ষষ্ঠ। সাম্রাজ্য ও দুর্ভাগ্য
সৈনিক তৈমুর আজ আমির তৈমুর!
এতকাল তিনি অস্ত্র ধারণ করেছেন সবল হস্তে। এবার কতখানি যোগ্যতার সঙ্গে তিনি রাজদণ্ড ধারণ করেন, তা দেখবার জন্যে সকলেই কৌতূহলী হল।
যারা ভেবেছিল রাজ্যচালনায় অনভ্যস্ত এই নতুন রাজার অনভিজ্ঞতার সুযোগে ঐশ্বর্য ভাণ্ডার দুই হাতে লুণ্ঠন করবে, দু-দিন পরেই ভেঙে গেল তাদের সুখ-স্বপ্ন!
তৈমুরের হাত দরাজ বটে, কিন্তু তাঁর তীক্ষ্ণদৃষ্টি ফেরে রাজ্যের প্রত্যেক বিভাগে। তাঁকে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব!
এবং যারা ভেবেছিল বন্ধুত্ব বা আত্মীয়তার খাতিরে তৈমুর এর-ওর-তার হাতে প্রচুর ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন, তাদেরও হতে হল হতাশ।
তৈমুরের কাছে যে কোনও সময়ে যে কোনও বন্ধুর অবারিত দ্বার ছিল বটে, কিন্তু রাজ্য চালনার বলগা রইল একমাত্র তাঁর নিজের হাতেই। কোনও বিশেষ প্রিয়পাত্রকেও তিনি রাজদণ্ড স্পর্শ করতে দিলেন না।
এবং যারা ভেবেছিল রাজদণ্ড লাভ করে তৈমুর তাঁর তরবারিকে আর কোষমুক্ত করবেন না, তাদেরও বড় আশায় পড়ল ছাই।
সিংহাসনের উপরে বসে তৈমুর দেখলেন, রাজ্যের উত্তর দিকে পার্বত্য অঞ্চলে জাট-মোগলেরা এখনও যখন-তখন হানা দিতে ছাড়ছে না—গ্রামের পর গ্রাম সমর্পিত হচ্ছে সর্বগ্রাসী অগ্নির লেলিহান শিখায়—হাজার হাজার রক্তাক্ত তরবারির উত্থান-পতনে দিকে দিকে উঠছে গগনভেদী হাহাকার!
তৈমুর বুঝলেন, আত্মরক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে প্রতিপক্ষকে আক্রমণের সুযোগ না দিয়ে আক্রমণ করা। জাট-মোগলেরা আক্রমণ করতে যেমন অভ্যস্ত, আত্মরক্ষা করতে তেমন নয়।
তৈমুর জাট-মোগলদের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করলেন। তারা জাট-মোগলদের দেশে গিয়ে চতুর্দিকে করলে বিষম অশান্তির সৃষ্টি। তারা গ্রামের পর গ্রামে আগুন ধরিয়ে দিলে, সর্বত্রই চলতে লাগল লুণ্ঠন, হত্যা ও অত্যাচারের অবিরাম লীলা। জাট-সৈনিকরা বাধা দিতে এসে বারবার হল পরাজিত। জাট-মোগলরা পরের উপরে যে ঔষধ প্রয়োগ করত, এবারে নিজেরা সেই ঔষধ খেতেই বাধ্য হল। তখন দায়ে পড়ে তাঁরা হার মানলে এবং তৈমুরকে স্বীকার করলে।
তারপর তৈমুরের দৃষ্টি ফিরল প্রতিবেশী রাজা-রাজড়াদের দিকে। খিভা, উরগঞ্জ ও অ্যারাল সমুদ্রের অধিপতির নাম ছিল খারেজমের সুফি।
সুফির সুন্দরী মেয়ের নাম খান জেদ। দূত-মুখে তৈমুর জানালেন, নিজের ছেলে জাহাঙ্গিরের সঙ্গে তিনি রাজকন্যা খান জেদের বিয়ে দিতে চান।
