সকল কাঁটা ধন্য করে – ২

দুই

পরদিন। চোদ্দই নভেম্বর। সোমবার সকাল সাড়ে এগারোটা।

আজ কালীপূজার ভাসান। বাসু পরিবারের প্রাতরাশ অনেকক্ষণ শেষ হয়েছে। তবু আসরটা ভাঙেনি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে সবাই দু’তিনখানি সংবাদপত্র ভাগাভাগি করে পড়ছেন। কৌশিক দ্বিতীয় কাপ চা/কফির অর্ডার দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে কিনা চিন্তা করছে, এমন সময় বেজে উঠল টেলিফোন। বিশে ছিল সবচেয়ে দূরে; কিন্তু আর কেউ স্টার্ট নেবার আগেই সে হুমড়ি খেয়ে পৌঁছে গেল টেলিফোন যন্ত্রটার কাছে।

বাসু বলেন, অমন হুড়মুড় করে দৌড়াস কেন? তোর গদি তো কেউ কেড়ে নিচ্ছে না। টেলিফোন বাজলে তুইই প্রথম তুলবি।

বিশে ততক্ষণে ও-প্রান্তের কথা শুনে নিয়ে ‘কথামুখে’ হাত-চাপা দিয়ে বাসু-সাহেবকে বললে, ‘আপনের।’ –কথার সঙ্গে সঙ্গে কর্ডলেস ফোনের রিসিভারটা এগিয়ে দেয়।

বাসু বলেন, কে ফোন করছে?

—হুমোসাইড থেকে। নিখিল দাশ-সাহেব!

বাসু রানীর দিকে ফিরে বললেন, ছোকরা কেমন উন্নতি করছে, দেখেছ?

তারপর রিসিভারটা বিশের হাত থেকে গ্রহণ করতে করতে তাকে বলেন, ওটা ‘হুমোপাখি’ নয় রে বিশে : ‘হোমিসাইড’। পুলিশদের যে অফিস শুধু খুনোখুনির কিনারা করে তাদের বলে—’হোমিসাইড’। বুঝলি?

বিশ্বনাথ ঘাড় নেড়ে স্বীকার করে। অর্থাৎ তার জ্ঞানবুদ্ধি হয়েছে।

টেলিফোনে বাসু বলেন, বলো নিখিল, এত সকালে কী বলতে চাও?

—কলকাতা ইজুক্যালটু লন্ডন! কাল রাত্রে বোমাবাজির সুযোগে—

বাসু ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললেন, বুঝলাম। আর পিকাডেলি সার্কাস ইজ ইকোয়াল টু…?

—সল্ট লেক! আজ সকালে খবরটা এসেছে। মিনিট-পাঁচেক আগে। আমি যাচ্ছি। আসবেন নাকি? জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশনে রাজি আছেন?

বাসু বললেন, ডিপেন্ডস্! তুমি যদি আমার শর্ত দুটো মেনে নাও।

—শর্ত! কী শর্ত? দুটো শর্ত বললেন না?

—হ্যাঁ! প্রথমত, যে লোকটা সত্যিকারের খুনী তাকে বাদ দিয়ে তুমি একটা নিরীহ গোবেচারা লোককে অ্যারেস্ট করবে। দ্বিতীয়ত, গোবেচারা লোকটা যেন একেবারে ‘অদ্যভক্ষ্যধনুর্গুণ’ না হয়!

নিখিল হাসতে হাসতে বলে, এটা কী বলছেন, স্যার? আমি আপনার সাহায্য চাইছি যাতে ভুল করে কোনও নিরীহ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার না করি….

—তাহলে আমার সংসার কেমন করে চলবে, নিখিল? তুমি তো জানই, যাকে দোষী বলে মনে করি, তার কেস আমি নিই না, তাকে ‘গিটি প্লীড’ করতে বলি….

—তা তো বুঝলাম। কিন্তু আপনার শর্ত দুটি মানলে আমার সংসার কেমন করে চলবে, স্যার? ক্রমাগত ভুল লোককে অ্যারেস্ট করলে আমার যে ‘ডিমোশন’ হয়ে যাবে! যাবে না?

—কারেক্ট! ঠিক আছে! শোধবোধ… আমি আছি তোমার সঙ্গে—’উই আর ইন দ্য সেম বোট, ব্রাদার!’ রাস্তায় বসে যুগলবন্দিতে যদি হাপু গাইতে হয় তাও সই, তবু নিরপরাধীকে ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচাতে আমাদের যৌথ প্রচেষ্টা করতে হবে।

নিখিল বলে, আসলে কী হয়েছে জানেন, স্যার? অনেকদিন ধরে তো হোমিসাইডের কাজ করছি না—ছিলাম, নর্থ বেঙ্গলে; স্মাগলার আর গোর্খাল্যান্ড সামলাতে সামলাতেই…

—ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি।

—আমি কি আপনাকে পিক-আপ করে নেব?

—না। তাহলে লালবাজার থেকে তোমাকে উল্টোমুখো অনেকটা আসতে হবে। তুমি সোজা অকুস্থলে চলে যাও। আমি কৌশিককে নিয়ে এখনি আসছি। তুমি অ্যাড্রেসটা বলো শুধু—

নিখিল ঠিকানাটা জানায়। লবণ হ্রদের করুণাময়ী এলাকায় আট নম্বর জলের ট্যাঙ্কের কাছে। বলে, ঐ ওভারহেড ইন্‌জে-ট্যাঙ্ক থেকে পুব দিকে একটা রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলে একটা রিক্শ স্ট্যান্ড পাবেন। তার আগে একটা দোতলা বাড়ি দেখবেন। নম্বর খুঁজতে হবে না। কারণ আপনি ওখানে পৌঁছানোর আগেই পুলিশের গাড়ি পৌঁছে যাবে। কৌতূহলী জনতাই আপনাদের পথ বাৎলে দেবে। আমি এখনই রওনা হচ্ছি।

বাসু-সাহেব টেলিফোনটা ক্র্যাডেলে রেখে এদিকে ফিরলেন। কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ধড়াচুড়ো পরে নাও। গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বার কর।

কৌশিক বলে, কেন মামু? আপনারা দুজন রাস্তায় বসে যখন ‘হাপু’ গাইবেন তখন কি আমাকে তবলায় ঠেকা দিতে হবে?

বাসু ধমকে ওঠেন, জ্যাঠামো কর না।

রানী জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি দুপুরে বাড়িতে খাবে?

বাসু চলতে শুরু করেছিলেন। থমকে থেমে গিয়ে বলেন, কেমন করে বলব বল, রানু? কতক্ষণ লাগবে তা কি জানি? যেটুকু তথ্য জানা গেছে তা : কাল বোমা-পটকার আওয়াজের সুবাদে কেউ কাউকে গুলি করে মেরেছে। যে মারা গেছে সে জোয়ান না বুড়ো, পুরুষ কি স্ত্রীলোক তাও তো এখনো জানি না।

—তার মানে তোমরা দুজন বাইরে খাচ্ছ?

—তার মানে যদি তাই হয়, তো—তাই।

—অন্তত বিকাল পাঁচটার মধ্যে ফিরে এস। সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টায় ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কৌশিকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট।

—কেন? কৌশিকের আবার কী হয়েছে?

রানী দেবী জবাব দিলেন না। পূর্ণ ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। বাসু- সাহেব তৎক্ষণাৎ লজ্জিত হয়ে বলেন, ও আয়াম সরি! হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ডাক্তারবাবু, মানে… ইয়ে… ‘গাইনো’। আজ সুজাতার উইকলি চেকিং-এর দিন।

বাসু-সাহেবের ভুল তো হতেই পারে। সাংসারিক বিষয়ে তিনি চিরদিনই এলোভুলো। কাহিনীকার হিসাবে আমারই তো একটা মারাত্মক ত্রুটি হয়ে গেছে। আপনাদের আগেভাগে জানানো হয়নি। ‘ড্রেস-রিহার্সালের কাঁটা’ সমূলে উৎপাটনের পর, সকল কাঁটা ধন্য করে এ পরিবারে একটি গোলাপকুঁড়ি ফুটবার উপক্রম করছে। গাইনো যে সম্ভাব্য তারিখ বাৎলেছেন সেই সুদিনের জন্য আর হপ্তাখানেক মাত্র অপেক্ষা করতে হবে।

এইখানে কিছু ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। যাতে গল্পের ধরতাইটা আপনারা ধরতে পারেন। তাই বা কেন, এ ব্যাখ্যা তো এই গল্পের নামকরণের পক্ষে আবশ্যিক। যাঁরা ‘ড্রেস- হিহার্সালের কাঁটা’ ইতিপূর্বে পাঠ করেননি তাঁদের জন্য পূর্ববর্তী কাহিনীর কিছু পূর্বকথন শোনানো গেল।

‘ড্রেস-রিহার্সালের কাঁটা’ কাহিনীতে বাসু-সাহেব একসময় বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। পুলিশ তখনো কাউকে অ্যারেস্ট করেনি, ফলে বাসু-সাহেবের কোনো ক্লায়েন্ট নেই। কিন্তু যে নির্বিরোধী পাদরী এবং বিশ্ববন্ধু ডাক্তারবাবু গল্পের প্রথম দিকে খুন হয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের বন্ধুত্বের ঋণ শোধ করতেই যেন ‘সু-মটো’ তদন্ত শুধু করেছিলেন ব্যারিস্টার-সাহেব। সম্ভাব্য চার পাঁচজন অপরাধীর মধ্যে ইন্দ্রকুমার জানিয়েছিল মৃত্যুর সময় সে ছিল ঘটনাস্থল থেকে অনেকটা দূরে : গালুডিতে, মানে ঘাটশিলায়, ‘সুবর্ণরেখা’ হোটেলে। বাসু সেই ‘অ্যালেবাইটা যাচাই করতে সুজাতা আর কৌশিককে গালুডিতে পাঠিয়ে দিলেন, দু’দিনের জন্য। কৌশিক বলেছিল, ‘আপনিও চলনু না, মামু।’ বাসু রাজি হননি। রানুকে নিউ আলিপুরে একা রেখে তিনজনের ঘাটশিলা যাওয়া সম্ভবপর নয়। সে-কথা অবশ্য মুখে বললেন না। বললেন, তোমরা প্রাথমিক তদন্তটা সেরে এস তো। তারপর দরকার হলে আমি না হয় আবার একাই যাব।

কৌশিক ও সুজাতা যুগলে ঘাটশিলা রওনা হয়ে যাবার পরদিন সকালে প্রাতরাশে বসেছেন বুড়োবুড়ি। পট থেকে কফি ঢালতে ঢালতে রানু বললেন, একদিক থেকে ওদের দুজনকে গালুডি পাঠানোটা ভালোই হয়েছে।

বাসু নির্মাখন টোস্টে কামড় দিতে দিতে বললেন, কোন দিক থেকে?

