সকল কাঁটা ধন্য করে – ৬

ছয়

সন্ধ্যা ছয়টা-সাড়ে ছয়টার সময় বি.বাদী বাগ থেকে বাগবাজার পর্যন্ত ড্রাইভ করা নিতান্ত বখেড়ার কথা। ছুটির দিন ছাড়া এই দুঃসাহসিক অভিযান যিনি না করেছেন তাঁকে সেকথা বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই, আর যাঁরা সে নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছেন তাঁদের তা বোঝাতে যাবার প্রচেষ্টা বাহুল্য। কিন্তু গাড়ির মাথায় ঘূর্ণমান লাল-বাতির ক্রমাগত ‘অ্যা- ওঁ’-র ব্যবস্থা যার আছে, তার কাছে কুড়ি মিনিটে এ-পথ পাড়ি দেওয়া অসম্ভব নয়। নিখিল বাসু-সাহেবকে এই মটোরাকীর্ণ যানপথের ভিতর দিয়ে নিয়ে আসতে পারল ওই কুড়ি মিনিটেই। একবারেও পিছনের গাড়ির হর্নের তাগাদা অথবা সামনের গাড়ির একজস্ট পাইপের কার্বন-ডায়োক্সাইডে আপ্যায়িত হতে হলো না ওঁদের।

গাড়িতে যেতে যেতে বাসু-সাহেব জানতে চাইলেন, কী বুঝলে? মাইতি-সাহেব কোনও ‘ক্লু’ সরবরাহ করতে পারল?

—তা পারল। আপনার অনুমানই ঠিক। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যোগ থাক বা না থাক—এ মৃত্যু ঘিরে একটা অদৃশ্য শাশ্বত ত্রিকোণ বর্তমান। বেস-এ দুটি নারী—একজন দীর্ঘদিনের বান্ধবী, যাঁকে পছন্দ করেছেন শীর্ষবিন্দুর জননী এবং যিনি প্রাণপাত পরিশ্রম করেছেন পর পর দুবার মাইতির নির্বাচনের সময়। অপরপ্রান্তে একজন অত্যন্ত সুন্দরী যৌবনবতী, যে উড়ে এসে জুড়ে বসে প্রথমজনের অধিকার জবর-দখল করতে চাইছে। ফলে ত্রকোণের শীর্ষবিন্দু একেবারে ভেঙে পড়েছেন! 750 মিলিলিটার একসিটিং-এ কর্পূর!

বাসু বললেন, তা তো বুঝলাম। কালীপূজার রাতে সে কেথায় ছিল? তার নিজের ম্যালেবাইটা কী?

নিখিল একটু অবাক হয়ে বলে, কী বলছেন স্যার! সে সম্ভাবনা আমার মনে আদৌ জাগেনি। লোকটা রীতার মৃত্যুতে একেবারে ভেঙে পড়েছে, অফিসে বসে মদ্যপান করছে—সে কেন নিজে হাতে…

বাসু বাধা দিয়ে বলেন, ওই তোমাদের দোষ নিখিল! তোমরা নিরাসক্ত থাকতে পার না, ট. টি. আই.দের মতো..

–টি. টি. আই? মানে?

—রেলের টিকেট চেকারদের দেখনি? এ. সি. কোচে যদি জজ-সাহেবকে চিনতে পারে তখন সে হাত তুলে নমস্কার করে বলে, ‘ভাল আছেন, স্যার? আপনার টিকিটটা কাইন্ডলি…’। কারণ টিকেট চেকারের ধর্মই হচ্ছে টিকেট দেখে তা পাঞ্চ করবে, অথবা সই করবে। ডিস্ট্রিক্ট জাজ বিনা টিকিটের যাত্রী হতে পারেন কি না,—এসব বাহুল্য প্রশ্ন তার মনে মনেও করার অধিকার নেই। যা হোক, নতুন কথা কী বলল মাইতি?

—শকুন্তলাকে সে পাঁচ-সাত বছর ধরে চেনে। তার জন্যেই শকুন্তলা রায় স্কুলে শিক্ষকতার চাকরিটা পায়। পড়াতে পড়াতে এবং পড়তে-পড়তে এম. এ.-টা পাস করে, ওই মাইতি সাহেবের বদান্যতাতেই। এজন্য মেয়েটি রবিনবাবুর কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। পরিবর্তে রবিনবাবুও মেয়েটির কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ—পর পর দুটি ইলেকশানে সে ওঁর পার্টিকর্মী হিসাবে জানকবুল পরিশ্রম করেছে।

—আর রীতা বিদ্যার্থী? তাকে সে কতদিন ধরে চেনে?

—মাস তিনেক। দু’জনেই দু’জনের প্রেমে আকণ্ঠ মগ্ন ছিল। কথাবার্তা শুনে আমার মনে হলো, মাইতি-সাহেবের তরফে দু-দুটো বাধা ছিল। না হলে ওই সোনালীচুলের সুন্দরী মেয়েটিকে উনি ইতিমধ্যেই বিবাহ করে ফেলতেন। প্রথম বাধা : ওঁর মা। তিনি ইংরেজি অথবা হিন্দি জানেন না। দীর্ঘদিন পুত্রকে বিয়ের জন্য তাগাদা দিচ্ছেন। ঘরোয়া মেয়ে হিসাবে শকুন্তলাকে তাঁর পছন্দ। রীতা বিদ্যার্থীকে সম্ভবত তিনি চোখের দেখাও দেখেননি। চেনেনই না। দেখলে, রূপে মুগ্ধ হলেও তিনি হয়তো রাজি হতেন না—বধূমাতার সঙ্গে বাক্যলাপেরই তো সুযোগ হতো না তাঁর! দ্বিতীয় বাধা : স্বয়ং শকুন্তলা রায়! মাইতি জানে, ওই মেয়েটির চোখে রবিন মাইতি স্বপ্নলোকের রাজপুত্র। তার চোখের সামনে, তারই বাড়ি থেকে রীতাকে ছোঁ-

—মেরে কেড়ে নিয়ে গিয়ে…

—বুঝলাম! আর কোনও ব্লু?

