শ্যামনিবাস-রহস্য – ১৫

১৫ 

কুসুমবালার সঙ্গে কথা বলে আমাদের চেনা একজন উকিলকে আমি আগেই সব জানিয়ে রেখেছিলুম। সদানন্দবাবুর জামিনের ব্যাপার নিয়ে সোমবার সকালে তাঁর সঙ্গে কথা বলছি, এমন সময় কৌশিক এল। অবাক হয়ে বললুম, “কী ব্যাপার?”

কৌশিক বলল, “একবার থানায় যাব। কয়েকটি বিষয়ে মিস্টার সামন্তর সঙ্গে একটু আলোচনা করা দরকার। হাতে সময় ছিল, তাই ভাবলুম যে, আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই। মামিমা, পারুল—ওরা সব ভাল আছে তো?” 

“তা আছে। তবে এলেই যখন, ওদের সঙ্গে একটু কথা বলে যাবে না?” 

“আজ আর বসব না। পরে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে নেব।” 

কৌশিক উঠে পড়ল। 

জামিনের ব্যবস্থা করা গেল না। সরকারি উকিল বললেন, একে তো এটা খুনের ব্যাপার, তার উপরে আবার কী দিয়ে খুন করা হয়েছে, এখনও সেটা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি, পুলিশ তাই আশঙ্কা করছে যে, আসামিকে যদি এখনই জামিন দেওয়া হয়, তা হলে তদন্তের অসুবিধে হবে। এখনও যা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি, তেমন কিছু-কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ এর ফলে লোপাট হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। 

আমাদের উকিল বললেন, সদানন্দবাবু একজন মানী ব্যক্তি, তদন্তের অছিলায় এইভাবে তাঁকে হাজতে আটকে রাখা উচিত হচ্ছে না। তা ছাড়া এটাও আদালতকে বিবেচনা করে দেখতে হবে যে, ঘটনাস্থলে চব্বিশ ঘন্টার জন্যে পুলিশ-পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সুতরাং সেখান থেকে সাক্ষ্য- প্রমাণ লোপাট হবার কোনও আশঙ্কাই নেই। 

হাকিম দু’পক্ষের কথা শুনলেন; তারপর রায় দিলেন, আসামিকে আপাতত আরও তিন দিন থানা-হাজতে রাখা যেতে পারে; তবে আদালত আশা করছে যে, পুলিশের তরফে বুধবারের মধ্যেই তদন্তের কাজ শেষ করা হবে, তারপরে আর তাঁরা জামিন দেবার ব্যাপারে কোনও আপত্তি তুলবেন না। সদানন্দবাবুর বয়সের উল্লেখও করলেন তিনি; বললেন যে, এই বয়সের একজন বৃদ্ধকে যে দীর্ঘকালের জন্য হাজতে আটকে রাখা চলে না, তাতে যে তাঁর স্বাস্থ্যভঙ্গ হতে পারে, পুলিশের সে-কথা উপলব্ধি করা উচিত। 

দেবনারায়ণ ঘোষ মশাই আমাদের উকিল। দুপুর দুটো নাগাদ আমার অফিসে ফোন করে তিনি এই খবর দিলেন। সব শুনে বললুম, “বেস্পতিবার জামিনের ব্যবস্থা হবে তো?” 

“তা হবে।” ঘোষমশাই বললেন, “আজ হল না ঠিকই, তবে রায় শুনে মনে হয়, সেদিন আর কোনও অসুবিধে হবে না। আসামির বয়েস যে সত্তর, সেটা একটা মস্ত ফ্যাক্টর।” 

‘আসামি’ শব্দটা খট্ করে কানে বাজল। বললুম, “শনির থেকে বুধ। শুনলে মনে হয় মোটে তো পাঁচটা দিন। তা এই বয়সে পাঁচ-পাঁচটা দিনও তো কম নয়। তার উপরে আবার যা গরম পড়েছে।” 

“কী আর করা যাবে বলুন! সবই কপালের ভোগ।”“ 

ফোন নামিয়ে রাখলুম। তারপরেই মনে হল, কৌশিকের সঙ্গে গঙ্গাধর সামন্তর কী সব কথা হল, সেটা জানা দরকার। টেলিফোন অপারেটরকে মালতীদের বাড়ির ফোন নম্বরটা দিয়ে বললুম, “নম্বরটা একটু ডেকে দাও তো।” 

ফোন মালতীই ধরেছিল। বললুম, “আমি কিয়দা। দাদা বাড়িতে আছেন?”

“তা আছে।” 

“তাঁর সঙ্গে একটু কথা বলব। ঘুমুচ্ছেন না তো?” 

“রাত্তিরেই দাদা ঘুমোয় না, তা দুপুরবেলায়। ধরুন, ডেকে দিচ্ছি।”

সেকেন্ড পাঁচেক বাদেই ভাদুড়িমশাইয়ের গলা ভেসে এলে। “কী খবর?”

“খবর তো কৌশিকের কাছে। গঙ্গাধর সামন্ত ওকে কী বললেন?” 

“পরে বলব। আপাতত জেনে রাখুন, সামন্ত মোটেই খারাপ লোক নয়। একটু একবগ্‌গা ঠিকই, নাক-বরাবর যা চোখে পড়ে, তা ছাড়া আর অন্য-কিছু দেখতে পায় না। বাট সার্টেনলি নট ওয়ান অভ্ দোজ কনসিটেড অফিসারস। কোথায় ভুল হচ্ছে সেটা ধরিয়ে দিলে মেনেও নেয়। কৌশিকের সঙ্গে তো এখন পুরোপুরি কো-অপারেট করছে।” 

“কৌশিক বাড়িতে আছে?” 

“তাই থাকে কখনও? থানা থেকে একটা নাগাদ ফিরেছিল, তার আধঘন্টার মধ্যেই আবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। মারুতি নিয়েই বেরুচ্ছিল, তা আমি বললুম, গরমে একেবারে সেদ্ধ হয়ে যাবি, বরং তোর বাবার অ্যাম্বাসাডরটা নিয়ে যা।” 

“কোথায় গেল?” 

“বাগনান আর কোলাঘাট, দু’জায়গাতেই যাবে।” 

“ওখানে আবার কী?”

“বাগনানের কাছেই যমুনার বাপের বাড়ি, আর নকুলদের বাড়ি হল কোলাঘাট থেকে মাইল কয়েক পশ্চিমে একটা গ্রামে। ব্যাপারটা বুঝলেন তো?” 

“কিছুই বুঝলুম না।” 

“যমুনা আর নকুলের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কৌশিক একটু কথা বলতে চায়।” 

“ফিরবে কবে?” 

“ফিরবে তো বলল কাল বিকেল নাগাদ। কিংবা তা যদি না পারে তো পরশু দুপুরে। চিন্তা করবেন না, ও ঠিক-পথ ধরেই এগোচ্ছে।” 

বললুম, “আমি কি আপনার ওখানে একবার যাব?” 

ভাদুড়িমশাই সেকেন্ড তিন-চার চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “আজ তো সোমবার। মঙ্গল আর বুধ, দুটো দিন আমাকে একটু ভাবতে দিন। আপনি একেবারে বেস্পতিবার বিকেলে আসুন। মনে তো হয় তখন কিছু খবর দিতে পারব।” 

ফোন নামিয়ে রাখলুম। 

মঙ্গল আর বুধ, দুটো দিন যেন কাটতেই চাইছিল না। অফিস করলুম যথারীতি, কিন্তু কাজকর্ম যে বিশেষ করতে পারা গেল, তা নয়। শুধু অফিসের কাজ বলে কথা কী, কোনও কাজেই যেন ঠিক মন বসাতে পারছিলুম না। বাসন্তী সেটা বুঝতে পেরেছিল, দু একবার প্রশ্নও করে ইল তা নিয়ে, কিন্তু স্পষ্ট কোনও জবাব না-পেয়ে আর-কিছু বলেনি। আমার শরীরটাও দু-একদিন ধরে একটু অবসন্ন লাগছিল! বুধবার সকালে টেলিফোন করে ডাক্তার চাকলাদারকে সে-কথা জানাতে তিনি বললেন, “আজ বিকেলে একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরতে পারবেন?” 

“তা কেন পারব না?” 

“ঠিক আছে, তা হলে ছ’টা নাগাদ আমার চেম্বারে চলে আসুন। ব্লাড শুগার বেড়ে যায়নি তো?”

“না মশাই, ও-সব ঝঞ্ঝাট আমার নেই।”

“তা হলে হয়তো প্রেশার বেড়েছে। চলে আসুন, দেখে দেব অখন। তা ছাড়া আমারও দু-একটা কথা বলবার আছে আপনাকে।” 

“কী কথা?” 

“আসুন, তখন বলব।”

চাকলাদার ফোন নামিয়ে রাখলেন। 

অফিস থেকে ফিরতে-ফিরতেই পাঁচটা চল্লিশ। জামা-কাপড় আর পালটানো হল না। মুখ-হাত ধুয়ে, কোনওক্রমে এক কাপ চা খেয়ে, পাশের গলিতে চাকলাদারের চেম্বারে যখন পৌঁছলুম, তখন ছ’টা পাঁচ। 

প্রেশার দেখে চাকলাদার বললেন, “ঠিকই আছে। মনে হচ্ছে এগ্‌জারশানের ব্যাপার। দু’দিন একটু বিশ্রাম নিন, সব ঠিক হয়ে যাবে।” 

বললুম, “বিশ্রাম তো নিতেই পারতুম, কিন্তু এখন কী করে নিই বলুন তো। সদানন্দবাবুর ব্যাপারটার ফয়সলা হোক, তারপর নেওয়া যাবে।” 

চাকলাদার বললেন, “আমি যা বলতে চাই, তাও কিন্তু ওই পাঁচ-নম্বর বাড়ির ব্যাপারেই।”

ভদ্রলোককে বড় গম্ভীর দেখাচ্ছিল। হাসিখুশি, বন্ধুবৎসল মানুষ; শুনেছি ছ’টা সাড়ে ছ’টা নাগাদ তাঁর চেম্বারে রোজই কিছু-না-কিছু বন্ধুবান্ধব আসেন, আড্ডা চলে আটটা-ন’টা পর্যন্ত। আজ কাউকে দেখা গেল না। বললুম, “ কী ব্যাপার বলুন তো? কাউকে দেখছি না কেন?” 

“আমিই ফোন করে সবাইকে আসতে বারণ করে দিয়েছি। বলেছি, শরীরটা ভাল যাচ্ছে না, চেম্বারে না-বসে আজ একটু বিশ্রাম নেব।” 

“শরীর সত্যি খারাপ নাকি?” 

“না না, ও-সব কিছু নয়। আসলে আপনাকে এমন দু-একটা কথা বলতে চাই, অন্যদের যা না-শোনাই ভাল।” 

“কী কথা?” 

ডাক্তার চাকলাদার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। মুখ নিচু করে কী যেন ভাবলেন। তারপর মুখ তুলে বললেন, “এখুনি আমি বিস্তারিতভাবে কিছু বলব না, বলা উচিতও নয়। আমি ডাক্তার–মানুষ, এমন কিছু করা বা বলা আমার ঠিক হবে না, যা কিনা আমাদের পেশায় আন্-এথিক্যাল বলে গণ্য হয়ে থাকে। শুধু একটা কথা বলি। আপনি তো সদানন্দবাবুর বাড়ির একেবারে সামনেই থাকেন, আপনি একটু মিসেস বসুর উপরে নজর রাখুন।” 

“সদানন্দবাবুর স্ত্রীর উপরে? কেন?” 

“আর-কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, প্লিজ। শুধু যা বললুম, দয়া করে সেটা মনে রাখবেন।… মানে, আপনারা একটু সতর্ক থাকুন। হ্যাঁ, আপনারা সবাই। আমার ধারণা, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।” 

চাকলাদারের কথাবার্তা আমার কানে কেমন যেন অসংলগ্ন ঠেকছিল। মনে হল, ভদ্রলোকের শরীর সত্যি ভাল যাচ্ছে না। বিশ্রাম সম্ভবত ওঁরই সবচেয়ে বেশি দরকার। 

চলে আসবার আগে একবার জিজ্ঞেস করেছিলুম, “কী হয়েছে, একটু খুলে বলুন তো মশাই।”

কিন্তু চাকলাদার আর একটি কথাও বললেন না। 

.