—তোমার পাল্লায় পড়ে ওরা দুটি তো গোল্লায় গেছে। দিবারাত্র শুধু খুনজখম, তদন্ত- মদন্ত নিয়ে মেতে আছে। রাতদিন কর্তাগিন্নি শুধু চোর-পুলিশ খেলছে। ওরা দুজন বোধহয় এতদিনে ভুলেই গেছে যে, ওদের সম্পর্কটা শুধু ‘সুকৌশলী’-র পার্টনার হিসাবেই শেষ হয়ে যায় না : ওরা দুজন স্বামী-স্ত্রী। যাক্ দুদিন ঘাটশিলায় ফূর্তি করে আসুক।

বাসু হাসলেন। বলেন : তা ঠিক!

—না, শুধু হাসলে হবে না। তুমি একটা জিনিস হিসাব করে দেখেছ? ওদের এত বছর বিয়ে হয়েছে, অথচ আজও বাচ্চা-টাচ্চা হয়নি! কেন? বাচ্চা হয় না কেন? আপত্তিটা কার? কিসের?

বাসু আমতা-আমতা করে বলেন কী আশ্চর্য! তা, আমি কেমন করে জানব?

রানী চটে ওঠেন, বটেই তো! তুমি কেমন করে জানবে? সন্তান না হবার অপরাধে ওদের যখন পুলিশে ধরছে না, তখন তুমি তো নির্লিপ্ত! তুমি জান না, আমি জানি!

—কী জান?

—ওদের দুজনের মধ্যে কারও কোনও শারীরিক ত্রুটি নেই। সুজাতা আমার কাছে স্বীকার করেছে। ওদের সন্তান হচ্ছে না—কারণ ওরা সেটা চাইছে না। তাহলে ওদের ‘সুকৌশলী’-র কাজে ক্ষতি হবে।

র-কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বাসু সংক্ষেপে বলেন : আই সী!

রানী খেঁকিয়ে ওঠেন, য়ু সী নাথিং! কিছুই দেখতে পাও না তুমি। কারণ, তুমি ছুঁচোর মতো অন্ধ! কী দেখবে তুমি? দেখবার চোখ তোমার আছে? চোর-পুলিশ খেলার বাইরে যে দুনিয়াটা আছে তা কখনো চোখ তুলে দেখেছ? সুজাতার বয়স কত হলো বল তো? এর পর ‘ফার্স্ট কনসাইনমেন্ট’ যে বিপদজনক তা কি তুমি জান না? ওদের এখনি একটা সন্তান হওয়া উচিত। ছেলে অথবা মেয়ে। এ সংসারে একটা চুন্নিমুন্নি বাচ্চা এলে সকলের জীবন—বিশেষ করে আমার এই বন্ধ্যা-জীবন- কেমন আনন্দঘন হয়ে উঠবে তা তুমি কোনোদিন ভেবে দেখেছ?

বাসু রীতিমতো বিব্রত হয়ে বলেছিলেন, কী আশ্চর্য! তা এ বিষয়ে আমি কী করতে পারি, বল?

—তুমিই তো যত নষ্টের গোড়া! ওদের ফুলশয্যার রাত ভোর হলো-কি-হলো না তুমি ওদের কাঁটা দিয়ে খোঁচাতে শুরু করলে! তারপর থেকে ক্রমাগত কাঁটার পাহাড় বানিয়ে চলেছ। কাঁটার পরে কাঁটা! একটা কাঁটা শেষ হতে-না-হতেই : আবার কাঁটা! কোনো বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই—শুধু কাঁটা আর কাঁটা! ডাইনে কাঁটা, বাঁয়ে কাঁটা, হেঁটোয় কাঁটা, মুড়োয় কাঁটা! বলি, সকল কাঁটা ধন্য করে গোলাপ-ফুলটা কি ফুটবার সুযোগ পাচ্ছে?

বাসু তাঁর ফাঁকা হয়ে আসা পাকাচুলে আঙুল বুলিয়ে কী একটা কথা জবাবে বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই বেজে উঠল টেলিফোনটা।

রানু বললেন, ঐ শুরু হয়ে গেল! স্বামী-স্ত্রীতে মন খুলে দুটো সংসারের কথা বলার সুযোগ নেই। তার মাঝখানে শুরু হয়ে গেল খোঁচানি : ‘টেলিফোনের কাঁটা’!

.

দিন-তিনেক পরে ঘাটশিলা থেকে ওরা যুগলে ফিরে এল। সুজাতা আর কৌশিক। হাওড়া থেকে ট্যাক্সি নিয়ে যখন নিউ আলিপুরের বাড়িতে এসে পৌঁছালো তখন পাড়া সুনসান। রাত সাড়ে দশ। কলবেল বাজাতে, ম্যাজিক-আই দিয়ে ভালো করে দেখে নিয়ে বিশে সদর দরজা খুলে দিল।

কৌশিক জানতে চায়, কি রে বিশে? মামা-মামী শুয়ে পড়েছেন?

—না তো। ঘরে বসে গপ্পোসপ্পো করছেন। সাহেব আজ সেইটা বার করেছেন!

হাতের মুদ্রায় শ্যিভাস-রিগ্যালের বোতলটা দেখায়।

সুজাতা জানতে চায়, তুই খেয়ে নিয়েছিস?

—না। এবার খাব। আপনেরা?

—আমরা রাতে খাবো না। ট্রেনেই খেয়ে নিয়েছি। মামিমা জিজ্ঞেস করলে বলে দিস্।

ঠিক তখনই করিজোরের ও-প্রান্তে একটা সুইট কেউ জ্বালল। হুইল-চেয়ারে পাক মেরে রানু এগিয়ে আসেন। বলেন, এই তো! এসে গেছ তোমরা। রাতের খাবার ফ্রিজে রাখা আছে। বিশে শুধু গরম করে দেবে।

কৌশিক বলে, না, মামিমা, হোটেল থেকে প্যাকেট নিয়েছিলাম। আমরা ট্রেনেই রাতের খাবার সেরে নিয়েছি। ফ্রিজে যা রাখা আছে তা কাল সকালে সদ্ব্যবহার করা যাবে। মামু কি শুয়ে পড়েছেন?

রানু বললেন, না! তাঁর এখন থার্ড পেগ চলছে। একটু আগে উনি আমাকে বলছিলেন—খুনীটা কে তা উনি জানেন কিন্তু পুলিশকে জানাতে পারছেন না।

সুজাতা জানতে চায় : কেন?

—কারণ ওঁর বিশ্বাস : গিল্টি-ভার্ডিক্ট হবার মতো এভিডেন্স উনি এখনো যোগাড় করতে পারেননি। উনি পুলিশকে জানালেই লোকটা ‘অ্যারেস্টেড’ হবে। সে সজাগ হয়ে যাবে!

কৌশিক বলে, লোকটা কে তা বলেছেন? আই মীন, উনি কাকে সন্দেহ করছেন?

—সন্দেহ নয়, কৌশিক, উনি বলছেন যে, লোকটাকে নির্ভুল ভাবে সনাক্ত করেছেন। যাহোক তোমরা গিয়ে ঘাটশিলা-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টটা দাখিল কর; দেখি, সেই মওকায় হাতসাফাই করে বোতলটা সরিয়ে ফেলতে পারি কি না।

তিনজনে এগিয়ে আসেন বাসু-সাহেবের ঘরে। সে-ঘরে স্তিমিত একটা সবুজ আলো জ্বলছে। উনি একটা ইজিচেয়ারে লম্ববান। পাশে টি-পয়তে গ্লাস-বোতল-স্ন্যা-জল, আইস কিউব।

সুজাতা-কৌশিক এদিক থেকে প্রাচীন ভারতীয় শালীনতা মেনে চলে। মাত্র দু’দিনের ভ্রমণান্তে ফিরে এসে দুজনেই বাসু-সাহেবকে প্রণাম করল। মামীকেও

বাসু সোজা হয়ে সোৎসাহে উঠে বললেন : অ্যাই যে মিস্টার অ্যান্ড মিসেস্ সুকৌশলী! গুড-ঈভনিং! আপনারা দুজন যে নিরাপদে ফিরে আসতে পেরেছেন এতেই আমরা কৃতার্থ।

বোঝা গেল, সাড়ে তিন পেগেই বাসু-মামুর নেশাটা জমজমাট!

রানু ইতিমধ্যে কায়দা করে হুইল-চেয়ারটা টি-পয়ের ওপাশে নিয়ে গেছেন। বোতলটাও দখল করেছেন। বলেন, ওদের কাছ থেকে প্রাথমিক রিপোর্টটা এবার শুনে নাও। বিস্তারিত কাল সকালে শুনো বরং!

