উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ । রাজার ঘোড়া

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ । রাজার ঘোড়া

তক্ষশীলার অদূরে মহারাজা হস্তীর রাজ্য। মহারাজা হস্তীর নাম গ্রিকদের ইতিহাসে স্থান পেয়েছে, কিন্তু তাঁর রাজধানীর নাম অতীতের গর্ভে হয়েছে বিলুপ্ত।

তবু তাঁর রাজধানীকে আমার চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কাছে, দূরে পাহাড়ের পর পাহাড় এবং গিরিনদীদের বুকে বুকে নাচছে গাছের শ্যামল ছায়া, আকাশের প্রগাঢ় নীলিমা। এক-একটি পাহাড়ের শিখরের উপরেও আকাশ-ছোঁয়া মাথা তুলে আছে সুরক্ষিত গিরিদুর্গ—তাদের চক্ষুহীন নির্বাক পাথরে পাথরে জাগছে যেন ভয়ানকের ভ্রূভঙ্গ!

রাজধানীর বাড়ি ঘর কাঠের। সেকালে ভারতবাসীরা পাথর বা ইট ব্যবহার করত বড় জোর বনিয়াদ গড়বার জন্যে। অনেক কাঠের বাড়ি তিন-চার-পাঁচ তলা কি আরও বেশি উঁচু হত। কাঠের দেওয়ালে দরজায় থাকত চোখ-জুড়ানো কারুকার্য। কিন্তু সে-সব কারুকার্য বর্তমানের বা ভবিষ্যতের চোখ আর দেখবে না, কারণ কাঠের পরমায়ু বেশি নয়। তবে পরে ভারত যখন পাথরের ঘরবাড়ি তৈরি করতে লাগল, তখনকার শিল্পীরা আগেকার কাঠের খোদাই কারুকার্যকেই সামনে রাখলে আদর্শের মতো। ওই সব পুরানো মন্দিরের কতকগুলি আজও বর্তমান আছে। তাদের দেখে তোমরা খ্রিস্টপূর্ব যুগের ভারতীয় কাঠের বাড়ির সৌন্দর্য কতকটা অনুমান করতে পারবে। ভারতের প্রতিবেশী ব্রহ্ম ও চিন প্রভৃতি দেশ কাঠের ঘর-বাড়ি-মন্দির গড়ে আজও প্রাচীন প্রাচ্য সভ্যতার সেই চিরাচরিত রীতির সম্মান রক্ষা করছে।

খ্রিস্ট জন্মাবার আগে তিনশো সাতাশ অব্দের জুন মাসের একটি সুন্দর প্রভাত। শীত-কুয়াশার মৃত্যু হয়েছে। চারিদিক শান্ত সূর্যকরে সমুজ্জ্বল। শহরের পথে পথে নাগরিক জনতা। তখন পৃথিবীর কোথাও কেউ পরদাপ্রথার নাম শোনেনি, তাই জনতার মধ্যে নারীর সংখ্যাও অল্প নয়। নারী ও পুরুষ উভয়েরই দেহ সুদীর্ঘ, বর্ণ গৌর, পরনে জামা, উত্তরীয়, পা-জামা। দুর্বল ও খর্ব চেহারা চোখে পড়ে না বললেই হয়।

চারিদিকে নবজাগ্রত জীবনের লক্ষণ। দোকানে-বাজারে পসারি ও ক্রেতাদের কোলাহল, জনতার আনাগোনা, নদীর ঘাটে স্নানার্থীদের ভিড়, দলে দলে মেয়ে জল তুলে কলসি মাথায় নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসছে, পথ দিয়ে রাজভৃত্য দামামা বাজিয়ে নতুন রাজাদের প্রচার করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে, স্থানে স্থানে এক-এক দল লোক দাঁড়িয়ে তাই নিয়ে আলোচনা করছে এবং অনেক বাড়ির ভিতর থেকে শোনা যাচ্ছে বৈদিক মন্ত্রপাঠের গম্ভীর ধ্বনি।

নগরতোরণে দুজন প্রহরী অভিসার ও তক্ষশীলা রাজ্যের নতুন যুদ্ধের ব্যাপার নিয়ে গল্প করছে এবং অনেকগুলি নাগরিক তাই শোনবার জন্যে তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রথম প্রহরী বলছে, ‘তক্ষশীলার বুড়ো রাজার ভীমরতি হয়েছে।’

দ্বিতীয় প্রহরী বললে, ‘কেন?’

