শ্যামনিবাস-রহস্য – ৫

সদানন্দবাবু যে কী বলতে চাইছেন, কিছুই ঠাহর করতে পারলুম না। বললুম, “ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলুন তো।” 

সদানন্দবাবু একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, সব তা হলে খুলেই বলি। দেখুন মশাই নকুল যে মোটেই সুবিধের লোক নয়, সে ওরা ভাড়াটে হয়ে আসবার এক বছর বাদেই আমি টের পেয়েছি। বলেছিল ওরা দুটিমাত্র প্রাণী এখানে থাকবে, অথচ বছরখানেক যেতে না যেতেই একটা উটকো লোককে আমার বাড়ির মধ্যে এনে ঢোকাল। তার মানে ওর কথার ঠিক নেই। না না, বিষ্টুচরণ যে খারাপ লোক তা আমি বলছি না। কাজকর্ম না খুঁজে ও যে পড়ে-পড়ে শুধু ঘুমোয় তাতেও আমার আপত্তি নেই। কিন্তু এমন তারস্বরে গান গাইবে কেন? তার উপরে আবার বছর দুয়েক আগে নলের একটা মেয়ে হয়েছে। রাত্তিরে সেটা এক-একদিন এমন ট্যা-ট্যা করে কাঁদে যে, আমার ঘুগ্মের বড় ব্যাঘাত হয়। আমি মশাই শান্তিপ্রিয় লোক, আমার গিন্নিটিও তা-ই, এতসব চিৎকার চেঁচামেচি আমাদের পছন্দ হয় না। তার উপরে আবার অশান্তি আজকাল আরও বেড়েছে।” 

“আঁশটে গন্ধের কথা বলছেন তো?” 

“আরে সে উৎপাত তো আছেই। মাছ যখন পচে, তখন তার গন্ধে আমাদের অন্নপ্রাশনের ভাত পর্যন্ত মুখে উঠে আসে মশাই।” 

কথাটা সেদিন বাসন্তীর কাছেও শুনেছি। হাসতে-হাসতে বাসন্তী বলছিল, “কুসুমদির কাছে আজ উলের একটা প্যাটার্ন তুলতে গিয়েছিলুম, তা পচা-মাছের দুর্গন্ধে তো বসতেই পারলুম না। কুসুমদিরও একেবারে পাগল-পাগল অবস্থা। শাড়ির আঁচল নাকের উপর চেপে ধরে পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছিলেন আর সদানন্দবাবুকে নাকিসুরে বলছিলেন, বিদেয় করো বিদেয় করো, আঁজই এই পাঁপ বিদেয় করো। প্যাটার্ন তুলব কী, আমি তখন পালাতে পরলে বাঁচি।’ 

সদানন্দবাবুকে বললুম, “আঁশটে গন্ধটা তো আর নতুন সমস্যা নয়, ওটা তো কিছুদিন ধরেই চলছে। নতুন অশান্তিটা কী হল?” 

সদানন্দবাবু বললেন, “সেই কথাই তো বলছি। তা আপনি শুনছেন কই। ব্যাটা আজকাল বড্ড বাড়াবাড়ি করছে। মানে সবকিছুরই একটা মাত্রা থাকবে তো, তাও থাকছে না।” 

ভদ্রলোকের সবই ভাল, কিন্তু মুশকিল এই যে বক্তব্যের চেয়ে ভূমিকাটাই বড় হয়ে দাঁড়ায়। বললুম, “অত বিতং দিয়ে কথা বলবেন না তো, স্পষ্ট করে বলুন যে কী হয়েছে।” 

সদানন্দবাবু বললেন, “সে কী মশাই, কিছুই আপনার কানে যায় না নাকি।” তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, “অবশ্য যাবেই বা কী করে? রাত্তিরে তো আপনারা পিছনের দিককার ঘরে থাকেন, তাই না?” 

“হ্যাঁ, তো কী হয়েছে?” 

“রাস্তার দিককার ঘরে যদি থাকতেন তো ঘুম ভেঙে যেত। উরে বাপরে বাপ্ সে কী চেঁচামেচি!”

“কে চেঁচামেচি করে?” 

“কে আবার, ওই নকুল। ব্যাটা বরাবরই রাত করে ফিরত, তা আজকাল তো দেখছি রাত বারোটাও পেরিয়ে যাচ্ছে। ফিরে এসেই চেঁচামেচি জুড়ে দেয়, আর বউয়ের উপরে চোটপাট করতে থাকে। উপর থেকে যে আমি তাতে আপত্তি করিনি তাও নয়। বেশ কয়েকদিনই গলা চড়িয়ে বলেছি, ‘এ সব কী হচ্ছে, অ্যাঁ? এত হল্লা কিসের? এটা বস্তি নয়, এটা ভদ্রপাড়া।’ তা সে-সব কথা তো গেরাহ্যিই করে না। চেঁচাচ্ছে তো চেঁচাচ্ছেই, হল্লা করছে তো করছেই। ওরে বাবা রে বাবা, সে এক জগঝম্প কান্ড।” 

“এত রাত করে ফেরে কেন, কখনও জিজ্ঞেস করেছিলেন?” 

“তা করেছিলুম বই কী। রাত্তিরে তো আর নীচে নামতে ভরসা হয় না, তাই একদিন দিনের বেলায় দেখা হয়ে যেতে জিজ্ঞেস করেছিলুম যে বাড়ি ফিরতে আজকাল এত রাত হচ্ছে কেন?”

“তাতে কী বলল?” 

“বলল যে, মহাজনের পাওনা মিটিয়ে ফিরতে হয় তো, তাই একটু রাত হয়ে যায়।” সদানন্দবাবু একটা চোখ একটু ছোট করে হাসলেন। তারপর গলার স্বর একটু নীচে নামিয়ে বললেন, “ও-ও বলল, আর আমিও বিশ্বাস করলুম! আসল কথাটা কী জানেন, ব্যাটা আজকাল খুব মাল টানছে।” 

“তা টানুক না, আপনার পয়সায় তো আর টানছে না, তা হলে আর আপনার তা নিয়ে এত উতলা হবার দরকার কী? ওর ডানা গজিয়েছে তাই উড়ছে। তা উড়ুক না, আপনি তাতে বিচলিত হচ্ছেন কেন?” 

সদানন্দবাবু অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “যাচ্চলে, আমি কেন বিচলিত হব? আরে না মশাই, কে মাল টানল না-টানল তাতে আমার কী। ও-সব নিয়ে আমি একটুও ভাবছি না। আমার সাফ কথা, যা করতে হয়, মুখ বুজে করো, হল্লাবাজি চলবে না। আর হ্যাঁ, বাড়ির মধ্যে পচা মাছের দুর্গন্ধ ছড়ানোও চলবে না। ওই আড়তটাকেও এখান থেকে সরাতে হবে।” 

পারুল এসে ঘরে ঢুকল। বললুম “কী ব্যাপার, পড়া ছেড়ে উঠে এলি যে? কিছু বলবি?”

“মা বলছে, এবার চান করতে যাও, মার রান্না হয়ে গেছে।” 

সদানন্দবাবু বললেন, “তা হলে চলি মশাই। আপনার অফিস যাবার টাইম হল।” 

বললুম, “বসুন বসুন, পাঁচ মিনিট পরে গেলেও চলবে।” তারপর পারুলের দিকে তাকিয়ে বললুম, “তোর মাকে বল যে, বোসদা এসেছেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলছি, মিনিট পাঁচেক বাদে কলঘরে ঢুকব।” 

পারুল চলে গেল। সদানন্দবাবু বললেন, “মোট কথা, হল্লা যদ্দিন পর্যন্ত না বন্ধ হচ্ছে আর যদ্দিন পর্যন্ত না সরানো হচ্ছে এই মাছের আড়ত, আমিও তদ্দিন ছাড়ছি না।” 

বললুম, “সেইজন্যেই যে জল আর লাইট কেটে দিয়েছেন, সে তো বুঝতেই পারছি।” 

“ব্যাটারা ভারী দিয়ে জল আনাচ্ছে। সকালে যখন বাজার থেকে ফিরছে তখন আবার দেখলুম, এক হাতে বাজারের থলি, আর এক হাতে দুটো হ্যারিকেন।” 

“লাইট যখন কেটে দিয়েছেন, তখন হ্যারিকেন আর হাতপাখা ছাড়া উপায় কী। কিন্তু এখনও বলছি, কাজটা আপনি ভাল করলেন না। শেষ পর্যন্ত একটা বিপদে না পড়ে যান।” 

“সে তো পড়েইছি। না না, যা ভাবছেন তা নয়, নকুল এ নিয়ে কী করবে না-করবে জানি না, তবে এখনও থানা-পুলিশ করেনি।” 

“বিপদটা তা হলে কীসের?” 

“বিপদ একেবারে উল্টো দিকের।” 

কথাটা যে সদানন্দবাবু গোড়াতেই বলেছিলেন, সেটা ভুলে গিয়েছিলুম। এতক্ষণে আবার মনে পড়ল। বললুম “হ্যাঁ হ্যাঁ, এইরকম একটা কথা আপনি বলছিলেন বটে, আমারই খেয়াল ছিল না। তা উলটো দিকের মানে কোন দিকের?” 

একটু আগেও বেশ চড়া গলায় কথা বলছিলেন সদানন্দবাবু; এমন একটা ভাব দেখাচ্ছিলেন যেন নকুলচন্দ্রকে উচিত-শিক্ষা না-দিয়ে তিনি ছাড়বেন না। হঠাৎ যেন সেই ‘যুদ্ধং দেহি’ ভাবটা একেবারে মিলিয়ে গেল। মুখের উপরে আবার মেঘ ঘনিয়ে এসেছে, ভঙ্গিটাও ভারী কুণ্ঠিত। বেজার গলায় ভদ্রলোক বললেন, “বিপদটা ঘটিয়েছেন আমার গিন্নিই।” 

“তার মানে?” অবাক হয়ে বললুম, “আপনার মিসেস আবার কী বলছেন?” 

কাঁচুমাচু হয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “বলছেন যে আমি মানুষ নই, একেবারে অমানুষ। আমার মধ্যে নাকি মনুষ্যত্ব বলতে কিছু নেই।” 

ব্যাপারটা আসলে কী ঘটেছে, সেটা জানতে আমার ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল। অথচ সদানন্দবাবু যেভাবে অনাবশ্যক বিতং দিয়ে কথা বলেন, তাতে সন্দেহ হচ্ছিল যে, সমস্যাটা যে ঠিক কী, বিস্তর বাক্যব্যয় করেও তিনি সেটা ঠিক পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলতে পারবেন না। তাই মনে হল যে, ওর বাড়িতে গিয়ে সরাসরি ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার। 

সদানন্দবাবুকে একটুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে তাই বৈঠকখানা থেকে রান্নাঘরে এসে বাসন্তীকে বললুম, “অফিসের আজ তেমন তাড়া নেই, ঘন্টাখানেক পরে গেলেও চলবে। চট করে একবার ও-বাড়ি থেকে ঘুরে আছি।” 

বৈঠকখানায় ফিরে এসে সদানন্দবাবুকে বললুম, “চলুন আপনার মিসেসের সঙ্গে কথা বলব।” আমাদের বাড়ির প্রায় উল্টো দিকেই পাঁচ-নম্বর বাড়ি। গলিটা পার হয়ে বাড়িতে ঢুকে উপরে উঠে এলুম। 

কুসুমবালা তাঁর শোবার ঘরের খাটের উপরে একটা তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখে হেসে বললেন, “আসুন আসুন। আমি কিন্তু উঠতে পারব না, বাতের ব্যথাটা আবার খুব বেড়েছে।” 

বললুম, “না না, উঠতে হবে না।” 

সদানন্দবাবু একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে আমাকে বসতে বসলেন। তারপর বললেন, “আমি তো দিনে তিন কাপের বেশি চা খাই না, তার মধ্যে দুকাপ ইতিমধ্যেই খাওয়া হয়ে গেছে। থার্ড কাপ খাব বিকেলে। কিন্তু আপনি তো আর অত হিসেব করে খান না, আপনার জন্যে একটু চা করি?” 