—আজ্ঞে হ্যাঁ! অনিমেষকে সল্ট লেক থানায় ফোন করেছিলাম, লেটেস্ট খবর জানতে। ও খবর দিল : এক—ডক্টর সান্যাল শবব্যবচ্ছেদ শুরু করে দিয়েছেন। মৃতার করোটির ভিতর সীসার গোলকটাকে খুঁজে পাওয়া গেছে। সেটা ঐ পিস্তল থেকেই ছোঁড়া হয়েছিল কি না সেটা এখনি বলা যাচ্ছে না। ডক্টর সান্যাল সীসার বলটা ব্যালাসটিক এক্সপার্টকে হস্তান্তরিত করেছেন। তিনি বর্তমানে কম্পারেটিভ মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা চালাচ্ছেন। রেজাল্ট পাওয়া যায়নি। কাল সকালে রিপোর্ট পাওয়া যাবে। দু’নম্বর : মৃত্যুর সময় সম্বন্ধে কিছু আন্দাজ করা যাচ্ছে না। মেয়েটি উপবাসে ছিল—তার পাকস্থলী বা খাদ্যনালীতে বিশেষ কিছুই পাওয়া যায়নি; যার খাদ্যজীর্ণতার পরিমাণ থেকে মৃত্যু-সময়ের আন্দাজ করা যাবে। তাছাড়া যা সামান্য কিছু ওর পাকস্থলীতে পাওয়া গেছে তা মেয়েটি কখন আহার করেছে তার কোনও হদিস নেই। বাসু বললেন, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত রীতা যে জীবিতা ছিল তার সাক্ষী আছে। কেষ্টার-মা। সে রীতার কাছে অনুমতি নিয়ে বাড়ি গেছে।

—না, স্যার, আমি শুধু মেডিক্যাল এভিডেন্স থেকে বলছি। শবব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যু- সময়ের কোনো সিদ্ধান্ত করা যাচ্ছে না।

—আর কোনও সূত্র?

—হ্যাঁ। আরও দুটো তথ্য সরবরাহ করেছে অনিমেষ। প্রথম কথা : দ্বিতলের ঘরে সেন্টার- টেবিলে যে দগ্ধশেষ চুরুটের স্টাম্পটা পাওয়া গেছে, ওটা মাদ্রাজী-চুরুট। চুরুটটার ব্র্যান্ড নেম ‘জয়রঙ্গম’; তৈরি হয় চিদাম্বরমের একটা ফ্যাক্টারিতে। দ্বিতীয়ত অনিমেষ সামনের ওই মিত্তিরবাড়ির মেজবৌটির জবানবন্দি ইতিমধ্যে সংগ্রহ করেছে। সে ভদ্রমহিলা বলেছেন, মদ্রসাহেবকে তিনি অনেকবার দেখেছেন, আইডেন্টিফিকেশন প্যারেডে নিশ্চয় শনাক্ত করতে পারবেন যদি না আমরা তাঁর যমজ ভাইকে দলে মিশিয়ে দিই। তিনি আরও বলেছেন, পূর্বদিন সন্ধ্যায় ওই দাক্ষিণাত্যের বেঁটে মোটা মানুষটি তাঁর কালো রঙের ফিয়াট গাড়ি চেপে এসেছিলেন। কখন আসেন তা উনি জানেন না, কিন্তু ফিরে যান সন্ধ্যা ছয়টা-সাড়ে ছয়টা নাগাদ। তখন উনি বাইরের রোয়াকে দাঁড়িয়ে কালীপূজার বাজি পোড়ানো দেখছিলেন। কেষ্টার মাও ছিল সেখানে। ওই ভদ্রমহিলার জবানবন্দিতে : মাদ্রাজী লোকটির পরনে ছিল কালো রঙের প্যান্ট, পায়ে চপ্পল, ঊর্ধ্বঙ্গে ফুল শার্টের উপর গ্রে-রঙের সোয়েটার। সামনে- বাড়ির অর্থাৎ শকুন্তলার দ্বিতল বাড়ির সদর দরজা খুলে ঐ মদ্র-সাহেব বার হয়ে আসেন। দুই ধাপ নেমে রাস্তার সমতলে দাঁড়িয়ে হিন্দিতে বলেন, কোট ‘মাস-মাস এ ঝামেলা আমার ভাল লাগে না, তোমারও নিশ্চয় নয়। তাই ও-কথা বলেছিলাম,’ আনকোট। তখন দরজার ওপাশ থেকে কে যেন কী একটা কথা বলে। মদ্র-সাহেব ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে মুখ করে তখন বলে, ‘বেশ তো! তাড়াতাড়ি করার কী আছে? কথাটা ভেবে দেখ, সুবিধা মতো জবাব দিও।’

বাসু বললেন, কেষ্টার-মা যা বলেছিল প্র্যাকটিকালি তাই। ভার্বাটিম এক হতে পারে না। কারণ কেউই কথাটা মুখস্থ করে রাখেনি এবং দুজনেই হিন্দি থেকে নিজ নিজ ভাষাজ্ঞান অনুযায়ী কথাগুলো বাংলায় অনুবাদ করেছে। সে যা হোক, কিন্তু মিত্তিরবাড়ির সেই মেজবৌমা কি রীতাকে দেখতে পেয়েছিল?

—না স্যার। রীতা নাকি দরজার আড়ালে ছিল। তার পরিধানে শাড়ি ছিল না সালোয়ার কামিজ, বা অন্য কোনও পোশাক, তাও বলতে পারেনি। এমন কি দরজার আড়াল থেকে রীতা কী বলেছিল, তা শুনতেও পায়নি।

—সে কি অন্তত এটুকু বলেছে, “কপাটের ওপাশ থেকে মেয়েলী গলায় কে যেন কী একটা কথা বলল?” অর্থাৎ দেখতে না পেলেও, এবং অর্থ না বুঝলেও সে কি স্ত্রীলোককণ্ঠে কিছু বাক্য উচ্চারিত হতে শুনেছে?

