সকল কাঁটা ধন্য করে – ৩

তিন

আরও ঘণ্টাখানেক পরের কথা। ডক্টর সান্যাল বিদায় হয়েছেন। মৃতদেহ অপসারিত হয়েছে। ফটো আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়ার কাজও সারা। শকুন্তলার তরফে কেষ্টা-মায়ের উপস্থিতিতে রীতার স্টিল-আলমারি খুলে নিখিল চিরুনি তল্লাশি করেছে। আশ্চর্য! রীতা বিদ্যার্থীর ফেলে-আসা জীবন সম্বন্ধে কোনও তথ্যই পাওয়া যায়নি। কোনও পুরানো দিনপঞ্জিকা, চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ—কিছু না। কিছু বই অবশ্য পাওয়া গেছে। তাতে রীতা বিদ্যার্থীর নাম লেখা। ঠিকানা এই বাড়ির। কিছু শাড়ি- ব্লাউজ, সালওয়ার-কামিজ, রাতের পোশাক, আন্ডার গার্মেন্টস্, প্রসাধন দ্রব্য, তোয়ালে, রুমাল এবং একটি ছোট বাঁধানো পার্সোনাল টেলিফোন-বই। নিখিল সেটা উল্টে-পাল্টে দেখল। কৌশিকও দেখল। বাসুও দেখলেন। সবই অচেনা নাম, অজানা ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বর। সবই কলকাতা শহরের। ইনসাইড লকারে কিছু স্বর্ণালঙ্কার—কানের দুল, আংটি, একপাটি বালা, একটা জরোয়া হার। একটা টফির কৌটায় পঞ্চাশ টাকার নম্বরি বান্ডিলে খান আষ্টেক নোট। সল্ট লেকে অবস্থিত একটি বিদেশী ব্যাঙ্কের সেভিংস অ্যাকাউন্ট চেকবই। তাতে দেখা যাচ্ছে এগারোই নভেম্বর, শুক্রবার, রীতা ছয় হাজার টাকা তুলেছে। সে টাকার কোনো চিহ্ন নেই।

বাসু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আদালতে উঠে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করতে পারব না—কিন্তু নাইন্টি-নাইন পার্সেন্ট চান্স ওই বেঁটে কালো লোকটা রবিবার সন্ধ্যাবেলা রীতার কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ব্ল্যাকমেলিং-এর ইনস্টলমেন্ট আদায় করেছে।

অনিমেষ বলে, পাঁচ হাজার তা কেমন করে বুঝলেন, স্যার?

—পঞ্চশ টাকার নম্বরী নোটে আলমারিতে আছে চারশ, ওর ভ্যানিটি ব্যাগে সাড়ে চারশ, আন্দাজ করছি ও খরচ করেছিল প্রায় দেড়শ টাকা—একুনে হাজার টাকা। দেয়ারফোর, ছয় হাজার মাইনাস হাজার ইজুক্যালটু পাঁচ হাজার হচ্ছে ব্ল্যাকমেলারের প্রাপ্য।

নিখিল বলে, কেষ্টার-মায়ের জবানবন্দি অনুসারে মিস্ রায় ভদ্রেশ্বরে চলে যাবার পরে রীতা জীবিত ছিল। কিন্তু পরদিন রবিবার সন্ধ্যায় সে কাজ সেরে যখন চলে যায় তখন কি ঐ মদ্রদেশীয় লোকটা এসেছিল।

বাসু বলেন, অ্যাশুমিং এসেছিল। তাতে কী প্রমাণ হয়?

অনিমেষ বলে, লোকটা অ্যান্টিসোশাল। রীতা দেবীকে জীবিতাবস্থায় সেই শেষ দেখেছে, এক্ষেত্রে সন্দেহটা তার উপরেই পড়ে না কি, স্যার?