বাসু ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, তা না হয় শুনব। কিন্তু…তুমি…মানে, ইয়ে…ওটা নিয়ে যাচ্ছে কেন?

রানু বোতলটা সুজাতাকে হস্তান্তরিত করে বলেন, তোমার বরাদ্দ মতো দু’পেগ খতম করে একটা এক্সট্রা পেগও ঢালা হয়ে গেছে। আর নয়।

প্রসঙ্গটা চাপা দিতে কৌশিক বলে ওঠে, আমাদের মিশন সাকসেসফুল! বুঝলেন মামু?

বাসু ইজিচেয়ারে এলিয়ে পড়ে বলেন, রীয়েলি? কী মিশন নিয়ে তোমরা ঘাটশিলা গেলে, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস্ সুকৌশলী?

—বাঃ! আপনার মনে নেই? ঘোষাল-হত্যা মামলায় চার-চারজন সম্ভাব্য অপরাধীর কথা আপনি ভাবছিলেন—ব্রজবাবু, ইন্দ্রকুমার, অ্যাগি আর ডক্টর দাশ। তাই আপনি আমাদের দুজনকে ঘাটশিলায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, ইন্দ্রকুমারের ‘অ্যালেবাই’টা যাচাই করে দেখতে। দ্যাট চ্যাপ্টার ইজ ক্লোজড। ইন্দ্রকুমার ইজ অ্যাকুইটেড। মানে, ঐ চারটি সম্ভাব্য কাঁটার ভিতর থেকে তাকে সমূলে উৎপাটিত….

—কী? কী? কী বললে? কিসের থেকে?

—সম্ভাব্য কণ্টক! কাঁটা—

কোথাও কিছু নেই, ব্যারিস্টার সাহেব একেবারে দুর্বাসা মুনি : তোমরা কি আমাকে একটুও শান্তিতে থাকতে দেবে না, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস্ সুকৌশলী? মধ্যরাত্রে একা বসে মৌজ করছি, সেখানেও তোমরা হাঁউ মাঁউ খাউ রাক্ষসের মতো তাড়া করে এসেছ ‘কাঁটা-কাঁটা’ করতে করতে? কী পেয়েছ তোমরা? শুধু কাঁটা আর কাঁটা? একটা শেষ হতে না হতেই আর একটা কাঁটা! হেঁটোয় কাঁটা—মুড়োয় কাঁটা! তাহলে সকল কাঁটা ধন্য করে জোলাপটা কখন ফুটবে? অ্যাঁ? আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন মিস্টার অ্যান্ড মিসেস্ সুকৌশলী?

রানু কৌশিকের আস্তিন ধরে টানলেন। ওদের ইঙ্গিত করলেন কেটে পড়তে। তাই পড়ল ওরা। নিঃশব্দে। পা টিপে টিপে। বাসু ক্লান্ত হয়ে আবার ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়েছেন। তাঁর চোখ দুটি বোঁজা। অস্ফুটে শুধু বলে চলেছেন : দিস্ ইজ ডিজগাস্টিং! হেঁটোয় কাঁটা, মুড়োয় কাঁটা, সামনে কাঁটা, পিছনে….

সুজাতা ফিস্ ফিস্ করে রানুর কাছে জানতে চায়, মামা কি আজ একেবারে আউট? জোলাপের কথা কী যেন বললেন?

রানু হাসলেন। বলেন : উনি না হয় তিন পেগের পর মুখ ফকে কথাটা বলে ফেলেছেন। কিন্তু তোমরা দুজন তো মদ্যপান করনি। বুঝতে পার না—উনি ‘জোলাপে’র কথা বলছেন না আদৌ! বলছেন : গোলাপের কথা।

সুজাতা অবাক হয়ে বলে : গোলাপ! মানে?

রানু বলেছিলেন, গোলাপ একটা ফুলের নাম, সুজাতা। তুমি সে-কথা অনভ্যাসে বেমালুম ভুলে গেছ! একটু চেষ্টা করে দেখ, মনে পড়ে যাবে! এখন যাও, শুয়ে পড়।

—কিন্তু মামু যে…

—ভবের ভ্রূকুটির ভাবনাটা ভবানীকেই ভাবতে দাও, সুজাতা। তোমরা দুজন বরং ভেবে দেখ হঠাৎ গোলাপের কথাটা উনি তোমাদের শুনিয়ে দিলেন কেন? ‘কাঁটা’ নয়, ‘গোলাপ’!

.

এ ঘটনা প্রায় বছর খানেক আগেকার। ইতিমধ্যে ঘোষাল-হত্যা মামলার জট খুলেছে। সেসব কথা বিস্তারিতভাবে লেখা হয়েছে ড্রেস-রিহার্সালের কাঁটায়। তারপর আরও এটা কণ্টক উৎপাটন করতে হয়েছে বাসু-সাহেবকে। একেবারে একা হাতে। না সুজাতা, না কৌশিক কেউই ওঁকে সেবার সাহায্য করতে পারেনি। সে ঘটনা বেলডাঙার কাছাকাছি মোহনপুর গ্রামে, মুর্শিদাবাদ জেলায় : দর্পণে প্রতিবিম্বিত কাঁটা।

এবারও বাসু-সাহেবকে, একা-একাই লড়তে হচ্ছে। সুজাতা যেকোনো দিন নার্সিংহোমে ভর্তি হতে পারে। আর রানু দেবীর কড়া নির্দেশ কৌশিককে কলকাতার বাইরে পাঠানো চলবে না। কলকাতার চৌহদ্দির মধ্যে কৌশিকের গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। আর সুজাতা শুধু সামনের লন-এ পায়চারি করতে পারে। রানুর নজরবন্দি অবস্থায়।

.

ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস ধরে ড্রাইভ করতে করতে কৌশিক পার হলো সায়েন্স সিটি, যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন। ক্রমে লবণহ্রদ নবনগরীতে প্রবেশ করে ওঁরা সোজা চলে এলেন আট নম্বর জলের ওভারহেড ট্যাঙ্কে। সেখানে থেকে ডান দিকে মোড় নিয়ে কিছুটা অগ্রসর হতেই অকুস্থলে পৌঁছে গেল কৌশিক। একটা দোতলা বাড়ির সামনে কৌতূহলী মানুষের জটলা। রাস্তার বাঁদিকে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ-ভ্যান। এদিকটা খুব ঘনবসতি নয়। ফাঁকা প্লটে একটা বস্তি মতো গড়ে উঠেছে। তা থেকে বহু মানুষ এসে ভিড় করেছে দোতলা বাড়ির সামনে। তবে পুলিশ তাদের বেশ কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছে। বাড়ির খুব কাছাকাছি ঘেঁষতে দেয়নি।

পুলিশ-ভ্যানের পশ্চাৎভাগে পার্কিঙের সৌভাগ্য লাভ করায় কৌশিক তার গাড়িটা ‘লক্‌’ করার কোনও প্রয়োজন বোধ করল না। শুধু ইনিশন থেকে চাবিটা খুলে নিয়ে হিপ-পকেটে রাখল। দুজনে বাড়ির দিকে অগ্রসর হতেই নিখিল বিপরীত দিকে থেকে এগিয়ে এল। রাস্তায় কেউ কোনো কথা বললেন না। নিখিলের নেতৃত্বে বাসু-সাহেব আর কৌশিক সদর দরজা অতিক্রম করলেন। নিখিল দরজাটা ঠেলে বন্ধ করে দিল। সদর দরজায় ইয়েল-লক

বাড়িতে ঢুকতেই একটা বড় হল-কামরা। সামনের দিকে বৈঠকখানা বা ড্রইংরুমের আকারে সোফা-সেট দিয়ে সাজানো। একটা সেন্টার-টেবিল। এক দিকে স্ট্যান্ডের উপর টি.ভি.। পাশে একটা লোহার আলমারি। বিপরীত দিকে কাচের আলমারিতে বই ও শৌখিন ‘কিউরিও’ সাজানো। ওদিকে কাশ্মীরি জারিকাটা কাঠের পার্টিশন দেওয়াল। তার ও-পাশে চারজনের উপযুক্ত ছোট ডাইনিং টেবিল ও চেয়ার। হল-কামরার ডান দিক দিয়ে কাঠের রেলিং সমন্বিত সিঁড়ি দ্বিতলে উঠে গেছে। সিঁড়ির তলাটাও সুদৃশ্য কাঠের প্যানেলিং করা তাতে একটা ছোট্ট একপাল্লার দরজা। কাচের শার্শি পাল্লা। কিন্তু কাচের উপর কালো কাগজ আঠা দিয়ে সাঁটা। মনে হয় গুদাম ঘরটা নীরন্দ্র অন্ধকার। মোজেইক মেঝে, ‘সেম’-পেন্টিং করা দেওয়াল।

ওঁরা ভিতরে আসতে ড্রইংরুমের গদি-ঠাশা সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো বছর পঁয়ত্রিশের একজন সুপুরুষ পুলিশ সার্-ইন্সপেক্টার। লোকাল থানার।

নিখিল বলে, বল, অনিমেষ, এ পর্যন্ত যেটুকু জেনেছ—

বাসু বাধা দিয়ে বললেন, রসো! তার আগে আমরা গুছিয়ে বসি। তুমিও বস, অনিমেষ। আমাকে চেন তো?

