবীকে কিশোরী বয়স থেকে চেনেন। পারলে, আপনিই পারবেন ওর অতীত জীবনের কিছু সন্ধান দিতে। রীতা বিদ্যার্থীর জীবনে এমন কিছু অতীত ঘটনা থাকতে পারে কি—যার জন্য ওকে ব্ল্যাকমেইল করা যায়?

আমি শকুন্তলা তার ম্যানিকিওর-করা নখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, নিশ্চিতভাবে জানি না, রীতার সঙ্গে এ বিষয়ে কখনো আমার কোনো কথাবার্তা হয়নি—কিন্তু স্কুলে একটা গুজব শুনেছিলাম—সত্যমিথ্যা জানি না…

—থেমে গেলেন কেন? বলুন?

—দু’একজন বলেছিল, রীতা…মানে… বাস্টার্ড!

—বাস্টার্ড? মানে ওর জন্মের আগে ওর বাবা-মায়ের বিবাহ হয়নি?

—না, স্যার। সে অর্থে নয়। ওর মা ছিলেন সম্ভবত কর্ণাটকী মহিলা। সম্ভবত তাঁকে একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ‘রেপ’ করে। লোকটা পালিয়ে যায়। সন্তান জন্মের পর ওর মা ওকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেয়। পথচলতি মানুষ ওকে কুড়িয়ে পায়—থানায় জমা দেয়, হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে একটি মিশনারী প্রতিষ্ঠান ওর দায়িত্ব নেয়।…আই রিপীট, স্যার, এটা একেবারে শোনা কথা—গুজব মাত্র। এ নিয়ে রীতার সঙ্গে আমার কোনোদিন কথা হয়নি, অর্থাৎ রীতা আমার কাছে কোনোদিন সেকথা স্বীকার করেনি।

নিখিল বলে, “যা রটে তার কিছুটা বটে।’ এটা সত্য হলে বাকি ঘটনা পরস্পরার একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।

—কী ঘটনা পরম্পরা?

—ঐ মাদ্রাজী লোকটি এই তথ্য জানত। রীতার ওই বংশ-পরিচয়টা জানাজানি হলে সমাজে তার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। অ্যাডভোকেট মাইতির মতো খানদানি ঘরে তার স্থান হতে পারে না। ফলে, পান্ডুরঙ তথ্যটা গোপন রাখার শর্তে ওর কাছে মাসে-মাসে…

শকুন্তলা বাধা দিয়ে বলে, লোকটার নাম পান্ডুরঙ? তার সন্ধান পেয়েছেন?

–পেয়েছি। লোকটা সম্ভবত স্বভাবক্রিমিনাল। সে যে ব্র্যান্ডের চুরুট খায় সেই ব্র্যান্ডের চুরুট আমরা পেয়েছি রীতার ঘরে। তাছাড়া এই জিনিসটা দেখুন। এটা কী বলে মনে হয়?

শকুন্তলা ঝিনুকের টুকরোটা নেড়ে চেড়ে দেখল। বলল, মনে হয় ঝিনুকের কানের দুলের অংশ। এমন দুল অবশ্য আমারও নেই, রীতারও ছিল না। কোথায় পেলেন ওটা?

নিখিল বললে, না, মিস্ রায়, এটা মেয়েদের দুল থেকে খসে পড়েনি। পড়েছে পুরুষমানুষের ফুলস্লিভ শার্টের কাফ-লিংক থেকে। ঐ পান্ডুরঙেরই আস্তিন থেকে খসে পড়া। আর এটা আবিষ্কৃত হয়েছে রীতা দেবীর শোবার ঘর থেকে….

—তার মানে কি…তার মানে কি…

—হ্যাঁ, তাই। রীতা বিদ্যার্থী আত্মহত্যা করেনি। দিস্ ইজ এ কেস অব মার্ডার! শকুন্তলা বজ্রাহতা হয়ে নিস্পন্দ তাকিয়ে থাকে। তারপর সম্বিত পেয়ে আঁচলটা তুলে মুখটা ঢাকে।

বাসু এতক্ষণ কোনও কথা বলেননি। এবার বললেন, তুমি শান্ত হও মা! বুঝতে পারছি, তুমি এ সংবাদে কতটা শক্ড। কিন্তু তোমার বান্ধবীর হত্যাকারীকে তার প্রাপ্য শাস্তিটা দিতে তুমি নিশ্চয় পুলিসকে সাহায্য করবে?