—উনি দাবি করছেন, উনি তা শুনেছেন। খুব সম্ভবত রীতার কণ্ঠস্বর, শকুন্তলার নয়। উনি দুজনকেই চেনেন। কিন্তু কথাটাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না। কারণ এটা অপরাধজীবীদের একটা বহুল প্রচলিত কায়দা। সর্বসমক্ষে ঐভাবে পিছন ফিরে অনুপস্থিত কারও সঙ্গে কথা বলা—যাতে পরে প্রমাণ করা যায় যে, কোনো বিশেষ লোক অন্তরালে দাঁড়িয়ে ছিল! তাছাড়া হয়তো কেষ্টার-মায়ের কাছ থেকে উনি শুনেছিলেন, শকুন্তলা ভদ্রেশ্বরে গেছে। ফলে তিনি ধরে নিয়েছিলেন দরজার কপাটের ওপ্রান্তে রীতাই আছে। তৃতীয়ত ঐ মদ্র- সাহেব ‘ভেন্ট্রিলোকুইজম্’ বিদ্যায় পারদর্শী কি না, তাও আমরা জানি না।

—ইয়েস। অসম্ভব নয়। লোকটা পাকা ক্রিমিনাল। অপারেশনে যখন যায় তখন সুবিধামতো নির্জন স্থানে জ্যাক দিয়ে গাড়িটাকে তুলে গাড়ির নম্বর-প্লেট বদলায়—যাতে দূর থেকে যারা দেখে, অথবা চতি গাড়ি থেকে দেখে মনে হয় ও গাড়ির পাঞ্চার হয়ে-যাওয়া চাকা পালটাচ্ছে। তাই পাড়ার লোক আর বেপাড়ার লোক ওর গাড়ির নম্বরটা দু’রকম জানে। তাছাড়া দেখ এক বছরে সে দশ-বারোবার ব্ল্যাকমেইল-এর টাকা আদায় করে গেছে তবু শকুন্তলা জানতে পারেনি : লোকটার কী নাম, কী ঠিকানা, কেন আসে। ‘স্বরক্ষেপণ’-এর ম্যাজিক হয়তো তার এক্তিয়ারে।

নির্দিষ্ট ঠিকানায় ওঁরা এসে পৌঁছালেন। রাত তখন সাতটা। টি.ভি.তে বাঙলায় খবর হচ্ছে। বাড়িটা নতুন। বহুতল বিশিষ্ট। নিচে সার সারি লেটারবক্স। তার ভিতর এস. স্বামীনাথনের নামে কোনও লেটারবক্স নেই। ইতিমধ্যে লিফ্‌টটা বার-দুই উপর-নিচ করেছে। তৃতীয়বার লিফটা ভূতলে নেমে আসার পর লিম্যান এগিয়ে এল। জানতে চাইল : কী নাম খুঁজছেন, স্যার?

—এস. স্বামীনাথন।— নিখিল বললে।

—স্বামীনাথন? ঠিকানা এ বাড়ির?

নিখিল বললে, হ্যাঁ এই মাল্টিস্টোরিড বাড়িরই বাসিন্দা। মাদ্রাজী। বয়স পঞ্চাশ। হাইট পাঁচ তিনের বেশি নয়। মোটা একটা কালো রঙের ফিয়াট গাড়ি আছে…

লিম্যান বাধা দিয়ে বলল, আর বলতে হবে না, স্যার। ঠিকানা ঠিকই আছে, নামটা ভুল হয়েছে। ওঁর নাম স্বামীনাথন নয়—পাণ্ডুরঙ্গ-সাহেব। আসুন, ফিফ্‌থ-ফ্লোর।

বাসু মাথা নাড়েন, না হে! তোমার কোথাও কিছু ভুল হয়েছে—লোকটা আদৌ পাণ্ডুরঙ নয়! কালোজামরঙ!

লিম্যান প্রতিবাদ করতে গিয়ে বেমক্কা হেসে ওঠে। বলে, ঠিকই বলেছেন, স্যার। ‘পাণ্ডুরঙ’ নাম হলেও সাহেব কালোজামের মতোই কালো—আসুন। ওঁর অ্যাপার্টমেন্ট নম্বর হচ্ছে পাঁচের তিন।

ওঁরা লিফটের গর্ভে প্রবেশ করেন। ফিফ্থ্ ফ্লোরে সেটাকে রুখে দিয়ে লিফটম্যান দরজাটা দেখিয়ে দেয়। দরজার পাশে একটা প্লাস্টিকের নেম-প্লেট। নীল জমিতে সাদা হরফ : এল. পাণ্ডুরঙ। পাশে ‘ইন-আউট’ ব্যবস্থা আছে। তাতে নির্দেশ : পাণ্ডুরঙ সাহেব বর্তানে বাড়িতেই আছেন। নিখিল কলবেল বাজাল। সদর দোরের পাল্লাটা দেড়-ইঞ্চি মতো ফাঁক হলো। একজোড়া কৌতূহলী চোখ ও-প্রান্তে দেখা গেল। দরজায় চেন আটকানো। ভিতর থেকে ইংরেজিতে প্রশ্ন হলো : কাকে চাই?

নিখিল ওই দেড় ইঞ্চি ফাঁকের ভিতর দিয়ে বললে, মিস্টার এল, পাণ্ডুরঙ।

—কোথা থেকে আসা হচ্ছে?

—আমার পোশাক দেখে কী মনে হয়? চার্চ থেকে? নাকি মজিদ থেকে?

লোকটা তবু দরজাটা খুলে দিতে আগ্রহ দেখাল না। আবার জানতে চায়, না, মানে হঠাৎ পুলিশ কেন?

নিখিল বলে, আপনি যদি চান তাহলে এই করিডোরে দাঁড়িয়েই আমি চিৎকার করে সেটা ঘোষণা করতে পারি—তাতে আপনার লাভ কিছু হবে না। অহেতুক পাশের ফ্ল্যাট থেকে কিছু কৌতূহলী মানুষ …

কথাটা নিখিলের শেষ হলো না। দরজাটা খুলে গেল। পাণ্ডুরঙ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললে, বুঝেছি, স্যার! বিশ্বাস করুন, আমি লক্ষ্য করে দেখিনি ট্রাফিক সিগন্যালটা বদলে গেছে। পুলিশের হুইসেলও আমি শুনেছিলাম, কিন্তু তখন ব্রেক কষলে পিছনের গাড়ি এসে ধাক্কা মারত। কারণ বাই দ্যাট টাইম আলো সবুজ হয়ে গেছে—

নিখিল বললে, আলোচনাটা আপনার বৈঠকখানা ঘরে বসে করলে ভাল হতো না?

