সকল কাঁটা ধন্য করে – ১

এক

—বেশ তো খোশগল্প হচ্চিল, এর মধ্যে তুমি আবার খুনের কথা ওঠাতে চাইছ কেন? নিখিলের দিকে তাকিয়ে বেশ ধমকের সুরে কথাটা বলল কাকলি। নিখিল দাশ আর কাকলিকে আপনারা বোধহয় চিনতে পেরেছেন। এক সময় কাকলি হয়ে পড়েছিল একটি খুনের মামলার সম্ভাব্য আসামী, আর নিখিল সে সময়ে ছিল ঐ খুনের মামলার ইনভেস্টিগেটিং অফিসার। ‘প্যারাফিন টেস্টে’–না, ল্যাবরেটারিতে নয়, ইন্টারোগেশনের অবকাশে কাকলি ইন্সপেক্টর দাশের কাছে ধরা পড়ে যায় (পশ্য : ‘যাদু-এ তো বড় রঙ্গ’-র কাঁটা)। পরে নিখিল অনুভব করে, ধরতে গিয়ে সে নিজেও ধরা পড়ে গেছে। যে ছিল সম্ভাব্য আসামী, ও নিজে হয়ে পড়েছিল তার রূপে মোহিত, বন্দী। ক্রমে স্বামী। ফলে খুনের কথা বরদাস্ত হয় না কাকলির। তাছাড়া ওই বিশ্রি শব্দটা ওদের দাম্পত্যজীবনে নিত্য-বিভীষিকা। সিনেমা দেখার প্রোগ্রাম ভেস্তে গেছে। বান্ধবীর বিয়ের নিমন্ত্রণ রাখতে যেতে পারেনি; মায় মশারি-ফেলা জনান্তিকের কোনো আনন্দঘন মুহূর্তকে খান্ খান্ করে খন্ খন্ করে বেজে উঠেছে টেলিফোন। বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে রিসিভারটা কানের কাছে চেপে ধরতে হয়েছে নিখিলকে। যথারীতি সেই ডায়াল ‘এন’ ফর মার্ডার। হেড-কোয়ার্টার্সে খুনের খবর পৌঁছালেই সেটা তৎক্ষণাৎ শান্ট করে দেওয়া হয় হোমিসাইডের ইন্সপেক্টরকে : নিখিল দাশকে—’এন’কে।

ফলে খুনের প্রসঙ্গে কাকলি ক্ষিপ্ত হবেই।

নিখিল বলে, আয়াম সরি!

কথা হচ্ছিল বাসু-সাহেবের বাড়ির সামনের বাগানে। নিখিল আর কাকলি এসেছে সৌজন্য সাক্ষাতে। নিখিলের আজ খাতা-কলমে ছুটি—একে রবিবার, তায় কালীপূজা। খাতা-কলমে, অর্থাৎ এখানে আসার আগে হেড-কোয়ার্টার্সকে খবর দিয়ে আসতে হয়েছে—এমার্জেন্সি কেসে তাকে কত নম্বরে টেলিফোন করলে পাওয়া যাবে। ‘পেজার নম্বর’ বা ‘মোবাইল ফোন’ তখনো খুব ব্যাপক আকারে চালু হয়নি।

নিখিল সস্ত্রীক সৌজন্য-সাক্ষাতে এসেছে একটা বিশেষ হেতুতে। প্রায় বছর দুই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে পোস্টেড থাকার পর নিখিল সম্প্রতি কলকাতায় ফিরে এসেছে। শুধু বদলিই নয়, সেই সঙ্গে পদমর্যাদা তথা মাহিনাবৃদ্ধিও ঘটেছে। বর্তমানে সে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে মেজ-কর্তার পদটি অলঙ্কৃত করছে। অর্থাৎ আরক্ষা-বিভাগের পারিভাষিক সাদা বাঙলায় নিখিল দাশ বর্তমানে অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার, ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট। সংক্ষেপে এ. সি. ডি. ডি.।

কালীপূজার রাত। মহামান্য উচ্চ-ন্যায়ালয়ের সেই ‘তিন-কুড়ি-পাঁচ’ ডেসিব্লু-এর সীমারেখা তখনো জারি হয়নি। ফলে নিউ আলিপুরের ধনকুবের তনয়েরা দনাদ্দন কালী- পটকা, চকলেট-বন্ধ, দোদোমা ফাটাচ্ছে, অতি উচ্চ নিনাদে। বিশে প্লেটে করে খাবার এবং বাসু-সাহেব বাদে আর সবাইকে কফি পরিবেশন করে গেছে। বাসু-সাহেব দু’পেগ শেষ করে একটা মিনি হাফ তাঁর গ্ল্যাসে ঢালছিলেন এমন সময়—খুব কাছেই বিকট শব্দে রাস্তায় একটা বোমা ফাটলো। হাফ-আ-টেব্‌লস্পুনফুল শ্যিভাস রিগাল গ্লাসের বাইরে পড়ল। সে কয় ফোঁটা তরল পদার্থের আর্থিক মূল্য ঐ দোদোমার চেয়ে বেশি!

