উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

ষষ্ঠ। বাঙালি পাখি

ষষ্ঠ। বাঙালি পাখি

শশাঙ্ক স্থির করলেন, রাজ্যবর্ধনকেই আগে আক্রমণ করবার সুযোগ দেবেন।

রাজ্যবর্ধন তরুণ যুবক, তাঁর প্রকৃতিও নিশ্চয় উগ্র; নইলে শশাঙ্কের বিপুল সৈন্যবল সম্বন্ধে কোনও সন্ধান না নিয়েই মাত্র সাত হাজার সৈনিকের সঙ্গে এমনভাবে অগ্রসর হতে সাহস করতেন না।

শশাঙ্ক মৃদু হাস্য করে সেনাপতিকে ডেকে বললেন, ‘আমার কী মনে হচ্ছে জানেন? উত্তর-পশ্চিম ভারতের লোকেরা উত্তর-পূর্ব ভারতের লোকদের বরাবরই তুচ্ছ বলে জ্ঞান করেন। মগধ আর বঙ্গের বাসিন্দারা তাই তাঁদের মতে নগণ্য ‘পক্ষী’ মাত্র। রাজ্যবর্ধন বোধহয় ভেবেছেন, তাঁর সাত হাজার যোদ্ধাকে দেখলেই আমার এক লাখ সৈন্য ভীরু পাখির পালের মতোই উড়ে পালিয়ে যাবে।’

সেনাপতি বললেন, ‘চমৎকার যুক্তি বটে।’

শশাঙ্ক বললেন, ‘অতিরিক্ত সৌভাগ্য মানুষের সুবুদ্ধি হরণ করে। উত্তর-ভারতের লোকেরা আমাদের কেবল ‘অনার্য’ বলে ডেকেই তুষ্ট নয়। তারা বলে কিনা, মগধ আর বঙ্গদেশে পদার্পণ করলেও তাদের পাতিত্য দোষ জন্মাবে, তাদের আবার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। অহমিকা এর ঊর্ধ্বে আর উঠতে পারে না। অতিদর্পে লঙ্কা আর অতি মানে কৌরবদের পতন হয়েছিল। আজকেও আবার তারই পুনরাভিনয় হবে। সেনাপতিমহাশয়, আপনি অর্ধচন্দ্র-ব্যূহ রচনা করে শত্রুদের জন্যে অপেক্ষা করুন। ব্যূহের দক্ষিণ আর বাম বাহুতে স্থাপন করুন রথারোহী সৈন্যদের। শত্রুরা যখন ব্যূহের মধ্যভাগ আক্রমণ করবে, তখন আপনার কর্তব্য কী জানেন?’

হাস্যমুখে সেনাপতি বললেন, ‘আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না মহারাজ! আমি বেশ বুঝতে পারছি, আজ যুদ্ধের নামে হবে প্রকাণ্ড একটা ছেলেখেলা।’

দুই ভুরু কুঞ্চিত করে শশাঙ্ক বললেন, ‘পতঙ্গ যখন অগ্নিতে আত্মাহুতি দেয় তখন অগ্নিকে কেউ তার জন্য দায়ী করে না। স্বরাজ্য ছেড়ে এত দূরে আমি ছেলেখেলা করতে আসিনি, কিন্তু শত্রুরা যদি ছেলেখেলা করে তাহলে আমার কী দোষ?

সেনাপতি বললেন, ‘যুদ্ধে যে আমাদের জয় হবে সে বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। তারপর রাজ্যবর্ধনকে নিয়ে আমরা কী করব?’

শশাঙ্ক চিন্তিত মুখে কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললেন, ‘সেনাপতিমহাশয়, রাজনীতি বড় নির্মম, কারণ রাজনীতি বড় স্বার্থপর, আমাদের প্রধান পূর্বপুরুষ সমুদ্রগুপ্ত দিগবিজয়ে বেরিয়ে অধিকাংশ প্রতিদ্বন্দ্বী রাজাকেই ‘সমূলে উৎপাটন না করে ক্ষান্ত হননি।’

সেনাপতি কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে বললেন, ‘কিন্তু মহারাজ রাজ্যবর্ধনকে বালক বললেও চলে।’

—’সিংহশিশু অবহেলার যোগ্য নয়। আর একটা কথা ভুলবেন না। আমার রাজ্যের সীমান্ত প্রদেশে আছে রাজ্যবর্ধনের রাজ্য শুনেছি, সে ধার্মিক বলে প্রজারা তাকে ভালোবাসে। রাজনীতি বলে যে, সীমান্ত প্রদেশের রাজা ধার্মিক হলে নিজের রাজ্যের কল্যাণ হয় না। এর পরে আপনাকে আর কিছু বলা বাহুল্য। আমি রাজ্যবৃদ্ধি আর নিজের রাজ্যের কল্যাণ চাই। বুঝলেন?’