চাকলাদার বলেছিলেন, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। তা কিছু-একটা যে সেই রাত্রেই ঘটবে, তখন তা আমি কল্পনাও করিনি। খবর পাওয়া গেল ভোরবেলায়। না, আমাদের জন্যে তো ভদ্রলাক বড় উদ্বিগ্ন ছিলেন, আমাদের গলিতে কিন্তু কারও কিছু হয়নি, ক্ষতি যা হবার তা চাকলাদারেরই হয়ছে। তাঁর চেম্বারের জানলা ভেঙে মাঝরাত্তিরে চোর ঢুকেছিল। চেম্বারে তো বিশেষ-কিছু থাকবার কথা নয়, ছিলও না, তাই চোরও বিশেষ কিছু হাতিয়ে নিতে পারেনি। আমরা গিয়ে দেখলুম, চেম্বারের ঘরের মেঝের উপরে একরাশ কাগজপত্র ছত্রাকার হয়ে পড়ে আছে। পুলিশ এসেছে। ডাক্তার চাকলাদার তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। আমাকে দেখে বললেন, “চলে যাবেন না, একটু বসুন, কথা আছে।” 

পুলিশ চলে যেতে-যেতে আটটা বাজল। চাকলাদার আমাকে ভিতরের দিকের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। কাজের লোকটি এসে দু’কাপ চা দিয়ে গেল সেখানে। চাকলাদার বললেন, “খান।” 

আমি বললুম, “আজকাল আর আমি এই রকমের চা নাই না, সদানন্দবাবুর পরামর্শমতো স্রেফ হাল্কা লিকার খাই।” 

চাকলাদার বললেন, “তা হলে ওটা খাবেন না, পালটে দিতে বলছি।” 

বললুম, “আরে দূর মশাই, আমি কি সদানন্দবাবুর মতো অত নিয়ম মানি? এটাই খেয়ে নিচ্ছি, পালটাতে হবে না। …কথাটা কী সেইটে এবারে বলুন তো?” 

“ও, হ্যাঁ।” চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ডাক্তার চাকলাদার বললেন, “আপনার কাছে মিঃ ভাদুড়ির কথা অনেক শুনেছি। তা সেদিন তো আপনারা বলছিলেন যে, তিনি এখন কলকাতায়। তাই না?” 

বললুম, “হ্যাঁ। কেন বলুন তো?” 

“শিগগিরই কি তাঁর কাছে আপনি যাবেন?”

“রবিবারে গিয়েছিলুম। আজ তো বেস্পতিবার, আজ বিকেলেও একবার যাব।” 

“আজ অফিসে যাবেন না?” 

“না। সদানন্দবাবুর জামিনের ব্যাপারটা আজ আবার উঠবে। মনে হচ্ছে আজ ওটা পেয়েও যাবেন উনি।” 

“আপনি কি আদালতে যাবেন?” 

“না না,” আমি বললুম, “আমার যাবার কিছু দরকার নেই। ভাল ল-ইয়ার দিয়েছি, যা করবার তিনিই করবেন। আমি বাড়িতেই থাকব। কেন থাকব, জানেন?”

“কেন?” 

“হাজত থেকে উনি ফেরবার সঙ্গে-সঙ্গেই ওঁর সঙ্গে গিয়ে দেখা করব। যাতে না ওঁর মনে হয় যে, পুলিশে ধরেছিল বলে আমরা ওঁকে অদ্ভুত ভাবছি, ওঁকে এড়িয়ে যাচ্ছি।” 

“সে তো ভালই।” চাকলাদার বললেন, “তা হলে মিঃ ভাদুড়ির ওখানে কখন যাচ্ছেন?” 

“পাঁচটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ব, তার আগে তো রোদ্দুরে সব তেতে থাকে।” 

“আমিও আপনার সঙ্গে যাব তখন। ওঁর সঙ্গে আমার একবার দেখা করা দরকার।”

বললুম, “আপনি ওঁকে কিছু বলতে চান?” 

“হ্যাঁ, একটা কথা ওঁকে জানাতে চাই আমি। না-জানানো পর্যন্ত আমি শান্তি পাচ্ছি না।” 

“বেশ তো, যাবেন। পাঁচটা নাগাদ আপনার এখানে চলে আসব আমি, তারপরে দু’জনে মিলে বেরিয়ে পড়ব।” 

চাকলাদারের বাড়ি থেকে বেরিয়েই বড়রাস্তা। দু’পা এগিয়ে বাঁদিকে মোড় নিয়ে পীতাম্বর চৌধুরি লেনে ঢুকলুম। দেখলুম, একটা থলে হাতে বিষ্টুচরণ বাজার করতে যাচ্ছে। কাপড়টা নোংরা, হাফ-হাতা শার্টটাও কাঁধের কাছে ছিঁড়ে গেছে। দেখে মায়া হল। ভগ্নিপতির আশ্রয়ে দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পাচ্ছিল, এবারে মুশকিলে পড়বে। 

১৬ 

বাড়ি ফিরে শুনলুম, ভাদুড়িমশাই ফোন করেছিলেন। একটু বাদে আবার করবেন। ঠিক ন’টায় ফোন বাজল। রিসিভার তুলে ‘হ্যালো’ বলতেই ও-দিক থেকে প্রশ্ন ভেসে এলে, “আজ বিকেলে আসছেন তো?” 

“তা যাচ্ছি। কৌশিক ফিরেছে?” 

“পরশু ফিরতে পারেনি, কালও দুপুরে ফেরা হল না, ফিরেছে কাল রাত্তিরে। অনেক খবর। বিকেলে আসুন, তখন বলব। আজ অফিসে যাচ্ছেন?” 

“না, ছুটি নিয়েছি।” 

“শরীর খারাপ?” 

“না,” হেসে বললুম “সদানন্দবাবু আজ জামিন পাচ্ছেন। তাঁকে রিসিভ করতে হবে তো।”

“অর্থাৎ আপনি ধরেই নিয়েছেন যে, তিনি নির্দোষ। তাই না?” 

বললুম, “ভাদুড়িমশাই, আমার কাছে এটা দোষ-গুণ বিচারের প্রশ্ন নয়, বিপদের মেয়ে বন্ধুর পাশে দাঁড়াবার প্রশ্ন। তা আপনি খুব ভালই জানেন যে, আই অলওয়েজ স্ট্যান্ড বাই মাই ফ্রেন্ডস।” 

“জানি বলেই তো কৌশিককে পাঠিয়ে দিয়েছিলুম। কিন্তু সে-কথা থাক। দুগুরটা যখন হাতে রয়েছে, তখন একটা কাজ করুন দেখি।” 

“কী কাজ?” 

“বলছি। গত শনিবার সকালে চিৎকারটা শুনেই আপনি ও-বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন। তাই না? “

“হ্যাঁ, তা প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই গিয়েছিলুম।” 

“গিয়ে যা দেখেছিলেন…মানে কে কোথায় দাঁড়িয়ে কিংবা বসে ছিল, কে কী বলছিল কিংবা করছিল, ডিটেলসে সব লিখে ফেলুন। মানে ওই যাকে অকুস্থল বলা হয় আর কি, তার একেবারে হুবহু একটা রিপোর্ট আমি চাইছি। কিচ্ছু বাদ দেবেন না।” 

“পারব কি?” 

“খুব পারবেন। আপনার মেমারি যে সব কিছুকেই ধরে রাখে, তার পরিচয় আমি আগেও পেয়েছি। নইলে কি আপনার রিপোর্টটার উপরেই সবচেয়ে জোর দিতুম?” 

“তার মানে? আরও কাউকে-কাউকে এটা লিখতে বলেছেন নাকি?”

“আরও তিনজনকে বলেছি। গঙ্গাধর সামন্ত, ডাক্তার গুপ্ত আর কৌশিক। সো, কিরণবাবু, ইউ আর ইন গুড কম্প্যানি। কৌশিক তো ব্রেকফাস্ট করেই খাতা-কলম নিয়ে লিখতে বসে গেছে। …তা হলে ছেড়ে দিই?” 

“দাঁড়ান, দাঁড়ান, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি।” 

“কী কথা?” 

“বিকেলে এক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে আপনার ওখানে যেতে চান। নিয়ে যাব?” 

“ভদ্রলোকটি কে?” 

“ডাক্তার চাকলাদার। বলছেন যে, আপনাকে কিছু জানাতে চান।… পাড়ার ডাক্তারবাবু তো, খবরটা তাই ওঁকেই আগে দিয়েছিলুম।” 

“আই সি। উনি তা হলে ঘটনাস্থলে ছিলেন?”

“তা তো ছিলেনই। কৌশিক ওঁকে দেখেওছে ওখানে।” 

“আমাকে উনি কী জানাতে চান? …এনি আইডিয়া?” 

“না, মশাই, কিছু আমার জানা নেই। শুধু বললেন যে, আপনাকে একটা কথা না-বলা পর্যন্ত ওঁর শান্তি হচ্ছে না।” 

“ঠিক আছে,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওঁকে নিয়ে আসুন।” 

লাইন কেটে গেল। রিসিভার ক্রেড্‌লে নামিয়ে রাখা হয়েছে। 

.

কয়েকটা দিন হাজতবাসের ফলেই যে একটা লোকের চেহারা আর চরিত্র কতটা পালটে যেতে পারে, সদানন্দবাবুকে না-দেখলে সেটা বিশ্বাস করা শক্ত হত। এ কাকে দেবনারায়ণবাবু জামিনে ছাড়িয়ে আনলেন? বাড়িতে ফিরে এসেছেন, চারটে নাগাদ এই খবর পেয়ে, বাসন্তীকে নিয়ে পাঁচ-নম্বরের দোতলায় উঠে ‘কেমন আছেন সদানন্দবাবু’ বলে যাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম, আমাদের চেনা সদানন্দবাবুর সঙ্গে তাঁর আকাশ-পাতাল ফারাক। শুকনো মুখ, চোখের কোলে কালি, মাথার প্রায় সবটাই সাদা, মুখ নিচু করে যে মানুষটি বসে আছেন, বলতে গেলে তাঁকে আমরা চিনিই না। দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। একই সঙ্গে বুঝতে পারছিলুম যে, তাঁর ব্যক্তিত্ব একটা মারাত্মক রকমের ঝাঁকুনি খেয়েছে, এটা সামলে উঠতে তাঁর সময় লাগবে। তা ছাড়া, জামিন পেয়েছেন বটে, কিন্তু রোজ একবার থানায় গিয়ে হাজিরা দিয়ে আসতে হবে। 

মিনিট পনেরো ওখানে থেকে আমি বেরিয়ে এলুম। আসবার সময় নমস্কার করে বললুম, “আজ আসি, পরে আসব।” সদানন্দবাবু তাতে প্রতি-নমস্কার তো করলেনই না, একটু হাসলেন না পর্যন্ত। ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। 

বাসন্তী বসে ছিল তার কুসুমদির পাশে। আমাকে উঠতে দেখে সেও উঠে পড়ল। বলল, “সন্ধের দিকে আবার আসব কুসুমদি।” 

বাড়িতে ফিরে এসে বাসন্তী বলল, “উঃ, কেমন যেন দম আটকে যাচ্ছিল আমার।” 

বললুম, “সে তো আমারও। কিন্তু তবু যেতে হবে। আগে তো তুমি রোজই যেতে, আমি যেতুম না। এখন থেকে আমিও রোজ যাব। কেন যাব, সেটা তুমি বুঝতেই পারছ।” 

বাসন্তী বলল, “সে তো পারছিই। এখন না-গেলে কুসুমদি ভুল বুঝবেন। তা ছাড়া, দেখলে তো, এক শম্ভুবাবুর স্ত্রী ছাড়া আর কেউ ও-বাড়িতে যায়নি।” 

বললুম, “সে তো দেখলুমই। তবে শম্ভুবাবু যাবেন। ভদ্রলোক অফিস থেকে এখনও ফেরেননি। ফিরে একবার যাবেন নিশ্চয়। নাও, এবারে চা করো, চা খেয়ে আমি বেরিয়ে পড়ব। দেরি হয়ে যাচ্ছে।” 

চা খেয়ে চাকলাদারের কাছে যেতে-যেতে পাঁচটা দশ বাজল। ভদ্রলোক তৈরি হয়েই বসে ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, “গ্যারাজ থেকে আমার মরিস-মাইনরটা এইমাত্র মেরামত হয়ে ফিরল। চলুন, ওটাতেই যাওয়া যাক। কেমন সারিয়েছে, সেটা বুঝতে পারা যাবে। চা খেয়ে বেরিয়েছেন তো?” 

