সকল কাঁটা ধন্য করে – ৭

সাত

ষোলই নভেম্বর, বুধবার, সকাল।

প্রাতরাশে বসেছেন ওঁরা তিনজন। হ্যাঁ, তিনজনই। সুজাতা বাদে। কারণ কাল সন্ধ্যাবেলায় সুজাতাকে পরীক্ষা করে ‘গাইনো’ পরামর্শ দিয়েছেন তাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করে দিতে। বেশি বয়সে প্রথম সন্তান হচ্ছে তো। তাই এই বিশেষ সাবধানতা। হয়তো শেখ পর্যন্ত সিজারিয়ানই করতে হবে।

বাসু বিনা-মাখন টোস্টে অভ্যাসবশে ছুরিটা বোলাতে বোলাতে বললেন, সিজারিয়ান আজকাল জলভাত। এ তো আর সীজার অথবা ম্যাকডাফের আমল নয়!

কৌশিকের মাখন-আহারে ডাক্তারের বারণ নেই। সে যেন বাসু-সাহেবকে দেখিয়ে দেখিয়ে টোস্টে মাখনের মোলায়েম প্রলেপ লাগাচ্ছিল। জানতে চায়, জুলিয়াস সীজারকে চিনি, কিন্তু ম্যাকডাফটি কে?

বাসু ওর ওই দেখিয়ে-দেখিয়ে মাখন মাখানোর কায়দায় বোধহয় চটে ছিলেন। বললেন, সেটা জুলিয়াস সীজারের সৌভাগ্য আর সেক্ষপীয়রের দুর্ভাগ্য।

ঠিক তখনই বেজে উঠল টেলিফোনটা। যথারীতি বিশে সেটা তুলে নিয়ে শুনল। রাসু – সাহেবের দিকে যন্ত্রটা বাড়িয়ে ধরে বললে, আপনের। হোমিসাইড অফিস থেকে দাশ-সাহেব বলতেছেন।

বাসু বলেন, হোমিসাইড? সেটা আবার কী?

এক গাল হেসে বিশে বলে, আমি জানি। যে অফিসে সবাই শুধু খুনোখুনি করে।

এঁরা তিনজনেই হেসে ওঠেন।

নিখিল টেলিফোনে জানায় সাম্প্রতিকতম সংবাদ। অনেকটা অগ্রসর হওয়া গেছে। যদিও সমাধানের কোনও ইঙ্গিতই পাওয়া যাচ্ছে না।

প্রথম কথা : ব্যালাস্টিক এক্সপার্ট ইতিমধ্যে কম্পারেটিভ মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছেন মৃত্যুবাহী বুলেটটি রীতার নিজস্ব পিস্তল থেকেই নিক্ষিপ্ত। দ্বিতীয়ত, ব্যাঙ্গালোরে ফ্যাক্স করে জানা গেছে : রীতা বিদ্যার্থীর পিতৃপরিচয় নেই। বস্তুত ফুটপাতের একান্তে সদ্যোজাত অবস্থায় ফুটফুটে মেয়েটিকে আবিষ্কার করে শহরের কোনো এক মানুষ তাকে পুলিশের হেপাজতে জমা দেয়। পরে একটি মিশনারী প্রতিষ্ঠানে রীতা অনাথা হিসাবে মানুষ হয়। তারাই ওকে স্কুলে পড়ায়। স্কুল ফাইনাল পাস করে রীতা কর্ণাটকের বাইরে চলে আসে। তখনও সে মিশনারী সোসাইটি থেকে আর্থিক সাহায্য পেত। পরে গ্র্যাজুয়েট হয়ে একটি বড় কোম্পানিতে রিসেপশনিস্টের চাকরি পায়। ব্যাঙ্গালোরের গোয়েন্দা দপ্তর তার বর্তমান ঠিকানা জানে না। নিখিল জানালো, সে আর একবার ওই করুণাময়ী অঞ্চলের বাড়িটায় যাচ্ছে। বাসু-সাহেব কি ওকে সঙ্গ দেবেন?

