সংযোজন

সংযোজন

মধ্যমাগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং বহরমপুরের রামদাস সেন ও ভ্রাতুষ্পুত্র জ্যোতিষচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত বঙ্কিমচন্দ্রের কয়েকখানি পত্রের পাণ্ডুলিপি নৈহাটী বঙ্কিম ভবনে রক্ষিত আছে। এই পত্রগুলি কোন কোন পত্রিকায় ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়। হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের “ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র” শীর্ষক পুস্তকেও এ সমুদয় গ্রথিত হইয়াছে। আমরা এখানে চিঠিগুলি দিলাম। পাঠক লক্ষ্য করিবেন কোন কোন পত্রে সম্পূর্ণ তারিখ নাই। বঙ্কিমচন্দ্রের শেষ উইলটিও এখানে দেওয়া হইল।
বঙ্কিমচন্দ্রের একখানি অসম্পূর্ণ নাটিকা বিমলচন্দ্র সিংহ “বঙ্কিম কণিকা” নামক পুস্তকে প্রকাশিত করিয়াছেন। ঐ গ্রন্থের ভূমিকায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে নাটিকাটি সম্বন্ধেও বিমলচন্দ্র লিখিয়াছেনঃ “পূর্বের ন্যায় এ গুলিও আমার পিতামহদেবের সহধ্যায়ী ও সুহৃৎ শ্রদ্ধেয় শ্রীযুক্ত হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ মহাশয়ের নিকট পাইয়াছি এবং তাঁহারই সস্নেহ অনুগ্রহে এগুলি প্রকাশ করা সম্ভব হইল। ইহার মধ্যে প্রথমটি একটি অসম্পূর্ণ নাটক—এ পর্যন্ত অপ্রকাশিত ছিল।”

সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত পত্র

To Babu Sanjib Chandra Chatterjee
সেবক শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র শর্মণঃ
প্রণামা শত সহস্র নিবেদনঞ্চ বিশেষ—
আপনি যতীশের বিবাহ সম্বন্ধে যে পত্র লিখিয়াছেন, তাহার উত্তর আমি বাঙ্গলায় লিখিলাম। ইহার কারণ এই যে, আবশ্যক হইলে বা উচিত বিবেচনা করিলে পিতাঠাকুরকে পড়িতে পাঠাইয়া দিবেন।
শ্রীযুক্ত—আপনাকে যতীশের বিবাহ সম্বন্ধে ১৬০০৲ ষোলশত টাকা ‍ কর্জ করিতে বলিয়াছেন। কর্জ পাওয়া আশ্চর্য নহে। আপনি না পান শ্রীযুক্ত আজ্ঞা করিলে অনেকে কর্জ দিবে। কর্জ করিলে আপনার বর্তমান পাঁচ হাজার টাকা ঋণের উপর ৭০০০৲ টাকা হইবে। ইহা প‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍রিশোধের সম্ভাবনা কি? এক্ষণে আপনি কত করিয়া মাসে কর্জ শোধ করিয়া থাকেন। কোন মাসে কুড়ি টাকা কোন মাসে কিছুই না। অদ্য ২০ বৎসর অবধি আপনি ঋণগ্রস্ত, কখনও ঋণের বৃদ্ধি ব্যতীত পরিশোধ করিতে পারেন না। ভবিষ্যতে যে অন্য প্রকার হইবে, তাহার কি লক্ষণ দেখা যায়? কিছুই না। তবে ইহা নিশ্চিত বলা যাইতে পারে যে, এক্ষণে আপনি যে ঋণ করিবেন, তাহা পরিশোধের সম্ভাবনা নাই।
যে ঋণ পরিশোধ করিতে পারেন না মনে জানিতেছেন, তাহা গ্রহণ করা পরকে ফাঁকি দিয়া টাকা লওয়া হয়। আপনি যদি এখন ১৫০০‍/- টাকা কর্জ করেন, তবে ঋণ গ্রহণ করাকে বঞ্চনা বলিতে হইবে। বরং ভিক্ষাবৃত্তি ভাল, তথাপি বঞ্চনা ভাল নহে। পিতৃ-আজ্ঞা পালনার্থ অথবা পিতার সুখবর্ধনের জন্য তাহা কর্তব্য নহে। এরূপ অধর্মাচরণ অপেক্ষা পিতার আজ্ঞা লঙ্ঘন কর্তব্য।
২। এই ৭০০০‍৲ টাকার ঋণ পরিশোধ হইবে না। ইহার পরিণাম কি হইবে? মহাজন ছাড়িবে না, তাহারা নালিশ করিয়া ডিক্রি করিবে। এমন কোন সম্পত্তি আমাদের নাই যাহা বিক্রয় করিয়া টাকা আদায় হইতে পারিবে। সুতরাং আপনি যে পরিমাণে পরামর্শের কথা লিখিয়াছেন, তাহা অন্যায় হইল কি প্রকার? এমন সর্বনাশ যাহাতে ঘটিবার সম্ভাবনা সে ঋণ কেন করিবেন? ইহা জানেন যে, ডিক্রি হইলে একখানি ওয়ারেণ্ট বাহির হইলেই আপনার চাকুরীটি যাইবে এরূপ নিয়ম হইয়াছে।
৩। আপনি যদি এই ঋণ বৃদ্ধি করেন তবে যতীশের যাবজ্জীবনের জন্য যে কি গুরুতর অনিষ্ট করিবেন তাহা বলা যায় না। যতীশ সে সবেরই দায়িক। যেদিন সে প্রথম উপার্জন করিতে শিখিবে সেই দিন হইতে এই ঋণের ভার তাহার মাথার উপর চাপিবে। আর ইহজন্মে তাহা নামাইতে পারিবে কি না বলা যায় না। আপনাদিগের অবস্থা দেখিয়া ভরসা হয় না যে কখনও উদ্ধার পাইবে। যাহার স্কন্ধে ঋণের ভার চাপে তাহার অপেক্ষা অসুখী পৃথিবীতে আর কেহ নাই। যত টাকা উপার্জন করে তাহার একটী পয়সাও আপনার বলিয়া বোধ করিবার অধিকার থাকে না। উদাহরণ আমাকেই দেখিতেছেন। রমেশ মিত্র হাইকোর্টের জজ্, আর আমি মালদহের ক্ষুদ্র চাকুরীজীবী, পিতৃঋণই ইহার কারণ। অতএব আপনি যদি আর ঋণবৃদ্ধি করেন তবে আপনাকে যতীশের শত্রু বিবেচনা করিব। যদি বলেন, ঋণ না করিলে পিতার এই শেষ অবস্থায় অত্যন্ত মনঃপীড়া পাইবেন। আমার বিবেচনায় তাঁহাকে এই সকল কথা বুঝাইলে তিনি কদাচ ঋণ করিতে বলিবেন না। তিনি পুত্রবৎসল, অবশ্য আপনার এবং যতীশের ভবিষ্যৎ মঙ্গলের প্রতি দৃষ্টি করিবেন। যদি না করেন, তবে তাঁহার আজ্ঞা লঙ্ঘন করিতে হইবে। পিতার অনুরোধে পুত্রের অনিষ্ট করিলে আপনি ধর্মে পতিত হইবেন।
আমার নিশ্চিত বিশ্বাস যে, এই সকল কথা তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলে, তিনি আপনাকে ঋণ করিতে দিবেন না। কিন্তু স্বয়ং ঋণ করিয়া যতীশের বিবাহ দিবেন। আপনার কাছে বিশেষ ভিক্ষা এই যে, কোন মতে তাহা করিতে দিবেন না। তিনি যদি ঋণ করিতে প্রবৃত্ত হয়েন, তবে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিবেন যে, তিনি যে ঋণ করিতেছেন, তাহা কে পরিশোধ করিবে? তিনি বলিবেন যে, আমার ২২৫‍৲ টাকা পেন্সন আছে, আমি তাহা হইতে পরিশোধ করিব। তখন বুঝাইয়া দিবেন যে, তাহা ভ্রম মাত্র। আজি নয় বৎসর হইল আমরা পৃথক হইয়াছি। তখন শ্রীযুক্তের ৮০০০৲ টাকা দেনা ছিল। এক্ষণে ৩৬০০‍৲ আছে, অতএব এই ৯ বৎসরে ৪৪০০‍৲ টাকা মাত্র পরিশোধ হইয়াছে। আমাতে ও দাদাতে ঋণ পরিশোধার্থেই নয় বৎসরে ৪৪০০‍৲ টাকা দিয়াছি। অতএব নয় বৎসরের মধ্যে শ্রীযুক্ত পেন্সন হইতে একটী পয়সাও কর্জ শোধ করেন নাই। অতএব ভবিষ্যতে করিবেন তাহার কোন সম্ভাবনা নাই।
অতএব তিনি এক্ষণে ঋণ করিলে পরিশোধ করিবে কে? তিনি বলিবেন, পুত্রগণ। কিন্তু পুত্রগণের মধ্যে মধ্যম নিজের দেনাই পরিশোধ করিতে অশক্ত, পিতৃঋণের এক পয়সাও পরিশোধ করিবার সম্ভাবনা নাই। কনিষ্ঠও তদ্রূপ, তাহার যে আয় তাহাতে কোনমতে সংসার নির্বাহ হয়, ঋণ পরিশোধ হইতে পারে না। জ্যেষ্ঠ এক পয়সাও দিবেন না, ইহা নিশ্চিত, বাকী আমি কেবল একা দায়ে ধরা পড়ি। অতএব তিনি যদি এখন যতীশের বিবাহের জন্য ঋণ করেন, তবে আমার ঘাড়ে ফেলিবার জন্য। উহা আমার প্রতি কতবড় অত্যাচার হইবে তাহা তাঁহাকে আপনি বুঝাইবেন।
আর একটি কথা যদিও অবক্তব্য, তথাপি এস্থলে না বলিলে নয়। আমার উপর রাগ করিবেন না, আমার দেহের প্রতি বিশ্বাস নাই। আমার শরীরে শ্বাস কাশাদির বীজ রোপিত আছে, অন্যান্য উৎকট রোগেরও লক্ষণ আছে। তাহার প্রতিকারের চেষ্টা করি না, কেন না দীর্ঘজীবন বাসনা করি না। অধিক দিন বাঁচিলে অধিক কষ্ট পাইতে হয় এবং প্রতিকারের চেষ্টায় কষ্ট পাইতে হয়, প্রায়ই কোন না কোন ব্যাধিতে আমার শরীর রোগগ্রস্ত।
অতএব কতদিন বাঁচিয়া থাকিব তাহা বলিতে পারি না, বোধহয় ঋণ পরিশোধ পর্যন্ত আমাকে বাঁচিতে হইবে না। আর কেবল ঋণ পরিশোধের জন্য বাঁচিয়া কি হইবে। কোন ঋণ হইতে মুক্তি না পাই, তবে রোগের কোন চিকিৎসা হইবে না।
যতীশের বিবাহে আপনি বা শ্রীযুক্ত এক পয়সাও ঋণ করিতে পারিবেন না। ইহাতে বলিবেন যতীশের কি বিবাহ দেওয়া হইবে না? আমার বিবেচনায় যতীশের বিবাহ দুই বৎসর পরেও ভাল, তথাপি ঋণ কর্তব্য নহে। নিতান্ত যদি বিবাহ দেওয়া কর্তব্য হয়, (কিন্তু তাহার প্রয়োজন নাই); অক্ষয় সরকারের কাছে আপনার চারিশত টাকা পাওনা আছে, সে এখন দিবে না সত্য বটে, কিন্তু গঙ্গাচরণকে ধরিতে পারিলে সে দিতে পারে, সেই চারিশত টাকা আদায় করুন। আর আপনি ২০০‍৲ টাকা দিতে পারেন, শ্রীযুক্ত ২০০‍৲, আমিও দুই শত টাকা দিব। এই হাজার টাকা ব্যয় করিয়া বিবাহ দিন। ঋণ করিতে পারিবেন না। এই সকল টাকা সংগ্রহ করিতে দুই তিন মাস লাগিবে। অতএব এই ফাল্গুন মাসে বিবাহ হইতে পারে।
প্রণতঃ বঙ্কিম
৩০ কার্তিক