এ প্রস্তাবে সুফির বংশমর্যাদায় আঘাত লাগল। ভবঘুরে তৈমুর ভুঁইফোঁড় রাজা হয়েছেন বটে, কিন্তু আজও তিনি আভিজাত্যের গর্ব করতে পারেন না। অতএব সুফি বলে পাঠালেন, ‘তোমার ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে অসম্ভব।’
অসম্ভব? আজ তৈমুরের কাছে কিছুই অসম্ভব নয়। তাঁর শতযুদ্ধজয়ী তরবারি সব অসম্ভবকেই সম্ভবপর করতে পারে।
সিংহাসন থেকে নেমে তৈমুর আবার পরলেন বর্ম এবং হাতে নিলেন চর্ম, তরবারি ও ধনুর্বাণ। সামন্ত রাজারা সদলবলে ছুটে এসে দাঁড়ালেন তাঁর পতাকার তলায়। তৈমুর করলেন যুদ্ধযাত্রা।
প্রথমেই হল খিভার পতন। তারপর তৈমুর উরগঞ্জ অবরোধ করলেন।
সুফি বলে পাঠালেন, ‘তৈমুর, ঝগড়া কেবল তোমাতে-আমাতে। আমাদের ব্যক্তিগত ঝগড়ার জন্যে হাজার হাজার লোক প্রাণ দেবে কেন? তার চেয়ে এসো, আমরা দুজনেই দ্বন্দ্বযুদ্ধ করি।’
তৈমুর বললেন, ‘উত্তম! রাজি। তোমার নগরের সিংহদ্বারের সামনেই আমাদের দ্বন্দ্বযুদ্ধ হবে।’
সেনাপতিরা বললেন, ‘তোমার স্থান সিংহাসনে। তুমি দেবে হুকুম, আমরা করব হুকুম পালন। আমরা থাকতে তুমি তরবারি ধরবে কেন?’
তৈমুর বললেন, ‘তা হয় না। সুফির কোনও সেনাপতি আমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলে আমি তোমাদেরই কারুকে পাঠাতে পারতুম। কিন্তু আমাকে আহ্বান করেছেন একজন রাজা, সুতরাং আমাকে নিজেই যেতে হবে।’
তৈমুর ঘোড়া ছোটালেন। সৈফুদ্দিন নামে এক প্রাচীন সেনানী দৌড়ে গিয়ে তাঁর ঘোড়ার রাশ চেপে ধরে বললেন, ‘না প্রভু, একজন সাধারণ সৈনিকের মতন এমন করে আপনি যুদ্ধে যেতে পারবেন না।’
তাঁর এই অতি-ভক্ত অনুচরটিকে মুখে কোনও জবাব না দিয়ে তৈমুর নিজের তরবারির উলটো পিঠের দ্বারা তাঁকে আঘাত করতে গেলেন।
সৈফুদ্দিন আঘাত এড়াবার জন্যে তাড়াতাড়ি ঘোড়ার রাশ ছেড়ে সরে এলেন।
শত্রু নগরের প্রাচীরের উপরিভাগ তখন লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছে,—আমির তৈমুর স্বয়ং একাকী এসেছেন প্রধান সিংহদ্বারের সামনে! সকলেই অবাক ও হতভম্ভ!
তৈমুর হাঁক দিলেন, ‘ওহে, তোমাদের কর্তা সুফিকে খবর দাও। বলো, আমির তৈমুর তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছেন।’
অদ্ভুত সাহস ও বীরত্ব! শত শত বল্লম ও ধনুক উদ্যত হয়ে আছে তাঁর মাথার উপরে, কিন্তু তৈমুরের ভ্রূক্ষেপও নেই! আমির তৈমুর আজও যুবকের মতনই ডানপিটে!