বললুম, “আরে না মশাই চায়ের দরকার নেই। মিসেস বসুকে একটা কথা বলতে এসেছি। বলেই চলে যাব।” 

কুসুমবালা হেসে বললেন, “আমার সঙ্গে আবার কী কথা?” 

“সদানন্দবাবু যে একতলার লাইট কেটে দিয়েছেন, তাতে আপনারা আপত্তি আছে, তাই না?”

কুসুমবালার মুখ থেকে হাসিটা নিমেষে মিলিয়ে গেল। বললেন, “আছেই তো। এটা কি একটা মানুষের মতো কাজ হল?” 

“এ কথা বলছেন কেন? কুলদের জন্যে আপনার এত ভাবনা কিসের?” 

কুসুমবালা যেন ফুঁসে উঠলেন। বললেন, “ওদের জন্যে ভাবতে আমার বয়ে গেছে! না কিরণবাবু, আমি নকুলের কথাও ভাবছি না, যমুনার কথাও ভাবছি না, যমুনার নানা বিষ্টুর কথাও ভাবছি না। কিন্তু দু’বছরের একটা দুধের বাচ্চা. তার কষ্টের কথাটা তো একবার ভাবতে হবে।” 

সদানন্দবাবু বললেন, “কমলির কথা বলছ? সে তো বলতে গেলে সারাটা দিন দোতলায় এসে তোমার কাছেই কাটায়।” 

কুসুমবালা বললেন, “তা কাটায়। কিন্তু সারাটা রাত একতলায় তার মায়ের কাছে থাকে। চত্তির মাস, গরম পড়ে গেছে, গরমে কাল রাত্তিরে ওই মেয়েটা ঘুমোতে পারেনি। তা ছাড়া আমি জানি তো, মা’রাত্তিরে একবার হিটারে দুধ গরম করে ওকে খাইয়ে দিতে হয়। তা ইলেকট্রিক না থাকলে যেমন ফ্যান চলে না, তেমনি হিটারও চলে না। মাঝরাত্তিরে কাল তাই মেয়েটার নিশ্চয় কিছু খাওয়া হয়নি। তা এ-সব কথা কি তুমি ভেবে দেখেছিলে? একবারও ভাবোনি। দুম করে তুমি ইলেকট্রিকের লাইন কেটে দিলে। দিয়ে ভাবলে যে এই করে নকুলকে খুব জব্দ করা হল। কিন্তু নকুলকে জব্দ করতে গিয়ে একটা দুধের বাচ্চাকে যে কী কষ্টে ফেলা হল, তা ভেবেও দেখলে না। তুমি কি মানুষ? ছিছি!” 

সদানন্দবাবুর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যে, তিনি একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছেন। আমার দিকে তাকিয়ে করুণ মুখে বললেন, “আপনি কিছু বলবেন না?” 

“কী আর বলব? আমার তো মনে হয়, মিসেস বসু যা বলেছেন ঠিকই বলেছেন।” 

উঠে পড়লুম। সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে একটা বাচ্চা-মেয়ের কান্নার শব্দ কানে এল। সেইসঙ্গে একটা মেয়েলি গলার ধমক। “থাক্, জেঠির দরদ যে কত সে তো বোঝাই গেছে, ফ্যানের হাওয়া খাওয়ার জন্যে আর তোমার উপরে গিয়ে কাজ নেই।” 

বুঝতে পারলুম যে, কমলি তার জ্যাঠাইমার কাছে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছে, কিন্তু তার মা তাকে যেতে দিচ্ছে না।

রাইটার্সে একটা ফোন করবার দরকার ছিল। সংক্ষেপে যাকে পি. এ. বি. এক্স. বলে, ডায়াল ঘুরিয়ে সেই প্রাইভেট অটোমেটিক ব্রাঞ্চ এক্সচেঞ্জের সঙ্গে যোগাযোগ করতেই সেখানকার মেয়েটি বলল, “একটু আগেই এক ভদ্রলোক আপনাকে চাইছিলেন। আপনি নেই শুনে বললেন যে, খানিক বাদে আবার ফোন করবেন।” 

“নাম বলেননি?” 

“আমি জিজ্ঞেস করেছিলুম, উনি কিছু বললেন না। শুধু বললেন যে, উনি বাইরে থেকে এসেছেন, আপনাকে এই মেসেজটা দিয়ে দিলেই হবে।” 

কিছুই বুঝতে পারলুম না। বাসন্তীর দাদা দিল্লিতে থাকেন, কিন্তু তাঁর তো এখন কলকাতায় আসবার কথা নয়, এলেও নিশ্চয় অফিসে না করে বাড়িতেই ফোন করতেন। ছেলে থাকে এলাহাবাদে। সে-ই কি হঠাৎ তার অফিসের কাজে কলকাতায় এল? অফিসে কোনও জরুরি কনফারেন্স আছে হয়তো, তাই স্টেশন থেকে একেবারে সরাসরি অফিসে চলে গিয়ে সেখান থেকে ফোন করেছে। কিন্তু সে-ই বা অফিসে ফোন করবে কেন? 

এক্সচেঞ্জের মেয়েটিকে বললুম, “ঠিক আছে, এখন রাইটার্সকে একবার ডেকে দাও তো।”

বাইটার্সের সঙ্গে কথা শেষ করে সদ্য ডেস্কের কাজে হাত দিয়েছি, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল।

“কেমন আছেন মশাই?” 

এ যে কার গলা, সে আর বলে দিতে হয় না। হাজার লোকের গলার ভিতর থেকেও এই গলাটিকে একেবারে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়। চারু ভাদুড়ি। 

বললুম, “কী কান্ড! কোথেকে ফোন করছেন?” 

“কলকাতায় এসে বরাবর যেখানে উঠি সেখান থেকে।” 

“তার মানে মালতীদের বাড়ি থেকে, তাই না?” 

“বিলক্ষণ।” 

“কিন্তু এখন তো আপনার কলকাতায় আসবার কথা ছিল না। গত হপ্তাতেই তো আপনার চিঠি পেয়েছ। তাতে লিখেছিলেন যে, পুজোর আগে কলকাতায় আসার কোনও প্ল্যান নেই। 

“প্ল্যান সত্যিই ছিল না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু হঠাৎ একটা কাজ পড়ে গেল। এমন কাজ যে, না এলেই নয়। 

“কবে এসেছেন?”

“তা চার-পাঁচ দিন হল। …দাঁড়ান, দাঁড়ান, হিসেব করে বলছি। আজ তো বুধবার। আমি এসেছি গত শুক্রবার। তা শুক্র, শনি, রবি সোম, মঙ্গল—পাঁচ রাত্তিরই তো হল, মোট পাঁচ রাত্তির এখানে কাটিয়েছি।” 

“কাজ মিটেছে?” 

“পনরো আনা মিটেছে। আজ বিকেলে একজনের আসবার কথা আছে এখানে। সে এলে বাকি এক আনাও মিটে যায়। তা শুধু কাজ মিটলেই তো চলে না, তার একটা রিপোর্ট লিখে ক্লায়েন্টের হাতে দিতে হয়। কাল দুপুরে রিপোর্টটা লিখে ফেলব। ক্লায়েন্ট আসবে রাত্তিরে। রিপোর্টটা তার হাতে ধরিয়ে দিলেই আমার ছুটি।” 

“তার মানে পরশুই ব্যাঙ্গালোরে ফিরবেন?” 

“তা-ই তো ভেবেছিলুম। কিন্তু মালতী আটকে দিয়েছে। অরুণের শরীরটা বিশেষ ভাল যাচ্ছে না। তাই ব্যাঙ্গালোরে ফোন কবে বলে দিলুম যে, সামনের হপ্তাটাও আমি কলকাতাতেই থাকব।”

“অরুণের কী অসুখ?” 

“সেই একই অসুখ। ওর যে একটা মাইল্ড স্ট্রোক হয়ে গিয়েছিল, তা তো আপনি জানেনই। তার পর থেকেই খুব সাবধানে থাকতে হয়। তা মালতী ওকে যথাসাধ্য সাবধানে রাখেও। তবু যে কেন প্রেশারটা এত ফ্লাকচুয়েট করে, বুঝতে পারি না। দিন কয়েক হল, ওই প্রেশারই একটু ট্রাব্‌ল দিচ্ছে। ….না না, চিন্তা করবেন না। মাঝে-মাঝে তো এ-রকম ওর হয়ই, আবার ঠিকও হয়ে যায়।” 

“কবে যাব আপনার কাছে?” 

“কাল পর্যন্ত ব্যস্ত আছি। পরশু থেকে একদম ফ্রি।” 

“শুক্রবার আর শনিবার, দুটো দিন একটু ঝঞ্ঝাটে থাকব। অর্থাৎ পরও আর তরশু। তারপরেই তো রোব্বার। বলেন তো রোব্বার বিকেলেই যেতে পারি। ফোনে অবশ্য রোজই খবর নেব।” 

“ঠিক আছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন। “তা হলে রোব্বারই আসুন। তবে বিকেলে নয়, সকালে। …..এই নিন, মালতীর সঙ্গে কথা বলুন।” 

“সকালেই চলে আসুন, কিরণদা।” ফোনে মালতীর গলা ভেসে এল। “দুপুরে এখানেই খাবেন বিকেলের আগে আপনাকে ছাড়া হচ্ছে না। পারুল আর বউদিকেও নিয়ে আসবেন কিন্তু।” 

“আবার খাওয়া-দাওয়ার হাঙ্গামা বাধাচ্ছ কেন মালতী? অরুণের শরীর তো শুনলুম ভাল যাচ্ছে না। আর তা ছাড়া তোমার বউদি যে যেতে পারবে, এমন আশাও নেই। পারুলের জন্যেই পারবে না। সামনের মাসেই পারুলের বি.এ. ফাইনাল। সারা দিন পড়ছে। অর্থাৎ কিনা মরণকালে হরিনামের ব্যাগার। তা বাসন্তীও গত দুমাস ধরে পাড়া ছেড়ে কোথাও যায়নি। বলছে, মেয়ের পরীক্ষা যন্দিন না শেষ হয়, কোথাও যাবেও না।” 

“ঠিক আছে, তা হলে আপনি একাই আসুন। অরুণকে নিয়ে ভাববেন না। আজ প্রেশার নেওয়া হয়েছিল, আগের চেয়ে অনেক ভাল আছে।” 

ফোন নামিয়ে রেখে কাজে বসে গেলুম। 

কাজকর্ম চুকিয়ে অফিস থেকে বাড়িতে ফিরতে-ফিরতে রাত দশটা। বাসন্তী বলল, “চটপট জামা কাপড় পালটে হাত-মুখ ধুয়ে নাও, সেই ফাঁকে আমি খাবারগুলো গরম করে ফেলি। দেরি কোরো না।” 

বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি, খাবার টেবিলে বাসন্তী সব সাজিয়ে ফেলছে। পারুন চটপট নাকে-মুখে দুটি গুঁজে উঠে পড়ল। বলল, “তোমরা ধীরেসুস্থে খাও, আমি গিয়ে পড়তে বসছি। আজ দুটো পর্যন্ত পড়ব।” 

বাসন্তী বলল, “দেখিস, পরীক্ষার আগে আবার একটা অসুখ বাধিয়ে বসিস না। চারদিকে বড্ড জ্বরজারি হচ্ছে।” 

পারুল গিয়ে পড়তে বসে গেল। বাসন্তীকে বললুম, “বাবা রে বাবা, ভাল করে খেল না পর্যন্ত, মেয়েটা তো দেখছি পড়তে-পড়তেই পাগল হয়ে যাবার জোগাড়।”

বাস্তী বলল, “বা রে, না-পড়লে চলবে কেন? পার্ট ওয়ানে অল্পের জন্যে ফার্স্ট ক্লাস পায়নি, ফাইনালে সেটা মেটাতে হবে না? ওহো একটা কথা তোমাকে তো বলা-ই হয়নি, ও-বাড়ির খবর শুনেছ?”

“কী করে শুনব? আমি তো এইমাত্র বাড়ি ফিরলুম। কেন, আবার কী হয়েছে?” 