অনিমেষ বললে, পুলিশে চাকরি করছি আজ সাত বছর। ফলে শুধু আপনাকে নয় স্যার, কৌশিকবাবুকেও বিলক্ষণ চিনি।

—ঠিক আছে। এবার শুরু কর।

সবাই বসলেন। অনিমেষ সংক্ষেপে ঘটনার বিবরণ দিল :

প্রয়াতার নাম রীতা বিদ্যার্থী। অবাঙালী। বয়স আন্দাজ ছাব্বিশ-সাতাশ। এই বাড়িরই বাসিন্দা। বাড়ির মালকিন শকুন্তলা রায়ের বান্ধবী। এ বাড়ির নির্মাতা শকুন্তলার পিতৃদেব। তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর প্রয়াণের পর বর্তমানে গোটা বাড়িটাই শকুন্তলা ভোগ করে, যদিও অর্ধেক মালিকানা তার দাদার। সে আছে মার্কিন মুলুকে, সপরিবারে। রীতা ভাড়াটে হিসাবে থাকত অথবা বন্ধবী হিসাবে, কিংবা পেইং গেস্ট হিসাবে, সেই স্থূল প্রশ্নটা এখানো জানা হয়নি অনিমেষের। তবে এটুকু জেনেছে যে, ওরা দুজনে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল। দুজনের একই বয়স। শকুন্তলা গত পশুদিন তাঁর মাসিমার বাড়ি গিয়েছিলেন সপ্তাহান্তে। ভদ্রেশ্বরে। কালবাতি লেন- এ! সে বাড়িতে কালীপূজা হয়। আজ সকালে—মূর্তি বিসর্জন না হওয়া সত্ত্বেও তিনি ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। রীতা সপ্তাহান্তটা একাই ছিলেন এ বাড়িতে। শকুন্তলা ফিরে আসেন আজ সকালে। সদর দরজায় ইয়েল-লক লাগানো। তার দুটো চাবি। এক-একটা এক-একজনের কাছে থাকত। ফলে মিস্ শকুন্তলা কল-বেল বাজাননি। চাবি খুলে ভিতরে আসেন। একতলায় তিনি কাউকে দেখতে পাননি। একজন কাজের লোক সচরাচর বেলা নয়টা নাগদ আসে। সে- ই রান্না করে, বাসন ধোয়, ঘর মোছে। শকুন্তলা তাকে একতলায় দেখতে পাননি, যদিও তখন বেলা দশটার কাছাকাছি। নিচে কাউকে দেখতে না পেয়ে শকুন্তলা সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতলে উঠে যান। দেখেন, রীতার দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। বেশ কয়েকবার জোরে জোরে ধাক্কা দিয়েও শকুন্তলা তাঁর বান্ধবীর সাড়া পাননি। এত বেলা পর্যন্ত সচরাচর সে ঘুমায় না। তাছাড়া ওঁদের দু’জনের মধ্যে একটা অলিখিত বোঝা-পড়া আছে—কেউ যদি বাড়ি তালাবন্ধ করে বার হয়ে যায় তাহলে সিঁড়ির লাগোয়া স্টিল আলমারির পাল্লায় ‘ম্যাগনেট-নব’-এ চাপা দিয়ে একটা চিরকুট রেখে যায়—কখন ফিরবে, বা কোথায় যাচ্ছে জানিয়ে। শকুন্তল দেখলেন আলমারির গায়ে কোনও চিঠি চুম্বকী-বেতামে আটকানো নেই। উনি অত্যন্ত ভয় পেয়ে যান। ওঁদের বাড়িতে একটাই ফোন—একতলার ড্রইংরুমে। উনি নেমে এসে স্থানীয় থানায় টেলিফোন করে সাহায্য প্রার্থনা করেন। লোকাল থানা ফোনটা পায় দশটা বেয়াল্লিশে। থানা কাছেই। মিনিট পনেরর মধ্যে থানা থেকে পুলিশ এসে যায়। দরজাটা তারাই ভাঙে। বস্তুত অনিমেষ নিজেই তা ভাঙে দুজন কন্সটেবল-এর সাহায্যে।

রীতা বিদ্যার্থী পড়েছিল মেঝেতে। জমাট বাঁধা রত্তের গালিচায়। মাথায় গান-শট উন্ড। তার হাতে ধরা আছে পয়েন্ট টু-টু বোরের একটা অটোমেটিক পিস্তল। জানলার পাল্লা ভিতর থেকে ছিট্‌কিনি বন্ধ ছিল। দরজাটা তালাবন্ধ ছিল। ফলে আপাতদৃষ্টিতে কেসটা আত্মহত্যা মনে হলেও অনিমেষ মৃতদেহকে কোনো রকম নড়াচাড়া না করে সোজা হোমিসাইডকে খবর দিয়েছিল।

নিখিল জানতে চায়, প্রথমত বল, তুমি এটাকে হোমিসাইড কেস বলে ভাবলে কেন? দরজা-জানলা ভিতর থেকে বন্ধ। এক্ষেত্রে আত্মহত্যা নয় কেন?

—কোনও ‘সুইসাইডাল নোট’ আমরা খুঁজে পাইনি।

—বুঝলাম। আর কিছু?

—লক্ষ্য করে দেখুন, স্যার, দরজায় যে গা-তালা তা ‘ইয়েল-লক’ নয়। অর্থাৎ ঠেলে বন্ধ করলেই লক করা যায় না। চাবি ঘুরিয়ে তালাবন্ধ করতে হয়। রীতা দেবী যদি তাই করে থাকেন, তাহলে চাবিটা গেল কোথায়?

—তোমরা খুঁজে পাওনি?

—না, স্যার। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও চাবিটা ঘরের ভিতর পাইনি।

নিখিল মাথা নিচু করে কী যেন ভেবে নিল। তারপর জানতে চাইল, শখুন্তলা দেবী কোথায়?

—নিচে যে ড্রইং-কাম-ডাইনিং রুম আছে তার পাশেই ওঁর শয়নকক্ষ। উনি সেই ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন। খুবই ভেঙে পড়েছেন তিনি। তাঁকে খবর দেব?

নিখিল বাসু-সাহেবের দিকে তাকায়। তিনি বলেন, চল, আগে হতভাগিনীটাকে স্বচক্ষে দেখি। তারপর শকুন্তলার সঙ্গে কথা হবে। তাকে বরং একটু সামলে নেবার সময় দাও।

ওঁরা চারজনে সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতলে উঠে এলেন। সিঁড়ির চাতাল অতিক্রম করে একটা বড় বেডরুম। দরজাটা খোলাই আছে। এটা রীতা বিদ্যার্থীর শয়নকক্ষ। সেটার দিকে এগিয়ে যেতে ঘরে উপস্থিত একজন সৌম্যদর্শন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক আহ্বান জানালেন, আসুন, দাশসাহেব।

তারপর বাসু-সাহেবকে দেখে বলে ওঠেন, আরে! ব্যারিস্টার-সাহেব যে! আপনি এত সকাল-সকাল? ‘হোমিসাইড’ কেসটা নিতে না-নিতেই আপনার মক্কেল জুটে গেল?

বাসু বললেন, না হে, না। কোনো মক্কেলের তরফে আসিনি। এটা হোমিসাইড কেস না আত্মহত্যা তাই তো এখনো স্থির হয়নি। আমাকে নিখিল সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। এ কেসে আমি এখানে নিখিলের অ্যাসিস্টেন্ট—

নিখিল বাধা দিয়ে বললে, ওকথা বলবেন না, স্যার! আপনি আমার গার্জেন হিসেবে এসেছেন। ফ্রেন্ড, ফিলজফার অ্যান্ড গাইড!

বাস্তবে ঘরের ভিতর যিনি বসেছিলেন তিনি পুলিশ বিভাগের অটোপ্সি সার্জেন, ডাক্তার অতুলকৃষ্ণ সান্যাল। তাঁর এখানে আসার কথা নয়। মৃতদেহ তিনি সচরাচর দেখতে পান শবব্যবচ্ছেদাগারে। তবে ডক্টর সান্যালের বাড়ি সল্ট লেকে, কাছেই। অনিমেষ তাঁকে ফোনে খবর দেয়। তাই উনি এত সকালে এসেছেন।

আগন্তুক চারজনেরই দৃষ্টি পড়ল ভূলুণ্ঠিতার উপর। হ্যাঁ, অনিমেষের আন্দাজ ঠিকই। মেয়েটি ত্রিশের নিচে। অত্যন্ত সুন্দরী। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, মাথায় সোনালী চুল, পরনে সালোয়ার-কামিজ। হঠাৎ দেখলে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বলে মনে হয়। মৃতদেহের ডানহাতে ধরা আছে ছোট্ট পিস্তলটা। বেশ বোঝা যায়, গুলিবিদ্ধ হবার সময় সে বসেছিল একটা সোফায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে সে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। তার দোপাট্টার অনেকটা এখনো সোফার উপর নেতিয়ে আছে। মেয়েটির বাঁ-কানের উপর একটা গভীর ক্ষত। নিঃসন্দেহে বুলেট-উন্ড। তা থেকে একটা রক্তের ধারা ওর গাল বেয়ে কামিজে নেমে এসেছে।

নিখিল ডক্টর সান্যালের দিকে ফিরে বললে, সুইসাইড?

ডক্টর সান্যালের ভ্রূকুঞ্চন হলো। বললেন, আইনত কাটাছেঁড়ার আগে আমার কথা বলা মানা। কিন্তু এক্ষেত্রে আমি অটোন্সি সার্জেন হিসাবে আসিনি। এসেছি প্রতিবেশী হিসাবে। অনিমেষ ঘোষ ডেকে পাঠিয়েছিল বলে। তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি : ‘ডালমে কুছ কালা হ্যায়!”

নিখিল প্রশ্ন করে, কী জাতের গোলমাল?

ডঃ সান্যাল বললেন, পোজিশন ঠিকই আছে। ওই সোফাটায় বসে মাথার বাঁ-দিকে গুলি লাগলে এভাবেই মেজেতে পড়ে যাবার কথা। দরজা ভিতর থেকে ‘লক্’ করা ছিল। সব কটা জানলাও বন্ধ ছিল, ছিটকানি লাগানো, এখন যেমন আছে।

—তাহলে ডালমে ‘কালাটা কোথায় দেখলেন?