শ্রীচরণেষু—
আপনি মঙ্গলবার যে পত্র লিখিয়াছিলেন তাহা আমি বৃহস্পতিবারে পাইয়াছি। আর বুধবারে যে পত্র লেখেন তাহা শুক্রবার পাইয়াছি। এরূপ বিলম্বের কারণ আপনার চিঠি সময়ে post হয় না। তিনটার মধ্যে চিঠি post করিতে হয়।
দাদার পীড়া মারাত্মক নহে তজ্জন্য ব্যস্ত হইবেন না। গোড়ায় Homeopathic treatment করিলে tap করিবার প্রয়োজন হইত না। এক্ষণে হইয়াছে ঔষধ আমি তাঁহাকে বলিয়া দিব যদি আর কখনও হয় তবে প্রথমাবস্থায় ব্যবহার করিলে সহজে আরাম হইবে। আমার ভরসা আছে রক্ষা পাইবেন।
যতদিন না নিঃশেষ আরাম হন ততদিন কলিকাতায় রাখিবেন। বোধ করি তাঁহার চিকিৎসার ব্যয় তাঁহাকে কিছুই বহন করিতে দেন নাই। ব্যয় আমার ব্যয়ে হওয়া কর্তব্য। টাকার প্রয়োজন হইলে উমাচরণকে বলিবেন সে সরবরাহ করিবে। দাদার নিঃশেষ আরোগ্য সম্বাদের প্রতীক্ষায় রহিলাম। ১০ই মাঘ।
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

শ্রীচরণেষু—
আপনার একখানা পত্র পাইলাম, তাহার তারিখ নাই, প্রায় থাকে না।
বরদা ভট্টাচার্য ৫‍৲ খাজানা পায় তজ্জন্য সে ৫X২০=১০০‍৲ পাইতে পারে। High Court ruling এই যে Every person should receive amount of compensation proportionate to his interest in the land, উহার interest ৫‍৲ annually— এ জন্য ১০০‍৲ পাইতে পারে। আমি ঐ ১০০‍৲ লইয়া সাধাসাধি করিয়াছি তাহাতে সে আমাকে কটূক্তি করিয়া গিয়াছে।
তার উপর উহাকে বলিয়াছি যে যদি তুমি না লও তবে তোমাকে চিরকাল ঐ খাজনা দিব। এবং তাহার খাজানা আদায়ের জন্য আমার অন্য সম্পত্তি আবদ্ধ রাখিয়া লেখাপড়া করিয়া registry করিয়া দিতে চাহিয়াছিলাম। তাহাতে সে রাজী না হইয়া কড়া কথা বলিয়া গিয়াছে।
তাহাকে কেহ বুঝাইয়াছে যে আমি ১২০০‍৲ টাকা পাইয়াছি তাহার মধ্যে ৮০০‍‍৲ তাহার প্রাপ্য, বড়বাবু আমাকে আটশত টাকা দিবার জন্য পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করিয়াছেন এবং নিজে চণ্ডী ভট্টচার্য প্রভৃতিকে ফাঁকি দিবার জন্য আমার সাহায্য চাহিতেছেন। যখন জমি মাপ হয় তখন আমি ঝিনাইদহ ছিলাম, আমার লোকজন জরিপের সময়ে কেহ উপস্থিত ছিল না। তথাপি এই ভট্টাচার্য বলিয়া বেড়াইতেছে যে আমি জুয়াচুরি করিয়া খরিদা ব্রহ্মোত্তর বলিয়া তাহা খাইয়াছি এবং আপনাকেও ঐরূপ লিখিতে সাহস করিয়াছে। যখন কাঁটালপাড়ার সকল লোকের আমার প্রতি এই ব্যবহার, তখন কাজেই কাঁটালপাড়ার বাড়ী ফেলিয়া দিলাম।
ইতি ১১ জুন
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