শকুন্তলা মুখ মুছে জানতে চাইল, সেই মাদ্রাজী শয়তানটা এখন কোথায়?

—হাজতে। তাকে মার্ডার-চার্জে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

শকুন্তলা কোনও জবাব দিল না।

নিখিল বলে, লোকটা স্বীকার করেছে যে, কালীপূজার দিন সন্ধ্যায় সে রীতার কাছ থেকে নগদে পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু তার বক্তব্য হচ্ছে, সে টাকা ও নিয়েছে ‘চিট ফ্যান্ডের’ ইন্সটলমেন্ট হিসাবে। ব্ল্যাকমেলিং বাবদ নয়।

শকুন্তলা অবাক হলো। বলল, চিট ফান্ড? রীতা তো কখনো আমাকে তা বলেনি। ওর হাতে প্রায়ই টাকা থাকত না। মাঝে মাঝে আমার কাছে ধার নিত, আবার পরের মাসে মাইনে পেলে শোধ করেও দিত। সে কোনও ‘চিট ফান্ডে মাসে মাসে ডিপজিট করত এটা আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। আর যদি তাই করতে চায় তাহলে ‘অ্যাকাউন্ট-পেয়ী’চেকে কেন নয়? লোকটা নিঃসন্দেহে ব্ল্যাকমেলার। পাক্কা শয়তান!

—আমারও তাই বিশ্বাস। তবু আপনার উপস্থিতিতে আমি ঐ আলমারিটা আর একবার খুলব। খুঁজে দেখব, ওই চেন্নাইয়ের কোনও চিট ফান্ডের সার্টিফিকেট বা রসিদ পাওয়া যায় কি না। গতবার সে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা তো আলমারিটা সার্চ করিনি।

শকুন্তলা বললে, চাবি দিচ্ছি। আপনারা খুঁজে দেখুন। তবে, প্লিজ আমাকে রেহাই দিন। ওই ঘরে আমি এখনো যাইনি। যেতে পারছি না। আরও দু চারদিন না গেলে….

—কিন্তু আপনার অসাক্ষাতে কেমন করে আমরা আলমারি খুলে…

বাধা দিয়ে শকুন্তলা বলল, অলরাইট। আমি কেষ্টার-মাকে আবার আপনাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সে আমার প্রতিনিধি। এভাবেই আইনটাকে বাঁচিয়ে আমাকে রেহাই দিন, প্লিজ। নিখিল রাজি হলো। উঠে দাঁড়াল। চলতে গিয়ে হঠাৎ ফিরে এসে বলল, আর একটা প্রশ্ন মিস্ রায় : রীতা কি ‘লে-হ্যান্ডার’ ছিল?

—লেফট-হ্যান্ডার? মানে—ওই যারা বাঁ-হাতে লেখে?

—হ্যাঁ, তাই। আপনি তাকে স্কুলজীবন থেকে দেখেছেন, আপনি নিশ্চয়ই তা জানেন…

—কেন জানব না? না, রীতা আপনার-আমার মতো ডান হাতেই লিখত। কিন্তু হঠাৎ এ-কথা কেন?

—পিস্তলটা রীতার কোন হাতে ছিল, তা মনে নেই?

শকুন্তলা মুখ নিচু করে চিন্তা করল। তারপর মুখ তুলে স্বীকার করল, সরি। তা আমার মনে নেই।