“তাতেই তো দেরি হয়ে গেল। গ্যাস ফুরিয়েছে, কেরোসিন নেই, তাই কাগজ পুড়িয়ে চা বানাতে হল, মশাই। ডবল সিলিন্ডার করে কী যে লাভ হল বুঝি না। যা দেখছি, ফের সেই ঘুঁটে-কয়লার ব্যবস্থা করতে হবে।” 

চাকলাদার হাসলেন। বললেন, “তা যা বলেছেন, চলুন বেরিয়ে পড়ি।” 

যতীন দাস রোডে মালতীদের বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে সওয়া ছ’টা বাজল। উপরে উঠে দেখি, বসবার ঘরে আসর একেবারে জমজমাট। গঙ্গাধর সামন্ত এসে গেছেন। বাকি শুধু ডাক্তার গুপ্ত। সামন্ত বললেন, “তিনিও এসে পড়বেন এবারে।” 

বলতে-না-বলতেই ডাক্তার গুপ্ত এসে গেলেন। ঘরে ঢুকে হাত থেকে স্টেথোসকোপটা নামিয়ে রেখে একটা সোফায় বসতে-বসতে বললেন, “খুব দেরি হয়নি তো?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আরে না। …তা হলে সামন্তমশাই, শুরু করা যাক, কেমন? নকুলের ব্যাবসার কাগজপত্র যা সিজ করেছেন, সবই নিয়ে এসেছেন তো?” 

কৌশিক বলল, “কাগজপত্র তো বেশি নয়, খান তিনেক জমা-খরচের খাতা, আর কিছু রসিদ। সবই উনি এনেছেন। আমার ঘরে রেখে দিয়েছি। এতক্ষণ তো তারই উপরে চোখ বুলোচ্ছিলুম। এখানে নিয়ে আসব?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখন আনবার দরকার নেই। যখন দরকার হয়, বলব।” 

সামন্ত বললেন, “সবই কিন্তু আজই আমি ফেরত নিয়ে যাব।” 

“বেশ তো, নিয়ে যাবেন, একটা কুটোও আমি এখানে আটকে রাখব না। কিন্তু আগের কথাটা আগে হোক। যা-যা আটক করেছেন, তার মধ্যে মার্ডার-ওয়েপন বলে কোন্টা সাব্যস্ত হল?” 

সামন্তমশাই একেবারে নিবে গেলেন। বললেন, “কোনওটাই না।” 

কৌশিক বলল, “লাঠি দিয়ে যে মাথা ফাটানো হয়নি, সে তো আমি আগেই বুঝেছিলুম।”

গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “কী করে বুঝলেন?”

কৌশিক বলল, “বা রে, লাঠিটার এখানে-ওখানে রক্ত লেগে ছিল ঠিকই, কিন্তু যে-জায়গাটা দিয়ে মারলে মাথা ফাটানো সম্ভব, সেই লোহার বলটার গায়ে এক ছিটেও রক্ত ছিল না। সেটা আমি শনিবার সকালেই লক্ষ করেছিলুম। আমার শুধু ভয় ছিল যে, অসাবধানে নাড়াচাড়া করার ফলে ওই লোহার বলেও না রক্ত লেগে যায়। তা আপনি সাবধানে ওটা হ্যান্ডল করেছেন, তাই রক্তও লাগেনি।” 

গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “লাঠিটাকে আমি মার্ডার-ওয়েপন বলে সন্দেহ করেছিলুম ঠিকই, কিন্তু তাই বলে অসাবধান হব কেন? কোনওভাবে যাতে কোনও ট্যাম্পারিং না হয়, সেদিকে আমি কড়া নজর রাখি। দোষীর শাস্তি হোক, এটা আমি চাই নিশ্চয়ই। কিন্তু আমি সন্দেহ করছি বলেই একটা লোক দোষী, আর আমারই ভুলে কিংবা অসাবধানতায় তার ফাঁসি হয়ে যাবে, এটা নিশ্চয়ই চাই না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “মারণাস্ত্র হিসেবে ওই লাঠিটা ছাড়া আর কী কী যেন আটক করা হয়েছিল ও-বাড়ি থেকে?” 

গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “তার লিস্টি আমি মিঃ সান্যালকে দিয়েছি। আটক তো করেছিলুম অনেক-কিছুই। ইট, পাথর, নোড়া, হাতুড়ি, বাটখারা, রেঞ্চ, বিস্তর জিনিস।” 

“অন্যগুলো কী কাজে লাগে, সে তো বুঝতে পারছি। বাটখারা দিয়ে কী হত?” 

“বাটখারা যেমন একতলা থেকে অনেকগুলো পেয়েছি, তেমনি অন্তত একটা পেয়েছি দোতলা থেকেও। একতলায় এত বাটখারা কেন জিজ্ঞেস করেছিলুম। তা বিষ্টুচরণ বলল, ওগুলো মাছ ওজন করার কাজে লাগে।” 

“লাগতেই পারে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “মাছের ব্যাবসা, বাড়িতেই খুচরো দোকানিদের মাছ বিক্রি করা হত, তা বাটখারা তো লাগবেই। কিন্তু সদানন্দবাবুর তো কোনও ব্যাবসা ছিল না, তাঁর বাটখারা কী কাজে লাগত?” 

আমি বললুম “সদানন্দবাবু কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন আমি জানি না, তবে কেন যে তিনি বাটখারা রাখতেন সেটা জানি। আসলে আমরা সকলেই পুরনো খবরের কাগজ কি অকেজো শিশিবোতল বিক্রি করি তো, তা ও-সব যারা কেনে, তাদের বাটখারাকে সদানন্দবাবু বিশ্বাস করতেন না। বলতেন, ‘ওরা ডাকাত মশাই, ডাকাত। যেটাকে ওরা এক কিলোর বাটখারা বলে চালায়, তার ওজন অন্তত বারো শো গ্রাম।’ নিজের বাটখারা ছাড়া তিনি তাই ও-সব জিনিস বিক্রি করতেন না। আমাকেও একটা বাটখারা কিনতে বলেছিলেন।” 

ডাক্তার গুপ্ত হেসে উঠলেন। বললেন, “ওরব্বাবা, এ তো দেখছি ভীষণ হিসেবি লোক, এ-সব তো আমাদের মাথাতেই আসে না!” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “যাক, যে-সব জিনিস আটক করেছিলেন, তার একটাও তা হলে পরীক্ষায় ওতরায়নি, কেমন?” 

গঙ্গাধর বললেন, “একটাও না। ছাতে যে জলের ট্যাঙ্ক রয়েছে, সেটার মধ্যেও লোক নামিয়েছিলুম। বাড়ির সামনে যে কর্পোরেশনের ডাস্টবিন রয়েছে, সেটাকেও হাঁটকে দেখতে ছাড়িনি। কিন্তু না, কিচ্ছু পাওয়া গেল না। মার্ডার-ওয়েপনটা একটা মিস্ত্রিই রয়ে গেল।” 

আমি বললুম, “তা তো হল, আপনি যে রিপোর্টটা দিতে বলেছিলেন, সেটা আমি লিখে এনেছি।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কৌশিকের রিপোর্টও লেখা হয়ে গেছে। সামন্ত মশাই, আপনি?”

“আমিও লিখে ফেলেছি।” 

ভাদুড়িমশাই আমাদের তিনজনের লেখা তিনটে রিপোর্ট নিয়ে সেন্টার-টেবিলের উপরে একটা পেপার ওয়েট চাপা দিয়ে রাখলেন। তারপর ডাক্তার গুপ্তের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, “আপনারটাও দিয়ে দিন।” 

ডাক্তার গুপ্ত কাঁচুমাচু মুখে বললেন, “ইয়ে…আমারটা এখনও লেখা হয়নি।” 

গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “আমাদের তিনটেই আপাতত পড়ে দেখুন।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখন নয়। রাত্তিরে নিজের ঘরে বসে ধীরেসুস্থে পড়ব। এখন বরং কৌশিকের কথা শুনুন।” 

কৌশিক প্রথমে গিয়েছিল কোলাঘাটের মাইল কয়েক পশ্চিমে, রহমতপুর গ্রামে। সেখানকার কাজ শেষ করে সে বাগনানের কাছে বিষ্ণুহাটি গ্রামে যায়। 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “হঠাৎ আবার ও-সব জায়গায় যাবার দরকার হল কেন?” 

গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “নকুলচন্দ্র রহমতপুরের লোক আর বিষ্ণুহাটিতে হল যমুনার বাপের বাড়ি। সোমবার সকালে মিঃ সান্যাল থানায় এসে আমার কাছ থেকে এই দুটো গাঁয়ের কথা জেনে গিয়েছিলেন!” 

কৌশিক বলল, “একবার ভেবেছিলুম সরাসরি পাঁচ নম্বর বাড়িতে ঢুকে বিষ্টুচরণকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিই যে, ওরা কে কোথাকার লোক। কলকাতার লোক যে নয়, সে তো ওদের কথা শুনেই বুঝতে পেরেছিলুম। পরে মনে হল, বিষ্টুচরণকে জিজ্ঞেস করবারই বা দরকার কী, জেরার সময়েই মিস্টার সামন্ত সে-সব জেনে নিয়েছেন নিশ্চয়। তাই আর পাঁচ-নম্বর বাড়িতে গেলুম না, একেবারে থানায় চলে গেলুম। তারপর আর কী, থানা থেকে ঠিকানা নিয়ে সেইদিনই বেরিয়ে পড়লুম কলকাতা থেকে।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “বেরিয়ে পড়বার দরকার হল কেন, সেটা কিন্তু এখনও বুঝতে পারছি না।” কৌশিক বলল, “দরকার হল মামাবাবুর জন্যে। আপনারা তো গত রবিবার এখানে এসেছিলেন। সেদিন রাত্তিরে আপনারা চলে যাবার পরেই মামাবাবু আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে, নবু চন্দ্ৰ কোথাকার লোক তা আমি জানি কি না। তা আমি বললুম, নকুলের সঙ্গে কথা বলবার সুযোগ তো আমার হয়নি, আমি তার ডেডবডিটাই দেখেছি মাত্র, তবে যমুনা আর বিষ্টুচরণের কথা শুনে মনে হল যে, তারা কলকাতার লোক নয়। তখন মামাবাবু বললেন যে, নকুল যদি বাইরের লোক হয়, তো যেখান থেকে সে কলকাতায় এসেছে, সেখানেও একবার যাওয়া দরকার; সেইসঙ্গে যমুনার বাপের বাড়িতে গিয়েও একটু খোঁজখবর করলে ভাল হয়।” 

গঙ্গাধর সামন্ত ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এমন কথা আপনার মনে হল কেন? খুন তো হয়েছে কলকাতায়। বাড়িওয়ালার সঙ্গে ভাড়াটের ঝগড়া, এ তো একেবারে স্ট্রেট কেস।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওপর ওপর দেখলে সেটাই মনে হয় বটে। কিন্তু প্রথম থেকেই আমার মনে হচ্ছিল যে, অত স্ট্রেট কেস এটা না-ও হতে পারে। অর্থাৎ খুনটা কলকাতায় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার কারণটাও যে কলকাতাতেই খুঁজে পাওয়া যাবে, এমন কথা তো নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না।” 

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “কজালিটি অর্থাৎ কার্যকরণের ব্যাপারটা আপনারা সবাই বোঝেন। কারণ ছাড়া কার্য হয় না। কিন্তু কাজটা যেখানে হল, কারণটাকেও যে সেখানেই খুঁজে পাওয়া যাবে, এমন তো কোনও কথা নেই। সত্যি বলতে কী, সেইজন্যেই কৌশিককে আমি কলকাতার বাইরে গিয়ে একটু খোঁজখবর করতে বলেছিলুম।” 

গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “আপনি কি মনে করেন যে, খুনটা কেউ বাইরে থেকে এসে করেছে?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি কী মনে করি না-করি, এখুনি তা বলছি না। বলা সম্ভবও নয়। তবে লক্ষণ যা দেখছি, তাতে মনে হয়, উই আর অন দি রাইট ট্র্যাক। কিন্তু সে-কথা থাক। কৌশিক কী বলছে, শুনুন!” 

১৭ 

কৌশিক বলল, “সোমবারে দুপুর ঠিক দেড়টার সময় আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। যা গরম, তাতে গাড়ি না-নিয়ে ট্রেনে গেলেই ভাল হত। কিন্তু আমি বুঝে গিয়েছিলুম যে, বিস্তর ঘোরাঘুরি করতে হবে, তাই গাড়িতেই যাই। একটু ঘুরপথে গিয়েছিলুম। পাছে হাওড়ায় ঢুকে ট্র্যাফিক-জ্যামে আটকে যাই, তাই বি.টি. রোড ধরে, দক্ষিণেশ্বরে গঙ্গা পেরিয়ে, খানিকটা এগিয়ে বাঁদিকে টার্ন নিয়ে লিঙ্ক রোড দিয়ে এন. এই সিক্স ধরে এগোই। তাতে বেশ কয়েক মাইল বেশি কভার করতে হল বটে, কিন্তু ট্র্যাফিক জ্যামে পড়তে হল না বলে বিকেল পাঁচটার মধ্যেই রহমতপুরে পৌঁছে গেলুম।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “ওইখানেই তো নকুলদের বাড়ি, তাই না?” 