—সরি, স্যার। নিশ্চয়! নিশ্চয়! আসুন, বসুন।

ওঁরা দুজনে ভিতরে গিয়ে বসলেন। ছোট ঘর। আট বাই দশ। মাঝে একটা সেন্টার-টেবিল। একপাশে সেটী, অপরপাশে দুটি সোফা। একান্তে একটি টেবিল। তাতে টেলিফোন। কিছু বই ও টি.ভি.।

নিখিল বললে, মানলাম, কিন্তু আপনি তো একটু দূরে গিয়েও গাড়ি থামাতে পারতেন। আপনি ঝড়ের বেগে গাড়ি চালিয়ে পালিয়ে গেলেন কেন?

—না স্যার, পালাইনি! পালাব কেন? আর পালানোর কোনও উপায় আছে? পুলিশ তো গাড়ির নম্বর টুকেই নিয়েছে। এই তো আপনি সেই সূত্র ধরে এসে হাজির হয়েছেন।

নিখিল বললে, লেট আস প্রসিড সিসটেমেটিক্যালি। আপনার গাড়ির নম্বরটা কত? ঐ কালো ফিয়াট গাড়িটার?

পাণ্ডুরঙ নম্বরটা বলল। নিখিল পকেট থেকে নোটবইটা বার করে লিখল। বলাবাহুল্য, শকুন্তলা রায় প্রদত্ত সাদা অ্যাম্বাসাডার গাড়ির নম্বরের সঙ্গে এটা মিলে গেল না।

নিখিল প্রশ্ন করে : আপনার টেলিফোন নম্বরটা কত?

পাণ্ডুরঙ সাতটা সংখ্যা উচ্চারণ করল।

নিখিল তার নোটবই দেখে নিয়ে বললে, সে কি মশাই? টেলিফোন ডাইরেক্টরি অনুসারে এ নম্বরটা তো মিস্টার এস. স্বামীনাথনের?

মদ্রলোকটা একগাল হাসল। বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ। স্বামীনাথন আমার সম্বন্ধী। মানে আমার ওয়াইফের বড় ভাই। সে-ই এতদিন এই ফ্ল্যাটে থাকত। বছর খানেক আগে বদলি হয়ে যায়। তার ফ্ল্যাটেই আমি আছি; তার টেলিফোনটা ব্যবহারও করছি।

—আই সি!

পাণ্ডুরঙ জানতে চায়, চা বা কফি জাতীয় কিছু খাবেন, স্যার? অথবা কোল্ড ড্রিঙ্কস্?

বাসু-সাহেব প্রতিপ্রশ্ন করেন, বাড়িতে আর কেউ কি আছেন? যিনি চা-কফি বানিয়ে দেবেন? না কি অপনাকেই উঠে গিয়ে বানাতে হবে?

পাণ্ডুরঙ বললে, না স্যার। এ ফ্ল্যাটে আমি একাই থাকি। একজন পার্টটাইম কম্বাইন্ড-হ্যান্ড আছে। তবে চা-কফি আমাকে বানাতে হবে না। লিফটম্যানকে ফ্লাস্কটা ধরিয়ে দিলে সে-ই নিচে থেকে আনিয়ে দেবে। বলব? তিন কাপ কফি?

বাসু বললেন, নো থ্যাংকস্।

নিখিল তৈরি হয়েই এসেছিল। পকেট থেকে সিগ্রেট-কেস আর লাইটার বার করে টেবিলে রাখল। তারপর সিগ্রেটের কেসটা খুলেই আপনমনে বললে, এই য্যাঃ। সব শেষ হয়ে গেছে। শূন্যগর্ভ সিগ্রেট-কেসটা সে বাসু-সাহেবকে দেখিয়ে বলে, আপনার কাছে আছে, স্যার?

বাসু বললেন, আমি কি সিগারেট খাই?

পাণ্ডুরঙ অযাচিত বললে, সিগ্রেট নেই। চুরুট চলবে?

নিখিল বললে, খুব কড়া না হলে চলবে। কী ব্র্যান্ড?

পাণ্ডুরঙ টেবিলের কাছ থেকে দুটি মাদ্রাজী চুরুট নিয়ে এল—’জয়রঙ্গ’ ব্র্যান্ড। মেড ইন চিদাম্বরম্।

নিখিল প্রত্যাখ্যান করল, না! এটা খুব কড়া।

—লিফটম্যানকে দিয়ে সিগারেট আনিয়ে দিই? কী ব্র্যান্ড চলবে, বলুন?

—না, থাক! আপনি বরং আমার প্রশ্নের জবাবগুলো দিন। সল্ট লেকের মিস্ রীতা বিদ্যার্থীর সঙ্গে আপনার কতদিনের আলাপ?

পাণ্ডুরঙের মুখের রঙ বদলালে তা বোঝার উপায় নেই। কিন্তু গম্ভীর হয়ে গেলে তা বোঝা যায়। টেবিল থেকে সে একটা চুরুট তুলে নিয়ে ধরায়। বলে, ও! তাই বলুন! ট্রাফিক-রুল ভায়োলেশনের কেস নয় তাহলে? রীতা বিদ্যার্থীর আত্মহত্যার ব্যাপারে তদন্ত। খুবই দুঃখের ব্যাপারটা! কতই বা বয়স মেয়েটির!

—তাহলে ওকে চিনতেন। ও যে মারা গেছে তা-ও জেনেছেন?

—হ্যাঁ চিনতাম। আজ সন্ধ্যার কাগজে ও আত্মহত্যা করেছে জেনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি, আমি নিজে থেকেই পুলিশে খবর দেব কি না তাই এতক্ষণ ভাবছিলাম।

—কেন?

