উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

ষোড়শ। যোদ্ধা এবং কবি

ষোড়শ। যোদ্ধা এবং কবি

কবি শ্রীহর্ষ, যোদ্ধা শ্রীহর্ষ, রাজর্ষি শ্রীহর্ষ। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভারতের ভাগ্যলক্ষ্মী হলেন আর্যাবর্তের নাট্যশালা থেকে অদৃশ্য।

বিশাল সাম্রাজ্য হয়ে গেল খণ্ডবিখণ্ড। মৌর্য চন্দ্রগুপ্ত, বিন্দুসার, অশোক, গুপ্তবংশীয় সমুদ্রগুপ্ত, চন্দ্রগুপ্ত-বিক্রমাদিত্য, কুমারগুপ্ত, দেবগুপ্ত, মালবরাজ যশোধর্মদেব এবং সর্বশেষে থানেশ্বরের হর্ষবর্ধন। তারপর আর্যাবর্তে এমন কোনও শক্তিধর মহাবীর আত্মপ্রকাশ করেননি, যিনি সম্রাট উপাধি ধারণ করতে পারেন। প্রায় দুই শতাব্দী পরে (৬৪০-৮১০ খ্রিঃ) মিহির ভোজ কান্যকুব্জের সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন, উত্তরাপথের অধিকাংশই ছিল যাঁর করতলগত। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তাঁর যুগে মেগাস্থেনিস, ফাহিয়েন বা হুয়েন সাঙের মতন বিদেশি রাজদূত বা পরিব্রাজক আর্যাবর্তে আসেননি এবং হরিষেণ বা বাণভট্টের মতন কবিও রাজসভা অলংকৃত করেননি, কাজেই মহারাজাধিরাজ মিহির ভোজের কীর্তিকাহিনির সঙ্গে ইতিহাস কোনও পরিচয়ই স্থাপন করতে পারেনি। কথায় বলে ‘কৃপাণের ঘরে শক্তিশালী হচ্ছে লেখনী’। ভুল কথা নয়; গ্রিক রাজদূত মেগাস্থেনিস না থাকলে মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের, কবি হরিষেণ না থাকলে সমুদ্রগুপ্তের, চৈনিক পরিব্রাজক ফাহিয়েন না থাকলে চন্দ্রগুপ্ত-বিক্রমাদিত্যের এবং পরিব্রাজক হুয়েন সাঙ ও কবি বাণভট্ট না থাকলে হর্ষবর্ধনের প্রকৃত পরিচয় ইতিহাস আজ জানতেই পারত না।

প্রামাণিক ইতিহাসের পৃষ্ঠায় দেখি, হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর উত্তরাপথের দিকে দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন খুদে খুদে রাজার দল, পরস্পরের সঙ্গে মারামারি, কাটাকাটি করেই তৃপ্ত হত তাঁদের রাজধর্ম। একাধিক অপেক্ষাকৃত বৃহৎ রাজ্য ছিল বটে, কিন্তু সেগুলিকে সাম্রাজ বলে সন্দেহ করা চলে না। বড় বড় সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতবর্ষের বরাবরই হয়েছে এই একই দুরবস্থা এবং বরাবরই ওই একতাহীনতা ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ভারতবর্ষের মধ্যে প্রবেশ করেছে পারসি, গ্রিক, শক, হুন, মোগল ও ইংরেজ প্রভৃতি বিদেশি শত্রুরা। খ্রিস্ট জন্মাবার তিন শত সাতাশ বৎসর আগে দিগবিজয়ী আলেকজান্ডার ভারতবর্ষে এসে দেখেছিলেন ঠিক এই বিসদৃশ দৃশ্যই। তারপর হর্ষবর্ধনের কয়েক শত বৎসর পরে মুসলমানরাও ভারতের মাটিতে পা দিয়ে দেখেছিল ওই রকম দৃশ্যেরই পুনরাভিনয়।

হর্ষবর্ধনের ধর্মমত ছিল সে যুগের পক্ষে যথেষ্ট উদার। বুদ্ধদেবের প্রতি তাঁর অচলা ভক্তি থাকলেও তিনি নিজে বৌদ্ধ ছিলেন না, শিব ও সূর্যও লাভ করতেন তাঁর শ্রদ্ধা। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর আর্যাবর্তের মধ্যে আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল ধর্মে ধর্মে সংঘর্ষ। হিন্দু মাত্রই নির্বিচারে ঘৃণা করত বৌদ্ধদের! কিন্তু বিভিন্ন সম্প্রদায়ের হিন্দুদেরও মধ্যে ছিল দস্তুরমতো অহি-নকুল সম্পর্ক। তারা কেউ ছিল শিবের, কেউ ছিল বিষ্ণুর এবং কেউ ছিল অগ্নির বা গণেশের বা সূর্যের বা ভৈরবের বা কার্তিকের বা যমের বা বরুণের উপাসক। তা ছাড়া অনেকের পূজ্য ছিল আকাশ বা জল বা বায়ু বা বৃক্ষ বা সর্প—এমনকি ভূতপ্রেত পর্যন্ত।

কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হল বৌদ্ধরা। সম্রাট অশোক, কনিষ্ক ও হর্ষবর্ধন এবং তারপর পালরাজগণের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে সব দিক দিয়েই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম। ওঁদের সাহায্যেই বৌদ্ধধর্ম ভারতের বাইরেও সুদূর দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়বার সুযোগ পেয়েছিল। সম্রাট অশোক বুদ্ধধর্ম প্রচার করবার ফলে ভারতের বাইরে এশিয়ার নানা দেশে—এমনকী ইউরোপ ও আফ্রিকাতেও প্রচারকদের প্রেরণ করেছিলেন। হর্ষবর্ধনও চিন দেশের সঙ্গে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কীয় যোগস্থাপন করতে ত্রুটি করেননি।