—মনে নেই? মাত্র দুদিন আগেকার ঘটনাটা…

—আয়াম এক্সট্রিমলি সরি, অফিসার। এই দুটো দিন ধরে আমি ক্রমাগত চেষ্টা করে গেছি, সেই ক্ষণিক-দেখা দৃশ্যটা ভুলে যেতে! আমার এটুকু মনে আছে : অনিমেষবাবু আর তাঁর কন্সটেব্লা মিলে দরজাটা ভেঙে ফেললেন। তিনজনেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন। আমিও তাঁদের পিছু পিছু…কিন্তু অনিমেষবাবু হঠাৎ আমাকে রুখে দিলেন। বললেন, ঘরের ভিতরে এলে কোনো কিছু স্পর্শ করবেন না। দূর থেকে…তা, হ্যাঁ, আমি দূর থেকেই দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম। ঘরে আদৌ ঢুকিনি…রক্তের মধ্যে পড়ে আছে রীতা। ইনফ্যাক্ট, তার কোথায় গুলিটা লেগেছে, তার হাতে কোনো কিছু ছিল কি না, আমি কিছুই দেখিনি। আমার প্রচণ্ডভাবে গা গুলিয়ে উঠল। আগের রাত্রে ভদ্রেশ্বরে অনেক রাত করে খাওয়া-দাওয়া করেছিলাম…তারপর ঘুম হয়নি…ট্রেন জার্নি…আমার সব কিছু বমি হয়ে গেল। এরপর আমি আর দোতলায় যাইনি!

নিখিল বলল, কেষ্টার-মাকে পাঠিয়ে দিন দোতলায়। আর আলমারির চাবিটা দিন। আসুন, স্যার-

বাসু কিন্তু গাত্রোত্থান করলেন না। বসে বসেই বললেন, এর মধ্যে অ্যাডভোকেট মিস্টার মাইতির সঙ্গে তোমার কোনোও কথা হয়েছে? টেলিফোনে?

শকুন্তলা তার আয়ত চোখজোড়া তুলে বললে, এসকিউজ মি স্যার, তার সঙ্গে কি রীতার মৃত্যুরহস্যের কোনও সম্পর্ক আছে?

বাসু হেসে বললেন, সেইটাই তো জানতে চাইছিলাম!

.

ওঁরা দুজনে সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতলে উঠে এলেন। পিছন-পিছন কেষ্টার মা। নিখিল এগিয়ে গিয়ে আলমারিটা খুলল। বাসু-সাহেব হঠাৎ রুখে গেলেন। কেষ্টার-মাকে বললেন, টুলের উপর উঠে ঐ ছবিটা টাঙালো কে গো? তুমি?

বাসু-সাহেবের অঙ্গুলি নির্দেশে কেষ্টার-মা ঊর্ধ্বমুখ হলো। অবাকও হলো। বলল, অ-মা! ফটোকটা বড়দিমণি আবার টাইঙ্গে দেছে দেখছি…

বাসু বলেন, না! তোমার ভুল হচ্ছে। বড়দিমণি তো ওই ঘটনার পর এঘরে আর আসেইনি বলল। তুমিই নিশ্চয় টাঙ্গিয়েছ!

কেষ্টার-মা রুখে ওঠে, না! আমি টাংগাই নাই…

বাসু আপসের চেষ্টা করেন, বেশ তো, বেশ তো! তা রাগ করছ কেন? এই ছবিটাই তো আগে ছিল ওখানে? তোমার ছোড়দিমণির ছবিটা?

কেষ্টার মার কেমন যেন ধন্ধ লেগে গেল। বললে, ওই ফটোকটাই কি ছেল ওখানে? ওইডা ছোড়দিমণি?

বাসু বলেন, সেটা তো তুমি বলবে কেষ্টার-মা! আমি কি আগের ছবিখানা দেকিচি? তা কী বলছ তুমি? এইটাই সেই ছবি তো?

কেষ্টার-মা একগাল হেসে বললে, এজ্ঞে! পেরথমটায় কেমন যান ধন্দ ধরি গেল! মনে হতি ছিল, এডা ছোড়দিমণি লয়। তার যমজ বোনের ফটোক!

—এখনো তাই মনে হচ্ছে?

দুদিকে মাথা নেড়ে কেষ্টার মা বললে, না! এডাই সেডা!

নিখিল ও-পাশ থেকে প্রশ্ন করে, কী কথা হচ্ছে আপনাদের?

