সকল কাঁটা ধন্য করে – ৫

পাঁচ

মধ্যাহ্ন আহারের পর বাসু-সাহেব কৌশিককে বললেন, তুমি এবার বাড়ি ফিরে যাও। আমি একটু বিশ্রাম নেব। তারপর নিখিল আমাকে ওল্ড-কোর্ট হাইস স্ট্রিটে নিয়ে যাবে।

নিখিল জানতে চায়, আপনি যাবেন, স্যার, ওই এম.এল.এ. অ্যাডভোকেটের চেম্বারে?

বাসু বললেন, না, নিখিল। সেটা সৌজন্যে মানা। ওই হাঁটুর বয়সী অ্যাডভোকেটের চেম্বারে আমি কেন আনইনভাইটেড যাব? তুমি আমাকে আমার চেম্বারেই নামিয়ে দিও। ওখানে আমার একটি সাবেকি ইজিচেয়ার আছে। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। রে-সাহেবের জুনিয়ার হিসাবে যখন কাজ করতাম তখন রে-সাহেব ওই ইজিচেয়ারে অর্ধশয়ান অবস্থায় ডিকটেশন দিতেন।

নিখিল বলে, আমি জানি, স্যার।

—ওই ইজিচেয়ারে আমাকে বিশ্রাম করতে দিয়ে তুমি ঠিক পাঁচটায় অ্যাডভোকেট মাইতির চেম্বারে যেও। তার ইন্টারভিয়ু নিয়ে আমার চেম্বারে ফির এস, আমাকে পিক্‌-আপ করতে।

কৌশিক বলে, তার মানে আপনি আজই শুনতে চান মিস্টার মাইতির বক্তব্যটা?

—না হে! অন্য কারণ আছে! তারপর আমরা দুজন—আমি আর নিখিল—যাব বাগবাজারে। সন্ধ্যার ঝোঁকে কিছু সাধু-সন্তের সন্ধানে। কীর্তিটা যদি তারই হয় তবে হয়তো সে ফেরার হয়ে যেতে পারে। অবশ্য সে এখনো জানে না যে, পুলিস তার ঠিকানা জেনে গেছে। তুমি তোমার মামিমাকে বলে দিও, আন্দাজ রাত নয়টার মধ্যে আমি ফিরব।

কৌশিক জানতে চায়, তার মানে, রাত্রে বাড়িতেই খাচ্ছেন তো?

—যদি না তোমার মামিমা মুখের সামনে নৈশাহার হিসাবে এক বাড়ি সাবুর পায়েস ধরে দেন।

.

কৌশিক নিউ আলিপুরের দিকে রওনা হয়ে গেল। নিখিল বাসু-সাহেবকে তাঁর চেম্বারে পৌঁছে দিল। তাঁর অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে জুনিয়াররা খুশি হয় ওঠে। বাসু তাঁর উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ-করা ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে সকলের তত্ত্ব-তালাশ নিতে থাকেন।

নিখিল যখন ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটে মাইতি-সাহেবের চেম্বারে গিয়ে পৌঁছালো তখনো পাঁচটা বাজতে আট-দশ মিনিট বাকি। এটি একটি ত্রিতল মোকাম। শতখানেক বছর বয়স হবে হয়তো। দু’তিনটি অথবা দু’একটি ঘর দখল করে এক-একজন আইনজীবীর চেম্বার। কারও বা এককামরার আস্তানা। এমন কি কিছু লোকের খুপরি এত ছোট যে, একসঙ্গে তিনজন লোক বসার জায়গা হয় না! ওই খুপরি ঘরের দখল পেতে হলে অন্তত লাখ-টাকা সেলামী দিতে হবে!

মাইতি-সাহেবের দখলে তিনটি কামরা। রবিন মাইতির পিতৃদেবও ছিলেন নামকরা অ্যাডভোকেট—ইনকাম ট্যাক্স আর সেলট্যাক্সের কেসই বেশি করতেন তিনি। তাঁর পরলোকগমনের পর রবিন মাইতি উত্তরাধিকারসূত্রে ঘর তিনখানির দখল পেয়েছে. রবিনের স্পেশালিটি বাড়িভাড়া সংক্রান্ত মামলা,—মালিক বনাম ভাড়াটে। অর্থাৎ ভাড়াটে উচ্ছেদের মামলা। অথবা বাড়িওয়ালাকে নাস্তানাবুদ করার

আদালতের ছুটি হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। পাড়াটা ক্রমে ক্রমে ফাঁকা হতে শুরু করেছে। নিখিল নিজেই ড্রাইভ করে এসেছে। গাড়িটা পার্ক করে সে এগিয়ে গেল ত্রিতল বাড়িটার দিকে। মাইতি-সাহেবের চেম্বারের সামনে একজন চাপরাশি-জাতীয় লোক হঠাৎ এগিয়ে এসে বলল, সাহেবের শরীর খারাপ। আজ আর কারও সঙ্গে দেখা করবেন না।

—’সাহেব’ মানে মিস্টার রবিন মাইতি, অ্যাডভোকেটের কথা বলছ তো? তিনি কি চেম্বারে আছেন?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, স্যার। আছেন। তবে শরীর খারাপ, তাই…

হঠাৎ তাকে সরিয়ে একজন বৃদ্ধ ল-ক্লার্ক এগিয়ে এসে নিখিলকে বিনম্র নমস্কার করেন। জোড়হস্তেই বলেন, আসুন। আসুন স্যার, বসুন এই চেয়ারটায়।

তারপর চাপরাশিটার দিকে ফিরে ধমক দেন, কাকে কী বলছিস্, কানাই? তোর কি কোনোদিন কাণ্ডজ্ঞান হবে না?

