শ্যামনিবাস-রহস্য – ১০

১০

ভোরবেলায় যখন পাঁচ নম্বর বাড়িতে এসে ঢুকি, যমুনাকে তখন ডেডবডির পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলুম। ফোন করে ফিরে আসার পর থেকে আর তাকে দেখতে পাইনি। অনেকক্ষণ থেকেই অবশ্য চাপা একটা কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তাতেই বুঝেছিলুম যে, সে তার শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকেছে, সেখানে বসে কাঁদছে। একটানা কান্নার শব্দ। সেইসঙ্গে ভেসে আসছিল, টুকরো-টুকরো কিছু কথা। যে-রকমের কথা, তাতে মনে হচ্ছিল, কাঁদতে কাঁদতেই কাউকে সে সমানে গালমন্দ করে যাচ্ছে। কাকে গালমন্দ করছে, নিজের ভাগ্যকে না আর-কাউকে, তা অবশ্য বোঝা যাচ্ছিল না। 

সদানন্দবাবুর স্ত্রী কুসুমবালা যে বাতের রুগি, আগেই সে কথার উল্লেখ করেছি। ভদ্রমহিলা বিশেষ হাঁটাচলা করতে পারেন না, করেনও না। সদানন্দবাবুর সঙ্গে তিনিও ইতিমধ্যে একবার নীচে নেমে এসেছিলেন। নীচে নেমে যমুনাদের ঘরেও ঢুকেছিলেন একবার। খুব সম্ভব সান্ত্বনা দিতেই গিয়েছিলেন, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকেননি। ভিতরে একটা চেঁচামেচি শুনেছিলুম, কিন্তু সেটা যে কী নিয়ে তা বুঝতে পারিনি। তার পরেই অবশ্য যমুনার ঘর থেকে কুসুমবালা বেরিয়ে আসেন। দেড়তলার ল্যান্ডিংয়ে এখন একটা মোড়ার উপরে তিনি বসে আছেন। শুনছেন কে কী বলে। নিজে কিছু বলছেন না। 

সদানন, তাঁকে বললেন, “বাচ্চাটাকে উপরে নিয়ে গিয়ে কিছু খাইয়ে দিলে পারতে। ও তো আজ কিছুই খায়নি। অবিশ্যি খাবেই বা কী, আজ তো দুধই আনতে পারলুম না।” 

কুসুমবালা বললেন, “দুধের জন্যে আটকাচ্ছে না। ও তো আর হরিণঘাটা কি মাদার ডেয়ারির দুধ খায় না, টিনের দুধই খায়। সে-দুধ তো ওর জন্যে দু-টিন কিনেই রেখেছি।” 

সদানন্দবাবু বললেন, “তা হলে আর দেরি কোরো না। ওর মাকে একটু বুঝিয়ে শুঝিয়ে ওকে উপরে নিয়ে যাও।” 

কুসুমবালা বললেন, “বোঝাতেই তো গিয়েছিলুম, তা শুনছে কে। কমলিকে কিছুতেই ছাড়ল না।”

গঙ্গাধর সামন্ত কথা বলছিলেন ডাক্তার গুপ্ত আর কৌশিকের সঙ্গে। কিন্তু সদানন্দবাবু আর কুসুমবালার কথাবার্তাও তাঁর কানে যাচ্ছিল নিশ্চয়ই। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে কুসুমবালাকে তিনি প্রশ্ন করলেন, “কমলিটা আবার কে?” 

উত্তরটা কুসুমবালার বদলে সদানন্দই দিলেন। বললেন, “নকুলের মেয়ে।” তারপর কুসুমবালাকে বললেন, “যমুনাকে একটু ভাল করে বুঝিয়ে বলো। না-বুঝবার তো কিছু নেই।” 

কুসুমবালা বললেন, “তবেই হয়েছে। যমুনা তখন আমাকে কী বলল জানো?” 

সদানন্দবাবু কিছু বলবার আগেই সামন্ত তাঁকে আড়াল করে দাঁড়ালেন। তারপর খর চোখে কুসুমবালার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী বলল?” 

কুসুমবালা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মুখ খুলবারও সময় পেলেন না। চারদিক থেকে ক্যানেস্তারা পিটিয়ে হাঁকোয়া করতে শুরু করলে রাগী বাঘিনি যেমন ক্রমাগত কোণঠাসা হতে-হতে তারপর হঠাৎ এক সময় জঙ্গলের আড়াল থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে, মেয়েকে কোলে করে ঘর থেকে ঠিক তেমনি করেই ছুটে বেরিয়ে এসে যমুনা বলল, “বাপকে মেরে এখন মেয়েকে সোহাগ দেখানো হচ্ছে। ঝ্যাঁটা মারি তোদের সোহাগের মুখে। কী ভেবেছিস তুই রাক্ষুসি, অ্যাঁ? ভেবেছিস যে, কিছুই আমি জানি না! জানি, জানি, জানি। কমলির বাপকে তোরাই মেরেছিস। হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোরাই!” 

তারপরেই সে গঙ্গাধর সামন্তের সামনে এসে আছাড় খেয়ে পড়ল। চেঁচিয়ে বলল, “দারোগাবাবু, জলজিয়ন্ত মানুষটাকে ওরাই খুন করেছে। ওদের আপনি ফাঁসিতে লটকে দিন, দারোগাবাবু, ফাঁসিতে লটকে দিন!” 

গোটা ব্যাপারটা এমন হঠাৎ করে ঘটল যে, আমি একেবারে হতবাক। সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখলুম, তাঁর ঠোট থরথর করে কাঁপছে। যেন কিছু বলতে চাইছেন তিনি, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনও কথা সরছে না। কুসুমবালা স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। কৌশিক, চাকলাদার আর ডাক্তার গুপ্তও স্তম্ভিত। শুধু গঙ্গাধর সামন্তই দেখলুম হকচকিয়ে যাননি। কড়া ধাতের থানা-অফিসার। যমুনা তাঁর পায়ের কাছে পড়ে ছিল। সেখান থেকে দু’পা পিছিয়ে এসে কঠিন গলায় তিনি যমুনাকে বললেন, “এখন ও-সব থাক। একটু বাদেই তো আপনার সঙ্গে আমরা কথা বলব। কাকে আপনার সন্দেহ হয়, সে-কথা তখনই শোনা যাবে! এখন আপনি ঘরে যান। আমরা কাজ করতে এসেছি। কাজ করতে দিন।” 

মেঝের উপর থেকে হাত ধরে তুলে বিষ্টুচরণই যমুনাকে আবার তার শোবার ঘরে পৌঁছে দিয়ে এল। ডাক্তার চাকলাদার বললেন, “উরেব্বাবা, এই বুঝি নকুলবাবুর স্ত্রী?” 

বিষ্টুচরণ বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ।” 

“আর যাকে কোলে করে এনেছিল, সেই বাচ্চা মেয়েটি?” 

“ওর মেয়ে কমলি।” 

“মেয়েটা কবে হল?” 

“গত বছরের আগের বছর চোতমাসে হয়েছে।” সিঁড়ির ল্যান্ডিং থেকে কুসুমবালা বললেন, “গত বুধবারই তো ওর জন্মদিন গেল।” 

ডাক্তার চাকলাদার আর কিছু বললেন না। মাথা নিচু করে কী যেন ভাবতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ এক সময় মুখ তুলে গঙ্গাধর সামত্তের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার আর এখানে কোনও কাজ নেই তো?” 

ডাক্তার গুপ্তকে সামন্ত বললেন, “ওকে দিয়ে কি আর কোনও দরকার আছে আমাদের?” 

“কিছু না।” গুপ্ত বললেন, “এখন ওঁকে ছেড়ে দিন। পরে যদি দরকার হয় তো আমরাই বরং ওঁর ল্যাবরেটরিতে গিয়ে দেখা করব।’ 

সামন্ত বললেন, “ঠিক আছে, ডক্টর চাকলাদার, আপনি এবারে যেতে পারেন। অনেকক্ষণ আপনাকে আটকে রেখেছিলুম, তার জন্যে কিছু মনে করবে না।” 

চাকলাদার চলে গেলেন। 

থানা থেকে ইতিমধ্যে আরও দুজন লোক এসে পৌঁছেছিল। সদানন্দবাবু আর বিষ্টুচরণকে উদ্দেশ করে সামন্ত বললেন, “এরা এই বাড়িটা একটু সার্চ করে দেখবে, আপনাদের তাতে আপত্তি নেই তো?” 

সদানন্দ বললেন, “কিছুমাত্র না।” 

সামন্ত বললেন, “ধন্যবাদ। আপনারা কেউ এঁদের সঙ্গে থাকুন।” তারপর লোক দুটির দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “তা হলে তোমরা কাজ শুরু করে দাও। একেবারে ছাত থেকে শুরু করবে।” 

যাকে বললেন, সে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই তাকে একপাশে খানিকটা সরিয়ে নিয়ে গিয়ে নিচু গলায় কিছু বললেন। কী খুঁজতে হবে, সেটাই জানিয়ে দিলেন সম্ভবত। লোক দুটিকে সঙ্গে নিয়ে উপরে চলে গেলেন সদানন্দবাবু। কুসুমবালা সেই থেকে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়েই বসে ছিলেন। এবারে তিনিও উঠে দাঁড়ালেন। স্বামীকে বললেন, “চলো, আমিও তোমার সঙ্গে যাচ্ছি।” 

বিষ্টুচরণও ইতিমধ্যে ঘরে গিয়ে ঢুকেছিল। সম্ভবত তার বোনকে বলতে গিয়েছিল যে, একটু বাদেই একতলা সার্চ হবে। 

সিঁড়ির সামনের জায়গাটায় এখন আমরা চারজন রয়েছি। সামন্ত, ডাক্তার গুপ্ত, কৌশিক আর আমি। পুলিশের পাহারাদারটিও রয়েছে অবশ্য। তবে সে ঠিক এই জায়গাটায় নেই। সদর-দরজার সামনে তাকে মোতায়ান করা হয়েছিল, সেইখানেই সে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “কী দিয়ে আঘাত করার ফলে মৃত্যু হয়েছে, তাই নিয়ে কথা হচ্ছিল। হ্যাঁ, ইট, পাথর, নোড়া, রেঞ্চ, হাতুড়ি, মুগুর বাটখারা, অনেক কিছু দিয়েই ও-রকম আঘাত করা সম্ভব। মানে এমন আঘাত যাতে মাথার খুলি ফেটে যায়। তা মিস্টার সামন্ত, আপনি কি আশা করছেন যে, সার্চ করে অমন-কিছু পাওয়া যাবে?” 