কৌশিক বলল, “হ্যাঁ। কুড়ি-পঁচিশ ঘর লোক নিয়ে ছোট্ট গ্রাম। মেচেদা ছাড়িয়ে এন. এইচ. সিক্স ধরে আরও খানিকটা এগিয়ে ডাইনে একটা কাঁচা রাস্তায় নেমে একটু ভিতরে ঢুকে যেতে হয়। বিশ্বাসদের বাড়িতে যাব বলতে একটা লোক আমাকে বাড়িটা দেখিয়ে দিল। তো সেখানে নকুলের এক ভাই থাকে। বড় ভাই। বয়েস মনে হল পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন। অবস্থা যে মোটেই সুবিধের নয়, সে তার জামাকাপড় আর চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। নিজের থেকেই লোকটা সে-কথা বললও। নাম শুনলুম যুধিষ্ঠির।” 

“সুতরাং যা বলল, তা যে মিথ্যে, এম কথা ভাবা-ই চলে না!” ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “কিন্তু যুধিষ্ঠিরের অন্য সব ভাই, মানে ভীম অর্জুন আর সহদেব, তারা কোথায় থাকে?” 

কৌশিক হেসে বলল, “কথাটা নেহাত মন্দ বলেননি। নকুলের বাবার সম্ভবত পাঁচ ছেলেরই প্ল্যান ছিল, তবে নকুল অব্দি এগিয়ে তিনি মারা যান, ফলে সহদেব আর জন্মাতেই পারল না। চার ছেলের নাম অবশ্য মহাভারতের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা। যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন আর নকুল। ভীম আর অর্জুন কোথায় থাকে, যুধিষ্ঠিরের তা জানা নেই। নকুলের খবরও বছর দশেক রাখেন না। আগে-আগে মাঝে-মধ্যে দাদাকে পাঁচ-দশ টাকা পাঠাত; বিয়ে করবার পর থেকে সেটা বন্ধ হয়ে যায়।” 

গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “নকুল যে মারা গেছে, এই খবর শুনে কী বলল?” 

কৌশিক বলল, “সেটাই তো তাজ্জব ব্যাপার! বলল, ‘তাই বুঝি? তা হবে।’ মানে রি-অ্যাক্টই করল না। অথচ, নকুল তার ছোট ভাই! ভাবা যায়? কী হয়েছিল, তাও পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল না।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “তারপর?” 

“তারপর আর কী, সেখান থেকে চলে এলুম। সন্ধে হয়ে গিয়েছিল, তাই সেদিন আর উজিয়ে আসিনি। উজিয়ে এলে লাভ হত না। রাত করে যদি বিষ্ণুহাটিতে পৌঁছতুম, তো যমুনার বাপের বাড়িটা নিশ্চয় খুঁজে পাওয়া যেত, তবে অসুবিধেয় পড়তুম রাত কাটাবার জায়গা নিয়ে। সে-দিন তাই নদীর ও-পারে দাইনানেই রয়ে গেলুম আমি।” 

“জায়গা পাওয়া গেল?” 

“ও-সব নিয়ে কোনও সমস্যা হয়নি।” কৌশিক বলল, “হাওড়া আর মেদিনীপুর, দুটো জেলার দুই এস.পি.-কেই মামাবাবু ফোন করে দিয়েছিলেন তো; কোথায় কোথায় যাব, তাও তাঁদের জানিয়ে দিয়েছিলেন। তা রহমতপুরেই দেখলুম পুলিশের একজন লোক আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। দাইনান তো রূপনারানের ধারে। সে-ই সেখানে একটা বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে গেল আমাকে।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “তা রাতটা সেখানে কাটিয়ে তারপর মঙ্গলবার ভোরবেলাতেই নদীর এ-পারে বাগনানে চলে এলে?” 

কৌশিক বলল, “একেবারে ভোরবেলাতেই যে দাইনান থেকে বেরিয়ে পড়েছিলুম, তা নয়। দেখলুম, দুপুরের খাওয়াটা দাইনান থেকে চুকিয়ে যাওয়া ভাল। বাগনানে পৌঁছলুম দেড়টা-দুটো নাগাদ। সেখানে প্রথমেই গেলুম থানায়। থানা অফিসার বললেন, হাওড়ার এস.পি. তাঁকে সোমবারেই জানিয়ে রেখেছেন যে, আমি বাগনানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করব। চমৎকার লোক, বললেন যে, দরকার হলে তিনি আমার সঙ্গে একজন লোক দিতে পারেন। বিষ্ণুহাটির পথের ডিরেকশান তো তাঁর কাছেই পেলুম। জিপও দিতে চাইলেন। আমি বললুম, বৃষ্টি তো আর হয়নি, রাস্তা জায়গায়-জায়গায় কাঁচা বটে, তবে কাদা-টাদা যখন নেই, একেবারে শুকনো খটখটে, তখন আর জিপ নেব না। আর তা ছাড়া পুলিশের জিপ নিয়ে গেলে অসুবিধে হতে পারে, ভয় পেয়ে লোকে হয়তো কথাই বলতে চাইবে না। আর, কেউ যদি না কথাই বলে তো খবর পাব কী করে?” 

গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “খবর পাওয়া গেল?” 

কৌশিক বলল, “তা গেল বই কী। মারাত্মক সব খবর। আসলে রহমতপুরে যে এক্সপিরিয়েন্স হয়েছিল, তাতে আমি একটু দমেই গিয়েছিলুম। ভেবেছিলুম যে, এখানেও ওই একই ব্যাপার হবে। তা কিন্তু হল না। বিষ্ণুহাটিতে গিয়ে পৌঁছবার পর ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই একটার পর একটা খবর পেতে লাগলুম! খবর তো নয়, তাজা এক-একটা বোমা!” 

সামন্তমশাই নড়ে-চড়ে বসলেন। বললেন, “তার মানে?” 

“বলছি, সব বলছি।” কৌশিক তার পকেট থেকে একতাড়া কাগজ বার করে বলল, “বুধবার অর্থাৎ গতকাল সারাটা সকাল নৌপালার বাংলোয় বসে এই রিপোর্ট তৈরি করেছি। যাবতীয় খবর রয়েছে এখানে। সব ডিটেল্‌সে বলব?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “রিপোর্টটা আমি কালই পড়েছি। আপনারা আপাতত সংক্ষেপে সব শুনুন। রিপোর্টটা না হয় পরে সময় করে দেখে নেবেন।” 

কাগজের তাড়া পকেটে পুরে কৌশিক বলল, “সেই ভাল। খবরগুলো আপাতত সংক্ষেপে বলছি। আমার প্রথম খবর বিষ্টুচরণ আর যমুনার সম্পর্ক মোটেই মামাতো-পিসতুতো ভাইবোনের নয়।” 

সামন্ত বললেন, “সে কী!” 

“ওদের বাড়ি একই গ্রামে। যমুনার চেয়ে বিষ্টু বছর চার-পাঁচের বড়, তাই ‘দাদা’ বলত। ও-সব মামাতো-ভাইটাই স্রেফ বাজে কথা। যমুনার সঙ্গে বিষ্টুর বিয়ের কথাও হয়েছিল, কিন্তু সেটা ভেস্তে যায়।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “কেন?” 

কৌশিক বলল, “সেটাই হচ্ছে দ্বিতীয় খবর। আপনাদের ধারণা বিষ্টুর অবস্থা খুব খারাপ, চাকরি-বাকরির চেষ্টায় কলকাতায় এসে সে তাই তার ভগ্নিপতির কাছে আশ্রয় নিয়েছিল।” 

গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “কথাটা ঠিক নয়?” 

“মোটেই ঠিক নয়।” কৌশিক বলল, “বিষ্টু খুবই ধনী পরিবারের ছেলে। গাঁয়ের লোকেদের কাছে শুনলুম, স্বনামে-বেনামে বিষ্টুর বাবার বিস্তর জমিজমা তো আছেই, তার সঙ্গে আছে তেজারতি ব্যাবসা। গয়নাগাঁটি বন্ধক রেখে তিনি গাঁয়ের মানুষকে টাকা ধার দেন। সুদের হার অসম্ভব রকমের চড়া, ফলে সুদে-আসলে মিলিয়ে অঙ্কটা যা দাঁড়ায়, তাতে বারো-আনা লোকের পক্ষেই আর পাওনাগন্ডা মিটিয়ে তাদের গয়নাগাঁটি ফেরত নেওয়া সম্ভব হয় না; বিষ্টুর বাবা কেষ্টচরণের লোহার সিন্দুকে জমতে-জমতে সেগুলো পাহাড় হয়ে যায়।” 

সামন্ত বললেন, “বিষ্ণু যে বড়লোকের ছেলে, নকুল তা জানত না? এ তো বড় তাজ্জব কথা আরে মশাই, নকুল তো ওই গ্রামেরই জামাই। মাঝেমধ্যে শ্বশুরবাড়িতে যেতও নিশ্চয়। তা হলে সে এটা জানবে না কেন?” 

“সেইটেই তো মজার ব্যাপার।” কৌশিক বলল, “আপনি বলছেন, শ্বশুরবাড়িতে মাঝে-মধ্যে যেত নকুল। মানে এটাই আপনার বিশ্বাস। তা বিশ্বাসটা যে একেবারে অবাস্তব, তাও নয়। কিন্তু গ্রামের লোকরা বলছে, সেই যে বিয়ের রাত্তিরে নকুল বিষ্ণুহাটিতে গিয়েছিল, তারপর আর একবারও সে ও-মুখো হয়নি।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “বলো কী হে?” 

কৌশিক বলল, “আমি কিছুই বলছি না। গাঁয়ের লোকেদের কাছে যে খবর পেয়েছি, সেটাই আপনাদের শোনাচ্ছি মাত্র।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “নকুল কেন শ্বশুরবাড়ি যেত না, সে-সব কথা কিছু জানতে পারলে?”

“জানবার চেষ্টা করেছিলুম। তবে যাকেই জিজ্ঞেস করেছি, সে-ই বলেছে যে, কেন যেত না তা সে জানে না।” 

“যমুনার বাপের বাড়ির অবস্থা কেমন”“ 

“খুব খারাপ। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় বলে একটা কথা আছে না? প্রায় সেইরকম।”

“বাপ-মা বেঁচে আছে?” 

“বিয়ের সময় বেঁচে ছিল, তার কিছুদিন পরেই তারা মারা যায়। থাকবার মধ্যে ভিটের উপরে একটি ঘর আছে। আর আছে একটা ভাই। তার সঙ্গে দেখা করেছিলুম। কাছেই একটা ইটখোলায় সে মজুর খাটে।” 

“সে কিছু বলল?” 

“ভগ্নিপতির নাম করতেই খেপে গেল সে। খেপবারই কথা। নকুল যখন শ্রীমানী মার্কেটের কাছে থাকত, বাপ মরবার পর যমুনার এই ভাই তখন নাকি সেখানে একবার গিয়েছিল। গিয়েছিল বাপের শ্রাদ্ধের জন্য কিছু টাকা চাইতে। তা ভগ্নিপতি তাকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দেয়।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “নকুল যে শ্বশুরবাড়িতে যেত না কেন, সেটা আন্দাজ করা তা হলে শক্ত হবে কেন? বিয়ের রাত্তিরেই সে বুঝতে পেরেছিল নিশ্চয় যে, এদের অবস্থা খুবই খারাপ, সুতরাং বেশি মাখামাখি করাটা ঠিক হবে না, ও-সব করতে গেলে এরা তার ঘাড়ে চেপে বসতে পারে। সম্ভবত সেইজন্যেই সে আর ও-মুখো হয়নি।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “তা তো হতেই পারে।” 

কৌশিক বলল, “কারণ যা-ই হোক, নকুল তার শ্বশুরবাড়িতে সেই বিয়ের দিনের পরে আর একদিনও যায়নি। তবে গাঁয়ের লোকেদের কাছে শুনলুম, নকুল না-গেলেও যমুনা যেত। দু-মাস তিন মাস অন্তর-অন্তরই যেত। যাওয়া তো খুব শক্ত নয়, হাওড়া থেকে রেলগাড়িতে উঠে বাগনানে নেমে পড়লেই হল। ওখান থেকে বিষ্টুহাটিতে বাসেও যাওয়া যায়, আবার সাইকেল-রিকশাও তো সব-সময়েই চলছে। বাপের বাড়িতে যেতে যমুনার তাই কোনও অসুবিধে ছিল না। যেত, বিষ্টুর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎও হত। গাঁয়ে এই নিয়ে কানাঘুষো হত না, এমনও নয়। যাই হোক, যমুনাও নাকি ইদানীং আর বাপের বাড়ি যেত না। অন্তত গত তিন বছরের মধ্যে যায়নি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বিষ্টুচরণও তো গত তিন বছর ধরেই নকুলদের সঙ্গে রয়েছে, তাই না?” সামন্ত তাঁর নোটবইয়ের পাতা চটপট উলটে বললেন, “হ্যাঁ, ঠিক তিন বছর।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দ্যাট এক্সপ্লেনস?” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “একটা কথার উত্তর কিন্তু এখনও পাইনি, বাবা। বিষ্টুচরণের সঙ্গে যমুনার তো বিয়ে হবার কথা হয়েছিল, সেটা ভেস্তে গেল কেন?” 