আবার নিখিলের দিকে ফিরে বলেন, আমার নাম মহেন্দ্রলাল জানা, স্যার। আমি ছোট- সাহেবের ল-ক্লার্ক। আমি জানি, আপনার আসার কথা আছে। পাঁচটার সময়। অ্যাপয়েন্টমেন্ট প্যাডে আমিই লিখে রেখেছি। কিন্তু মুশকিল হয়েছে কি, ছোট-সাহেবের শরীরটা একেবারে হঠাৎ…

বাধা দিয়ে নিখিল বলে, ‘ছোট-সাহেব’ মানে রবিনবাবু তো? তাহলে বড়-সাহেবটি কে?

—আমি স্যার, দু’পুরুষের গোলামী করছি। রবিনবাবুর বাবার আমল থেকে। তাই ওঁকে…

—বুঝেছি। তা আপনার ছোট-সাহেবের হয়েছেটা কী? ডাক্তার ডেকেছেন?

মহেন্দ্রবাবু রীতিমতো কুণ্ঠিত হয়ে বললেন, কী ভাষায় আপনার কাছে মার্জনা চাইব জানি না—আমার বেয়াল্লিশ বছরের চাকরি, স্যার। এই একই চেম্বারে—দু’ পুরুষের গোলামী আমার! কিন্তু আজ যে কাণ্ডটা হয়েছে তা আমার জীবনে ইতিপূর্বে কখনো হয়নি। নেভার!

—কিন্তু হয়েছেটা কী?

—আপনি স্যার, এই ঘরে এসে বসুন। কথাটা একটু ইয়ে জাতীয়। গোপন….

জনান্তিকে সরিয়ে এনে মহেন্দ্রবাবু বললেন, ছোট-সাহেব এক্কেরে বে-এক্তিয়ার। ইতিপূর্বে চেম্বারে তিনি কোনোদিন ড্রিংক করেননি, কিন্তু আজ…কি জানি কেন…সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করে দেবার ফর্মান জারি করে দিয়েছেন!

—ও! বুঝলাম! চেম্বারে বসে মদ্যপান করছেন। একা? না কি বান্ধবী-টান্ধবীও আছে?

মহেন্দ্ৰবাবু দু’হাতে নিজের কান চাপা দিলেন।

নিখিল বললে, ঠিক আছে। আমি ফিরে যাচ্ছি। শুনুন : ওঁর খোঁয়াড় ভাঙলে ওঁকে বলবেন—হ্যাঁ, আমি বলে গেছি বলে আপনি তাঁকে জানাতে বাধ্য হচ্ছেন : নেশা ভাঙলে মিস্টার মাইতি যেন তাঁর ডায়েরিতে লিখে রাখেন—এক : বিধানকক্ষের বাইরে তিনি ভারতীয় নাগরিক মাত্র! প্রয়োজনে আমি তাঁর মাজায় দড়ি পরাতে পারি। দুই : আদালত থেকে যেদিন সাক্ষী দেবার সমন পাবেন সেদিন মদ্যপান করলে তাঁর ‘বার’ লাইসেন্স বাতিল হয়ে যেতে পরে। তিন :…

মহেন্দ্রেবাবু বললেন, ব্যস! ব্যস! আর দরকার নেই স্যার! আপনি বসুন! আমি আমার ডিউটিটা করি। আপনি এসেছেন—সময় মতোই এসেছেন—এ খবরটা তাঁকে দিয়ে আসি। তারপর তিনি যা করবেন তার জিম্মাদারী আমার নয়।

নিখিল বলল, ঠিক কথা! যান! ওঁকে বলুন আমি এসেছি! মাথায় ঢোকে ভাল, না ঢোকে তাও ভাল। তারপর নেশার ঝোঁকে তিনি যা করবেন, তার জিম্মাদারী আপনার নয়!

মহেন্দ্রবাবু ঊনবিংশতি শতাব্দীর বাবু-কালচারের ভঙ্গিতে ‘যে-আজ্ঞে’ বলে নব ঘুরিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন।

নিখিলেশের হাতঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাটা পুরো একটা পাক মারার সময় পেল না। তার আগেই দ্রাম করে খুলে গেল দরজাটা। বার হয়ে এলেন রবিন মাইতি। বছর চল্লিশ বয়স। সুন্দর সুঠাম চেহারা। গলার টাইটা শুধু আলগা করা—পা কিন্তু টলছে না। চুলও সুবিন্যস্ত। দুটি হাত জোড় করে বলেন, ছি, ছি, ছি! আপনাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে এরা? আয়াম সো সরি। এদের হয়ে মার্জনা চাইছি আমি। আপনি ভিতরে আসুন, মিস্টার দাশ।

ববিন মাইতি তার স্টাফ্‌ড রিভলভিং চেয়ারে গিয়ে বসল। তার টেবিলের উপর হোয়াইট হর্স হুইস্কির বড় বোতল, গ্লাস ও বরফ। নিখিলও বসল টেবিলের এপাশে ভিজিটার্স চেয়ারে। নিখিল বললে, মহেন্দ্রবাবু বলছিলেন, আপনি অসুস্থ। অসুস্থতা তো যে কোনো লোকের যে কোনও সময়েই হতে পারে। সুতরাং মার্জনা চাওয়ার কিছু নেই, মিস্টার মাইতি। আমি না হয় পরে আর একদিন আসব, ধরুন কাল।

মাইতি দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে বললেন, আমি যে অসুস্থ নই, তা তো স্বচক্ষেই দেখছেন। সকালে খবরটা শুনেই আমি প্রচণ্ড শক্ড হই। ঠিক মনে নেই, কী কী কথোপকথন হয়েছিল, আপনাতে-আমাতে—কিন্তু আমি বোধহয় ঠিক ভদ্রজনোচিত কথাবার্তা বলিনি। ওই একই কারণে। আমার মাথার ঠিক ছিল না খবরটা শুনে। রীতা কেন..কেন হঠাৎ আত্মহত্যা করে বসল?