সামন্ত বললেন, “দেখা যাক, তল্লাসি তো চলছে। ওই ধরনের জিনিস যা-কিছু পাওয়া যাক, পরীক্ষার জন্যে আটক করা হবে। গেরস্ত বাড়িতে ও-সব জিনিস কিছু-না-কিছু থাকেই। কিন্তু থাকলেই তো আর হল না, পরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত হওয়া চাই যে, যে-সব জিনিস পাওয়া গেল, তারই কোনও একটা দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “তা তো বটেই, কিছু-একটা পাওয়াই যথেষ্ট নয়, পরীক্ষা করে দেখতে হবে। তার আগে কোনও সিন্ধান্ত করবার উপায় নেই।” 

কৌশিক বলল, “মিস্টার সামন্ত ঠিক-কথাই বলেছেন। নোড়া, হাতুড়ি, রেঞ্চ কি এই ধরনের আরও নানা জিনিস যে গেরস্ত বাড়িতে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। না-থাকলেই বরং আমি অবাক হব।” 

সামন্ত বললেন, “এ সব জিনিস যে থাকতেই পারে একটু আগে আমিই সে কথা বলেছি, তা-ই না?” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “ঠিকই বলেছেন।” 

সামন্ত বললেন, “না মশাই ঠিক বলিনি।” 

আমি বললুম, “সে কী, বেঠিকটা কী বললেন? যে-ক’টা জিনিসের নাম করা হল তার সবই তো গেরস্তবাড়িতে থাকে। রেঞ্চ হাতুড়ি কিংবা এই ধরনের জিনিসও গেরস্তকে রাখতে হয়। কল-টল সারাবার কাজ অনেকে নিজেই করে নেন, তাতেই ও-সব লাগে। সব সময়ে তো আর প্লাম্বারকে ডেকে পাওয়া যায় না, তাই রেঞ্চ আর হাতুড়ি না-রেখে উপায় নেই। অন্তত সদানন্দবাবুকে তো অনেক সময় এ-সব খুঁটিনাটি কাজ আমি নিজের হাতেই করতে দেখেছি।” 

সামন্ত বললেন, “আরে মশাই, রেঞ্চ আর হাতুড়ির কথা আমি ভাবছি না।” 

“তা হলে কিসের কথা ভাবছেন?” 

“আমি ভাবছি নোড়ার কথা।” 

“কেন নোড়াই বা কী অপরাধ করল?” 

গঙ্গাধর সামন্ত বললেন, “তাও বুঝতে পারছেন না? তা হলে ভাবুন যে, নোড়া কোন্ কাজে লাগে।” 

“কেন, মশলা বাটার জন্যেই তো নোড়া রাখতে হয়। নোড়া না-থাকলে মশলা বাটা হবে কী দিয়ে? “অবশ্য অবশ্য।” গঙ্গাধর সামন্ত হেসে বললেন, “তা হলে এবারে ভাবুন যে, ক’টা বাড়িতে আজকাল মশলা বাটা হয়। আরে মশাই, সব বাড়িতেই আজকাল গুঁড়ো মশলা দিয়ে কাজ চলছে, সুতরাং নোড়ার কোনও ভূমিকাই কোথাও নেই। দি রোল অফ নোড়া হ্যাজ বিন কমপ্লিটলি প্লেড আউট।” 

গঙ্গাধর সামন্ত হাসতে লাগলেন। হাসি থামবার পরে আমি বললুম, “কথাটা কিন্তু ঠিক হল না।” 

“কেন, এবারে আবার বেঠিকটা কী বললুম?” 

“অনেকেই যে আজকাল গুঁড়ো মশলা ব্যবহার করছেন, সেটা বেঠিক কথা নয়। কিন্তু তাঁদের বাড়িতেও হয়তো নোড়ার সন্ধান মিলবে। কাজ ফুরিয়েছে বলেই যে নোড়াটা তাঁরা ফেলে দিয়েছেন এমন না-ও হতে পারে; হয়তো হেঁশেলের মধ্যেই সেটা ফেলে রেখেছেন। গেরস্ত-বাড়িতে এমন কত জিনিসই তো থাকে, আসলে যা কোনও কাজেই লাগে না।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “কথাটা আপনি মন্দ বলেননি।” তারপর সামন্তের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আই থিংক হি হ্যাজ এ পয়েন্ট দেয়ার!”

আমি বললুম, “আর তা ছাড়া এটাও ভেবে দেখুন যে, গুঁড়ো মশলার চলন হয়েছে কোন ধরনের পরিবারে। মোটামুটি সেইসব পরিবারেই হয়েছে, যেখানে গিন্নিরাও চাকরি-বাকরি করেন। কাজে বেরুবার তাগিদে রান্নার পাট তাঁদের চটপট চুকিয়ে নিতে হয়, ফলে মশলা-বাটাবাটির ঝামেলার মধ্যে তাঁরা যেতে চান না। নোড়াও অতএব আউট। পুরনো আমলের গিন্নিরা কিন্তু গুঁড়ো মশলায় অতটা বিশ্বাসী নন, তাঁরা এখনও শিলের উপরে নোড়া দিয়ে মশলা পিষে নেন। তা সদানন্দবাবুর গিন্নিটি যে পুরনো আমলের মানুষ, সে তাঁকে দেখেই আপনারা বুঝেছেন। তো আমার বিশ্বাস, অন্তত তাঁর হেঁশেলে শিল-নোড়ার ভূমিকা এখনও শেষ হয়নি।” 

সামন্ত মশাই বললেন, “ঠিক আছে, আই উইথড্র মাই স্টেটমেন্ট। তবে কিনা নোড়া দিয়েই যে নকুলচন্দ্রের মাথা ফাটানো হয়েছে, তাও কিন্তু আমি ভাবছিলুম না।” 

ডাক্তারবাবু বললেন, “তা হলে কী ভাবছিলেন?” 

সদানন্দবাবুর লাঠিটা সামন্তের হাতে ধরাই ছিল। সেটার দিকেই খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর বললেন, “আমি ভাবছিলুম অন্য কথা।” 

কৌশিক চুপচাপ আমাদের কথা শুনছিল। এবারে সে এগিয়ে এসে বলল, “কী ভাবছেন সেটা বোঝা মোটেই শক্ত নয়। লাঠিটা একবার দেখতে পারি?” 

কৌশিকের দিকে লাঠিটা এগিয়ে দিয়ে সামন্ত বললেন, “সাবধানে ধরুন। জায়গায় জায়গায় রক্তের ছিটে লেগে আছে, মুছে না যায়।” 

লাঠির মাথায় যে লোহার বল বসানো, এইটে দেখেই কৌশিকের ভুরু দুটো একটু উপরে উঠে গিয়েছিল। খানিক বাদেই সে-দুটো আবার যথাস্থানে ফিরে এল। সামন্তের হাতে লাঠিটা ফিরিয়ে দিয়ে সে বলল, “আপনার ধারণা, এইটে দিয়েই খুন করা হয়েছিল, তাই না?” 

সামন্ত বললেন, “করা কি অসম্ভব?” 

কৌশিক বলল, “তা কেন বলব? বিশেষ করে যে-দিকটায় লোহার বল বসানো রয়েছে সেই দিক দিয়ে তেমন-তেমন জোরে মারতে পারলে মানুষ তো মানুষ হাতির মাথাও হয়তো ফাটিয়ে দেওয়া যায়। ….কিন্তু না, আর নয়, আপনি আপনার জেরার কাজ শুরু করুন। অনেক বেলা হয়েছে, আমি এবারে চলি।” 

কৌশিক চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাকে বলল, “কাল তো আমাদের বাড়িতে আপনার আসবার কথা, তাই না?” 

বললুম, “হ্যাঁ, কালই তো রবিবার।” 

“আসবেন কিন্তু। মামাবাবু বিশেষ করে বলে দিয়েছেন।” 

১১ 

পাড়ায় দেখলুম সদানন্দবাবুর যেমন আমার মতো কিছু শুভার্থী আছেন, তেমনি শত্রুও নেহাত কম নেই। বরং শত্রুর সংখ্যাই বেশি। তার কারণ অবশ্য আর কিছু-ই নয়, ঈর্ষা। সদানন্দবাবুর অবস্থা যে তাঁর প্রতিবেশীদের তুলনায় কিছুটা সচ্ছল সে-কথা আমরা আগেই বলেছি। যে-কথা বলা হয়নি, সেটা এই যে, স্রেফ সেই সচ্ছলতার কারণেই অনেকে তাঁর উপরে বিশেষ সন্তুষ্ট নন। ভাড়াটে খুন হয়েছে, আর খুনি হিসেবে সদানন্দবাবুকেই পুলিশ সন্দেহ করছে, এই কথাটা চাউর হতে খুব দেরি হল না। শুনে তাঁরা বলাবলি করতে লাগলেন, ঠিক হয়েছে, ব্যাটা যেন ধরাকে সরা জ্ঞান করছিল। এখন বোঝো ঠ্যালা। যেমন কর্ম তেমনি ফল! অর্থাৎ তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন যে, অপকর্মটা সদানন্দবাবুই করেছেন, আর তার ফল ভোগ না-করেও তাঁর নিস্তার নেই। 

মনটা ভাল নেই। রাত হয়েছে, কোনওক্রমে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় এসে শুয়ে পড়েছি, কিন্তু ঘুম আসছে না। ব্যাপারটা নিয়ে যত ভাবছি, মন যেন ততই আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সদানন্দবাবুর মুখখানা বারবার ভেসে উঠছে আমার চোখের সামনে। খানাতল্লাসির পর্ব শেষ হবার পর পুলিশ যখন তাঁকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়, তখন যে তাঁকে কী অসহায় দেখাচ্ছিল। 

যা দিয়ে একটা মানুষের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া যায়, তল্লাসি করে এমন জিনিস নেহাত বম পাওয়া যায়নি। ইট, পাথর, নোড়া, রেঞ্চ আর হাতুড়ি তো বটেই, একটা বেশ মোটামতন শাবলও পাওয়া গিয়েছে। সবই সদানন্দবাবুর সম্পত্তি। তল্লাসিটা প্রথমদিকে চলেছিল উপর-উপর। পরে উইটনেস রেখে বাক্স-প্যাঁটরা- সিন্দক-আলমারি সবই হাঁটকে দেখা হয়। তাতে যেমন নকুলের মাছের আড়তে একগাদা বাটখারা পাওয়া যায়, তেমনি সদানন্দবাবুর আলমারি থেকেও একটা এক-কিলো ওজনের বাটারা বেরিয়ে পড়ে। তবে, সবচেয়ে বেশি মুশকিল বাধিয়েছে ওই লোহার-বল-বসানো লাঠিটাই। সামন্ত সম্ভবত ধরেই নিয়েছেন যে, ওই লাঠি দিয়েই নকুলের মাথা ফাটানো হয়েছিল। তাঁর কথা শুনে অন্তত সেইরকম মনে হয়। 