বাসু জানতে চান, আজ তুমি আবার কেন যাচ্ছ, বল তো?

নিখিল টেলিফোনে বলে, কাল যে প্রশ্নটা মিস্ রায়কে করিনি, আজ সেটাই করে দেখতে চাই, সে কী বলে!

—কালই বা সেটা জানতে চাওনি কেন?

–যে কারণে আপনিও তাকে প্রশ্নটা করেননি, সেই একই কারণে। শকুন্তলা রায়কে সন্দেহ তালিকার বাইরে রাখা যাচ্ছিল না। তাই আপনিও তার কাছে জানতে চাননি, রীতা লে-হ্যান্ডার ছিল কি না। তাই না?

বাসু বললেন, তুমি আমাকে পিক্‌-আপ করে নিয়ে যেও। বিশেষ কারণে কৌশিককে আজ নিয়ে যাওয়া যাবে না। গাড়িটাও তার হেপাজতে থাকবে।

—বিশেষ কারণে?

—হ্যাঁ। কাল গাইনো সুজাতাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করে নিয়েছেন। হয়তো অ্যাডভান্স ডেলিভারি হবে।

—আই সী। ঠিক আছে, স্যার, আমি আধঘন্টার মধ্যেই আসছি।

বাসু-সাহেব তৈরি হয়ে নিলেন। নিখিল আধঘন্টার মধ্যেই এসে পৌঁছাল। রানী দেবী ওর কাছে জানতে চাইলেন, ব্রেকফাস্ট করে এসেছ তো, নিখিল?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু তাহলেও আমি আর এক কাপ কফি খাব। কিছুটা আলোচনা করার আছে—সল্ট লেকে যাত্রা করার আগে।

অগত্যা বিশে আবার গেল কফি বানাতে।

নিখিল বলে, আপনি কি এখনো কোনো সমাধানের ইঙ্গিত পাচ্ছেন না স্যার?

বাসু বললেন, তুমি তো জানই, আমি নিজের মতো চিন্তা করে চলি। সম্পূর্ণ সমাধানের নাগাল পাওয়ার আগে মুখ খুলি না। আমার মনে একটা সমাধান এসেছে, কিন্তু জিগ্‌গ্স-পা- এ এখনো আছে দু’একটা মিসিং-পিস্। তুমি বরং গুছিয়ে বল—তোমার কী কী সম্ভাবনার কথা মনে হচ্ছে।

নিখিল বলে, তিনটি বিকল্প সমাধান। কিন্তু প্রত্যেকটিতেই কিছু-না-কিছু প্রশ্নের জবাব নেই। অর্থাৎ একটাও সবসমস্যার সমাধানসম্পন্ন নয়।

—একে একে বলে যাও।

—প্রথম সমাধান : আত্মহত্যা। তাহলে তার আগে প্রতিষ্ঠা হওয়া দরকার যে, রীতা বিদ্যার্থী ‘লেফট্-হ্যান্ডার’ ছিল। সে যদি বাঁ-হাতে লিখত, বাঁ-হাতে তালার চাবি খুলত, আক্রান্ত হলে প্রতিবর্তী-প্রেরণায় বাঁ-হাতটাই বাড়িয়ে দিত আত্মরক্ষার জন্য—তাহলে ধরে নিতে হবে যে সে বাঁ-হাতে নিজের প্রাণ নিয়েছে। মোটিভটা তো এতক্ষণে খুঁজে পেয়েছি আমরা : রীতা বাস্টার্ড! খানদানি ঘরের সুপাত্র রবিন মাইতির জীবনসঙ্গিনী সে কোনোদিনই হতে পারবে না। হলে ওই ব্ল্যাকমেলার তাকে সারা জীবন শোষণ করে যাবে! সে এক নরকযন্ত্রণা! তাই উত্তেজনার মুহূর্তে নির্জন বাড়িতে সে আত্মহত্যা করে বসেছে। কিন্তু সে-ক্ষেত্রে পিস্তলটা ওর ডান হাতে চলে এল কী করে? তাছাড়া ঐ কাফ-লিংকটা আর চুরুটের স্ট্যাম্প-এর অস্তিত্বটাও ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। ফলে এ ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ সন্তোষজনক নয়। দ্বিতীয় সম্ভাবনা : পান্ডুরঙ মিছে কথা বলেছে। সে দ্বিতলে উঠে এসেছিল। বৈঠকখানায় নয়, দ্বিতলেই ওরা কথাবার্তা বলেছিল, কেষ্টার-মা চলে যাবার পরে

