সকল কাঁটা ধন্য করে – ৪

চার

আরও আধঘণ্টা বাদে। বেলা একটা বাজে। অনিমেষও ইতিমধ্যে নিজের থানায় চলে গেছে। কেষ্টার-মা যাব যাব করছে। নিখিল বাড়ি ছেড়ে যাবার আগে গৃহস্বামিনীর কাছে বিদায় নিতে চেয়েছিল; কিন্তু কেষ্টার-মা নিচের তলায় শকুন্তলার শয়নকক্ষ ঘুরে এসে জানালো : বড়দিমনি কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে।

অগত্যা ওঁরা তিনজনে নিঃশব্দেই নিষ্ক্রান্ত হলেন সে বাড়ি থেকে। কেষ্টার-মা তার ঘরপানে রওনা হলো। বাসু-সাহেব বললেন, অতঃ কিম্?

নিখিল বললে, চলুন, প্রথমে কোনও রেস্তোরাঁয় গিয়ে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক। বেলা একটা বেজে গেছে।

বাসু রাজি হলেন না। বললেন, তার চেয়ে তোমার অফিসে চল। সেখানে তোমার ঘরে বসে কিছু খাবার আনিয়ে খেয়ে নিতে পারব। কাজও করা যাবে ঐ সঙ্গে।

—এত তাড়াতাড়ি করছেন কেন, স্যার?

—দুজনের সঙ্গে আমাদের এক্ষুণি যোগাযোগ করতে হবে। এক নম্বর : মদ্র-সাহেব, দু- নম্বর এম. এল. এ. সাহেব। আমি জানতে চাই এদের মধ্যে কেউ জানে কি না যে, সল্ট লেক অঞ্চলে রীতা, বিদ্যার্থী নামে একটি সোনালী চুলের মেয়ে এখন শবব্যবচ্ছেদের শীতাতপ- নিয়ন্ত্রিত কামরায় শায়িতা। কালকের কাগজে খবরটা ছাপা হবার পরে ওদের অ্যাটিচুড বদলে যাবে।

—তাহলে এক কাজ করি, স্যার। আমার বাড়ি চলুন। অফিসে গেলেই পাঁচজন সাক্ষাৎপ্রার্থী, পাঁচটা ফাইল, আর কিছু না হয় তো অন্য একটা মার্ডার কেস ঘাড়ে চাপবে। আমার বাড়িতে গিয়ে টেলিফোন করতে পারব। কাকলি ইতিমধ্যে কিছু খাবার বানিয়ে অথবা আনিয়ে নিতে পারবে।

অগত্যা তাই।

মিনিট-পনেরোর মধ্যে ওঁরা পৌঁছে গেলেন নিখিলের বাড়িতে। কাকলি খুবই খুশি। বললে, ও-বেলার জন্য চিকেন দো-পেঁয়াজা করাই আছে। দুজনের মতো ভাত তো আছেই! আমি বরং খান-কয় পরোটা ভেজে দিই।

বাসু বলেন, তোমাদের তিনজনের জন্য পরোটা বানাও। আমাকে স্রেফ শশা বা টমেটোর ভেজিটেব্‌ব্ল স্যান্ডুইচ বানিয়ে দাও। পরোটা খাব না। আর তোমার মাসিমা কিংবা সুজাতাকে টেলিফোন করে জানিয়ে দাও আমরা দুজনে এখানে খাচ্ছি।

ওঁরা তিনজনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ড্রইংরুমে বসলেন। নিখিল জানতে চায়, ওই ফটোটাকে আপনি অতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন, স্যার?

বাসু পকেট থেকে পাইপ বার করে টেবিলের উপর রাখলেন। বললেন, প্রসঙ্গটা শুরু করেছিলাম নিতান্ত ‘ওয়ইল্ড গুজ চেজ’ হিসাবে। রীতার টেবিলের উপর একটা বড় ফটো টাঙানো ছিল, সেটা সম্প্রতি সরিয়ে ফেলা হয়েছে—এটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূত্র নয়। কিন্তু গোয়েন্দাগিরির ধর্মই হচ্ছে : ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই…’! ছবিটার অনুপস্থিতি থেকেই আমার মনে প্রশ্ন জাগল, এটা কোন কারণে খুলে রাখা হয়েছে? অ্যাক্সিডেন্টালি দড়ি ছিঁড়ে পড়েনি।

নিখিল জানতে চায়, কেন? সেটা নয় কেন?