খুনি হিসেবে যে সদানন্দবাবুকেই তিনি সন্দেহ করছেন, সেটাকে অবশ্য অস্বাভাবিকও বলা যায় না। তিনি বাড়িওয়ালা। ভাড়াটের উপরে তিনি প্রসন্ন ছিলেন না। ভাড়াটে যাতে উঠে যেতে বাধ্য হয়, তার জন্যে জল দেওয়া বন্ধ করেছিলেন, এমনকি ইলেকট্রিক লাইনও কেটে দিয়েছিলেন একদিনের জন্যে। তার উপরে আবার নকুলের লাশের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল তাঁকেই। সামন্তের সন্দেহ তো হতেই পারে। 

সন্দেহের একটা কাঁটা যে আমার মনেও খচখচ করছিল না, তা-ই বা কী করে বলি। একদিকে যেমন সদানন্দ বাবুর অসহায় দুখখানা আমার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল, অন্যদিকে তেমনি বারবার আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল সদানন্দবাবুর সেই কথাটা, বৃহস্পতিবার সকালে আমার বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে যাবার সময় যা তিনি খুব উত্তেজিতভাবে আমাকে বলে গিয়েছিলেন। 

কী বলেছিলেন সদানন্দবাবু? ভাড়াটে তাড়াবার জন্যে দরকার হলে যে গুন্ডা লাগাতেও পিছপা হবেন না, শুধু এইটুকু বলেই তো ক্ষাও হননি তিনি, সেইসঙ্গে যোগ করেছিলেন এই ভয়ঙ্কর কথাটা যে, গুন্ডা লাগাবারই বা দরকার কী, “এই যে লাঠিটা দেখছেন না, এটাই যথেষ্ট, এইটে দিয়েই ওর মাথা ফাটিয়ে ছাড়ব।” 

তা হলে কি শেষপর্যন্ত সেই কাজই তিনি করলেন? করা যে অসম্ভব, তাও বলা যাচ্ছে না। শারীরিক সামর্থ্যের দিক থেকে তো নয়ই। ভদ্রলোকের একমাত্র অসুবিধা চোখ নিয়ে। ছানি কাটিয়েছন ঠিকই….কিন্তু দৃষ্টির সেই আগের মতো জোর আর ফিরে পাননি। তবে শরীর এখনও রীতিমতো মজবুত। এই যে এতদিন এখানে আছি, সদানন্দবাবুকে একদিনও বিছানায় পড়ে থাকতে দেখলুম না। জ্বর নেই, জারি নেই, সর্দি নেই, কাশি নেই, ছেলেছোকরাদের মতোই টগবগে টনকো-তাজা স্বাস্থ্য, তাই নিয়ে একটু জাঁকও করেন, লোহার বল বসানো ওই লাঠিটা দিয়ে একটা নেড়িকুত্তার মাথাও ফাটিয়ে দিয়েছেন, মানুষের মাথা ফাটানোই বা তবে একেবারে অসম্ভব হবে কেন? বিশেষ করে সিঁড়ির দু’ধাপ উপরে যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখান থেকে তো কাজটা আরও সহজ হবার কথা। গঙ্গাধর সামন্ত এই ব্যাপারটার উপরে দেখলুম খুবই জোর দিচ্ছেন। 

কিন্তু সত্যিই কি কাজটা সদানন্দবাবু করেছেন? ভাড়াটেকে তুলে দেবার জন্য জল আর লাইটের লাইন কেটে দিয়েও যখন সুবিধে হল না, তখন তাকে খুনই করে বসলেন? ভেবে ভেবে কোনও কূলকিনারা পাচ্ছিলুম না। এক-একবার মনে হচ্ছিল যে, বিচিত্র কী, মানবচরিত্র বড়ই জটিল, বড়ই রহস্যময় ব্যাপার, তার কতটুকুই বা বুঝি আমরা? এ তো প্রায় সমুদ্রে ভাসমান সেই হিমশৈলের মতোই, জলের উপরে যার সামান্য অংশই আমরা দেখতে পাই, আর বেশির ভাগটাই গোপন থেকে যায় জলের তলায়। সদানন্দবাবুর ক্ষেত্রেও হয়তো সেটাই ঘটেছে। তাঁর চরিত্রের খুব সামান্যই আমি দেখেছি, বাদবাকিটার সম্পর্কে কোনও ধারণাই আমার ছিল না। বাইরে তিনি সদানন্দ, হাস্যময়, পরোপকারী প্রতিবেশী, কিন্তু ভিতরে ভিতরে হয়তো খুবই নিষ্টুর। এতই নিষ্ঠুর যে, একটা জলজ্যান্ত মানুষকে মেরে ফেলতেও তাঁর হাত কিছুমাত্র কাঁপেনি। 

এক-একবার এইরকম ভাবছিলুম আমি, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হচ্ছিল যে, না, এটা সম্ভব নয়, এটা হতে পারে না। সদানন্দবাবুর পক্ষে কাউকে খুন করা একেবারেই অসম্ভব একটা ব্যাপার। 

ভদ্রলোক এখন থানা-হাজতে রয়েছেন। আজ আর আমি অফিসে যাইনি। বারোটা নাগাদ লাশ সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করা হল। তারপর জিপে তুলে সদানন্দবাবুকে নিয়ে যাওয়া হল থানায়। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আমি আর শম্ভুবার্ এই দৃশ্য দেখলুম। শম্ভুবাবুর অবস্থাও আমারই মতো। সদানন্দবাবুকে তিনিও বিশেষ শ্রদ্ধা করেন, ভালবাসেন। বললেন, “কী করা যায় বলুন তো?” 

করবার কিছুই ছিল না। একে শনিবার, তায় বেলা একটা বাজে। তাই জামিনের ব্যবস্থা করা যায়নি। কালও করা যাবে না। যা-করবার সোমবারে করতে হবে। 

এখন একমাত্র ভরসা ভাদুড়িমশাই। ভাগ্য ভাল যে, তিনি কলকাতায় রয়েছেন। সদানন্দবাবুকে যে আমি উপকারী একজন বন্ধু হিসেবে গণ্য করি, সকালে ফোনেই সে-কথা ভাদুড়িমশাইকে আমি জানিয়েছিলুম। নিজে আসতে না পারলেও নিশ্চয় সেইজন্যেই তিনি কৌশিককে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমি আর বাসন্তী যদি খুব মিনতি করে বলি যে, এই খুনের তদন্তের ভার তাঁকে নিতেই হবে, তা হলে কি দরকার হলে আরও কিছু দিন তিনি কলকাতায় থেকে যাবেন না? মনে তো হয় থেকে যাবেন। 

কৌশিকের উপরেও আমার আস্থা অবশ্য নেহাত কম নয়। বয়স মাত্র ছাব্বিশ সাতাশ, কেমিস্ট্রিতে এম. এসসি. করে আর চাকরি-বাকরির চেষ্টা করেনি, মামার লাইন ধরেছে। অর্থাৎ গোয়েন্দাগিরিতে তার অভিজ্ঞতা মাত্র চার-পাঁচ বছরের। কিন্তু এরই মধ্যে যে কিছুটা নাম করেছে, তাতে বোঝা যায় যে, ছেলেটার অভিজ্ঞতা যতই কম হোক, বুদ্ধিটা পাকা। মেদবর্জিত ছিপছিপে লম্বা চেহারা, গায়ের রং বাবার মতো ফর্সা নয়, মায়ের মতো তামাটে। আর অসম্ভব রকমের ধারালো চোখ দুটি দেখে তার মামার কথাই বারবার আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল। 

নেবুতলার ঘটকবাড়ির জোড়া-খুন নিয়ে যে মামলা চলছিল, কৌশিকের পাকা বুদ্ধির প্রমাণ তাতেই প্রথম পাওয়া যায়। এ হল গত বছরের ঘটনা। তার আগেও সে খুচরো কয়েকটা কাজ করেছিল বটে, কিন্তু এটাই ছিল তার ব্রেক-থ্র। এই মামলায় যাবতীয় সাক্ষ্যপ্রমাণ সে এত নিপুণভাবে সাজিয়ে দিয়েছিল যে, নিশ্চিত প্রাণদন্ড থেকেও ‘সন্দেহের অবকাশে’ খুনের আসামিদের বাঁচিয়ে দেবার ব্যাপারে যিনি সিদ্ধহস্ত, সেই দুদে ব্যারিস্টার সুধাকান্ত মজুমদারও ঘটক অ্যান্ড চৌধুরি এন্টারপ্রাইজের জুনিয়ার পার্টনার অমরেশ চৌধুরিকে কিছুতেই খালাস করিয়ে আনতে পারেননি। আদালতের রায়ের যে অংশটাকে ওবিটার ডিক্‌টাম বলা হয়, হাইকোর্টের প্রবীণ জজ আবদুল কুরেশি তাতে কৌশিকের কর্মনৈপুণ্য ও কর্তব্যনিষ্ঠার খুব প্রশংসাও করেছিলেন। বলেছিলেন, স্রেফ পুলিশ বিভাগের গাফিলতির জন্যই অনেক ক্ষেত্রে তদন্তের কাজে অস্বাাবিক দেরি হয়ে যায়, আর তারই পরিণামে লোপাট হয়ে যায় অনেক সাক্ষ্যপ্রমাণ। ফলে, নেহাতই সন্দেহের অবকাশে আসামিদের সে-সব ক্ষেত্রে মুক্তি না দিয়ে আদালতের উপায় থাকে না। কিন্তু এ-ক্ষেত্রে সাক্ষ্যপ্রমাণ অতি দ্রুত সংগ্রহ করা হয়েছে, এবং যথাসময়ে সেগুলি দাখিল করবার ব্যাপারেও কোনও শৈথিল্য ঘটেনি বলেই সমাজের পক্ষে অতিশয় বিপজ্জনক ও অত্যন্ত নৃশংস এক অপরাধীকে সেই শাস্তি দেওয়া গেল, যা তার প্রাপ্য ছিল। 

মিঃ জাস্টিস আবদুল কুরেশির রায় পাঠ করায় অনেকে অবাক হয়েছিলেন। আমি হইনি। তার কারণ সে ভাদুড়িমশাইয়ের ভাগ্নে। মামার ওণ যে কিছু-না-কিছু সে পাবেই, তা যেন আমি ধরেই নিয়েছিলুম। আসলে হত্যাকান্ডের ধরন দেখে খুনির চরিত্র কীভাবে অগ্রিম আন্দাজ করে নিতে হয়, হত্যার ফলে কে কোন দিক দিয়ে কতটা উপকৃত হচ্ছে, সেইটে বুঝে নিয়ে তদন্তের একটা ছক কীভাবে তৈরি করে নিতে হয়, এভিডেন্স কীভাবে সংগ্রহ করতে হয়, এবং মামলা কীভাবে কোন পথ ধরে এগোতে পারে, সে-দিকে খেয়াল রেখে যাবতীয় সাক্ষ্যপ্রমাণকে সাজাতেই বা হয় কীভাবে, মামার কাছেই কৌশিক সে-বিষয়ে যৎপরোনাস্তি তালিম পেয়েছে। সুতরাং তদন্তের ব্যাপারে সে যে কোনও পর্যায়েই কোনও ফাঁক রাখবে না, এটাই স্বাভাবিক। 