দুদিকে মাথা নেড়ে সান্যাল বলেন, পিস্তলের গ্রিপটা ভালো করে দেখুন। আমি ডেডবডিকে স্পর্শ করিনি। সুধাকর যতক্ষণ না আসছে, যতক্ষণ ফটো তোলা না হচ্ছে ততক্ষণ ছোঁয়াছুঁয়ি করা ঠিক নয়। তাছাড়া নন্দী এসে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিক্…

মৃতদেহের পাশে উবু হয়ে বসে নিখিল বলল, কারেক্ট। দেখে মনে হচ্ছে পিস্তলটা ওর হাতে রাখা আছে। যেন ধরা ছিল ওর মৃত্যু মুহূর্তে; কিন্তু আসলে তা নয়। পিস্তলটা কেউ ওর মুঠিতে গুঁজে দিয়েছে…

ডাক্তার সান্যাল বলেন, কারেক্ট! পিস্তলটা ওর হাতে আছে, ‘গ্রিপ্’-এ নেই!

নিখিল হঠাৎ বলে ওঠে, আরও একটা অসঙ্গতি : দক্ষিণ হস্ত এবং বাম কর্ণ!

বাসু-সাহেব ইতিমধ্যে গোটা ঘরখানা খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করেছেন। ঘরে আসবাব বেশি নেই। একটা সেন্টার-টেবিল, খান তিনেক চেয়ার। পিছনে একটা স্টিল-আলমারি। এ ছাড়া যেটা নজরে পড়ে তা হলো একটা লেখার টেবিল। ঝকঝকে পালিশ-করা মেহগনি কাঠের। এমন জিনিস আজকাল শুধু অক্সান মার্কেটে পাওয়া যায়। টেবিলের উপরটা মোটা প্লেট-গ্লাসে চাপা দেওয়া। কাচের নিচে অনেক সুন্দর-সুন্দর ফটোগ্রাফ। অধিকাংশই প্রাকৃতিক দৃশ্য। কিছু আছে মানুষের। দু’একটি ঐ মৃতা মেয়েটির। প্রতিটি ফটোই অতি নিখুঁত। ভাল ক্যামেরা- পার্সেন-এর হাতের কাজ। দেওয়ালেও অনেকগুলি এনলার্জড ফটোগ্রাফ। ফ্রেমে বাঁধানো। অথবা লামিনেট করা। গৃহস্বামিনীর রুচি অনুসারে প্রাচীন ও আধুনিক যুগের এক বিচিত্ৰ সংমিশ্রণ। মান্ধাতা আমলের মেহগনি কাঠের টেবিল, তার গামছা-মোড় পায়া, টেবিলের উপর প্লেট-গ্লাসের আচ্ছাদন। আবার তার উপর একটা প্রাচীন যুগের ব্লটিং-পেপার হোল্ডার। সবুজ রঙের রেক্সিনের পাড় দিয়ে বাঁধান। ব্লটিং-পেপারটা ধপধপে সাদা, নিদাগ! তার ডানদিকে সেকালের মানানসই কাটূগ্লাসের দোয়াত ও খাগের কলম। এ দুটি ব্যবহারের জন্য নয়। শোভাবর্ধনকারী। শৌখিন বস্তু। টেবিলের বাঁদিকে আধুনিক পেন-হোল্ডারে একটি পাইলট কলম। তার পাশে একটি স্ট্যান্ডিং ক্যালেন্ডার। দৈনিক তারিখ বদলাতে হয় তাতে। তারিখটা গতকালকার। বাসু সব কিছু খুঁটিয়ে দেখছিলেন। হঠাৎ নিচু হয়ে তিনি কী একটা জিনিস কুড়িয়ে নিলেন। পকেটে রাখলেন।

নিখিল নজর করেছিল, এগিয়ে এসে বললে, কী ওটা?

বাসু পকেট থেকে বার করে দেখালেন। ঝিনুকের কাফ-লিংক-এর একটা ভাঙা টুকরো!

নিখিল বলে, এ তো পুরুষ মানুষের কাফ-লিংক। এ ঘরে?

—রীতার বন্ধুরা হয়তো এঘরে আসে। দেখ না, সেন্টার টেবিলে অ্যাশট্রেতে একটা চুরুটের স্টাম্প। রীতা সিগ্রেট হয়তো খেত। কিন্তু চুরুট খেত না নিশ্চয়?

নিখিল এগিয়ে এসে চুরুটটা তুলে নিয়ে কাগজে মুড়ে পকেটে রাখল। কাফ-লিংটাও। বাসু-সাহেব ততক্ষণে টেবিলের তলায়-রাখা ওয়েস্ট-পেপার ড্রামটাকে দেখছিলেন। বেতের বোনা ওয়েস্ট-পেপার রাস্কেট নয়। নক্শা-কাটা টিনের ব্যারেল। ‘দেখছিলেন’ মানে কব্জি ডুবিয়ে হাতড়াচ্ছিলেন।

অনিমেষ দূর থেকে বললে, বৃথাই খুঁজছেন, স্যার, কোনও সুইসাইডাল নোট ওটাতে নেই। আমরা তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছি।

বাসু বললেন, তা নেই, কিন্তু দেখে বোঝা যাচ্ছে এটা নিত্যি সাফা করা হয় না। কাজের মহিলাটি বেশ ফাঁকিবাজ।

নিখিল বলে, কিন্তু ওয়েস্ট-পেপার ড্রামের অর্ধেকও তো ভরে যায়নি।

—তা যায়নি; কিন্তু ওটা মাসখানেক সাফা করাও হয়নি। ছেঁড়া ভাউচার কিছু দেখলাম সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের। আরও একটা কথা : ড্রামটায় ছোঁড়া চিঠি বা লেফাফা একটাও নেই। মনে হয়, রীতা মেয়েটির বন্ধুবান্ধব বিশেষ ছিল না, থাকলেও তাদের চিঠিপত্র লেখার বাতিক ছিল না। সে যা হোক, এবার কি আমরা রীতার বান্ধবী, গৃহস্বামিনীর কাছে যাব?

নিখিল জবাব দেবার আগেই উৎকর্ণ হয়ে কী যেন শুনল। হ্যাঁ, একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে রাস্তায়। ওঁরা নিচে নেচে এলেন। ঠিকই অনুমান করা গেছে। ক্যামেরা নিয়ে সুধাকর আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট ওঠানোর সরঞ্জাম নিয়ে নন্দী এসে গেল।

নিখিল ওদের দুজনের জিম্মায় মৃতদেহ ও ঘরখানি রেখে দিয়ে নিচে নেমে আসবার উদ্যোগ করল। বাসু প্রশ্ন করেন, ডক্টর সান্যাল, মৃতদেহের বাঁ ভ্রূর উপর একটা প্রমিনেন্ট কাটা দাগ দেখেছেন নিশ্চয়? ওটার বয়স কত হতে পারে?

ডাক্তার সান্যাল বললেন, সেটা বলা অসম্ভব। তবে বছর খানেকের মধ্যে সে দুর্ঘটনা ঘটেনি বলে মনে হয়। আমার আন্দাজ কিশোরী বয়সে ও কোথাও পড়ে গিয়ে কপালের বাঁদিকে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিল। দু-একটি স্টিচ করতেও হয়েছিল। সাম্প্রতিক এই মৃত্যুর সঙ্গে ওই কাটা দাগের কোনও সম্পর্ক নেই। চলুন।

ওঁরা নিচে নেমে এলেন। ডাক্তার অতুলকৃষ্ণ বললেন, আপনারা অনুমতি দিলে আমি এবার রওনা দিতে পারি।

নিখিল বললে, বিলক্ষণ! আপনি তো এসেছেন প্রতিবেশী হিসাবে। আপনার যাওয়া- আসার জন্য কারও অনুমতি লাগবে কেন?

সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ছিল মধ্যবয়সী একজন বিধবা স্ত্রীলোক। দেখেই বোঝা যায়, এই মহিলাটি অনিমেষ-বর্ণিত সেই কম্বাইন্ডহ্যান্ড। ওঁদের দেখে মাথায় ঘোমটা তুলে দিল, হাত তুলে সকলকে যৌথ নমস্কারও করল।

নিখিল বলে, মিস রায়কে একটু খবর দাও। আমরা এবার তাঁর সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।

মহিলাটি বলল, আপনেরা বৈঠকখানায় বসেন। বড়দিমনিরে খপর দিই।

ড্রইংরুমে এঁরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলেন। একটু পরে একতলার শয়নকক্ষ থেকে বার হয়ে এল মিস্ শকুন্তলা রায়। রীতা বিদ্যার্থীর প্রায় সমবয়সী। কিন্তু চেহারায় ও পোশাকে যেন তার বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। রীতা দীর্ঘাঙ্গী, মেদবর্জিত, অত্যন্ত ফর্সা। এ মেয়েটি পাঁচ ফুটের সামান্য উপরে, শ্যামাঙ্গিনী, কিছুটা পৃথুলা। তবে আদৌ কুৎসিতদর্শনা নয়। রীতার সঙ্গে তুলনা না করে বলা যায়, এই বাংলাদেশের একটি শ্যামাঙ্গী সাধারণ মেয়ে। কিন্তু তার দুটি চোখে বুদ্ধির দীপ্তি। যদিও এখন চোখ দুটো রক্তবর্ণের। নিঃসন্দেহে অশ্রুপাতজনিত কারণে। রীতার পরনে ছিল সালোয়ার-কামিজ, এ পরেছে ফল্সা-রঙের শান্তিপুরী ঘরোয়া তাঁতের শাড়ি, নীল পাড়। ওই পাড়ের রঙের ম্যাচিং ব্লাউজ। চোখে মোটা কাচের চশমা।

নিখিল নমস্কার করে অত্মপরিচয় দিল। অন্য সবাইয়ের পরিচয় উহ্য রেখে বলে ওঠে, বুঝতে পারি, বান্ধবীর এমন অকস্মাৎ মৃত্যুতে আপনি কতটা মর্মাহত। তবু আমাদের কর্তব্য তো করে যেতে হবে। আপনার কাছে কিছু জিজ্ঞাস্য আছে।

—নিশ্চয়ই। বলুন, কী জানতে চাইছেন?