বাসন্তী হেসে বলল, “ভাড়াটেদের জল আর লাইট আজ বিকেল থেকে আবার চালু হয়ে গেছে।”

বললুম, “তা-ই নাকি? সদানন্দবাবু সুবুদ্ধি হয়েছে দেখছি।” 

বাসন্তী বলল, “ওঁর আবার সুবুদ্ধি কী হল? যা-কিছু হয়েছে সবই কুসুমদির জন্যে। তুমি অফিসে চলে যাবার পরে ও বাড়িতে একবার গিয়েছিলুম তো, কুসুমদিই ওঁদের কাজের মেয়েটাকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তা গিয়ে দেখলুম কর্তা-গিন্নিতে একেবারে ধুন্ধুমার কাণ্ড হচ্ছে। কুসুমদি আমার সামনেই তাঁর কর্তাটিকে বলে দিলেন যে, আজ বিকেলের মধ্যেই ভাড়াটেরা যদি জল আর লাইট না পায় তো বাড়ি ছেড়ে তিনি যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবেন। তা সদানন্দবাবুও দেখলুম, গায়ে একটা পাঞ্জাবি চাপিয়ে সুড়সুড় করে অমনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। কুসুমদির অমনি অন্য চেহারা। একগাল হেসে আমাকে বললেন, ‘ভয় পাসনি রে বাসন্তী, মিস্ত্রি ডাকতে গেল, আমাকে ভীষণ ভয় পায় তো!’ বোঝো ব্যাপার!” 

আমি বললুম, “বটে? সদানন্দবাবু যে এত স্ত্রৈণ তা তো জানতুম না।” 

বাসন্তী মুখ টিপে হেসে বলল, “এতে এত অবাক হচ্ছ কেন? অল্প বয়েসে যে যা-ই করুক, বুড়ো বয়েসে তো বউ ছাড়া আর গতি থাকে না, তখন আর স্ত্রৈণ না-হয়ে উপায় কী।” 

শুনে প্রায় বিষম খেতে যাচ্ছিলুম, অনেক কষ্টে সেটা সামলে নিয়ে বললুম, “তা বটে।”

“এত করেও কিন্তু কিছু হল না। কুসুমদির যেটা সমস্যা, সেটা রয়েই গেল।” 

“তার মানে?” 

বাসন্তী বলল, “তাও তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে? সমস্যাটা যে কী, তা তুমি এখনও টের পাওনি?” 

“না পাইনি। একটু বুঝিয়ে বলবে?” 

“এত তো বুদ্ধির বড়াই করো, অথচ আসল ব্যাপারটাই তুমি ধরতে পারোনি। কুসুমদির সমস্যা ওই কমলিকে নিয়ে। বাদবাকি ভাড়াটেদের কী হল না হল তা নিয়ে ওঁর কিছু মাথাব্যথা নেই, কিন্তু ‘ কমলির যে অসুবিধে হচ্ছে, এইটে উনি সহ্য করতে পারছেন না।” 

বললাম, “এ তো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ভদ্রমহিলার ছেলেপুলে হয়নি, তাই কমলির উপরে ওঁর যে একটা টান পড়ে যাবে, সে আর বিচিত্র কী। মেয়েটা তো শুনলুম সারাদিন ওঁরই কাছে থাকে।” বাসন্তী বলল, “আগে থাকত, কাল রাত্তির থেকে আর থাকছে না। কাল বিকেলের মধ্যেই তো জল আর লাইট আবার চালু হয়ে গেল, তার পরেও একবার সন্ধে-নাগাদ কুসুমদির কাছে গিয়েছিলুম। গিয়ে দেখলুম মুখ ভার করে বসে আছেন। কী ব্যাপার? না কমলিকে উপরে নিয়ে আসবার জন্যে ওঁদের কাজের মেয়েটিকে উনি একতলায় নকুলের বউয়ের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তা নকুলের বউ তাকে খুব মুখঝামটা দিয়েছে। বলেছে, ‘থাক থাক, আর অত সোহাগ দেখাতে হবে না!’ কমলিকেও উপরে নিয়ে আসতে দেয়নি।” 

বললুম, “তাই তো, সমস্যাটা দেখছি ক্রমেই ঘোরালো হয়ে উঠছে।” 

বাসন্তী বলল, “পরকে আপন করার এই হচ্ছে বিপদ। ওই যে বলে না পরের সোনা কানে দিতে নেই, ঠিকই বলে। কখন হ্যাঁচকা টান মারবে, তার ঠিক কী। তখন সোনাও যাবে কানও যাবে।” 

বললুম, “কমলির উপরে মিসেস বসুর এত মায়া না পড়লেই ভাল ছিল। ভদ্রমহিলাকে কষ্ট পেতে হবে।” 

খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। মুখ ধুয়ে শোবার ঘরে এসে একটা সিগারেট ধরালুম। মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। 

রাত্তিরে একবার ঘন্টাখানেকের জন্যে লোডশেডিং হয়েছিল। বাড়িতে একটা ইনভার্টার আছে বটে, কিন্তু সেটা পারুলের ঘরে থাকে। ফ্যান বন্ধ। ভাল ঘুম হল না। হাতপাখা চালাতে চালাতে শেষ রাত্তিরে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, ঘুম ভাঙল বেলা আটটায়। তাও ভাঙত না, যদি না বাসন্তী এসে ঠেলা মেরে আমাকে তুলে দিত। 

চোখ খুলে বললুম, “কী ব্যাপার?” 

“আর কত ঘুমোবে, উঠে পড়ো। সদানন্দবাবু সেই কখন থেকে বসে আছেন।” 

“একটু বসিয়ে রাখো। বলো যে, হাত-মুখ ধুয়েই আমি বৈঠকখানায় যাচ্ছি। ওঁকে চা দিয়েছ তো?”

“দিয়েছি। এখন ওঠো তো।” 

হাত-মুখ ধুয়ে চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে বৈঠকখানা ঘরে ঢুকলুম। ঢুকেই বুঝলুম, অবস্থা সুবিধের নয়। সদানন্দবাবুর মুখ একেবারে অন্ধকার। 

বললুম, “কী ব্যাপার মশাই, আবার কিছু হল নাকি?” 

“আর বলবেন না!” সদানন্দবাবু বললেন, “আমি এবারে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাব।”

“কেন পাগল হবার মতো কী ঘটল?” 

“জল আর লাইট যে কাল বিকেলেই ফের চালু করে দিয়েছি, সেটা শুনেছেন তো?” 

“শুনেছি। সে তো ভালই করেছেন।” 

“কিন্তু ভালটা আমি কার জন্যে করলুম? এই বজ্জাতগুলো কি ভাল ব্যবহার পাবার যোগ্য? “

“এ-কথা বলছেন কেন?” 

সদানন্দবাবু বললেন, “তা হলে শুনুন, যার কষ্টের কথা ভেবে আমার গিন্নির ঘুম হচ্ছিল না, সেই বাচ্চা মেয়েটাকে আজ সকালেও ওরা উপরে আসতে দেয়নি। কমলি আসতে চায়, কিন্তু ওরা আসতে দেবে না। কমলি তাই কাল থেকে সমানে কাঁদছে। তা সে কাঁদতেই পারে। ও যে এত বড়টা হয়েছে সে তো বলতে গেলে আমার গিন্নির হাতেই। সারাটা দিন তো তিনিই ওকে দেখতেন। রাত্তিরে গিয়ে মায়ের কাছে শুত; বাস, একতলার সঙ্গে ওইটুকুই ওর সম্পর্ক। সেই মেয়েকে ওরা কিনা উপরে আসতে দেবে না! ফলে একতলায় যেমন কমলি একটানা কেঁদে যাচ্ছে, তেমনি দোতলায় কাঁদছেন আমার গিন্নি। কাল থেকে সমানে কাঁদছেন। আমার হয়েছে মহা জ্বালা। কী যে করি, কিছুই বুঝতে পারছি না। একটা-কিছু পরামর্শ দিন তো।” 

এ-সব ক্ষেত্রে কী আর পরামর্শ দেব। একবার ভাবলুম বলেই ফেলি যে, মাদার টেরিজার কাছ থেকে একটা বাচ্চাকে নিয়ে এসে আপনার গিন্নির কোলে ফেলে দিন। তাতে একটা অনাথ শিশুও যেমন বেঁচে যাবে, তেমনি বাঁচবেন আপনার গিন্নিও। কিন্তু সাত-পাঁচ ভেবে আর সে-কথা বললুম না। চুপ করে রইলুম। 

সদানন্দবাবু বললেন, “তার উপরে আবার কাল রাত একটা-দেড়টার সময়ে বাড়ি ফিরে নকুল যে কান্ডটা করল, সে আর কহতব্য নয়। তখন লোডশেডিং চলছিল, কিন্তু হারামজাদা সে-কথা বুঝল না, ভাবল যে, আমিই বোধহয় ফের লাইট কেটে দিয়েছি। তাই প্রথমেই তো আমার চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার করে গালাগাল করতে লাগল, তারপর শুরু হল ঠেঙানি। শুধু যে বউকে ধরে ঠেঙিয়েছে তা নয়, ব্যাটা একেবারে বেহেড মাতাল, দুধের বাচ্চাটাকেও ছাড়েনি, তাকেও বোধহয় চড়চাপড় দিয়েছে গোটাকয়। মেয়েটা যেমন ডাক ছেড়ে কাঁদছিল, তাতে তো মশাই সেইরকমই মনে হল।” 

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন সদানন্দবাবু। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠতে-উঠতে বললেন, “আপনি কিছু বলবেন না, কেমন?”

বললুম, “কী যে বলব, কিছুই তো বুঝতে পারছি না।” 

“বেশ, আপনি তা হলে চুপ করেই থাকুন। কিন্তু এই আমি বলে গেলুম যে, আমিও ছেড়ে দেবার পাত্র নই। পাড়ার সক্কলকে আমি বলেছি যে, যদি দরকার হয় তো গুন্ডা লাগিয়ে আমি ওকে তাড়াব আর গুন্ডারই বা দরকার কী, এই যে লাঠিটা দেখছেন না, এটাই যথেষ্ট, এইটে দিয়েই ওর মাথা ফাটিয়ে ছাড়ব আমি।” 

সদানন্দবাবু বেরিয়ে গেলেন। 

এ হল বৃহস্পতিবার সকালের কথা। কাল ছিল শুক্রবার। কালও নকুলচন্দ্র নাকি অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছিল। আর আজ শনিবার ভোরবেলায় একটা বিকট আর্তনাদ শুনে পাড়ার লোকেরা ছুটে গিয়ে যা দেখল, তাতে তাদের রক্ত একেবারে হিম হয়ে যাবার জোগাড়। সে এক ভয়াবহ দৃশ্য। পাঁচ-নম্বর বাড়ির একতলার সিঁড়ির ঠিক সামনেই তার নিষ্প্রাণ শরীরটা লুটিয়ে পড়ে আছে। 

সদানন্দবাবুই যে নকুলচন্দ্রকে খুন করেছেন, আমার পক্ষে এ-কথা বিশ্বাস করা খুব শক্ত। ভদ্রলোককে আমি চিনি, দশ বছর ধরে তাঁকে বলতে গেলে প্রায় রোজই দেখছি। তা একটা মানুষের ধাতটা যে ঠিক কীরকম, সে রগচটা না ঠান্ডা মাথার লোক, হাঙ্গামাবাজ না শান্তিপ্রিয়, তা বোঝার পক্ষে—আমার তো মনে হয়—দশ কেন, পাঁচটা বছরই যথেষ্ট। আমার বিশ্বাস, তিনি পরোপকারী, সজ্জন, উপরন্তু খুবই নিরীহ ব্যক্তি। মাঝেমধ্যে একটু রেগে যান ঠিকই, রেগে গেলে ‘হ্যান, করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা’ বলেনও বটে, কিন্তু খুন তো খুন, কাউকে একটা চড়চাপড় মারাও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। 