কৌশিক বাধা দিয়ে বলে, সেটা একটু কষ্টকল্পনা হয়ে যাচ্ছে না? কেষ্টার মায়ের উপস্থিতিতে দুজনে বাইরের ঘরে বসে কথা বলল, আর তারপর রীতা ওই ব্ল্যাকমেলারটাকে তার শয়নকক্ষে দ্বিতলে নিয়ে যাবে?

নিখিল বলে, ঘটনাটা যদি এই রকম হয় : কেষ্টার-মা চলে যাবার পর পান্ডুরঙ তাগাদা দেয়—আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, টাকাটা দাও।’ হয়তো তখন রীতা দ্বিতলে তার শয়নকক্ষে উঠে যায়—আলমারির থেকে টাকাটা বার করে আনতে। পান্ডুরঙ গোপনে তাকে অনুসরণ করে। তারপর ধরা যাক, মেয়েটি যখন স্টিল-আলমারিটা খুলছে তখন পান্ডুরঙ ঠিক ওর পিছনে চুপিসাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। হয়তো রীতা বলেছিল, এ কী? আপনি উপরের ঘরে এসেছেন কেন? আর তখনই পান্ডুরঙ ওকে জড়িয়ে ধরে। এমনটা কি হতে পারে না?

কৌশিক জানতে চায়, অটোপ্সি-সার্জেন কি এ বিষয়ে…

—না, বলেননি। শী ওয়াজ নট রেপড বিফোর হার ডেথ!

বাসু বলেন, ঠিক আছে। তুমি তোমার গল্পটা শেষ কর। এ পর্যন্ত তুমি যা বলেছ তার মধ্যে ‘ফ্যালাসি’ কিছু নেই। এমনটা বাস্তবে ঘটে থাকতে পারে।

নিখিল উৎসাহিত হয়ে বলে, ধরুন সে সময় ওর মুখে ছিল জ্বলন্ত চুরুট। রীতাকে আক্রমণ করা মাত্র একটা ধস্তাধস্তি হবেই। তাতে ওর হাতের কাফ-লিংকটা ভেঙে ঝিনুকের টুকরোটা মাটিতে পড়ে যেতে পারে। চুরুটটাও মুখ থেকে মেজেতে ছিটকে পড়বে, তাই না?

—ন্যাচরাল কনক্লুশান। বলে যাও?

—ধরা যাক, রীতার পিস্তলটা ছিল আলমারির ভিতর। সম্ভাব্যস্থান! মেয়েটি হাত বাড়িয়ে পিস্তলটার নাগাল পেয়ে যায়। পান্ডুরঙের অবস্থা তখন কাহিল। কামাবেগ চরিতার্থ করা অথবা ব্ল্যাকমেলিং-এর টার্গেটকে বাঁচিয়ে রাখার চেয়ে নিজের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদটা অনেক বড় হয়ে ওঠে। হাত কাড়াকাড়ি এবং ধস্তাধস্তির সময় পিস্তলটা ফায়ার হয়ে যায়! কালীপূজার রাত বলে রাস্তার ওপাশে কেষ্টার-মা বা মেজবৌ তা শুনতে পায় না। অর্থাৎ পটকার শব্দ বলে মেনে নেয়। এমনটা কি হতে পারে না? –

কৌশিক বলে, আপনি বলতে চান, তারপর পান্ডুরঙ পিস্তলটাকে রুমাল দিয়ে মুছে রীতার মুঠিতে ধরিয়ে দেয়। সিগারটা অ্যাশট্রেতে ফেলে সব কটা দরজা-জানলা বন্ধ করে?