—আপনি প্রথমে বসুন, মিস্ রায়।— নিখিল নিজেও বসে। আর সকলে ইতিপূর্বেই সোফা অথবা ডিভানে বসে পড়েছেন।

নিখিল বলে, শুনলাম কাল রাত্রে আপনি ভদ্রেশ্বরে ছিলেন। আজ সকাল কটার সময় আপনি বাড়ি ফিরে আসেন?

—ঘড়ি দেখিনি। দশটা বোধহয় তখনও বাজেনি। কেষ্টার-মা তখনো আসেনি —

কাজের মহিলাটি কথার মাঝখানে বলে ওঠে, আমি তো এনু অনেক পরে গো। তখন তো দোতলার দরজা ভাঙা হয়ে গেছে…

নিখিল এপাশ ফিরে বলল, ও! তুমিই বুঝি কেষ্টার-মা? তা তুমি তোমার এজাহারটা দিয়েছ?

—এজাহার! মানে? সেডা কি?

—ঐ পুলিশ সাহেবের সঙ্গে ও ঘরে যাও। উনি যা যা জানতে চাইবেন তা জানাও। অনিমেষ …

বাকিটা বলতে হলো না। অনিমেষ বাধাদানকারী মহিলাটিকে নিয়ে দ্বিতলে উঠে গেল।

নিখিল আবার শুরু করে, মিস্ রীতা বিদ্যার্থী কত দিন ধরে আছেন এ বাড়িতে?

—প্রায় দেড় বছর। না, না,…গত পূজা থেকে—ধরুন চৌদ্দ মাস।

—ভাড়াটে? না পেয়িং গেস্ট? অথবা বান্ধবী হিসাবে?

—না, ভাড়াটে নয়। বান্ধবী হিসাবেই। একেবারে একা-একা থাকতাম তো। তবে সংসারখরচ আমরা দুজনে সমান ভাগে ভাগ করে নিতাম। বাজার, কাজের লোকের মাহিনা, ইলেকট্রিক অথবা টেলিফোনের বিল ইত্যাদি সব কিছুই। বাড়ির ট্যাক্স অবশ্য আমার।

—ওঁকে আপনি কতদিন ধরে চিনতেন?

এ প্রশ্নটার জবাব দিতে—কি জানি কেন—একটু দেরি হলো। ভেবে নিয়ে শকুন্তলা বললে, আমরা দুজনে একই স্কুলে, একই ক্লাসে পড়তাম। পাস করার পর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তারপর দীর্ঘদিন পরে গতবছর সেপ্টেম্বরে একটি পূজামণ্ডপে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। রীতা সেসময় একটা মাথা গোঁজার আস্তানা খুঁজছিল। ও কিছুদিন আগে কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছে। অসুবিধা সত্ত্বেও একটা ওয়ার্কিং গার্লস হস্টেলে থেকে চাকরি করছিল। আমিই ওকে ডেকে নিয়ে এলাম।

নিখিল কী একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, তার আগেই বাসু জানতে চান, কোন স্কুলে তোমরা পড়তে, মা? কলকাতায়?

শকুন্তলার স্পষ্টই ভ্রূকুঞ্চন হলো। এ-কথার জবাব না দিয়ে নিখিলকে প্রশ্ন করে, উনি কি একজন প্লেন-ড্রেস পুলিশ অফিসার?

নিখিল বলে, না। উনি মিস্টার পি. কে. বাসু, ব্যারিস্টার। আমাকে সাহায্য করতে এসেছেন।

শকুন্তলা নিখিলের দিকে ফিরেই জানতে চায়, আমরা কোন স্কুলে পড়তাম, কে কোন ডিভিশনে পাশ করেছিলাম, এসব প্রশ্ন কি রীতার এই মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় প্রাসঙ্গিক?

এবারও নিখিল জবাব দেবার আগে বাসু-সাহেব বলে ওঠেন, সেটা প্রাসঙ্গিক কি অপ্রাসঙ্গিক এ প্রশ্ন তো পরের কথা, মা; কিন্তু পুলিশ অফিসার এখনো তোমাকে একথা জানায়নি যে, সে তোমাকেই এ খুনের মামলায় আসামী করবে না। ফলে, তুমি ওর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য নও। অর্থাৎ যতক্ষণ তোমার স্বার্থ দেখতে কোনো সলিসিটার এখানে এসে উপস্থিত না হন। ইটস্ য়োর কন্সটিট্যুশনাল রাইট!

শকুন্তলা অস্ফুটে শুধু বললে, খুন! মানে? রীতা তো সুইসাইড করেছে… নিখিল সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে, তাই আপনার ধারণা?

—তা ছাড়া কী? দরজা-জানলা ভিতর থেকে বন্ধ। ওর হাতের মুঠিতে নিজের পিস্তল….

—নিজের পিস্তল? ওর যে একটা পিস্তল ছিল, তা আপনি জানতেন?

–কেন জানব না?

—যা হোক, আপনি আজ সকালের কথা বলুন?

শকুন্তলা ধীরে ধীরে সব কথা গুছিয়ে বলল।

আজ যদিও ওর স্কুলের ছুটি তবু বাড়িতে বসে ও কিছু পরীক্ষার খাতা দেখবে বলে খুব ভোর-ভোর ট্রেন ধরে ভদ্রেশ্বর থেকে কলকাতায় চলে আসে। হাওড়া থেকে ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে ও এসে সদর দরজার ইয়েল-লক্ খুলে বাড়িতে ঢোকে। একতলায় কাউকে দেখতে পায় না—না কাজের লোক, না রীতা। ও তখন সুটকেসটা সিঁড়ির নিচে রেখে দ্বিতলে উঠে যায়। রীতার ঘর ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। বহু ধাক্কাধাক্তি করেও রীতাকে জাগাতে পারেনি। ও ভয় পেয়ে যায়। নিচে নেমে এসে আলমারির গায়ে কোনও ‘নোট’ও দেখতে পায় না। তখন ও পুলিশে ফোন করে।

বাসু প্রশ্ন করেন, রীতার ঘরে তো গা-তালা লাগানো দেখলাম। তোমার কাছে ডুপ্লিকেট চাবি ছিল না?

আবার ভ্রূকুঞ্চন হলো শকুন্তলার। বললে, ছিল। এ বাড়ির সব গা-তালার ডুপ্লিকেট চাবি আছে—কিন্তু তা রাখা আছে আমার ব্যাঙ্ক ভল্টে। আজ দেওয়ালীর ছুটি।

বাসু আবার বলেন, তা পুলিশ ডাকার আগে পাড়ার লোকজন ডেকে দরজাটা ভাঙার কথা তোমার মনে হলো না? অথবা বাইরে মই লাগিয়ে উঠে কাচের ভিতর দিয়ে ঘরের ভিতরটা দেখার চেষ্টা?

আবার যেন বিরক্ত হলো মেয়েটি। বললে, না। পাড়ার লোকজনের সঙ্গে আমার তেমন আন্তরিকতা নেই। আর তাছাড়া অঘটন কিছু ঘটলে প্রথমে পুলিশে খবর দেওয়াই তো উচিত।

—তার মানে তুমি তখনই বুঝতে পেরেছিল—রীতার ঘরের ভিতর ‘অঘটন’ কিছু ঘটেছে?

—ন্যাচারালি। না হলে সে সাড়া দিচ্ছে না কেন?

—বেশি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে সে গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে থাকতে পারে। সে তো জানতো না যে, তুমি আজ সকালে ফিরে আসবে দশটা নাগাদ! কী? জানত?

শকুন্তলা জবাব দিল না। চুপ করে বসেই রইল। বাসু আবার বলেন, অথবা সে হয়তো বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে বাড়ির বাইরে কোথাও গেছে—আলমারির ম্যাগনেটিক নবে চিঠি লিখে যায়নি।

—সেটা আমরা কখনও করি না। বাইরে গেলেই…

বাধা দিয়ে বাসু বলেন, কারেক্ট! কিন্তু, রীতা তো জানে যে, তুমি ভদ্রেশ্বরে। কালীঠাকুরের বিসর্জন দিয়ে রাত্রে ফিরবে। ও হয়তো ঘণ্টা-খানেকের জন্য বাইরে গেছে। সে ক্ষেত্রে ওর পক্ষে কোনও নোট রাখা তো অর্থহীন। এসব সম্ভাবনার কথা তোমার মনে হলো না? তুমি প্রতিবেশীদের কাউকে কিছু না জানিয়ে সোজা থানায় ফোন করে দিলে?

শকুন্তলা একবার বাসু-সাহেব একবার নিখিলেশের দিকে পর্যায়ক্রমে দেখে নিয়ে বললে, এটা কি আমার কিছু অন্যায় কাজ হয়েছে?

নিখিল তৎক্ষণাৎ বললে, নিশ্চয় নয়। আপনি একা বাড়িতে থাকেন। বিপদের সম্ভাবনা বুঝলে প্রথমেই তো পুলিশে ফোন করবেন। আপনি ঠিকই করেছেন, মিস্ রায়। সে যা হোক, রীতা দেবী কী কারণে আত্মহত্যা করতে পারেন তা আন্দাজ করতে পারেন?

