ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ । কালাপাহাড়ি কাণ্ড
বোম্বেটে দ্বীপের সমস্ত বোম্বেটের কাছে খবর গেল—স্পেনরাজ্য লুণ্ঠনে মহাবীর লোলোনেজ তোমাদের আহ্বান করছেন!
মড়ার খোঁজ পেলে দলে দলে শকুনি যেমন আকাশ ছেয়ে উড়ে আসে, অ্যাডমিরাল লোলোনেজের কালো পতাকার তলায় চারিদিক থেকে তেমনই করে ডাকাত, বোম্বেটে ও হত্যাকারীর দল ছুটে আসতে লাগল।
এখন, বোম্বেটে দ্বীপে আর একজন মস্ত মাতব্বর ব্যক্তি বাস করে, তার নাম মাইকেল ডি বাস্কো, আপাতত মেজরের পদে অধিষ্ঠিত। ইউরোপের সমুদ্রেও আগে সে বড় একজন বোম্বেটে বলে নাম কিনেছিল। আজকাল অনেক টাকা রোজগার করে বকধার্মিক সেজে পায়ের উপরে পা দিয়ে পরম আরামে বসে বসে খাচ্ছে।
কিন্তু লোলোনেজের বিপুল আয়োজনে প্রচুর লাভের সম্ভাবনা দেখে সে আবার ভালোমানুষের মুখোশ খুলে রাখলে। লোলোনেজের কাছে গিয়ে বাস্কো বললে, ‘অ্যাডমিরাল, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমস্ত পথঘাট আমার নখদর্পণে। তুমি যদি আমাকে প্রধান কাপ্তেনের পদ দাও, আমি তাহলে তোমাকে সাহায্য করতে পারি।’
লোলোনেজ এতবড় একজন জাঁদরেল ও শক্তিশালী লোককে পেয়ে তখনই রাজি হয়ে গেল। বাস্কোকে সে কেবল প্রধান কাপ্তেন নয়, স্থলপথেও নিজের ফৌজের সেনাপতির পদে নিযুক্ত করলে।
এবারে আটখানা জাহাজ ও প্রায় সাতশোজন লোক নিয়ে লোলোনেজ স্পানিয়ার্ডদের সর্বনাশ করতে বেরুল। সবচেয়ে বড় জাহাজখানা নিলে নিজে, তার ওপরে ছিল দশটা কামান।
হাইতি দ্বীপের উত্তরদিক দিয়ে যেতে যেতে প্রথমেই তাদের নজরে পড়ল একখানা প্রকাণ্ড জাহাজ। লোলোনেজের নিজের জাহাজেরও চেয়ে সে জাহাজখানা বড়।
সে ইচ্ছা করলেই আটখানা জাহাজ নিয়ে আক্রমণ করে খুব সহজেই জয়লাভ করতে পারত। কিন্তু এখানে সে যথেষ্ট বীরত্ব ও আত্মশক্তির ওপরে নির্ভরতার দৃষ্টান্ত দেখালে। সে কেবল নিজের জাহাজখানাকে রেখে বাকি সাতখানা জাহাজকে সাভোনা দ্বীপের কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে বললে, তারপর শত্রুর তরীর দিকে অগ্রসর হল।
স্পানিয়ার্ডরা বোম্বেটে জাহাজকে আসতে দেখেও ভয় পেলে না। কারণ তাদের জাহাজে ষোলোটা কামান ও পঞ্চাশজন সৈনিক ছিল। এই দুঃসাহসই হল তাদের কাল।
যুদ্ধ হল তিন ঘণ্টা ধরে। তারপর স্পানিয়ার্ডদের সমস্ত শক্তি উবে গেল। জাহাজ, ধনরত্ন ও মালপত্তর বোম্বেটেদের হস্তগত হল। বন্দিদের কী দশা হল, প্রকাশ পায়নি। খুব সম্ভব তাদের কারুর কাঁধের উপরে কেউ আর মাথা বলে কোনও জিনিস দেখতে পায়নি।
অধিকৃত জাহাজখানা নিয়ে লোলোনেজ সানন্দে সাভোনা দ্বীপের দিকে নিজের নৌবাহিনীর খোঁজ করতে গেল। আনন্দের উপরে আনন্দ! সেখানে গিয়ে শোনে, তারাও একখানা ধনরত্নে পরিপূর্ণ জাহাজ হস্তগত করছে! লোলোনেজ বললে, ‘আমাদের যাত্রা শুভ দেখছি! গাছে না উঠতেই এক কাঁদি!’