“ভেস্তে গেল বিষ্টুর বাবার আপত্তিতে।” 

“কী যেন নাম বললে লোকটার? কেষ্টচরণ, তাই না?” 

“আজ্ঞে হ্যাঁ,” কৌশিক বলল, “এ হল কেষ্টবিষ্টুর ব্যাপার। বিষ্টুর সঙ্গে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যমুনার বাবা গিয়েছিলেন কেষ্টচরণের কাছে। কেষ্ট তো শুনেই বোমার মতো ফেটে পড়লেন। একে তো যমুনার বাপ বংশে ছোট, তার উপরে আবার তাঁর আর্থিক অবস্থাও যাচ্ছেতাই, ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলোয় না, কেষ্টচরণ নাকি তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন, ওই শুধু ঘাড়ধাক্কাটা দিতেই যা বাকি রেখেছিলেন। তিনি বিশাল বড়লোক, অমন হাঘরের ময়েকে ঘরে ঠাঁই দেবেন কেন? কাছাকাছি আর-এক গ্রামের এক ব্যবসায়ীর গলায় গামছা দিয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা বরপণ আর পঁচাশি ভরি গয়না নিয়ে তাঁর মেয়েকে তিনি পুত্রবধূ করে এনে ঘরে তুললেন।” 

“তারপর?” 

“তারপরে ঘটল এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। বিয়ের মাস ছয়েক বাদে এক সকালবেলায় দেখা গেল, বিষ্টুদের বাড়ির ঠাকুরদালানের উঠোনে সেই নতুন বউয়ের রক্তাক্ত লাশ পড়ে রয়েছে, ওদিকে ঠাকুরঘরের ভিতর থেকে…” 

“বিগ্রহটি উধাও নিশ্চয়?” ডাক্তার গুপ্ত প্রশ্ন করলেন। 

কৌশিক হাসল। বলল, “বিগ্রহ তো এক্ষেত্রে একটি শালগ্রাম শিলা। কিছুকাল ধরেই মন্দিরে-মন্দিরে চোরের উৎপাত খুব চলছে, বটে, যেমন বিগ্রহ তেমনি আনুষঙ্গিক অন্য নানা জিনিসও নেহাত কম উধাও হচ্ছে না, তবে কিনা এ-সব জিনিস চুরি হচ্ছে মূলত তার আর্ট-ভ্যালুর জন্যে, বিদেশে যার প্রচন্ড বাজার-দর। কিন্তু শালগ্রাম-শিলার তো কোনও আর্ট-ভ্যালু নেই, অথচ আপনি ঠিকই ধরেছেন, সেই শিলাটিই এক্ষেত্রে হাপিস হয়ে গেল। তাজ্জব ব্যাপার, তাতে আর সন্দেহ কী! চোর যে কেন শালগ্রাম শিলা চুরি করতে গেল, সেটাই বুঝতে পারছি না।” 

গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “পুলিশ-কেস হয়েছিল?” 

কৌশিক বলল, “তা হয়েছিল বই কী। তবে, তখন যিনি থানা-অফিসার ছিলেন, তিনি বললেন, এও আসলে চুরির ব্যাপার। বিগ্রহ চুরি করবার জন্য চোর এসে মন্দিরে ঢুকেছিল, আর শেষ-রাত্তিরে ঘুম থেকে উঠে নতুন বউ গিয়েছিল পুজোর ফুল তুলতে। বাস্, হঠাৎ সে চোরের সামনে পড়ে যাওয়াতেই এই বিপত্তি। তার মাথা না-ফাটিয়ে চোরের কোনও উপায় ছিল না।” 

“চুরি করবার মতো আর-কিছু ছিল সেখানে?” 

“ছিল বই কী!” কৌশিক বলল, “পঞ্চপ্রদীপটাই তো ছিল। তার প্রদীপের অংশটা পিতলের বটে, কিন্তু পিলসুজের অংশটা সোনার পাতে বাঁধানো। ছিল রুপোর বিস্তর বাসনও। চোর সে-সব ছুঁয়েও দেখেনি, বউটাকে মেরে স্রেফ শালগ্রাম-শিলা নিয়ে পালিয়েছে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “গ্রামের লোকেরা এই ব্যাপারে তোকে কী জানিয়েছে, সেটাও তা হলে এঁদের বল।” 

কৌশিক বলল, “গ্রামের লোকেরা বলে বউকে মেরেছে বিষ্টুচরণই। বউটা বড়লোকের মেয়ে বটে, কিন্তু যেমন মোটা, তেমনি কালো, তাই মাথা ফাটিয়ে বিষ্টুই তাকে মেরেছে। ব্যাপারটা অবশ্য বেশিদূর গড়ায়নি। তার কারণ কেষ্টচরণ একে বড়লোক, তায় পঞ্চায়েতের কর্তাব্যক্তি। তা ছাড়া কাকে কীভাবে তুষ্ট করতে হয়, তাও তিনি বেশ ভালই জানেন। ফলে গোটা ব্যাপারটাই ধামাচাপা পড়ে গেল।” 

সামন্ত বললেন, “বউয়ের মাথা কী দিয়ে ফাটানো হয়েছিল?” 

“তা কেউ জানে না। পুলিশও না।” কৌশিক বলল, “যেমন পীতাম্বর চৌধুরি লেনের ঘটনায়, তেমনি হাওড়ায় গ্রামের এই ঘটনাতেও মার্ডার-ওয়েপনের কোনও হদিস নাকি মেলেনি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেষ্টচরণের মন্দিরে নিশ্চয় নতুন শালগ্রাম-শিলা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে?”

“তা তো হয়েছেই।” 

“বাড়িতে ইঁদারা আছে?” 

“নেই।” 

“পুকুর আছে?” 

“তা আছে।” কৌশিক বলল, “পুকুর বললে কমই বলা হয়। বিরাট দিঘি।” 

ভাদুড়িমশাই আমার দিকে তাকালেন। হাসলেন একটু। তারপর বললেন, “মুকুন্দপুরের মনসামূর্তির কথা মনে পড়ছে?” 

“তা পড়ছে বই কী।” আমি বললুম “সেখানে তো মূর্তি দিয়েই মাথা ফাটানো হয়েছিল।”

“এখানে সম্ভবত শালগ্রাম শিলা দিয়েই মাথা ফাটানো হয়েছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “দিঘিতে জাল ফেলে ভালভাবে তল্লাশ চালালেই মনে হয় মার্ডার-ওয়েপনটা খুঁজে পাওয়া যেত।” 

১৮ 

সবাই একেবারে চুপ। কেউ কোনও কথা বলছি না। প্রথম কিস্তির চা আর জলখাবার অনেকক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে। এবারে দ্বিতীয় কিস্তির চা নিয়ে মালতীদের কাজের লোকটি এসে ঘরে ঢুকল। হাত বাড়িয়ে ট্রে থেকে তাঁর চায়ের পেয়ালা তুলে নিলেন গঙ্গাধর সামন্ত। পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, “গোটা ব্যাপারটাই দেখছি অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে।” 

কৌশিক বলল, “মজাটা কী জানেন? বিষ্টুচরণের বাবার সঙ্গে আমি দেখা করেছিলুম। নিজের পরিচয় অবশ্য দিইনি। বলেছিলুম যে, ‘ কলকাতায় তাঁর ছেলের সঙ্গে আমার খুব চেনাশোনা, মাঝে-মঝেই আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হয়। তাতে বিষ্টুচরণের বাবা যা বললেন, তাতে তো আমি অবাক। ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, বিষ্টু যেখানে থাকে, সেই হোটেলে তো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা খুব ভাল নয়, সে কি এর মধ্যে নতুন কোনও হোটেলের সন্ধান পেয়েছে?” 

সামন্ত বললেন, “তার মানে? বিষ্টু যে গত তিন বছর ধরে নকুলের বাড়িতে রয়েছে, তার বাবা তা জানেই না?” 

কৌশিক বলল, “জানেন না বলেই তো মনে হল। ভদ্রলোকের ধারণা, বিষ্টু হোটেলে থাকে। কথায়-কথায় হোটেলটার নামও বললেন তিনি। মির্জাপুর এলাকার হোটেল। নাম ‘শান্তিধাম’। বিষ্টুর নামে ফি মাসে তিনি ওই হোটেলের ঠিকানাতেই টাকা পাঠান। চিঠিও লেখেন ওই ঠিকানাতেই।” 

সামন্ত বললেন, “এখান থেকে একটা ফোন করতে পারি?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বিলক্ষণ। কিন্তু তার দরকার হবে না। থানায় ফোন করে হোটেলে খোঁজ নিতে বলবেন তো?” 

“হ্যাঁ।” 

“কিচ্ছু দরকার নেই। আজ সকালেই কৌশিক ওখানে গিয়েছিল। হোটেলের ম্যানেজার বললেন, বিষ্ণু ওখানে থাকে না, তবে হোটেলের ঘরটাও সে ছাড়েনি। প্রতি সোমবারে একবার করে সে হোটেলটায় যায়। চিঠিপত্র থাকলে নিয়ে আসে।” 

“কিন্তু টাকা?” সামন্ত বললেন, “বাবার কাছ থেকে তো নিয়মিত তার নামে টাকা আসে, হোটেলে তার হয়ে সে-টাকা রিসিভ করে কে?” 

“সে-খবরও কি আর নেওয়া হয়নি ভাবছেন? টাকা রিসিভ করে হোটেলের ম্যানেজার। তাকে ‘লেটার্ অভ্ অথরিটি’ দেওয়াই আছে। না, সামন্তমশাই, হোটেলে লোক পাঠাবার দরকার নেই। তবে হ্যাঁ, থানায় একটা ফোন বোধহয় করাই ভাল। জানিয়ে দিন যে, পীতাম্বর চৌধুরি লেনে যে-লোকটাকে আপনি পাহারায় রেখেছেন, এক্ষুনি লোক পাঠিয়ে তাকে একটা কথা বলে দেওয়া দরকার।” 

“কী বলে দিতে হবে?” 

“বলতে হবে যে, বিষ্টুকে সে যেন বাড়ি থেকে আপাতত বেরুতে না দেয়। কথাটা বলছি কেন জানেন? সাধারণত সোমবার-সোমবার বিষ্ণু ওই হোটেলটায় যায় বটে, কিন্তু বলা তো যায় না, হঠাৎ যদি সে আজ একবার যায় ওখানে, আর গিয়ে শোনে যে, তার সম্পর্কে ওখানে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে, তা হলে সে যে ভয় পেয়ে গা-ঢাকা দেবে না, তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই। নাঃ, কথাটা আমার আগেই ভাবা উচিত ছিল।” 

সামন্তমশাই উঠে গিয়ে ফোন করে ফের ফিরে এলেন। তারপর ধপাস করে তাঁর সোফাটায় বসে পড়ে বললেন, “ওরেব্বাবা, এ তো দেখছি ভয়ঙ্কর ব্যাপার! কেস তো একেবারেই ঘুরে গেল! আর আমি কিনা ভাবছি সদানন্দ বসুই কালপ্রিট, আর-একটু চাপ দিলেই তাঁর কাছ থেকে কনফেশনটা আদায় করে নেওয়া যেত।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আর-একটু চাপ মানে? খানিকটা চাপ কি অলরেডি দিয়েছেন নাকি? পুরো পাঁচদিন তো ভদ্রলোককে একেবারে মুঠোর মধ্যে আপনি পেয়েছিলেন। কনফেশন আদায় করবার জন্যে থার্ড ডিগ্রির ব্যবস্থা করেননি তো?” 

গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “আরে না না, আপনারা কি আমাদের অমানুষ ভাবেন নাকি? মারধরের কথা ভাবছেন নিশ্চয়? ও-সব কিছু হয়নি। ওই আমাদের কস্টেবল রামশরণ পান্ডেকে দিয়ে দু-চারটে চড়-থাপ্পড় মারাবার ব্যবস্থা করেছিলুম মাত্র, তাকে নিশ্চয়ই মারধর বলবেন না আপনারা? ওটুকু তো করতেই হয়।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ছি ছি, মানী লোক, বয়সও হয়েছে সত্তর বছর, তাঁকে চড়-থাপ্পড় লাগাবার ব্যবস্থা করলেন? ছিছি, মিস্টার সামন্ত, কাজটা মোটেই ভাল করেননি।” 

সামন্ত কুণ্ঠিতভাবে বললেন, “তা নিশ্চয় করিনি। কিন্তু কী করব বলুন, আমি তো ধরেই নিয়েছিলুম যে, এটা একেবারে ‘ওপ্‌ন অ্যান্ড শাট’ কেস।”

কৌশিকের সবই ভাল, কিন্তু একটু মুখফোঁড়। গঙ্গাধর সামন্তের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে সে বলল, “আজকাল খুব অ্যামেরিকান ক্রাইম-স্টোরি পড়ছেন বুঝি?” 

গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “কেন, কেন, এ-কথা বলছেন কেন?” 

কৌশিক বলল, “না… মানে মার্কিন গোয়েন্দা-গল্পে ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নিরা প্রায়ই ও-রকম ধরে নেয় কিনা, তাই বলছি। তবে শেষ পর্যন্ত অবশ্য দেখা যায় যে, তারা সাপ ধরতে গিয়ে ব্যাং ধরেছিল।” 

সামন্ত বললেন, “ঠাট্টা করছেন? করুন। ভুল যখন একটা হয়েই গেছে, তখন এই ধরনের কথা তো কিছু শুনতেই হবে। কিন্তু একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ভুল সকলেরই হতে পারে। আমিও বিস্তর ব্যাপারে বিস্তর ভুল করেছি। ভুল এক্ষেত্রে কৌশিকেরও হতে পারত। বিষ্ণুহাটিতে গেলেই যে নির্ভুল নিশানা মিলবে, ও-ই কি সেটা জানত নাকি? সত্যটা যে কী সেটা তো আর ও হিসেব কষে বার করেনি, ভাগ্য ওকে সাহায্য করেছে, হি জাস্ট্ স্টাম্বলড অন ইট।” 

বুঝতে পারলুম যে, সামন্তকে একটা মারাত্মক লজ্জার হাত থেকে বাঁচাবার জন্যেই ভাদুড়িমশাই এ-কথা বলছেন। নয়তো আমি ভালই জানি যে, ভাদুড়ি মশাইয়ের প্রতিটি পদক্ষেপ একবারে হিসেব কষে করা। তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে, সদানন্দবাবু খুনি নন। তা হলে বাকি থাকে যমুনা আর বিষ্টুচরণ। খুন করবার সুযোগ ছিল তাদেরও। শুধু খুনের কোনও মোটিভ তাদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছিল না। সেই মোটিভের সন্ধানেই কৌশিককে তিনি রহমতপুরে আর বিষ্টুহাটিতে পাঠিয়েছিলেন। 

ভাদুড়িমশাই একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর সামন্তকে বললেন, “কোন্ কথাটা আপনি বুঝতে পারছেন না বলুন তো। দেখি বুঝিয়ে দিতে পারি কি না। পারব যে, এমন কথা বলছি না কিন্তু, তবে চেষ্টা করতে পারি।” 

সামন্ত বললেন, “বিষ্টুচরণের সঙ্গে যমুনার বিয়ের কথা হয়েছিল তা অন্তত দশ বছর আগে। অর্থাৎ এটা অনেক দিনের পুরনো ব্যাপার। অথচ কার্যত দেখছি, সেই পুরনো ব্যাপারের জের দশ বছর বাদেও মেটেনি। সত্যি কি এমন হতে পারে নাকি? হওয়া সম্ভব?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কথাটা আপনি মন্দ বলেননি। এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে কী জানে, ব্যাপারটা পুরনো হলেও প্রেমটা পুরনো নয়। আগুনটা ধিকিধিকি জ্বলছিলই। জ্বলত না, যদি যমুনা মাঝে-মাঝেই বাপের বাড়িতে না যেত। কিন্তু সে যেত, আর গাঁয়ের লোকেরা যদি না মিথ্যে ক বলে থাকে, তবে বিষ্টুচরণের সঙ্গে তখন দেখাসাক্ষাৎও হত তার। অর্থাৎ প্রেমের আগুনটা একেবারে নিবে যাবার সুযোগই ইতিমধ্যে পায়নি। আর তারপরে তো বিষ্টুচরণ কলকাতাতেই চলে এল। কিছুদিন একটা হোটেলে কাটিয়ে তারপর উঠলও গিয়ে নকুলের বাড়িতে। ফলে এতদিন যা ধিকিধিকি করে জ্বলছিল, সেই আগুন একবারে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল!” 

সামন্তমশাই বললেন, “তা তো বুঝলুম, কিন্তু নিজের শালাটিকে তো দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল নকুল। তা হলে যমুনা যাকে মামাতো ভাই বলছে, সেই মামাতো শালাটিকে সে তার ঘাড়ে চেপে বসতে দিল কেন? তাকেও তো নকুল ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়াতে পারত। বলুন, পারত না?” 

“তা পারত বই কী।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু তাড়ায়নি কেন, তাও তো আপনার না-বুঝবার কথা নয়। নকুলের জমাখরচের যাবতীয় খাতা তো আপনি সিজ করেছেন; আমি দেখতে চেয়েছিলুম বলে কৌশিকের হাত দিয়ে সেগুলো পাঠিয়েও দিয়েছেন আমার কাছে। তা আপনি নিজে কি সেগুলি একবারও পড়ে দেখেননি?” 

সামন্ত বললেন, “নিশ্চয় পড়েছি। কেন, ওর মধ্যে কিছু আছে নাকি?” 

“আছেই তো। গত তিন বছর ধরে প্রত্যেক মাসের একেবারে পয়লা তারিখেই দেখবেন জমার ঘরে লেখা রয়েছে বি—৫০০.০০ টাকা। ওটার অর্থ বোধহয় আপনি বুঝতে পারেননি। বি মানে বিষ্টুচরণ। প্রতিমাসে সে তার খাইখরচা বাবদ নকুলের হাতে পাঁচশো টাকা তুলে দিত। থাকত মাছের আড়তের এক কোণে, খেতও এমন-কিছু হাতি-ঘোড়া নয়, অথচ তারই জন্যে মাসে-মাসে লোকটা পাঁচশো টাকা দিয়ে যাচ্ছে। এমন হাতের লক্ষ্মীকে কেউ পায়ে ঠেলতে পারে? নকুলও পারেনি। তবে আমার ধারণা, টাকার লোভে বিষ্টুচরণকে সে তার বাড়িতে থাকতে দিয়েছিল বটে, তবে শেষের দিকে হয়তো একটু-একটু সন্দেহ করতে শুরু করেছিল। চেঁচামেচির সেটাই সম্ভবত মস্ত কারণ।” 

ভাদুড়িমশাই একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। সিগারেটটা নিবে গিয়েছিল। অ্যাশট্রেতে পিষে দিলেন সেটাকে। তারপর বললেন, “আমার ধারণা, মাঝরাত্তিরে মত্তাবস্থায় বাড়িতে ফিরে চেঁচামেচি করবার সময়ে যমুনা আর বিষ্টুচরণের সম্পর্ক নিয়ে ইদানীং এমন দু-একটা কথাও সে হয়তো বলতে শুরু করেছিল, যাতে ওরা ভয় পেয়ে যায়। হয়তো তখন থেকেই ওরা নকুলকে সরিয়ে দেবার প্ল্যান আঁটতে থাকে। সদানন্দ যে নকুলকে তাড়াতে চাইছিলেন, জল আর লাইট কেটে দিয়েছিলেন, তাতে আরও সুবিধে হয়ে যায় ওদের। ওরা বুঝতে পারে, নকুল যদি খুন হয়, তা হলে সন্দেহটা সরাসরি সদানন্দবাবুর উপরে গিয়ে পড়বে। সামন্তমশাই, ওরা যে ভুল বুঝেছিল, অন্তত আপনি তো সে-কথা বলতে পারেন না। আপনি যে সদানন্দ বসুকেই খুনি বলে ধরে নিয়েছিলেন, তাতে তো আর সন্দেহ নেই।… না না, আমি আবার বলছি যে, আপনি অত লজ্জিত হবেন না। এ-ভুল আমারও হতে পারত। কেন হয়নি জানেন? 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “কেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমার যে ভুল হয়নি, তার মস্ত কারণ, সদানন্দ বসুর পক্ষে লাঠি দিয়ে যে একটা লোকের মাথা ফাটানো সম্ভব নয়, সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলুম।” 

“লোহার-বল-বসানো লাঠি দিয়েও না?” 

“না, তাও নয়। জানি, আপনারা কী বলবেন। আপনারা বলবেন যে, বয়স সত্তর হলেও সদানন্দ বসুর স্বাস্থ্য টসকায়নি। কিন্তু তাঁর চোখের কথাটা আপনারা ভুলে যাচ্ছেন কেন? কিরণবাবুর কাছেই শুনেছি যে, মাত্রই কিছুকাল আগে ছানি কাটিয়েছেন সদানন্দবাবু, কিন্তু আগের মতো দৃষ্টিশক্তি এখনও ফিরে পাননি। এখন আপনারাই বলুন, যাঁর দৃষ্টিশক্তি বিশেষ ভাল নয়, আর স্বাস্থ্য মোটামুটি পোক্ত হলেও বয়েস অন্তত সত্তর, সেই মানুষের পক্ষে কি মাত্রই এক-হাতে লাঠি চালিয়ে কারও মাথা ফাটানো সম্ভব?” 

সামন্ত বললেন, “দু-হাতে চালাতে বাধা কোথায়?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বাধা থাকত না, যদি কিনা তাঁর দুটোর বদলে তিনটে হাত থাকে। কিন্তু মুশকিল এই যে, যেমন আমাদের তেমনি সদানন্দবাবুরও হাত মাত্র দুটি। তার মধ্যে একটা হাতে যদি টর্চ ধরে থাকতে হয় তো লাঠি চালাবার জন্যে দুটো হাতের সাহায্য তিনি পাবেন কী করে?” 

“সিঁড়ির আলো জ্বেলে রাখলে কিন্তু টর্চ জ্বালবার দরকার হয় না।” 

“কিন্তু যাকে খুন করা হবে, তাকে সাবধান করে দেওয়া হয়। বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসবার আগেই নকুল যদি দেখে যে, সিঁড়ির উপরকার ইলেকট্রিক আলোয় সব একেবারে ঝলমল করছে, তা হলে দরজা থেকেই সে সিঁড়ির দিকে তাকাবে নিশ্চয়, আর তখনই সদানন্দবাবুকে দেখতেও পেয়ে যাবে। তখন আর তার মাথা ফাটানো অত সহজ হবে না।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “কিন্তু এমন যদি হয় যে, সদানন্দের স্ত্রীও এর সঙ্গে জড়িত?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “অর্থাৎ কিনা অন্ধকারে যেই নকুলচন্দ্র বাথরুম থেকে বেরিয়েছে, কুসুমবালাও অমনি দোতলা থেকে সুইচ টিপে সিঁড়ির আলো জ্বেলে দিয়েছেন, আর সদানন্দও অমনি দু’হাতে চালিয়েছেন লাঠি? না মশাই, ইউ আর স্ট্রেচিং ইয়োর ইমাজিনেশান টু মাচ্! একে তো কুসুমবালা বাতের রুগি, ভাল করে নড়াচড়াই নাকি করতে পারেন না, তার উপরে আবার তাঁরও বয়স অন্তত পঁয়ষট্টি। দুই অ্যামেচার বুড়োবুড়ি মিলে এইভাবে গোটা ব্যাপারটাকে একেবারে কাঁটায়-কাঁটায় সিনক্রোনাইজ করে একজনকে খুন করেছে, এ-কথা ভাবা-ই চলে না।”

সামন্ত বললেন, “অর্থাৎ আপনি বলতে চান যে, বিষ্টুচরণই খুনি?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তার পক্ষেও এ-কাজ করা সম্ভব হয় না, যদি না সে যমুনার সাহায্য পায়। তা, খবর যা মোটামুটি জোগাড় হয়েছে তাতে তো মনে হয় যমুনা তাকে সাহায্য করতেই পারে।” 

সামন্ত বললেন, “ঠিক আছে, আজই ওদের দুজনকে অ্যারেস্ট করে হাজতে ঢোকাবার ব্যবস্থা করছি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ও-কাজ এখুনি করবেন না। আগে মার্ডার-ওয়েপনটা খুঁজে বার করা চাই। আপাতত ওদের কড়া পাহারায় রাখুন, গ্রেফতার করবার দরকার নেই। তা ছাড়া নকুলের যে একটা দু’বছরের মেয়ে রয়েছে, তার কথাটাও ভাবুন। বিষ্টু আর যমুনাকে যদি হাজতে ঢোকান, তো ওই দুধের বাচ্চাটাকেও যে মায়ের কাছছাড়া করা যাবে না, সেটা কি ভেবে দেখেছেন?” 