—কারণ কাছেই রয়েছে ওই ব্যারেল-শেপড্ টিনের ওয়েস্ট-পেপার ড্রামটা। যেটাতে দু’- তিন মাস আগেকার ছেঁড়া ভাউচার রয়েছে, অথচ একটাও ভাঙা কাচের টুকরো নেই। কিন্তু মেয়েটি বললে, মাত্র তিন-চার দিন আগে ফটোটা পড়ে ভেঙেছে। আমার সন্দেহ হলো—এর মধ্যে হয়তো কিছু একটা কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। তাই আরও একটু খোঁজখবর নিলাম। মজার কথা : কেষ্টার-মা জানেই না যে, ছবিটা পড়ে গিয়ে কাচ ভেঙেছে-

নিখিল আবার বলে, কিন্তু ওটা আমাদের তদন্তে কীভাবে সাহায্য করতে পারে?

—জানি না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ছবিটা থাকলে আমরা একটা বিষয় নিশ্চিন্ত হতে পারতাম : রীতা বিদ্যার্থী গারফিল্ড সোবার্স থেকে ডেভিড গাওয়ারের দলে কিনা। আই মীন, লে-হ্যান্ডার কি না। কারণ কেষ্টার-মা ইতিমধ্যে জানিয়েছে ছবিতে দেখা যাচ্ছিল রীতা খাটে শুয়ে শুয়ে চিঠি লিখছিল। আমি জানতে চাই : ডান হাতে, না বাঁ-হাতে? সেটা কেষ্টার-মা বলতে পারত না। তার অতটা বুদ্ধি নেই।

কৌশিক বলল, ধরুন যদি ছবিতে দেখতাম কলমটা ওর বাঁ-হাতে? তাহলে কী ইনফারেন্স হতো?

—আমরা সিদ্ধান্তে আসতাম : এটা আত্মহত্যার কেস। মেয়েটি ছিল বেঁয়ো। বাঁ-হাতে পিস্তল ধরে নিজের বাঁ-কানের উপর ফায়ার করে আত্মহত্যা করেছে। পরে কেউ পিস্তলটা ওর ডান হাতে গুঁজে দিয়েছে!

–কে দিতে পারে? কেন দিতে যাবে?

বাসু বলেন, আমরা এখনও তা জানি না। দু’দুটো ‘ভাইটাল ব্লু’ এখনও আমাদের হাতে আসেনি। এলে, তখন হয়তো ও প্রশ্নের জবাবটা বোঝা যাবে। নাম্বার ওয়ান : ফিঙ্গার প্রিন্ট রিপোর্ট। পিস্তলে আর কারও আঙুলের ছাপ আছে কি না।

নিখিল বলে, কেউ যদি পরে মেয়েটির মুঠিতে পিস্তলটা গুঁজে দিয়ে থাকে তাহলে মিলিয়ান টু ওয়ান চান্সেও তেমন কোনও ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যাবে না। পিস্তলটা মৃত মেয়েটির মুঠিতে গুঁজে দেবার আগে অপরাধী সযত্নে রুমাল দিয়ে সেটা মুছে নেবে—

বাসু বলেন, অথবা আঁচল দিয়ে!

কৌশিক এদিকে ফিরে বলে, আপনি কি শকুন্তলাকে সন্দেহ করছেন?

—না! তবে শকুন্তলাকে বর্তমানে সন্দেহের বাইরে রাখতে পারছি না।

—কিন্তু শকুন্তলার কী স্বার্থ?

—শকুন্তলাই যদি হয়, তবে মোটিভও পাব। জোরালো মোটিভ—আদিম রিপু। সেই শাশ্বত ত্রিকোণ! একজন সুদর্শন, সুপ্রতিষ্ঠিত পুরুষ আর দুটি নারী। যে মারা গেছে সেই বেশি সুন্দরী! দ্বিতীয়ত শকুন্তলার জবানবন্দি অনুসারে ঐ ভদ্রলোক এবাড়িতে ইতিপূর্বে ঘন ঘন আসত। ইদানীং আসে না। রীতার সঙ্গে তার অন্যত্র দেখা হয় নিশ্চয়। তৃতীয়ত শকুন্তলার পক্ষে ওই পিস্তলটা সংগ্রহ করা খুব সহজ।

নিখিল বলে, কিন্তু সে তো ভদ্রেশ্বরে ছিল—

—তার জবানবন্দি অনুসারে। অ্যালেবাইটা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাছাড়া সকালে এসে সে যে রুদ্ধদ্বার দেখেছিল—এটাও তো তারই জবানবন্দি অনুসারে। হত্যার পর দরজা-জানলা বন্ধ করে সে পুলিশে ফোন করে থাকতে পারে।

নিখিল বলে, সেক্ষেত্রে পিস্তলটা কি রীতার বাঁ-হাতে থাকত না?