—কাগজে লিখেছে, আজ ভোরবেলা তার মৃতদেহ সল্ট লেকে করুণাময়ীর কাছে একটা বাড়িতে পাওয়া গেছে। অথচ আজ দুপুরবেলা রীতার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। অবশ্য গলার স্বরটা কেমন যেন সন্দেহজনক। কিন্তু সেটা রীতারই ফোন। কারণ…

—কারণ?

—কারণ যান্ত্রিক গোলযোগে লাইনটা কেটে যায়। আমি রিং-ব্যাক করি। রীতা যে বাড়িতে থাকে সেখানে। ঐ বাড়িতে থাকে—ও আপনারা এতক্ষণে নিশ্চয় সেসব কথা জানেন— পুলিশ-তদন্ত তো হয়েই গেছে—মিস্ শকুন্তলা রায় টেলিফোনটা তোলেন। আমি তাঁকে বলি, রীতা বিদ্যার্থীকে ডেকে দিতে। তিনি অস্বীকার করেন। বলেন, রীতাকে ডেকে দেওয়া যাবে না। দ্যাটস্ মিস্টিরিয়াস্! তাই না? শকুন্তলা দেবী আমাকে একবারও বলেননি যে, রীতা জীবিতা নেই।

—তা বলেননি, কিন্তু শকুন্তলা দেবী আপনার নাম জানতে চেয়েছিলেন, তাও আপনি বলেননি! তাই নয়?

পাণ্ডুরঙ রুখে ওঠে, এটা কি একটা কথা হলো, স্যার? আমি তাঁকে একথাও বলেছিলাম যে, এইমাত্র রীতা দেবী আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন, হঠাৎ যান্ত্রিক গোলযোগে ডিস্কানেক্ট হয়ে যায়। উনি তো সে কথার প্রতিবাদ করবেন! বলবেন না যে, “রীতা পাঁচ মিনিট আগে আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারে না? যেহেতু সে মারা গেছে?”

নিখিল জানতে চায়, রীতা বিদ্যার্থীকে আপনি কতদিন ধরে চেনেন? সে যখন ব্যাঙ্গালোরে স্কুলে পড়ত, তখন থেকে। তাই নয়?

পাণ্ডুরঙ একটু চিন্তা করে বলল, হ্যাঁ, পাঁচ-ছয় বছর ধরে চিনি।

—তার মানে, ও যখন ব্যাঙ্গালোরে সেন্ট থেরেসা স্কুলে পড়ত তখন থেকে, তাই নয় কি?

—হ্যাঁ প্ৰায় তখন থেকেই।

—আবার ‘প্রায়’ কেন মিস্টার পাণ্ডুরঙ? ও যখন ব্যাঙ্গালোরে স্কুলে পড়ত তখন আপনি ও ব্যাঙ্গালোরে থাকতেন। ওকে চিনতেন। রীতা যখন ফ্রক পরে সাইকেল চেপে স্কুলে যেত, তখন আপনি তাকে দেখেছেন। তাই তো?

পাণ্ডুরঙ রুখে ওঠে, সাইকেলে চেপে একটি কিশোরী মেয়ে স্কুলে পড়তে যাচ্ছে এটা চোখ মেলে দেখাতে ফৌজদারির কোনও ধারায় কি কিছু আপত্তি আছে?

—না নেই; কিন্তু সে কথাটা স্বীকার করিয়ে নিতে যদি তিনবার প্রশ্ন করতে হয়, তখন মনে সন্দেহ জাগে না কি : কোথাও-না-কোথাও একটা ফৌজদারি ধারা লঙ্ঘিত হচ্ছে? পাঁচ- ছয় নয়, আপনি ওকে দশ বছর ধরে চেনেন তাই নয়?

পাণ্ডুরঙ জবাব দিল না।

—ওর বাবা-মা, পরিবার-পরিজনদের কাউকে কি চিনতেন?

–না! তবে একথা জানতাম, মেয়েটি ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি ছাত্রাবাসে থাকত।

—সে কী! শকুন্তলা তো বললেন, রীতা হিন্দু!

পাণ্ডুরঙ তার চুরুটে একটি টান দিয়ে বললে, শকুন্তলা দেবী ঠিকই বলেছেন। প্রাপ্তবয়স্কা হবার পর আর্যসমাজীদের প্রভাবে সে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছিল। ঠিক জানি না, শুনেছিলাম, ওর মা ছিলেন হিন্দু, কিন্তু বাবা ছিলেন সাহেব! সেজন্য জন্মসূত্রে ও খ্রিস্টান। পরে স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়ে : হিন্দু।

—আপনি মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন?

—তা যেতাম। ও আমার মাধ্যমে কিছু ইনভেস্টমেন্ট করেছিল। সেই সূত্রে এজেন্ট হিসাবে যেতে হতো। প্রতি মাসেই।

—কালীপূজার রাত্রে, রবিবার, সন্ধ্যা নাগাদ আপনি ওর কাছে গিয়েছিলেন, তাই না? পাণ্ডুরঙ চুরুটে একটি টান দিয়ে একমুখ ধোঁওয়া ছেড়ে বলল, হ্যাঁ, রীতা বিদ্যার্থীর আহ্বানে আমি ওই দিন ওই সময় ওর বাড়িতে গিয়েছিলাম। ইয়েস! দ্যাটস্ এ ফ্যাক্ট! কী বলব মশাই, তখন ওর কথাবার্তা শুনে আদৌ বুঝতে পারিনি যে, রাত না পোহাতে মেয়েটা আত্মহত্যা করবে!

—ওকে কি খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছিল, নার্ভাস লাগছিল?

—তখন অতটা মনে হয়নি, এখন যতই ভাবছি, ততই মনে হচ্ছে। ওর কথাবার্তা, ব্যবহার কেমন যেন স্বাভাবিক ছিল না।

বাসু জানতে চাইলেন, রবিবার সন্ধ্যায় মেয়েটি আপনাকে কেন ডেকে পাঠিয়েছিল? কী আলোচনা করলেন আপনারা?

পাণ্ডুরঙ নিখিলের দিকে ফিরে বললে, আপনার পরিচয় তো আপনার পোশাকেই বোঝা য়ায়। ইনি? প্লেন-ড্রেস কোনও পুলিশ-অফিসার?