Midnapore, 1887
17th Aug., ২রা ভাদ্র
শ্রীচরণেষু—
কাঁটালপাড়ায় স্কুল বা কলেজ বা University যাহাই হ’ক তাহাতে আমি কোন সাহায্য করিব না। কাঁটালপাড়ার পূজায় আমি টাকা দিব না। এ বৎসর আমি ও আমার পরিবার পূজার সময়ে মেদিনীপুরেই থাকিব। সুতরাং কলিকাতাতেও পূজা করিতে পারিলাম না।
যেখানে বরদা ভট্টাচার্যের মত ব্যক্তি আমাকে জুয়াচোর বলে, যে স্থানে রামকৃষ্ণ ও ব্রজনাথের মত লোক আমার পিতাকে জালসাজ বলে, যে দেশে বসন্ত ও চণ্ডী ভট্টাচার্যের মত লোকের সঙ্গে দলাদলি এবং যেখানে বড়বাবুর মত সহোদরের মুখদর্শন করিতে হয়, সে দেশের সঙ্গে আমি কোন সম্বন্ধ রাখিব না। সেখানে আমার দুর্গোৎসব হইবে না।
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

আপনি বাড়ী আসিয়াছেন জানিয়া আনন্দিত হইলাম। আসিবেন তাহা জানিতাম, কেন না আমি দেখিয়াছি আপনার মনে রাগ ভিন্ন বৈরাগ্য উপস্থিত হয় নাই, রাগ পড়িয়া যায়, বৈরাগ্য ভিন্ন সংসার ত্যাগ হইতে পারে না। এজন্য আমি যতীশের মাতাকে বলিয়াছিলাম যে চারিমাস অপেক্ষা কর, কেননা টিকিটের ম্যায়াদ ৪ মাস। চারিমাসে না আসেন তখন ব্যস্ত হইও। যাহা হউক আসিয়া ভালই…
অনেক দুঃখ পাইয়াছেন; ইহাই প্রমাণ যে বৈরাগ্যের অনেক দেরী, মমতা পরিত্যাগই বৈরাগ্য, যাহা হউক আসিয়াছেন ভালই হইয়াছে, এখন আমার বোধ হইতেছে যে আমাকে আপনার ঠিকানা বলিয়া দিতে নিষেধ না করিলে ভাল হইত। কেননা আমি ঠিকানা বলিতে অস্বীকৃত হইয়া অনেকের কাছে শত্রু হইয়াছি, অন্ততঃ বড়বাবু ঐরূপ প্রতিপন্ন করিতেছেন।
চিরণ প্রভৃতির…অবস্থা তাহাও আমারই দোষ বলিতে হইবে, কেননা আমি মাসে ত্রিশ টাকা মাত্র দিয়াছি কিন্তু আমারও দোষ বড় নাই কেননা আমি আপনাকে টাকা পাঠাইয়াছি। আপনি বিদেশ যাত্রার পর তাহাকে কিছু দিই নাই বটে…সে খুচরা ১০/২০ টাকা নিতে নারাজ এককালীন বেশী দিতে হইবে। আমি টাকার সাশ্রয় করিবার জন্য বাড়ীর ত্রিশ টাকা বরাদ্দ করি নাই। কিন্তু অনেকের সেই বিশ্বাস এবং সেইজন্য আমি নিন্দিত হইয়াছি। বড়বাবুর কাছে অনেক গালি খাইয়াছি। কপালী যে তাহার ভাইকে ২৫‍৲ টাকা দেয় সেই দৃষ্টান্ত দ্বারা আমার চরিত্রের শোধন করিবার চেষ্টা পাইয়াছেন। বড়বাবু…
তিনি আমাকে সম্প্রতি লিখিয়াছেন তাঁহার সহিত শত্রুতা করাই ভায়েদের কার্য, তিনি মরিলে আমরা কি করিব জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। আমি কোন উত্তর দেই নাই।

শ্রীচরণেষু—
27.12.87
জ্যোতিশের নিজ পরিবার প্রতিপালন…কিন্তু আপনার ভার তাহার উপর আমার দিবার ইচ্ছা নাই। তাহা পূর্বপত্রে লিখিয়াছিলাম। এবং এক্ষণে সবিস্তার বিবেচনা করিয়া লিখিতেছি—
স্বর্গীয় কর্তা মহাশয় জীবিত থাকিতে তাঁহার (১) আহার (২) পরিধেয় (৩) চিকিৎসা এই তিন প্রকারের ব্যয় আমরা নির্বাহ করিতাম। আপনার সম্বন্ধেও আমি তাহাই করিতে চাহি। অতএব ইহার বন্দোবস্ত আমি নিম্নলিখিতভাবে করিলাম।—
(১) নিজ প্রয়োজনীয় ঘৃত ময়দা কিনিয়া দিয়া আসিবে। /১॥• সের দুগ্ধ বরাদ্দ থাকিতে পারে তাহার মূল্য মাস মাস আমি দিব…
(২) বস্ত্র…তা এবং শয্যা গাত্রবস্ত্র প্রভৃতি যখন যাহা নিজের জন্য প্রয়োজনীয় হইবে উমাচরণকে বা আমাকে জানাইলে পাঠাইয়া দিব।
(৩) আপনার নিজ চিকিৎসার বিল ডাক্তারকে আমার কাছে পাঠাইতে বলিয়া দিলাম।
কর্তার প্রতি যাহা করিতাম আপনার প্রতি তাহা করিতে চাহিতেছি ইহাতে আপনার অনভিমত হইবে না বিবেচনা করি।
…দ্বারা লেপের খোল পাঠাইয়া দিয়াছি পৌঁছ সংবাদ দিবেন। ১৩ পৌষ।