নিখিল বলে, সেই রহস্যের সমাধান প্রচেষ্টাতেই তো আমার এই অভিযান। কিন্তু আপনি যখন…

—না, না, না, মিস্টার দাশ! আমি প্রস্তুত। আপনি যা জানতে চান তা অকপটে জানতে চাইতে পারেন। আই ওয়ান্ট টু নো, রীতাকে কেন…

নিখিল পকেট থেকে ছোট্ট একটি টেপ-রেকর্ডার বার করে টেবিলে রেখে বলল, সেক্ষেত্রে আমি কিন্তু আমাদের কথাবার্তা টেপ করে রাখব।

—য়ু থিংক আয়াম টিপ্‌সি?

নিখিল জবাব দিল না। সুইচ টিপে জাপানি টেপ-রেকর্ডারটা চালু করে দেয়। স্পষ্ট উচ্চারণে বলে, মিস্টার মাইতি, আজ চোদ্দই নভেম্বর, সোমবার, আপনি বিকাল পাঁচটায় আপনার চেম্বারে আমার সঙ্গে রীতা বিদ্যার্থীর মৃত্যু-বিষয়ে আলোচনা করতে রাজি হয়েছিলেন; কিন্তু শুনলাম আপনার শরীর ভাল নয়। তা সত্ত্বেও আপনি কি আলোচনাটা চালিয়ে যেতে চান?

মাইতি হাসলেন, বললেন, বি ইট রেকর্ডেড, আমি সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায়, স্বেচ্ছায় আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করছি। অথবা বলতে পারেন, আমার জবানবন্দি দিচ্ছি!

নিখিল জানতে চায়, আপনি এইমাত্র বলছিলেন, আপনি প্রচণ্ড শক্ড হয়েছেন, মিস্ বিদ্যার্থীর মৃত্যুতে। কিন্তু কেন? তিনি আপনার আত্মীয় নন, ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন কি?

মাইতি টেপ-রেকর্ডার যন্ত্রটা দেখিয়ে বললেন, ওটা চালু থাকলে আমি যে জবাবটা দেব তা ‘নাথিং বাট দ্য ট্রুথ’ হবে না, মিস্টার দাশ! সেটা রাখা-ঢাকা ‘ডাইলিউটেড ট্রুথ’ হবে।

নিখিল তৎক্ষণাৎ যন্ত্রটা সুইচ-অফ করে পকেটে পুরল। বলল, না। আমি খোলামেলা আলোচনা করতেই এসেছি। আপনাকে জড়াতে নয়। শুধু জানতে এসেছি। বলুন, আপনি এতটা শক্ড হলেন কেন?

—বিকজ আই লাভড্ হার। নিজের হাতে নিজেকে হত্যা না করলে আমি তাকে জীবনসঙ্গিনী করতাম!

নিখিল অবাক হয়ে গেল মদ্যপটার দৃঢ়তায়। জানতে চায়, কতদিন ধরে তাকে চিনতেন?

–ধরুন তিন মাস!

—এ তিন মাসে কতবার আপনাদের দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে?

—তিন মাসে বারো-তেরোটা সপ্তাহ। আন্দাজ সপ্তাহে দু’বার ধরে বার পঁচিশ।

—তাকে প্রথম কোথায় দেখেন?

—তার কর্মস্থলে। আমি ওদের কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। রিসেপশানিস্ট হিসাবে সেখানে ওকে প্রথম দেখি। এম. ডি. একটা মিটিঙে ছিলেন। ফলে আমাকে রিসেপশনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। প্রায় পনের মিনিট। তখন ওর সঙ্গে আলাপ হয়। ওর রূপে, ওর ব্যবহারে, ওর মোহিনী চৌম্বকবৃত্তিতে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই! ওই পনের মিনিটের মধ্যেই আমি ওর প্রেমে পড়ে যাই, মিস্টার দাশ! ও তখনও আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল কিনা, জানি না।

নিখিল বলে, কীভাবে আলাপটা শুরু হয়, মনে আছে আপনার?

ম্লান হাসল মাইতি। বলল, আর একটা গ্লাস আনতে বলব? কম্পানি দেবেন আমাকে?

নিখিল সংক্ষেপে বলল, নো থ্যাংক্‌স্!

—আপনি ড্রিঙ্ক করেন না আদৌ?

–করি। য়ুনিফর্ম পরে নয়। ডিউটি আওয়ার্সে নয়!

-–ও আয়াম সরি।

টঙে করে একটা আইস-কিউব তুলে নিয়ে গ্লাসে দিলেন। এক সিপ্ পানীয় মুখে টেনে নিয়ে বললেন, কী যেন প্রশ্ন করলেন? হ্যাঁ, হাউ আই স্টার্টেড টু ফল সো ডীপ ইন লাভ্!

এবার সে ড্রয়ার থেকে বার করল ইন্ডিয়া কিঙের ডবল্ প্যাকেট, আর লাইটার। একটা স্টিক্ বার করে ঠোঁটে চেপে লাইটার দিয়ে ধরালো। তারপর বললে, ডিউটি আওয়ার্সে স্মোকও করেন না, না কি?