সে আবার বোম্বেটে দ্বীপে ফিরে এল। আগে তাড়াতাড়ি ধনরত্ন, মালপত্তর বিলি করবার ও দ্বীপের লাটকে ঘুষ দেওয়ার ব্যবস্থা করলে। আরও নতুন লোকজন নিলে। তারপর যে শত্রু-জাহাজ দখল করেছিল সেখানাকে নিজে নিয়ে আবার সদলবলে যাত্রা শুরু করলে। এবারে তার দৃষ্টি বিখ্যাত মারাকেবো নগরের দিকে।
মারাকেবো হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার ভেনেজুয়েলা প্রদেশের একটি বন্দর নগর। এখান থেকে এখন কফি, চিনি, রবার, কাঠ, চামড়া, নানা ধাতু ও কুইনিন প্রভৃতি চালান দেওয়া হয়। তখনও এ শহরটি প্রসিদ্ধ ব্যবসায় প্রধান স্থান ছিল। এর উত্তরে আছে পঁচাত্তর মাইল বিস্তৃত ভেনেজুয়েলা উপসাগর ও দক্ষিণে আছে বৃহৎ মারাকেবো হ্রদ। এর বর্তমান লোকসংখ্যা চুয়াত্তর হাজার, কিন্তু যখনকার কথা বলছি, তখন এই শহরের লোকসংখ্যা এত বেশি ছিল না।
লোলোনেজ এই শহরের কাছে এসে নোঙর ফেলল। তারপর সদলবলে ডাঙায় গিয়ে নামল। শহরে যাওয়ার পথেই পড়ে এক কেল্লা। তাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় জেনে সে যুদ্ধ করবার জন্যে প্রস্তুত হতে লাগল।
কিন্তু দ্বীপের লোকরাও অপ্রস্তুত ছিল না, লোলোনেজের শনির দৃষ্টি যে তাদের উপরে পড়েছে এ খবর তারা আগেই পেয়েছিল।
বোম্বেটের দল কেল্লার দিকে আসছে শুনে সেখানকার লাট এ দল সৈন্যকে জঙ্গলের ভিতরে লুকিয়ে থাকবার জন্যে পাঠিয়ে দিলেন। তাদের উপরে হুকুম রইল, কেল্লার সৈন্যেরা যখন বোম্বেটেদের সমুখ থেকে আক্রমণ করবে, তখন তারা তাদের আক্রমণ করবে পিছনদিক থেকে। দুদিক থেকে আক্রান্ত হলে পর বোম্বেটেদের জনপ্রাণীও আর প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না।
বন্দোবস্ত খুব ভালো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, লোলোনেজও ঘুমিয়ে ছিল না, সব খবরই সে জানতে পেরেছিল যথাসময়ে। সেও নিজের একদল লোককে জঙ্গলের ভিতরে পাঠিয়ে দিল এবং তারা এমন বিক্রমে ও সবেগে শত্রুদের আক্রমণ করল যে, একজন স্পানিয়ার্ডও আর কেল্লার ভিতরে ফিরে যেতে পারল না!
তারপর তারা কেল্লার দিকে অগ্রসর হল। কেল্লার সৈন্যেরা পাঁচিলের উপর বড় বড় ষোলোটা কামান বসিয়ে তাদের অভ্যর্থনা করবার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিল।
বোম্বেটেরা বার বার কেল্লার দিকে এগিয়ে যায়, কিন্তু ষোলোটা তোপের প্রতাপে বার বার ফিরে আসে। তাদের সঙ্গে তোপও ছিল না, বন্দুকও ছিল না—তাদের সম্বল খালি পিস্তল ও তরবারি!