—হ্যাঁ, তাই থাকার কথা। কেন নেই, তা আমরা এখনো জানি না। মেয়েটি যে ঐ পিস্তলের গুলিতেই মারা গেছে সেটাও তো এখনো জানা যায়নি।

কৌশিক বলে, আর ধরুন যদি ফটোতে আমরা দেখতে পেতাম কলমটা ডান হাতে ধরে রীতা লিখছে?

—সেক্ষেত্রে আমাদের সিদ্ধান্ত হতো—এটা আত্মহত্যার কেস আদৌ নয়! মার্ডার! পিস্তলটা ডান হাতে ধরে কেউ বাঁ-কানের উপর ফায়ার করতে পারে না। সেটা ফিজিক্যালি অ্যাবসার্ড। তার মানে ওর পিস্তলটা হাতিয়ে কেউ ওকে ফায়ার করে এবং রিভলভারটা ওর মুঠিতে গুঁজে দেয়। সেক্ষেত্রে আমরা পিস্তলে আদৌ কোনও ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাব না। রুমালেই হোক বা আঁচলেই হোক, মুছবার সময় সব ফিঙ্গারপ্রিন্টই মুছে যাবে। রীতারটাও!

কৌশিক বলে, এখনো অবশ্য আমরা জানিই না যে, ওই পিস্তলটা বাস্তবে মার্ডার ওয়েপন কিনা। সীসার বলটা সম্ভবত খুলিতেই আটকে আছে। ব্যালাটিক্ এক্সপার্ট কম্পারেটিভ মাইক্রোস্কোপে যাচাই করে প্রথমে বলুন যে, মৃত্যু হয়েছে ওই পিস্তলের গুলিতেই—তারপর আবার আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। তবে হ্যাঁ, ফটো থেকে যদি বোঝা যেত রীতা কোন হাতে লেখে, তাহলে আমাদের বিশ্লেষণের সুবিধা হতো।

নিখিল ইতিমধ্যে উঠে গিয়ে একটা ফোন করল। বাসু জানতে চাইলেন, তোমার অফিসে ফোন করলে না কি?

—না স্যার। মোটর ভেহিক্লস্-এ আমার এক সহকারী বসে। তাকে ওই কালো ফিয়াট গাড়ির নম্বরটা দিলাম। রেকর্ড ঘেঁটে দেখতে, গাড়ির মালিকের নাম। ঘটনাচক্রে লাইসেন্স নম্বর থেকেই বোঝা যাচ্ছে—গাড়িটার লাইসেন্স এখানকার।

বাসু বললেন, তুমি আর একটা কাজ কর তো হে। এম. এল. এ. সাহেবকে একটা ফোন করে দেখ তিনি বাড়িতে আছেন কি না। এখন অ্যাসেম্‌ব্লি চলছে না। তবে বেলা দেড়টার সময় তিনি বাড়িতে নাও থাকতে পারেন। কায়দা করে সমঝে নাও, মাইতি-সাহেব ইতিমধ্যে খবর পেয়েছেন কি না।

নিখিল পকেট থেকে কাগজের টুকরোটা আবার বার করে। টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়ে বলল, এই ফোনের একটা এক্সটেনশান আছে পাশের ঘরে, আমার বেডরুমে। আমি সেখান থেকে ফোন করছি। আপনি এটায় শুনুন। তাহলে দু’পক্ষের কথাই শুনতে পাবেন।

বাসু ওর হাত থেকে ফোনটা তুলে নিলেন।

নিখিল পাশের ঘরে উঠে গেল। কর্ডলেস্ ফোনটা নিয়ে ডায়াল করতে করতে এ-ঘরে ফিরে এল। বার দুই রিঙিং টোন হতেই ও প্রান্তে কেউ সাড়া দিল : রবিন মাইতি বলছি। বলুন?

নিখিল বললে, গুড আফটারনুন, স্যার। আমি অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার, ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট, নিখিল দাশ বলছি…

—বলুন? রীতা বিদ্যার্থীর বিষয়ে কি?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি তাহলে খবরটা পেয়েছেন?

–পেয়েছি। আপনারা ঘুরে এসেছেন তাও শুনেছি।

—মিস্ শকুন্তলা রায় বুঝি টেলিফোনে খবরটা দিলেন?