‘এই সেদিন মহারাজ পুরুর কাছে তক্ষশীলার সৈন্যরা কী মার খেয়ে পালিয়ে এল, কিন্তু বুড়ো রাজার লজ্জা নেই, আবার এরই মধ্যে অভিসারের রাজার সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়েছে, সেদিন নাকি একটা মস্ত লড়াইও হয়ে গেছে।’

‘লড়ায়ে কী হল?’

‘পাকা খবর এখনও পাইনি। কিন্তু যুদ্ধে যে-পক্ষই জিতুক, দুই রাজ্যেরই হাজার হাজার লোক মরবে, ঘরে ঘরে কান্না উঠবে, জিনিসপত্তরের দাম চড়বে।’

একজন মুরুব্বি-গোছের নাগরিক বললে, ‘রাজাদের হবে খেয়াল, মরবে কিন্তু প্রজারা!’

প্রহরী বললে, ‘কিন্তু সব রাজা সমান নয়, মহারাজা হস্তীর রাজত্বে আমরা পরম সুখে আছি! আমাদের মহারাজা মস্ত যোদ্ধা, কিন্তু তিনি কখনও অন্যায় যুদ্ধ করেন না।’

নাগরিক সায় দিয়ে বললে, ‘সত্য কথা। মহারাজা হস্তী অমর হোন!’

ঠিক সেই সময় দেখা গেল, মূর্তিমান ঝড়ের মতো চারিদিকে ধুলো উড়িয়ে ছুটে আসছে এক মহাবেগবান ঘোড়া এবং তার পিঠে বসে আছে যে সওয়ার, ডানহাতে জ্বলন্ত তরবারি তুলে শূন্যে আন্দোলন করতে করতে চিৎকার করছে সে তীব্র স্বরে!

নগরতোরণে সমবেত জনতার মধ্যে নানা কণ্ঠে বিস্ময়ের প্রশ্ন জাগল :

‘কে ও? কে ও?’

‘ও তো দেখছি ভারতবাসী! কিন্তু অত চেঁচিয়ে ও কী বলছে?’

‘পাগলের মতো লোকটা তরোয়াল ঘোরাচ্ছে কেন?’

অশ্বারোহী কাছে এসে পড়ল—তার চিৎকারের অর্থও স্পষ্ট হল।

সে বলছে—’জাগো! জাগো! শত্রু শিয়রে! অস্ত্র ধরো, অস্ত্র ধরো!’

একজন প্রহরী সবিস্ময়ে বললে, ‘কে শত্রু? তক্ষশীলার বুড়ো রাজা আমাদের আক্রমণ করতে আসছে নাকি?’

নগরতোরণে এসেই অশ্বারোহী ঘোড়া থেকে লাফিয়ে পড়ে উত্তেজিত সুরে বলে উঠল, ‘আমাকে মহারাজা হস্তীর কাছে নিয়ে চলো!’

প্রহরী মাথা নেড়ে বললে, ‘সে হয় না। আগে বলো কে তুমি, কোথা থেকে আসছ?’

গম্ভীর স্বরে সুবন্ধু বললে, ‘আমি ভারতসন্তান সুবন্ধু। আসছি হিন্দুকুশ ভেদ করে শত শত গিরি নদী অরণ্য পার হয়ে!’

‘কী প্রয়োজনে?’

