শ্যামনিবাস-রহস্য – ২০

২০

বাসন্তীকে নিয়ে একটু ভয় ছিল। সামনেই পারুলের পরীক্ষা, এই সময়ে বাড়িতে একগাদা লোক আসছে, তাদের জন্যে খাবার তৈরি করতে হবে, হইচইও হয়তো নেহাত কম হবে না, তাই ভাবছিলুম যে, বাসন্তী না খেপে যায়। 

অথচ সে-ই দেখলুম দারুণ খুশি। গ্যাস নিয়ে অবশ্য ভাবনা নেই, কাল বিকেলেই নতুন সিলিন্ডার দিয়ে গিয়েছে, তবু ভাদুড়িমশাই যে আজ আমাদের বাড়িতেই বৈঠক ডেকেছেন, কাল রাত্তিরে বাড়িতে ফিরে বাসন্তীকে এই খবরটা দিয়ে একটু কিন্তু-কিন্তু করে বলেছিলুম, “রাজি না হলেই ভাল কত, তাই না?” 

বাসন্তী তা-ই শুনে অবাক। গালে হাত দিয়ে বলল, “সে কী! চারুদা আসছেন, কৌশিক আসছে, এ তো দারুণ ব্যাপার! কদ্দিন যে চারুদাকে দেখিনি! কৌশিক অবশ্য মাঝেমধ্যে আসে। কিন্তু চারুদা এবারে অনেক দিন বাদে কলকাতায় এলেন! তুমি কিন্তু মালতী আর অরুণবাবুকেও আসতে বলতে পারতে!” 

বললুম “বলো কী, পারুল এখন রাতদিন তার বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে, লোক আরও বেড়ে গেলে ওর অসুবিধে হত না?” 

বাসন্তী বলল, “অসুবিধে হবে কেন, বরং সুবিধেই হত। মেয়েটা সারারাত পড়ে। কিন্তু অত পড়া ভাল নয়, বুঝলে? একটু গল্প-টল্পও করা দরকার।” 

এবারে আমার অবাক হবার পালা। 

ছটায় সকলের আসবার কথা। কৌশিককে নিয়ে ভাদুড়িমশাই কিন্তু পাঁচটার মধ্যেই এসে গেলেন। এসেই হাঁক পাড়লেন, “কই বাসন্তী, আমার প্রিয় পানীয়টি তৈরি আছে তো?” 

ভাদুড়িমশাইয়ের যা প্রিয় পানীয়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় তা হল ‘বিল্ববাসিত তক্র’। অর্থাৎ কিনা বেলের সুবাসযুক্ত ঘোল। তা বাসন্তী সেই পানীয়ের পুরো দুটি গ্লাস ফ্রিজের মধ্যে ঢুকিয়েশরেখেছিল। উপর্যুপরি সেই গ্লাস দুটিকে নিঃশেষ করে ভাদুড়িমশাই আমাকে বললেন, “চলুন, চটপট এবারে ঘটনাস্থলটা একবার দেখে আসি।” 

বাসন্তী বলল, “বা রে, আপনি তো আপনার প্রিয় পানীয় পেয়েছেন, এবারে কৌশিককে তার প্রিয় পানীয় তৈরি করে দিতে হবে না?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কৌশিকের তো এখন আমার সঙ্গে যাবার কোনও দরকার নেই। ও চা খাক, পারুলের সঙ্গে গল্প করুক, কিরণবাবু আমার সঙ্গে থাকলেই হবে। দেরি হবে না, মিনিট পাঁচ-দশের মধ্যে আমরা ফিরে আসছি।” 

ভাদুড়িমশাই আর আমি গিয়ে পাঁচ-নম্বর বাড়িতে ঢুকলুম। সিঁড়ির তলাটা আজ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, কোথাও ধুলো-ময়লা নেই। মাছের সেই গন্ধও নেই কোনওখানে। ভাদুড়িমশাই মিনিট কয়েক চুপচাপ সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “চলুন, এবারে ফেরা যাক।” 

বললুম, “সদানন্দবাবু আর তাঁর স্ত্রী উপরে রয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে একবার কথা বলবেন না?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দরকার কী।” তারপর সদর-দরজা পর্যন্ত গিয়ে হঠাৎ আবার বললেন, “চলুন, ভদ্রলোককে একবার দেখেই যাই।” 

উপরে গিয়ে দেখলুম, সদানন্দবাবু তাঁর শোবার ঘরে চুপচাপ একটা ইজিচেয়ারে বসে আছেন। বললুম, “কেমন আছেন সদানন্দবাবু?” 

সদানন্দবাবু কোনও উত্তর দিলেন না। আমার সঙ্গে যে আরও একজন রয়েছে, এটা দেখেও ইজিচেয়ার থেকে তিনি উঠে দাঁড়ালেন না পর্যন্ত। যেমন বসে ছিলেন, তেমনি বসেই রইলেন। 

বললুম, “ইনি মিস্টার চারু ভাদুড়ি। বিখ্যাত গোয়েন্দা, ব্যাঙ্গালোরে থাকেন। দিন কয়েকের জন্যে কলকাতায় এসেছেন। আমার একজন বিশিষ্ট বন্ধু।” 

সদানন্দবাবু ফ্যালফ্যাল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন, একটি কথাও বললেন না। 

নীচে নামতে বিষ্টুচরণের সঙ্গে দেখা। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে বলল, “কী বিপদ, বলুন তো। কাল রাত্তির থেকে আমাকে বাইরে বেরুতে দিচ্ছে না। আজ সকালে বাজার করতে বেরুচ্ছিলুম, তা যে লোকটা পাহারায় রয়েছে, সে আমাকে আটকে দিল। বলল, ‘বাহার জানেকা হুকুম হ্যায় নহি।’ কমলির বেবিফুড ফুরিয়েছে, তাও বাইরে যেতে দিচ্ছে না। মেয়েটা কি না-খেয়ে মরবে নাকি?” 