—এ প্রশ্ন অবান্তর। সল্ট লেক আমার কন্সটিটুয়েন্সিতে। এলাকার যাবতীয় খবর আমাকে রাখতে হয়। সবই জেনেছি-

নিখিলের পিত্তি জ্বলে গেল এম. এল. এ.-সাহেবের হামবড়াই ভঙ্গিতে। বললে, তাহলে তো ল্যাটা চুকেই গেল। কাইন্ডলি বলবেন স্যার, এটা কেস অফ সুইসাইড না মার্ডার?

মাইতি-সাহেব ধমকে ওঠেন, মানে? সেটা আমি বলব, না আপনি বলবেন? মার্ডার হতে যাবে কেন? বদ্ধঘরের ভিতর…

—না, আপনি এখনি বললেন না : ‘সবই জেনেছি’…

—ডোন্ট বি ফ্রিভলাস মিস্টার দাশ! ইটস্ এ ভেরি ভেরি সিরিয়াস কেস। আমি জানতে চাই : আপনারা কতটুকু কী জানতে পেরেছেন। কে মিস্ বিদ্যার্থীকে সুইসাইডে প্ররোচিত করেছে?

—সেজন্যেই তো আপনাকে টেলিফোন করছি। কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে।

–করুন। কী জানতে চান, বলুন?

—টেলিফোনে হবে না, মিস্টার মাইতি। সামনা-সামনি বসে কথা বলতে হবে…

—তাহলে আপনি আমার চেম্বারে চলে আসুন। ওল্ড-কোর্ট হাউস স্ট্রিটে। পাঁচটার সময়। নাম্বারটা জানেন তো?

—জানি। কিন্তু আলোচনাটা লালবাজারে হলে ভাল হতো না কি? কফিডেন্সিয়েলি কথা বলা যেত।

—এখানে আমার চেম্বারটাও সাউন্ড-প্রুফ। সে বিষয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। তবে ঠিক পাঁচটায় আসবেন। ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়বেন না। সাড়ে পাঁচটায় আমার অন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

নিখিল বললে, অলরাইট স্যার! তাই হবে।

লাইন কেটে দিয়ে বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে নিখিল বললে, তেজ দেখেছেন এম. এল. এ.-সাহেবের? এখন সিংহবিক্রম! আর মেয়াদ ফুরোলেই যুক্তকরে পথে-পথে ভিক্ষে করে বেড়াবেন : আমাকে আপনার ভোটটা কাইন্ডলি দেবেন স্যার?

কৌশিক এতক্ষণে বসে বসে টেলিফোন ডাইরেক্টােিত কী যেন খুঁজছিল। তার দিকে ফিরে নিখিল বলে, আপনি কার নম্বর খুঁজছেন বলুন তো?

কৌশিক বইটা বন্ধ করে মুখ তুলে তাকায়। এক গাল হেসে বলে, না মিস্টার দাশ, আমি কারও নম্বার খুঁজছিলাম না। আমি ডাইরেক্টরি হাতড়ে দেখছিলাম SATAKIA আর SATAPATI-র মাঝখানে কোনও এন্ট্রি আছে কি না। না, নেই!

—তার মানে?

—মানেটা খুব ইন্টারেস্টিং! আমার আস্তিনের তলায় বহুক্ষণ ধরে একটা তাস লুকানো আছে। সেটা তুরুপের তাস কিনা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এখন মনে হচ্ছে বোধহয় আমার আন্দাজটা ঠিকই। দেখা যাক চেষ্টা করে। যদি ঠিক হয়, মামু, তাহলে আপনার কাছে আমার খাওয়া পাওনা থাকল। কারণ জিনিসটা আপনারা দুজনেই খুঁটিয়ে দেখেছেন। নজর করেননি। বাসু টেবিলের উপর থেকে পাইপটা তুলে নিয়ে তাতে তামাক ঠেশতে ঠেশতে বলেন : ফায়ার!