সুবন্ধুর বিরক্ত দুই চোখে জাগল অগ্নি। অধীর স্বরে বললে, ‘প্রয়োজন? ওরে ঘুমন্ত, ওরে অজ্ঞান, যবন আলেকজান্ডার মহাবন্যার মতো ধেয়ে আসছে হিন্দুস্থানের দিকে, তার লক্ষ লক্ষ সৈন্য রক্তগঙ্গার তরঙ্গে ভাসিয়ে দেবে আর্যাবর্তকে, এখন কি তোমাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করবার সময় আছে? নিয়ে চলো আমাকে মহারাজের কাছে! শত্রু ভারতের দ্বারে উপস্থিত, প্রত্যেক মূহূর্ত এখন মূল্যবান।’

মন্ত্রণাগার! রাজা হস্তী সিংহাসনে। অপূর্ব তাঁর দেহ—দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে যথার্থ পুরুষোচিত। ধবধবে গৌরবর্ণ, প্রশস্ত ললাট, আয়ত চক্ষু, দীর্ঘ নাসিকা, দৃঢ় সংবদ্ধ ওষ্ঠাধর, কবাট বক্ষ, সিংহকটি, আজানুলম্বিত বাহু। তাঁকে দেখলেই মহাভারতে বর্ণিত মহাবীরদের মূর্তি মনে পড়ে।

রাজার ডানপাশে মন্ত্রী, বাঁ-পাশে সেনাপতি, সামনে কক্ষতলে হাতজোড় করে জানু পেতে উপবিষ্ট সুবন্ধু—সর্বাঙ্গ তার পদধুলায় ধূসরিত।

রাজার কপালে চিন্তার রেখা, যুগ্মভুরু সঙ্কুচিত। সুবন্ধুর বার্তা তিনি শুনে অনেকক্ষণ মৌনব্রত অবলম্বন করে রইলেন। তারপর ধীর-গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কোন পথ দিয়ে ভারতে এসেছ?’

‘খাইবার গিরিসঙ্কট দিয়ে।’

‘যবন সৈন্য কোন পথ দিয়ে আসছে?’

‘কাবুল নদের পার্শ্ববতী উপত্যকা দিয়ে। কিন্তু তারা এখন আর আসছে না মহারাজ, এতক্ষণে এসে পড়েছে।’

‘তুমি আর কী কী সংবাদ সংগ্রহ করেছ, বিস্তৃতভাবে বলো।’

সুবন্ধু বলতে লাগল, ‘মহারাজ, নিবেদন করি! আলেকজান্ডার তাঁর দুজন বড় বড় সেনাপতিকে সিন্ধুনদের দিকে যাত্রা করবার হুকুম দিয়েছেন। তাঁদের নাম হেফাইসমান আর পার্ডিক্কাস। এই খবর নিয়ে প্রথমে আমি মহারাজার কাছে যাই। কিন্তু বলতেও লজ্জা করে, তক্ষশীলার মহারাজার মুখ এই দুঃসংবাদ শুনে প্রসন্ন হয়ে উঠল। তিনি বললেন, ‘যবন আলেকজান্ডার আমার শত্রু নন, আমি আজকেই বন্ধুরূপে তাঁর কাছে দূত পাঠাব। তিনি এসে স্বদেশি শত্রুদের কবল থেকে আমাকে উদ্ধার করবেন।’ আমি বলুলম, ‘সে কী মহারাজ, আলেকজান্ডার যে ভারতের শত্রু!’ তিনি অম্লানবদনে বললেন, ‘ভারতে নিত্য শত শত বিদেশি আসছে, আলেকজান্ডারও আসুন, ক্ষতি কী? যে তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলবে, তিনি হবেন কেবল তারই শত্রু। তবে তাঁকে দেশের শত্রু বলব কেন? আর ভারতের কথা বলছ? ভারত কি আমার একলার? বিশাল ভারতে আছে হাজার হাজার রাজা সুযোগ পেলেই তারা আমার রাজ্য লুট করতে আসবে, তাদের জন্যে আমি একলা প্রাণ দিতে যাব কেন? যাও সুবন্ধু, এখনই তক্ষশীলা ছেড়ে চলে যাও, নইলে আমার বন্ধু, সম্রাট আলেকজান্ডারের শত্রু বলে তোমাকে বন্দি করব।’ আমি আর কিছু না বলে একেবারে আপনার রাজ্যে উপস্থিত হয়েছি। এখন আপনার অভিমত কী মহারাজ?’