তৈমুর তাঁর ঘোড়া ‘বাদামি ছোকরা’র পিঠে চড়ে অনেকক্ষণ এদিক-ওদিক করলেন, কিন্তু সুফির দাড়ির প্রান্তটুকুও দেখা গেল না!
তৈমুর ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, ‘যে নিজের বাক্যরক্ষা করতে পারে না, সে নিজের প্রাণও রক্ষা করতে পারবে না!’ তারপর ফিরে গেলেন নিজের দলে।
আমিরকে অক্ষত দেহে নিরাপদে ফিরে আসতে দেখে সৈন্যরা সমস্বরে জয়ধ্বনি করে উঠল—আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বাজতে লাগল কাড়া-নাকাড়া এবং তূরী-ভেরি!
কিন্তু আর বেশিদিন তৈমুরকে নগর অবরোধ করে থাকতে হল না। তাঁর কথা ফলে গেল দৈববাণীর মতন। সুফি হঠাৎ রোগশয্যায় শুয়ে প্রাণত্যাগ করলেন। নগরবাসীরাও করলে আত্মসমর্পণ। সুফির মস্ত রাজ্য হল তৈমুরের হস্তগত, এবং রাজকন্যা খান জেদের পাণিপীড়ন করলেন তৈমুর পুত্র জাহাঙ্গির।
সে সময়ে ও-অঞ্চলে ভারত সীমান্তের হিরাট শহরের নামডাক ছিল অসাধারণ। মস্ত বড় শহর, তার মধ্যে বাস করে আড়াই লক্ষ মানুষ। তখনকার দিনে এত বেশি জনসংখ্যার জন্যে গর্ব করতে পারে পৃথিবীতে এমন শহর দুই-তিনটির বেশি ছিল না—লন্ডন ও প্যারিসেরই লোকসংখ্যা ছিল ষাট হাজারের মধ্যে। হিরাটের মধ্যে বিদ্যালয় ছিল কয়েক শত, স্নানাগার ছিল তিন হাজার এবং দোকান ছিল প্রায় দশ হাজার।
হিরাটের অধিপতির উপাধি ‘মালিক’। তৈমুর দূত পাঠিয়ে জানতে চাইলেন, মালিক তাঁর সামন্ত রাজা হতে রাজি আছেন কি না?
না, মালিক রাজি নন। উলটে তৈমুরের দূতকে তিনি করলেন বন্দি।
নগ্ন অসি হস্তে তৈমুর আবার সসৈন্যে বেরিয়ে পড়লেন। হিরাটের পতন হতে দেরি লাগল না।
এই হিরাটের যুদ্ধে তৈমুরের দেহের দুই জায়গায় বিদ্ধ হয়েছিল দুইটি তির। অধিকাংশ সেনাপতির মতন তৈমুর কখনও নিজে নিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়ে সৈন্য চালনা করতেন না। যুদ্ধ যেখানে ভয়াবহ, তৈমুরকে দেখা যেত সেইখানেই।
হিরাট জয়ের পরে তৈমুরের রাজ্য হল চারিদিকে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। ‘সবুজ শহর’ সুন্দর নগর বটে, কিন্তু এত বড় রাজ্যের রাজধানী হওয়ার উপযোগী নয়। তৈমুর তখন সমরখন্দকে নিজের রাজধানী বলে ঘোষণা করলেন।
অতি প্রাচীন নগর এই সমরখন্দ। তৈমুরের আগে আরও দুইজন বিশ্ববিখ্যাত দিগবিজয়ী এখানে এসে আস্তানা গেড়েছিলেন—আলেকজান্ডার দি গ্রেট ও চেঙ্গিজ খাঁ।
সমরখন্দের খ্যাতি অসামান্য হলেও তার নানা দিক তখন পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। তৈমুর নিজের হাতে সমরখন্দকে আবার নতুন করে গড়ে তোলবার চেষ্টায় নিযুক্ত হলেন।