কিন্তু অনেকবার ফিরে আসার পর তারা এমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে দুর্গ আক্রমণ করলে যে, কামানের গোলা ও বন্দুকের অগ্নিবৃষ্টিও আর তাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারল না, প্রাণের সব মায়া ছেড়ে পাঁচিল টপকে তারা কেল্লার ভিতরে লাফিয়ে পড়ল। তিনঘণ্টা যুদ্ধের পর দুর্গ এল তাদের দখলে।
ইতিমধ্যে ভগ্নদূত গিয়ে শহরে খবর রটিয়ে দিয়েছে যে, হাজার হাজার বোম্বেটে কেল্লা ফতে করে শহর লুটতে ছুটে আসছে! ভয়ে সে কিছু বাড়িয়েই বলল!
এই মারাকেবো শহর এর আগেও আরও তিন-চারবার শত্রুদের হাতে পড়েছে। সে যে কী বিপদ, কী যন্ত্রণা, কী বিভীষিকা, বাসিন্দারা আজও তা ভুলতে পারেনি। তখনই চারিদিকে রব উঠল—ওই এল রে, ওই এল! পালা! পালা! পালা! টাকাকড়ি ও মালপত্তর নিয়ে সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে শহর ছেড়ে লম্বা দিল—কেউ গেল বনের ভিতরে, কেউ গেল জিব্রালটারের দিকে! বলাবাহুল্য, এই জিব্রালটার হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার নতুন শহর। কিন্তু এই নতুন শহরের নামও আজ আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
ওদিকে দুর্গপ্রাকারের উপর থেকে লোলোনেজ সঙ্কেত করে নিজের নৌ-বাহিনীকে জানিয়ে দিল—পথ পরিষ্কার, তারা ভিতরে ঢুকে অনায়াসেই শহরের দিকে যাত্রা করতে পারে!
জলপথে মারাকেবো শহর সেখান থেকে আঠারো মাইল। বোম্বেটেরা আগে দুর্গটাকে সমূলে ধ্বংস করলে এবং সেই কাজেই গেল পুরো একটি দিন। তারপর তারা নৌবাহিনী নিয়ে একেবারে শহরের কাছে গিয়ে নোঙর ফেলল।
একদল বোম্বেটে সমুদ্র থেকে শহরের উপরে গোলাবর্ষণ করতে লাগল, আর একদল নৌকো বেয়ে তীরে উঠে শহরের ভিতরে সার বেঁধে প্রবেশ করলে। কেউ বাধা দিল না।
বাধা দেবে কে? সব লোক সে মুল্লুক ছেড়ে পিঠটান দিয়েছে! বোম্বেটেরা শহরে ঢুকে দেখলে, চারিদিকে খা খা করছে! তখন তারা সেখানকার বড় বড় ও ভালো ভালো বাড়িগুলো দখল করে বসল—তেমন সব বাড়িতে তারা জীবনে কোনওদিন বাস করেনি। বাড়িগুলোর ভিতরে ময়দা, রুটি, শূকর ও মদ প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে পেলে, কিন্তু ধনরত্ন সব যেন অদৃশ্য হয়েছে ফুসমন্ত্রে! যা পেলে তাই নিয়েই তারা আপাতত আমোদ-আহ্লাদ করতে বসল বটে, তবে তাদের বড় আশায় ছাই পড়ল!
কিন্তু লোলোনেজ হাল ছাড়লে না। সে জনকয়েক বোম্বেটেকে পাঠিয়ে দিলে বনের ভিতরটা আঁতিপাতি করে খুঁজে দেখতে।
সেই রাত্রেই বোম্বেটেরা বনের ভিতর থেকে বিশজন স্ত্রী-পুরুষ, গাধার পিঠে চাপানো নানারকম মাল ও প্রায় নগদ লক্ষ টাকা নিয়ে ফিরে এল। কিন্তু একটা এত বড় শহরের পক্ষে লক্ষ টাকা তো তুচ্ছ জিনিস!
লোলোনেজ স্পানিয়ার্ডদের ডেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘টাকাকড়ি কোথায় লুকিয়ে ফেলেছিস?’