হস্তী একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, ‘আমার অভিমত? যথাসময়ে শুনতে পাবে। মন্ত্রীমহাশয়, আলেকজান্ডার যে পারস্য জয় করে দিগবিজয়ে বেরিয়েছেন, সে খবর আমরা আগেই পেয়েছিলুম। কিন্তু তাঁর সেনাপতিরা যে এত শীঘ্র ভারতে প্রবেশ করেছেন, এ খবর আপনি রাখেননি কেন? আমার রাজ্যে কি গুপ্তচর নেই?’

মন্ত্রী লজ্জিত স্বরে বললেন, ‘মহারাজ, একচক্ষু হরিণের মতো আমাদের দৃষ্টি সজাগ হয়ে ছিল কেবল খাইবার গিরিসঙ্কটের দিকেই, কারণ বহিঃশত্রুরা ওই পথেই ভারতে প্রবেশ করে। যবন সৈন্যরা যে নতুন পথ দিয়ে ভারতে আসবে, এটা আমরা কল্পনা করতে পারিনি!’

হস্তী বিরক্তস্বরে বললেন, ‘এ অন্যমনস্কতা অমার্জনীয়। আচ্ছা সুবন্ধু, তুমি বললে আলেকজান্ডার তাঁর দুই সেনাপতিকে এদিকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজে এখন কোথায়?’

‘মহারাজ, আলেকজান্ডার নিজে তাঁর প্রধান বাহিনী নিয়ে সীমান্তের পার্বত্য রাজাদের দমন করতে গিয়েছেন।’

‘হু! দেখছি এই যবনসম্রাট রণনীতিতে অত্যন্ত দক্ষ। এরই মধ্যে সীমান্তের পার্বত্য রাজাদের মতিগতি তিনি বুঝে নিয়েছেন। এই যুদ্ধপ্রিয় বীরদের পিছনে রেখে ভারতে ঢুকলে যে সর্বনাশের সম্ভাবনা এ সত্য তিনি জানেন।’

সেনাপতি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সুবন্ধু, যবনসম্রাটের অধীনে কত সৈন্য আছে?’

‘কেউ বলছে এক লক্ষ, কেউ বলছে লক্ষাধিক। আমার মতে, অন্তত দেড় লক্ষ। কারণ পথে আসতে আসতে আলেকজান্ডার অসংখ্য পেশাদার সৈন্য সংগ্রহ করেছেন।’

হস্তী বললেন, ‘কিন্তু বিদেশি যবনরা ভারতে ঢুকবার নতুন পথের সন্ধান জানলে কেমন করে?’

সুবন্ধু তিক্তস্বরে বললে, ‘ভারতের এক কুসন্তান পিতৃভূমির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে যবনদের পথ দেখিয়ে আনছে। নাম তার শশীগুপ্ত, সে নাকি আলেকজান্ডারের বিশ্বস্ত এক সেনাপতি। মহারাজ, এই শশীগুপ্তের সঙ্গে রণস্থলে একবার মুখোমুখি দেখা করব, এই হল আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা! আর্যাবর্তের শত্রু আর্য! এ-কথা কল্পনাতীত!’ বলতে বলতে তার বলিষ্ঠ ও বৃহৎ দেহ রুদ্ধ ক্রোধে যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠল।

হস্তী একটু হেসে বললেন, ‘শান্ত হও সুবন্ধু, শশীগুপ্ত এখন তোমার সামনে নেই। মন্ত্রীমহাশয়, এখন আমাদের কর্তব্য কী? শিয়রে শত্রু, এখনও আমরা ঘুমাব, না জাগব? হাতজোড় করব, না তরবারি ধরব? গলবস্ত্র হব, না বর্ম পরব? আপনি কী বলেন?’

বৃদ্ধ মন্ত্রী মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘দেড় লক্ষ যবন সৈন্যের সামনে আমাদের পঁচিশ-তিরিশ হাজার সৈন্য কতক্ষণ দাঁড়াতে পারবে মহারাজ? ঝড়ের মুখে একখণ্ড তুলোর মতো উড়ে যাবে।’

সুবন্ধু বললে, ‘মন্ত্রীমহাশয়, বৃশ্চিক হচ্ছে ক্ষুদ্র জীব, কিন্তু বৃহৎ মানুষ তাকেও ভয় করে। ক্ষুদ্র হলেই কেউ তুচ্ছ হয় না। মানুষ বৃশ্চিককে ভয় করলেও এক চপেটঘাতে তাকে হত্যা করতে পারে।’