অভিবাদন করে বিদায় নিলেন সেনাপতি।

শশাঙ্ক আপন মনে বললেন, ‘রাজ্যবর্ধন, তোমার উন্নতি আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরোধী। কিন্তু তোমার জন্যে আমি দুঃখিত।’

রাজ্যবর্ধন দুর্ধর্ষ হুন-সমরে বিজয়ী হয়ে ইতিহাসে স্থায়ী খ্যাতি অর্জন করেছেন। কিন্তু বয়সে তিনি কাঁচা হলেও তাঁর বুদ্ধিকে অপরিণত বলে মনে করা চলে না। তাঁরও আগে তাঁরই মতন বয়সে গ্রিক-দিগবিজয়ী আলেকজান্ডার অসাধারণ সামরিক জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে রাজ্যবর্ধনের মস্তিষ্কের স্থিরতা ছিল না। একে তাঁর সহোদরার স্বামী নিহত, তার উপরে বিধবা রাজশ্রীও নিরুদ্দেশ এবং তারও উপরে পঞ্চনদ অঞ্চলের সাধারণ কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে তিনিও সত্য সত্যই মনে করেছিলেন যে থানেশ্বরের সাত হাজার সৈন্য বঙ্গাধিপের লক্ষ সৈন্যের চেয়েও বলবান।

এই ভ্রান্ত ধারণার অবশ্যম্ভাবী ফল ফলতেও দেরি লাগল না। শশাঙ্ক যে ফাঁদ পেতেছিলেন, রাজ্যবর্ধন সেই ফাঁদেই পা দিলেন অন্ধের মতো। থানেশ্বরের সাত হাজার অশ্বারোহী মগধবঙ্গের বিপুল বাহিনীর মধ্যভাগ আক্রমণ করল। মগধবঙ্গের মধ্যভাগের গজারোহী, পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্যগণ তাদের বাধা দিতে লাগল এবং সেই অবকাশে তাদের অর্ধচন্দ্র ব্যূহের দক্ষিণ ও বাম বাহুও এগিয়ে এসে পরস্পরের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে সমগ্র থানেশ্বর বাহিনীকে একেবারে ঘিরে ফেললে। ঠিক বেড়াজালের মধ্যে আবদ্ধ হয়েও রাজ্যবর্ধনের সৈন্যরা যুদ্ধ করতে লাগল বটে বিপুল বিক্রমে, কিন্তু এক লক্ষের সামনে সাত হাজারের শক্তি কতটুকু? দেখতে দেখতে থানেশ্বরের ক্ষুদ্র বাহিনী নিঃশেষে হারিয়ে গেল সমুদ্রের মাঝখানে ঠিক নদীর মতোই।

শিবিরের বাইরে যুদ্ধের কোলাহল—অস্ত্রে অস্ত্রে ঝনৎকার, আহতের আর্তনাদ, যোদ্ধার গর্জন, দামামার ডিমি-ডিমি-ডিমি, কিন্তু মহারাজ শশাঙ্ক তখন জনৈক পারিষদের সঙ্গে নিশ্চিন্ত মনে দাবা-বোড়ে খেলায় নিযুক্ত হয়েছিলেন। জ্যোতিষী না হলেও তিনি জানতেন যে, আজকের যুদ্ধের ফলাফল কী হবে।

বার্তাবাহ সংবাদ নিয়ে এল,—স্থানেশ্বরের বাহিনী প্রায় নির্মূল, রাজ্যবর্ধন নিহত।

ভ্রূসঙ্কোচ করে শশাঙ্ক শুধোলেন, ‘নিহত? কার হস্তে?’

‘সেনাপতিমহাশয়’ থানেশ্বরের মহারাজাকে স্বহস্তে বধ করেছেন।’

শশাঙ্ক স্তব্ধ হয়ে রইলেন গম্ভীর মুখে। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘পণ্ডিতরা বলেন, অমঙ্গল থেকেই মঙ্গলের উৎপত্তি হয়। উচ্চাকাঙ্ক্ষার আর এক ধাপ উপরে উঠলুম। থানেশ্বরের অমঙ্গলের উপরে মগধবঙ্গের মঙ্গলের প্রতিষ্ঠা। এ জন্যে রাজনীতি আমাকে অপরাধী বলে মনে করতে পারবে।’