বললুম, “বাইরে যাবার দরকার কী। সদানন্দবাবুর স্ত্রী যে কমলির জন্যে দুটিন দুধ আনিয়ে রেখেছেন, তা তো আপনিও সেদিন শুনলেন। উপরে গিয়ে তার একটা নিয়ে এলেই তো হয়।” 

বিষ্টুচরণ বলল, “তা তো হয়ই। কিন্তু আমার বোন যে আমাকে উপরে যেতে দিচ্ছে না।”

বললুম, “তাই তো, বড় মুশকিল হল দেখছি। তা এক কাজ করুন, কমলিকেই বরং উপরে পাঠিয়ে দিন।” 

ভাদুড়িমশাইকে নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে ঢুকলুম। এ-বাড়ির সদর দরজা সব সময় খোলাই থাকে। দোতলায় উঠবার আগে একবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিলুম; তখন চোখে পড়ল, বিষ্টুচরণ আবার তাদের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু থানা থেকে যে পাহারাদারটিকে সেখানে মোতায়েন রাখা হয়েছে, বিষ্টুকে সে বাড়ি থেকে বেরুতে দিচ্ছে না। 

উপরে উঠে আমাদের বৈঠকখানা ঘরে এসে ঢুকলুম আমরা। বাসন্তী একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল; বুঝলুম যে, তার রান্নাবান্নার পাট শেষ হয়েছে। আমাদের দেখে ম্যাগাজিনটা নামিয়ে রেখে সে উঠে দাঁড়াল। ভাদুড়িমশাই বললেন, “আরে বোসো, বোসো। … কৌশিক কোথায়?” 

বাসন্তী বলল, “পারুলের ঘরে বসে গল্প করছে। ডেকে দেব?” 

পাশের ঘর থেকে টুকরো-টুকরো কথা আর হাসির শব্দ ভেসে আসছিল। ভাদুড়িমশাই মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, “থাক্, ডেকে দেবার দরকার নেই। বাকি সবাই আসুন, তখন ডেকে দিলেই হবে।” 

বাসন্তী বলল, “তা হলে বরং একটু চা করি আপনার জন্যে?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তারও এখন দরকার নেই। প্রায় ছ’টাই তো বাজে। ওরা এখুনি এসে পড়বেন। তখন চা দিলেই চলবে।” 

মিনিট দশেকের মধ্যে ডাক্তার চাকলাদার এসে পৌঁছলেন। তার একটু বাদেই গঙ্গাধর সামন্ত আর ডাক্তার গুপ্ত। কৌশিককেও ডেকে পাঠানো হল। 

এক প্রস্ত চা হয়ে যাবার পরে সামন্ত বললেন, “এবারে তা হলে কাজের কথা শুরু হোক।”

ভাদুড়িমশাই বলেন, “আজ শুক্রবার। মার্চের আজ শেষ দিন, ৩১ তারিখ। নকুলচন্দ্র খুন হয়েছে গত শুক্রবার। গত শুক্রবার ছিল ২৪ মার্চ। কখন খুন হয়েছে? না রাত তিনটে নাগাদ। লাশ পরীক্ষা করে অন্তত সেই কথাই বলা হয়েছে, ইংরেজি মতে রাত বারোটার পরেই নতুন তারিখ শুধু হয়ে যায়। নকুল তা হলে ২৫ মার্চ খুন হয়। তার দু’ঘন্টা বাদে সদানন্দবাবু দেখতে পান যে, তার ডেডবডিটা সিঁড়ির তলায় লুটিয়ে পড়ে আছে। অবশ্য সদানন্দবাবু যা বলছেন, তাতে মনে হয়, ও যে জ্যান্ত নকুল নয়, তার ডেডবডি, তা তিনি তখনও জানতেন না।” 

গত রাত্রে যে-সব কথা হয়েছিল, আর সেইসঙ্গে প্রকাশ পেয়েছিল যে-সব নতুন তথ্য, তাতে গঙ্গাধর সামন্তর চিন্তাভাবনার পেন্ডুলামটি দেখলুম একেবারে বিপরীত বিন্দুতে গিয়ে পৌঁছেছে। তিনি বললেন, “এতে আর মনে হওয়া-টওয়ার কী আছে, সদানন্দবাবু নিশ্চয় মিথ্যে কথা বলেননি।” 

কৌশিকের এও একটা মস্ত দোষ যে, সে হাসি চাপতে পারে না। 

সামন্ত তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “হাসছেন যে?” 