একজন এতক্ষণ একটিও কথা বলেননি, এককোণে বসে চুপচাপ অন্যদের কথা শুনে যাচ্ছিলেন। তিনি ডাক্তার চাকলাদার। এইবারে তিনি মুখ খুললেন। বললেন, “মিস্টার ভাদুড়িকে একটা কথা বলব বলেই আজ আমি এখানে এসেছি। ভেবেছিলুম, কথাটা একমাত্র উনিই জানবেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আপনারা জানলেও ক্ষতি নেই। শুধু দয়া করে বলুন, কথাটা আপনারা আর কাউকে জানাবেন না।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “যদি বুঝি যে, কথাটা আর-কাউকে জানাবার দরকার নেই, তা হলে নাহক কেন জানাতে যাব? কী বলবেন বলে ফেলুন মশাই।” 

ডাক্তার চাকলাদার বললেন, “একটু আগে কমলির কথা হচ্ছিল। আপনাদের ধারণা, ও নকুলের মেয়ে। সেটা ভুল ধারণা।” 

গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “কী বলছেন আপনি?” 

“ঠিকই বলছি। যমুনা ও-মেয়ের মা হতে পারে, কিন্তু নকুল বিশ্বাস ওর বাপ নয়।” 

১৯ 

গোটা ঘর একেবারে নির্বাক। গঙ্গাধর সামন্তের নোটবইটা তাঁর হাত থেকে খসে মেঝের উপরে পড়ে গিয়েছিল। তবু যে তার শব্দ আমরা শুনতে পাইনি, তার কারণ আর কিছুই নয়, ডাক্তার অরুণপ্রকাশ স্যান্যালের এই ড্রয়িংরুমের গোটা মেঝেটাই পুরু কার্পেট দিয়ে মোড়া। নইলে নিশ্চয় একটা পিন পড়লেও তার শব্দ তখন শোনা যেত। 

ডাক্তার চাকলাদারের কথায় যে ধাক্কা লেগেছিল, সেটাকে সামলে নিয়ে ভাদুড়িমশাই-ই প্রথম তাঁর মুখ খুললেন। বললেন, “নকুল নয়? তা হলে কে ওর বাপ?” 

“সম্ভবত বিষ্টুচরণ।” 

সামন্ত বললেন, “প্রমাণ কী?” 

“প্রমাণ তো কম্‌লির মুখের উপরেই লেখা রয়েছে।” ডাক্তার চাকলাদার বললেন, “মেয়ের মুখের সঙ্গে বাপের মুখের এমন আশ্চর্য মিল বড়-একটা চোখে পড়ে না। শনিবার সকালে যখন পাঁচ-নম্বর বাড়িতে যাই, মিলটা তখনই আমার চোখে পড়ে। মানে যমুনা যখন তার মেয়েকে কোলে করে আপনার পায়ের সামনে এসে আছাড় খেয়ে পড়েছিল। বিষ্টুচরণও তো সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে। বিষ্টুর মুখের সঙ্গে কমূলির মুখের মিলটা তবু আপনাদের চোখে পড়ল না? আশ্চর্য!” 

সামন্ত বললেন, “ব্যভিচার যে একটা মোটিভ তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু মুখের মিলকে তো আর ব্যভিচারের প্রমাণ হিসেবে আদালতে দাখিল করা যাবে না। আসামি পক্ষের উকিল বলবে, অমন একটু-আধটু মিল অনেকের সঙ্গেই অনেকের থাকতে পারে। ও সব মিল-টিলের কথা ছাড়ুন। নকুল যে কম্‌লির বাপ নয়, তার এমন কোনও প্রমাণ কোথায়, আদালতে যা পেশ করলে আমাদের বোকা বনতে হবে না?” 

ডাক্তার চাকলাদারকে দেখে মনে হল, তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। বললেন, “ঠিক আছে, দরকার যদি হয় তো তেমন প্রমাণই আমি দেব। তাও আমার কাছে রয়েছে।” 

সামন্তর ভুরু কুঁচকে গেল। বললেন, “তা হলে সেটা প্রথম দিনই আমাদের দেননি কেন?”

প্রশ্নটার জবাব দিলেন না চাকলাদার। সামন্তর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তিনি ডাক্তার সুরেশ গুপ্তের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, “কেন যে কিছু-কিছু কথা আমরা গোপন রাখি, একজন পুলিশ অফিসারের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু মিস্টার গুপ্ত, পুলিশের ডাক্তার হলেও আপনি ডাক্তার তো বটেন, আপনি নিশ্চয় বুঝবেন যে, অনেক কথা জেনেও আমরা মুখ খুলতে পারি না, অন্য-কাউকে তার সামান্যতম আভাস দিতেও আমাদের এথিকসে বাধে। তা ছাড়া, এটা বিশ্বাসরক্ষার ব্যাপার। …রোগী তার ডাক্তারকে বিশ্বাস করে… তাঁকে সে এমন অনেক কথা জানায়, যা হয়তো তার অতি আপনজনকেও সে জানায় না …মানে জানাতে তার সংকোচ হয় …কী, হয় না?” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “হয় বই কী।” 

“অথচ ডাক্তারের কাছে তার কোনও সংকোচ নেই। কেন নেই? না সে ধরেই নিয়েছে যে, ডাক্তারকে সে যা বলছে, আর-কেউ তা ঘূণাক্ষরেও কখনও জানবে না। আমরাও জানি যে, রোগী যা বলছে, তা আমাদের বিশ্বাস করে বলেই বলছে। অন্য-কাউকে সেটা জানাবার কোনও প্রশ্নই নেই। জানালে সেটা ব্রিচ অভ্ ট্রাস্ট হয়ে দাঁড়ায়। কী, আমি ভুল বলছি?” 

ডাক্তার গুপ্ত চুপ করে রইলেন, কোনও উত্তর দিলেন না। 

চাকলাদার বললেন, “কী হল, কিছু বলছেন না কেন? যা হোক কিছু বলুন।” 

“কী আর বলব, বলবার তো কিছুই নেই।” ডাক্তার গুপ্ত মাথা নাড়লেন, “ইউ আর অ্যাবসলিউটলি রাইট। রোগী আপনাকে বিশ্বাস করে যা বলছে, তা কারও কাছে ফাঁস করবার কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না। ইট উইল বি হাইলি আনএথিক্যাল। … না না, ও-সব কথা কাউকে জানাতে আপনি বাধ্য নন।” 

চাকলাদার বিষণ্ণ হাসলেন। বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর গুপ্ত। কিন্তু আমার সমস্যা তাতেই মিটছে না। আমি পড়েছি উভয়-সংকটে। আমি যা জানি…মানে আমার পেশেন্ট আমাকে যা বলেছে, আর তাকে পরীক্ষা করে যা আমি জানতে পেরেছি, তা বলাও অন্যায়, আবার না-বলাও অন্যায়। হয়তো না-বলার অন্যায়টাই আরও মারাত্মক।” 

সামন্ত বললেন, “বড্ড হেঁয়ালি হয়ে যাচ্ছে, ডাক্তার চাকলাদার। একটু ঝেড়ে কাসুন দেখি।” 

সামন্তর কথাটাকে গ্রাহ্যও করলেন না চাকলাদার। তাঁর দিকে একবার ফিরেও তাকালেন না। ভাব দেখে মনে হল যেন তাঁর কথাটা তিনি শুনতেও পাননি। ডাক্তার গুপ্তের দিকেই তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বললেন, “আর সেই জন্যেই এখন আমার মনে হচ্ছে যে, কমলিকে কোলে নিয়ে যমুনা যখন তার ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল, আর তারপর যখন আমি শুনলুম যে, ও নকুলের মেয়ে, তখনই সব কথা আমার জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। তা যদি জানাতুম, মিস্টার সামন্তর সন্দেহটা তা হলে নিশ্চয় তখনই অন্য দিকে ঘুরে যেত; আর-কিছু না হোক, তিনি বুঝতে পারতেন যে, নকুলকে খুন করবার মোটিভ একমাত্র সদানন্দবাবুরই নয়, অন্যদেরও থাকা সম্ভব। আর তা যদি তিনি বুঝতেন, তা হলে নিশ্চয় তড়িঘড়ি একজন বুড়োমানুষকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে তাঁর কাছ থেকে কনফেশান আদায় করবার জন্যে তাঁকে চড়াচাপড় লাগাবার ব্যবস্থা করতেন না।” 

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন চাকলাদার। তারপর বললেন, “কথাটা আমার তখনই বলা উচিত ছিল। কিন্তু আমি বলিনি। কেন বলিনি? না পেশেন্টের রোগের ব্যাপারে যাবতীয় গোপনীয়তা আমাদের রক্ষা করতে হয়, ডাক্তারি পেশার সেটা মস্ত শর্ত। সেই শর্তটাকেই আমি মান্য করে চলছিলুম। কিন্তু ডাক্তার গুপ্ত, আমাকে মার্জনা করুন, কোনও শর্তই এখন আর আমি মান্য করতে পারছি না। আর তা ছাড়া, রোগটা যার, সে তো মারাই গেছে, এখন যদি তার একটা শারীরিক ত্রুটির কথা আমি প্রকাশ করি, তবে অন্তত তার তাতে কোনও ক্ষতি হবারও আশঙ্কা নেই।” 

কৌশিক বলল, “কিসের ক্ষতি?” 

চাকলাদার বললেন, “লোকের কাছে উপহাসের, ঠাট্টা-বিদ্রুপের পাত্র হওয়াটাই কি একটা মস্ত বড় ক্ষতির ব্যাপার নয় : সত্যি বলতে কী, অনেকটা সেই কারণেও এ-সব ত্রুটির কথা অনেকে গোপন করে রাখে, রাখতে বাধ্য হয়।” 

সামন্ত আবার বললেন, “বড্ড হেঁয়ালি হয়ে যাচ্ছে, বড্ড হেঁয়ালি হয়ে যাচ্ছে। ও-সব আগড়ম-বাগড়ম বাদ দিয়ে এবারে কাজের কথায় আসুন তো। নকুল যে কমলির বাপ নয়, তার প্রমাণ কী?”

এক নিশ্বাসে বিস্তর কথা বলে ফেলে বোধহয় চাকলাদার একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। আকস্মিক উত্তেজনাও বোধহয় তাঁর ক্লান্ত বোধ করবার একটা মস্ত কারণ। এতক্ষণে তিনি সামন্তর দিকে চোখ ফেরালেন। স্থির চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর প্রতিটি শব্দকে পৃথকভাবে উচ্চারণ করে খুব শান্ত গলায় বললেন, “শুধু কমলি কেন, কারও বাপ হওয়াই নকুল বিশ্বাসের পক্ষে সম্ভব ছিল না।” 

সামন্ত বললেন, “আমি প্রমাণের কথা বলছিলুম। আপনি প্রমাণ দিতে পারেন?” 