তবে কিনা বাইরে থেকে যাঁকে নেহাত ভালমানুষ বলে মনে হয়, খুন-টুন করা যে তাঁর পক্ষে একান্তই অসম্ভব একটা ব্যাপার, নিশ্চিত হয়ে তা-ই বা বলি কী করে? বললে সে-কথা আপনারা শুনবেনই বা কেন? তার উপরে আবার গল্পটা যেখানে শোনাচ্ছি, সেই কলকাতা শহরে সম্প্রতি খুব সমারোহ সহকারে চ্যাপলিন উৎসব হয়ে গেল। চ্যাপলিনের শতবর্ষ উপলক্ষে তাঁর যে-সব ছবি আবার নতুন করে দেখানো হল, তার মধ্যে মঁসিয়ে ভের্দুও ছিল বই কী। আপনারা সে-ছবি দেখেছেন নিশ্চয়। কেউ-কেউ হয়তো একাধিকবার দেখেছেন। ফলে আপনারা জেনেই গিয়েছেন যে, এমনিতে যে-লোক নেহাতই নিরীহ, এত নিরীহ যে, একটা পোকাকেও পিষে মারতে পারে না, সে-ও খুন করতে পারে। তাও একবার নয়, বারবার। সুতরাং সদানন্দবাবুকে যদি এক্ষুনি আমি একটা গুড কন্‌ডাক্ট সার্টিফিকেট দিয়ে দিই, তো সেটা আপনারা মেনে নেবেন না। 

আর তা ছাড়া যাকে অকুস্থল বলা হয়, ঘটনাটা ঘটার সময়ে আমি যে সেখানে কিংবা তার আশেপাশে হাজির ছিলুম, তাও তো নয়। ফলে কিছুই আমি স্বচক্ষে দেখিনি। সবই আমার শোনা কথা। কিছুটা সদানন্দবাবুর কাছে শুনেছি, কিছুটা অন্যদের কাছে। অন্যদের কথা পরে হবে, আগে বরং সদানন্দবাবুর কাছে যা শুনেছি, সেটাই বলব। 

কিন্তু তারও আগে বলা দরকার, শনিবার ভোরবেলায় একটা ভয়ংকর আর্তনাদ শুনে যখন পারুল আমাদের ঘরে এসে আমাকে জাগিয়ে দিয়ে বলে যে, পাঁচ-নম্বর বাড়িতে নিশ্চয় কিছু হয়েছে, এক্ষুনি আমার সেখানে যাওয়া উচিত, আর তার কথা শুনবামাত্র আমি ধড়মড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে নীচে নেমে সদর-দরজা খুলে একছুটে রাস্তা পেরিয়ে যখন ও বাড়িতে গিয়ে ঢুকি, তখন সদানন্দবাবুকে আমি ঠিক কী অবস্থায় দেখেছিলুম। ভদ্রলোক তখন সিঁড়ির কয়েক ধাপ উপরে একেবারে পাথরের একটা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন। সিঁড়ির তলায় সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখছে যমুনা আর বিষ্টুচরণ। যা-ই দেখুক, সেটা তাদের শরীরের আড়ালে পড়ে যাওয়ায় অন্তত সেই মুহূর্তে আমি দেখতে পাইনি। স্পষ্ট করে আমি দেখতে পাচ্ছিলুম শুধু সদানন্দবাবুকেই। তাঁর মাথার উপরে কড়া পাওয়ারের একটা ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বলছে। তার আলোয় আমার মনে হল যে, ভদ্রলোকের মুখ একেবারে মড়ার মতন ফ্যাকাশে। চোখের দৃষ্টিও কেমন বিহ্বল। যেন কোনও কিছুই তিনি ঠিক দেখছেন না বা বুঝে উঠতে পারছেন না। সেই অবস্থাতেই হঠাৎ তিনি ধপ করে সেই সিঁড়ির ধাপের উপরেই বসে পড়লেন। 

এ হল শনিবার ভোরবেলাকার ঘটনা। মনে হয় কথা বলবার মতো অবস্থাই তখন সদানন্দবাবুর ছিল না। বাইরের লোকেদের মধ্যে আমি আর আমার পাশের বাড়ির শম্ভুবাবুই ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রথম পৌঁছই। পরে এক-এক করে আরও অনেকে এসে পড়েন। মোটামুটি ছ’টার মধ্যেই বাড়ির বাইরে রাস্তার উপর ভিড় জমে যায়। 

যমুনা আর বিষ্টুচরণের আড়ালে পড়ে গিয়েছিল বলে নকুলের লাশটা প্রথমে আমার চোখেই পড়েনি। ফলে আমি মিনিট খানেকের মধ্যে বুঝেই উঠতে পারিনি যে, ব্যাপারটা ঠিক কী হয়েছে। সেটা বুঝলুম শম্ভুবাবু গিয়ে বিষ্টুচরণকে একপাশে সরিয়ে দেবার পর। 

তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ আর ছেচল্লিশের দাঙ্গায় এই শহরের রাস্তাঘাটে নিত্য যেসব দৃশ্য আমি প্রত্যক্ষ করেছি, তাতে আর এখন একটা মৃতদেহ দেখে আমার শিউরে ওঠার কথা নয়। নকুলকে দেখে তবু যে আমি শিউরে উঠেছিলুম, তার কারণ নিশ্চয় এই যে, আমারই বয়সী আরও অনেকের মতো এখনও আমি একটা ইট কিংবা পাথরের মতো নিশ্চেতন পদার্থে পরিণত হইনি। 

সিঁড়ির নীচে চিত হয়ে নকুল পড়ে আছে। শম্ভুবাবু এগিয়ে গিয়ে উবু হয়ে বসে, তার নাড়িতে হাত রাখলেন। তারপর মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ডেড।” 

নকুল যে বেঁচে নেই, সে তার চোখ দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলুম। আমার বুকের মধ্যে দমাস-দমাস করে মুগুর পেটার শব্দ হচ্ছিল। ঠোঁট শুকিয়ে গিয়েছে, দুই কানের ভিতর দিয়ে বইছে গরম হাওয়া। অনেক কষ্টে প্রায় অস্ফুট গলায় শম্ভুবাবুকে বললুম “আপনি একটু থাকুন এখানে, আমি ডঃ চাকলাদারকে সব জানাচ্ছি, তারপর থানায় একটা ফোন করে দিয়ে এখুনি আবার ফিরে আসব।” রাস্তায় নামতেই চোখে পড়ল যে, বাসন্তী আর পারুল সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। দুজনে প্রায় একই সঙ্গে জিজ্ঞেস করল “কী হয়েছে?” 

বললুম, “সর্বনাশ হয়েছে।” তারপর উপরে এসে ফোনের ডায়াল ঘোরাতে লাগলুম। 

ফোন আজকাল চট করে পাওয়া যায় না। ড. চাকলাদার কাছেই থাকেন, তাঁকে পেতে দেরি হয়নি, কিন্তু থানার লাইন পেতে পেতে মিনিট দশেক লাগল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, পাঁচটা পঁয়ত্রিশ। ওদিক থেকে যিনি ‘হ্যালো’ বললেন, গলা শুনেই বোঝা গেল যে, তিনি ঘুমোচ্ছিলেন তাঁর ঘুমের আমেজ এখনও কাটেনি। 

বললুম, “আমি পীতাম্বর চৌধুরি লেন থেকে কথা বলছি। আমার নাম কিরণ চট্টোপাধ্যায়, আমি জার্নালিস্ট, দৈনিক সমাচার পত্রিকায় কাজ করি।” 

“জার্নালিস্ট? খবর চাইছেন নিশ্চয়? না, আমাদের এলাকায় কাল রাত্তিরে বড়-কিছু ঘটেনি। রাস্তা থেকে গোটা দুয়েক মাতাল ধরে এনে লক-আপে পুরে দিয়েছি। আর আছে একটা রোড-অ্যাক্সিডেন্টের কেস। তাও মাইনর অ্যাক্সিডেন্ট, কেউ মারা-টারা যায়নি। ব্যস, আর কোনও খবর নেই।” 

বললুম, “আরে মশাই, আমি খবর চাইছি না, খবর দিতে চাইছি। আমাদের রাস্তায় হঠাৎ একজন মারা গেছে। মনে হচ্ছে আপনাদের ও. সি.-র একবার আসা দরকার।” 

“আমি ও. সি.। কী হয়েছে বলুন তো? মার্ডার?” 

“তা তো জানি না। মার্ডার হতে পারে, অ্যাকসিডেন্টও হতে পারে। ঠিক কী যে হয়েছে, সেটা আপনারা এসে ঠিক করুন।” 

“ঠিক আছে, আমরা যাচ্ছি। একটা কথা জিজ্ঞেস করি, ব্যাপারটা কোথায় ঘটেছে? মানে রাস্তায় না বাড়ির মধ্যে?” 

“বাড়ির মধ্যে।” 

“যে বাড়িতে ঘটেছে, আপনি কি তার কাছেই থাকেন?” 

“খুবই কাছে। বলতে গেলে এটা আমাদের একেবারে উল্টো-দিকের বাড়ি।” 

“তা হলে তো ভালই হল। আমরা একটু বাদেই ওখানে পৌঁছে যাব। কিন্তু তার আগে আপনি কাইন্ডলি একবার ওখানে গিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিন যে, ঘটনাটা যেখানে ঘটেছে, সেখান থেকে কেউ যেন কিছু না সরায়। মানে যা-কিছু যেখানে যেমনভাবে আছে, ঠিক সেইখানে ঠিক তেমনিভাবেই যেন থাকে। আর হ্যাঁ, ডেডবডিটাকেও যেন কেউ টাচ না করেন। এটা জানিয়ে দিতে আপনার কোনও অসুবিধা হবে?” 

“কিছুমাত্র না। এখুনি ওখানে গিয়ে জানিয়ে দিচ্ছি।” 

ফোন নামিয়ে রাখলুম। পরক্ষণেই মনে হল, ভাদুড়িমশাই তো কলকাতাতেই আছেন। তাঁকে একবার ব্যাপারটা জানানো দরকার। 

কপাল ভাল, এবারে আর লাইন পেতে দেরি হল না। দুচার কথায় যা জানাবার জানাতেই তিনি বললেন, “সম্ভবত আপনি চাইছেন যে, আপনার বন্ধু সদানন্দবাবুকে সাহায্য করবার জন্যে আমি একবার যাই। কিন্তু আমি এখন যাব না। আমার বদলে যাকে পাঠাচ্ছি, তাকে দেখলেই আপনি চিনতে পারবেন।” 

বাসন্তী আর পারুল ইতিমধ্যে উপরে উঠে এসেছিল। পাশেই এসে দাঁড়িয়ে ছিল তারা। চুপচাপ আমার কথা শুনে যাচ্ছিল। ফোন নামিয়ে রাখতে বাসন্তী বলল, “ও-বাড়িতে অত কান্নাকাটি হচ্ছে কেন? কী হয়েছে? সদানন্দবাবুর কিছু হয়নি তো?” 

বললুম, “সদানন্দবাবুর কিছু হয়নি। তবে যা ভয় করছি তা যদি সত্যি হয় তো ভদ্রলোক বিপদে পড়ে যাবেন। নকুল মারা গেছে।” 

পারুল বলল, “সে কী! কখন মারা গেল? কী হয়েছিল? 

বললুম, “কিছু জানি না। আমি একবার ও-বাড়িতে যাচ্ছি।” 

বাসন্তী বলল, “আমিও তোমার সঙ্গে যাব।” তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর যাবার দরকার নেই। তুই নিজের জন্যে এক কাপ চা বানিয়ে নে। কাল বিকেলে যে পায়েস করেছিলুম তার খানিকটা ফ্রিজে রয়েছে। সন্দেশও রয়েছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে পড়তে বসে যা।” 

আমি আর বাসন্তী চটপট নীচে নেমে রাস্তার উপরের ভিড় ঠেলে পাঁচ নম্বরে গিয়ে ঢুকলুম। ছ’টা বাজে। কিন্তু যতই বেলা বাড়ুক, মধ্য-কলকাতার এইসব এঁদো গলির অন্ধকার যেন আর কাটে না। সিঁড়ির উপরকার কড়া-পাওয়ারের আলোটা তখনও জ্বলছে। নইলে নিশ্চয় চৈত্র মাসের সকাল ছ’টাতেও জায়গাটা একেবারে অন্ধকার হয়ে থাকত। 

নকুলের মাথার পাশে মেঝের উপরে চাপ-চাপ রক্ত। আগে এটা চোখে পড়েনি। বাসন্তী যে ভয় পেয়ে গিয়েছে সে তার মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলুম। তাকে বললুম “তুমি আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না, উপরে চলে যাও।” 

শম্ভুবাবু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। বাসন্তী উপরে যাবার পরে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “থানায় খবর দিয়েছেন?” 