সুবন্ধু বললে, ‘মানলুম। কিন্তু আলেকজান্ডারের মূল বাহিনী এখানে আসতে এখনও অনেক দেরি আছে। তাঁর দুই সেনাপতির অধীনে বোধ হয় পঞ্চাশ হাজারের বেশি সৈন্য নেই।’

‘যুবক, তুমি কেবল বর্তমানকে দেখছ, ভবিষ্যৎ তোমার দৃষ্টির বাইরে! আজ আমরা অস্ত্র ধরব, কিন্তু কাল যখন যবনসম্রাট নিজে আসবেন সসৈন্যে, তখন আমরা কী করব?’

সুবন্ধু বললে, ‘আপনার মতো বিজ্ঞতা আমার নেই বটে, কিন্তু ভবিষ্যৎকে আমি ভুলিনি মন্ত্রীমহাশয়! ভারতে আসবার পথের উপরেই আছে আপনাদের গিরিদুর্গ। সেই গিরিদুর্গে গিয়ে আপনারা যবন সেনাপতিদের পথরোধ করুন। যদি দু-মাস দুর্গ রক্ষা করতে পারেন, যবনসম্রাট স্বয়ং এলেও আপনাদের ভয় নেই।’

‘কেন?’

‘ইতিমধ্যে আমি আমার দেশে—মহারাজা পুরুর রাজ্যে ফিরে যাব। আমাদের মহাবীর মহারাজকে কে না জানে? তাঁর কাছ থেকে তক্ষশীলার কাপুরুষতা দুঃস্বপ্নেও কেউ প্রত্যাশা করে না। তাঁর জীবনের সাধনাই হচ্ছে বীরধর্ম। যবনরা আর্যাবর্তে ঢুকতে উদ্যত শুনলেই তিনি ক্রুদ্ধ সিংহের মতো গর্জন করে এখানে ছুটে আসবেন! তার উপরে অভিসার রাজ্যের শত্রু তক্ষশীলা যখন যবনদের পক্ষ অবলম্বন করবে, অভিসারের রাজা তখন নিশ্চয়ই থাকবে আপনাদের পক্ষে।’

মন্ত্রী জবাব দিলেন না, হতাশভাবে ক্রমাগত মাথা নাড়তে লাগলেন।

হস্তী আবার একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘সুবন্ধু, আমাকে ভাবতে সময় দাও—কারণ এ হচ্ছে জীবন-মরণের প্রশ্ন! যবনরা প্রবল, আমরা দুর্বল। তুমি তিন দিন বিশ্রাম করো, আমি ইতিমধ্যে সমস্ত সংবাদ সংগ্রহ করি!’

কিন্তু তিন দিন পরে সুবন্ধুর কাছে মহারাজা হস্তীকে মতামত প্রকাশ করতে হল না।

চতুর্থ দিনের প্রভাতে মহারাজা যখন রাজকার্যে ব্যস্ত, রাজসভার মধ্যে হল গ্রিকদের এক ভারতীয় দূতের আবির্ভাব।

মহারাজা হস্তী দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে মুখ তুললেন। প্রশস্ত ললাট চিহ্নিত হল চিন্তার রেখায়। কিন্তু সঙ্কুচিত ধনুকের মতো যুগ্মভুরুর তলায় চক্ষে যেন জাগল তীক্ষ্ণ অগ্নিবাণ—মুহূর্তের জন্যে। তারপরেই মৃদুহাস্য করে বললেন, ‘কী সংবাদ, দূত?’

‘সমগ্র গ্রিস ও পারস্যের সম্রাট আলেকজান্ডার এসেছেন অতিথিরূপে ভারতবর্ষে। আপনি কী তাঁকে অভ্যর্থনা করতে প্রস্তুত আছেন?’

‘দূত, তুমি হিন্দু। তুমি তো জানো, অতিথিকে অভ্যর্থনা করা হিন্দুর ধর্ম!’

‘এ কথা শুনলে সম্রাট আলেকজান্ডার আনন্দিত হবেন। তাহলে মিত্ররূপে আপনি তাঁকে সাহায্য করবেন?’