বোমার শব্দ এতক্ষণে সকলের প্রায় কান-সওয়া হয়ে এসেছে; কিন্তু এটা এত কাছে ফাটল যে, সুজাতা দু’হাতে কান চাপা দিয়ে বলে উঠে, ওফ্! আর পারা যায় না! আইন করে এ ধাষ্টামো থামানো যায় না?

বাসু তাঁর লীগ্যাল ওপিনিয়ান দেবার আগেই নিখিল বলল, আপনাদের অসুবিধা হয় ঠিকই, কিন্তু কালীপূজার এমন একটা রাত খুনীর কাছে আইডিয়াল। ‘সাইলেন্সার’-এর দরকারই হবে না। ত্রিসীমানায় কেউ আদালতে উঠে হলপ নিয়ে পরে বলতে পারবে না কোনটা ছিল পট্‌কা-ফাটার শব্দ আর কোনটা ফায়ারিঙের। আজ রাতটায় খুনীর পক্ষে আদর্শ সুযোগ!

আর নিখিলের এই কথাতেই কাকলি আপত্তি জানিয়েছিল : বেশ তো খোশগল্প হচ্ছে, এর মধ্যে আবার খুনের কথা কেন?

বাসু বললেন, গল্পের সঙ্গে খুনের কিছু ভাশুর-ভাদ্দরবউ-এর সম্পর্ক নয়, কাকলি। গোয়েন্দা গল্পের বারো-আনাই তো ‘খুন’ নিয়ে। আজ তো তেরই নভেম্বর, রবিবার, আজ থেকে মাত্র আটদিন আগে, পাঁচই নভেম্বর, শনিবার, এবারও ওদের কালীপূজার রাত্রে লন্ডনে একটা খুন হয়েছে—পিকাডেলি সার্কাস অঞ্চলে—বাজি-পটকার শব্দে পাশের ঘরের মানুষজন পর্যন্ত বুঝতে পারেনি যে, পার্টিশন দেওয়ালের ওপাশে একজন পিস্তলের গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ল।

কাকলি অবাক হয়ে বলে, লন্ডনের কালীপূজাতেও এত ধুমধাম হয়?

বাসু বলেন, লন্ডনেই। তবে কালীপূজা নয়। ‘গাঈ ফ’ক্স্‌ ডে-র সমাবর্তনে পাড়ায় পাড়ায় ছেলে-ছোকরার দল পটকা ফোটায়।

কৌশিক বলে, গাঈ ফক্স ব্যক্তিটি কে? কেওকেটা কেউ একজন নিশ্চয়। অহল্যা-দৌপদী- কুন্তীর মতো একেবারে ‘স্মরেন্নিত্যম্’ না হলেও ইংরেজ তাকে বছরে একদিন যখন স্মরণ করে আজও!

বাসু বলেন, ঐ তো মুশকিল, ভাগ্নে। তোমাদের বি. ই. কলেজে আবার ইতিহাস পড়ানোর রেওয়াজ নেই। গাঈ ফ’ক্‌স্ একজন প্রফেশনাল কীলার। বিস্ফোরণে ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে উড়িয়ে দিয়ে সপরিবারে ইংলন্ডেশ্বরকে হত্যা করতে চেয়েছিল। পারেনি। ধরা পড়ে যায়। লোকটার ফাঁসি হয়ে যায়।

কৌশিক বলে, বেচারি গাই ফক্স! তার আমলে বোধকরি ভাল ক্রিমিনাল-সাইড ব্যারিস্টার ছিল না, যাঁর আইন আর ইতিহাস বিষয়ে সমান পাণ্ডিত্য।

বাসু জবাবে কী-একটা কথা বলতে যাচ্ছিলেন—বাধা পড়ল। দ্রাম করে একটা পকা ফাটল। আর সেই সুযোগে সুজাতা কথাটার মোড় ঘোরায় : আপনি ওসব পাগল-ছাগলদের কমেন্ট্-এ কান দেবেন না, মামু। গাঈ ফ’ক্‌সের গল্পটা শেষ করুন।