বললুম “দিয়েছি। ওরা একটু বাদেই এসে পড়বে। কিন্তু সদানন্দবাবুকে দেখছি না যে?”

“ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে; বললেন যে, শরীরটা অস্থির-অস্থির করছে। মাথাটা বোধহয় একটু ঘুরে গিয়েছিল। একবার একটু বমিও করে ফেললেন। ওঁকে উপরে নিয়ে শুইয়ে দিয়েছি।” 

পাড়ার যাঁরা ভিতরে এসে ঢুকেছিলেন, থানায় খবর দেওয়া হয়েছে শুনেই তাঁরা একে-একে সরে পড়তে লাগলেন। কী হয়েছে, সেটা জানবার জন্যে কারও কৌতূহলই কিছু কম নয়, কিন্তু যেমন কৌতূহল তেমনি অল্প-বিস্তর ভয়ও আছে প্রায় প্রত্যেকেরই। পুলিশ এসে জেরা করবে, মামলা হলে সাক্ষী দিতে বলবে, সাধ করে কে আর এ-সব ঝঞ্ঝাটে নিজেকে জড়াতে চায়। 

শম্ভুবাবুকে ব্যতিক্রম বলেই গণ্য করতে হবে, তিনি গেলেন না। জিজ্ঞেস করলুম, “আপনার আজ অফিস নেই?” 

“আজ তো শনিবার। আমার ছুটি। একবার অবশ্য বাজারে যাবার দরকার ছিল, তা সে কাল গেলেও চলবে।” 

“ভালই হল, আপনি তা হলে আর-কিছুক্ষণ এখানে থেকে যান। ও হ্যাঁ, থানা থেকে বলল যে, কেউ যেন এখান থেকে কিছু না সরায়। ডেডবডিটাও না ছোঁয়।” 

দেওয়ালের ধারে বসে হাপুস নয়নে যমুনা কাঁদছিল। বিষ্টুচরণ তার ঘরের দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কথাটা মূলত ওদেরই উদ্দেশে বলা, কিন্তু শুনতে পেল কি না, কে জানে। 

শম্ভুবাবু বললেন, “পুলিশ না আসা পর্যন্ত আপনিও এখানে থাকবেন তো?” 

বললুম “থাকব। তবে এখন একটু উপরে যাচ্ছি। সদানন্দবাবুর অবস্থাটা একবার দেখে আসা দরকার।” 

দোতলায় এসে দেখলুম, সদানন্দবাবুকে তাঁর খাটের উপরে শুইয়ে রাখা হয়েছে। মাথার কাছে দাঁড়িয়ে কাজের মেয়েটি বাতাস করছে তাঁকে। সদানন্দবাবুর স্ত্রী একদিকে একটা চেয়ারে বসে আছেন। পাশের চেয়ারে বসে বাসন্তী তাঁর সঙ্গে কথা বলছিল, আমি গিয়ে ঘরে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল, “থানা থেকে এসেছে?” 

বললুম, “না। পুলিশ কি এত তাড়াতাড়ি আসে নাকি?” 

সদানন্দবাবু আমাকে দেখে ম্লান হাসলেন। বললুম “কেমন আছেন এখন?” 

ক্লান্ত গলায় ভদ্রলোক বললেন, “অনেকটা ভাল। মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গিয়েছিল।”

“যাবারই কথা। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে না তো?” 

“না।” 

“তা হলে ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলুন দেখি।” 

আবার হাসলেন সদানন্দবাবু। সেই ম্লান হাসি। তারপর বললেন, “কী আর বলব বলুন, সবই আমার গ্রহের ফের।” 

বললুম, “সে তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে যে, এই নিয়ে আপনি একটা ঝঞ্ঝাটে না জড়িয়ে যান। ঠিক কী হয়েছিল?” 

সদানন্দবাবু উঠে বসতে যাচ্ছিলেন। আমি বাধা দিয়ে বললুম, “ওঠবার কোনও দরকার নেই। তাড়াহুড়ো করবারও না। যা বলবার আস্তেসুস্থে বলুন।” 

অতঃপর তিনি যা বললেন, আপনাদেরও আমি সেটাই জানাচ্ছি। 

চৈত্র মাস। রাত্তিরে বেজায় গরম পড়েছিল, তা ছাড়া মাঝরাত্তিরে মত্তাবস্থায় বাড়িতে ফিরে নকুলচন্দ্র কালও এমন হই-হট্টগোল বাধিয়ে দিয়েছিল যে, সদানন্দবাবুর ঘুম ভেঙে যায়। টর্চ জ্বেলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেছিলেন, রাত তখন একটা। তারপরে আর ভাল করে ঘুম হয়নি, ওই একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে ছিলেন আর কি। মনে হয়, তার বেশ কিছুক্ষণ বাদে এই মোটামুটি তিনটে নাগাদ একতলায় কিছু একটা ভারী জিনিস পড়ে যাবার শব্দও শুনেছিলেন। কিন্তু সেটা যে কীসের শব্দ তা বুঝতে পারেননি। ভাল করে ঘুমোতে না-পারলেও রোজ যেমন ওঠেন তেমনি আজও ঠিক সাড়ে চারটেতেই তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন। স্টোভ ধরিয়ে তাতে জলের কেতলি বসিয়ে দেন। জলটা ফুটতে-ফুটতেই রোজকার মতো ধুয়ে নেন মুখ-চোখ। তারপর হালকা এককাপ লিকার খেয়ে, জামাকাপড় পাল্টে রোজকার মতোই মর্নিং ওয়াকে বেরুবার জন্যে যখন নীচে নামেন, পাঁচটা বাজতে তখনও মিনিট পাঁচেক বাকি। সিঁড়িটা অন্ধকার। উপর থেকে সুইচ টিপে সিঁড়ির আলো জ্বেলে নীচে নামা যায়। কিন্তু সিঁড়ির আলোটা তিনি কোনওদিনই এইসময় জ্বালেন না। আজও জ্বালেননি। না জ্বালবার কারণ আর কিছুই নয়, সিঁড়ির আলো জ্বালাবার আর নেবাবার জন্য যে টু-ওয়ে সুইচের ব্যবস্থা আজকাল প্রায় সব বাড়িতেই দেখা যায়, সদানন্দবাবুর বাড়িতে সেটা নেই। তাই উপর থেকে আলো জ্বেলে নীচে নামলে আর নীচ থেকে সেটা নেভাবারও উপায় নেই। মর্নিং ওয়াক শেষ করে যতক্ষণ না তিনি আবার বাড়িতে ফিরে আসছেন ততক্ষণ সেটা জ্বলতেই থাকবে। ভদ্রলোক অনেকদিন ধরেই ভাবছেন যে, একটা টু-ওয়ে সুইচের ব্যবস্থা করে নেবেন, কিন্তু এখনও সেটা করা হয়নি। অগত্যা তাঁকে টর্চ জ্বেলে নীচে নামতে হয়। ছোট্ট পকেট-টর্চ। আজ তার বোতাম টিপেই বুঝলেন যে, ব্যাটারির তেজ ফুরিয়ে এসেছে। একে তো ম্যাড়মেড়ে আলো, তায় ছানি কাটাবার পর থেকে চোখেও ভাল দেখতে পান না, খুবই সতর্কভাবে পা ফেলতে ফেলতে তাই নীচে নামছিলেন তিনি। কিন্তু বারো-চোদ্দো ধাপ নেমেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন। ম্লান আলোতে আবছামতন তিনি দেখতে পান যে, সিঁড়ির শেষ ধাপের ঠিক সামনেই একটা লোক মেঝের উপরে হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে পড়ে আছে। লোকটা যে নকুলচন্দ্র সে-কথা বুঝতে তাঁর কয়েক সেকেন্ড সময় লেগেছিল। তারপরেই তিনি বিকটভাবে চেঁচিয়ে ওঠেন। 

নকুল যে মারাই গিয়েছে, চিৎকার করে উঠবার মুহূর্তেও অবশ্য সদানন্দবাবু তা বুঝতে পারেননি। তাঁর চিৎকার শুনে সিঁড়ির দু’দিকের দুটো ঘর থেকে যখন যমুনা আর বিষ্টুচরণ ছুটে বেরিয়ে আসে তখনও না। তিনি ভেবেছিলেন, মোদো-মাতাল লোকটা হয়তো শেষ-রাত্তিরে একবার বাথরুমে যাবার জন্যে টলতে টলতে তার ঘর থেকে বেরিয়েছিল; তখন, কিংবা বাথরুম থেকে বেরিয়ে আবার ঘরে ফিরবার সময়ে, অন্ধকারের মধ্যে দেওয়ালে ধাক্কা লেগে আর টাল সামলাতে পারেনি, আছাড় খেয়ে মেঝেতে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা যে তা নয়, আরও ভয়াবহ, একটু বাদেই তা বোঝা গেল। চিৎকার শুনে কুসুমবালারও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ তিনি দোতলায় তাঁদের শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সিঁড়ির আলোটা জ্বেলে দেন। টর্চের ম্যাড়মেড়ে আলোয় সবকিছু এতক্ষণ স্পষ্ট দেখা যায়নি। এবারে ইলেকট্রিকের আলো জ্বলে উঠতেই দেখা গেল যে, মেঝের উপর চাপ-চাপ রক্ত, আর সেই রক্ত নেমে এসেছে নকুলচন্দ্রের মাথা থেকেই। যেমন নিথর, নিস্পন্দ হয়ে সে পড়ে আছে; তাতেই সদানন্দ বুঝতে পেরে যান যে, সে বেঁচে নেই। তাঁর এক হাতের লাঠি ও অন্য হাতের টর্চ খসে পড়ে যায়। সিঁড়ির রেলিং আঁকড়ে ধরে তিনি তখন দ্বিতীয়বার চেঁচিয়ে ওঠেন। 

ডাক্তার চাকলাদারকে সংক্ষেপে সব জানিয়ে রেখেছিলুম। তিনি এলেন সাড়ে ছটায়। একতলায় এসে আমার খোঁজ করতে শম্ভুবাবু তাঁকে সঙ্গে নিয়ে দোতলায় উঠে আসেন। ডাক্তার চাকলাদারকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে শম্ভুবাবুকে বললুম “আপনি একটু থেকে যান। অন্তত যতক্ষণ না থানা থেকে ওরা এসে পৌঁছচ্ছে। নীচেই থাকুন, নইলে, কে কী নাড়াচাড়া করবে, কোথার থেকে কোন জিনিসটা সরিয়ে রাখবে, তার ঠিক কী। 

শম্ভুবাবু নীচে নেমে গেলেন। ডাক্তার চাকলাদার বললেন, “ওরেব্বাবা, এতটা তো ভাবিনি। একতলায় তো রক্তারক্তি কান্ড। কী হয়েছিল মশাই?” 