বাসু বললেন, ওই দেখ! রীতা বিদ্যার্থীর সেই ছবিখানা ফ্রেমিং হয়ে ফিরে এসেছে।

নিখিল ঊর্ধ্বমুখে ছবিটা দেখে! তারপর আলমারির চাবি বন্ধ করে এদিকে এগিয়ে আসে। বলে, শী ওয়াজ নট দেন আ লেফ্‌-হ্যান্ডেড লেডি?

এনলার্জড ফটোতে দেখা যাচ্ছে, বাসন্তী রঙের একটা চকড়া-বকড়া সালোয়ার কামিজ পরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে রীতা একটা প্যাডে কাকে যেন চিঠি লিখছে। তার ডান হাতে কলম।

নিখিল আবার আপন মনে বললে, সো দ্যাটস্ দ্যাট! মেয়েটি লেট্-হ্যান্ডার নয় তাহলে?

বাসু বললেন, তাই তো দেখছি। কিন্তু একটা কথা, নিখিল। কেষ্টার-মা প্রথম-দর্শনে বলেছিল এটা তার ছোড়দিমণির ফটোক নয়।

–সে কি! কেন? এটা তো রীতা বিদ্যার্থীর ফটোই।

—হ্যাঁ। তোমার-আমার তাই মনে হচ্ছে বটে, তবে কেষ্টার-মায়ের মনে হয়েছিল : এটা ছোড়দিমণির যমজ বোনের ফটোক।

নিখিল অবাক হয়। বলে, যমজ বোন! রীতার কি কোনও যমজ বোন ছিল না কি? কি গো কেষ্টার-মা? ও রীতার যমজ বোন?

কেষ্টার-মা সলজ্জে বলে, পেরথমটায় আমার ‘ভেরম্’ হই গেল, পুলিশ-সাহেব। না গো, এইডা ছোড়দিমণির সেই ফটোকটাই।

নিখিল একদৃষ্টে ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিল। বললে, ডেট-কার্ডটা পড়া যাচ্ছে—লক্ষ্য করেছেন?

বাসু বললেন, হ্যাঁ। মাস বা বার কী ছিল পড়া যাচ্ছে না; কিন্তু তারিখটা ছিল কোনো একটা মাসের এগারো তারিখ।

নিখিল হঠাৎ বলে বসে, হোল্ড এভরিথিং! ব্যাপারটা কী?

একটা চেয়ার টেনে এনে ফ্রেমে বাঁধানো ফটোটা নামাল সে। উল্টো-পাল্টে দেখল। তারপর হিপপকেট থেকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বার করে খুব গভীরভাবে ছবিটা দেখল। অবশেষে সে বলল, ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখুন!

বাসু ফটো আর আতস কাচটা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন। নিখিল বললে, অ্যানোম্যালিটা নজরে পড়েছে?

বাসু বললেন, ‘অ্যানোম্যালি’? মানে অসংগতি? কই না। আমি তো যা প্রত্যাশা করেছিলাম, তাই দেখতে পাচ্ছি।

—রীতার বাম ভ্রূর উপর কাটা দাগটা…

—হ্যাঁ, এবার ডান ভ্রুতে চলে গেছে এবং এগারো অক্ষরের ইলেকদুটো উল্টো দিকে চলে গেছে…

–‘ইলেকদুটো উল্টো দিকে চলে গেছে’ মানে?

—ও! সেটা তোমার নজরে পড়েনি বুঝি? শোন, কলমটা যদি রীতার বাঁ-হাতে থাকত আর কাটা দাগটাও বাম-ভ্রূর উপরে দেখতে পেতাম তাহলে, দাও দেখি তোমার নোটবইটা… নিখিল পকেট থেকে তার নোটবইটা বার করে দিল। বাসু-সাহেব পাশাপাশি দুটি স্কেচ এঁকে বললেন, এই দেখ, ফটোতে যদি কলমটা ওর বাঁ-হাতে থাকত তাহলে এগারো হরফটা ফটোতে ‘ক’-চিহ্নের মতো হতো। কিন্তু তা হয়নি। একের-পিঠে-এক-এর ইলেকদুটো উল্টো দিকে হয়ে গেছে—কারণ কলমটা এসে গেছে ওর ডান হাতে। তাই এগারোটা দেখতে হয়েছে ‘খ’-চিহ্নের ছবির মতো!