—না। পারি না। আর সেটাই আমাকে খোঁচাচ্ছে। কেন, কেন, ও এভাবে…নিজের হাতে…

বাক্যটা অসমাপ্ত রেখে মেয়েটি মুখে আঁচল চাপা দিল।

ওকে সামলে নেবার জন্য মিনিটখানেক সময় দিয়ে নিখিল প্রশ্ন করল, রীতা সম্বন্ধে আপনি কতটুকু জানেন, বলুন। ওর আত্মীয়স্বজন, বাবা-মা,…

দুদিকে ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে শকুন্তলা বললে, আয়াম এক্সট্রীমলি সরি, অফিসার! আমি সে-সব কথা কিছুই জানি না।

নিখিল বাসু-সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখে তিনি পকেট থেকে পাইপ-পাউচ বার করতে ব্যস্ত। নিখিল বলে, এটা কেমন করে সম্ভব, শকুন্তলা দেবী? আপনারা দুজন ক্লাস-ফ্রেন্ড, বান্ধবী..

শকুন্তলা ততক্ষণে সামলে নিয়েছে। বলে, লুক হিয়ার, অফিসার! আমরা দুজনে একই ক্লাসে পড়তাম বটে, কিন্তু একই সেকশানে নয়। ওর সঙ্গে আলাপ ছিল, কিন্তু ও কখনও আমাদের বাড়ি আসেনি। আমিও ওরু বাড়িতে যাইনি। স্কুলজীবনে আমাদের এমনকিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়নি। গত বছর পূজামণ্ডপে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। ও একটা আশ্রয় খুঁজছে, আর আমি এই নির্বান্ধব পুরীতে হাঁপিয়ে উঠেছি। আমাদের দুজনেরই মনে হলো ‘উই আর মে ফর ইচ আদার’। তবে এটুকু জানি, ওর তিন কুলে কেউ নেই। এতদিনেও ও কখনো কারও কাছ থেকে চিঠিপত্র পায়নি। আইনের কথা যদি বলেন, তবে আমিই ওর নিকটতম বন্ধু হিসাবে মৃতদেহ গ্রহণ করব সৎকারের জন্য।

বাসু পাইপটা ধরিয়েছেন। সেটা মুখ থেকে সরিয়ে বলেন, সৎকার? সেটা কী জাতের, মিস্ রায়? দাহ, না কবর?

শকুন্তলা জুলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল কিছুক্ষণ বাসু-সাহেবের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বললে, রীতা হিন্দু। হিন্দুমতেই দাহ করব ওকে।

নিখিল প্রসঙ্গটা বদল করতে চায় : রীতা দেবীর কোনও আত্মীয়-স্বজনের কথা তো আপনি জানেন না বলছেন, ওঁর কোনও বন্ধু-বান্ধবও দেখা করতে আসত না?

—খুব কম। ওর অফিসের দু’একজন কখনো-সখনো আসতেন।

—কোন অফিস? কী কাজ করতেন উনি?

শকুন্তলা জানালো—রীতা একটি নামকরা প্রাইভেট অফিসে রিসেপশনিস্ট ছিল। সে ইংরেজি-অনার্স গ্র্যাজুয়েট। স্টেনোগ্রাফি টাইপিংও জানত।

—উনি তো আধুনিকা ছিলেন। স্যূটার বা বয়-ফ্রেন্ড জাতীয় কেউ আসত না?

এবার জবাব দিতে বেশ কিছু দেরি হলো। ভেবেচিন্তে নিয়ে শকুন্তলা বলল, আসত। ইন ফ্যাক্ট একজনের সঙ্গে ইদানীং ওর স্টেডি ডেটিং চলছিল। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি— এই খুনের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই।

বাসু ঝপ করে বললেন, খুন? আত্মহত্যা নয়, তাহলে?

—আমি…আমি কেমন করে জানব? সে তো আপনারা বলবেন!

বাসু ঠোঁট থেকে পাইপটা সরিয়ে বললেন, ঠিক কথা মা, কিন্তু তোমার যেটুকু বলার কথা সেটুকু তো তুমি বলবে? আমাদের সাহায্য করতে? কী? যে তথ্যগুলো তুমি জান, আমরা জানি না। ওর বয়-ফ্রেন্ডের নাম-ঠিকানা। ও তোমার সঙ্গে কোন স্কুলে, কোন ক্লাসে পড়ত। ওর অর্থনৈতিক অভাব ছিল কিনা। এমন কোনো গোপন কথ্য থাকতে পারে কি না, যার জন্য ক্ষণিক উত্তেজনায় ও আত্মহত্যা করতে পারে? কিছু মনে কর না, মা, আমার মনে হচ্ছে, তুমি সব কথা খুলে বলছ না। তোমার তরফে কোনো লীগ্যাল অ্যাডভাইসার ছাড়া…

মেয়েটি নড়ে-চড়ে সোজা হয়ে বসে। বলে, না, না! আমার কোনো লীগ্যাল অ্যাডভাইসারের প্রয়োজন নেই। আমি ওর সম্বন্ধে যেটুকু জানি তা অকপটে জানাব। আপনারা বিবেচনা করে দেখুন : এটা আত্মহত্যা না মার্ডার।

নিখিল তার পকেট থেকে নোটবইটা বার করল :

রীতা আর শকুন্তলা সহপাঠিনী ছিল সেন্ট থেরেসা স্কুলে। ব্যাঙ্গালোরে। শকুন্তলার বাবা ছিলেন ইনকামট্যাক্স কমিশনার। তখন কর্ণাটকে পোস্টেড। ওরা দুজনে ভিন্ন-ভিন্ন সেকশনে পড়ত বটে কিন্তু থাকত কাছাকাছি পাড়ায়। দুজনেই লেডিজ সাইকেলে চেপে স্কুল করতে যেত। মস্তানদের ঈভটীজিং রুখতে ওরা তিনচার জনে স্কুলছুটির পরে একসঙ্গে সাইকেলে চেপে বাড়ি আসত। রীতা থাকত মিশনারীদের ব্যবস্থা করা একটা লেডিজ হস্টেলে। স্কুল থেকে পাস করার বছরেই শকুন্তলার বাবা বদলি হলেন কলকাতায়। তারপর রীতা বিদ্যার্থী ওর জীবন থেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়। দুজনের সাক্ষাৎ হলো প্রায় দশ-বারো বছর বাদে কলকাতার একটি পূজামণ্ডপে।…রীতা কখনো একসাথে দুজন বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কোর্টশিপ করত না। প্রায় মাসতিনেক ধরে সে যাঁর সঙ্গে স্টেডি চলছিল তিনি একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। বড়লোকের ছেলে, সুদর্শন, অ্যাডভোকেট এবং একটি রাজনৈতিক দলের এম. এল. এ.। রবিন মাইতি। বর্ধমানে বাড়ি। সচ্চরিত্র। হ্যাঁ, শকুন্তলা তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে চেনে। কারণ সে যে স্কুলে পড়ায় সেই হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের উনি গভর্নিং বড়ির প্রেসিডেন্ট। তিনি আগেও এ বাড়িতে বহুবার এসেছেন নানান কাজে। ইদানীং আসেন না।

নিখিল জানতে চায়, গত সাত-দশ দিনের মধ্যে তিনি কি এসেছিলেন এ বাড়িতে?

—অন্তত আমার জ্ঞাতসারে নয়।

—এ ছাড়া ওর অফিসের বন্ধু-বান্ধবীরা কেউ কি আসত না?

—কখনো-সখনো।

—তাদের মধ্যে কোনও সন্দেহজনক ব্যক্তির কথা কি আপনার মনে পড়ে?

শকুন্তলা নীরবে চিন্তা করতে থাকে।

— পড়ে?

—দেখুন, আমার একথাটা বলা শোভন হবে কিনা জানি না, কিন্তু একজন লোক মাঝে মাঝে— ইন ফ্যাক্ট প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে—রীতার সঙ্গে দেখা করতে আসত। লোকটা কে, আমি জানি না। রীতা তার কথা আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু বেশ বোঝা যেত যে, সে অবাঞ্ছিত অতিথি। আসত একটা কালো ফিয়াট গাড়িতে। তার নম্বরটা আমার ডায়েরিতে লেখা আছে। দিতে পারব। কিন্তু সে কেন আসত, তা জানি না।

নিখিল বলে, প্রতিমাসের প্রথম সপ্তাহে যদি একটা লোক বারে বারে আস তখন স্বতই মনে হয়— সে পাওনাদার…

বাসু বাধা দিয়ে বলেন, অথবা ‘ব্ল্যাকমেলার’! মাসের প্রথম সপ্তাহে তারাও হাজিরা দিয়ে থাকে ভিক্‌টিমের কাছে। তেমন কিছু কি আশঙ্কা করেছিলে তুমি?

শকুন্তলা জানলা দিয়ে আমগাছটার মগডালের দিকে অনেকক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি না।

—কিন্তু তোমার মনে নিশ্চয় কিছু সন্দেহ জেগেছিল, নাহলে তার গাড়ির নম্বর ডায়েরিতে লিখে রাখবে কেন?

—তা বলতে পারেন। লোকটাকে আমার আদৌ ভাল লাগেনি। রীতার কাছে ওর বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম, সে কিছু বলেনি। কিন্তু বাড়িটা যেহেতু আমার, তাই সন্দেহজনক লোকটার গাড়ির নম্বরটা লিখে রেখেছিলাম।

অনিমেষ বলে ওঠে, তার একটা বর্ণনা দিন কাইন্ডলি …

মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টিতে শকুন্তলা ধীরে ধীরে বললে, বয়স বছর পঞ্চাশ। বেঁটে। পাঁচ-তিনের উপরে নিশ্চয় নয়। বেশ মোটা। খুব কালো। অবাঙালী-

নিখিল জানতে চায়, অবাঙালী তা কেমন করে বুঝলেন?