কৌশিক বলল, “হাসব না? দু’দিন আগেই যাঁকে আপনি চড়-থাপ্পড় মারবার ব্যবস্থা করেছিলেন, এখন তো দেখছি তাঁর সম্পর্কে আপনার ধারণা একেবারে উল্টে গেছে।” 

সামন্ত বললেন, “সে তো আমি ভুল করেছিলুম। তা ভুলটা ঠিক-সময়ে শুধরেও নিয়েছি, তা-ই বা ক’জনে করে? এখন তো বুঝতেই পারছি যে, এটা একটা ফ্রেম-আপ, নির্দোষ একটা মানুষের ঘাড়ে দোষ চাপাবার চক্রান্ত।” 

কৌশিক আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল, ভাদুড়িমশাই কাল রাত্তিরের মতোই আবার তাকে মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, “কী হচ্ছে কৌশিক! যা বলছি, একটু মন দিয়ে শোনো। মিস্টার সামন্ত কাল বলছিলেন যে, চোদ্দো-আনা কাজই মিটে গেছে, বাকি মাত্র দু-আনা। কিন্তু সেই দু-আনার গুরুত্ব মোটেই কম নয়, হয়তো সবচেয়ে বেশি। কাজটা কী? না মার্ডার-ওয়েপনটা খুঁজে বার করতে হবে। যতক্ষণ না তার হদিশ করা যাচ্ছে, খুনির বিরুদ্ধে একটা ওয়াটারটাইট কেসও ততক্ষণ দাঁড় করানো যাচ্ছে না। যা দিয়ে ওভাবে মাথা ফাটানো যেতে পারে, এমন জিনিস অবশ্য ও-বাড়ি থেকে বিস্তর আটক করা হয়েছে, কিন্তু ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় তার একটাও যে ওতরায়নি, সেটা ভুলে যাচ্ছ কেন?” 

কৌশিক চুপ করে রইল। চাকলাদার বললেন, “মিস্টার সামন্ত কাল বলছিলেন যে, মার্ডার-ওয়েপনের একটা হদিশ শিগগিরই করে ফেলতে পারবেন।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “করে ফেলতে পারলে নিশ্চয় বলতেন আমাদের। মনে হচ্ছে, এখনও হদিশ করতে পারেননি। কিন্তু সে-কথা থাক। সে-দিন সকালে পাঁচ নম্বর বাড়িতে যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র ডাক্তার চাকলাদার ছাড়া বাকি চারজনকে—মানে কিরণবাবু, মিস্টার সামন্ত, ডাক্তার গুপ্ত আর কৌশিককে আমি চারটে রিপোর্ট লিখে ফেলতে বলেছিলুম, এও বলে দিয়েছিলুম যে, ওখানে সেদিন যা-কিছু তাঁরা দেখেছেন কি শুনেছেন, রিপোর্টে সব ডিটেলসে লিখতে হবে। কে কোথায় দাঁড়িয়ে ছিল, কিংবা বসে ছিল, কিংবা কার কথায় কার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তাও বাদ দেওয়া চলবে না। অর্থাৎ আমি চেয়েছিলুম যে, গোটা ব্যাপারটার একটা সর্বাঙ্গীণ বর্ণনা আপনারা আমাকে দিন। সে-দিন সকালে ঘটনাস্থলে উপস্থিত না-থাকা সত্ত্বেও যাতে সবটা আমি ভিশুয়ালাইজ করতে পারি।” 

কৌশিক বলল, “আমি কিছু বাদ দিইনি মামাবাবু। যা-কিছু আমার চোখে পড়েছে সবই আমার রিপোর্টের মধ্যে আছে।” 

সামন্ত বললেন, “আমিও তো সবই জানিয়েছি আমার রিপোর্টে। কিছু বাদ পড়েছে বলে তো মনে হয় না।” 

ভাদুড়িমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার সম্পর্কে আমার কোনও ভাবনা নেই। আপনার তো ওই যাকে বলে ফোটোগ্রাফিক মেমারি। যা-কিছু দেখেন শোনেন, সব একেবারে মাথার মধ্যে গেঁথে থাকে।”

বললুম, “থ্যাঙ্ক ইউ। আশা করি সবই আমার রিপোর্টের মধ্যে আছে, কোনও কিছু বাদ পড়েনি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তিনটি রিপোর্টই আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি। একটা কথা বলতেই হবে, কারও কথার সঙ্গেই অন্য-কারও কথার বিশেষ পার্থক্য বিরোধ কিংবা অসঙ্গতি কোথাও নেই। সেটা খুবই ভাল কথা। অমন কোনও বিরোধ কি অসঙ্গতি থাকলে আমাকে ধাঁধায় পড়ে যেতে হত। ক্রমাগত ভাবতে হত কার কথাটা ভুল, এঁর না ওঁর। না, তেমন কোনও ধাঁধায় আমাকে পড়তে হয়নি। কিন্তু রিপোর্টগুলি পড়ে আমি যে খুব সন্তুষ্ট হতে পেরেছি, তাও নয়। কেন জানি না, কেবলই আমার মনে হচ্ছে, যা আপনারা লিখেছেন, তার মধ্যে কোথাও কিছু-একটা ফাঁক রয়েছে, কিছু একটা ব্যাপার বাদ পড়েছে। এমন কোনও ব্যাপার, যাকে তিনজনের একজনও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বা উল্লেখযোগ্য মনে করেননি। কোনও তুচ্ছ বা মাইনর ব্যাপার। মানে এমন কোনও ব্যাপার, এই ঘটনার সঙ্গে সরাসরি যাকে একটা কার্যকারণের সূত্রে গাঁথা যায় বলে কেউ কল্পনাই করতে পারে না। একটু ভেবে দেখুন তো এমন-কিছু কি সেখানে আপনারা দেখেছিলেন কিংবা শুনেছিলেন?” 