‘কী সাহায্য, বলো!’

‘সম্রাট আলেকজান্ডার বেরিয়েছেন দিগবিজয়ে। সৈন্য আর অর্থ দিয়ে আপনাকে তাঁর বন্ধুত্ব ক্রয় করতে হবে।’

‘সম্রাট আলেকজান্ডার আমাদের স্বদেশে এসেছেন দিগবিজয়ে। ভারতের বিরুদ্ধে আমার ভারতীয় সৈন্যরা অস্ত্রধারণ করবে, এই কি তাঁর ইচ্ছা?’

‘আজ্ঞে হাঁ মহারাজ! সম্রাটের আর একটি ইচ্ছা এই যে, সুবন্ধু নামে গ্রিকদের এক শত্রু আপনার রাজ্যে আশ্রয় পেয়েছে। তাকে অবিলম্বে বন্দি করে আমার হাতে অর্পণ করতে হবে।’

মহারাজা হস্তী ফিরে সুবন্ধুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যুবক, এই দূতের সঙ্গে তুমি কি গ্রিস-শিবিরে বেড়াতে যেতে চাও?’

সুবন্ধু অভিবাদন করে বললে, ‘আপনি আদেশ দিলে শিরোধার্য করব। কিন্তু দূতকে বহন করে নিয়ে যেতে হবে আমার মৃতদেহ।’

‘দূত, তুমি কি সুবন্ধুর মৃতদেহ বহন করে নিয়ে যেতে পারবে? দেখছ, সুবন্ধুর দেহ ক্ষুদ্র নয়, আমারই মতো বৃহৎ! আমার মতে, পতঙ্গের উচিত নয় যে মাতঙ্গকে বহন করতে যাওয়া। পারবে না, কেবল হাস্যাস্পদ হবে।’

‘আপনার একথা থেকে কি বুঝব, আপনি সম্রাট আলেকজান্ডারকে অতিথিরূপে অভ্যর্থনা করতে প্রস্তুত নন?’

দূতের কথার জবাব না দিয়ে মহারাজা হস্তী বাঁ-পাশে ফিরে তাকালেন। সেনাপতি নিজের কোশবদ্ধ তরবারি নিয়ে অন্যমনস্কভাবে নাড়াচাড়া করছেন। হাসতে হাসতে মহারাজা বললেন, ‘কী দেখছ সেনাপতি? অনেকদিন যুদ্ধ করোনি, তোমার তরবারিতে কি মরচে পড়ে গেছে?’

‘না মহারাজ, মরচে-পড়া অসুখ আমার তরবারির কোনওদিন হয়নি!’

‘তবে?’

‘তরবারি নাড়লেচাড়লে সংগীতের সৃষ্টি হয়। তাই আমি তরবারি নাড়াচাড়া করছিলুম।’

‘বেশ করছিলে। অনেকদিন আমি তরবারির গান শুনিনি। শোনাতে পারবে?’

‘আদেশ দিন মহারাজ!’

হস্তী আচম্বিতে সিংহাসন ত্যাগ করে দাঁড়িয়ে উঠলেন। চোখের নিমেষে নিজের খাপ থেকে তরোয়াল খুলে শূন্যে তুলে জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘শোনাও তবে মুক্ত তরবারির রক্তরাগিণী—নাচাও তবে জীবনের বুকে মৃত্যুর ছন্দ! প্রাচীন আর্যাবর্তে এ রাগিণীর ছন্দ নতুন নয়—ভীম, অর্জুন, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ কত বীর কতবার ধনুকের টংকারে অসির ঝংকারে এই অপূর্ব সংগীতের সাধনা করে গেছেন, ভারত যে যুগযুগান্তরেও তাঁদের সাধনা ভুলবে না—’

বৃদ্ধ মন্ত্রী বাধা দিয়ে হতাশভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বললে, ‘মহারাজ—মহারাজ—’

বাধা দিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে হস্তী বললেন, ‘থামুন মন্ত্রীমহাশয়! তরবারি যেখানে গান গায় বৃদ্ধের স্থান সেখানে নয়! সেনাপতি, ডাক দাও তোমার দেশের ঘরে ঘরে দুরন্ত বেপরোয়া বাঁধনখোলা যৌবনকে, গগনভেদী অট্টহাসির মধ্যে লুপ্ত হয়ে যাক হিসেবি বিজ্ঞতার বাণী!’