—টেলিফোনে তার কণ্ঠস্বর শুনে। সে কখনো আন-অ্যাপয়েন্টেড আসত না। কোনোদিন তার নাম বা রিটার্ন-নম্বর জানায়নি। রীতাকে ডেকে দিতে বলত। ওর কণ্ঠস্বরে বা বাচনভঙ্গিতে মনে হয়েছিল ও দাক্ষিণাত্যের লোক। রীতাকে বহুবার প্রশ্ন করেছি—লোকটা কে, কেন আসে; ও বলেনি।

—শেষ কবে সে এসেছিল?

—গতপশুই বিকালে। আমি ভদ্রেশ্বর বেরিয়ে যাবার পর। আমাকে এইমাত্র কেষ্টার-মা জানালো, পশু সন্ধ্যায় সেই মদ্র-সাহেব এসেছিল।

—কেষ্টার-মা কেমন করে জানল? ও কি দু’বেলাই আসে?

—হ্যাঁ। বিকালে এসে বাসন ধুয়ে দেয়। অ্যাকোয়া-গার্ড থেকে জল ভরে রাখে। ঘণ্টাখানেক লেগে যায় সব কাজ সারতে।

এরপর নিখিল কী প্রশ্ন করবে ভেবে পায় না। এদিকে ফিরে বাসু-সাহেবকে বলে, আপনি কি আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন, স্যার?

বাসু মুখ থেকে পাইপটা সরিয়ে নিয়ে বললেন, ফটো তোলার ‘হবি’টা কার? তোমার না রীতার?

শকুন্তলা অবাক হয়ে প্রতিপ্রশ্ন করে, মানে? দুজনের মধ্যে অন্তত একজনের ফটো তোলার বাতিক থাকতেই হবে, এ-কথা মনে হলো কেন, আপনার?

—বাঃ! ‘পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ’! সারা বাড়িতে চমৎকার সব ফটো বাঁধানো। এঘরেও রয়েছে। রীতা বিদ্যার্থীর গ্লাস-টব টেবিলের তলাতেও দেখলাম দারুণ কিছু ফটো। দেওয়ালেও টাঙানো আছে…

শকুন্তলা বলল, তাই বলুন। হ্যাঁ, ছবি তোলার হবিটা আমারই।

—নিজেই ডেভেলপ আর প্রিন্ট কর, তাই না?

—কী আশ্চর্য! আপনি তা কেমন করে জানলেন?

-–বাঃ! সিঁড়ির নিচে যে ঘুচি ঘরটা আছে তার দরজার কাচের প্যানেলে কালো কাগজ সাঁটা দেখেই তো বোঝা যায় : ওটা তোমার ডার্করুম। না হলে অমন অন্ধকূপের ভিতর আলো ঢোকার শেষ ছিদ্রটিও কেন ওভাবে বন্ধ করা হবে? ওইটাই ডার্করুম? তাই না?

শকুন্তলা হেসে বলে, আপনার তো দারুণ নজর! হ্যাঁ তাই। বাসু হেসে বললেন, তা আমার নজরের কথাই যখন তুললে মা, তখন আরও একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি : রীতার টেবিলের ওপরে দেওয়ালে যে ফটোখানা ছিল—পনের ইঞ্চি খাড়াই, দশ ইঞ্চি চওড়া—সে ছবিটার কী হলো?

শকুন্তলা দুরত্ত বিস্ময়ে শুধু আঙ্কিক মাপটার পুনরুক্তি করল, পনেরো ইঞ্চি বাই দশ ইঞ্চি…?

— না, না, ফটোর মাপটা আরও ছোট। আমি ফ্রেমসমেত মাপটা বলছি। দেওয়ালের দিকে তাকালেই মনে হয় না যে, ওখানে ‘ফিফটিন বাই টেন’ একটা বিবর্ণ আয়তক্ষেত্র দেওয়ালে বন্দী হয়েছে? মাথায় একটা হুক, নিচে দু’দুটি ভারবাহী পেরেক মাথা কুটছে হারানো ছবিটার জন্য!

শকুন্তলা এতক্ষণে স্বাভাবিক হয়েছে। মৃদু হেসে বলে, আপনার ডিটেক্‌টিভ হওয়া উচিত ছিল, ব্যারিস্টারের বদলে। হ্যাঁ ছিল, দিন চার-পাঁচ আগে ঝড়ে ছবিটা খুলে পড়ে। কাচটা ভেঙে যায়। ওটা ফ্রেমিং করতে দিয়েছি।

নিখিল আর অনিমেষ বুঝল ‘পি. কে. বাসু’ নামটা শকুন্তলার কাছে অপরিচিত। কৌশিক অবশ্য মর্মাহত হলো। এ ব্যর্থতা তারই। তার কাঁটা-সিরিজ ‘গেলেও বিচিত্র পথে’ হয়নি সে সৰ্বত্ৰগামী!

বাসু জানতে চান, রীতারই পোট্রেট ছিল, নিশ্চয়। তাই না?

—হ্যাঁ, এবারও ঠিক আন্দাজ করেছেন। অবশ্য এবার আপনার কৃতিত্ব ততটা নয়। টমের ঘরে ডিক্-এর ফটো থাকবে না, ডিক্-এর ঘরে হ্যারির।

কৌশিক এতক্ষণে কথা বলে, কিন্তু ওটা যীজাস বা মা-মেরীর ছবিও তো হতে পারত। আমি তো ভেবেছিলাম মিকেলাঞ্জেলোর ‘পীতা’-র একটা এলার্জড কপি : যীশুক্রোড়ে মা মেরী!

নিখিল প্রসঙ্গটা বদলে বললে, আপনি ওই এম. এল. এ. ভদ্রলোকের নাম-ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর একটা কাগজে লিখে দিন। আর ঐ অবাঞ্ছিত আগন্তুকের গাড়ির নম্বর। আমরা এবার উপরের ঘরে যাব। ফিংগারপ্রিন্ট এক্সপার্ট-এর সঙ্গে কথা বলতে।

শকুন্তলা তার শয়ন কক্ষে উঠে গেল। তার অ্যাড্রেস-বই বোধকরি ওই ঘরে রাখা আছে। কাগজ-কলমও। শকুন্তলা উঠে যেতেই কৌশিক বাসু-সাহেবের কাছে ঘনিয়ে এসে বললে, ফটোখানার বিষয়ে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন, মামু?

বাসু অস্ফুটে বললেন, মেয়েটি ‘নাথিং বাট দ্য ট্রুথ’ বলছে না বলে। দিন তিন-চার আগে ফটোর কাচখানা ভাঙলে আমরা ওই ব্যারেল-শেপড ময়লা ফেলার টিনের পাত্রে কিছু কাচের টুকরো পেতাম। সেটা দেড়-দু’মাস সাফা করা হয়নি। আর অমন সহজলভ্য সংগ্রহপাত্র থাকা সত্ত্বেও ভাঙা কাচগুলো ফেলতে অন্যঘর থেকে…

কথাটা তাঁর শেষ হলো না। শকুন্তলা ফিরে এল। রবিন মাইতি, অ্যাডভোকেটের নাম- ধাম, টেলিফোন নম্বর পরিষ্কার করে লেখা একটা কাগজ বাড়িয়ে ধরল। অবাঞ্ছনীয় আগন্তুকের গাড়ির নম্বরটাও। নিখিল সেটা পকেটে রেখে বলল, আচ্ছা, নমস্কার। আপনি এবার বিশ্রাম নিয়ে যেতে পারেন।

শকুন্তলা প্রতিনমস্কার করে বললে; একটা কথা, অফিসার! এ পর্যন্ত যেটুকু দেখেছেন, যেটুকু বুঝেছেন, তাতে আপনাদের কী মনে হচ্ছে? রীতা কি আত্মহত্যা করেছে? নাকি….

নিখিল নীরবে নতনয়নে দাঁড়িয়েই থাকল। জবাব দিল না।

শকুন্তলা আবার বলে, দেখুন! অন্য কিছু হলে আমাকে আরও সাবধান হতে হবে। আমি এ বাড়িতে আবার একা থাকতে বাধ্য হয়ে গেলাম তো!

নিখিল মনস্থির করে বলল, ঠিকই বলেছেন, মিস্ রায়। হ্যাঁ, আমরা এটাকে ‘আত্মহত্যা’ বলে ধরে নিচ্ছি না। না, হোমিসাইডও নয়—ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার। কেন সেকথা মনে করছি তা আপনাকে এখনি জানাতে পারব না। তবে লোকাল থানাকে নির্দেশ দেব—আপনার বাড়িটা তারা গোপনে নজর রাখবে।

— থ্যাঙ্কু, অফিসার।

—আরও একটু সাহায্য চাইব আমরা। ‘ডেডবডি’ রিমুভ হয়ে গেলে আপনাকে নিয়ে আমি দোতলায় যাব। মিস্ রীতার ভ্যানিটি ব্যাগে একটা চাবির গোছা দেখেছি। মনে হয়, ওঁর ঘরে যে আলমারিটা আছে তার চাবি…

শকুন্তলা বাধা দিয়ে বলে, হ্যাঁ, আলমারিটা আমারই। ওকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলাম….

—আমরা আলমারিটা সার্চ করব। হয়তো কিছু ‘সীজ’ করব—পিস্তলটা তো বটেই। ‘সীজার লিস্ট’ আপনাকে এক কপি দিয়ে যাব। আপনি আমাদের সাহায্য করবেন তল্লাশিতে। আর রীতার দু’তিনটি ছবি আমাদের দেবেন। ফ্রন্ট ফেস্ এবং প্রোফাইল।

—শ্যিওর!