নিখিল বললে, না। উনি একজন কোর্ট-অফিসার। মিস্টার পি. কে. বাসু, বার-অ্যাট-ল।

পাণ্ডুরঙ বললে, চেন্নাইতে দেখেছি ক্লায়েন্টরা ব্যারিস্টারের পিছন পিছন ঘোরে। তাঁর চেম্বারে যায়। কলকাতার ব্যারিস্টারেরা ক্লায়েন্টদের চেম্বারে শুভাগমন করে থাকেন বুঝি? এটাই এখানকার রীতি?

নিখিল বলল, না। আপনি আদৌ ওঁর ক্লায়েন্ট নন। ফলে সে প্রশ্ন ওঠে না। উনি এসেছেন আমাকে সাহায্য করতে। কিন্তু ওঁর প্রশ্নটার জবাব আপনি এখনো দেননি।

—তার কারণ, ওঁর প্রশ্নের জবাব দেওয়ার ইচ্ছা আমার নেই; তবে পুলিশের সঙ্গে সৰ্বদাই আমি সহযোগিতা করে থাকি। এখনও করব। আপনি জানতে চাইছেন, তাই জানাচ্ছি : মিস্‌ বিদ্যার্থীর কালীপূজার ছুটি ছিল। উনি আমাকে বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, বিশেষ একটি ‘চিট্‌ ফান্ডে’ মান্থলি ইন্সটলমেন্ট দেবার জন্য।

—তিনি ইনভেস্ট করেছেন? কোন ‘চিট ফান্ডে’?

—লুক হিয়ার, স্যার! রীতা বিদ্যার্থী আমার ক্লায়েন্ট ছিল। সে কোথায় টাকা খাটাতো আমি তা জানতে বাধ্য নই সিভিল পুলিশকে। আপনি এনফোর্সমেন্ট বিভাগের পুলিশ অফিসার নন, ইনকাম ট্যাক্স অফিস থেকেও আসেননি। রীতা বিদ্যার্থীর ওয়ারিশদের স্বার্থে আমি বর্তমান ক্ষেত্রে আপনার প্রশ্নের জবাব দেব না।

—কোন ‘চিট ফান্ডে’ টাকা খাটাতো সেটা না জানালেও আপনি কি এটুকু জানাবেন : মিস্ রীতা বিদ্যার্থী-কি গতকাল আপনাকে কিছু পেমেন্ট করেছিলেন?

—ইয়েস, করেছিলেন। ‘ফাইফ গ্র্যান্ডস্’!

—মানে পাঁচ হাজার টাকা? চেক-এ?

—হ্যাঁ, পাঁচ হাজার টাকাই। না ‘চেক’-এ নয়। নগদে। আপনি চাইলে আমি প্ৰমাণ দিতে পারব। আনকোরা পঞ্চাশ টাকার নম্বরী নোট। তার দু’একটা আপনাকে এখনি দিতে পারি। মিস্ বিদ্যার্থীর বাড়িতে ওই নম্বরী নোটের পরবর্তী নম্বরের নোট হয়তো আপনারা খুঁজে পাবেন।

নিখিল বলে, তার মানে কাল সন্ধ্যায় আপনি রীতা বিদ্যার্থীর বাড়ি গিয়েছিলেন—তারই ইচ্ছানুসারে। কী একটা ‘চিট ফান্ডের’ ইনভেস্টমেন্ট ব্যাপারে। সেসময় মিস্ শকুন্তলা রায় বাড়ি ছিলেন না। আপনি ঘণ্টাখানেক কথাবার্তা বলে চলে আসেন। এই তো?

—হ্যাঁ, ঘণ্টাখানেক অথবা সওয়া ঘণ্টা।

—কটার সময় আপনি ও-বাড়ি ছেড়ে আসেন?

—আমি ঠিক ঘড়ি দেখিনি। আন্দাজ সাড়ে ছয়টায়।

—কোথায় বসে কথা বলছিলেন আপনারা দুজন?

—ন্যাচারালি নিচের বৈঠকখানা ঘরে। একটি অবিবাহিতা মেয়ের শয়নকক্ষে যাবার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি যাইনি ও

নিখিল জানতে চায়, আপনি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর?

—বুঝলাম না! কী বিষয়ে?

—আপনি দ্বিতলে রীতা বিদ্যার্থীর শয়নকক্ষে আদৌ যাননি?

—কী আশ্চর্য! এক কথা কতবার বলব? না, যাইনি। সত্যি কথা বলতে কি, মিস্‌ শকুন্তলার এবং মিস্ রীতার, কার কোনটা শয়নকক্ষ তা আমি জানিই না।

নিখিল ধমকে ওঠে, কথা সেটা নয়। আমি জানতে চাইছি, গতকাল সন্ধ্যাবেলায় আপনি একটু সময়ের জন্যও দ্বিতলে মিস্ বিদ্যার্থীর ঘরে প্রবেশ করেননি। ইজ দ্যাট কারেক্ট?

দ্যাটস্ কারেক্ট! হান্ড্রেড পার্সেন্ট কারেক্ট।

—অলরাইট। এবার বলুন, কাল বিকালে আপনি কোন শার্টটা পরে রীতার সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন?

—সে প্রশ্ন কেন উঠছে?

—আপনি জবাবটা দিন, হেতুটা তখন জানাব।

—একটা স্ট্রাইপড্ লিবার্টি ফুলস্লিভ শার্ট।

—সেটা কি আপনার ওয়ারড্রোবে আছে? না কাচতে দিয়েছেন?

—না, কাচতে দিইনি। দেখতে চান?

—যদি না আপনার আপত্তি থাকে?

—আপত্তি কিসের?—পাণ্ডুরঙ এগিয়ে যায় তার শয়নকক্ষে। হ্যাঙারে ঝোলানো তার ফুলস্লিভ শার্টটা নিয়ে ফিরে এসে বলে, এইটা। কিন্তু এসব কী শুরু করলেন আপনি? কোন জামা? কোন প্যান্ট? কোন জুতো? আপনি কি শার্লক হোমস্? না এয়ার্কুল প্যারো?