নেবুতলার কেসটাতে সে মার্ডার-ওয়েপনটিও একেবারে ঝটিতি উদ্ধার করে, এবং সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে দেয় যে, অস্ত্রটি আর কিছুই নয়, আসলে সেটা অমরেশ চৌধুরিরই অফিস ঘরের কলমদানের মধ্যে অতিশয় যত্নে রাখা একটা নকশা-কাটা বিদেশি পেপার-নাইফ। নিহত ঘটক-দম্পতিই যে বিদেশ থেকে ঘুরে এসে ধারালো সেই কাগজ-কাটা ছুরিটি অমরেশ চৌধুরিকে উপহার দিয়েছিলেন, কাগজে এই ঘটনাটা সেদিন ‘নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস’ বলে বর্ণিত হয়েছিল। 

পাঁচ-নম্বর বাড়ির ক্ষেত্রে যে মার্ডার-ওয়েপন কোনটা তা এখনও জানা যায়নি। গঙ্গাধর সামন্ত অবশ্য ধরেই নিয়েছেন যে, লাশের পাশে যে লাঠিটা পড়ে ছিল, লোহার বল বসানো সেই লাঠি দিয়েই নকুলচন্দ্রের মাথা ফাটানো হয়েছে। তবে কৌশিকের মুখের ভাব দেখে মনে হল, সামন্তের এই সিন্ধান্ত সে ঠিক মেনে নিতে পারছে না। ঘটনাস্থল থেকে সে যখন চলে আসে, তাকে এগিয়ে দিতে আমিও তখন সদর দরজা পর্যন্ত এসেছিলুম। সেইসময়ে সে আমাকে বলে যে, সামন্তমশাই যা ভাবছেন, কেসটা তত সহজ-সরল নয়। তাতে আমি বলি, “তোমার কী মনে হয়, বলো তো। সদানন্দবাবুই খুনি?” প্রশ্ন শুনে কৌশিক একটুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপরে বলে, “উনি যে খুব বিপদে পড়েছেন, তাতে সন্দেহ নেই। 

কৌশিক তার মারুতিতে উঠে স্টার্ট দেবার আগে ভাদুড়িমশাই সম্পর্কেও দুটো-একটা কথা হল। জিজ্ঞেস করেছিলুম, “তোমার মামাবাবু এবারে কী কাজ নিয়ে এসেছেন?” তাতে কৌশিক একগাল হেসে বলল, “আর বলবেন না কিরণমামা, একটা রেসের ঘোড়ার ব্যাপার।” 

“তার মানে?” 

“তা হলে শুনুন। মাদ্রাজ থেকে একটা রেসের ঘোড়াকে নাকি কলকাতায় পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু মধ্যপথে ট্রেনের ওয়াগন থেকে সেটা হাপিস হয়ে যায়। ঘোড়ার মালিক কলকাতার এক বিরাট ব্যবসায়ী। বিস্তর টাকা খর্চা করে সে মামাবাবুকে কলকাতায় নিয়ে আসে। গ্র্যান্ডে তুলতে চেয়েছিল, কিন্তু মামাবাবুকে তো আমার চেয়ে আপনি অনেক ভাল জানেন, তিনি গ্র্যান্ডে উঠলেন না, এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি আমাদের ওখানে চলে এলেন। তা রেসের ঘোড়া উদ্ধার করবার জন্যে মামাবাবুকেই দেখলুম একেবারে রেসের ঘোড়ার মতো ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। ক’টা দিন যা ধকল গেল ওঁর সে আর বলবার নয়।” 

“ঘোড়াটা উদ্ধার হয়েছে?” 

“বিলক্ষণ। কাজ কমপ্লিট; ঘোড়া এখন তার মালিকের আস্তাবলে। ব্যাপার কী জানেন, জাল কাগজপত্র দেখিয়ে মধ্যপথে একটা স্টেশনে একজন লোক ওয়াগন থেকে ঘোড়াটাকে নামিয়ে নিয়েছিল। হেঁজিপেঁজি লোক নয়, তারও প্রচুর পয়সা, মস্ত কারবার। মামাবাবুর তদন্তে তার জারিজুরি যখন ফাঁস হবার উপক্রম, তখন সে নিজেই এসে ঘোড়াটা ফেরত দিয়ে যায়। শুধু তার একটা অনুরোধ, স্ক্যান্ডালটা যেন খবরের কাগজ টের না পায়…..ওঃহো কথাটা আপনাকে বলে ফেললুম। আপনিও যে খবরের কাগজের লোক, তা আমার মনেই থাকে না।” 

“কাল সকালে তুমি বাড়িতে থাকছ তো?” 

“আপনি আসছেন আর আমি থাকব না?” কৌশিক হেসে বলল, “নিশ্চয় থাকব। আসবেন কিন্তু……উইদাউট ফেইল। …. মামি আর পারুলকেও নিয়ে আসুন। মা খুব বলছিল।” 

বললুম, “পারুলের পরীক্ষা, তাই যেতে পারবে না। আর তোমার মামিই বা ওকে ছেড়ে এখন যায় কী করে?” 

“ঠিক আছে, আপনিই আসুন।” 

গলি থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে টার্ন নিল কৌশিকের গাড়ি। আমি আবার ভিতরে চলে এলুম। 

শুয়ে শুয়ে এই সব কথাই ভাবছি। ঘুম আসছে না। কৌশিককে বিদায় দিয়ে ফিরে আসবার পরে গঙ্গাধর সামন্ত যে মন্তব্য করেছিলেন, সেটা মোটেই আশাপ্রদ নয়। সামন্ত বলেছিলেন, “প্রাইভেট ডিটেকটিভদের সম্পর্কে পুলিশের নাকি একটা অ্যালার্জি থাকে। কই মশাই, আমার তো কোনও অ্যালার্জি নেই। দরকার হলে ওঁদের সাহায্য নেব বই কি। তবে কিনা দরকার হবে বলে মনে হয় না। এ তো একেবারে জলের মতো সোজা ব্যাপার।” 

ডাক্তার গুপ্ত কোনও কথা বলেননি। চুপ করে ছিলেন। তবে সামন্তের কথা শুনেই আমি বুঝতে পেরে গিয়েছিলুম যে, ভদ্রলোক মনঃস্থির করে ফেলেছেন। যে সিদ্ধান্ত করেছেন, তার আর নড়চড় হবার উপায় নেই। 

এইসব ভাবতে-ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলুম আমি। 

.

পারুল এসে যখন আমার ঘুম ভাঙাল, তখন প্রায় আটটা বাজে। বলল “মা খুব রাগারাগি করছে, বিছানা ছেড়ে এবারে উঠে পড়ো বাবা।” 

আম’কে তুলে দিয়ে পারুল আবার পড়তে চলে গেল। বাসন্তী ইতিমধ্যে ঘরে এসে ঢুকেছিল। বলল, “বাজার করতে হবে না? চটপট মুখ-হাত ধুয়ে বেরিয়ে পড়ো। তোমাকে রওনা করিয়ে দিয়ে আমি একবার ও-বাড়ি যাব।” 

“কেন, ও-বাড়িতে আবার কী হল? 

“নতুন-কিছু হয়নি। ওদের কাজের মেয়েটা একটু আগে একবার এসেছিল। বলল, কুসুমদি সারা রাত ঘুমোননি, সকালেও খুব কান্নাকাটি করছেন।” 

“তা তো করবেনই। আজ রবিবার, ফলে আজ জামিনের ব্যবস্থা করা যাবে না। হুট করে যে কেন ওঁকে ধরে নিয়ে গেল। ভদ্রলোক কি তাঁর বাড়ি আর বউ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন?”

বাসন্তী বলল, “আর কথা নয়, বাথরুমে যাও, তারপর বাজার করে নিয়ে এসো। তোমার নাহয় নেমন্তন্ন রয়েছে, আমাদের তো মুখে কিছু দিতে হবে। এদিকে বাড়িতে সব বাড়ন্ত। অন্তত মাছটাও যদি থাকত তো আজকের দিনটা চালিয়ে নিতুম। নাও চটপট বেরিয়ে পড়ো। তুমি বাজারে গেলে সেই ফাঁকে আমি কুসুমদির কাছ থেকে একটু ঘুরে আসব।” 

বাথরুমে ঢুকে পড়লুম। বুঝতে পেরেছিলুম যে, বাসন্তীর গলা এখন ক্রমেই চড়তে থাকবে। 

১২

ভাদুড়িমশাই এবারে কলকাতায় এসেছেন তা প্রায় বছর দুই বাদে। দেখে ভাল লাগল যে, তাঁর শরীর ইতিমধ্যে একটুও টসকায়নি। অরুণ সান্যালও দেখলুম ভালই আছেন। ভাদুড়িমশাই মাঝখানে একবার টেলিফোন ধরবার জন্যে ঘর থেকে উঠে গিয়েছিলেন। তখন মালতীকে জিজ্ঞেস করলুম, “ব্যাপার কী বলো তো? অরুণের শুনেছিলুম শরীর বিশেষ ভাল নয়, কিন্তু কই, তোমার কর্তাকে দেখে তো তা মনে হচ্ছে না।” 

উত্তরটা অরুণই দিলেন। বললেন, “বুঝলেন না কিরণদা, ওই কথা বলে দাদাকে আটকে রাখা হয়েছে আর কি। নইলে তো কাজ মিটবার সঙ্গে-সঙ্গেই উনি চলে যাচ্ছিলেন।” 

মালতী মুখ টিপে হাসল। তারপর বলল, “দাদা যে এই বয়সেও এত খাটাখাটি করছে কেন, বুঝতে পারছি না। একটামাত্র মেয়ে, তা সে তো তার স্বামীর সঙ্গে বিদেশে থাকে। বউদিও সেই কবেই স্বর্গে গেছেন। তা হলে আর এত খাটাখাটি করছে কার জন্যে? কোনও মানে হয়? এত বলি যে, ব্যাঙ্গালোরের অফিসটা গুটিয়ে ফেলে এবারে কলকাতায় ফিরে এসে একটু থিতু হয়ে বোসো, তা সে-কথা শুনছে কে। আপনি একটু বুঝিয়ে বললেও তো পারেন।” 

কৌশিক বলল, “কালই তো কিরণমামাকে আমি বলছিলুম যে, মামাবাবুর এবারে বড্ড ধকল গেল। এই বয়সে এত দৌড়ঝাঁপ করা ওঁর ঠিক হচ্ছে না।” 

বললুম, “সে তো আমি যখনই দেখা হয়, তখনই বলি। এও বলেছি যে, আপনার এখন আর এত ছোটাছুটি করা ঠিক নয়। আপনার ভূমিকা হওয়া উচিত কনসালট্যান্টের। লোকে আপনার কাছে পরামর্শ নিতে আসবে, আপনি একটা ফি নিয়ে বলে দেবেন যে, কোন পথে কীভাবে তদন্তটা হওয়া উচিত। ব্যাস, ঝামেলা মিটে গেল। তা উনি সে-কথায় কানই দেন না। যত বলি, তত হাসেন। আসলে ব্যাপারটা যে কী তা তো তোমাদের না-বুঝবার কথা নয়। মানুষটা আসলে কাজ- পাগলা, সবকিছু নিজের হাতে করতে ভালবাসেন।” 

ভাদুড়িমশাই ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, “সব শুনেছি, সব শুনে ফেলেছি।” 

“কী শুনলেন?” 