—না, পড়ে না। যে হাঁস মাস-মাস সোনার ডিম পাড়ে তাকে কেন মারতে চাইবে ব্ল্যাকমেলার? তার উপর পিস্তলটা রীতার জিম্মাদারীতেই ছিল! ব্ল্যাকমেলারের নাগালের মধ্যে নয়।

—তাহলে আপনি কী বলতে চান?

—আমি বলতে চাই, আমাদের হাতে যা তথ্য আছে তা অপ্রতুল। ওই কেষ্টার-মা তার জবানবন্দিতে কী বলল?

অনিমেষ বলে, সে তো আজ সকালের কথা বলেছে। গতকাল সন্ধ্যার প্রসঙ্গ আমি তুলিইনি। তখনও আমি জানতাম না যে, ঐ মদ্রদেশীয় লোকটা কাল সন্ধ্যায় এসেছিল।

বাসু জানতে চান, কী যেন নাম? হ্যাঁ, কেষ্টার-মা। সে আছে, না চলে গেছে?

—না, স্যার। তাকে ছুটি দিইনি। সে নিচে বসে আছে।

—তাকে ডাক দিকিন একবার।

একটু পরেই কেষ্টার-মা এসে দাঁড়ালো। বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে বললে, দেখুন সাহেবরা! আমি ন্যায্য কথা কইব! আমি গতর খাটিয়ে খাই। পাঁচ-বাড়ি কাজকাম করে আমার সংসার চলে। তা আপনেরা আমারে এ কী আতান্তরিতে ফেললেন, ছার! হকাল থিকে বসি আছি তো বসিই আছি! আমার সময়ের কি দাম নাই?

বাসু নিক্কথায় তাঁর হিপ-পকেট থেকে ওয়ালেটটা বার করলেন। তা থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে বললেন, তুমি হক্কথা বলিছ, কেষ্টার-মা। পাঁচ কতার অ্যাকথা! লাও! এইডা ধর দিনি। এইডা হলো গে তোমার একবেলার মজুরি! বুঝলা? অখন বহু দেহি, এইহানে। যা জিগাই তার নিয্যস জবাব দাও!

কেষ্টার-মা অবাক হয়ে গেল। বললে, কী কন? হেইডা কি আমারে বকিশ দিতেছেন, সাহেব?

বাসু জবাবে বলেন, না! বকিশ লয়। ন্যায্য মজুরি। বহু দেহি ওইখানে! যা জিগাই তার জবাব দাও!

বাসু-সাহেব যদিও তাকে একটি চেয়ার দেখিয়েছিলেন, কিন্তু কেষ্টার-মা তাতে বসল না। থাপন-জুড়ে মাটিতেই বসে পড়ল। এরপর ওঁদের দুজনের ওই বিচিত্র গ্রাম্য ভাষায় দীর্ঘ আলাপচারী হলো। সওয়াল ও জবাব। যার সংক্ষিপ্তসার এইরকম :

আজ সকালে তার কাজে আসতে অনেক বেলা হয়ে গেছিল। দোষ কেষ্টার—ওর পুত্রের। সারারাত জেগে সে যাত্রা দেখেছে পূর্বরাত্রে। সকালে তার জ্বর আসে। ফলে কেষ্টার-মার দেরি হয়ে যায়। ও যখন এ বাড়িতে এসে পৌঁছায় ততক্ষণে রীতার ঘরের দরজা ভাঙা হয়ে গেছে। ‘তাই আজ সকালের কথা সে কিছুই জানে না। পুলিশের গাড়ি আসার পরে সে এসে পৌঁছায়।