নিখিল জবাব দিল না। একটা সিগ্রেট নিয়ে ঠোঁটে চেপে ধরতেই রবিন মাইতি লাইটার বাড়িয়ে সেটা জ্বালিয়ে দিল।

তারপর বদ্ধ ঘরের ভিতর সিগারেটের রিঙ পাকাতে পাকাতে সে ফিরে গেল তার প্রথম সাক্ষাতের দিনটাতে। স্মৃতির সরণী বেয়ে সেই শীতাতপ-তথা-ধূম্র-নিয়ন্ত্রিত রিসেপশান কাউন্টারে।

ঘরে আর কেউ ছিল না। টীক-প্যানেলিং-করা ঘেরাটোপ কাউন্টারে বন্দিনী নারীর মতো বসে ছিল রীতা বিদ্যার্থী। তার পরনে ময়ূরকণ্ঠী রঙের একটা কাঞ্জিভরম শাড়ি। লাল চওড়া পাড়। ওই রানী-কালার রঙেরই আঁটো জ্যাকেট। পিছনে বোতাম। নীবিবন্ধের অনেকটাই অনাধৃত। হাতির দাঁতের মতো দুটি শুভ্র বাহু। বকাট চুল। কপালে ছোট্ট একটা রানী-কালার টিপ্। অদূরে বসে আছে রবিন মাইতি। থ্রি-পিস্ স্যুট। হাতে সিগ্রেট।

মেয়েটি বললে, আয়াম সরি, স্যার। মনে হয় মিনিট পনের অপেক্ষা করতে হবে আপনাকে।

মাইতি বলেছিল, আই ডোন্ট মাইন্ড। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, ড্যাম্প ওয়েদার। এখানে তো ভালই বসে আছি আমি। আমার হাতে সময়ও আছে।

মেয়েটি বললে, ও-পাশের টেবিলে কিছু ম্যাগাজিন আছে। উল্টোপাল্টে দেখতে দেখতে সময় কাটাতে পারেন।

মাইতি বলেছিল, ও তো দেখছি ফিলম্-ফেয়ার, ডেবনেয়ার, আর স্টারডাস্ট! শুধু সুন্দরী মেয়েদের ছবি!

মেয়েটি চোখ বড় বড় করে বললে, কী আশ্চর্য! সুন্দরী মেয়ের ছবি দেখতে আপনার ভাল লাগে না? দেখেন না?

—ভাল লাগে। দেখিও। যখন ত্রিসীমানায় সুদৃশ্য নয়নাভিরাম কিছু থাকে না।

মেয়েটি হাসল। মাইতির নজর হলো হাসলে ওর গালে সুন্দর টোল পড়ে। কথাবার্তা হচ্ছিল ইংরেজিতে। মাইতি বলে, আমার নাম তুমি জান, আমি কিন্তু তোমার নামটা…

—রীতা বিদ্যার্থী।

—তুমি কেরালার মানুষ, তাই না?

—না, স্যার, আমি কর্ণাটকের মেয়ে। —ক্রিশ্চিয়ান?

—বাই নো মীনস্। আমি হিন্দু

—আমি তোমাকে কী বলে ডাকব? মিস্ বিদ্যার্থী, না মিসেস্ বিদ্যার্থী?

—ডাকাডাকির কি সুযোগ কিছু পাবেন? এখনি তো আপনার নিজের ডাক আসবে বড়-সাহেবের ঘর থেকে।

—তবু?

—আপনি আমাকে ‘রীতা’ বলেই ডাকতে পারেন। বয়সে যখন আপনি বড়!

মাইতি বুঝতে পারে, রীতা বিদ্যার্থী কৌশলে এড়িয়ে গেল প্রশ্নটা। জানতে চায়, কলকাতার কোন্ অঞ্চলে থাক তুমি?

—লবণ হ্রদ এলাকায়।

—তবে তো তুমি আমার এলাকার লোক?

—আপনিও সল্ট লেখে থাকেন বুঝি?

—না! তবে সল্ট লেক আমার কন্সটিটুয়েন্সিতে পড়ে।

—কন্সটিটুয়েন্সি?

—আমি অ্যাসেম্লিতে আছি। বাই প্রফেশন অ্যাডভোকেট। সল্ট লেকের কোন দিকটায় থাক তুমি?

—আট নম্বর ওভারহেড ট্যাঙ্কের কাছাকাছি।

—তাই নাকি! করুণাময়ীতে? ওখানে আমার এক বান্ধবীও থাকে। তাকে চেন? শকুন্তলা রায়? তোমাদের পাড়ারই মেয়ে।

রীতা বিদ্যার্থী খিলখিল করে হেসে উঠে বলেছিল, শকুন্তলা আপনার বান্ধবী? কেমনতর বান্ধবী? গত এক বছরের ভিতর তো সেই বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে যাননি আপনি একবারও!

—তুমি কেমন করে জানলে?

—যেহেতু ওই একই বাড়িতে আমি থাকি। কুন্তলা আমারও বান্ধবী। আমার ক্লাস-মেট! বর্তমানে আমার রুমমেট!

মাইতি আরও ঘনিষ্ঠ আলাপ জমাবার অবকাশ পায়নি। কারণ তখনই ভিতরের মিটিঙটা শেষ হলো। ভিতর থেকে একজন উর্দিধারী পিওন এসে ওকে বললে, আপনাকে বড়-সাহেব সেলাম দিয়েছেন।

মাইতি উঠে দাঁড়ায়। জানতে চায়, আমি মিটিঙ সেরে ফিরে আসা পর্যন্ত তুমি কি ডিউটিতে থাকবে, রীতা?

—ডিপেন্ডস্! আপনার মিটিং কতক্ষণ ধরে চলবে তা তো আমি জানি না।

সেই ওদের প্রথম আলাপ।

মাইতি তার প্রথম সাক্ষাতের বর্ণনা শেষ করে গ্লাসে আবার একটা চুমুক দিল। নিখিল বলে, বুঝলাম। তারপর নিশ্চয় সল্ট লেকের দিক থেকে একটা চৌম্বক আকর্ষণ অনুভব করতে থাকেন। সপ্তাহে গড়ে দু’বার সেই আট নম্বর ট্যাঙ্কের…

বাধা দিয়ে মাইতি বলে, নো, স্যার! য়ু আর রং দেয়ার! বিদ্যার্থীর বাড়িতে যাওয়ায় বাধা ছিল। টেলিফোন করারও। আমি সময় পেলে অফিস ছুটির পর ওর সঙ্গে অফিসেই দেখা করতাম। অফিসেই ফোনে কথাবার্তা হতো। ফেরার পথে কখনো আমরা সিনেমা দেখেছি, কখনো রেস্তোরাঁয় নৈশ আহারও সেরেছি।

—ওর বাড়িতে যাওয়ার বাধাটা কী ছিল?