তারা কোনও সন্ধান দিল না।
তখন তাদের ভীষণ যন্ত্রণা দেওয়া হতে লাগল। তার ফলে কেবল জানা গেল যে টাকাকড়ি সব বনের ভিতরে লুকানো আছে। কিন্তু কোথায় আছে, সে ঠিকানা পাওয়া গেল না।
লোলোনেজ রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠল। সে হঠাৎ খাপ থেকে তলোয়ার খুলে একজন স্পানিয়ার্ডকে তখনই কেটে কুচি কুচি করে ফেলল। তারপর চোখ পাকিয়ে বললে, ‘কী! বলবিনি! তাহলে একে একে সকলকেই আমি মোরগের মতো জবাই করব!’
এই নরপশুর ভয়ংকর স্বভাব দেখে বন্দিরা স্তম্ভিত হয়ে গেল! একজন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললে, ‘বনে যারা লুকিয়ে আছে, চলুন তাদের দেখিয়ে দিচ্ছি!’
কিন্তু ডাকাতরা তাদের খুঁজতে আসছে, বনবাসী নাগরিকরা সে খবর পেয়েই ঊর্ধ্বশ্বাসে আবার নতুন এক জায়গায় গিয়ে গা ঢাকা দিল। বোম্বেটেরা কারুর টিকি পর্যন্ত দেখতে পেল না।
নিরুপায় হয়ে বোম্বেটেরা দিন পনেরো সেই শহরেই বাস করল।
তারপর লোলোনেজ বলল, ‘বন্ধুগণ, এই শহরের ধড়িবাজ লোকগুলো আমাদের কলা দেখাতে চায়! এখানে অনেক খাবারদাবার আছে বটে, কিন্তু খাবার খেতে আমরা এখানে আসিনি। এখানকার ধনরত্ন ওরা সব জিব্রালটারে নিয়ে গেছে,—চলো, আমরা জিব্রালটার আক্রমণ করিগে!’
তার অভিপ্রায় হাওয়ার আগেই জিব্রালটারে গিয়ে পৌঁছোল! সবাই আবার সে শহর ছেড়ে অন্য জায়গায় পালাবার জোগাড় করল।
কিন্তু সেখানকার শাসনকর্তা বললেন, ‘তোমাদের কোনও ভয় নেই! আসুক না বোম্বেটেরা—এখানে এলে বাছারা মজাটা টের পাবেন! আমি তাদের সমূলে বিনাশ করব!’
শাসনকর্তা ছিলেন একজন পাকা যোদ্ধা, তিনি ইউরোপে অনেক লড়াই করেছেন। তিনি তখনই অসংখ্য কামান ও আটশোজন সৈন্য নিয়ে বোম্বেটেদের অভ্যর্থনার আয়োজন করতে লাগলেন। সমুদ্রের দিকে কুড়িটি কামান বসানো হল। আর একদিকে বসানো হল আটটা বড় বড় কামান। শহরে যাওয়ার একটি রাস্তা খুব শক্ত বেড়া দিয়ে বন্ধ করা হল। আর একটা রাস্তা খুলে রাখা হল—তাতে এমন পুরু পাঁক ও কাদা ছিল যে, সেখান দিয়ে পথ-চলাচল করা প্রায় অসম্ভব। সে পথে যারা আসবে সৈন্যদের অগ্নিবৃষ্টিতে তাদের অবস্থা হবে শোচনীয়।
বোম্বেটেরা যথাসময়ে নগর থেকে খানিক তফাতে এসে দেখল, শহরের উপরে স্পেনরাজের পতাকা উড়ছে সগর্বে এবং স্পানিয়ার্ডরা শ্রেণিবদ্ধ হয়ে তাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। এরা যে যুদ্ধের জন্যে এমন বিপুল আয়োজন করবে, লোলোনেজ তা কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু এজন্যে সে ভীত হল না, দলের মাথাওয়ালা লোকদের ডেকে পরামর্শ করতে বসল। পরামর্শ হচ্ছে এই যে, স্পানিয়ার্ডরা যখন উচিতমতো আত্মরক্ষা করবার জন্যে এত বেশি সময় পেয়েছে এবং তাদের সৈন্যসংখ্যাও যখন এমন অসামান্য, তখন তাদের আর আক্রমণ করা উচিত কিনা!