জ্যোতিষচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত পত্র
নীলমণি কি পাইবে না পাইবে তাহা জানি না। তুমি আমার বড় সুসময় দেখিয়াছ। রথযাত্রা, ঠাকুর বাড়ীর মেরামত, তোমার কন্যার বিবাহ, বাকী দেনার পরিশোধ (তোমার ছোটকাকা কিছুই দিলেন না।) ইত্যাদিতে ব্যতিব্যস্ত, এই সময় তুমি গচ্ছিত টাকার মত ব্যতিব্যস্ত করিয়াছ। আমার অসাধ্য হইয়াছে—ইতি—
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
তাং ২৩শে আষাঢ়

কাল তোমাকে যখন পত্র লিখিয়াছিলাম, তখন আমার তেতলা ঘরে আগুন লাগিয়াছিল। ঘর পোড়ে নাই কিন্তু বিস্তর দ্রব্য সামগ্রী পুড়িয়া ক্ষতি হইয়াছে। সেই সময়ে তোমার পত্র পাইয়া উত্তর দিয়াছিলাম, তাই অমন পত্র লিখিয়াছিলাম। নহিলে লিখিতাম না। টাকাকড়ি এক পয়সা হাতে নাই। পূঁজি ভাঙ্গিয়া বিবাহের উদ্যোগ করিতেছি—
ইতি—তাং ২৪শে আষাঢ়
1st Aug. 1889

প্রিয়তমেষু—
তোমার পত্র পাইয়া ও তুমি কঠিন রকম পড়িয়া যাওয়ার সম্বাদ পাইয়া চিন্তিত আছি। কোথায় কি রকম জখম হইয়াছে কিরূপ চিকিৎসা হইতেছে এক্ষণে কেমন আছ আর এখন লোক পাঠান আবশ্যক কিনা লিখিবে।
তুমি বাড়ী আসিলে সপিণ্ডীকরণ হইবে। আমি সেই সময় দিনস্থির করিয়া দিব। ভাদ্র মাস পড়িতে না পড়িতে যাহাতে পরিবার লইয়া যাওয়া হয় সে চেষ্টা করা আবশ্যক।
কাঁটালপাড়ার সব ভাল আছে, সংবাদ পাইয়াছি।

14th Aug., 1889
কল্যাণবরেষু—
তোমার পত্র পাইয়াছি। তুমি সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করিয়াছ কিনা লিখিবে। তোমার কনিষ্ঠ পুত্রের অন্নপ্রাশন এক্ষণে হইতে পারে না, কেননা তাহার সর্বাঙ্গে ফোঁড়া ও জ্বরও কখন কখন হইয়া থাকে। অসুস্থ শরীরে অন্নপ্রাশন দিতে নাই। উপনয়নের সময়ে হইবে।
সুতরাং এক্ষণে সপিণ্ডীকরণের প্রয়োজন নাই। নীলমণি মুড়াগাছায় গিয়াছিল। পুনশ্চ আসিয়াছে; সে মুড়াগাছায় যাওয়ার পর আমার পরিবারবর্গ লইয়া রাখিতে কাঁটালপাড়ায় গিয়াছিল, এক্ষণে তাহারা সেইখানেই আছে অতএব চিন্তার বিষয় নাই।
টাকা মাসকাবারে কৈলাসের নিকট পাঠাইব। কৈলাসকে টাকা মজুত রাখিতে বলিবে, আমি বাড়ী গিয়া খরচপত্র করিব। আমি সংসারের সকল বন্দোবস্ত করিতেছি।
যদি মেহেরপুরে পীড়া বেশী না থাকে তবে পরিবার লইয়া যাওয়াই ভাল। কেননা তোমার নিজের তত্ত্বাবধান না হইলে ছেলেগুলি ভাল থাকে না। আর তোমাদের বাড়ীর কূয়া-পায়খানা অতিশয় অনিষ্টকারী জানিবে।
অনিলার একটী সম্বন্ধ আসিয়াছে। পাত্র ধনী ব্যক্তি, সব ভাল কিন্তু বয়স ৩৬ বৎসর। তোমার মত কি-না। অনিলার বিবাহে ব্যয় করা তোমার বা আমার ক্ষমতা নাই, অতএব যাহাতে অল্পব্যয় হয় তাহাই খুঁজিতে হয়। কৃতদার পাত্রে ব্যয় হইবে না।
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
২৮শে শ্রাবণ

প্রাণাধিকেষু—
এবার যখন কোন সুযোগ পাইবে আমার ঘরের চাবির গোছা পাঠাইয়া দিও। তোমার পিতার আমলের বঙ্গদর্শন তিন বৎসর আমার জন্য বাঁধাইয়া দিও।
আমি এক বেল কাগজ পাঠাইয়াছি, পৌঁছিয়াছে কিনা সংবাদ পাই নাই। সংবাদ লিখিবে। রথের সে ১৫ টাকা কি হইল লিখিবে। বড়বাবু দিয়াছেন কি?
আনন্দমঠ যে সংখ্যায় বাহির হইয়াছে সেই সংখ্যা হইতে এক কপি বঙ্গদর্শন অক্ষয় সরকারকে দিও। “With B.C. Chatterjee’s compliments” লিখিয়া দিও। তাহা হইলে তোমাদের দেওয়া বুঝাইবে না। আনন্দমঠ শেষ হইলে দেওয়া বন্ধ করিবে।
আমায় হাবড়ায় পত্র লিখিও। বঙ্গদর্শন অচল হইলে আমাকে জানাইও। টাকা বা matter সম্বন্ধে যাহা উপকার করিতে পারি করিব।
রাধানাথ আমাকে আন্দাজি ৩০‍৲ দিয়াছে। তোমাদের যদি despatch বন্ধ থাকে তবে লিখিও, আমি টাকা পাঠাইব।
ইতি তাং ১৪ জুলাই
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চাটার্জি
ঝিনাইদাহ, ২২শে কার্তিক