—মিস্ বিদ্যার্থীর সেই ছোট্ট নোটবইটার কথা বলছি। যাতে অনেকগুলি নাম আর টেলিফোন নম্বার লেখা। আপনারা দুজনেও তা দেখেছেন, আমিও খুঁটিয়ে দেখেছি। একটা এন্ট্রিতে আমার কেমন যেন খটকা লাগল। ‘S’-এর ঘরে অনেকগুলি এন্ট্রি। সাহা, সরকার, সেনগুপ্ত, সৎপতি ইত্যাদি বারো-তেরটা নাম। তার মধ্যে একটি উপাধি SATAN—ওটা তার নাম, না উপাধি সেটার উল্লেখ নেই। এখন ডাইরেক্টরি ঘেঁটে দেখছি ‘সতকিয়া’ অর ‘সতপতির’ মাঝখানে SATAN উপাধিওয়ালা কোনও লোকের টেলিফোন নেই। আমার আন্দাজ : এটা নাম নয়, ‘কোড-নাম’–ওই মদ্র ভদ্রলোকের টেলিফোন নম্বারটা মিস্ বিদ্যার্থী এভাবে খাতায় লিখে রেখেছে।

বাসু বললেন, গুড-ওয়ার্ক! হতে পারে। রীতার জীবনে লোকটা শয়তান; সে এমন কোনও তথ্য জানে যেটা রীতা গোপন রাখতে চায়—তাই ছদ্মনামে টেলিফোন নম্বরটা লিখে রেখেছে। নিখিল, তুমি এক কাজ কর। পরোটা ভাজা থাক। তুমি কাকলিকে একটু ডাক।

উপায় নেই, কম্বাইন্ড-হ্যান্ডকে গ্যাস-স্টোভের দায়িত্ব দিয়ে কাকলিকে এঘরে আসতে হলো।

বাসু তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন। কাকলিকে কী করতে হবে তাও বললেন, লোকটার সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট কর রাত আটটায়। তুমি রীতা বিদ্যার্থী হিসাবে কথা বলবে। হিন্দিতে নয়, ইংরেজিতে। তোমার হিন্দি চোস্ত নয়; ধরা পড়ে যাবার চান্স। বেশি কথা বল না। লোকটা তোমার কণ্ঠস্বরে যেন সন্দেহ না করে। অবশ্য এটাই যে সেই লোকটা তা আমরা নিশ্চিত জানি না। উই আর জাস্ট টেকিং আ ওয়াইল্ড চান্স। নাও। তুলে নাও টেলিফোনটা; দেখি তুমি কেমন অভিনয় করতে পার।

কাকলি টেলিফোনটা ক্র্যাডল থেকে তুলে নিল। এক্সটেনশন লাইনে বাসু কান পাতলেন। ‘SATAN’–এর নম্বারে কাকলি ডায়াল করল। বার তিন-চার রিঙিং টোন—তারপরই কে যেন বলল, হ্যালো?

কাকলি ইংরেজিতে বললে, আমি রীতা বলছি, রীতা বিদ্যার্থী…

ও-প্রান্তবাসী হিন্দিতে প্রশ্ন করল, ইয়েস! কাকে খুঁজছেন?

কাকলি একটু ইতস্তত করে বলল, নামটা টেলিফোনে বলায় অসুবিধা আছে। বুঝেছি, আপনি নন। আয়াম সরি…

ও-প্রান্ত থেকে লোকটা বলল, না, না, আমিই! তোমার গলার আওয়াজটা প্রথমে ঠিক বুঝতে পারিনি।

কাকলি জোর দিয়ে বললে, না! আপনি নন! আপনার গলার আওয়াজ শুনে আমিও বুঝতে পেরেছি—আপনি সে লোক নন।

লোকটা এবার ইংরেজিতে বললে, প্লিজ ডোন্ট কাট্ অফ্। মিস্ রীতা,… মিস্ রীতা…

কাকলি বিনাবাক্যব্যয়ে ক্র্যাডাল-এ টেলিফোনটা রেখে দিল। বাসু বললেন, এক্সেলেন্ট!

লাইনটা কেটে দিয়েই তিনি আবার কী একটা নম্বরে ডায়াল করতে থাকেন। ও-প্রান্তে বার দুই-তিন রিঙিং টোনের পর কে যেন রিসিভারটা তুলে নিয়ে বলল, দিস্ ইজ শকুন্তলা রয়…

বাসু বললেন, লুক হিয়ার শকুন্তলা! আমি পি. কে. বাসু বলছি। ইন্সপেক্টার দাশের সঙ্গে সকালবেলা তোমার বাড়ি গেছিলাম। তুমি চিনতে পারছ আমাকে?

–ইয়েস। বলুন, স্যার!