মাইতি একদৃষ্টে তার গ্লাসের দিকে তাকিয়ে থাকল। জবাব দিল না।

নিখিল জানতে চায়, আর মিস্ শকুন্তলা রায়ের সঙ্গে আপনার কতদিনের আলাপ? কীভাবে আলাপটা হয়েছিল?

মাইতি আবার একটা সিপ্ দিয়ে বললে, য়ু আর ভেরি শার্প, মিস্টার দাশ। ঠিকই বুঝেছেন। রীতার বাড়িতে যাওয়ার সেটাই ছিল বাধা।

—এটা কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব নয়!

—না। আপনার পূর্ববর্তী অজবাবিত প্রশ্নের জবাব। কুন্তলার সঙ্গে আমার আলাপ সাত- আট বছর ধরে। আমি ওর অসীম উপকার করেছি। ও-ও আমার জানকবুল উপকার করেছে। আমরা দুজনেই দুজনের কাছে ওব্লাইজড—কৃতজ্ঞ। মুশকিল হচ্ছে এই যে, আমি কৃতজ্ঞতাপাশটাই বন্ধনের সীমান্ত বলে মেনে নিতে চাইছিলাম; কিন্তু…

নিখিল বললে, এখনও কিন্তু আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দেননি। শকুন্তলার সঙ্গে আপনার প্রথম আলাপ হলো কীভাবে? এখন অবশ্য আরও দুটি প্রশ্ন যোগ করব—কোন সূে আপনারা দুজনে দুজনের প্রতি কৃতজ্ঞ?

—রীতা বিদ্যার্থীর আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানে সেসব তথ্যের কোনও প্রয়োজন আছে কি, মিস্টার দাশ?

—আছে। প্রচণ্ডভাবে আছে। হেতুটা আমি যাবার আগে জানিয়ে যাব। তার আগে—যদি এটাকে আপনার ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহৈতুকী নাক-গলানো বলে মনে ন করেন—শকুন্তলার সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা আমি সমঝে নিতে চাই। বলবেন?

—বলব। আশা করি এটা প্রকাশ হবে না।

–না। নিশ্চয় নয়।

—অল রাইট। শুনুন তাহলে—

প্রায় সাত বছর আগেকার কথা। রবিন তখনো সিনিয়ার অ্যাডভোকেট হয়নি। এম. এ. আর ল পাস করে এক পিতৃবন্ধুর কাছে অ্যাপ্রেনটিস্ হিসাবে কোর্টে যাচ্ছে। আর সেই বছরই গ্র্যাজুয়েট হলো শকুন্তলা রায়। বাঙলা অনার্স। ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড। শকুন্তলার বাবা তার আগেই মারা গেছেন। মা তখনো জীবিতা। দাদা মার্কিন মুলুকে। বাবার রেখে যাওয়া টাকার সুদে কোনোরকমে সংসার চলে। দাদাও সাহায্য পাঠায়, তবে নিয়মিত নয়। বৌদি বিদেশিনী। শকুন্তলার ইচ্ছে নয়, দাদার অর্থনৈতিক সাহায্য হাত পেতে নেবার। মায়েরও সেটা পছন্দ নয়। বি. এ. পাস করে সে মরিয়া হয়ে একটা চাকরি খুঁজতে থাকে। একটার পর একটা দরখাস্ত। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত করেছিল বিভাবতী মাইতি সেকেন্ডারি স্কুলে। ওঁরা বাঙলার জন্য একজন শিক্ষিকা নেবেন। ন্যূনতম যোগ্যতা : বাঙলা ভাষায় অনার্স গ্র্যাজুয়েট। কপাল ঠুকে দরখাস্ত ছেড়ে দিল শকুন্তলা।

বিভাবতী হচ্ছেন রবিন মাইতির পিতামহী। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ওর পিতৃদেব, সিনিয়ার মাইতি-সাহেব। তিনি গভর্নিং-বড়ির প্রেসিডেন্ট। রবিন তাঁর একমাত্র পুত্র। সেও ছিল গভর্নিং-বড়ির জনৈক সদস্য। ঘটনাচক্রে রবিন বাঙলায় এম. এ.। তাই ইন্টারভিয়ু বোর্ডে তার প্রাধান্যটাই অন্য সবাই মেনে নিয়েছিলেন। যারা ইন্টারভিয়ু দিতে এসেছে তাদের প্রশ্ন করেছিল রবিনই।

কতজন প্রতিযোগিনী ছিল তা আজ আর মনে পড়ে না। তবে দুজন এম. এ. বি. টি ছিলেন। একজন পি. এইচ. ডি. করছিলেন। রবিন খুব জোর দিয়ে শকুন্তলার রায়কে সমর্থন করেছিল। তার যুক্তিটা ওঁরা মেনে নিয়েছিলেন। বোর্ডের অন্যান্য সদস্যরা। রবিনের মতে—অন্য সবাই এ চাকরিটাকে ‘জাম্পিং-বোর্ড’ হিসাবে গ্রহণ করবে। চাকরিতে যোগদান করেই মেয়েদের কলেজে অধ্যাপনার জন্য দরখাস্ত করতে থাকবে। পরিবর্তে যদি এই মধ্যবিত্ত ঘরের অভিভাবকহীন মেধাবী মেয়েটিকে নেওয়া হয় এবং স্কুলে শিক্ষকতা করতে করতেই যদি তাকে এম. এ. পাস করানো যায়, তাহলে মেয়েটি কৃতজ্ঞতাবশত এখানেই টিকে যেতে পারে। স্কুলের প্রতি একটা মায়াও পড়ে যাবে তার।

তিন-তিনটি এম. এ. পাস প্রতিযোগিনীকে টপকে শকুন্তলা চাকরিটা পেয়ে যায়। পরে হেডমিস্ট্রেস-এর কাছ থেকে—তিনিও ছিলেন সিলেকশন বোর্ডে—জানতে পারে, কার জন্য তার চাকরিটা হলো!