নিখিল বলল, এনাফ!

—না, নিখিল, এখনো ‘এনাফ’ হয়নি। ফটোটা উল্টে পিছন দিকটা দেখ। বালি-কাগজে আঠা দিয়ে পাশটা এবং পিছনটা মোড়ানো হয়নি। খবরের কাগজ কেটে আঠা দিয়ে সেঁটে তড়িঘড়ি ফটোটা বাঁধানো হয়েছে। একেবারে অ্যামেচারিশ কাজ!

নিখিল বললে, এই এভিডেন্সটা কনক্লুসিভ! মার্ডারার পুলিশের চোখে ধোঁকা দিতে নিজের ডার্করুমে নিজে হাতে ‘রিভার্স প্রিন্ট এনলার্জ করেছে! প্রমাণ করতে চেয়েছে রীতা ছিল রাইট- হান্ডার।

—কিন্তু কেন? কী তার উদ্দেশ্য?

—হত্যাপরাধটা পান্ডুরঙের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে। আপনি একটু অপেক্ষা করুন, স্যার। গাড়িতে আমার রেডিও-সেটটা আছে। আমি হোমিসাইডে একটা ফোন করি।

বাসু ওর হাত চেপে ধরেন। বলেন, না, নিখিল, না। আগে সবটা বুঝে নাও! এখনও তুমি সবটা জান না!

নিখিল দৃঢ়তার সঙ্গে বললে, সরি স্যার! এত বড় একটা ক্লু আমি আস্তিনের তলায় লুকিয়ে রাখতে পারব না। আমার ‘বস’-কে এক্ষণি ওটা জানাতে হবে। আর তিনি যদি মিস্ রায়কে অ্যারেস্ট করতে বলেন, তাহলে সেটাও আমাকে করতে হবে। আমি পুলিশে চাকরি করি, স্যার। কৌশিকবাবুর মতো শখের গোয়েন্দা নই।

বাসু শ্রাগ করলেন। কেষ্টার মা বলল, হৈছেডা কী?

নিখিল জবাব দিল না। ফটোটা বগলে নিয়ে তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল বাইরে।

বাসু ধীর পায়ে নেমে এলেন নিচে। দেখলেন, শকুন্তলা নিশ্চুপ বসে আছে তার বৈঠকখানা ঘরে। বাসু ধীরে ধীরে এসে বসলেন তাঁর পাশটিতে। কেষ্টার-মা কলঘরের দিকে চলে গেল কাপড় কাচতে।

বাসু পকেট থেকে পাইপ-পাউচ বার করে তামাক ঠেশতে ঠেশতে বললেন, এটা তুমি কী করলে, কুন্তলা মা! এত বুদ্ধি তোমার, আর এটুকু বুঝলে না যে, তোমার ফটোগ্রাফিক ট্রিকস্টা পুলিশে সহজেই বুঝে ফেলবে? লেফট্-হ্যান্ডারকে ওভাবে রাইট-হ্যান্ডার করা যায় না—তার জন্য ‘মোবিয়াস্ প্লেন’-এ স্পেসকে পাক খাওয়াতে হয়। সে বড় কঠিন অঙ্ক, মা…*

[* নক্ষত্রলোকের দেবতাত্মা দ্রষ্টব্য]

শকুন্তলা কুঞ্চিত ভ্রূভঙ্গে এতক্ষণ শুনে যাচ্ছিল। এবার বলে, সম্ভবত আপনি বাংলা ভাষাতে কথা বলছেন। ওইটাই আমি স্কুলে পড়াই; কিন্তু আপনার কথা আমি বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারছি না।

বাসু ঝুঁকে পড়ে বললেন, সাদা-বাংলায় বলি, বুঝবে! রীতা বিদ্যার্থীকে কে গুলিবিদ্ধ করেছে, এ দুনিয়ায় তা তিনজন জানে। এক : রীতা নিজে জানত। সে চিরনির্বাক হয়ে গেছে। দুই : আমি জানি, যেহেতু ঘটনার পারম্পর্য বিশ্লেষণ করে সেটা বোঝার মতো বিশেষ শিক্ষা আমার আছে। তিন : তুমি নিজে। যেহেতু—কিন্তু হেতুটা তোমাকে বোঝানো বৃথা। তুমি জান কীভাবে তুমি নিজেই অপরাধী…

শকুন্তলা বাধা দিয়ে বললে, আপনার কথা এখন সহজবোধ্য। কিন্তু আপ্তবাক্যধর্মী। এসব আবোল-তাবোল কথা আমাকে কেন বলছেন?