“না, মামাবাবু।” কৌশিক বলল, “কিছুই আমি বাদ দিইনি। সবকিছুই তুমি জানাতে বলেছিলে, তাই সবকিছুই আমার রিপোর্টে আমি জানিয়েছি। এমন কী, জায়গার একটা নকশা এঁকে সেটাও গেঁথে দিয়েছি আমার রিপোর্টের সঙ্গে।” 

“তা দিয়েছিস ঠিকই,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিরণবাবু আর মিস্টার সামন্তও খুঁটিনাটি কথা কিছু কম জানাননি। বাট্ আই জাস্ট কান্ট গেট রিড অভ্ দিস ফিলিং দ্যাট নান্ অভ্ ইউ টাচ্‌ড অল দি পয়েন্টস, ইউ মিস্ড সামথিং সামহোয়্যার অ্যালং দি ওয়ে। এমন-কিছু, যা এই কেসটার পক্ষে খুবই ভাইটাল।” 

চুপ করে রইলুম। বারবার ভাবতে লাগলুম, কী বাদ দিয়েছি। কিন্তু অনেক ভেবেও কোনও কূলকিনারা করতে পারলুম না। 

ভাদুড়িমশাই একটা সিগারেট ধরালেন, ধোঁয়া ছাড়লেন কিছুক্ষণ। তারপর অনুযোগের সুরে বললেন, “ডাক্তার গুপ্ত, আপনাকেও আমি কিন্তু একটা রিপোর্ট লিখে দিতে বলেছিলুম। আপনি সেটা আজও দিলেন না।”

ডাক্তার গুপ্ত লজ্জিত গলায় বললেন, “লিখলে তো দেব। লেখাই হয়ে ওঠেনি।” 

“সময় করে উঠতে পারেননি, নিশ্চয়? আপনি যা ব্যস্ত মানুষ!” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “না না, সময়ের ব্যাপার নয়, কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসেছিলুম ঠিকই। কিন্তু কী লিখব, সেটাই ঠিক বুঝতে পারছি না। এক ওই লাশ ছাড়া আর কোনও-কিছুই তো তেমন নজর করে দেখিনি। আর দেখবেই বা কী করে? মন দিয়ে কিছু দেখবার কি শুনবার উপায়ই তো ছিল না।” 

“কেন, উপায় না-থাকার কী হল? রিপোর্ট পড়ে তো মনে হয় অন্যেরা অনেক-কিছুই দেখেছেন। শুনেছেনও অনেক-কিছু।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “তা হলে বুঝতে হবে, হয় ওঁদের সর্দি হয়ে নাক বুজে গিয়েছিল, আর নয়তো এমনিতেই ওঁদের ঘ্রাণশক্তি তেমন প্রবল নয়।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তার মানে?” 

“আরে মশাই, সে এক উৎকট গন্ধ! কোনও-কিছু দেখব অথবা শুনব কী, গন্ধের দাপটে যেন পাগল-পাগল লাগছিল। মনে হচ্ছিল, পালাতে পারলে বাঁচি, নয়তো অন্নপ্রাশনের ভাত পর্যন্ত মুখে উঠে আসবে। ওরেব্বাপ রে বাপ, কী গন্ধ, কী গন্ধ!” 

ভাদুড়ি আমার দিকে তীব্র চোখে একবার তাকালেন। তারপর সামন্ত আর কৌশিকের দিকে। বললেন, “কই, কারও রিপোর্টেই তো গন্ধের কথা নেই। কীসের গন্ধ?” 

কৌশিক বলল, “পচা মাছের। নকুলের তো মাছের ব্যবসা, আর বাড়িতেই ছিল তার আড়ত। সেখানে মাছ পচে গিয়ে অতি উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছিল।” 

শুনে দুই হাতে নিজের মাথাটাকে আঁকড়ে ধরে গুম হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর মিনিট কয়েক বাদে যখন নিজের শরীরটাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, তখন দেখলুম, তাঁর মুখচোখের চেহারা একেবারে পালটে গিয়েছে। বললেন, “আমারই ভুল হয়েছিল। যা দেখেছেন, যা শুনেছেন, শুধু তারই কথা লিখতে বলেছিলুম আমি, আর আপনারাও শুধু তা-ই লিখেছেন। গন্ধের কথাটা আপনারা কেউই বলেননি। …ডাক্তার গুপ্ত, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনি রিপোর্ট লেখেননি বটে, কিন্তু সবচেয়ে যেটা জরুরি খবর, শেষপর্যন্ত সেটা আপনার কাছেই পাওয়া গেল। এখন দেখা যাক, আমি যা ভাবছি সেটা ঠিক কি না।” 

কৌশিকের দিকে তাকালেন ভাদুড়িমশাই। বললেন, “হ্যাঁ রে কৌশিক, নকুলের বাড়িতে তার ব্যাবসাপত্রের যে-সব হিসেব, কাগজ আর সিদ পাওয়া গেছে, সেগুলি নিয়ে এসেছিস তো?” 