বললুম, “ঈশ্বর জানেন। কিন্তু ও তো মারাই গেছে, ওকে নিয়ে আর ভাববার কিছু নেই। যিনি বেঁচে আছেন তাঁকে দেখুন।” 

ডাক্তার চাকলাদার খাটের কাছে তাঁর চেয়ারটাকে সরিয়ে আনলেন। সদানন্দবাবুর কপালে হাত রাখলেন, টেম্পারেচার নিলেন,বুকে-পিঠে স্টেথোস্কোপ বসিয়ে লম্বা করে নিঃশ্বাস টানতে বললেন, তারপর ব্লাড প্রেশার নিয়ে বললেন, “কিছু না, শুধু প্রেশারটা একটু বেড়েছে। একটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি, খান, আর আজকের দিনটা চুপচাপ শুয়ে থাকুন, নড়াচড়া করবেন না। কাল সকালে কাউকে দিয়ে প্রেশারটা আর-একবার দেখিয়ে নেবেন।”

কুসুমবাল। আলমারি খুলে টাকা বার করে এনেছিলেন, চাকলাদার হেসে বললেন, “টাকা কীসের? জানেন তো আমি কারও বাড়িতে যাই না।” 

কথাটা মিথ্যে নয়। ডঃ চাকলাদার আসলে প্যাথলজিস্ট। পাশের গলির মোড়েই তাঁর ল্যাবরেটারি। জ্বরজারি হলে আমরা তাঁর কাছে যাই বটে, প্রেসক্রিপশনও লিখিয়ে নিই, কিন্তু তার জন্যে তিনি এক পয়সাও নেন না। বাড়িতেও যান না কারও। আজ যে এসেছেন, সেটা একেবারে না এসে উপায় ছিল না বলেই। 

চাকলাদার উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, “চলি তা হলে।” 

ঘর থেকে ভদ্রলোক বেরিয়েওছিলেন, কিন্তু সিঁড়ির মাথা থেকেই ফিরে এসে বললেন, “যাওয়া হল না। মনে হচ্ছে আটকে গেলুম।” 

“কেন কী হল?” 

“পুলিশ এসে গেছে।” 

বললুম, “তা হলে একটু থেকেই যান। অসুবিধা নেই তো?” 

“অসুবিধে আর কী, ল্যাবরেটারিতে ক’টা টেস্ট করবার ছিল, তা সে ঘন্টা-খানেক বাদে করলেও ক্ষতি নেই। চলুন, নীচে যাওয়া যাক।” 

বাসন্তীও উঠে দাঁড়াল। বলল, “চলি কুসুমদি। মেয়েটা একলা রয়েছে। পরে আবার আসব।”

তিনজনে মিলে নীচে নেমে এলুম। 

আমাদের থানা অফিসার গঙ্গাধর সামন্তকে আমি আগে কখনও দেখিনি। নামটাই মাত্র শোনা ছিল। এও শুনেছিলুম যে, মানুষটি ধান্ধাবাজ নন; পোলিটিক্যাল পেট্রনেজের ধার ধারেন না; এলাকার শান্তি যাতে মোটামুটি বজায় থাকে, তার জন্যে যেটা করা দরকার বলে তাঁর মনে হয়, সেটাই করেন। আর তা ছাড়া খুব পরিশ্রমীও নাকি। 

তা পরিশ্রম করার জন্য যে-রকম স্বাস্থ্য চাই, সামন্তমশাইয়ের স্বাস্থ্য দেখলুম সেইরকম‍ই। চওড়া কাঁধের ছ’ফুট লম্বা মানুষ; শরীর একেবারে লোহা-পেটানো। মোটা একজোড়া গোঁফ থাকায় যেন ভদ্রলোকের চেহারার বাহার আরও খোলতাই হয়েছে। ঝুলো গোঁফ নয়, আদ্যন্ত সমান করে ছাঁটা; ওই যাকে ইংরেজিতে টুথব্রাশ-গোঁফ বলে সেই বস্তু। 

বাসন্তী আর দাঁড়াল না। সিঁড়ির সামনের জায়গাটুকু দেওয়াল ঘেঁষে সন্তর্পণে পার হয়ে রাস্তায় নেমে বাড়ির দিকে চলে গেল। সামন্তমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনিই তো মিঃ চ্যাটার্জি?” 

“হ্যাঁ। আমিই আপনাকে ফোন করেছিলুম।” 

“এইমাত্র যিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন, তিনি কে?” 

“আমার স্ত্রী। বলতে গেলে উল্টো দিকের বাড়িতেই থাকি আমরা। টেলিফোনেই তো সে-কথা আপনাকে বলেছি।” 

গঙ্গাধর সামন্ত ডাক্তার চাকলাদারের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, তারপর তাঁর গলায়-ঝোলানো স্টেথোস্কোপ আর ডান-হাতে ধরা ব্লাড প্রেশার মাপবার যন্ত্রটার উপর চোখ বুলিয়ে বললেন, “আপনি তো দেখছি ডাক্তার। এদের ফ্যামিলি-ফিজিশিয়ান?” 

“আজ্ঞে না। আমি ডাক্তার ঠিকই, তবে প্র্যাকটিস করি না। আমি প্যাথলজিস্ট, কাছেই আমার ল্যাবরেটারি রয়েছে। সব রকমের পরীক্ষা হয় সেখানে।” 

“আপনার নামটা জানতে পারি?” 

“বিলক্ষণ। হরষিত চাকলাদার। এ-পাড়ার সবাই আমাকে চেনেন। সাধারণত কারও বাড়িতে আমি রোগী দেখতে যাই না। তবে পাড়ায় থাকি যখন, এ-সব ক্ষেত্রে আসতেই হয়।” 

“যিনি মারা গেছেন, তাঁকে পরীক্ষা করে তারপর উপরে গিয়েছিলেন?” 

ডাক্তার চাকলাদার অবাক হয়ে গঙ্গাধর সামন্তের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, “যিনি মারা গেছেন, তাঁকে আবার পরীক্ষা করব কী। পরীক্ষা করবার কথা উঠছেই বা কেন? আমি তো ময়না-তদন্ত করি না। যিনি বেঁচে আছেন তাঁকেই আমি পরীক্ষা করে এলুম।” 

“অর্থাৎ?” 

“অর্থাৎ আমি বাড়িওয়ালা সদানন্দ বসুকে দেখতে গিয়েছিলুম। এখন আমি যেতে পারি?”

“একটু থেকে যান।” গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “না না, আমি জোর করছি না, অনুরোধ করছি মাত্র। আমাদের পুলিশ-ডিপার্টমেন্টের ডাক্তার সুরেশ গুপ্তকে খবর দিয়েছি, তিনি এক্ষুনি এসে পড়বেন। এলেই আপনার ছুটি। অবশ্য যা দুর্গন্ধ এখানে, কাউকে থাকতে বলতেও সঙ্কোচ হয়।” 

দুর্গন্ধের কারণ আর কিছুই নয়, মাছের ঘরের দরজা খুলে বিষ্টুচরণ ইতিমধ্যে থানা অফিসার আর আমাদের জন্যে খান তিন-চার টিনের চেয়ার বার করে এনেছিল। গঙ্গাধর সামন্ত পকেট থেকে একখানা রুমাল বার করে গেঁফের উপরে সেটাকে ঠেসে ধরে বললেন, “ওরে বাবা, এ যে মারাত্মক গন্ধ মশাই। কীসের গন্ধ?” 

আমি বললুম, “পচা মাছের। ও-ঘরটায় মাছ থাকে। যা গরম, কিছু মাছ নিশ্চয় পচেছে।” 

“তা হলে ও-ঘরের দরজা খুললেন কেন?” বিষ্টুচরণের দিকে তাকিয়ে সামন্তমশাই বললেন, “শিগগির বন্ধ করুন। নইলে একজন তো মরেইছে, এবারে আমরাও মারা পড়ব।” 

বিষ্টুচরণ তক্ষুনি দরজা বন্ধ করে দিল। গন্ধটা তবু ঝুলেই রইল, মিলিয়ে গেল না।

নাক থেকে রুমাল নামিয়ে গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “সদানন্দবাবুকে কেমন দেখলেন?”

চাকলাদার বললেন, “প্রেশারটা একটু বেড়ে গেছে, আর কোনও ট্রাব্‌ল নেই।” 

“যিনি মারা গেছেন, তাঁর স্ত্রী আর শালা ছুটে এসে তো শুনলুম সদানন্দবাবুকেই সিঁড়ির কয়েক ধাপ উপরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন, তা-ই না?” 

বিষ্টুচরণ বলল, “হ্যাঁ, স্যার।” 

বাইরে রাস্তার উপরে একটা গাড়ি এসে থামার শব্দ হল। 

সদর দরজায় যাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল, সেই কনস্টেবলটি ভিতরে এসে জিজ্ঞেস করল, “ইখানে কোই কিরোনবাবু আছেন?” 

বললুম, “আমিই কিরণ চ্যাটার্জি। কী দরকার?”

কনস্টেবলটি উত্তর দেবার আগেই যে এসে সদর দরজায় দাঁড়াল, তাকে দেখে তো আমি অবাক। ভাদুড়িমশাই অবশ্য বলেছিলেন যে, নিজে না এলেও কাউকে তিনি পাঠিয়ে দিচ্ছেন, আর যে-লোকটিকে পাঠাচ্ছেন তাকে আমি চিনতেও পারব, কিন্তু সে যে কৌশিক, তা আমি ভাবতেও পারিনি। 

কৌশিককে আমি প্রথম দেখি বছর পনরো আগে, সেই যে-বারে আমরা মুকুন্দপুরের মনসামূর্তি উদ্ধার করতে নর্থ বেঙ্গল গিয়েছিলুম তখন। কৌশিক তখন তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনে পড়ত, আর এখন একেবারে জবরদস্ত যুবাপুরুষ। 

বললুম, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, মিঃ সামন্তের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই। মিঃ সামন্ত, আপনি চারুচন্দ্র ভাদুড়ির নাম নিশ্চয় শুনেছেন?” 

“চারুচন্দ্র ভাদুড়ি…চারুচন্দ্র ভাদুড়ি….” নামটাকে দু’বার জিভের উপরে নাচিয়ে নিয়ে সামন্ত বললেন, “আপনি কি সি. সি. ভাদুড়ির কথা বলছেন? মানে এখন যিনি ব্যাঙ্গালোরে থাকেন?”

“আরে হ্যাঁ, মশাই।”

“ওরেব্বাবা,” সামন্ত বললেন, “তিনি তো স্বনামধন্য ইনভেস্টিগেটার। আমাদের লাইনে তাঁকে কে না চেনে! তা ইনি তাঁর কেউ হন নাকি?” 

বললুম, “এ হল কৌশিক সান্যাল। তাঁর ভাগ্নে। আর কৌশিক, ইনি মিঃ গঙ্গাধর সমান্ত, আমাদের থানার ও. সি.।” 

নমস্কার বিনিময়ের পরে সামন্ত বললেন, “তা মিঃ সান্যাল, আপনিও কি মামার লাইন ধরেছেন নাকি?” 

কৌশিক হাসল। বলল, “এখনও ঠিকমতো ধরিনি, তবে চেষ্টায় আছি। কিরণমামা আজ সকালে মামাবাবুকে ফোন করেছিলেন। তা মামাবাবুর একটা কাজ পড়ে গেছে, তাই আসতে পারলেন না, আমাকে বললেন, তুই গিয়ে ব্যাপারটা একটু দেখে আয়।” 

আমি বললুম, “গোয়েন্দা হিসেবে কৌশিকও কিন্তু এরই মধ্যে বেশ নাম করেছে।” 

সামন্ত বললেন, “বটে? তা মিঃ ভাদুড়ি এখন কলকাতায়?” 

“হ্যাঁ, একটা কাজে এসেছেন, সামনের হপ্তাটা থেকে যাবেন। 

“ভাল, ভাল, খুব ভাল।” সামন্তমশাই হেসে বললেন, “ভাল করে সব দেখে যান। কাউকে যদি কিছু জিজ্ঞেস করতে হয় তো করুন। তারপর মিঃ ভাদুড়িকে গিয়ে বলুন যে, কী বুঝলেন। দরকার হলে, আমিও তাঁর পরামর্শ নিতে যাব। তবে দরকার হবে বলে মনে হয় না। এ তো যদ্দুর বুঝতে পারছি একেবারেই সিম্পল ব্যাপার। ওই যাকে ইংরেজিকে ‘ওপন অ্যান্ড শাট্ কেস্’’লা হয় তাই আর কি।” 

বলেই ডাক্তার চাকলাদারের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন সামন্ত। বললেন, “কী, ঠিক বলিনি?”