প্রিয়তমেষু—
তোমার পিতাকে আর অধিক কুইনাইন খাওয়াইবা না। কলিকাতায় পাঠাইবা। আমি জ্বরে বড় কষ্ট পাইয়াছি। যশোহর হইতে ডাক্তার ও ঔষধ আনাইয়া চিকিৎসা হইয়াছে। কাল রাত্রিতে জ্বর ছাড়িয়াছে। এই পত্রের সহিত তোমাদের সাংসারিক খরচ ১০০‍৲ টাকা, পূজার ১০‍৲ টাকা, ৺ঠাকুর সেবার বাকী ১৬‍৲, একুনে ১২৬‍৲ টাকা পাঠাইলাম। তোমার পিতর হাতে দিবে।
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

প্রাণাধিকেষু,
বারাসতের ডেপুটি-ম্যাজিষ্ট্রেট কেদার বসু রবিবার দিন প্রাতে কাঁটালপাড়ায় যাইবেন ও বৈঠকখানায় দুইদিন বাস করিবেন। বৈঠকখানাটি ঝাঁট দিয়া সাফ করাইয়া টেবিল চৌকি পাতিয়া রাখিবা। শয়ন জন্য একখানি তক্তপোষ পাতিয়া দিবা। রন্ধন জন্য কোন চালা সাফ করাইয়া রাখিবা, রাত্রিতে শয়ন জন্য আমায় যেরূপ বিছানা দাও, সেইরূপ দিবা। কেদারবাবু বড় ভদ্রলোক, পরম বৈষ্ণব ও শুদ্ধাচার। তাঁহাকে আনাইবার জন্য ষ্টেশনে ৮||• টার ট্রেণে লোক উপস্থিত থাকিলে ভাল হয়।
পুঃ কর্তার সপিণ্ড সময়ে সমাজ খাওয়ানো হয় নাই, আগামী বুধবার উদ্যোগ করার ইচ্ছা আছে, আম্র দধি ইত্যাদির বন্দোবস্ত রাখিবা। ভাল গ্লাস দেওয়ার জন্য কুম্ভকার ঠিক করিবা।
কেদারবাবুকে আনিতে ষ্টেশনে তুমি নিজে গেলে ভাল হয়।
আং শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

প্রিয়তমেষু,
মুরলী যে কাঁটালপাড়ায় যায় এমন কোন সম্ভাবনা নাই। বড়বাবুরও চাকর নাই। চাকর যাহাকে যাহাকে বহাল করিয়াছিলেন তাহারা পালাইয়াছে। কেহ থাকিতে চাহে না। আজ তিনি পৃথক বাসা করিয়াছেন, তাঁহার বাসায় অটল মোতায়েন আছে, অতএব মুরলীকে পাঠাইলে আমার বাসায় কাজ চলিবে না। অটল মুরলী উভয়ে উপস্থিত না থাকিলে বড়বাবুর কার্য চলে না। কেননা তাঁহার বাসায় জনপ্রাণী নাই। আমার কাঁটালপাড়া যাইবার কোন সম্ভাবনা নাই। বড়বাবুর অবস্থা ঘণ্টায় ঘণ্টায় পরিবর্তন হইতেছে, কখন কি রকম হয় তাহার স্থির নাই। তিনি আমাকে কোথাও যাইতে দেন না। রাত্রে উঠাইয়া আনেন। সুতরাং তাঁহাকে ফেলিয়া আমি কাঁটালপাড়া যাইতে পারিব না।
তোমার জ্যেষ্ঠতাতের এই মরণাপন্ন অবস্থা, আর তোমার পিতার শয্যাগত এই অবস্থায় তুমি যে ভোজের ঘটা বাধাইয়াছ তাহা অতি বিস্ময়কর। তোমার বালকবুদ্ধি আজও যায় নাই।
যাহা হউক সেখানে মুরলীর যাওয়া হইল না। সেখানে লোকাভাবে অটলকে পাঠান হইল না। আমার ছুরিকাঁটা যাহা ছিল তাহা ঝিনাইদহ হইতে আসিবার সময় Shirres সাহেবকে দিয়া আসিয়াছি। বেসেট যাহা আছে তাহা টেবিলে বাহির করা যায় না।
আমার বিবেচনায় যদি গোপেন্দ্রকৃষ্ণকে খাওয়াইতে হয়, তবে আমাদের দেশী ব্যঞ্জনাদি উত্তম করিয়া খাওয়াইলে ভাল হইতে পারে। তুমি যে ২||• পাঠাইয়াছিলে তাহা ফেরত পাঠাইলাম।
ইতি তাং বুধবার
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
১লা ফেব্রুয়ারী ১৮৮৬