লোলোনেজ বললে, ‘কিন্তু তবু আমি হতাশ হওয়ার কারণ দেখি না। তোমরা অনায়াসেই বুক বেঁধে দাঁড়াতে পারো! বীরপুরুষের মতো আত্মরক্ষা করবার শক্তি আমাদের আছে। আমি তোমাদের সরদার, আমি যা বলি তাই করো! এর আগেও আজকের চেয়ে কম লোক নিয়ে আমরা এর চেয়েও বড় বিপদকে এড়াতে পেরেছি। শত্রুরা দলে যত ভারী হবে, আমাদের গৌরবও তত বাড়বে!’
বোম্বেটেদের ধারণা ছিল যে মারাকেবোর সমস্ত ধনরত্নই এইখানে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অতএব তারা একবাক্যে বললে, ‘সরদার, তুমি যা বলবে আমরা তাই করব! তুমি যেখানে যাবে আমরা সেইখানেই যাব!’
লোলোনেজ বজ্রগম্ভীর স্বরে বললে, ‘সাবাস! কিন্তু শুনে রাখো, তোমাদের মধ্যে যে কেউ একটু ভয় পাবে, আমি তাকেই নিজের হাতে গুলি করে মেরে ফেলব!’
প্রায় চারশো বোম্বেটে যুদ্ধের আগে পরস্পরের সঙ্গে করমর্দন করে বিদায় নিলে—সে দিন যে কার জীবনের শেষদিন, তা কে জানে?
লোলোনেজ সকলকার আগে গিয়ে দাঁড়িয়ে নেতার স্থান অধিকার করলে। তারপর শূন্যে তরবারি তুলে দৃপ্তকণ্ঠে বললে, ‘ভাইসব! এসো আমার সঙ্গে—মাভৈঃ!’ সকলে তার অনুসরণ করল।
প্রথম পথে গিয়ে তারা দেখলে, তা এমনভাবে বন্ধ যে এগুবার কোনও উপায় নেই।
দ্বিতীয় পথ হচ্ছে পাঁক ও কাদাভরা পথ—সেটা স্পানিয়ার্ডদের ফাঁদ!
তারা বনজঙ্গল থেকে ডালপালা-পাতা কেটে এনে পথের ওপরে পুরু করে ছড়িয়ে দিতে লাগল—যাতে করে পাঁকে-কাদায় পা বসে যাবে না। ইতিমধ্যে স্পানিয়ার্ডদের কামান ও বন্দুক এমন ভীষণ গর্জন করতে লাগল যে, বোম্বেটেরা পরস্পরের গলার আওয়াজ পর্যন্ত শুনতে পেলে না! কিন্তু সেই ভয়াবহ গুলিগোলা-বৃষ্টির ভিতর দিয়েও তারা নির্ভয়ে ও অটল পদে সমান অগ্রসর হতে লাগল।
অবশেষে তারা শুকনো মাঠের উপরে এসে পড়ল। এখানে আরও ছয়টা বড় বড় নতুন কামান অগ্নি উদ্গার করতে আরম্ভ করল! ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় চারিদিক অমাবস্যার চেয়ে অন্ধকার! তার উপরে শত্রুরা আবার দুর্গ ছেড়ে বেরিয়ে এসে সবেগে তাদের আক্রমণ করল! সে এমন প্রবল আক্রমণ যে, বোম্বেটেরা পিছু না হটে পারল না! তাদের দলের অনেক লোক হত ও আহত হয়ে রক্তাক্ত মাটির উপরে লুটোতে লাগল।
বোম্বেটেরা বনের ভিতরে অন্য কোনও নতুন রাস্তা আবিষ্কারের চেষ্টা করলে—কিন্তু রাস্তা কোথাও নেই! শত্রুরা আর কেল্লা ছেড়ে বেরুবার নামও করল না—কিন্তু আড়াল থেকে সমান গোলাগুলি চালাতে লাগল।
লোলোনেজ তখন ভেবেচিন্তে পৃথিবীতে সব দেশেই সুপরিচিত একটি পুরোনো উপায় অবলম্বন করল—সকলকেই দিল হঠাৎ একসঙ্গে পালিয়ে যেতে হুকুম!