নিখিল বলে, হয়তো রীতা ঘবটার তালা ঢুকে ছিল এবং চাবিটা ‘কী-হোলে’ লাগানোই ছিল। সুতরাং বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে পান্ডুরঙ নেমে আসে একতলায়। সদর দরজা খুলেই দেখতে পায় সামনের বাড়ির রোয়াকে বসে আছে দুজন। একজন ওর পরিচিত— কেষ্টার-মা! পান্ডুরঙ লোকটা প্রফেশনাল ক্রিমিনাল। তৎক্ষণাৎ পিছন ফিরে এমনভাবে কথা বলে, যাতে দূর থেকে মনে হয় যে, কপাটের আড়ালে রীতা দাঁড়িয়ে আছে। বলুন স্যার? কোথাও কোনও ‘ফ্যালাসি’ আছে? যা ব্যাখ্যা করা যায় না এমন কিছু তথ্য?

কৌশিক বলে, আছে নিখিলবাবু। তিন-তিনটে অসঙ্গতি। প্রথম কথা, আপনার হাইপথেসিস্ অনুসারে পান্ডুরঙ একজন পাকা ক্রিমিনাল। সে জানলায় ছিটকিনি দিল, পিস্তলটা রুমালে মুছে নিয়ে রীতার মুঠিতে গুঁজে দিল। আলমারি বন্ধ করে চাবিটা রীতার ব্যাগে ফেলে দিল। এমনকি দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে নেমে এল চাবিটা পকেটে নিয়ে। হঠাৎ দুজন সাক্ষীকে দেখে এমন অভিনয় করল যাতে মনে হয়, রীতা দরজার কপাটের আড়ালে দাঁড়িয়ে। এমন একজন পাকা ক্রিমিনাল অ্যাশট্রেতে চুরুটটা রেখে আসবে?

নিখিল বলে, আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে ক্রিমিনালজিতে একটা কথা চালু আছে : ‘দেয়ার্স নেভার সামথিং অ্যাজ আ পার্ফেক্ট মার্ডার!’ কোথাও না কোথাও একটা ভুল হয়ে যায়ই। এছাড়া ও বাপারটার কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না। যাহোক, আর দুটো অসঙ্গতি কী কী?

কৌশিক বলে, পান্ডুরঙের মতো পাকা ক্রিমিনালের পক্ষে স্বাভাবিক হতো—পিস্তলটা ভাল করে মুছে নিয়ে সেটাকে রুমালে জড়িয়ে রীতার আঙুলের ছাপ তুলে নিয়ে গুঁজে দেওয়া। নয় কি?

—তা ঠিক! আর তৃতীয় অসঙ্গতি?

–পান্ডুরঙ রীতাকে দীর্ঘদিন ধরে চেনে। সে নিশ্চয় জানে রীতা বেঁয়ো কি না। যদি প্রমাণিত হয় যে, মেয়েটি লে-হ্যান্ডার ছিল, তাহলে সে কিছুতেই ওর ডান হাতে পিস্তলটা গুঁজে দেবে না। এমনকি যদি সে রাইট-হ্যান্ডার হয়, তাহলেও সে পিস্তলটা বাঁ-হাতেই গুঁজে দিত। কারণ অমন একজন দাগী আসামী নিশ্চয় খেয়াল করত যে, ডান হাতে পিস্তল ধরে ওইভাবে বাঁ-কানের উপর ফায়ার করা ফিজিক্যালি অসম্ভব।

বাসু বলেন, আর কোনও অলটারনেটিভ সল্যুশান?