নিখিল জবাব দিল না। শার্টটা গ্রহণ করে তার হাতের আস্তিনে কাফ-লিংক দুটো পরীক্ষা করল। যা আশঙ্কা করা গেছে! কাফ-লিংক-দুটি ঝিনুক বোতামের, রূপা দিয়ে বাঁধানো; কিন্তু বাঁ হাতের কাফ-লিংকের ঝিনুক বোতামের অনেকটা ভাঙা।

নিখিল জানতে চায়— এই কাফ-লিংকটা ড্যামেজড্। এর একটা টুকরো ভেঙে গেছে দেখছি। কবে ভেঙেছে?

পাণ্ডুরঙ জামাটা হাতে নিয়ে লক্ষ্য করল। বলল, এতক্ষণ এটা আমার নজরে পড়েনি। আপনি বলতে নজর হলো। কিন্তু…

—আমি যদি বলি, এটা খুলে পড়েছে ওই মিস্ বিদ্যার্থীর বাড়িতেই?

—হতে পারে। কারণ ওটা যে ভেঙে খুলে পড়েছে তা আমার নজরে পড়ল এইমাত্র

—কিন্তু আমি যদি বলি, এটা আমরা খুঁজে পেয়েছি, মিস্ রীতা বিদ্যার্থীর শয়নকক্ষে? যেখানে তার মৃতদেহটা আবিষ্কৃত হয়েছিল?

পাণ্ডুরঙ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। বলে, দ্যাটস্ আ ড্যাম্ড লাই! আমি দোতলাতে আদৌ যাইনি। সামবডি ইজ ট্রাইং টু ফ্রেম মি! হয়তো ও বাড়িতেই আমার কাফ-লিংকটা খোয়া গেছে। তা গেলে সেটা বৈঠকখানায় অথবা বাইরের সিঁড়িতে কিংরা সামনের রাস্তায় পাওয়া যেতে পারে। দোতলায় ওর শয়নকক্ষে নিশ্চয় নয়। কে বলেছে?

নিখিল কাগজের মোড়ক খুলে দেখাল ঝিনুকের টুকরোটা।

পাণ্ডুরঙ থমকে গেল। জানতে চায়, সত্যি? এটা ওই মেয়েটির শয়নকক্ষে— যেখানে সে আত্মহত্যা করেছিল—সেই ঘরে আপনারা খুঁজে পেয়েছন?

—শুধু তাই নয়, মিস্টার পাণ্ডুরঙ; দোতলার ঘরে একটা অ্যাশট্রেতে পাওয়া গেছে একটা সিগারের দগ্ধাবশেষ স্টাম্প! আর সেটা চিদাম্বরমে তৈরি একটা স্পেশাল ব্র্যান্ড চুরুট ‘জয়রঙ্গ’। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন? সে চুরুট থেকে কে ধূমপান করেছে? রীতা বিদ্যার্থী? না শকুন্তলা রায়?

পাণ্ডুরঙ কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, দিস্ ইজ প্রিপস্ট্রাস, অফিসার। আমি স্বীকার করছি, কাল সন্ধ্যাবেলায় রীতার বাড়িতে গেছিলাম। তার সঙ্গে কথাবার্তা বলেছি। চুরুট খেয়েছি—কিন্তু একতলার ঘরে। দোতলায় আমি আদৌ যাইনি। ইন ফ্যাক্ট, আমি আজও জানি না—কোন ঘরটায় ওদের মধ্যে কে শোয়। আই মীন দোতলার ওই ঘরটায় দুই বান্ধবীর মধ্যে কে শয়ন করে। বিশ্বাস করুন! হ্যাঁ, আমি স্বীকার করছি রীতা বিদ্যার্থী গতকাল সন্ধ্যায় আমাকে নগদে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল—কিন্তু সে তো ‘চিট্‌ ফান্ড’-এর মান্থলি ইন্সটলমেন্ট! ওর দেওয়া নোট আমার আলমারি সার্চ করলে এখনো পাবেন—সব পঞ্চাশ টাকার! বাট্- বাট্…ওর মৃত্যুর কথা আমি প্রথম জেনেছি আজ সান্ধ্য এডিশন খবরের কাগজ পড়ে।

নিখিল বললে, সেটা আদালতে প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন। পাবলিক প্রসিকিউটারের ওইসব প্রশ্নের বিশ্বাসযোগ্য জবাব দেবার চেষ্টা করবেন—কীভাবে আপনার জামার কাফ- লিংক একতলা থেকে দোতলায় চলে গেল, কীভাবে চুরুটের স্টাম্পটা রীতার শয়নকক্ষে আবিষ্কৃত হলো, কীভাবে আপনার গাড়ির নম্বারটা—আমি ওই কালো ফিয়াট গাড়িটার কথা বলছি—বহুরূপীর মতো রঙ বদলাতে পারে…

—গাড়ি রঙ বদলাতে পারে! এ কথার মানে?

—গোটা গাড়িটা নয়। নম্বারপ্লেটটা। সল্ট লেকের করুণাময়ী অঞ্চলে, মানে ওই আট নম্বর ট্যাঙ্কের কাছাকাছি লোকেরা গাড়িটার যে নম্বর বলেছে সে নম্বরপ্লেট এখন কেন আপনার গাড়িতে লাগানো নেই—এইসব প্রশ্নের!

—বিলীভ মি, স্যার! কেউ আমাকে ফাঁদে ফেলবার চেষ্টা করতে এসব এভিডেন্স সাজিয়ে বলেছে! গাড়ির নম্বর আমি পালটাতে যাব কেন? আমি অনেস্ট-ব্রোকার-

—তাই ‘অ্যাকাউন্ট-পেয়ী চেক’-এর বদলে ক্লায়েন্ট-এর কাছ থেকে মাস-মাস নগদ টাকা আদায় করেন, তাই নয়?