তবে হ্যাঁ, গত কালকার কথ সে কিছু বলতে পারে। বড়দিদিমনি শনিবার ভদ্রেশ্বরে চলে গেছে কালীপূজার নিমন্ত্রণে। ছোড়দিমনি খায়নি। তার কালীপূজার ‘উপুস’। রাতে খাবে। তার রাতের খাবার মিটসেফে রাখা আছে। সেটা কালীপূজার দিন। বোমা-পটকা লেগেই আছে। কেষ্টার-মা পড়ন্ত বেলায় এসেছিল এ বাড়িতে—এঁটো বাসন ধুতে, জলের বোতল ভরে দিতে, আর ছাদ থেকে শোকানো কাপড়গুলো পেড়ে নামাতে। তখনো সন্ধ্যা হয়নি। সূর্য ডুবে গেছে, কিন্তু রাস্তায় বাতি জ্বলেনি। কেমন একটা আলো-আঁধারি ভাব। কেষ্টার-মার নজর হলো : গেটের পাশে সেই কালো ছোট্ট গাড়িটা ‘ভেঁড়িয়ে’ আছে। অর্থাৎ সেই মুখপোড়া বেঁটে মদ্রসাহেবটা আজ আবার ‘এয়েচেন’। কেষ্টার-মা ‘তাঁরে’ চেনে। বহুবার দেখেছে ঐ ‘খ্যালনা গাড়ি’ চেপে আসতে। ছোড়দিমনির চেনা মনিষ্যি। ‘পেরাইই’ আসে। কী সব গুজুর গুজুর ফুসুর-ফুসুর চলে। আজ্ঞে না, ‘আপনেরা’ যা ‘ভাবতিছেন তা লয়’। মিনষেড়া ছোড়দিমনির বাপ লয়, – জ্যাঠার বয়সী। তা সে যাগ্গে মরুয়ে। কেষ্টার মা হাতের কাজসেরে যখন বাড়িফানে যাবার ‘উয্যোগ’ করছে ‘ত্যাখনো মিষেডা বিদেয় হয়নি।’ কেষ্টার মা দোরের বাইরে থেকে ‘জান্তে চেইছিল : ছোড়দিমনি আমি তাইলে যাই?’

এই পর্যায়ে বাসু-সাহেব ওকে বাধা দিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, ওরা দুজন কোথায় বসে কথাবার্তা বলছিল? উপরের ঘরে না নিচের?

—ওমা আমি কনে যাব? ছোড়দিমনি কি অই হাড়হাবাতেরে নিজের শোবার ঘরে নে যাবে? বাইরের ঘরেই। কিন্তু কী বলব সাহেবরা! চুরুটের গন্ধে বমি আসে—ওয়াক্ থুঃ।

বাসু বলেন, তা বাড়ি যাবার কথায় তোমার ছোড়দিমনি কী বললেন?

—বুললে, যাও কেনে। তবে সদরদোরটা টানি দে যেও।

—ছোড়দিমনি তাহলে বাঙলা বলতে পারতেন?

—ওমা আমি কনে যাব? ছোড়দিমনি একবন্নও বাংলা জানত না। হিন্দি!

—বুঝলাম। তারপর?

কেষ্টার-মা নির্দেশমতো সদর দরজাটা টেনে দিয়ে চলে যায়। ‘ইয়েল-লক’ কপাট। তালাবন্ধ হয়ে যায় তৎক্ষণাৎ। তবে কেষ্টার-মার মনটা খচখচ্ করতে থাকে। বদ্ধঘরের ভিতর দুজনকে রেখে বাড়ি যেতে তার মন সরছিল না। ততক্ষণে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। বাড়ি বাড়ি রেলিঙে, ছাদের পাঁচিলে দীপাবলী জ্বলতে শুরু করেছে। মিত্তিরবাড়ির ছেলেরা রাস্তায় ‘বসান তুবড়িতে’ রোশানাই দিতে আরম্ভ করছে। কেষ্টার-মা ওই মিত্তিরবাড়ির রোয়াকে ‘টুক’ বসি গেল। খানিকপরে মিত্তিরবাড়ির মেজ-বৌ বাইরে বেরিয়ে আসে। বাজি ফোটানো দেখতে। তার দু’চার মিনিট বাদে শকুন্তলার বাড়ি থেকে ওই মদ্র-সাহেব বেরিয়ে আসে। দরজার বাইরে এসে ভিতর-বাগে তাকিয়ে হিন্দিতে বললে, ‘তোমার ভালর জন্যই বলছিলাম। মাস-মাস এ বখেড়া ভাল লাগে না। তোমারও না, আমারও না।’