প্রিয়তমেষু—
তোমার চাকরী হওয়ার সংবাদ পাইয়া আমার বিশেষ আনন্দ হইয়াছে। তোমার চাকরীতে আমার বিশেষ উপকার; কিন্তু তাহা তত আনন্দের কারণ নহে। তুমি অমানুষ হইয়া যাইতেছিলে, এক্ষণে মনুষ্যত্বলাভ করিতে পারিবে। আর আমি আজ মরিলে কাল তোমাদের সংসার নির্বাহের উপায় ছিল না। সে উপায় হইল, ইহাই আমার আনন্দের কারণ।
কোন organic disease না থাকিলে কেহই certificate দিতে অস্বীকার করে না। তোমার সেরূপ কোন পীড়া নাই। কর্মকার্য সম্বন্ধে উপদেশ চাহিয়াছ তাহা আমি দিব। অনুবর্তী হইলে তোমার উপকার হইবে। আপাততঃ নিম্নলিখিত বইগুলি মনোযোগ পূর্বক অধ্যয়ন করিতে আরম্ভ করিবে।
(1) Code of Cr. Procedure Chap. 5, 6, 7, 14, cal 3 sub, II,
(2) Penal Code.
(3) Evidence Act.
(4) Police Manual.
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

কল্যাণবরেষু—
তোমার পত্র পাইয়াছি, আঙ্গুলের একটু বেদনা হওয়ায় নিজহাতে পত্র লিখিতে পারিলাম না। তুমি নূতন কার্যে প্রবৃত্ত হইয়া যেরূপভাবে ব্যবহার করিতেছ তাহাতে সুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা নাই। উপরওয়ালা সাহেবরা যখন যাহা বলিবেন তখনই তাহা স্বীকার করিতে হইবে এবং সাধ্যানুসারে তাহা সম্পন্ন করিতে হইবে। রাসবিহারীবাবু কুলোক হইলেও তাঁহার উপর কিছুমাত্র অসন্তোষ প্রকাশ করিবে না। তাঁহার সম্বন্ধে কোন কথা সাহেবের নিকট বা অপর কাহারও নিকট কিছুমাত্র বলিবে না এবং তাঁহার খুব আনুগত্য করিবে। তিনি কাজ শেখান বা না শেখান আপনি কাজ শিখিবে। যে আপনি কাজ শিখিতে জানে তাহার পরের সাহায্যের প্রয়োজন হয় না, যে আপনি কাজ শিখিতে না জানে পরের সাহায্যে তাহার কোন উপকার হয় না। সাহেব যদ্যপি তোমাকে পুনর্বার “কুষ্টিয়া” যাইতে বলেন তখনই তাহা স্বীকার করিবে, কাজের জন্য আটকাইবে না। অপরজনকে জিজ্ঞাসা করিয়া কাজ করা যাইতে পারে। Magistrate সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ হইলে তোমাকে সদরে রাখার জন্য কোন কথা বলিবে না। ইহাকে “ঘোড়া ডিঙ্গাইয়া ঘাস খাওয়া বলে।” District সাহেব তাহাতে খুব রাগ করিবার সম্ভাবনা। বংশমর্যাদা লইয়া একশবার বড়াই করিবে না, উহাতে লোক বিরক্ত হয়, উপহাস করে এবং বংশেও এমন কিছু গৌরবের কথা নাই যে সকলের কাছে সে বড়াই করা যায়। অমুককে কুষ্টিয়া দাও, আমি যাইব না, এমন সকল কথা সাহেবের কাছে বলিবে না। সর্বদা নম্রভাবে চলিবে। নম্রতা শিক্ষা তোমার নিতান্ত আবশ্যক। যাহারা তোমাকে পরামর্শ দিয়াছে যে, তুমি ছয়মাসকাল সদরে থাকিতে চাও একথা তুমি জোর করিয়া বলিতে পার, তাহারা তোমার পরম শত্রু। জোর করিয়া কোন কথা বলিলে তোমার চাকরী থাকিবে না। সাহেবের যাহা ইচ্ছা তাহা করিতে পারে। বাঙ্গালী বিশেষতঃ তোমার মত ক্ষুদ্র চাকুরের কোন কথায় জোর চলে না ইহা নিশ্চিত জানিও। কার্যে প্রবৃত্ত হইয়াছে। রাসবিহারীবাবু কি অন্য কাহাকেও শত্রু করিও না। ইতি—১৭ই ভাদ্র
শ্রীবঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়

তুমি বোধকরি পূজার সময় বাড়ী গিয়াছিলে, এতদিনে ফিরিয়া আসিয়া থাকিবে। আমার নিকট উপদেশ চাহিয়াছিলে, আমি এই পত্রের মধ্যে সাতটী উপদেশ লিখিয়া পাঠাইলাম। এই সাতটী Golden Rule বিবেচনা করিবে। বিশেষ প্রথম পাঁচটি। ইহার অনুবর্তী হইলে সর্বত্র মঙ্গল ঘটিবে।
এখানকার সমস্ত মঙ্গল। ভরসা করি এই মাস হইতে তুমি সংসারের ভার লইতে পারিবে। ইতি—১লা আশ্বিন
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বিশেষ উপদেশ