—স্যার! পোস্টমার্টাম-এ নিশ্চয় জানা যাবে—রীতা মারা গেছে মধ্যরাত্রে, বা পরদিন ভোরবেলায়! অথচ আমি ওর সঙ্গে যখন দেখা করি তখন সন্ধ্যা ছয়টা, সাড়ে ছয়টা। আমি যখন ও-বাড়ি ছেড়ে চলে আসি তখন সে সুস্থ-সবল ছিল। সে আমাকে সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। দরজা খুলে আমি বাইরে বেরিয়ে আসি। তখনো সামনের বাড়ির রোয়াকে দু’তিনজন বসেছিল। তাদের ভিতর একজনকে আমি চিনি—সে রীতার মেইড-সার্ভেন্ট। সে নিশ্চয় সাক্ষ্য দেবে যে, আমাকে চলে যেতে দেখেছে এবং তখনো রীতা বিদ্যার্থী জীবিতা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের কী কথা হয়—হয়তো তাও সে বলতে পারবে—

বাধা দিয়ে নিখিল বলে, কী কথা হয়েছিল আপনাদের?

—আমার যদ্দূর মনে পড়ে আমি হিন্দিতে বলেছিলাম “প্রতিমাসে এভাবে তোমার কাছে চিট ফান্ডের টাকা কালেক্ট করতে আসা আমার পোষাবে না—তুমি আমার কথাটা ভেবে দেখ।” জবাবে ও বলল, “তাতে আমার অসুবিধা আছে।” তখন আমি বললাম, “বেশ তো, পরে ভেবে-চিন্তে স্থির করে আমাকে জানিও।”

—রীতার কাছে আপনার প্রস্তাবটা কী ছিল?

—মাস-মাস ইন্সটলমেন্ট দেবার বদলে ত্রৈমাসিক পেমেন্ট করা। ও তাতে রাজি হচ্ছিল না। বলছিল টাকা ওর খরচ হয়ে যায়। এজন্য মাসের প্রথম সপ্তাহেই…

নিখিল বাধা দিয়ে—আপনি চিট ফান্ডের কাগজপত্র বার করুন তো। অরিজিনাল সার্টিফিকেট এবং অন্যান্য কাগজপত্র

লোকটা তৎক্ষণাৎ বললে, অরিজিনাল সার্টিফিকেট কি এজেন্টের হেপাজতে থাকে? সে তো পার্টির কাছে। মানে রীতার কাছে—

—কিন্তু তার স্টিল-আলমারিতে তন্ন তন্ন করে দেখেও আমরা তো তা খুঁজে পাইনি?

—সেটাও কি আমার অপরাধ? হয়তো ওর ব্যাঙ্ক-ভল্টে আছে, অথবা অফিসের আলমারিতে—

—কিন্তু ওর অ্যাপ্লিকেশন, ওর কোনো চিঠি বা ফাইল?

—সরি স্যার! সে-সব রাখা আছে চেন্নাইয়ের হেড-অফিসে। আমি তো এজেন্ট মাত্ৰ।

–বুঝলাম। কিন্তু রাত্রে যে আপনি দ্বিতীয়বার ফিরে আসেননি তার কী প্রমাণ?

—কালীপূজোর রাত্রে আমরা সাত-আটজন মধ্যরাত্রি পর্যন্ত তাস খেলেছিলাম—

—অর্থাৎ জুয়া?

–কেন এসব কথা আমাকে দিয়ে কবুল করাচ্ছেন?

–এবং মদ্যপান?

—যদি করেই থাকি তাহলে ‘মার্ডার-চার্জ’ কি আমার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, স্যার?

নিখিল বলে, শুনুন মশাই! আপনার ওই সাত-আটজন অনারেল সাক্ষীর মাধ্যমে অ্যালেবাঈ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে হবে না। তাতে কোনো লাভ নেই। আমাদের বক্তব্য : আপনি সন্ধ্যাবেলায় যখন ও বাড়ি ছেড়ে যান, তখন রীতা বিদ্যার্থী তার শয়নকক্ষে মরে পড়ে আছে। মৃত্যুর আগে সে ‘রেপড’ হয়েছিল কিনা তা এখনি বলতে পারছি না—পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা হাতে পাইনি। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, সে আপনাকে দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়নি। কেউ তাকে দেখেনি

—কেউ দেখেনি? কেউ শোনেনি? ঐ মেডসার্ভেন্টটি এবং তার পাশে যে ম্যারেড ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা আমাদের কথা বলতে দেখেননি, শোনেননি?

—না! তাঁরা শুধু একতরফা আপনাকেই দেখেছেন, আপনার কথাই শুনেছেন। এমনকি কায়দা করে আপনি পিছন ফিরে এমনভাবে কথা বলেছেন যে, স্বতই মনে হয় কপাটের আড়ালে কেউ একজন শ্রোতা আছে। কিন্তু রাস্তার ও পাশ থেকে ওঁদের দুজনের কেউই রীতাকে দেখতে পাননি বা কথা শুনতে পাননি।

—মাই গড! এরা সবাই মিলে আমাকে ফাঁসাতে…

বাধা দিয়ে নিখিল বলে, আপনি তৈরি হয়ে নিন মিস্টার পান্ডুরঙ। আমার সঙ্গে আপনাকে একবার লালবাজারে আসতে হবে।

—আপনি…আপনি…আমাকে অ্যারেস্ট করছেন?

—না! আপাতত ভদ্রভাষায় এটাকে বলা যায়—”বিস্তারিত তথ্যানুসন্ধানের জন্য আটকে রাখা।’

—মাই গড!

বাসু-সাহেব অনেকক্ষণ কোনো কথা বলেননি। এবার বললেন—লুক হিয়ার মিস্টার পান্ডুরঙ। কলকাতা শহরে আপনার পরিচিত কোনও ক্রিমিনাল ল-ইয়ারের বাড়ির টেলিফোন নম্বর জানা আছে কি? থাকলে এই মওকায় তাঁকে একটা ফোন করে রাখতে পারেন। আমার মনে হয়, আপনার বিরুদ্ধে পুলিশ ‘মার্ডার-চার্জ’ আনতে পারে। সলিসিটারের অনুপস্থিতিতে কোনো কথা না বলার সাংবিধানিক অধিকার আপনার আছে।

পান্ডুরঙ বিহ্বলের মতো বললে, থ্যাঙ্কু, স্যার!