চাকলাদার হকচকিয়ে বললেন, “কী ঠিক বলেননি? মানে আপনাব কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না।”

সামন্ত বললেন, “না-বুঝবার তো কিছু নেই। ইটস এ প্লেন অ্যান্ড সিম্পল কেস অভ মার্ডার। তা প্র্যাকটিস করুন আর না-ই করুন আপনি একজন ডাক্তার তো বটেন, খুনটা কান হয়েছে বলে আপনার মনে হয়?” 

চাকলাদার চুপ করে রইলেন। বুঝতে পারছিলুম যে, তিনি সাবধানী লোক, চটপট কোনও সিদ্ধান্ত করতে চাইছেন না। সামন্ত বললেন, “কী হল, কিছু বলুন।” 

চাকলাদার বললেন, “দেখুন মশাই, এটা খুন কি না, তা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আনন্যাচারাল ডেথ অবশ্যই। তা পড়ে গিয়ে মাথা কেটে মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে, আবার কেউ ভারী কিছু… এই ধরুন থান-ইট কি পাথর কি মশলা-বাটার নোড়ার মতো কিছু দিয়ে মারবার ফলে মাথা ফেটেছে, এমনটাও হওয়া সম্ভব। সত্যি বলতে কী, যদি শুনি যে, আগেই ভদ্রলোক হার্ট-ফেল করে মারা গিয়েছেন, তারপর পড়ে যাবার ফলে মাথা ফেটেছে, তো তাতেও আমি অবাক হব না। তেমন কেসও আমি দেখছি। তা এর মধ্যে কোনটা এক্ষেত্রে ঘটেছে, অর্থাৎ এটা অ্যাকসিডেন্ট না মার্ডার, নাকি ন্যাচারাল ডেথ ইন আনন্যাচারাল সারকামস্ট্যান্সেস, তা আমি কী করে বলব, তার জন্যে তো আপনাদের এক্সপার্টরাই রয়েছেন।” 

সামন্ত বললেন, “অর্থাৎ আপনি কিছু কমিট করতে চাইছেন না, কেমন? তা না-ই করুন, অন্তত একটা কথা তো বলতে পারেন।” 

“কী বলব?” 

“ঘটনাটা কতক্ষণ আগে ঘটেছে? না না, মিনিট আর সেকেন্ড মিলিয়ে কাঁটায় কাঁটায় নির্ভুল সময় আপনাকে বলতে হবে না, তা আমাদের এক্সপার্টদের পক্ষেও বলা সম্ভব নয়, আপনি একটা আন্দাজের কথা বলুন।” 

চাকলাদার এক পা এগিয়ে গিয়ে ডেডবডির পাশে উবু হয়ে বসলেন। ভেবেছিলুম, নকুলের মৃতদেহের উপরে হাত রেখে তিনি তার উত্তাপ পরীক্ষা করবেন। দেখে নেবেন যে, শরীর কতটা ঠান্ডা হয়ে এসেছে। এইভাবেও অনেককে মৃত্যুর সময়টা আন্দাজ করতে দেখেছি। চাকলাদার কিন্তু সে-সব কিছু করলেন না। মৃতদেহের মাথার পাশে মেঝের উপরে যে চাপ-বাঁধা রক্ত দেখা যাচ্ছিল, সেই রক্তের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন তিনি। পকেট থেকে একটা ম্যাচবক্স বার করলেন। তার থেকে একটা কাঠি বার করে নিয়ে চাপ-বাঁধা রক্তের একপাশে সেটাকে চেপে ধরলেন একটু। কী যেন ভাবলেন। তারপর দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, “আমার ধারণা, খুব বেশিক্ষণ আগের ব্যাপার এটা নয়।” 

সামন্ত বললেন, “অ্যাবসলিউটলি কারেক্ট। এবারে ওই লাঠিটা দেখুন।” 

প্রথম যখন এই বাড়িতে এসে ঢুকি, লাঠিটা আমি তখনই দেখেছিলুম। সদানন্দবাবুর লাঠি। যেমন সদানন্দবাবুর টর্চ, তেমনি তাঁর লাঠিটাও সিঁড়ির নীচে পড়ে আছে। দুটো বস্তুতেই অল্পবিস্তর রক্ত লেগে রয়েছে দেখলুম। 

সামন্ত বললেন, “দেখেছেন?” 

চাকলাদার বললেন, “লাঠির আর কী দেখব?” 

“আরে মশাই, আমি কি আর লাঠি দেখতে বলছি? আসলে দেখতে বলছি ওর মাথায় বসানো লোহার বলটাকে।” 

আমি বললুম, “মনে হচ্ছে, আপনি কিছু বলতে চান।” 

সামন্তমশাই হাসলেন। বললেন, “চাই-ই তো। ব্রহ্মাস্ত্রটি কার?” 

“লাঠিটার কথা বলছেন তো? ওটা আমার।” 

গলা শুনেই চমকে গিয়েছিলুম। তাকিয়ে দেখলুম দেড়তলা-বরাবর একটা বাঁক নিয়ে সিঁড়িটা যেখানে দোতলায় উঠে গিয়েছে, সদানন্দবাবু সেই ল্যান্ডিংয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। 

৯ 

চাকলাদার বললেন, “এ কী, আপনি বিছানা থেকে উঠে এলেন কেন? প্রেশার বেড়েছে, মাথা ঘুরে গিয়েছিল, এখন আপনার কমপ্লিট রেস্ট দরকার। না না, এইভাবে উঠে আসা আপনার মোটেই উচিত হয়নি।” 

সদানন্দবাবু ম্লান হাসলেন। বললেন, “এখন অনেকটা সুস্থ বোধ করছি। মাথাও আর ঘুরছে না।” সামন্ত বললেন, “আপনিই সদানন্দ বসু?” 

“হ্যাঁ।” 

“এই বাড়ির মালিক?” 

“হ্যাঁ।” 

“নীচে এসে একটু বসতে পারবেন?” 

“তা কেন পারব না? ভালই তো আছি।” 

“বেশ, তা হলে একটু নীচে এসে বসুন। আপনাকে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করব।” 

রেলিং ধরে সিঁড়ির ধাপগুলি সাবধানে ভেঙে সদানন্দবাবু নীচে নেমে এলেন। আমি তাঁকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিলুম। 

কৌশিক পটাপট ছবি তুলে যাচ্ছিল। হঠাৎ সে সদানন্দবাবুর সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, “মিঃ সামন্ত আপনাকে যে-প্রশ্নই করুন, আপনি কিন্তু তার উত্তর দিতে বাধ্য নন। দরকার বোধ করলে একজন ল-ইয়ারও রাখতে পারেন। উত্তর যা দেবার, আপনার হয়ে তিনিই দেবেন।”

সামন্ত হেসে বললেন, “ওরেব্বাবা, এ তো দেখছি নরাণাং মাতুলক্রমঃ। ঠিক আছে ঠিক আছে, সদানন্দবাবুকে আমি যে-সব প্রশ্ন করব, ইচ্ছে হয় তো উনি তার উত্তর দেবেন, না হয় তো দেবেন না।” 

সদানন্দবাবু বললেন, “ইচ্ছে-অনিচ্ছের কথা উঠছে কেন? তবে হ্যাঁ, উত্তরটা জানা থাকলে তবেই দেব, তা নইলে আর দেব কী করে?” 

সামন্ত বললেন, “ফেয়ার এনাফ। এখন অবশ্য সামান্য দু-একটা প্রশ্নই করব, দরকার বুঝলে অন্য-সব প্রশ্ন পরে করা যাবে। তা হলে শুরু করি?” 

“করুন।” 

“আমার প্রথম প্রশ্ন, ডেডবডি তো আপনিই প্রথম দেখেছিলেন, তা-ই না?” 

প্রশ্নের মধ্যে যে ফাঁদটা ছিল, ভেবেছিলুম, সদানন্দবাবু নির্ঘাত তার মধ্যে পা বাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু না, সন্তর্পণে তিনি সেটা এড়িয়ে গেলেন। বললেন, “তা কী করে বলব? আমি কখন কী অবস্থায় ডেডবডিটা দেখেছিলুম, শুধু সেটাই আপনাকে বলতে পারি।” 

সামন্ত বললেন, “বেশ, তা-ই বলুন।” 

অতঃপর সদানন্দবাবু যা বললেন, তা আগেই বলেছি। এই একটা ব্যাপার লক্ষ করলুম যে, ভদ্রলোক খানিক আগে আমাকে যা বলেছিলেন আর এখন গঙ্গাধর সামন্তকে যা বললেন, তা একেবারে হুবহু এক রকমের, কোথাও কোনও অসঙ্গতি নেই। 

সামন্ত তাঁর দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন লাঠিটা নিয়ে। আমাদের সঙ্গে কথা বলবার সময়ে তাঁর চোখ যে বারবার লাঠিটার দিকেই ঘুরে যাচ্ছিল আগেই সেটা দেখেছিলুম। মৃতদেহের পাশে শুধু রক্ত নয়, বেশ-খানিকটা জায়গা জুড়ে জলও ছড়িয়ে আছে। ঠিক জলও নয়, ধুলোর উপরে জল পড়লে যেমন হয়, তেমনি; কাদা-কাদা। সেই কাদা-জলও অবশ্য প্রায় শুকিয়ে গেছে। তবু পাছে পা হড়কে যায়, তাই সামন্ত খুব সাবধানে সেই কাদার উপর দিয়ে দু-পা এগিয়ে লাঠিটার কাছে উবু হয়ে বসলেন, তারপর বিষ্টুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “খানিকটা ন্যাকড়া দিতে পারেন?” 

ঘর থেকে বিষ্টু খানিকটা ন্যাকড়া এনে দিল। সেই ন্যাকড়ার ফালি নিয়ে যেখানটায় রক্ত নেই, খুব সন্তর্পণে সেইখানে ধরে লাঠিটাকে মেঝের উপর থেকে তুলে এনে মিনিট খানেক সেটাকে নিরীক্ষণ করে নিয়ে যখন সামন্ত আবার সদানন্দবাবুর দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, তখন দেখলুম যে, তাঁর ঠোঁটের উপরে খেলা করছে একটা রহস্যময় হাসি, আর চোখ দুটিও ঈষৎ কুঁচকে গেছে। 

বললেন, “এটা তা হলে আপনারই?” 

প্রশ্নটা যে-ভাবে করলেন, তাতেই সম্ভবত সদানন্দবাবুর গলায় কিঞ্চিৎ শ্লেষ্মা জমে গিয়েছিল। ঘড়ঘড়ে গলায় তিনি বললেন, “লাঠিটার কথা বলছেন তো? আজ্ঞে হ্যাঁ, ওটা আমারই। সে তো একটু আগেই বললুম।” 

“এর মাথায় লোহার বল বসানো কেন?” 

“না বসিয়ে উপায় ছিল না, তাই বসিয়েছি। আসলে ভোরবেলায় রোজই আমি এক চক্কর মর্নিং ওয়াক করতে বেরোই তো, তখন কুকুরগুলো বড্ড উৎপাত করে। গত বছর একদিন যখন শ্রদ্ধানন্দ পার্কে মর্নিং ওয়াক সেরে বাড়ি ফিরছি, তখন ওই পার্কের উত্তর-পশ্চিম দিকের ফুটপাথে যে ময়লা ফেলার ভ্যাটটা রয়েছে না, একটা নেড়িকুত্তা হঠাৎ সেই ভ্যাটের পাশ থেকে ছুটে এসে আমাকে কামড়েও দিয়েছিল।” 

সদানন্দবাবু তাঁর ধুতিটা একটু সরিয়ে ডান পায়ের একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, “এই দেখুন, সেই কামড়ের দাগ এখনও মিলিয়ে যায়নি। তা সেইজন্যে আমাকে গুচ্ছের ইঞ্জেকশান নিতে হয়েছিল স্যার। এই তো ডাক্তার চাকলাদারও তো রয়েছেন এখানে। ওঁকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, উনিও সব জানেন। যা-ই হোক সে-যাত্রা রক্ষে পেয়ে গেলুম, কিন্তু নেড়িকুত্তার ভয়ে তো আর মর্নিং ওয়াক বন্ধ করতে পারি না, তাই লাঠির মাথার ওই লোহার বলটা বসিয়ে নিয়েছি।” 

ডঃ চাকলাদারের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন সামন্ত। চাকলাদার বললেন, “সত্যি ওকে জলাতঙ্কের ইঞ্জেকশান নিতে হয়েছিল।” 

সামন্ত আবার সদানন্দবাবুর দিকে তাকালেন। “লাঠিতে লোহার বল বসিয়ে নেবার পরে আর কুকুরগুলো আপনাকে তাড়া করে না, কেমন?” 