নতুন নতুন পাথরে বাঁধানো প্রশস্ত রাজপথ, মনোরম তরুবীথি, রঙিন উদ্যান ও অপূর্ব সব প্রাসাদের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সমরখন্দ হয়ে উঠল বিচিত্র এবং মোহনীয়।
এমনকী নগরের রং পর্যন্ত গেল বদলে! তাতারিদের প্রিয় হচ্ছে নীল রং—যা থাকে অসীম আকাশে, অনন্ত সাগরে ও মেঘচুম্বী গিরিশিখরে। তৈমুর নতুন সমরখন্দেরও গায়ে মাখিয়ে দিলেন সেই রং। তার নতুন নাম হল ‘নীল নগর’।
তৈমুরের প্রথম পুত্র জাহাঙ্গিরের একটি ছেলে হল।
তৈমুর নিজেও দ্বিতীয় বিবাহ করলেন শ্যালক হুসেনের পরমাসুন্দরী বিধবাকে! তার নাম সেরাই খানুম। এটা ছিল প্রাচীন মোগলদের চিরাচরিত নিয়ম। পরাজিত ও নিহত রাজাদের সহধর্মিণীদের বিবাহ করতেন বিজয়ী রাজারা।
বংশগৌরবে সেরাই খানুমের তুলনা ছিল না। তাঁর ধমনীতে ছিল চেঙ্গিজ খাঁয়ের রক্ত। তিনি তৈমুরের উপযুক্ত সহধর্মিণী—অশ্বপৃষ্ঠে প্রায়ই যেতেন গভীর অরণ্যে শিকার করতে।
কিন্তু তৈমুরের অশান্ত মন সিংহাসনের নরম গদির উপরে কোনওদিনই তুষ্ট থাকতে পারত না। রাজধানীর মধ্যে তাঁর দেখা পাওয়া যেত খুবই কম। তাঁর খবর আসত দূর দেশ থেকে। তিনি প্রকাণ্ড সেনাদল নিয়ে ফিরতেন আজ এ-দেশে, কাল সে-দেশে—কখনও পূর্বে, কখনও পশ্চিমে—কখনও খোরাসানের পথে, কখনও কাস্পিয়ানের তটে।
অবশেষে তিনি একদিন ছুটলেন উত্তর দিকে—গোবি মরুভূমির দিকে। সেখানে শেষ মোগল কামারুদ্দিন তাঁর কাছে পরাজিত হয়ে পলায়ন করলেন। মোগলদের সব আশা নির্মূল হয়ে গেল এবং তৈমুরের রাজ্য পরিণত হল সাম্রাজ্যে!
বিজেতা তৈমুর যশোগৌরবে সমুজ্জ্বল হয়ে দেশে ফিরে এলেন। সমরখন্দের নিকটবর্তী এক পথের কাছে এসে দেখলেন, তাঁর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে এক বিপুল জনতা।
জনতার ভিতর থেকে বেরিয়ে তৈমুরের সামনে এসে দাঁড়ালেন সবচেয়ে প্রাচীন ওমরাও সৈফুদ্দিন। তাঁর মাথা হেঁট, মুখ নীরব।
তৈমুর বললেন, ‘দুঃসংবাদ আছে? বলতে ভয় হচ্ছে?’
সৈফুদ্দিন বললেন, ‘যুবরাজ জাহাঙ্গির আর ইহলোকে নেই।’
জাহাঙ্গিরকে তৈমুর প্রাণের চেয়ে ভালোবাসতেন। কিন্তু তাঁর প্রৌঢ় মুখের একটি মাংসপেশিও কুঞ্চিত হল না। কেবল বললেন, ‘সৈফুদ্দিন, তোমার ঘোড়ায় চড়ো। সৈন্যগণ, রাজধানীর দিকে যাত্রা করো।’
তৈমুর এতদিনে অসংখ্য যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু জাহাঙ্গিরের মৃত্যুর পর থেকে তিনি যেসব যুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছেন, সেইসব যুদ্ধই আজ পৃথিবীতে তাঁকে অমর করে রেখেছে।