এই রাজ-সাহায্য হারিয়ে বৌদ্ধদের দুরবস্থার সীমা রইল না। ওদিকে উদয়ন বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করে শঙ্কারাচার্যের জন্যে পথ তৈরি করে দিলেন। সেই পথ দিয়ে অগ্রসর হলেন যখন (৭৮৮-৮২০ খ্রিঃ) অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্য, বৌদ্ধদের অবস্থা হয়ে উঠল তখন একান্ত অসহায়।

হর্ষবর্ধনের চিতা প্রায় শীতল হতে-না-হতেই প্রতিক্রিয়া শুরু হল। হর্ষবর্ধন নিঃসন্তান ছিলেন। হত্যাকারী অর্জুনাশ্ব যখন কান্যকুব্জের সিংহাসন অধিকার করলে, তখন তাকে বাধা দিতে পারে রাজবংশে এমন কেউ ছিল না।

অর্জুনাশ্বের পক্ষে ছিল দলে দলে অসভ্যজাতীয় যোদ্ধা। অর্থ দিয়ে এবং বেপরোয়া লুণ্ঠনের লোভ দেখিয়ে অর্জুনাশ্ব তাদের বশীভূত করেছিল। দেশের দিকে দিকে বৌদ্ধ মঠ-মন্দিরের অভাব ছিল না এবং রাজানুগ্রহে সেগুলির মধ্যে সজ্জিত হয়েছিল প্রচুর ধনরত্ন ও বহু মূল্যবান দ্রব্য। প্রথমেই সেই সব মঠমন্দিরের ভিতরে আরম্ভ হল আবার লুণ্ঠনলীলা।

অধিকাংশ ব্রাহ্মণই ছিল বৌদ্ধদের পরম শত্রু। হর্ষবর্ধনের দোর্দণ্ডপ্রতাপে এত দিন এই ব্রাহ্মণের দল কুঞ্চিতফণা ফণীর মতো মনে মনেই পুষে আসছিল মনের যত রাগ ও আক্রোশ, এইবার সুযোগ পেয়ে তারাও অর্জুনাশ্বের সঙ্গে যোগ দিয়ে বৌদ্ধদের আক্রমণ করলে পৈশাচিক উল্লাসে।

কবি বাণভট্ট বললেন, ‘ওহে সেনাপতি সিংহনাদ!’

সিংহনাদ ম্রিয়মান কণ্ঠে বললেন, ‘আমাকে আর সেনাপতি বলে ডেকে ব্যঙ্গ কোরো না বাণবট্ট।’

‘ব্যঙ্গ?’

‘তা নয় তো কী? আমাকে যে সেনাপতি বলে ডাকছ, আমার সৈন্য কোথায়?’

‘মানে?

‘স্বর্গীয় মহারাজের বৌদ্ধপ্রীতির জন্যে সেনাদলের অনেকেই খুশি ছিল না। তাদের বেশিরভাগ লোকই দুষ্ট অর্জুনাশ্বকে রাজা বলে মেনে নিয়েছে। চক্ষুলজ্জার খাতিরে যারা অতটা নীচে নামতে পারেনি, তারাও চুপ করে আছে নিরপেক্ষর মতো।’

‘তুমি কি বলতে চাও, সেনাদলের মধ্যে মহারাজের বিশ্বাসী লোক ছিল না?’

‘ছিল বইকি! কিন্তু তারা দলে হালকা। তারা হতাশ হয়ে দেশ ত্যাগ করেছে।’

‘অতএব?’

‘অতএব আমি এখন হয়ে পড়েছি সোনার পাথরবাটির মতো—অর্থাৎ সৈন্যহীন সেনাপতি।’

‘তাহলে এখন কী করা উচিত?’

‘উচিত কান্যকুব্জের বাইরের দিকে দ্রুতবেগে পদচালনা করা।’

‘আরে নির্বোধ, বিদেশবিভুঁইয়ে গিয়ে খাব কী?’

‘বায়ু কিংবা ঘাস কিংবা ভুষি। এখানে থাকলে খাবি ভক্ষণ করতে বিলম্ব হবে না। সেটা অধিকতর ভয়াবহ। ওই শোনো, বিদ্রোহীদের জয়-কোলাহল। ইচ্ছা হয়তো তুমি এখানে অবস্থান করো, এই আমি সবেগে প্রস্থান করলুম!’

‘তিষ্ঠ ভায়া, কিছুক্ষণ তিষ্ঠ! এখনও তুমি নিরস্ত্র নও, পথে-বিপথে বিপদ ঘটলে তোমার তরবারি আমাকে রক্ষা করতে পারবে।’

‘এসো তাহলে দেরি করছ কেন?’

‘ব্রাহ্মণী যথাসময়ে মরে বেঁচে গিয়েছেন। এখন তোমার তরবারির মতো আমারও প্রধান সম্বল কাব্যপুথিগুলি। দাঁড়াও, চটপট সেগুলি গুছিয়ে নিয়ে বগলদাবা করি। হা মহারাজ হর্ষবর্ধন, হা আমার কাব্যকুঞ্জ, হা আমার এত সাধের ‘হর্ষচরিত’।’