—ঐ মদ্র ব্ল্যাকমেলারটার সন্ধান বোধহয় আমরা পেয়েছি। তার সঙ্গে এই মাত্র আমার এক মহিলা-সহকর্মী রীতা বিদ্যার্থী সেজে টেলিফোনে কথা বলে হঠাৎ লাইন কেটে দিয়েছে। সম্ভবত পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সে তোমাকে ফোন করবে। হয় সে এখনো জানে না, অথবা বোঝাতে চাইছে যে, সে জানে না—বিদ্যার্থী আজ সকালে মারা গেছে। লোকটা যদি এখনি ফোন করে তুমি তার নাম জানতে চাইবে। ও তোমাকে কোনোদিনই নিজের নাম জানায়নি এ-কথা বলেছিলে তুমি। আজও জানাবে না নিশ্চয়। সেক্ষেত্রে তুমি রূঢ় ভাষায় বলবে, ‘নাম- না-জানলে রীতাকে ডেকে দিতে পারব না। সরি! প্লিজ ডোন্ট ডিস্টার্ব মি এগেন’ বলে লাইন কেটে দেবে। এবং তৎক্ষণাৎ আমাকে এই নম্বারে ফোন করবে। নম্বরটা লিখে নাও—

নিখিলের নম্বরটা জানিয়ে বাসু-সাহেব লাইন কেটে দিলেন। কৌশিকের দিকে ফিরে বললেন, ইয়েস মিস্টার গুরু-মারা-চেলা! তোমার একটা ফাইভ-কোর্স ডিনার পাওনা হয়েছে। নাইন্টি-সেভেন পার্সেন্ট চান্স তুমি বুল্‌স্‌-আই হিট করেছ। লোকটার উচ্চারণ বিন্ধ্যাচলের দক্ষিণাঞ্চলের। কাকলিও দুর্দান্ত অ্যাকটিং করেছে। ‘অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স’! লোকটা যেই বলেছে, তোমার কণ্ঠস্বর ঠিক চিনতে পারিনি, অমনি কাকলিও একই ভাষায় রুখে উটেছে. আমার বিশ্বাস, নাইন্টি-ফাইভ পার্সেন্ট চান্স লোকটা রিং-ব্যাক করবে!

কৌশিক গোবেচারির মতো জানতে চায়, বেমক্কা দু’পার্সেন্ট কমে গেল কেন, মামু?

নিখিল তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গটা বদলে নিতে বললে, আমি আপনার সঙ্গে একমত! দুটো সম্ভাবনা। আইদার ওই লোকটাই খুন করেছে; সেক্ষেত্রে সে রীতার বাড়িতে রিং-ব্যাক করবে একথা প্রমাণ করতে যে, সে জানে না, রীতা মারা গেছে। অথবা লোকটা খুন করেনি; সেক্ষেত্রেও সে যাচাই করতে চাইবে রীতা বিদ্যার্থী কী বলতে চায়। কেষ্টার-মায়ের জবানবন্দি থেকে মনে হয়েছিল, লোকটা মাস-মাস টাকা আদায়ের বদলে একটা থওকা-টাকায় ফয়শালা করতে চেয়েছিল। সেটা পেতে হয়তো ব্ল্যাকমেলার এখনি রিং-ব্যাক করবে।

কাকলি জানতে চায়, আমার কাজ হয়ে গেছে তো? ছুটি?

বাসু বলেন, ও মা! ছুটি কি গো? পেটে ইঁদুরে ডন মারছে, আর তুমি ছুটি চাইছ?

কাকলি ধমকে ওঠে, বেশ লোক বাপু আপনারা! রান্না ফেলে ছুটে এলাম, এখন আমাকেই দোষ দিচ্ছেন!

কাকলি ফিরে গেল তার রান্নাঘরে।

বাসু-সাহেব টেলিফোনটা তুলে নিয়ে কী একটা নম্বর ডায়াল করতে থাকেন। দু’একবার রিঙিং টোনের পরেই মেয়েলি কণ্ঠে কে যেন বললে, হ্যালো?

বাসু জানতে চান, অশোক আছে? অশোক মুখুজ্জে?

মেয়েটি বলে, না, ও তো বাড়িতে নেই!

বাসু ধম্‌কে ওঠেন, কেন নেই? কাজের সময় সে বাড়িতে থাকে না কেন?

ও-প্রান্তবাসিনী বলে, সহজ কারণে বাসু-মামু। হেতুটা এই : ও এখনো রিটায়ার করেনি। আজ সোমবার। উইক ডে’জ-এ দুপুরবেলা…

ওকে মাঝপথে থামিয়ে বাসু বলেন, বুঝেছি, বুঝেছি! ভারতী বলছ তো? তা তোমার কর্তাটিকে কি অফিসে পাব, না ট্যুরে গেছে?