কৌশিক তার অ্যাটাশে-কেস খুলে সুতো দিয়ে বাঁধা কিছু কাগজপত্র, খানকয় খাতা আর দুটো ফ্ল্যাট-ফাইল বার করে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই নাও। এগুলি কিন্তু আজ মিস্টার সামন্তকে ফেরত দিতে হবে।”

কাগজপত্র আর খাতা একপাশে সরিয়ে রেখে ফ্ল্যাট ফাইল দুটো টেনে নিলেন ভাদুড়িমশাই। প্রথম ফাইলটায় রাখা কাগজপত্রগুলি দ্রুত একবার দেখে নিলেন। তারপর সেটাকে নামিয়ে রেখে হাতে তুলে নিলেন দ্বিতীয় ফ্ল্যাট ফাইলটা। সেটাকে আর উল্টে-পাল্টে দেখবার দরকার হল না। মুখের ভাব দেখে মনে হল যে, যা খুঁজছিলেন তিনি, ফাইলের একেবারে গোড়াতেই সেটা পেয়ে গেছেন। ফাইল থেকে সেটা তিনি খুলে নিলেন। একটা ক্যাশমেমো। সেটার উপরে চোখ বুলিয়ে টেনে নিলেন জমা-খরচের খাতা। দুটোকে মিলিয়ে দেখলেন। তারপর আপন মনে বললেন; “ও, এই তা হলে ব্যাপার!” 

স্বগতোক্তিটা সামন্তও শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি বললেন, “কী ব্যাপার?” 

ভাদুড়ি তাঁর কথার কোনও জবাব দিলেন না। কৌশিককে বললেন, “হ্যাঁ রে, লাশ যেখানে পড়ে ছিল, সেখানে মেঝে থেকে যা-যা কুড়িয়ে এনেছিস, তার মধ্যে কিছু কাঠের গুঁড়োও তো দেখলুম। শুকনো নয়, ভিজে গুঁড়ো। ওগুলো ভিজল কী করে? মেঝের উপরে কি জল ছিল নাকি?” 

কৌশিক বলল, “মেঝের উপর জল পড়েছিল নিশ্চয়। আমরা যখন যাই, তখন দেখেছিলুম যে, জায়গাটা কাদা-কাদা মতন হয়ে আছে। ধুলোবালির উপরে জল পড়ে তারপর শুকিয়ে গেলে যেমন হয় আর কি।” 

ভাদুড়িমশাই সামন্তের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কৌশিক যা বলছে, সেটা সত্যি?” 

সামন্ত বললেন, “এটা উনি ঠিকই বলছেন। জায়গাটা দেখে আমারও মনে হয়েছিল যে, এ-রকম কাদা-কাদা হয়ে আছে কেন, কারও হাত থেকে জল পড়েছিল নাকি?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “জল পড়ে গিয়েছিল, তাই না? মানে সেইরকমই মনে হয়েছিল, কেমন?”

“হ্যাঁ, সেইরকম মনে হয়েছিল।”

মস্ত একটা নিশ্বাস ফেললেন ভাদুড়িমশাই। বললেন, “তা হলে জেনেই রাখুন সামন্তমশাই, যা নিয়ে আপনি খুব ভাবনায় রয়েছেন, সেই মার্ডার-ওয়েপনেরও একটা হদিশ হয়তো করতে পেরেছি! তবে কিনা আমার অনুমানটা যদি সত্যি হয়, তবে যতই না কেন খুঁজে মরুন, সেই অস্ত্রটির সন্ধান আপনি কোনওদিনই পাবেন না।” 

“কেন, কেন, পাব না কেন? সেটা যাবে কোথায়? এ তো আর রামানন্দ সাগরের টিভির রামায়ণের ওয়েপন নয় যে, শত্রুকে বিনাশ করেই মহাকাশে ভ্যানিশ করে যাবে! মার্ডার-ওয়েপনটা নিশ্চয় ডানা গজিয়ে উড়ে যাবার জিনিস নয়।” 

“আমি কি বলছি যে, ওটা উড়ে গেছে?”

“তা হলে?” 

“আরে মশাই, ওটা উড়ে যায়নি, গলে গেছে!” 

সামন্ত তখনও হাঁ করে তাকিয়ে আছেন দেখে ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখনও বুঝতে পারছেন না?” 

