ষষ্ঠ অধ্যায় । ইসাস প্রান্তরের যুদ্ধ (খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৩)
পারস্য সম্রাট তৃতীয় দরায়ুস প্রথমটা আলেকজান্ডারকে গ্রাহ্য করেননি। তারপর তিনি বুঝলেন, এই গ্রিক শত্রু বড় সামান্য নয়। তখন তিনি নিজের সাম্রাজ্যের চারিদিক থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে আলেকজান্ডারকে একেবারে পিষে মেরে ফেলতে এলেন।
পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকেরা ইউরোপের গৌরব বাড়াবার জন্যে বারংবার অনেক সত্য গোপন করেছেন। তাঁদের মত হচ্ছে, সংখ্যায় গ্রিস ছিল নগণ্য এবং পারস্য ছিল ছয় লক্ষ সৈন্যের অধিকারী। দুই দলের মধ্যে এতটা পার্থক্য হয়তো ছিল না। তবে পারসিরা সংখ্যায় যে বেশি ছিল, একথা মানা যেতে পারে। কারণ, জনসংখ্যায় পারস্য সাম্রাজ্য ছিল অতুলনীয়। সুদূর উত্তর ভারত থেকে হাজার হাজার ভারতীয় সৈনিকও এসেছিল পারসিদের সাহায্য করতে। এমনকী, দরায়ুসের অধীনে যে ত্রিশ হাজার বেতনভুক গ্রিক সৈন্য ছিল, এটাও জানতে পারা গিয়েছে।
আলেকজান্ডারের গতি রোধ করবার জন্যে দরায়ুস যে স্থানে সৈন্য সমাবেশ করলেন তার নাম হচ্ছে ইসাস প্রান্তর।
এইটেই হল তাঁর পক্ষে মারাত্মক ভুল। এই প্রান্তর ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ—এক ক্রোশেরও কম। পারস্য রাজসভায় একজন গ্রিক এসে আশ্রয় নিয়েছিল, দরায়ুসকে বিশেষ রূপে মানা করে দিয়েছিল এখানে ছাউনি ফেলতে। কারণ, দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী এই সংকীর্ণ গিরিবর্ত্মের মধ্যে লক্ষ লক্ষ পারসি সৈন্য চালনা করবার কোনও উপায়ই ছিল না।
সে বলেছিল, ‘সম্রাট খুব প্রশস্ত ক্ষেত্রে গিয়ে আপনার বাহিনী নিয়ে অপেক্ষা করুন। তাহলে আলেকজান্ডার এলে আপনি তাঁকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলতে পারবেন।’
এত বড় সৎপরামর্শ দরায়ুস কানে তুললেন না। ফল হল এই যে, পারসিদের সংখ্যাধিক্য কোনও কাজেই লাগল না। ৪৮০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে লিওনিডাসের অধীনে মাত্র এক হাজার গ্রিক সৈন্য থার্মোপলির সংকীর্ণ গিরিবর্ত্মে দাঁড়িয়ে বিপুল পারসি বাহিনীকে কী আশ্চর্য বাধা দিয়েছিল, দরায়ুস সে কথাও ভুলে গেলেন। এই ভুলই তাঁর কাল।
পারসিদের সামনে ছিল সমুদ্র, পিছনে ছিল গিরিবর্ত্ম। এখানে পরাজিত হলে গ্রিকদের সর্বনাশ হত, কারণ ইউরোপে পালাবার পথ গিয়েছিল বন্ধ হয়ে। হয়তো এই লোভেই দরায়ুস তাঁর গ্রিক পরামর্শদাতার কথা কানে তোলেননি, কিন্তু প্রবাদে লোভকে বলে পাপ—যে পাপের ফলে হয় মৃত্যু!
ভয়ের কারণ যথেষ্ট ছিল বটে, তবু আলেকজান্ডার স্থির করলেন, এইখানে দাঁড়িয়েই তিনি দরায়ুসের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। কারণ, পারসিরা সংখ্যার অগণ্য হলেও এই সংকীর্ণ স্থানে স্বল্পসংখ্যক গ্রিকরা তাদের সঙ্গে সমানভাবে লড়াই করতে পারবে।
গ্রিক সৈন্যদের ডান দিকে রইল পাহাড়, বাঁ-দিকে সমুদ্র। তাদের সামনে পিনেরাস নদী এবং নদীর ওপারে পারসিরা।
ডান দিক পাহাড়ের দ্বারা সুরক্ষিত বলে আলেকজান্ডার সেদিক সম্বন্ধে হলেন নিশ্চিন্ত। কিন্তু পাছে সমুদ্রতীর দিয়ে অগ্রসর হয়ে পারসিরা গ্রিকদের ঘিরে ফেলে, সেই ভয়ে তিনি তাঁর সেনাপতি পার্মেনিয়োকে বামপার্শ্ব রক্ষা করার জন্যে পাঠিয়ে দিলেন। দরায়ুস জানতেন, পার্মেনিয়ো হচ্ছেন আলেকজান্ডারের চেয়ে কম সাহসী। কাজেই তিনি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অশ্বারোহীদলকে সর্বাগ্রে পাঠিয়ে দিলেন গ্রিকদের বামপার্শ্ব আক্রমণ করার জন্যে। শত্রুদের ফন্দি বুঝে আলেকজান্ডারও তাঁর অশ্বারোহী সৈন্যদলকে পার্মেনিয়োর সাহায্যের জন্যে প্রেরণ করলেন। এতক্ষণ পরে দরায়ুস নিজের ভ্রম বুঝতে পারলেন। এই সংকীর্ণ স্থানে না এলে তিনি অনায়াসেই দুইদিক থেকেই গ্রিকদের উপরে হানা দিতে পারতেন এবং দুই দিকেই অসংখ্য পারসিদের আক্রমণে বাধা দেবার মতো সৈন্য আলেকজান্ডারের ছিল না। সরু গিরিপথ দিয়ে এখন আর পিছু হটবারও সময় নেই, কারণ, ইতিমধ্যেই গ্রিকরা আক্রমণ করবার জন্যে অগ্রসর হচ্ছে। এখন তাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করবার জন্যে দরায়ুস নিজের ত্রিশ হাজার পেশাদার গ্রিক সৈন্যদের পাঠিয়ে দিলেন। গ্রিকের বিরুদ্ধে গ্রিক! ভারতবর্ষেও এমনি অনেকবার অন্য জাতির হয়ে লড়েছে মুসলমানের বিরুদ্ধে মুসলমান এবং হিন্দুর বিরুদ্ধে হিন্দু!