—না, কলকাতাতেই আছে। একটু আগে আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছে। অফিসের নম্বারটা জানেন তো?

—জানি! ধন্যবাদ।

লাইন কেটে দিয়ে নতুন করে ডায়াল করতে করতে নিখিলকে বলেন, অশোক হচ্ছে পূর্বাঞ্চলের চীফ এঞ্জিনিয়ার—টেলিকম ডিপার্টমেন্টের। ভারী ভাল ছেলে। নানা ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করে।

অশোক মুখার্জি, অর্থাৎ টেলিকম ডিপার্টনেন্টেই পূর্বভারতের চীফ এঞ্জিনিয়ারকে অফিসেই পাওয়া গেল। বাসু-সাহেব তাকে একটি টেলিফোন নম্বর দিয়ে বললেন, এই নম্বরটা কার এবং কোন ঠিকানায় তা একটু দেখে দিতে হবে। জানি, তুমি ব্যস্ত মানুষ, কিন্তু তোমার ডিপার্টমেন্টে সবাই নিশ্চয় ব্যস্ত নয়। সেই মেয়েটি কোথায়? কী যেন নাম, হ্যাঁ মনে পড়েছে, অপর্ণা দেব। ভারী কাজের মেয়ে। ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’ টাইপ। তাকে বল, এটা খুঁজে বার করে আমার এই নাম্বারে রিং-ব্যাক করতে—

অশোক বলে, অপর্ণা দেব-এর নাম আপনার মনে আছে, মামু?

—থাকবে না? কী দক্ষতার সঙ্গে সেবার (পশ্য : ন্যায়নিষ্ঠ ন্যাসনাশীর কাঁটা) খুঁজে দিয়েছিল সেই ক্রিমিনালটার নাম-ঠিকানা, যার টেলিফোনের শেষ চারটে সংখ্যা ছিল 1836!

—আশ্চর্য! নম্বরটাও মুখস্ত আছে?

—তুমি ভুলে গেছ, অশোক। নম্বরটা কষ্ট করে মনে রাখতে হয় না। ওটা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মবৎসর!

—ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ঠিক আছে, আধঘণ্টার মধ্যেই আপনাকে রিং-ব্যাক করছি। আপনি ওই নম্বরে আধঘণ্টা আছেন তো?

—আছি।

—তাহলে আধঘণ্টার মধ্যেই ক্রিমিনালটার নাম-ঠিকানা পেয়ে যাবেন।

বাসু বলেন, ক্রিমিনাল? লোকটা যে ক্রিমিনাল তা কেমন করে বুঝলে?

—সহজেই! আমার স্বনামধন্য পূজ্যপাদ বাসু-মামু শুধু ক্রিমিনালদেরই তত্ত্ব-তালাশ নিয়ে থাকেন! এই কারণে!

—অ! তাই বুঝি? সেক্ষেত্রে আজ বাড়ি ফিরে গিন্নিকে বল, ‘আজ দুপুরে হঠাৎ বাসু-মামু ফোন করেছিলেন।’ ভারতী ন্যাচারালি জানতে চাইবে, ‘কেন?” তখন তোমার ওই সহজ সমাধানটা তাকে শুনিয়ে দিও—আমার স্বনামধন্য পূজ্যপাদ বাসু-মামু শুধু ক্রিমিনালদের তত্ত্ব- তালাশই নিয়ে থাকেন যে!’

অশোক হো-হো করে হেসে ওঠে। বলে, আপনার সঙ্গে তর্ক-করা বৃথা—

—তাহলে অহেতুক বৃথা তর্ক কর কেন?—বলে লাইনটা কেটে দেন।

ক্র্যাডেলে টেলিফোনটা রাখা মাত্র সেটা ঝন্ ঝন্ করে বেজে উঠল। আবার যন্ত্রটা তুলে নিখিলের নম্বরটা ঘোষণা করলেন। ওপক্ষের বক্তা বললে, স্টিার দাশকে একটু ডেকে দেবেন? বলুন, মটোর ভেহিক্লস্ থেকে সেনগুপ্ত ফোন করছে।

বাসু নিখিলের দিকে তাকাতেই সে কর্ডলেস ফোনটা তুলে নিয়ে সুইট টিপে দিল। ও-প্রান্ত থেকে সেনগুপ্ত বললে, আপনি যে গাড়ির নম্বরটা দিয়েছেন সেটা একটা অ্যাম্বাসাডারের। সাদা রঙ। এইট্টি ফাইভ মডেলের ইঞ্জিন। মালিকের নাম যশোবন্ত সিং। সম্ভবত পাঞ্জাবী শিখ। তার বাড়ির নম্বর বলব?