ভাদুড়িমশাই এতক্ষণ কোনও কথা বলেননি। চুপচাপ সব শুনে যাচ্ছিলেন : এবারে বললেন, “তা যে উনি দিতে পারেন, সে তো আগেই বলেছেন।” 

কৌশিক বলল, “আপনার দেখছি অনেক কথাই শুনে থাকে না, মিস্টার সামন্ত। রোজ ব্রাহ্মীশাক খেতে শুরু করুন; শুনেছি ওতে মেমারি খুব বেড়ে যায়।” 

ভাদুড়িমশাই তাঁর ভাগ্নেকে একটা মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, “আঃ, এ-সব কী হচ্ছে কৌশিক? ছেলেমানুষি কোরো না।” 

গঙ্গাধর সামন্তও পাল্টা কিছু-একটা বলবেন বলে কৌশিকের দিকে একবার জ্বলন্ত চোখে তাকিয়েছিলেন। কিন্তু ভাদুড়িমশাই নিজেই যেহেতু ভাগ্নেকে ধমকে দিয়েছেন, তাই তিনি আর কৌশিককে কিছু বললেন না, চাকলাদারের দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, “মুখের কথায় তো চিঁড়ে ভিজবে না ডাক্তান চাকলাদার, আমাকে কেস সাজিয়ে পাবলিক প্রসিকিউটরের হাতে তুলে দিতে হবে; আমি প্রমাণ চাই।” 

চাকলাদার বললেন, “ প্রমাণ দিতে না-পারলে কি আর এ-সব কথা কেউ বলে? তা হলে শুনুন মিস্টার সামন্ত, নকুল তার শরীরের ব্যাপারে যা-কিছু পরীক্ষা করাবার, তা আমাকে দিয়েই করিয়েছি। তার যে বাপ হবার ক্ষমতা নেই, সেই রিপোর্ট তাকে আমি দিয়েওছিলুম। রিপোর্টের ওরিজিন্যাল তার কাছে ছিল, আর কপিটা আমার ফাইলে। ওরিজিন্যালটা আপনারা নকুলের বাড়িতে খুঁজে দেখতে পারেন। তবে আমার ধারণা, সেখানে সেটা পাবেন না। আপনাদের কথাবার্তা যা শুনলুম, তাতে তো মনে হয়, বিষ্টুচরণ অতি ধুরন্ধর ব্যক্তি, রিপোর্টটা সে নিশ্চয় গায়েব করেছে।” 

সামন্ত বললেন, “ তল্লাশি চালিয়ে দু’চারটে প্রেসক্রিপশন, নাসিংহোমের বিল আর টুকটাক কিছু ওষুধপত্রের ক্যাশমেমো পাওয়া গেছে, তবে অমন কোনও রিপোর্ট আমরা পাইনি।” 

চাকলাদার বললেন, “কী করে পাবেন, ওরা সেটা সরিয়ে ফেলেছে। আমার আরও একটা ধারণার কথা আপনাদের বলব?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “নিশ্চয় বলবেন। এ-ব্যাপারে যা কিছু আপনার মনে হয়, সবই খুলে বলবেন। যে লোকটি খুন হয়েছে, আপনি তার ডাক্তার–আপনার প্রতিটি কথাই আমাদের শোনা দরকার।” 

চাকলাদার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন আবার। মনে হল, কথাটা বলতে তিনি একটু দ্বিধা বোধ করছেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য দ্বিধাটা কাটিয়ে উঠলেন তিনি। বললেন, “দেখুন, আমার ভুল হতে পারে, তবু ভেবে দেখলুম যে, বলাই ভাল। আপনারা হয়তো জানেন না যে, কাল রাত্তিরে আমার চেম্বারে চোর ঢুকেছিল।” 

সামন্ত বললেন, “এঁরা না জানতে পারেন, কিন্তু আমি জানি। ভোরবেলায় আপনার ফোন পেয়ে তো আমি লোকও পাঠিয়ে দিয়েছিলুম আপনার চেম্বারে। …ওই যাঃ, নকুলকে আপনি যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন, সেটা তো পাঁচ-নম্বর বাড়িতে আমরা পাইনি, কিন্তু তার একটা কপি তো আপনার কাছে আছে বলছিলেন, সেটাও কাল রাত্তিরে আপনার চেম্বার থেকে চুরি হয়ে যায়নি তো?” 

চাকলাদার বললেন, “চেম্বারে কোনও দামি জিনিস থাকে না। থাকবার মধ্যে ছিল কিছু কাগজপত্র, নোটবই আর ডায়েরি। চোর সেগুলো নেয়নি, তবে ড্রয়ার, আলমারি আর যাবতীয় কাগজপত্র যেভাবে হাঁটকে দেখেছে, তাতে মনে হয়, কিছু একটা খুঁজে বার করতেই সে এসেছিল। মিস্টার সামন্ত, ওইসব কাগজপত্র তো চেম্বারের মেঝেয় ছত্রখান হয়ে পড়ে আছে। ওর উপরে, কি টেবিলের উপরকার কাচের ঢাকনায় কি আলমারির পাল্লায় কি অন্য কোথাও তার আঙুলের ছাপ থেকে যাওয়া কিছু বিচিত্ৰ নয়। আপনারা কি সে-কথা ভেবে দেখেছেন?” 

সামন্ত হেসে বললেন, “আপনারা আমাদের কী ভাবেন বলুন তো? ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে চিন্তা করবেন না, ও-ব্যাপারে যা ইনস্ট্রাকশন দেবার, তা আমি দিয়ে এসেছি। দেখা যাক কোনও দাগি চোরের আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলে যায় কি না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ডাক্তার চাকলাদার কোনও দাগি চোরের কথা ভাবছেন না। উনি ভাবছেন বিষ্টুচরণের কথা। ওঁর ধারণা, চেম্বারের কোথাও যদি আঙুলের ছাপ পেয়ে যান আপনারা, তো বিষ্টুর ফিঙ্গার প্রিন্টের সঙ্গে সেটা মিলেও যেতে পারে। কী ডাক্তার চাকলাদার, আমি কি ভুল বলছি?” 

চাকলাদার বললেন, “মোটেই না। সব রিপোর্টেরই একটা কপি যে আমি ফাইল করে রাখি, বিষ্টু সেটা ভাল জানত।”

সামন্ত বললেন, “বটে?” 

“কী করে জানত, বলি। বিষ্টুর একটু হাঁ, ‘নি-মতো আছে। অন্য সময়ে কষ্ট দেয় না বটে, তবে শীতকালে সেটা ওকে মাঝেমধ্যে ভোগার। ওর ডাক্তার ওকে তাই ব্লাড টেষ্ট করতে বলেছিলেন। তাঁর অ্যাডভাইস অনুযায়ী বিষ্টু আমার ল্যাবরেটরিতে টেস্টটা করিয়েছিল। তার রিপোর্ট আমি ওকে দিয়েওছিলুম। কিন্তু সেটা ও হারিয়ে ফেলে। আমাকে সে-কথা বলতে আমি বলি, ঠিক আছে, সব রিপোর্টেরই তো একটা কপি আমি ফাইল করে রাখি, এটাও আছে, কপি দেখে নতুন করে একটা রিপোর্ট লিখে দিচ্ছি। তো আমার ধারণা, নকুলকে যে রিপোর্ট আমি দিয়েছিলুম, বিষ্টু জানত যে, সেটার কপিও আমার কাছে রয়েছে, আর সেই কপিটা গায়েব করবার জন্যেই কাল রাত্তিরে সে আমার চেম্বারে এসে ঢুকেছিল। অবশ্য আমার ধারণাটা ভুলও হতে পারে।” 

“ঢুকল কী করে?” 

“জানলার কাচ খুলে। চেম্বারে তো আর দামি কিছু থাকে না। তাই জানালায় আর গ্রিলও বসাইনি।” 

সামন্ত বললেন, “কপিটা গায়েব হয়ে যায়নি তো?” 

চাকলাদার বললেন, “নিশ্চিন্ত থাকুন, সেটা দোতলায় থাকে। শুধু ওই একটা কপি নয়, যাবতীয় রিপোর্টের কপি আমার দোতলার ঘরে রাখি। ফলে সেটা খোয়া যায়নি। দরকার হলে জানাবেন, তার একটা জেরক্স কাল সকালেই আপনাকে পাঠিয়ে দেব।” 

সামন্ত বললেন, “বাঃ, কাজ তো তবে চোদ্দো-আনাই মিটে গেল। বাকি রইল শুধু মার্ডার-ওয়েপনটা খুঁজে বরা করা। তা সেটারও একটা হদিস নিশ্চয় শিগগিরই করে ফেলতে পারব।” 

কথাটা তিনি এমনভাবে বললেন যেন যাবতীয় হদিস এ-পর্যন্ত তিনিই করেছেন। 

ডাক্তার গুপ্ত উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “নটা বাজতে চলল, এবারে তা হলে যাওয়া যাক।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কাল আপনারা একটু সময় দিতে পারবেন?” 

সামন্ত বললেন, “কেন বলুন তো?” 

“ব্যাপারটা নিয়ে আর-একবার বসবার দরকার ছিল।” 

“এইখানে?” গঙ্গাধর সামন্ত যেন আঁতকে উঠলেন। “না মশাই, আমরা সেন্ট্রাল ক্যালকাটার মানুষ, রোজ-রোজ অ্যাদ্দুর ঠেঙিয়ে আসতে পারব না।” 

“এখানে আসতে হবে কে বলল?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “খুন যেখানে হয়েছে, সেই জায়গাটা তো আমি এখনও দেখিইনি। তাই ভাবছিলুম যে, কাল বিকেল ছ’টায় আমরা কিরণবাবুর বাড়িতে বসব। আপনি যে-সব খাতা আর কাগজপত্র সিজ করেছেন, সেগুলোও না হয় তখনই ফেরত দেওয়া যাবে। আজ সেগুলো আমার কাছেই থাক। কোনও আপত্তি নেই তো?” 

গঙ্গাধর সামন্ত হেসে বললেন, “কিচ্ছু না। তবে হ্যাঁ, একটা কথা। জলখাবারের ব্যবস্থাটা যেন এইরকম হয়।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “নিশ্চিন্ত থাকুন, ওটা এর চেয়ে ঢের ভাল হবে। কিরণবাবুর স্ত্রী বাসন্তীকে আমি অনেক কাল ধরে দেখছি তো, অমৃত যে কাকে বলে, কালই আপনারা বুঝতে পারবেন।” 

এবারে আমার আঁতকে ওঠার পালা। একে তো বাড়িতে গ্যাস নেই, কালকের মধ্যে সিলিন্ডারটা পাব কি না, তাও জানি না, তার উপরে আবার দিন কয়েক বাদেই মেয়ের পরীক্ষা শুরু হবে, এই সময়ে বাড়িতে বৈঠক বসছে শুনলে বাসন্তী না খেপে যায়। 

অরুণ সান্যাল আর মালতী এসে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের কাছে বিদায় নিয়ে আমরা নীচে নেমে এলুম। ডাক্তার গুপ্তকে নিয়ে সামন্ত তাঁর জিপে উঠলেন, আমি উঠলুম চাকলাদারের মরিস মাইনরে। 

সেলফের চাপি ঘোরাতেই ইঞ্জিন গোঁ-গোঁ করে উঠল। চাকলাদার বললেন, “ব্যাটা একেবারে বাঘের বাচ্চা! চলুন, মনটা হালকা হয়ে গেছে, একটু ঘুরপথে আজ বাড়ি ফিরব।” 

“ঘুরপথে মানে?” 

“পার্ক সার্কাস থেকে আর লোয়ার পার্কুলার রোড ধরব না, ডাইনে ঘুরে চার-নম্বর ব্রিজ পেরিয়ে বাইপাস ধরব। তারপর স্টেডিয়ামের কাছে বাঁয়ে টার্ন নিয়ে বেলেঘাটা মেন রোড ধরে শেয়ালদা ফ্লাই-ওভারে উঠলেই তো আমাদের পাড়ায় পৌঁছে যাচ্ছি?” 

“ওরে বাবা, সে তো বিস্তর পথ।” 

“পথ অবশ্যই বেশ কয়েক কিলোমিটার বেশি, তবে সময় লাগবে কম। একেবারে উড়ে চলে যাব। তা ছাড়া গাড়ির মেরামতিটা কেমন হল, তারও একটা পরীক্ষা হয়ে যাবে।” 

বাইপাসে পড়েই অ্যাকসিলেটারে চাপ বাড়ালেন চাকলাদার। পুরনো আমলের গাড়ি, কিন্তু মনে হল যেন সতিই তার দু’পাশে দুটো ডানা গজিয়ে গেছে। পাস দেবার জন্যে পিছন থেকে একটা লরি ক্রমাগত হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছিল, খানিক বাদে পিছনে তাকিয়ে সেটাকে আর দেখতে পেলুম না। 

আধ ঘন্টার মধ্যেই পীতাম্বর চৌধুরি লেনে পৌঁছে গেলুম। সারাটা পথ চাকলাদার আর কোনও কথা বলেননি। এতক্ষণে তিনি মুখ খুললেন। রাস্তার একধারে গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে বললেন, “নকুল বিশ্বাস যে একটা ভুল বিশ্বাস নিয়ে তারা গেল, সেটা ভেবে দেখেছেন?” 

“অর্থাৎ?” 

“বুঝতে পারছেন না?” তিক্ত হেসে চাকলাদার বললেন, “বিষ্টুকে সে যমুনার মামাতো ভাই বলেই জানত। এদিকে সে নিজেকে পরীক্ষা করিয়ে জেনে গিয়েছিল যে, যমুনা বাঁজা নয়, আসলে তার নিজেরই নেই বাপ হবার ক্ষমতা। ফলে, যমুনা যখন প্রেগন্যান্ট হল, আর তারও কিছুকাল বাদে যমুনার মেয়ের মুখে যখন স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল বিষ্টুচরণের মুখের আদল, নকুল তখন ধরেই নিল যে, মামাতো-পিসতুতো ভাইবোনের মধ্যে একটা ইনসেসচুয়াস সম্পর্কের জন্যেই এটা হয়েছে। আরে মশাই, বিষ্টু যে যমুনার মামাতো ভাই নয়, এটাই সে জানত না।”