আলেকজান্ডারের বাহিনীর মধ্যভাগ রক্ষা করছিল তাঁর বিখ্যাত ‘ফেলাঙ্কস’ বা ‘ঘনব্যূহ’। আগেই বলা হয়েছে, এই ঘনব্যূহের মধ্যে সাধারণত ষোলো সারে একেবারে পরস্পরের গা ঘেঁসাঘেসি করে গুরুভার অস্ত্রাদি নিয়ে সৈন্যেরা দাঁড়িয়ে থাকত এবং তাদের প্রত্যেকের হাতে থাকত আঠারো ফুট লম্বা বর্শা! এইভাবে ঘনব্যূহের পদাতিকরা যখন বর্শা সামনের দিকে উঁচিয়ে অগ্রসর হত, তখন তাদের বাধা দেওয়া বা দল ভাঙা প্রায়ই অসম্ভব হয়ে উঠত। আলেকজান্ডার অধিকাংশ যুদ্ধ জিতেছিলেন এই ঘনব্যূহেরই মহিমায়। ইসাসের যুদ্ধেও গ্রিকদের বিরুদ্ধে এই ঘনব্যূহ প্রমাণিত করলে তার সার্থকতা।
আলেকজান্ডার নিজের সৈন্যদের উৎসাহিত করে বললেন, ‘অগ্রসর হও গ্রিক বীরগণ! পারসিদের আগেও তোমরা হারিয়েছ, এবারেও অনায়াসে হারাতে পারবে। মনে রেখো, এই যুদ্ধে জিততে পারলে প্রাচ্যের সমস্ত ঐশ্বর্য হবে তোমাদের হস্তগত!’
আলেকজান্ডার নিজে পুরোভাগে থেকে অশ্বারোহী সৈন্যদল নিয়ে পেশাদার গ্রিক শত্রুদের বামপার্শ্ব আক্রমণ করলেন বিষম তেজে। এবং ঘনব্যূহের সৈন্যদলকে পারসিদের মধ্যভাগ আক্রমণ করবার জন্যে পাঠিয়ে দিলেন।
দুইদলের মাঝখানে তখন আর নদীর ব্যবধান নেই। পারসি অশ্বারোহীদল আক্রমণের পর আক্রমণ করতে লাগল, তাদের সংখ্যাধিক্যের জন্যে গ্রিকদের বামপার্শ্বের অবস্থা হয়ে উঠল সঙ্কটজনক। কিন্তু দেখতে দেখতে আলেকজান্ডারের চালিত সাদী-সৈন্য ও তাঁর প্রচণ্ড ঘনব্যূহের আক্রমণে পারসিদের মধ্যভাগ একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। পারসিরা সংখ্যায় বেশি বটে, কিন্তু সেই সংকীর্ণ ক্ষেত্রে আবদ্ধ ও আড়ষ্ট হয়ে থাকার দরুন দু-দিকে ছড়িয়ে পড়ে তারা গ্রিকদের ঘিরে ফেলতে পারলে না। রাস্তায় মারামারি বা দাঙ্গা দেখেছেন কি? একপক্ষে একশোজন ও একপক্ষে দশজন লোক যদি কোনও বড় চওড়া রাজপথে দাঁড়িয়ে মারামারি করে, তাহলে দশজন লোক চোখের নিমেষেই হেরে যায়। কিন্ত ওই দশজন লোক যদি কোনও খুব সরু গলির ভিতরে গিয়ে আশ্রয় নেয়, তাহলে দলে ভারী হয়েও একশোজন লোকও তাদের কাবু করতে পারবে না। ইসাস প্রান্তরে ঠিক এই কারণেই পারসিদের বিপুল বাহিনী পরাজিত হল।
সন্ধ্যার অন্ধকারে পারসিরা পলায়ন করতে লাগল—গ্রিকরা ছুটল তাদের পিছনে পিছনে। হতভাগ্য দরায়ুসও রথ থেকে নেমে ধরা পড়বার ভয়ে ঘোড়ায় চড়ে পালিয়ে গেলেন। গ্রিকদের ক্ষতি হল সামান্য। কিন্তু সংখ্যাতীত পারসি বীরের মৃতদেহে রণক্ষেত্র আচ্ছন্ন হয়ে রইল।
ধরতে গেলে এই যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্য লুপ্ত হয়ে গেল। আজ পর্যন্ত পারসিরা আর তাদের পূর্বগৌরবের শিখরে গিয়ে উঠতে পারেনি।