১। প্রথম প্রয়োজনীয় কথা—সত্য ভিন্ন মিথ্যা পথে যাইবে না। কলমের মুখে কখন মিথ্যা নির্গত না হয়। তাহা হইলে চাকরী থাকে না। নিতান্তপক্ষে কর্তৃপক্ষের অবিশ্বাস জন্মে। অবিশ্বাস জন্মিলে আর উন্নতি হয় না।
২। দ্বিতীয়—প্রয়োজনীয় কথা পরিশ্রম। বিনা পরিশ্রমে কখন উন্নতি হয় না। কখনও কোন কাজ পড়িয়া না থাকে।
৩। উপরওয়ালাদের আজ্ঞাকারিতা। তাঁহাদিগের নিকট বিনীত ভাব। চাকরী রাখার এবং উন্নতির পক্ষে ইহা নিতান্ত প্রয়োজনীয়। তর্ক করিও না।
৪। আপনার কাজের Rules & Hours বিশেষরূপে অবগত হইবে।
৫। কাহারও উপর অত্যাচার করিবে না। পুলিশের লোকে আসামীর উপর বড় অত্যাচার করে। অনেকের বিশ্বাস তাহা না হইলে কাজ চলে না, তাহা ভ্রান্তি। না চলে সেও ভাল। ইহা নিজে কখন করিবে না বা অধীনস্থ কাহাকেও করিতে দিবে না। ইহার কারাদণ্ড আছে।
৬। সকলের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করিবে। অধীনস্থ ব্যক্তিদিগকে সদ্ব্যবহার দ্বারা বশীভূত করিবে। কেহ শত্রু না হয়। কর্তব্য কর্মের অনুরোধে অনেকের অনিষ্ট করিতে হয়। উহার উপায় নাই। দোষীর অবশ্য দণ্ড চাই।
৭। নিষ্কারণে ভীত হইও না।
রামদাস সেনকে লিখিত পত্র
সুহৃদ্বরেষু—
আপনার প্রণয়োপহার স্বরূপ গ্রন্থ দুইখানি পাইয়াছি। পীড়াপ্রযুক্ত এতদিন পুস্তক প্রাপ্তির সংবাদ ও পত্রের উত্তর লিখিতে পারি নাই। অপরাধ মার্জনা করিবেন। কমলাকান্তের দ্বিতীয় সংস্করণ একখণ্ড আপনার নিকট পাঠাইবার জন্য কলিকাতায় আমার কার্যকারককে লিখিয়াছি। ভরসা করি আপনার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল। ১‍লা অগ্রহায়ণ
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বিপিনচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত পত্র

প্রিয়তমেসু—
মেজবাবুর রীতিমত চিকিৎসা করাইবে। ব্যয় জন্য কুণ্ঠিত হইবে না। আমার কাঁটালপাড়া যাওয়া দুর্ঘট। Suburban Police Court এর চার্জ আমার নিকট, Confession or Dying Declaration লিখিতে হয়, এজন্য কোথাও যাইতে বাসনা করি না। তবে নিতান্ত আবশ্যক হইলে তখন বিবেচনা করা যাইবে।
ডাক্তার যেরূপ বলিয়াছে আমার সেরূপ বোধ হয় না। কোন চিন্তার বিষয় নাই। মেজবাবুর ওরূপ জ্বর হইয়া থাকে। এক্ষণে কেমন থাকে আগামী কালই আমাকে সম্বাদ দিবে।
আমার নিজের ব্যবস্থা, এক আধ dose China দিবে। China এই অবস্থায় বলকারক।
পুঃ আমি রবিবার কাঁটালপাড়া যাইব।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বঙ্কিমচন্দ্রের শেষ উইল

লিখিতং শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পিতা ৺যাদবচন্দ্র জাতি ব্রাহ্মণ সাং কাঁটালপাড়া পরগণা হাবিলীসহর ষ্টেশন ও সবরেজিষ্টারী নৈহাটী ডিষ্ট্রিক্ট রেজিষ্টারী ২৪ পরগণা হাল সাকিন কলিকাতা পটলডাঙ্গা ৫নং প্রতাপ চাটুয্যের লেন কস্য উইল পত্রমিদং কার্যঞ্চাগে, যেহেতু আমার শরীর অসুস্থ হওয়ায় এবং আমার সাবেক উইল পরিবর্তন করা আবশ্যক বোধ হওয়ায় আমি নিম্নলিখিত উইল করিতেছি—
১ দফা কলিকাতা পটলডাঙ্গার ৫ নম্বর প্রতাপ চাটুয্যের গলির ভদ্রাসন বাটীর ও ৪ নম্বর দুর্গাপ্রসাদ ঘোষের নামীয় জমি যাহাতে আমি স্বত্ত্বাধিকারী ও দখলিকার আছি, আমার মৃত্যুর পর হইতে আমার বনিতা শ্রীমতী রাজলক্ষ্মী দেবী তদুভয়ের সম্পূর্ণ স্বত্তাধিকারিণী হইবেন এবং তদুভয়ের তাঁহার দান বিক্রয় ও হস্তান্তর করিবার সম্পূর্ণ অধিকার এবং তিনি উইল করিয়া অন্যকে দিয়া যাইতে পারিবেন কেবল উপদেশ বা পরামর্শ স্বরূপ আমি লিখিতেছি যে তিনি ঐ উভয় সম্পত্তি আমার জ্যেষ্ঠা কন্যা শ্রীমতী শরৎকুমারী দেবীকে উইল করিয়া দিয়া যাইবেন কিন্তু এই উপদেশের দ্বারা তাঁহার অন্যপ্রকার হস্তান্তর করার ক্ষমতা কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ করিতেছি না।
২ দফা আমার অপরাপর স্থাবর সম্পত্তি সম্বন্ধে উইল করার কোন প্রয়োজন দেখি না।
৩ দফা আমার মৃত্যুর পর আমার সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তিতে আমার বনিতা আইনানুসারেই সম্পূর্ণ অধিকারিণী হইবেন এজন্য সে সম্বন্ধেও কোন উইলের প্রয়োজন নাই, আমার পুস্তকের কপিরাইট অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে গণ্য।
৪ দফা আমার কৃত সাবেক উইল সমস্ত বাতিল ও নামঞ্জুর হইল। ইতি—১৮৯০। ২৩ মে—