“ওই আমাকে নিয়ে যে-সব কথা হচ্ছিল। ঠিক আছে, যা চাইছেন তা-ই হবে, অন্তত আপনাদের এই পীতাম্বর চৌধুরি লেনের কেসটাতে আমি নিজের হাতে কিছু করব না। করবার অবশ্য দরকারও নেই, কৌশিকই তো রয়েছে। আমি স্রেফ পরামর্শ দেব। এতদিন তো নিজের হাতে সব করেছি। এবারে দেখা যাক কনস্যালট্যান্ট হয়ে কদ্দুর কী করা যায়। তবে হ্যাঁ, জায়গাটা কিন্তু স্বচক্ষে একবার দেখব।” 

“আজই বিকেলে চলুন।” 

“আজ যাব না।” 

“কেন, আবার কী অসুবিধে ঘটল? বলেন, তো আমি ফোন করে গঙ্গাধর সামন্তকে একটা খবর দিয়ে রাখি। হাতে কোন জরুরি কাজ না-থাকলে বিকেল নাগাদ তিনিও সেখানে হাজির থাকবেন।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “অসুবিধে ওই গঙ্গাধর সামন্তকে নিয়েই। আজ বিকেলে সে তো ওখানে যেতে পারবে না। অন্য জায়গায় তার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট রয়েছে যে!” 

“কোথায়?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “বুঝতে পারছেন না?” 

কৌশিক বলল, “অত হেঁয়ালি কোরো না মামা।বু। বলেই দাও?”

মালতী বলল, “আমিই বলে দিচ্ছি কিরণদা, তোমাদের ওই থানা-অফিসারটিকে আজ বিকেলে আমাদের এখানে চা খেতে বলা হয়েছে। কিন্তু আন নয়, এবারে তোমরা খেয়ে নাও। তবে এখুনি বলে দিচ্ছি, খাবার টেবিলে বসে এ-সব খুন-জখম নিয়ে কিন্তু একটা কথাও বলা চলবে না। এ-সব কথা পরে হবে।” 

তা-ই হল। কলকাতায় এখন চ্যাপলিন-উৎসব চলছে। তারই সূত্রে মঁসিয়ে ভের্দুর প্রসঙ্গটা একবার উঠছিল বটে, কিন্তু কৌশিক যে-ই না ভাদুড়িমশাইকে বলতে শুরু করেছে, ‘আচ্ছা মামাবাবু, পাথরের সঙ্গে একটা দড়ি বেঁধে আর দড়ির মাথায় একটা ফাঁস লাগিয়ে ভদ্রলোক ওই যেখানে তাঁর… মানে কী বলব… তাঁর নতুন বউয়ের গলায় সেটা…’ মালতী অমনি কটমট করে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বলল, “থাক, থাক, এখন আর ও-সব কথার দরকার নেই, যথেষ্ট হয়েছে।” 

কৌশিক চুপ করে গেল। অরুণ একবার হাসিমুখে বলেছিলেন, “কেন, খুনের কথা বললে কী হয়? উইল দ্যাট স্পল ইয়োর অ্যাপিটাইট?” তাতে মালতী তাঁকেও এমন ধমক কষাল যে, অরুণ আর তারপরে একবারও মুখ খুলবার সাহস পেলেন না। 

খাওয়া-দাওয়ার পরেই যে পীতাম্বর চৌধুরি লেনের প্রসঙ্গটা উঠল তাও নয়। ভাদুড়িমশাইয়ের ঘরে ঢুকে দুজনেই গড়িয়ে নিলুম খানিকক্ষণ। গড়ানো মানে ঘুম নয়, শুয়ে শুয়ে ঘন্টা দেড়েক হরেক বিষয়ে গল্প চলল। তিনটে নাগাদ চা নিয়ে এল মালতী। চা খেয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “সামন্তকে সাড়ে-চারটেয় আসতে বলেছি, নিজেদের মধ্যে কথাবাতাটা তার আগেই সেরে নেওয়া যাক।” তারপর মালতীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ রে, কৌশিক বাড়িতে আছে তো?” 

মালতী বলল, “কোথায় আর যাবে, শুয়ে শুয়ে রাজ্যের ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছে।”

“তা হলে ওকে একবার এ-ঘরে পাঠিয়ে দে।” 

কাপ-প্লেট তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল মালতী। তার মিনিট খানেক বাদেই কৌশিক এসে ঢুকল। ভাদুড়িমশাই বললেন, “হ্যাঁ রে কৌশিক, ব্যাকগ্রাউন্ডটা তো মোটামুটি বুঝতে পেরেছি; তুই ওখানে যাবার পর যা-যা ঘটেছে, তারও একটা রিপোর্ট তোর কাছে কাল শোনা গেল। এখন বল তো সব্বাইকে বাদ দিয়ে একা ওই সদানন্দের উপরেই সামন্তের সন্দেহটা এ-ভাবে পড়ছে কেন?” 

কৌশিক বলল, “ওর সন্দেহের কারণ আপাতত দুটি। প্রথমত, যে ভাড়াটেকে তুলে দেবার জন্যে বাড়িওয়ালা নানানভাবে চেষ্টা করছে, আর সেই চেষ্টার কথাটা বলেও বেড়াচ্ছে সবাইকে, তার উপরে আবার জল আর লাইটের লাইন কেটে দেবার মতো দু-দুটো ক্রিমিন্যাল অফেন্স করতেও ছাড়েনি, সেই ভাড়াটে যদি হঠাৎ এইভাবে বাড়ির মধ্যেই মারা পড়ে, তো বাড়িওয়ালাই যে তাকে মেরেছে, এমন সন্দেহ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। যেটাকে খুন-খারাবির ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে, পুলিশ সেখানে মোটিভের সন্ধান করবেই। তা সদানন্দবাবুর ক্ষেত্রে যে সেটা ছিল, সে তো আর অস্বীকার করা চলে না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এটা তো প্রথম কারণ। দ্বিতীয় কারণটা কী?” 

“সেটাও তুমি আন্দাজ করেছ নিশ্চয়। সামন্তর সন্দেহের প্রথম কারণ যদি হয় মোটিভ তো দ্বিতীয় কারণ সুযোগ। খুন করবার একটা সুযোগ চাই তো, তা সদানন্দবাবুর সেটা ভালই ছিল।” 

“মোটিভ আর সুযোগ।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “খুনের একটা মোটিভ চাই, একটা সুযোগও চাই। ঠিক কথা। কিন্তু ও-দুটো বস্তু কি শুধু সদানন্দেরই ছিল? আর কারও ছিল না?” 

কৌশিক বলল, “থাকতে পারে, না-ও থাকতে পারে। তবে সদানন্দবাবুর যে দুটোই ছিল সেটা মিথ্যে নয়। তার উপরে আবার ওই যে ওখানে লোহার বল লাগানো লাঠিটা পাওয়া গেল, সামন্তের সন্দেহ তার ফলে আরও জোরদার হয়েছে।” 

“অর্থাৎ একেবারে ওয়ান-ট্র্যাক মাইন্ডের ব্যাপার। কিন্তু চোখ তো আর একটা নয়। তা হলে কথামালার সেই একচক্ষু, হরিণের মতো শুধু একটা দিকেই দেখছে কেন?” 

কৌশিক বলল, “কী জানি। লাঠিটা অবশ্য দাঁড়াচ্ছে না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সে তো বুঝলুম। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। হ্যাঁ রে কৌশিক, তুই তো আজ সকালে আমার নাম করে টেলিফোনে সামন্তর সঙ্গে কথা বললি। জেরায় কে কী বলেছে, সেটা বোঝা গেল?” 

“সামন্ত কিছু বললে তবে তো বুঝব। আমাকে তো কিছু জানাতেই চায় না। যা-ই জানতে চাই উত্তরে শুধু বলে যে, বিকেলে তো যাচ্ছিই, তখন সিসিবিকে সব বলা যাবে।” 

“ঠিক আছে।” 

ভাদুড়িমশাই একটা সিগারেট ধরালেন। 

আমি বললুম, “সিগারেটটা এখনও ছাড়তে পারলেন না?”

“আপনি ছেড়েছেন?”

“একেবারে যে ছেড়েছি, তা বলতে পারব না। তবে কমিয়েছি।” 

“আমিও গোটা চার-পাঁচের বেশি খাই না।” 

কৌশিক বলল, “আমি তা হলে নিজের ঘরে যাই মামাবাবু?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “সিগারেটের কথা শুনেই উঠে পড়বার ইচ্ছে হল বুঝি? যা তা হলে, খেয়ে আয়। তবে বেশি দেরি করিস না।” 

কৌশিক রেগে গিয়ে বলল, “কী যে বলো! ওই সব ছাইভষ্ম আমি খাই নাকি? ওর চেয়ে একটা রসগোল্লা খাওয়া ভাল।” 

“রসগোল্লাও একটা-দুটোর বেশি খাস না। জানিস তো সর্বমত্যন্তং গর্হিতম্। কোনও কিছুরই অতিশয্য ভাল নয়। যেমন অন্য-সব ব্যাপার তেমনি খাওয়ার ব্যাপারেও এটা একেবারে খাঁটি কথা। যা-ই হোক, সিগারেট খাওয়ার তাড়া যখন নেই, তখন একটু বোস, তোর সামনেই কিরণবাবুকে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করি। সদানন্দবাবুর ব্যাপারে ওঁর মতামতও তোর শুনে রাখা ভাল।” 

আমি বললুম, “কী জিজ্ঞেস করবেন করুন, আমি যা জানি সবই আপনাকে খোলাখুলি বলব।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দেখুন মশাই, নকুলচন্দ্র কীভাবে কখন মারা গেল, আর এটা যদি খুনের ব্যাপারই হয়, তা হলে কে-ই বা খুন করল তাকে, তার বিন্দুবিসর্গও আপনার জানবার কথা নয়। তার কারণ ঘটনাটা যখন ঘটে, তখন সেখানে আপনি ছিলেন না। সুতরাং ও-ব্যাপারে আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করে কোনও লাভ নেই, আর তা আমি করছিও না। আমি আপনাকে এমন প্রশ্ন করব, যার উত্তর দেওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব।” 

“বেশ তো, তা-ই করুন।” 

“সদানন্দবাবুকে আপনি কতদিন ধরে চেনেন?”