“আজ্ঞে তার পরেও তাড়া করত। কিন্তু ওইটে দিয়ে একদিন একটা নেড়িকুত্তাকে আমি মোক্ষম এক-ঘা বসিয়ে দিই। ব্যাস তারপর থেকে আর তেড়ে আসে না। ওই যা দূর থেকেই খেউ-খেউ করে, কিন্তু লাঠি উঁচিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেই ছুটে পালায়।”

লাঠিটা পড়ে ছিল রক্তের ধারে, আর তার পাশেই পড়ে ছিল টর্চটা। কিন্তু সেটা যেহেতু নেহাতই এক-ব্যাটারির পকেট-টর্চ এবং অতটুকু একটা জিনিসকে যেহেতু গঙ্গাধর সামন্তের পক্ষেও ব্রহ্মাস্ত্র কি পাশুপত অস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করা সম্ভব নয়, তাই আর তিনি টর্চটা নিয়ে কিছু বললেন না। 

বাইরে একটা গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। সদর দরজার দিকে এগোতে এগোতে সামন্ত বললেন, “রওনা হবার আগে যেমন আমাদের ডাক্তার গুপ্ত তেমনি ডি.সি. কেও একটা ফোন করে সব জানিয়ে এসেছিলুম। বোধহয় তাঁরাই এলেন।” 

গাড়ি থেকে যাঁকে নাগতে দেখলুম, হাতের স্টেথিসকোপ দেখেই বোঝা গেল যে, তিনি ডাক্তার গুপ্ত। ডি.সি. আসেননি। সামান্য একটা মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁর আসবার কথাও নয়। শুনলুম, কোথায় কোন পোলিটিক্যাল পার্টির অফিসে নাকি বোমা পড়েছে, তিনি সেখানে গিয়েছেন। 

ডাক্তার সুরেশ গুপ্ত বাড়িতে ঢুকেই কাজে লেগে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে নানান দিক থেকে মৃতদেহটি নিরীক্ষণ করলেন তিনি, গায়ে হাত রেখে উত্তাপটা দেখে নিলেন, তারপর বেসিনে ভাল করে হাত ধুয়ে, পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে হাত মুছতে মুছতে সামন্তের দিকে তাকিয়ে বললেন, “অ্যাকসিডেন্ট নয়, এটা মার্ডার।”

সামন্ত বললেন, “কী করে বুঝলেন?” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “কেন, আপনার তা মনে হয় না?” 

“সে কথা হচ্ছে না। সত্যি বলতে কী, আম’র ধারণাও একই। কিন্তু আপনি সে।” কী করে বুঝলেন, সেটাই জানতে চাইছি।” 

ডাক্তার গুপ্ত ধীরে-সুস্থে একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর বললেন “সিম্পল ব্যাপার, বুঝবার জন্যে খুব বেশি মাথা খাটাবার দরকার নেই। কেউ যদি পা হড়কে কি দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে চিত হয়ে মেঝের উপরে দড়াম করে পড়ে গিয়ে মারা যায়, তা হলে তার খুলির পিছনের দিকটা ফাটবার কথা, আর যদি উপুড় হয়ে পড়ে তো সামনের দিকটা ফাটবে। তার কোনওটাই কিন্তু এ-ক্ষেত্রে ঘটেনি। এ লোকটির মথার খুলির না-ফেটেছে পিছনের দিকটা, না ফেটেছে সামনের দিক। ফেটেছে এর খুলির একেবারে উপরের দিকটা। অর্থাৎ সাধুভাষায় যাকে আমরা ব্রহ্মতালু বলি আর সাদা বাংলায় বলি চাঁদি, সেই জায়গাটা। মাথার উপরে ফ্যান কি ঝাড়লণ্ঠন ভেঙে পড়লে খুলির এই জায়গাটা এভাবে ফাটতে পারে।” 

কৌশিক এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনে যাচ্ছিল। ডাক্তার গুপ্ত একটু থামতেই সে বলল, “কিন্তু এখানে ওঁর মাথায় উপরে ফ্যানও ছিল না, ঝাড়লণ্ঠনও ছিল না। চাঁদিটা তা হলে ফাটল কী করে?” 

হঠাৎ একজন অপরিচিত লোক তাঁর কথার মধ্যে ঢুকে পড়ায় স্পষ্টতই একটু বিরক্ত হলেন ডাক্তার গুপ্ত। সামন্তকে জিজ্ঞেস করলেন, “এঁকে তো চিনতে পারলুম না, আপনাদের নতুন রিক্রুট?” 

সামন্ত বললেন, “ওঃহো, পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি। ইনি মিঃ কৌশিক সান্যাল। প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার চারুচন্দ্র ভাদুড়িকে মনে আছে?” 

“চারু ভাদুড়ি….মানে ওই যাঁকে আমরা সিসিবি বলতুম? তিনি তো এ-লাইনে একটা লিজেন্ড মশাই। শুনেছি এখন ব্যাঙ্গোলোরে থাকেন।”

“হ্যাঁ, তাঁরই কথা বলছি। ব্যাঙ্গোলোরেই থাকেন বটে, তবে দিন কয়েকের জন্যে নাকি কলকাতায় এসেছেন। তা মিঃ সান্যাল তাঁরই ভাগ্নে। মামার লাইন ধরেছেন আর কি।” 

ডাক্তার গুপ্ত কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বটে? সিসিবি তোমার মানা? ‘তুমি’ বলছি বলে আবার কিছু মনে কোরো না যেন।” 

কৌশিক বলল, “মনে করব কেন? আপনি আমার চেয়ে অনেক বড়! ‘তুমিই তো বলবেন।”

“মামার লাইনে এসেছ…..মানে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশান? বাঃ বাঃ, চমৎকার। লাইক মামা লাইক ভাগ্নে। এক্সেলেন্ট। তা মামাবাবুকে বোলো, উই অল্ রিমেমবার হিম সো ফন্ডলি।” 

কৌশিক বলল, “নিশ্চয় বলব। মামাবাবু প্রায়ই তাঁর কলকাতার বন্ধুবান্ধব দের গল্প করেন।”

সামন্ত বললেন, “মিঃ সান্যালের প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনও আপনি দেননি গুপ্ত সাহেব।”

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “ও হ্যাঁ, প্রশ্নটা কী ছিল যেন? ফ্যানও নেই, ঝাড়-লই ও নেই, চাঁদিটা তা হলে ফাটল কী করে? তাই না?” 

কৌশিক বলল, “হ্যাঁ, কী করে ফাটল?” 

ডাক্তার গুপ্ত একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “আমার সন্দেহ, একটু উঁচু জায়গা থেকে, এই ধরো ঐ সিঁড়িটার দু-তিন ধাপ উপরে দাঁড়িয়ে আচমকা কেউ ভারী কিছু দিয়ে ওর মাথার ওই জায়গাটায় একটা আঘাত করেছিল। খুব জোরেই যে সেটা করেছিল, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। তা নইলে নিশ্চয় খুলিটা এভাবে ফেটে যেত না।”

গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “পাড়ার এই ডাক্তারবাবুটি ইট কি পাথর আর নয়তো মশলা-বাটা নোড়ার কথা বলছিলেন।” 

“না, না,” ডাক্তার চাকলাদার ব্যস্ত হয়ে বললেন, “নিশ্চিত হয়ে আমি কিছু বলিনি। একটা সম্ভাবনার কথাই বলেছিলুম মাত্র।” 

কৌশিক তার কাজ বন্ধ করেনি। যে-সব কথা হচ্ছিল, তা শুনতে-শুনতেই তার মিনলটা ক্যামেরা দিয়ে ডেডবডির আরও কয়েকটা ছবি তুলে নিল সে। মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকা কিছু ধুলোবালি আর কাঠের গুঁড়োর মতো কিছু জঞ্জাল কুড়িয়ে নিয়ে ছোট-ছোট দুটো প্ল্যাস্টিকের ব্যাগের মধ্যে রাখল। তারপর একটা ব্যাগ সামন্তের হাতে তুলে দিয়ে বলল, “একটা ব্যাগ আপনি রাখুন, অন্যটা আমি নিয়ে যাচ্ছি, মামাবাবুকে একবার দেখাব। আপনার আপত্তি নেই তো?” 

গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “কাজটা ইরেগুলার, তবে কিনা সিসিবিকে দেখাবেন তো, তাই আপত্তি করার কোনও অর্থ হয় না। কিন্তু যত তাড়াতাড়ি পারেন ফেরত দেবেন মশাই, নইলে আমি মুশকিলে পড়ব।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “লোকে কী ভাবে জানো তো? ভাবে যে, পুলিশ ডিপার্টমেন্টের লোকেরা প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটারদের দু’চক্ষে দেখতে পারে না। তাদের দোষ দেব কী করে, গোয়েন্দা-ক হিনিগুলোতে যা লেখা হয়,তাতে ওইরকমই মনে হয় যে। আরে বাবা, ক্রাইমের কিনারা ক্রাটাই তো কাজ, তা বাইরের কেউ যদি সে-কাজে সাহায্য করেন তো তাতে আমাদের আপত্তি হবে কেন? ইন ফ্যাক্‌ট উই অলওয়েজ লুক ফরোয়ার্ড টু গেটিং সাম্ হেল্প ফ্রম পিপল লাইক সিসিবি।” 

কৌশিক বলল, “আপনারা ভাবছেন এটা খুন, তা-ই না?” 

ডাক্তারবাবু বললেন, “সে তো বললুমই। শুধু খুন বললে অবশ্য কমই বলা হয়। ইট্স এ গ্রুসাম মার্ডার।” 

“ছবি তুলতে তুলতে আপনাদের কথা শুনছিলুম। কী দিয়ে খুন করা হয়েছে, তাও ভাবছেন নিশ্চয়?” 

গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “ডাক্তার চাকলাদার ইট, পাথর আর মশলাবাটা নোড়ার কথা বলছিলেন।” 

চাকলাদার আবার বললেন, “না না, আমি নিশ্চিত হয়ে কিছু বলিনি।” 

কৌশিক বলল, “যদি খুনই হয়, অস্ত্রটা তা হলে ইট-পাথর কি একটা নোড়া অবশ্য হতেই পারে। তবে এক-সেরি কি দু’সেরি একটা বাটখারা হওয়াও কিছু বিচিত্র নয়।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “নয়ই তো। আবার শেষপর্যন্ত যদি প্রমাণ হয় যে, বড়সড় একটা রেঞ্চ কিংবা হাতুড়ি দিয়ে মাথা ফাটানো হয়েছে, তো তাতেও আমি অবাক হব না।…. কিন্তু ব্যাপার কী বলুন তো, এখানে আসা অবধি একটা দুর্গন্ধ পাচ্ছি। হঠাৎ যেন সেটা আরও বেড়ে গেল। ব্যাপার কী?” 

তাকিয়ে দেখলুম, যে ঘরে মাছ রাখা হয়, হাওয়ায় তার দরজাটা খুলে গিয়েছে। গঙ্গাধর সামন্ত ও সেটা লক্ষ করেছিলেন। বললেন, “বন্ধ করুন, বন্ধ করুন, দরজাটা এখুনি বন্ধ করে দিন।” 

বিষ্টুচরণ গিয়ে দরজাটা ফের বন্ধ করে দিল। এবারে হুড়কোটাও টেনে দিল সে, বাতাসে যাতে না দরজাটা আবার খুলে যায়। 

সামন্ত বললেন, “মাছের গন্ধ। পচা মাছ। এইসব মাছ খেয়েই তো ক্যালকাটার মানুষদের স্বাস্থ্যের একেবারে বারোটা বেজে যাচ্ছে।”