রবিন মাইতির স্পষ্ট মনে আছে সেই ইন্টারভিয়ু নেবার দিনটার কথা। একটা পাটভাঙা সাদা-খোল, নীলপাড় তাঁতের শাড়ি পরে ইন্টারভিয়ু দিতে এসেছিল শ্যামলা মেয়েটি। তখন সে আদৌ পৃথুলা ছিল না। যৌবন তার কানায় কানায়—মধ্যক্ষাম দেহাবয়ব। নমস্কার করে সামনের চেয়ারে বসতেই রবিন মাইতি মেয়েটিকে প্রশ্ন করেছিল, আপনি ফার্স্টক্লাস সেকেন্ড হয়েছেন দেখছি। ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হতে পারলেন না কেন?

ভেবেছিল, মেয়েটি কৈফিয়ৎ দিতে আমতা-আমতা করবে। বাড়িতে কারও অসুখ করেছিল, নিজের শরীর খারাপ হয়েছিল ইত্যাদি কোনো একটা অজুহাত খাড়া করবে। শকুন্তলা সে দিক দিয়েই গেল না। তার আয়ত হরিণ নয়ন মেলে বললে, এর তো সহজ জবাব। যে ছেলেটি ফার্স্ট হয়েছে সে আমার চেয়ে ভাল আনসার করেছিল বলে।

এরপর রবিনের বাবা মেয়েটির পারিবারিক তথ্য, বাল্য-কৌশোরের সংবাদ সংগ্রহ করলেন। শকুন্তলার বাবা কেন্দ্রীয় সরকারে ভাল চাকরি করতেন। তিনি যখন বাঙ্গালোরে পোস্টেড তখন ও স্কুল-ফাইনাল পাস করে। পরে চলে আসে কলকাতায়। বেথুন থেকে বি. এ. করেছে। বাঙ্গালোরে সে বাংলা পড়েনি। এখানে একটি বছর তাই নষ্ট হয়েছে তার।

অন্যান্য সবাই নানান রকম প্রশ্ন করার পর আবার রবিনকেই তুলে নিতে হলো ‘বাঙলা’ বিষয়ে প্রশ্ন করার দায়িত্বটা। ও জিজ্ঞেস করেছিল, রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষণিকা’ কাব্যগ্রন্থের কোন পংক্তিটা আপনার সবচেয়ে ভাল লাগে এবং কেন ভাল লাগে?

ইন্টারভিয়ু দিতে আসা প্রার্থীর কাছে এমন একটা বেমক্কা প্রশ্ন রীতিমত কঠিন। শকুন্তলা কিন্তু ঘাবড়াল না। জবাবে তৎক্ষণাৎ বলেছিল, “মনে রে আজ কহ যে/ভালমন্দ যাহাই আসুক সত্যরে লও সহজে।” গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষণ বর্ণনায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দশ- বিশটা শ্লোকে যে কথা বলেছেন, এখানে মাত্র দুটি পংক্তিতে রবীন্দ্রনাথ তা বলতে পেরেছেন—সহজবোধ্য সরল ভাষায়। এ দুটি পংক্তি ভারতীয় দর্শনের নিষ্কামকর্মের সরলীকৃত চুম্বকসার।

মুগ্ধ হয়েছিল সবাই।

রবিন শেষ প্রশ্ন পেশ করেছিল শেষের কবিতা থেকে। জানতে চেয়েছিল, শেষের কবিতার শেষ কবিতার মোদ্দা কথাটা কী?

শকুন্তলা জবাবে বলেছিল, সেটা নির্ভর করে পাঠকের মানসিকতার উপর। ‘ঝরাফুল’ কাব্যগ্রন্থের লেখক পেসিমিস্টিক কবি করুণানিধানের মতে হয়তো মোদ্দা কথাটা “হে বন্ধু বিদায়”; আবার পরশুরামের ‘রাতারাতি’ কাহিনীর অপটিমিস্ট নায়িকার মতে, “উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে/সেই ধন্য করিবে আমাকে!”

এককথায় চাকরি হয়ে গেল শকুন্তলার।

বেশ কিছুদিন চাকরি করার পর একদিন স্কুলের নির্জন করিডোরে শকুন্তলার সঙ্গে ঘটনাচক্রে রবিনের দেখা হয়ে গেল। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। শকুন্তলা টিচার্সরুমে বসে মেয়েদের খাতা দেখছিল এতক্ষণ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। স্কুলবাড়ির পাশেই রাধাশ্যমের মন্দিরে সন্ধ্যারতির শঙ্খঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। শকুন্তলা খাতাপত্র গুছিয়ে বারান্দা দিয়ে গেটের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ লক্ষ্য হলো, বিপরীত দিক থেকে রবিন মাইতি এগিয়ে আসছেন। শকুন্তলা পাশ দিল। হাত তুলে নমস্কারও করল। রবিন ওর সামনে এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রতিনমস্কার’ করে বলল, কেমন আছেন মিস্ রায়? চাকরিটা ভাল লাগছে?

শকুন্তলা গ্রীবা সঞ্চালনে জানাল, তার ভাল লাগছে, অথবা সে ভাল আছে। রবিন চলতে শুরু করতেই ও পিছন থেকে হঠাৎ ডেকে উঠল, শুনুন?