“যতদিন ও পাড়ায় আছি, ততদিন ধরেই চিনি। তা ধরুন দশ বছর তো হলই।” 

“লোকটিকে আপনার কেমন লাগে?” 

“ভালই তো লাগে। গায়ে পড়ে একটু উপদেশ-টুপদেশ দেন ঠিকই, ‘এটা খাবেন না, ওটা করবেন, না’ বলেন, তা সেও তো আমাদের ভালর জন্যেই বলেন। না মশাই, লোকটি খারাপ নন, পরোপকারী সজ্জন সদালাপী মানুষ 

“উনি কাউকে খুন করতে পারেন বলে আপনার মনে হয়?” 

“সেইটে ভেবেই তো কূলকিনারা পাচ্ছি না। এটা ঠিকই যে, নকুলচন্দ্রকে উনি ভুলে দিতে চাইছিলেন। ওর জল আর লাইটের কানেকশন যে কেটে দিয়েছিলেন, সেটাও মিথ্যে নয়। তা ছাড়া, নকুলের ডেডবডি তো কাল সকালে সিঁড়ির নীচে পড়ে থাকতে দেখা গেল, তার মাত্র দুদিন আগে অর্থাৎ বিষ্যুতবার সকালে আমার বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে আসবার সময় উনি এমন কথাও বলেছিলেন যে, কিছুতেই যখন নকুলচন্দ্রকে তাড়ানো যাচ্ছে না, তখন দরকার হলে ওঁর ওই লোহার বল বসানো লাঠিটা দিয়েই উনি নকুলের মাথা ফাটিয়ে ছাড়বেন।” 

“এটা আপনি গঙ্গাধর সামন্তকে বলেছেন?” 

“না, এটা বলিনি। তবে কথাটা উনি আমাকে যেমন বলেছিলেন, তেমনি আরও দু’চারজনকেও বলে থাকতে পারেন। তাদের কেউ গঙ্গাধর সামন্তকে এটা জানিয়েছে কি না, বলতে পারব না।”

“ঠিক আছে। আর-কেউ যদি বলে থাকে তো বলুক, আপনার অন্তত এক্ষুনি এটা জানিয়ে কাজ নেই। না না, পুলিশের কাছ থেকে কোনও তথ্য আমি আপনাকে গোপন করতে বলছি না। অন্য-কোনও সূত্রে এই খবরটা জেনে তারপর পুলিশ যদি আপনার কাছে এটার করোবরেশন চায়, তো তখন আপনাকে বলতেই হবে যে, হ্যাঁ, আপনার কাছেও অমন কথা সদানন্দ বলেছিলেন বটে। কিন্তু সেটা তো তারা এখনও চায়নি, তাই আপনারও আগ বাড়িয়ে কিছু বলবার দরকার নেই।” 

“এটা বলছেন কেন?” 

“এইজন্যে বলছি যে, সদানন্দের গলায় তা হলে ফাঁসটা আরও শক্ত হয়ে এঁটে যাবে। কৌশিক যে থটার কথা ভাবছে সেইটে ধরে এগিয়ে তখন আর বিশেষ লাভ হবে না। সেইজন্যেই বলছি, আপাতত আপনি চুপ করে থাকুন। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে, যাকে সাপ্রেশান অভ এভিডেন্স বলে, এটা মোটেই সেই পর্যায়ে পড়ে না।” 

“কৌশিক কোন পথের কথা ভাবছে?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেটা এখন আপনার জেনে কোনও লাভ নেই। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর এখনও পাইনি।’ 

“কী প্রশ্ন? যা যা বলছেন, সবকিছুরই তো উত্তর দিয়ে যাচ্ছি।” 

“একটা প্রশ্নের উত্তর পাইনি। সদানন্দবাবু যে আদৌ কাউকে খুন করতে পারেন এটা আপনার বিশ্বাস হয়?” 

“বড় ভাবনায় ফেললেন দেখছি।” 

“বেশি ভাবনাচিন্তা করবেন না। ভাবনাচিন্তা না-করে যা বলবেন সেটাই আমার শোনা দরকার।’ পকেট থেকে প্যাকেটটা বার করে একটা সিগারেট ধরালুম। বুকের মধ্যে ধোঁয়া টেনে নিলুম অনেকটা। তারপর আস্তে-আস্তে ধোঁয়াটা ছেড়ে দিয়ে বললুম, “দেখুন মশাই, নজিরের অভাব নেই। এমনিতে যাকে নেহাত নিরীহ গোবেচারা কি ভালমানুষ বলে মনে হয়, সেও যে খুন করতে পারে, করেছে, এমন ঘটনার কথা আপনিও জানেন, আমিও জানি। শেষ পর্যন্ত হয়তো আদালতে এই গঙ্গাধর সামন্তই প্রমাণ করে ছাড়বে যে, আমাদের সদানন্দবাবুও আসলে একেবারে সেই রকমের একজন মানুষ। উপরে-উপরে খুবই ভদ্র খুবই শান্ত খুবই নিরীহ, কিন্তু ভিতরে ভিতরে যেমন নির্মম, তেমনি নিষ্ঠুর। কিন্তু তবু বলছি, না, সত্যিই যে উনি কাউকে খুন করতে পারেন তা আমি বিশ্বাস করি না।” 

কৌশিক বলল, “ব্যস ব্যস, এইটুকুই আমার জানবার দরকার ছিল। জানো মামাবাবু, লোকটিকে দেখে সত্যি আমার বড় মায়া হচ্ছিল। খালি মনে হচ্ছিল লোকটা বোকা, বোকামি করে একটা জালের মধ্যে জড়িয়ে গেছে, এখন আর জাল কেটে বেরুতে পারছে না।” 

আমি বললুম, “কৌশিক সম্ভবত ঠিক কথাই বলছে।” 

কলিং বেল বেজে উঠল। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “খুব সম্ভব গঙ্গাধর সামন্ত।” 

১৩ 

গঙ্গাধর সামন্ত একা আসেননি, ডাক্তার গুপ্তকেও নিয়ে এসেছেন। সুরেশ গুপ্ত যে ভাদুড়িমশাইকে ভালই চেনেন, কালই তিনি সে-কথা বলেছিলেন। তবে তাঁকে দেখবামাত্রই ‘আরে সুরেশবাবু আপনি?’ বলে ছুটে এসে ভাদুড়িমশাই যে ভাবে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন, তাতেই বুঝতে পারলুম যে, এটা নেহাত চেনা-জানার ব্যাপার নয়, এককালে দুজনের সম্পর্ক রীতিমতো ঘনিষ্ঠই ছিল। 

যে-ঘরে ভাদুড়িমশাই থাকেন এতক্ষণ আমরা সেই ঘরে বসে কথাবার্তা বলছিলুম। এবারে সবাই বাইরের ঘরে এসে বসা গেল। চৈত্রমাস, সারা দিন বেশ গরম গিয়েছে, ভেবেছিলুম যে, বিকেলের দিকে ঝড় উঠতে পারে, কিন্তু ওঠেনি; একটু একটু মেঘ জমছিল বটে, কিন্তু এলোমেলো হাওয়ার দাপটে সে-মেঘ স্রোতের মধ্যে নোঙর-ছেঁড়া নৌকোর মতো কোথায় যে ভেসে গেল তার ঠিক-ঠিকানা নেই, বিকেলবেলার আকাশ এখন আবার আয়নার মতো ঝকঝক করছে। 

কাজের লোকটির হাত দিয়ে মালতী পাঁচ গ্লাস ঘোলের শরবত পাঠিয়ে দিয়েছিল। গঙ্গাধর সামন্ত তাঁর শরবতের গ্লাসে চুমুক দেবার আগে দু’গ্লাস জলও খেয়ে নিলেন। তারপর রুমাল বার করে ঘাড় আর কপালের ঘাম মুছে বললেন, “উঃ, গরমে একেবারে মরে গেলুম!” 

খানিক বাদেই জলখাবার এসে গেল। খেতে-খেতে যেমন কুশল-জিজ্ঞাসা আর পারস্পরিক বার্তা-বিনিময় চলতে লাগল, তেমনি অন্য রকমের টুকটাক কথাও হল কিছু-কিছু। তারপর ভাদুড়িমশাই-ই একসময়ে বললেন, “এবারে তা হলে পীতাম্বর চৌধুরি লেনের ওই ব্যাপারটার কথায় আসা যাক, কেমন? মিস্টার সামন্ত, আপনাকে যদি এই প্রসঙ্গে গোটা কয়েক প্রশ্ন করি, তা হলে তার উত্তর দিতে আপনার আপত্তি হবেনা তো? তা যদি হয়, তো এখনই বলুন, সে-ক্ষেত্রে আর আপনাকে আমি বিব্রত করব না।” 

সামন্ত বললেন, “দেখুন মিস্টার ভাদুড়ি, এ-ব্যাপারে আমার তরফে যেটা বলবার কথা, সেটা খোলাখুলি বলা-ই ভাল। সরকারি নিয়মকানুন তো আপনার জানাই আছে। আপনি খুব ভালই জানেন যে, এ-সব ব্যাপার নিয়ে বাইরের কারও সঙ্গে কথা বলতে আমি বাধ্য নই, সাধারণত তা আমি বলিও না। তবে কিনা আপনার কথা আলাদা।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেন কেন, আমিই বা আর-পাঁচজনের থেকে আলাদা হলুম কীভাবে?”

গঙ্গাধর সামন্ত কিন্তু হাসলেন না। বললেন, “কথাটা আমার নয়, আমার উপরওয়ালার। আপনি যে এই পীতাম্বর চৌধুরি লেনের ব্যাপারটা নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চান, আপনার ভাগ্নের ফোন পাবার পরে এটা আমার উপরওয়ালাকে আমি সঙ্গে-সঙ্গেই জানিয়েছিলুম। জিজ্ঞেস করেছিলুম যে, এ-ব্যাপারে যে-সব তথ্য ইতিমধ্যে আমাদের হাতে এসেছে, আপনাকে তা আমি জানাতে পারি কি না।” 

“তিনি তাতে কী বললেন?” 

“বললেন যে, নর্মালি উই ডোন্ট ডু দিস, তবে কিনা মিস্টার ভাদুড়ির কথা আলাদা, হি হ্যাজ অলওয়েজ কোঅপারেটেড উইথ আস। সো গো অ্যাহেড অ্যান্ড টক টু হিম অ্যান্ড সি ইফ হি ক্যান হেলপ আস ইন এনি ওয়ে।” 

“সব কথাই আমাকে খুলে বলতে বলেছেন তিনি?” 