তখন ছোড়দিমনি ঘরের ভিতর থেকে ‘অরে কী-যান বুইললে’। তার জবাবে মদ্রসাহেব ‘বুইললে’—’বেশ তো। তাড়াহুড়ার কী আছে? পরে ভেবে-চিন্তে আমারে জানিও।’ এই কথা বলে দরজাটা টেনে দিয়ে মদ্রসাহেব গাড়িতে উঠে বসে। তখন মিত্তিরবাড়ির মেজবৌ হঠাৎ জানতে চায়, ‘ওই লোকটা কে বল তো কেষ্টার-মা? প্রায়ই আসে দেখি শকুন্তলার কাছে?’ কেষ্টার-মা বলেছিল, ‘না, উনি ছোড়দিমনির কাছে আসে। কে, তা জানি না!”

বাসু-সাহেব জানতে চান, মদ্র-সাহেব যখন তোমার ছোড়দিমনির সঙ্গে কথা বলছিল তখন সে ছিল দরজার বাইরে, রাস্তায়; আর রীতা ছিল দরজার ওদিকে, বাড়ির ভিতরে। তাই তো?

—তাই তো বল আমি।

—তুমি তখন তোমার ছোড়দিমনিকে দেখতে পাচ্ছিলে?

—হ্যাঁ, তা পাব না কেনে? ছোড়দিমনি তো জবাবে বইলল…

—কী বলল?

—ঠিক মনে নাই। কী যেন এট্টা কথা বইলল, তখন মদ্রসাহেব বইল্‌ল, ‘ঠিগাছে, ঠিগাছে। তাড়াহুড়া করনের কোনো দরকার নেই। পরে আমারে বুইললেই হবে নে।’

বাসু বললেন, সে-কথা তুমি আগে বলেছ। তার মানে, ছোড়দিমনি কী বলেছে তা তুমি শোননি। তাকে দেখতে পেয়েছিলে কী?

কেষ্টার-মা বেশ কিছুক্ষণ ধরে চিন্তা করল। তারপর বলল, নিশ্চয় দেখতে পেইছিলাম বোধহয়। নইলে মদ্রসাহেব ওকথাডা বুলবে কেন, কন?

বাসু-সাহেব সায় দিলেন, তা তো বটেই। এবার আর একটা কথা জিজ্ঞেস করি। বল তো : ঐখানে যে ছবিটা ছিল সেটা কতদিন আগে সরানো হয়েছে?

বাসু-সাহেবের অঙ্গুলি নির্দেশে কেষ্টার-মা ঊর্ধ্বমুখ হলো। অবাকও হলো। বলল, অ-মা! ফটোকটা কই গেল?

–ছবিটা ভেঙে পড়েছিল না?

—কবে?

–কবে ভেঙে পড়েছিল, সেটা তো তোমার জানার কথা, কেষ্টার-মা। তুমি কাচগুলো ঝেঁটিয়ে ফেলে দিলে। মনে পড়ছে না?

–আপনে যে কী কন! ফটোকটা যে বেপাত্তা হই গেছে, তা অ্যাইমাত্তর আমার নজরে পড়ল।

—কার ফটোক ছিল গো?

—ছোড়দিমনির। অ্যাই খাটে শুয়ি শুয়ি ছোড়দিমনি কারে যান চিঠি লিতিছেল। ভারী সোন্দর ফটোকটা গো! কই গেল সেটা?

বাসু বললেন, আমিও তো তোমারে হেই কথাডাই জিগাই!