রবিন দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকায়। কৃতজ্ঞতার আবেগে শকুন্তলা বলে বসে, হেডমিস্ট্রেস আমাকে সব কথা বলেছেন।

—’সব কথা’? মানে?

—আপনি আমাকে সাপোর্ট না করলে আমার চাকরিটা হতো না।

—তাই বলেছেন বুঝি?

—হ্যাঁ। আমি কৃতজ্ঞ। অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। বলুন, কীভাবে আমি আপনাকে….

কথাটা বেচারি শেষ করতে পারেনি। ওর হঠাৎ মনে হলো, এই নির্জন করিডোরে ওর অন্তরের আকুতিটার একটা কদর্য ইন্টারপ্রিটেশান হতে পারে। একটি কুড়ি বছরের অনূঢ়া যুবতী মেয়ে যদি একজন সুদর্শন অবিবাহিত যুবককে নির্জনে এমন কথা বলে….

রবিন সহাস্যে বলেছিল, বলুন? বাক্যটা আপনি শেষ করেননি—

দুরন্ত লজ্জায় শকুন্তলা বলেছিল, না করিনি! আমার হঠাৎ মনে হলো এ-কথায় আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না তো?

—কী কথায়? কী ভুল বুঝব?

মর্মান্তিক আহত হরিণীর মতো শকুন্তলা তার উপকারকারীর দিকে তাকিয়েছিল। তার মুখে কথা সরেনি। রবিন আবার হেসে বলেছিল, না, শকুন্তলা! তোমার ‘প্রত্যুপচিকীর্ষার’ ভুল ইন্টারপ্রিটেশন আমি করব না। কিন্তু এই নির্জন করিডোরে দাঁড়িয়ে সে-বিষয়ে আলোচনা করলে দূর থেকে তৃতীয় ব্যক্তি ভুল বুঝতে পারে। কাল তো ছুটির দিন। কাল সকালে আমাদের বাড়িতে এস। কথা হবে।

রবিন মাইতি কদিন আগে পার্টি নমিনেশন পেয়েছে। সে বিধায়ক হিসাবে নির্বাচন প্রার্থী। তার নিষ্ঠাবান কর্মীর খুব দরকার।

রবিন মাইতির ইলেকশনের সময় জান-কবুল লড়ে গিয়েছিল মেয়েটি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভোটার লিস্ট যাচাই করা, আর সারা দিন ধরে শহরের দেওয়াল দখল। রবিন মাইতি বাইশ হাজার ভোটে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে যে পরাজিত করতে পেরেছিল তার জন্য শকুন্তলার বিরাট অবদান অনস্বীকার্য!

শকুন্তলা সে সময় দিবারাত্র ওদের বাড়িতে পড়ে থাকত। ইলেকশনের কাজে। মেয়েটিকে মাইতি-জননীর নজরে ধরে। একমাত্র পুত্রের বিবাহের জন্য তিনি অনেকদিনই উদ্‌গ্রীব। পুত্রকে প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন। রবিন মাইতি বলেছিল, কী যে বল মা! সব সময়েই তোমার ওই এক বায়নাক্কা!

কেন যে শকুন্তলাকে বিবাহ করতে সে রাজি নয়, তা মাকে জানায়নি। বোধকরি নিজের চেতন মনকেও সে কোনে কৈফিয়ত দেয়নি। কিন্তু শকুন্তলার এই সাহায্যের প্রতিদান সে দিয়েছিল—আর্থিক সাহায্য নয়, অন্যভাবে। ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, শিক্ষিকা হিসাবে নৈশ-ক্লাস করে সে যাতে এম. এ. পরীক্ষাটা দিতে পারে। মাইতি ওর প্রতি মুগ্ধ হয়েছিল আরও একটা কারণে : শকুন্তলার বাঙলাপ্রীতিতে। মাইতি নিজেও বাঙলা ভাষার একান্ত সেবক। কবিতা- টবিতা লেখে! নিজের খরচে কবিতার বইও ছাপিয়েছে। সে মুগ্ধ হয়েচিল, এই কারণে যে, শকুন্তলা স্কুল-জীবনে আদৌ বাঙলা পড়েনি, বাঙ্গালোরে থাকার সময়। অথচ বাঙলা বই পড়েছে, বাঙলা-ভাষাকে ভালবেসেছে। ওর বাবা কলকাতায় বদলি হবার পর ‘স্পেশাল পেপার’ পাশ করে, একটি বছর নষ্ট করে, সে বি. এ. তে বাঙলা অনার্স নেবার অনুমতি পায়। মাইতির নিজস্ব সংগ্রহে প্রচুর বাঙলা বই। গল্প-উপন্যাস, ক্ল্যাসিক্যাল সাহিত্য, ভাষাতত্ত্বের উপর গ্রন্থ। শকুন্তলাকে সে লাইব্রেরির কপাট উজাড় করে খুলে দিয়েছিল। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। লাইব্রেরি মালিকের হৃদয়-দুয়ার শকুন্তলা খুলতে পারেনি।

রবিন মাইতি যে ঠিক এই ভাষায় স্বীকার করেছিল তা নয়, তবে ‘হোয়াইট হর্স’ হুইস্কির মাদকতায় মেশানো তার স্বীকৃতি থেকে নিখিল এভাবেই ব্যাপারটার ধারণা করেছিল। মাইতি থামলে নিখিল জানতে চায় : ঠিক আছে, ‘ইটার্নাল ট্রায়াঙ্গেল’-এর প্রসঙ্গে এখানেই ছেদ টানা যাক। আমি একটি প্রশ্ন করি : মিস্ বিদ্যার্থী কি বেঁয়ো ছিলেন?

—মানে? ‘লেফ্‌ট্-হ্যান্ডার’ ছিলেন কি না?

—ইয়েস। তিনি কি বাঁ-হাতে লিখতেন?

—কী আশ্চর্য! সে প্রশ্ন উঠছে কেন?