দূত বললে, ‘মহারাজ, উত্তর!’

হস্তীর চক্ষে আবার জাগ্রত অগ্নি! বজ্রকণ্ঠে তিনি বললেন, ‘উত্তর চাও, দূত? কাকে উত্তর দেব? যবনসম্রাট অতিথি হলে আমি তাঁর প্রশ্নের উত্তর মুখেই দিতুম, কিন্তু তিনি এসেছেন দস্যুর মতো ভারতের স্বর্ণভাণ্ডার লুণ্ঠন করতে। দস্যুর উত্তর থাকে তরবারির সংগীতে! যাও!’

পরদিনের প্রভাত-সূর্যও পৃথিবীর বুকে বইয়ে দিয়েছেন স্বর্ণরশ্মির বিপুল বন্যা! সূর্য হচ্ছেন আর্যাবর্তের দেবতা। আজও ভারত তাঁর স্তবের মন্ত্র ভোলেনি।

মহারাজা হস্তীর রাজ্যে সেদিন প্রভাতে কিন্তু স্তব জেগেছিল রণদেবতার! গম-গমা-গম বাজছে ভেরি, ভোঁ-ভোঁ-ভোঁ বাজছে তুর, আর বাজছে অসি ঝন-ঝনা-ঝন! সূর্যকরে জ্বলন্ত বর্ম পরে সশস্ত্র ভারতবীরবৃন্দ রাজপথে চরণতাল বাজিয়ে অগ্রসর হয়েছে, গৃহে গৃহে, ছাদে ছাদে, বাতায়নে, অলিন্দে দাঁড়িয়ে ভারতের বীরনারীরা লাজাঞ্জলি বৃষ্টি করতে করতে সানন্দে দিচ্ছেন উলুধ্বনি, দিচ্ছেন মঙ্গলশঙ্খে ফুৎকার! চলেছে রণহস্তীর শ্রেণি, চলেছে হ্রেষারব তুলে অশ্বদল, চলেছে ঘর্ঘর শব্দে যুদ্ধরথের পর যুদ্ধরথ। স্বাধীন ভারতের সে অপূর্ব উন্মাদনা আজও আমার সর্বাঙ্গে জাগিয়ে তুলেছে আনন্দরোমাঞ্চ!

নগরতোরণের বাইরে এসে দাঁড়াল তেজস্বী এক অশ্ব—মহারাজা হস্তীর সাদর উপহার! অশ্বপৃষ্ঠে উপবিষ্ট বলিষ্ঠ এক সৈনিক যুবক—বিপুল পুলকে তার মুখ চোখ উদ্ভাসিত। সে সুবন্ধু।

আদর করে অশ্বের গ্রীবায় একটি চাপড় মেরে সুবন্ধু বললে, ‘চলরে রাজার ঘোড়া, বাতাসের আগে উড়ে চল, মহারাজা পুরুর দেশে চল, আমার বাপ-মায়ের কোলে ছুটে চল! আজ বেজেছে এখানে যুদ্ধের বাজনা, কাল জাগবে পঞ্চনদের তীরে তীরে তরবারির চিৎকার! চল রে রাজার ঘোড়া, বিদ্যুৎকে হারিয়ে ছুটে চল—তোর সওয়ার আমি যে নিয়েছি মহাভারতকে জাগাবার ব্রত! আগে সেই ব্রত উদ্যাপন করি, তারপর তোকে নিয়ে ফিরে আসব আবার সৈনিকের স্বর্গ রণক্ষেত্রে! তারপর ভারতের জন্যে বুকের শেষ রক্তবিন্দু অর্ঘ্য দিয়ে হাসতে হাসতে সেই দেশে চলে যাব—যে-দেশে গিয়েছে ভাগ্যবান বন্ধু চিত্ররথ, যে-দেশে গিয়েছে ভাগ্যবান বন্ধু পুরঞ্জন! চলরে রাজার ঘোড়া, উল্কার মতো ছুটে চল!…