“তা-ই তো বললেন। আপনার কাছে নাকি কোনও-কিছুই গোপন রাখবার দরকার নেই। বললেন যে, গিভ হিম অল দি ইনফর্মেশন অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স দ্যাট উই হ্যাভ উইথ আস্। দেয়ার’স অ্যাবসলিউটলি নো নিড টু হোল্ড এনিথিং ব্যাক।” 

“বাঃ,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা হলে তো কোনও কথাই নেই। তা হলে শুরু করি, কেমন?” সামন্ত বললেন, “তার আগে এখানে আর যাঁরা উপস্থিত আছেন তাঁদের একটা কথা জানিয়ে রাখি। ব্যাপারটা এখন যে-স্টেজে রয়েছে, তাতে কোনও কিছুই ফাঁস হওয়াটা উচিত হবে না। হলে আমি তো বিপদে পড়বই। অন্য কিছু সমস্যাও দেখা দিতে পারে। সুতরাং আপনারা আমাকে কথা দিন যে, যা-যা আমি বলব তা শুধু আপনারাই জানবেন, আর কেউ নয়। 

সামন্ত যদিও ‘আর যাঁরা, আপনারা’ ইত্যাদি সব শব্দ ব্যবহার করছিলেন, তবু বুঝতে আমার অসুবিধে হল না যে, তাঁর কথাগুলি আসলে একান্তভাবে আমাকেই বলা। আমি খবরের কাগজে কাজ করি, তাই ভদ্রলোক সম্ভবত ভয়।চ্ছেন যে, এই নিয়ে আমাদের কাগজে কিছু বেরিয়ে যেতে পারে। 

বললুম, “আপনারা কথাবার্তা বলুন, আমি বরং ঘন্টাখানেকের জন্য একটু বাইরে যাই।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আরে বসুন বসুন।” তারপর সামন্তর দিকে তাকিয়ে বললেন “নিশ্চিত থাকুন, কিরণবাবু তো দীর্ঘদিন ধরে আমার সঙ্গে রয়েছেন, ফাঁস করতে হলে ঢের-ঢের এক্সপ্লোসিভ ব্যাপার উনি ফাঁস করে দিতে পারতেন। তা যখন করেননি, তখন এটাও করবেন না।” 

সামন্ত একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, “বাঁচালেন মশাই। ঠিক আছে, এবারে তা হলে বলুন যে, আপনি কী জানতে ঢান।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “লাশ পরীক্ষা করা হয়েছে?” 

“সে তো কালই হয়েছে।” 

“রিপোর্টটা পাওয়া গেছে নিশ্চয়?” 

“হ্যাঁ, তাও পেয়েছি।” সামন্ত বললেন, “তবে গুপ্তসাহেব নিজেই যখন উপস্থিত রয়েছেন এখানে, তখন আমি আর এ-ব্যাপারে কিছু বলব না; যা বলবার উনিই বলুন।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “শরীরটা চিত হয়ে পড়ে ছিল। ওইভাবে পড়ে যাবার ফলে যদি মাথা ফেটে থাকে, তা হলে মাথার পিছন দিকটা ফাটত।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এমন যদি হয় যে, লোকটা উপুড় হয়ে পড়ে মাথা ফাটিয়েছিল, কিন্তু পরে তার শরীরটাকে চিত করে দেওয়া হয়েছে।” 

“সেক্ষেত্রে ফাটত মাথার সামনের দিক, অর্থাৎ কপালের দিক। কিন্তু এখানে দেখছি, মাথাটা সামনের দিকেও ফাটেনি, পিছনের দিকেও না। ফেটেছে একেবারে খুলির উপরের দিকটা। ওই যাঁকে আমরা চাঁদি বলি।” 

এ-সব কথা কালই আমরা শুনছি। কৌশিকের কাছে ভাদুড়িমশাইও নিশ্চিত শুনে থাকবেন। তবু তিনি এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন কিছুই জানেন না। বললেন, “বটে? তা এ থেকে আপনার কী মনে হয়?” 

একটাই মাত্র কথা মনে হয়। সেটা এই যে, উপর থেকে ভারী-কিছু মাথার উপরে পড়লে কিংবা উপর থেকে ভারী কিছু দিয়ে কেউ মাথার ওখানে আঘাত করলে তবেই মাথার ওই জায়গাটা ও-ভাবে ফাটতে পারে। তা ওখানে তো মাথার উপরে ফ্যান কিংবা ঝাড়লণ্ঠন ছিল না, তাই উপর থেকে অমন কিছু খসে পড়বারও প্রশ্ন এ-ক্ষেত্রে উঠছে না। তা হলে আর এটাকে দুর্ঘটনা বলে কি হঠাৎ পড়ে গিয়ে মাথা ফাটবার ব্যাপার বলে মেনে নিই কী করে? একটাই মাত্র সিদ্ধান্ত এ-ক্ষেত্রে করতে পারি, সেটা হল ইটস এ ক্লিয়ার কেস অভ্ মার্ডার।”

“সেটা কীভাবে করা হল বলে আপনার মনে হয়?” 

“ভারী কিছু দিয়ে খুব জোরে ওর মাথায় আঘাত করা হয়েছিল। আঘাতটা কিন্তু একই লেভেলে সামনে কিংবা পিছনে দাঁড়িয়ে করা হয়নি, করা হয়েছিল একটু উপর থেকে। একই লেভেলে দাঁড়িয়ে যে সেটা করা যায় না, তা অবশ্য নয়। যাকে আঘাতটা করা হচ্ছে, তার চেয়ে যদি যে আঘাত করছে তার হাইট আরও অন্তত ফুটখানেক বেশি হয়, তো একই লেভেলে দাঁড়িয়েও সেটা করা যেতে পারে। কিন্তু তেমন কোনও সম্ভাবনাকেও এ-ক্ষেত্রে আমল দিতে পারছি না।” 

“এ-কথা কেন বলছেন?” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “এইজন্যে বলছি যে, যাকে খুন করা হয়েছে, তার হাইট পাক্কা ছ’ফুট। একই লেভেলে দাঁড়িয়ে তার মাথার ওই জায়গায় যদি আঘাত করতে হয় তো খুনির অন্তত সাত ফুট লম্বা হওয়া দরকার। তা ও-রকম লম্বা লোক আমেরিকান বাস্কেট-বল টিমে অনেক থাকতে পারে, আমাদের দেশে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না।” 

কৌশিক বলল, “আমি একটা কথা বলতে পারি?” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “নিশ্চয়, নিশ্চয়।”

কৌশিক বলল, “ওই যে আপনি এক ফুট ব্যবধানের কথা বলছেন, ওটা তো কৃত্রিমভাবেও তৈরি করে নেওয়া হতে পারে?” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “একটু বুঝিয়ে বলো তো বাবা।” 

কৌশিক বলল, “ধরুন একই লেভেলে দাঁড়িয়ে মাথার ওইখানটায় আঘাত করে আমি যদি কাউকে মারতে চাই, তো তার জন্যে আমাকে সত্যি-সত্যি তার চেয়ে আরও এক ফুট বেশি লম্বা হতে হবে কেন? সে যদি একটা চেয়ারে বসে থাকে, আর আমি থাকি দাঁড়িয়ে, তা হলেই তো আমাদের দুজনের দৈর্ঘ্য এক হওয়া সত্ত্বেও কি তার চেয়ে আমি ইঞ্চি কয়েক খাটো হওয়া সত্ত্বেও, কার্যত আমি তার চেয়ে অন্তত তখনকার মতো এক ফুট বেশি লম্বা হয়ে যাচ্ছি। কিংবা তাকে চেয়ারেই বা বসতে হবে কেন? সে নাহয় দাঁড়িয়েই থাক। কিন্তু সে-ক্ষেত্রে ওই এক ফুট আমি গেইন করতে পারব, যদি কিনা একটা টুলের উপরে দাঁড়িয়ে আমি তার মাথা ফাটাই।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “ওয়েল ইউ হ্যাভ এ পয়েন্ট দেয়ার। এ ভেরি গুড পয়েন্ট, ইনডিড। এদিক থেকে ব্যাপারটা আমাদের ভেবে দেখা উচিত ছিল।” 

গঙ্গাধার স’মন্তকে একটু গম্ভীর দেখাচ্ছিল। তিনি বললেন, “আমি যে এটা একেবারেই ভেবে দেখিনি, তা কিন্তু নয়। কিন্তু চেয়ারে বসে থাকার কথাটা এখানে খাটছে না। অত রাত্তিরে একটা লোক ওখানে চেয়ারে বসে থাকবে কেন? আর টুলের উপরে দাঁড়িয়েই বা খুন করবার দরকার কী? সিঁড়ির দু’ধাপ উপরে দাঁড়িয়েই তো সেটা করা যায়। কী গুপ্তসাহেব, যায় না?” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “যায় বই কী, নিশ্চয়ই যায়।” 

সামন্ত বললেন, “খুনি আর তা হলে অনর্থক টুল নিয়ে টানাটানি করতে যাবে কেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিক আছে, আপাতত এটাকে আমি খুন বলেই ধরে নিচ্ছি। তা সেটা কখন হয়েছে বলে আপনাদের ধারণা?” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “একেবারে একজ্যাক্ট সময় তো বলা সম্ভব নয়। লাশ পরীক্ষা করে মনে হচ্ছে, ঘটনাটা ঘটেছে মোটামুটি তিনটে নাগাদ। কিন্তু এ-সব ক্ষেত্রে একটু মার্জিন তো রাখতেই হয় আমাদের, তাই একেবারে নিশ্চিত হয়ে যা বলা সম্ভব, সেটা এই যে, ব্যাপারটা ঘটেছে রাত দুটো থেকে চারটের মধ্যে। 

আমি বললুম, “আড়াইটের আগে ঘটেনি।” 

সামন্ত বললেন, “এ-কথা আপনি বলছেন কেন?” 

“এইজন্যে বলছি যে, নকুল সেদিন রাত একটা নাগাদ বাড়ি ফিরেছিল বটে, কিন্তু চেঁচামেচি করেছিল দুটো পর্যন্ত।” 

“কী করে জানলেন? আপনি কি তখন জেগে ছিলেন নাকি?”

“আমি জেগে ছিলুম না, কিন্তু আমার মেয়ে জেগে ছিল। …না না, তার ইনসমনিয়া নেই, আসলে সামনেই তার বি.এ. ফাইনাল, তাই অন্তত রাত দুটো পর্যন্ত সে এখন লেখাপড়া করে। কখনও-কখনও আড়াইটেও বেজে যায়। তার ঘর একেবারে রাস্তার ধারেই। সেদিন সে ভেবেছিল যে, তিনটের আগে ঘুমোবে না। কিন্তু বাড়ি ফিরে নকুল সেদিন এমন হৈচৈ লাগিয়ে দিয়েছিল যে, আমার মেয়ের পড়াশুনো একেবারে মাথায় উঠে যায়। আলো নিবিয়ে সে শুয়ে পড়ে। তার আগে টেবিল-ক্লকে অ্যালার্মের কাঁটা ঘোরাতে গিয়ে দেখতে পেয়েছিল যে, রাত তখন দুটো পঁচিশ।” 

সামন্ত বললেন, “এই ব্যাপারে দেখছি সদানন্দবাবুর কথার সঙ্গে আপনার মেয়ের কথাটা মোটামুটি ট্যালি করে যাচ্ছে।” 

বললুম, “জানি। কাল সকালে আপনি এসে পৌঁছবার আগে সদানন্দবাবুও কথাটা আমাকে বলেছিলেন। পরে দেখলুম আপনার জেরার উত্তরেও উনি একই কথা বললেন। তা ছাড়া, আর-একটা কথাও বলেছেন উনি। সেটা এই যে, রাত তিনটে নাগাদ উনি একতলায় কোনও ভারী কিছু পড়ে যাবার শব্দ পান। কথাটা, যদ্দুর মনে করতে পারছি, আপনাকেও উনি বলেছেন। তাই না?” 