ডাক্তার গুপ্তই আমাদের সকলের হয়ে কথা বললেন। “উনি একা কেন, সম্ভবত আমরা কেউই কিছু বুঝতে পারিনি। অন্তত আমি যে পারিনি, এটা স্বীকার করতে আমার কিছু লজ্জা নেই।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেন, তা হলে ঘটনাগুলোকে পরপর সাজিয়ে নিন। নকুল খুন হয় মোটামুটি রাত তিনটের সময়। ইংরেজি মতে ২৫ মার্চ, ইন দি আর্লি আওয়ার্স অভ দি মর্নিং। খুন হবার ঘন্টা কয়েক আগে শেয়ালদা আইস ডিপো থেকে পঁচিশ কেজি বরফ কেনা হয়েছিল। এই ক্যাসমেমোটাই তার প্রমাণ। ক্যাসমেমোর তারিখ দেখছি ২৪ মার্চ। জমাখরচের খাতায় ওই একই তারিখে রবফ কেনার টাকাটা লেখা হয়েছে। টাকার অঙ্কের পাশে লেখা রয়েছে, ‘বিষ্টুকে পঁচিশ কেজি বরফ খরিদ করিবার জন্য দেওয়া হইল।’ খাতায় ওটাই শেষ এন্ট্রি।” 

কৌশিক মৃদু-মৃদু হাসছিল। মনে হল, সে একটা কিছু আঁচ করেছে। আমি কিন্তু কিছুই আন্দাজ করতে পারছিলুম না। ডাক্তার গুপ্ত, চাকলাদার আর সামন্তর মুখ দেখে বুঝলুম, তাঁদের অবস্থাও আমার চেয়ে খুব-একটা ভাল নয়। 

ভাদুড়িমশাই একটা সিগারেট ধরালেন। বুকের মধ্যে খানিকটা ধোঁয়া টেনে নিলেন। তারপর গলগল করে সেটাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “এতক্ষণ যা বললুম, সেটা তথ্য, সেটা প্রমাণ করা যায়।। এবারে এইসব তথ্যের ভিত্তিতে আমরা কয়েকটা ব্যাপার অনুমান করে নিতে পারি। প্রথমেই বলি, জমাখরচের খাতায় ওটাই যেহেতু শেষ এন্ট্রি, তাই মনে হয়, টাকাটা সেদিন অর্থাৎ ২৪ মার্চ বিকেল কিংবা সন্ধে নাগাদ বিষ্টুকে দেওয়া হয়। দুপুরে নকুল ঘুমোত, তা আমরা জানি। সম্ভবত ঘুম থেকে উঠে বিষ্টুকে সে টাকাটা দেয়, খাতায় সেটা লিখে রাখে, তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। বিষ্টু সম্ভবত তখনই বরফ কেনেনি। কিনেছিল বরফের দোকান বন্ধ হবার খানিক আগে। দোকানপাট দশটার পরে সাধারণত খোলা থাকে না। আমার ধারণা, দোকান বন্ধ হবার মুখে-মুখে বরফটা কিনে বিষ্টু বাড়ি ফিরে আসে। অভ্যাসবশত ক্যাসমেমোটা সে গেঁথেও রাখে ফ্ল্যাট-ফাইলে।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “তারপর?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “নকুল কেন পঁচিশ কেজি বরফ কিনতে দিয়েছিল, তা আপনাদের না-বুঝবার কথা নয়। মাছের কারবারি বরফ কেনে মাছের ঝুড়িতে বরফ চাপা দেবার জন্যে। গরমে যাতে মাছ না পচে যায়। আর বিষ্টু যে টাকা পেয়েই বরফ কিনতে বেরিয়ে পড়েনি, যতটা সম্ভব দেরি করে বেরিয়েছিল, সেটাও আমরা অনুমান করতে পারি।” 

কেন?” 

“সে জানত যে, বরফ যত দেরি করে কিনবে, সেটা গলে গিয়ে আকারে ছোট আর ওজন কম হয়ে যাবার সম্ভাবনা ততই কম। তাও সে নিশ্চিন্ত হয়নি, পানের দোকানে যেমন করে, সেইভাবে সেও সেই বরফের চাঙড়টাকে কাঠের গুঁড়ো দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। 

“তারপর?” 

“তারপর আর কী, নকুল তো মত্তাবস্থায় রোজই মাঝরাত্তিরে বাড়ি ফিরত। সেদিন ফিরল আরও দেরি করে। ফিরে খানিক চেঁচামেচিও করল, তারপর শুয়েও পড়ল যথারীতি। বিষ্টু কিন্তু ঘুমোল না। সে জেগে রইল। জেগে অপেক্ষা করতে লাগল নকুল কখন বাথরুমে যায়, সেই মুহূর্তটির জন্য।” 

ভাদুড়িমশাই তাঁর সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেটাকে অ্যাশট্রেতে পিষে দিলেন। তারপর বললেন, “নকুল মোটামুটি রাত-তিনটে নাগাদ একবার ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যেত। কিন্তু সেদিন সে চেঁচামেচি করেছিল রাত দুটো পর্যন্ত। দুটোর পরে ঘুমিয়ে আবার তিনটে নাগাদ ঘুম থেকে ওঠা একটু অস্বাভাবিক ব্যাপার। তাই আমার ধারণা নকুল সেদিন দুটোর পরে শুয়েছিল বটে, কিন্তু ঘুমোয়নি। ঘন্টাখানেক শুয়ে থেকে তিনটে নাগাদ সে ঘর থেকে বেরিয়ে বাথরুমে ঢোকে। কিন্তু সে টের পায়নি যে, সে গিয়ে বাথরুমে ঢুকবার সঙ্গে-সঙ্গেই বিষ্টুও অন্ধকারে তার ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে সিঁড়ির দু’ধাপ উপরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, বাথরুম থেকে তার বেরিয়ে আসার মুহূর্তটির জন্যে। বাথরুমের আলো নিবিয়ে নকুল বাইরে বেরিয়ে আসবামাত্র সিঁড়ির উপর থেকে বিষ্টু তার মাথা ‘কাটিয়ে দেয়। বেচারা নকুল! ব্রহ্মতালু ফেটে যাওয়ায় সে আর চিৎকার করে উঠতে পারেনি; মুখ থেকে কোনও শব্দ বেরুবার আগেই সে মেঝের উপরে লুটিয়ে পড়ে।” 

সামন্ত বললেন, “তা তো বুঝলুম, কিন্তু মাথাটা ফাটানো হল কী দিয়ে?” 