—বলছি, এজন্য যে, পনেরো মিনিটের ভিতর তুমি রীতা বিদ্যার্থীর হত্যাপরাধে গ্রেপ্তার হবে। ঐ পুলিস অফিসারটি ফিরে এলেই। তোমাকে আমার অনুরোধ—আমাকে দশটা টাকা এনে দাও। আমি তোমার নামে একটা রসিদ কাটি! আইনত তোমাকে মক্কেল বলে স্বীকার করতে হলে সেটা প্রয়োজন। কুইক!

শকুন্তলা বললে, সরি স্যার! আমি বুঝতে পেরেছি, মিস্টার দাশ রেডিও মেসেজে আমাকে গ্রেপ্তার করার অনুমতি আনতে গেলেন। এখনি এসে আমাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবেন। এই তো? আই নো! আমি সেজন্য প্রস্তুত হয়েই বসে আছি। কিন্তু আপনাকে আমি আমার কাউন্সেলার হিসাবে এনগেজ করতে পারব না! সরি স্যার!

—কিন্তু কেন? তুমি কি গিল্টি প্লীড করবে?

—আইনভঙ্গ করেছি, তাই গিটি তো আমি বটেই। কিন্তু রীতাকে আমি হত্যা করিনি! সুতরাং গিল্টি প্লাড করব কোন দুঃখে?

—তাহলে তুমি আমাকে ….

কথাটা তাঁর শেষ হলো না। সদর দরজাটা খুলে গেল। নিখিল ফিরে এসে বলল, মিস্ শকুন্তলা দেবী, আয়াম এক্সট্রিমলি সরি টু অ্যানাউন্স…

কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে শকুন্তলা বললে, আপনার দুঃখিত হবার কী আছে মিস্টার দাশ? আপনি তো উপরওয়ালার নির্দেশে আমাকে অ্যারেস্ট করছেন। আমি তৈরিই। শুধু একটা অনুরোধ—

—বলুন?

—আমার শোবার ঘরে একটা মিনি-অ্যাকোয়ারিয়াম আছে। তাতে আট-দশটা বিদেশী মাছ আছে। ও বেচারারা তো কোনো অপরাধ করেনি। ওগুলোকে আপনার লোক দিয়ে কোনও অ্যাকোয়ারিয়াম মালিককে পৌঁছে দেবেন। দাম চাই না আমি। জাস্ট এ গিফ্‌ট্! মাছগুলো না হলে মরে যাবে!

বাসু-সাহেব স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মেয়েটির মনের জোর দেখে

শকুন্তলা ঘরের ভিতর গেল। একটু পরেই একটা ওভারনাইট ব্যাগ নিয়ে সে ফিরে এল। বোঝা গেল, এ ঘটনা তার কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত নয়। সে মনে মনে তৈরি হয়েই ছিল। শকুন্তলা কেষ্টার-মাকে ডাকল। তার হাতে একটা খাম দিয়ে বলল, এতে তোমার তিন মাসের মাইনে আছে। তুমি অন্য কোথাও কাজ খুঁজে নিও।

কেষ্টার-মার অর্থগ্রহণ হলো না। বললে, আমার হাতের-কাজ এখনো সারা হয়নি। তুমি কি বেরুচ্ছ বড়দিমনি?

—হ্যাঁ, নাও এই খামটা ধর। কাপড় কাচার দরকার নেই। এস। আমি দরজা বন্ধ করব। তারপর বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বললে, থ্যাঙ্কু অল দ্য সেম, স্যার, ফর য়োর কাইন্ড অফার।

বাসু-সাহেব কথা খুঁজে পেলেন না।

শকুন্তলা এবার দাশের দিকে ফিরে বললে, চলুন?