তাদের ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে দেখে স্পানিয়ার্ডয়া মহা উৎসাহে বলে উঠল—’ওরা পালাচ্ছে! ওরা পালাচ্ছে! এসো, পিছনে পিছনে গিয়ে ওদের আমরা বধ করি!’—তারা সার ভেঙে বিশৃঙ্খল হয়ে বোম্বেটেদের পিছনে পিছনে তেড়ে এল।
স্পানিয়ার্ডরা যখন অতিরিক্ত উৎসাহের ঝোঁকে কামানের গোলার সীমানা ছাড়িয়ে এগিয়ে এসেছে,—বোম্বেটেরা তখন সরদারের হুকুমে আচম্বিতে আবার ফিরে দাঁড়াল এবং প্রচণ্ড বিক্রমে শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল! বিষম হাতাহাতি লড়াই শুরু হল।
খানিক পরে দেখা গেল, দুশো স্পানিয়ার্ডের দেহ পৃথিবীকে বুকের রক্তে রাঙা করে ছেয়ে আছে এবং বাকি সবাই কেল্লার দিকে আসতে না পেরে বনের দিকে প্রাণের ভয়ে পলায়ন করছে!
কেল্লার স্পানিয়ার্ডরা তাই দেখে হতাশভাবে কামান ছোড়া বন্ধ করে বলে উঠল—’আমরা আত্মসমর্পণ করছি। আমাদের বধ কোরো না।
কেল্লার উপর থেকে তখনই স্পেনের রাজপতাকা নামিয়ে ফেলা হল—সেখানে উড়তে থাকল বোম্বেটেদের পতাকা! কেল্লা ফতে! শহর তাদের হাতের মুঠোয়!
কিন্তু সাবধানের মার নেই—বলা তো যায় না, বনের পলাতক শত্রুরা আবার যদি সাহস সঞ্চয় করে ফিরে আসে! বোম্বেটেরা কেল্লার কামানগুলো আবার নিজেদের সুবিধামতো সাজিয়ে রাখলে!
মিথ্যা ভয়! রাত্রি প্রভাত, যারা পালিয়েছে তারা আর ফিরল না।
তখন হিসাবনিকাশ করে দেখা গেল, শত্রুদের মৃতদেহের সংখ্যা পাঁচশত! শহরের ভিতরে আহত লোকও অসংখ্য এবং তাদের ভিতরেও অনেকে মারা পড়ছে ও মারা পড়বে। বন্দি শত্রুর সংখ্যা একশো পঞ্চাশ ও ক্রীতদাসেরা গুণতিতে পাঁচশত।
বোম্বেটেদের লোক মরেছে মাত্র চল্লিশ জন এবং জখম হয়েছে চল্লিশ জন—যদিও ক্ষত বিষিয়ে আহতদেরও অধিকাংশই মারা পড়ল।
বোম্বেটেরা শত্রুদের মৃতদেহ নিয়ে দুখানা নৌকো বোঝাই করলে, তারপর সমুদ্রের ভিতরে গিয়ে নৌকো দুখানা ডুবিয়ে দিল।
তারপর আরম্ভ হল লুট! সোনার তাল, রুপোর তাল, হিরে-মুক্তো, ভালো ভালো দামি আসবাব ও নানারকম মাল—শহরের কোথাও আর কিছু বাকি রইল না! কিন্তু লোভ এমনই জিনিস, সারা শহর লুটেও বোম্বেটেদের আশ মিটল না, তাদের সন্দেহ হল আরও অনেক ধনরত্ন লুকিয়ে ফেলা হয়েছে! সুদীর্ঘ আঠারো দিন ধরে চলল অবাধে এই পরস্বাপহরণের বীভৎস পালা!