ভাদুড়িমশাই অবাক হয়ে সামন্তর দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। মনে হল, সামন্ত যে ব্যাপারটা এখনও বুঝে উঠতে পারেননি, এটাই যেন তিনি বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না। কিন্তু কৌশিকের মতো তিনি আর ঠাট্টা করলেন না সামন্তকে। একটু ক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “মাথা ফাটানো হল বরফের একটা বিশাল চাঙর দিয়ে, মাছের উপর চাপা দেবার জন্যে যা কেনা হয়েছিল, কিন্তু সে-কাজে যা ব্যবহার করা হয়নি বলেই ঝুড়ির সমস্ত মাছ সেদিন গরমে পচে যায়। তা নইলে ‘অমন উৎকট’ গন্ধ ওখানে ছড়িয়ে পড়ত না।” 

কৌশিক বলল, “সিঁড়ির নীচে যে কাদা-কাদা হয়ে গিয়েছিল সে তা হলে ওই বরফ-গলা জলের জন্যেই?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “নিশ্চয়ই। সিঁড়ির নীচে ধুলোময়লার সঙ্গে ওই যে কাঠের গুঁড়ো ছড়িয়ে ছিল, যার খানিকটা তুই ওখান থেকে কুড়িয়ে এনেছিলি, সেও আসলে বরফের চাঙড়টা যা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল, সেই কাঠের গুঁড়ো।” 

কৌশিকের প্রশ্নের জবাব দিয়ে আবার গঙ্গাধর সামন্তর দিকে তাকালেন ভাদুড়িমশাই। বললেন, “কেন যে তখন বলছিলুম যে, মার্ডার ওয়েপনটা উড়ে না-গেলেও গলে গিয়েছে, আশা করি সেটা এবারে আপনি বুঝতে পেরেছেন। হাজার চেষ্টা করেও অস্ত্রটা আর আপনি খুঁজে বার করতে পারবেন না।” 

সামন্ত বললেন, “তা না-পারলেও ক্ষতি নেই। অন্য যা-সব প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে, তা-ই যথেষ্ট।” 

*

এই কাহিনির ছোট্ট একটা পরিশিষ্ট রয়েছে। সেটা না-জানিয়ে আমি ঠিক শান্তি পাচ্ছি না। সেই রাত্রেই বিষ্টুচরণ ও যমুনাকে খুন ও তাতে সহযোগিতার দায়ে এখন গ্রেফতার করা হয়, যমুনার মেয়ে কম্‌লি অর্থাৎ কমলাকে নিয়ে তখন একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। দু’বছরের বাচ্চা মেয়ে, তাকে কোথায় রাখা হবে। যমুনা ইচ্ছে করলে মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই হাজতে যেতে পারত, তার তরফে সে-রকম দাবি তোলা হলে পুলিশেরও তা মেনে না-নিয়ে উপায় ছিল না। কিন্তু যমুনাই কম্‌লিকে সঙ্গে নিতে রাজি হয়নি। মেয়েটা তা হলে কোথায় থাকবে। যমুনার মা-বাপ নেই, থাকার মধ্যে আছে একটা ভাই, ‘তার অবস্থা ভাল নয়, সে কলকাতায় এসে দিদির কাছে আশ্রয় পায়নি, জামাইবাবু তাকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল, সে এখন ইটের ভাটায় মজুর খাটে। কমলিকে তার কাছে পাঠানো যায় কি না, জিজ্ঞেস করতে ঝাঁঝিয়ে উঠে যমুনা বলে, “তার চেয়ে এক কাজ করুন, মেয়েটাকে আমার এই আঁশবটিতে কেটে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিন।” বলে সে আর দেরি করে না, বিষ্টুচরণের পিছন-পিছন হেঁটে গিয়ে পুলিশ ভ্যানে উঠে পড়ে। 

ব্যাপার দেখে গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “এ তো মহা ফ্যাসাদ হল মশাই, মেয়েটাকে তা হলে বরং সরকারি হোমে বা কোনও অনাথ আশ্রমে-টাশ্রমে পাঠিয়ে দিই। আপনারা কী বলেন?” 

আমি আর শম্ভুবাবু চুপচাপ সব দেখছিলুম। শম্ভুবাবু বললেন, “আমরা আর কী বলব?”

কুসুমবালা সম্ভবত দোতলায় সিঁড়ির রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। এই সময়ে তিনি নীচে নেমে আসেন। এসে গঙ্গাধর সামন্তকে বলেন, “আপনি অনাথ-আশ্রমের কথা কী বলছিলেন?”