বাসু বললেন, হ্যাঁ, তোমাদের জানা থাকা ভাল। ভারতে তো সাম্রদায়িক দাঙ্গা লেগেই আছে। দলীয় স্বার্থে দু’দল রাজনৈতিক ধর্মান্ধ খুনোখুনি করে ঈশ্বরসেবা করতে চায়। গাঈ ফ’ক্স্ ষোড়শ শতাব্দীর একজন প্রফেশনাল ক্রিমিনাল। জন্মেছিল প্রটেস্টান্ট হিসাবে—তার বাবা-মা দুজনেই প্রটেস্টান্ট; কিন্তু সে নিজে বড় হয়ে রোমান ক্যাথলিক ধর্মগ্রহণ করে। রবার্ট ক্যাটেবি নামের একজন ধনী লন্ডনেয়ার ওকে ভাড়া করে নিয়ে আসে নেদারল্যান্ডস্ থেকে গাঈ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বেসমেন্টে প্রচুর বারুদ জমা করে রাখে। স্থির হয়, সে বছর পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশনের উদ্বোধনের দিনে যখন রাজারানী বাৎসরিক সভায় আসবেন তখন গাঈ ফ’স্ দূর থেকে দড়িতে আগুন দেবে। ইতিহাসে এর নাম ‘গানপাউড়ার প্লট’। রোমান ক্যাথলিক ধর্মান্ধদের পরিকল্পনা ছিল, পার্লামেন্টে ইংলন্ডের রাজারানী সহ যাবতীয় প্রটেস্টান্ট সেনেটাররা মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবেন। কিন্তু নিরাপত্তা-বিধায়ক পুলিশ আগে- ভাগেই টের পায়। দড়িতে আগুন দেওয়ার আগেই গাঈ ফ’ক্‌স্ ধরা পড়ে। পরে তার ফাঁসি হয়।

নিখিল জানতে চায়, আর যে ধর্মান্ধ রোমান ক্যাথলিক ঐ প্রফেশনাল কীলারটাকে নিয়োগ করেছিল? সেই রবার্ট ক্যাটেবির কী হলো?

—না, পুলিশ তাকে ছুঁতে পারেনি। তাকে গ্রেপ্তার করার আগেই ষড়যন্ত্রকারী দলের পাণ্ডারা তাকে গুলি করে মারে—নাহলে ষড়যন্ত্রকারীরা সবাই ধরা পড়ে যেত।

কাকলি বলে, কেনেডি হত্যাকারী অওয়াল্ডকে যেমন পুলিশপ্রহরার ভিতরেই মেরে ফেলা হলো।

রানী বলেন, তা তো বুঝলাম, কিন্তু গাঈ ফক্সের সঙ্গে কালীপূজার কী সম্পর্ক?

বাসু বললেন, ঐ পাঁচই নভেম্বর গোটা ইংলন্ডে ‘গান-পাউডার প্লট’-এর বার্ষিক সমাধর্তন হয়। রাস্তায় রাস্তায় চ্যাঙড়া ছেলেরা দনাদ্দন পটকা ফাটায়। ওরা একটা গানও গায় :

“Remember, remember / The fifth of November,
Gunpowder treason and plot.
We see no reason/Why gunpowder treason
Should ever be forgot!”

রানী বলেন, আশ্চর্য! ব্রিটেনের মতো রাজভক্ত দেশ ঐ লোকটাকে বছর-বছব স্মরণ করে?

বাসু বলেন, না রানু। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে না আদৌ। অনেক জায়গায় গাঈ ফ’ক্‌স্-এর কুশপুত্তলিকা দাহ করে নভেম্বরের শীতে ওরা আগুন পোহায়। আমরা যেমন দোলের সময় ম্যাড়া পোড়াই।

কৌশিক বলে, ম্যাড়া তো আসলে ভেড়া! আগুনে ঝলসে গেলে সুখাদ্য হয়, কিন্তু ফক্স পোড়ালে কী লাভ? শেয়ালপোড়া তো খাওয়াও যাবে না।

বাসু তাঁর পানীয়টা গলাধঃকরণ করে বললেন, আয়াম সরি, এগেন মিস্টার কৌশিক মিত্র, বি. ই.! গাঈ ফ’স্-এর উপাধি Fawkes অর্থাৎ Fox নয়। আপনার রসিকতাটা তাই অর্থহীন!