নিখিল টেলিফোনে বললে, একটু ধরতো, সেনগুপ্ত। আর একটা টেলিফোন বাজতে শুরু করেছে। সেটাকে থামাই…

বলে টেলিফোনের মাউথ-পিসে হাত-চাপা দিয়ে বাসু-সাহেবকে জিজ্ঞেস করে, যশোবন্ত সিং-এর নাম-ঠিকানা—

কথাটা ওকে শেষ করতে দিলেন না বাসু। বললেন, পণ্ডশ্রম! গাড়িটা ফিয়াট। কালো রঙ। বেটা ব্ল্যাকমেলিং করতে যাবার সময় নম্বরপ্লেটটা বদলে নিয়ে অপারেশনে যায়। প্রফেশনাল ব্লাকমেলার! ধরা-ছোঁওয়ার বাইরে থাকতে চায়!

নিখিল এবার সেনগুপ্তকে জানিয়ে দেয়—যশোবন্ত সিং-রে নাম-ঠিকানায় তার প্রয়োজন নেই।

কাকলি এসে বলে, খানা তৈয়ার। খানা-কামরামে পাধারিয়ে।

ওঁরা চারজনে চলে আসেন সংগগ্ন খানা-কামরায়। নিখিল তার কর্ডলেস ফোনটা রেখে দিল পাশেই। শুধু দো-পোঁয়াজি নয়, একটা নিরামিষ তরকারি আর নারকোল দেওয়া ছোলার ডালও দিল ওই সঙ্গে। তাছাড়া রায়তা এবং দোকান-থেকে-আনা মিষ্টি দই। মধ্যাহ্ন আহার যখন মধ্যগগন অতিক্রম করছে, তখন আবার বেজে উঠল টেলিফোন। এবার হতাশাব্যঞ্জক কিছু নয়। সল্ট লেক থেকে শকুন্তলা রায় টেলিফোন করে জানালো–মদ্রসাহেব ফোন করে রীতার সন্ধান করেছে। শকুন্তলা ওঁর নির্দেশমতো লোকটার নাম জানতে চায়। লোকটা বলে, ‘এক্সকিউজ মি ম্যাডাম! প্রয়োজনটা আমার নয়, রীতা দেবীর। একটু আগেই তিনি কী একটা দরকারে আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। কথাবার্তা বলতে বলতে যান্ত্রিক গোলযোগে লাইনটা কেটে যায়। কাইন্ডলি মিস বিদ্যার্থীকে একবার ডেকে দিন। আপনি তো মিস্ শকুন্তলা দেবী? তাই না?’ জবাবে শকুন্তলা কড়া ধমক দেয়। আবার বিরক্ত করতে নিষেধ করে টেলিফোনটা নামিয়ে রাখে। লোকটা আর ফোন করেনি। বাসু ধন্যবাদ জানিয়ে লাইনটা কেটে দিলেন।

কৌশিক বললে, ওয়ান উইকেট ডাউন! মদ্র লোকটা কট-বিহাইন্ড হয়েছে। তার টেলিফোন নম্বরটা অন্তত জানতে পেরেছি আমরা।

বাসু বললেন, না। কট-বিহাইন্ড নয়। কট অ্যান্ড বোল্ড বাই সুকৌশলী! চিন্তা কর না, নাইন্টি-টু পার্সেন্ট চান্স লাঞ্চ শেষ হওয়ার আগেই দ্বিতীয় উইকেট পড়বে। এবার ক্লিন বোল্ড অপর্ণার গুগলিতে!

বাসুর কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। লাঞ্চ শেষ হবার আগেই অশোক মুখার্জি ফোন করে জানালো, সন্ত-মহারাজের নাম এস. স্বামীনাথন! বাগবাজার স্ট্রিটের ঠিকানাটাও দিতে পারল। বাসু ধন্যবাদ দিয়ে জানতে চাইলেন, ‘সন্ত-মহারাজ’ বলছ কেন?

অশোক জবাবে বললে, আমার স্বনামধন্য পূজ্যপাদ বাসু-মামু যে শুধু সাধুসন্তদের তত্ত্বতালাশ নিয়ে থাকেন তা আপনি জানেন না?

বাসু বললেন, দ্যাসে আ গুড পিস অব রেইলারি (raillery)।