নিখিল একটু দম ধরে চিন্তা করে। তারপর বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ। ওই যাকে আপনি বলেছিলেন ইটার্নাল ট্রায়াঙ্গেল’—শাশ্বত ত্রিকোণ। দুটি নারী এবং একটি পুরুষ। এ সাবধানটা মেনে নিলে কেসটা আর ‘হোমিসাইড’ পর্যায়ে থাকবে না, স্যার—হয়ে যাবে ফার্স্ট ডিগ্রি ডেলিবারেট মার্ডার! যার শাস্তি : ফাঁসি।

কৌশিক বলে, বাই শকুন্তলা রায়?

—অভিয়াসলি। ভদ্রেশ্বরে আমি লোক পাঠিয়ে খোঁজ নিয়েছি। কালীপূজাটা ছিল মিস্‌ শকুন্তলার নিজের মাসির বাড়ি। সেবাড়ির অনেকেই স্বীকার করেছে যে, শনিবার সন্ধ্যাবেলা সে এসেছিল। পরদিন সন্ধ্যারাত্রে শকুন্তলা ওই বাড়িতে ছিল। প্রদীপ জ্বেলেছে, বাড়ি পোড়ানো দেখেছে। তারপর কালীপূজা শুরু হয়ে যাবার পর আর তাকে কেউ দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না। এক-একজন এক-এক রকম বলছে। ভদ্রেশ্বর থেকে হাওড়াগামী শেষ লোকালটা ছাড়ার পর কেউ তাকে দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না। একমাত্র ব্যতিক্রম ওর নিজের মাসিমা। তিনি বলেছেন, ভোরবেলা শকুন্তলা তাঁকে প্রণাম করে ট্রেন ধরতে যায়। বাড়ির অন্য সবাই তখন সারারাত জেগে ঘুমে অচেতন। কিন্তু আমার ধারণা—মাসিমা তাঁর বোনঝিকে বাঁচাবার জন্য সজ্ঞানে ডেলিবারেট মিছে কথা বলছেন।…অর্থাৎ শকুন্তলা কখন ফিরে এসেছিল তার প্রমাণ নেই।

কৌশিক বলে, মোটিভটা ব্যাখ্যা করা নিষ্প্রয়োজন। আপনি বলেছেন, আপনার ধারণায় শকুন্তলার চোখে অ্যাডভোকেট মাইতি ছিল স্বপ্নলোকের রাজপুত্র। মাইতি— যদিও মদ্যপ অবস্থায়—স্বীকার করেছিল, এককালে সে ঘন ঘন ওই করুণাময়ী অঞ্চলে যেত, ইলেকশানের সময় রাতের পর রাত শকুন্তলা মাইতির বাড়িতে কাজ করে গেছে। তার মায়ের স্নেহধন্যা হয়েছে। আর তারপর ঐ সোনালীচুলের দুধে-আলতা মেয়েটি ওর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াল। খুন যদি শকুন্তলাই করে থাকে তাহলে উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। আর মার্ডার ওয়েপনটার নাগাল পাওয়াও শক্ত নয় শকুন্তলার পক্ষে। স্টিল আলমারিটা তারই, ডুপ্লিকেট চাবি তার কাছে থাকার সম্ভাবনাটা প্রবল…

নিখিল বলে, এক্ষেত্রে কিন্তু কাফ-লিংক আর চুরুটের স্টাম্প দোতলায় চলে আসার ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে—

কৌশিক বলে, শকুন্তলার কীর্তি?