এরই মধ্যে বন্দি স্পানিয়ার্ডদের অধিকাংশই ইহলোক ত্যাগ করলে—অনাহারে! শহরে খাবার জিনিস—বিশেষ করে তাদের প্রধান আহার্য মাংসের যারপরনাই অভাব! যা ছিল তা বোম্বেটেদেরই পক্ষে অপ্রচুর। তা থেকে বন্দিদের ভাগ কেউ দিলে না। বন্দিদের খেতে দেওয়া হত খচ্চর ও গাধার মাংস। অনেকে তা মুখেই তুলতে পারত না, খিদের চোটে যারা তাও খেতে বাধ্য হত, অনভ্যাসের দরুন তারা পেটের অসুখে ভুগে ভবলীলা সাঙ্গ করল। অনেক বন্দিকে গুপ্তধন দেখিয়ে দেওয়ার জন্যে এমন দুঃসহ ও পাশবিক যন্ত্রণা দেওয়া হল যে, সইতে না পেরে তারাও পরলোকে প্রস্থান করল।
অল্প যে কয়েকজন বেঁচে ছিল, লোলোনেজ তাদের ডেকে বলল, ‘তোমাদের ছেড়ে দিচ্ছি। তোমরা বনের ভিতর গিয়ে তোমাদের সঙ্গীদের বলগে যাও যে, আমাকে আরও অনেক টাকা না দিলে আমি এই শহরে আগুন ধরিয়ে দেব। যাও, দুদিন সময় দিলুম।’
দুদিন কেটে গেল। বোম্বেটেরা তখন শহরে আগুন ধরাতে আরম্ভ করল।
স্পানিয়ার্ডরা দূর থেকে তাই দেখতে পেয়ে তখনই দূত পাঠিয়ে দিল। সে এসে জানাল,—’টাকা এখনই নিয়ে আসা হবে, দয়া করে আপনারা আগুন নিবিয়ে দিন!’
বোম্বেটেরা রাজি হল বটে, কিন্তু ততক্ষণে শহরের এক অংশ পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেছে!
তারপর তাদের টাকা এল। তবু চার হপ্তা সেই শহরে দৈত্যলীলা করে সমস্ত ধনরত্ন নিয়ে তারা আবার জাহাজে গিয়ে উঠল।
আবার তারা মারাকেবো শহরে এসে হাজির! পাপ বিদায় হয়েছে ভেবে যারা ভরসা করে শহরে ফিরে এসেছিল, তারা ফের পালাতে লাগল!
বোম্বেটেরা তাদের খবর পাঠিয়ে দিলে যে, হয় আমাদের ধনরত্ন দিয়ে খুশি করো, নয় আমরা সারা শহর আবার লুট করে আগুন ধরিয়ে দেব!
অনেক টাকা পাঠিয়ে মারাকেবোর অধিবাসীরা এই আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধারলাভ করলে।
বিজয়গর্বে ফুলে উঠে লোলোনেজ আবার বোম্বেটে দ্বীপে ফিরে এল। তাদের অপূর্ব সৌভাগ্যের কাহিনি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল—যারা তার সঙ্গী হয়নি তারা অনুতাপে হাহাকার করতে লাগল।
লোলোনেজ দলের প্রত্যেককে তার প্রাপ্য অংশ কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়ে দিলে—প্রত্যেকেরই রোগা পকেট মোটা হয়ে ফুলে উঠল। কিন্তু তারা এমনই লক্ষ্মীছাড়া যে, জুয়া খেলে আর মদ খেয়ে দুহাতে টাকা ওড়াতে লাগল। সে পাপের ধন আর বেশিদিন রইল না—অল্পদিন পরেই তারা যে গরিব ছিল সেই গরিবই হয়ে পড়ল! তখন তারা আবার নতুন শিকারের খোঁজে বেরিয়ে পড়বার জন্যে আগ্রহপ্রকাশ করতে লাগল!
সবাই বলে, ‘সরদার! আবার সাগরে জাহাজ ভাসাও!’
সরদার বলে, ‘তথাস্তু!’