সামন্ত বললেন, “কমলিকে কোথায় রাখা হবে, সেই কথা হচ্ছিল। ভাবছি ওকে আমাদের কোনও হোমে আর নয়তো মাদার টেরিজার আশ্রমে পাঠিয়ে দেব।” 

কুসুমবালা বললেন, “না। কমলি এ-বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে না। ওকে আমি উপরে নিয়ে যাচ্ছি, ও আমার কাছে থাকবে।” 

ডাক্তার চাকলাদারকে নিয়ে ইতিমধ্যে আর-একদিন ভাদুড়িমশাইয়ের কাছে গিয়েছিলুম। কৌশিকও বাড়িতে ছিল। চাকলাদারকে দেখে সে বলল, “শুনেছেন তো? আপনার চেম্বারে যে ফিংগার-প্রিন্ট পাওয়া গেছে, সেটা বিষ্টুরই। ওটা না-পাওয়া গেলেও অবশ্য ক্ষতি ছিল না। সাক্ষ্যপ্রমাণ যেভাবে সাজিয়ে নিয়ে তারপর সামন্তর হাতে তুলে দিয়েছি, তাতে কেস্ একেবারে পাকা। ফাঁসি হয়তো হবে না, তবে যাবজ্জীবন হবেই।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কালই ব্যাঙ্গালোর ফিরছি। আপনারা সেই কবে গিয়েছিলেন, সে কি আজকের কথা? পারুলের পরীক্ষা শেষ হলে সবাই আর-একবার চলে আসুন। দেখতে পাবেন যে, শহরটা কত পালটে গেছে।” 

বিদায় নেবার সময় কৌশিকের হাত ধরে খুব ঝাঁকিয়ে দিয়ে চাকলাদার বললেন, “যেমন মামা, তেমনি ভাগ্নে। নরাণাং মাতুলক্রমঃ।” 

পরে রাস্তায় নেমে তাঁর মরিস মাইনরের দরজা খুলতে খুলতে নিচু গলায় বললেন, “অবশ্য নারীরাও অনেক সময় অন্তত চেহারায় তাদের মাতুলের মতো হতে পারে। তবে কিনা এই আমাদের বিষ্টুচরণের মতো গ্রাম সম্পর্কের মামা হওয়া চাই।” 

বাড়ি ফিরে দেখি, সদানন্দবাবু আমাদের বৈঠকখানা ঘরে বসে বাসন্তীর সঙ্গে কথা বলছেন। আমি তো অবাক। জামিনে ছাড়া পাবার পর থেকে আর রাস্তাঘাটে তাঁকে দেখাই যায়নি। কাজের মেয়েটিই বাজার করে দিত; মাদার ডেয়ারির দুধও এনে দিত সে-ই। রাস্তায় বার হওয়া তো দূরের কথা, সদানন্দবাবু শুনেছিলুম দোতলা থেকে নীচেই নাকি নামতে চান না। 

আমি গিয়ে বৈঠকখানা ঘরে ঢুকতেই সদানন্দবাবু দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, “অবাক হচ্ছেন তো?”

বললুম, “তা যে একটু হইনি, তা নয়।” 

সদানন্দবাবু বললেন, “সব শুনেছি। কিন্তু কী যে বলব, বুঝতে পারছি না। যে-ক’টা দিন বেঁচে আছি, আপনার কাছে ঋণী হয়ে রইলুম। …একটা কথা; বউমা যা বললেন, তাতে বুঝতে পারছি, ভাদুড়িমশাই কিছু নেবেন না। কিন্তু কৌশিকবাবুও তো কম দৌড়ঝাঁপ করেননি, অন্তত তাঁর ফি’টা তো দেওয়া দরকার।” 

বললুম, “কৌশিককেও কিছু দিতে হবে না। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলুম। তাতে সে বলল, এ-কেসটায় টাকা নিতে মামাবাবুর নিষেধ আছে। তবে কিনা ওর কিছু খাপত্তর তো হয়েছে, অন্তত সেটা যাতে নেয় তা আমি দেখব।” 

সদানন্দবাবু চট করে তাঁর মুখটা নামিয়ে নিলেন। বুঝতে পারলুম, চোখে যে জল এসে পড়েছে, ভদ্রলোক আমাকে সেটা দেখতে দিতে চান না। আস্তে-আস্তে তিনি দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর সেখান থেকেই হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, “যাবার আগে একটা অনুরোধ করে যাই। কম্‌লি যে বিষ্টুর মেয়ে, সেটা যেন কখনও প্রকাশ না পায়। নিতান্ত দরকার না হলে আদালতে যাতে ওর প্রসঙ্গটা না ওঠে, দয়া করে সেটাও একটু দেখবেন।” 

বললুম, “আমার আর চাকলাদারের ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তা ছাড়া গঙ্গাধর সামন্তকেও বলব যে, কম্‌লি হ্যাজ টু বি কেপ্‌ট আউট অভ্ দিস। সামন্ত তো মানুষ মোটেই খারাপ নন। কমলির ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি এই অনুরোধটা নিশ্চয় রাখবেন।” 

ফলে সদানন্দ বসু আবার শেষরাত্রে ঘুম থেকে উঠে লোহার-বল-বসানো সেই লাঠিটা হাতে নিয়ে নতুন উদ্যমে শুরু করে দিয়েছেন তাঁর মর্নিং ওয়াক। 

রচনাকাল : ১৩৯৬