—মিস্টার মাইতি! আমি যা জানতে চাই তা প্রথমে আমাকে জানান। তারপর যাবার আগে—কথা দিচ্ছি—আপনার সব কৌতূহল আমি মিটিয়ে দিয়ে যাব। মিস্ বিদ্যার্থীর মৃত্যু সংক্রান্ত যেটুকু তথ্য আমরা জেনেছি। আপাতত বলুন, বিগত তিন মাসের মধ্যে আপনি কি মিস্ বিদ্যার্থীকে কিছু লিখতে দেখেছেন—চিঠি, চিরকুট, চেক? কোন হাতে?

রবিন মাইতি দীর্ঘক্ষণ তার পানপাত্রের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললে, সরি! মনে পড়ছে না। সে লেফট্-হ্যান্ডার ছিল কি না আমি জানি না।

—আপনারা তো রেস্তোরাঁয় বসে একসঙ্গে খেয়েছেন। মনে পড়ছে না মিস্ বিদ্যার্থী ডান হাতে কোনটা ধরতেন? ছুরি না ফর্ক?

—তাতে কিছুই প্রমাণ হয় না। অনেক লেফট্-হ্যান্ডেড ব্যাটম্যান আছে যারা ডান হাতে বল করে। রিচার্ড হ্যাডলি যেমন একজন।

—সেটা তো এক্সেপশন—ব্যতিক্রম!

—তা যদি বলেন, তাহলে আমি বলব ‘লেফট্ হ্যান্ডেডনেস্’ টেন্ডেসিটাই তো একটা ব্যতিক্রম।

—টু। তবু আপনার মনে পড়ে না?

একটু চিন্তা করে রবিন মাইতি বলে, হ্যাঁ মনে পড়ে। রীতা ডান হাতে ছুরি আর বাঁ হাতে কাঁটা নিয়ে খেত। আমার-আপনার মতোই। কিন্তু এ-প্রশ্নটা কেন জানতে চাইছেন?

নিখিল দুদিকে মাথা নেড়ে বলল, আপনার সঙ্গে মিস্ বিদ্যার্থীর শেষ যোগাযোগ কবে হয়েছিল? কোথায়?

—এগরোই নভেম্বর, বৃহস্পতিবার। ওকে অফিসে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম কালীপূজার সন্ধ্যটা ফ্রি রাখতে পারবে কি না। ও বলেছিল, না! ওইদিন শকুন্তলা কোথায় বুঝি যাবে আর সন্ধ্যোবেলায় ওর একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। আমি ঠাট্টা করে জানতে চেয়েছিলাম, ‘এনি আদার স্যুটার?’ ও বলেছিল, ‘তোমার হিংসে হচ্ছে? ভয় নেই। যাঁর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট তাঁর বয়স তিন কুড়ির ওপরে।’

নিখিল বলে, থ্যাংস-আ-লট! আমার আপাতত আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই।

উঠবার উপক্রম করতেই রবিন মাইতি নিখিলের হাত চেপে ধরে। বলে, সে কি মশাই! আপনি না কথা দিয়েছিলেন…

ওকে মাঝপথে থামিয়ে নিখিল বলে, আজ থাক প্লিজ। আপনি এমনিতেই অত্যন্ত কঠিন আঘাত পেয়েছেন একটা।

— নো, নো, নো! বলুন? আপনারা কতটুকু কী জানতে পেরেছেন। রীতা ‘লেফট্-হ্যান্ডার’ কি না এ প্রশ্নটা উঠছে কেন?

—যেহেতু মৃত্যুর পরে তাঁর ডান হাতে ধরা ছিল পিস্তলটা!

—তাই তো থাকবে! যদি সে লেফট্-হ্যান্ডার না হয়।

—আই এগ্রি। কিন্তু বুলেট-উন্ডটা তার বাঁ কানের উপর ঠিক এইখানে—

নিজের বাম কর্ণের উপর কপালের শেষ প্রান্তটা দেখায়।

রবিন মাইতি অনেকটা অ্যালকোহল নিয়েছে তার পাকস্থলীতে। মস্তিষ্কে তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ব্যাপারটা সমঝে নিতে সে তার নিজের মুষ্টিবদ্ধ ডান হাতটা বাম- কর্ণমূলে নিয়ে গিয়ে কল্পিত পিস্তলের ট্রিগার টানার চেষ্টা করে। শেষে বলেই বসে, বাট্ দ্যাটস্ অ্যাবসার্ড!

—ইয়েস, আমাদের তাই আশঙ্কা : হয়তো এটা ‘কেস অব সুইসাইড’ আদৌ নয়! মার্ডার!

শেষ শব্দটার প্রতিক্রিয়া হতে একটু সময় লাগল। তারপর ধীরে ধীরে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল রবিন মাইতি। মনে হচ্ছে অক্ষিগোলক থেকে ওর চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়।

নিখিল বলে, আমরা নিশ্চিত নই এখনো। আপনি শান্ত হোন, মিস্টার মাইতি! আমরা তো ইনভেস্টিগেট করছিই।

মাইতি তার বাম করতলে দক্ষিণ হস্তে মুষ্ট্যাঘাত করে চিৎকার করে ওঠে : ড্যাম ইট! মার্ডার!!

তৎক্ষণাৎ দরজাটা খুলে যায়। কানাই আর মহেন্দ্রবাবু যুগলে প্রবেশ করেন ঘরে। রবিন ততক্ষণে বসে পড়েছে চেয়ারে। বস্তুত এলিয়ে পড়েছে। মহেন্দ্রবাবু আর কানাই দুদিক থেকে সেদিকে এগিয়ে এসে ছোট-সাহেবকে সাঁড়াশি আক্রমণে চেপে ধরেন।

নিখিল নিঃশব্দে নিষ্ক্রান্ত হয় ঘর থেকে।