—অবভিয়াসলি! হয়তো শকুন্তলা দেবী জানতেন যে ওই মদ্রসাহেব বিকেলবেলা আসবে। হয়তো টেলিফোনে রীতার সঙ্গে পান্ডুরঙের যখন কথা হয় তখন মিস্ রায় তা শুনেছেন। সেক্ষেত্রে এমনটাও হতে পারে যে, মিস্ রায় রাত সাড়ে দশটা এগারোটার সময় অথবা সকালবেলাতেই ফিরে এসে বান্ধবীর কাছে শোনেন পান্ডুরঙ এসেছিল—

কৌশিক বলে, কিন্তু রীতা কি নিজে থেকে সে কথা স্বীকার করবে?

—হয়তো নিচের ঘরে অ্যাশট্রেতে পোড়া চুরুটটা দেখে, আর কাফ-লিংকের ঝিনুকের টুকরোটা ঘটনাচক্রে কুড়িয়ে পেয়ে শকুন্তলা আন্দাজ করেছিল ঠিকই। রীতাকে হত্যা করার পর খুব তাড়াতাড়ি সে কিছু এভিডেন্স সাজিয়ে দেয়। একতলা থেকে চুরুটের স্টাম্প আর কাফ-লিংকের টুকরোটা দোতলার ঘরে নিয়ে যায়। জানলাগুলো ভিতর থেকে ছিটকানি বন্ধ করে দেয়। দরজায় বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে পুলিশে ফোন করে।

কৌশিক বলে, সেক্ষেত্রে পিস্তলটা সে রীতার ডান হাতে গুঁজে দেবে কেন?

নিখিল বলে, একটাই সম্ভাব্য সল্যুশন : রীতা ‘লেফ্‌ট-হ্যান্ডার’ ছিল না। ফলে তার বাঁ- হাতে পিস্তলটা গুঁজে দিলে স্বতই মনে প্রশ্ন জাগবে, কেন সে বাঁ-হাতে পিস্তলটা নিয়ে বাঁ-কানে গুলি করে আত্মহত্যা করবে? তাই শকুন্তলা এটাকে ‘আত্মহত্যা’ বলে প্রতিষ্ঠা করতে চায়নি। অপরাধটা পান্ডুরঙের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে।সেই জন্যেই চুরুটের স্টাম্প আর ঝিনুকের টুকরোটা সযত্নে নিয়ে এসেছে দোতলায়!

কৌশিক বলে, আর যদি প্রমাণিত হয় রীতা ‘লে-হ্যান্ডার’ ছিল?

—তাহলে আবার সব গুলিয়ে যাবে। আমাদের মেনে নিতে হবে ‘আত্মহত্যা’ই সম্ভাব্য সমাধান। আর সেক্ষেত্রে ওই চুরুটের টুকরো আর ঝিনুকের টুকরোটা কী করে দোতলায় উঠে এল এ প্রশ্নটা অমীমাংসিত থেকে যাবে!

কৌশিক তার মামুর দিকে ফিরে বলল, আপনি কী বলেন?

বাসু উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমার মতামত তো আগেই জানিয়েছি। আমাদের হাতে এভিডেন্স যা আছে তা অপ্রতুল। এখন কোনও সিদ্ধান্তেই আসা যাবে না। ইনসাফিশিয়েন্ট ডাটা।

নিখিল বলে, আর নতুন কোনও সূত্র পাওয়া যাবে না, স্যার। যা হাতে এসেছে তাই দিয়েই…

—না হে, আমি ওইভাবে জোড়া-তালি দেওয়া সমাধান মেনে নিতে রাজি নই। চল, সল্ট লেকে আবার যাওয়া যাক। দেখা যাক— শকুন্তলা কী বলে। রীতা কি লে-হ্যান্ডার ছিল?

রানী ধমকে ওঠেন, অত তাড়াহুড়ো করার কী আছে? নিখিল ‘কফি খেতে চাইল না?

-–ও, আয়াম সরি।

বিশে কফির ট্রে নিয়ে ঠিক তখনই ঢুকল ঘরে।