সামন্ত তাঁর অ্যাটাচি-কেস খুলে একটা নোটবই বার করলেন। ওই যাতে স্টেনোবা ডিক্টেশান নিয়ে থাকেন, সেই রকমের ছোট-সাইজের খাতা আর কি। খুব দ্রুত তার কয়েকটা গাতা উল্টে গিয়ে এক-জায়গায় হঠাৎ থেমে গেলেন তিনি। সেখানে যা লেখা ছিল, তার উপরে চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, “হ্যাঁ,কথাটা তিনি আমাকেও বলছেন।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “একতলায় নকুল ছাড়া আর কে-কে থাকে যেন?” 

বললুম, “নকুলের বউ যমুনা, মেয়ে কমলি আর যমুনার দাদা বিষ্টুচরণ থাকে।” 

ভাদুড়িমশাই সামন্তের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই যে রাত তিনটে নাগাদ একতলায় কিছু একটা পড়ে যাবার শব্দ হয়েছিল…অন্তত হয়েছিল বলেই সদানন্দবাবু জানাচ্ছেন, এটা নিয়ে কি যমুনা আর তার দাদাকে কোনও প্রশ্ন করেছেন আপনি?” 

সামন্ত বললেন, “স্পেসিফিক্যালি যে এইটে নিয়ে কোনও প্রশ্ন করেছি, তা নয়। তবে অন্য অনেক প্রশ্ন তো করেছি, যমুনা আর বিষ্টুচরণ তার উত্তরও দিয়েছে। সে-রাতে যা হয়েছিল, উত্তরগুলো থেকে মোটামুটি তা আন্দাজও করা যায়। মানে একটা ছবি তার থেকে বেরিয়ে আসে ঠিকই।” 

“যমুনা কী বলছে? সব কথা বলবার দরকার নেই, জরুরি পয়েন্টগুলোই শুধু জানতে চাইছি।”

“যমুনা বলছে নকুলচন্দ্র রোজই দেরি করে ফিরত, সেদিনও দেরি করেই ফিরেছিল, তবে সেদিন তার ফিরতে-ফিরতে একটা বেজে গিয়েছিল কি না, তা সে বলতে পারবে না। ফিরে যে অনেকক্ষণ চেঁচামেচি করেছিল, তাও ঠিক। তার ভাত ঢাকা দেওয়া থাকে, কিন্তু সেদিন আর “ ভাত-টাত খায়নি। বেশ কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করে ঘরে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়েছিল।” 

“ভাল কথা। তারপর?” 

“এই পর্যন্ত যা বলা হল, তার মধ্যে কোনও গোলমাল নেই। গোলমাল ঘটছে তার স্টেটমেন্টের শেষ-দিককার অংশটা নিয়ে।” 

“সেটা কী?” 

সামন্ত একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “যমুনা বলছে, রোজই রাত তিনটে থেকে সাড়ে-তিনটের মধ্যে তার স্বামী একবার বাথরুমে যেত। তারপর বাথরুম থেকে ফিরে এসে আবার ঘুমিয়ে পড়ত। তবে কিনা বেশিক্ষণের জন্যে নয়। খানিকক্ষণ ঘুমিয়েই ফের উঠে পড়তে হত তাকে। খুচরো দোকানিয়া সাত-সকালে পাইকিরি দরে মাছ কিনতে আসত, সেইজন্যেই বেশিক্ষণ ঘুমিয়ে থাকা চলত না।” 

কৌশিক বলল, “লোকটা রাত করে ফিরত আবার উঠেও পড়ত সকাল-সকাল। তা হলে ঘুমোত কখন?” 

“যমুনা বলছে, রাত্তিরে তো সাধারণত ঘন্টা তিনেকের বেশি ঘুমোত না, তাই দুপুরবেলায় টানা আবার ঘন্টা কয়েক ঘুমিয়ে নিত।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা এর মধ্যে গোলমালটা ঘটছে কোথায়?” 

সামন্ত বললেন, “সেদিনও রাত তিনটে নাগাদ লোকটা বাথরুমে গিয়েছিল কি না, যমুনা সেটা বলতে পারছে না।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “গিয়েছিল নিশ্চয়। খুনের সময় তো দুটো থেকে চারটের মধ্যে। তা সেইসময় ঘর থেকে ওকে টেনে বাইরে নিয়ে এসে তো আর কেউ খুন করেনি। আর খুনটা যে ঘরের মধ্যে করে তারপর শরীরটাকে বাইরে টেনে নিয়ে এসে সিঁড়ির তলায় ফেলে রাখা হয়নি, তাও তো ও-ঘরের বিছানাপত্র পরীক্ষা করেই বোঝা গিয়েছে। তা ছাড়া এটাও ভেবে দেখুন যে, ঘর থেকে ওকে টেনে নিয়ে গেলে কি ঘরের মধ্যেই খুন করে লাশটাকে টেনে বাইরে নিয়ে গেলে তো ওর বউই সেটা টের পেয়ে যেত। তা কিন্তু যমুনা টের পায়নি। ….না মশাই, নির্ঘাত ও তখন বাথরুমে গিয়েছিল। তারপর বেরিয়ে এসে খুন হয়।” 

কৌশিক বলল, “বাথরুমে হয়তো ঢোকেইনি, সেখানে যাবার পথেই হয়তো খুন হয়েছে। তাও কিছু বিচিত্র নয়।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “যমুনা কী বলছে?” 

সামন্ত বললেন, “যমুনা বলছে, রোজই তো বাথরুমে যেত। তবে সেদিনও গিয়েছিল কি না, তা সে জানে না। তার কারণ, রাত-দুপুরে নকুলের চিৎকার-চেঁচামেচিতে তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু নকুল এসে ঘরে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়বার পর সে নিজেও আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভোর-পাঁচটায় সদানন্দবাবুর চিৎকার শুনে সে জেগে ওঠে, তার আগে আর তার ঘুম ভাঙেনি।” 

ডাক্তার গুপ্ত ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকালেন। বললেন, “আপনার কী মনে হয়? যমুনা যা বলছে সেটা সত্যি?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সত্যি তো হতেই পারে, তবে মিথ্যে হওয়াও বিচিত্র নয়।”

“যমুনা কেন মিথ্যে কথা বলবে?” 

“জেগে থাকলেও সে-কথা কবুল করা সম্ভব নয় বলেই বলবে। ধরুন নকুল সেদিনও তার অভ্যাসমতো রাত-তিনটে নাগাদ একবার বাথরুমে গিয়েছিল। ধরুন, যমুনা সেটা টেরও পেয়েছিল। তা আমরা এখন জেনে গেছি যে, নকুলের মৃত্যু ঘটেছিল মোটামুটি ওই সময়েই। তো যমুনা যদি স্বীকার করে যে, সে তখন জেগে ছিল, তা হলে প্রশ্ন উঠবে ওই সময়ে তার স্বামীর মাথা ফাটল, লোকটা মেঝের উপরে পড়ে যাবার ফলে শব্দও হল একটা, তা হলে জেগে থাকা সত্ত্বেও যমুনা কিছু টের পেল না কেন? 

সামন্ত বললেন, “আমার ধারণা যমুনা মিথ্যে কথা বলেনি, সত্যি সে ঘুমিয়েই ছিল তখন, নইলে শব্দটা শুনে সে ছুটে আসত নিশ্চয়।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনার ধারণা সত্যি হলে কি তদন্তের কোনও সুবিধে হয়?” 

“হয় বই কী,” সামন্ত বললেন, “ব্যাপারটাকে যে-ভাবে আমি রিকনস্ট্রাক্ট করেছি সেটা তা হলে জোর পায়।” 

কৌশিক বলল, “কীভাবে রিকনস্ট্রাক্ট করেছেন, একটু বুঝিয়ে বলুন।” 

১৪

সামন্ত বললেন, “নকুলচন্দ্র যে রোজই রাত তিনটে থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে বাথরুমে যেত, আমার ধারণা সদানন্দ সেটা জানতেন। গভীর রাত, কেউ কোথাও জেগে নেই, খুন করবার পক্ষে এর চেয়ে চমৎকার সময় আর কী হতে পারে। আমার বিশ্বাস, সদানন্দ এর মধ্যে ঠিক করে ফেলেছিলেন যে, অনেক চেষ্টা করেও নকুলকে যখন তাড়ানো যাচ্ছে না, তখন তাকে খুনই করবেন তিনি। সেইজন্যেই সেদিন মোটামুটি তিনটে নাগাদ তাঁর দোতলার ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন। একতলার ঘর থেকে নকুল বেরিয়ে এল। বাথরুমের মধ্যে আলো জ্বলে উঠল। সদানন্দও তাঁর লোহার বল বসানো লাঠিটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিঃশব্দে কয়েক ধাপ নীচে নেমে এলেন। বাথরুমের আলো নিবিয়ে নকুল যখন সিঁড়ির পাশ দিয়ে তার ঘরের দিকে যাচ্ছে, ঠিক তখনই সদানন্দ তার মাথা ফাটিয়ে দেন। নকুল একটা চিৎকার করবারও সুযোগ পায়নি, মাথায় লাঠির বাড়ি পড়বার সঙ্গে-সঙ্গে সে মেঝের উপরে লুটিয়ে পড়ে।’ 

কৌশিক বলল, “কাট। এই দৃশ্যটা আবার নতুন করে টেক করতে হবে। কিন্তু তার আগে স্ক্রিপ্টের এই অংশটা একটু অন্যভাবে লেখা দরকার।” 

সামন্ত বললেন, “তার মানে?” 

কৌশিক বলল, “মানে আর কী, ব্যাপারটা একেবারে ফিল্মের স্ক্রিপ্টের মতো লাগছে। এইখানে যদি ‘ক্যাঅ্যাচ’ করে একটা দরজা খোলার সাউন্ড লাগিয়ে দেন, কি সদানন্দবাবু তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসবার ঠিক আগেই যদি ক্যামেরা চার্জ করে দেখিয়ে দেন যে, একটা দেওয়াল ঘড়ির ছোট কাঁটাটা তিনটের ঘরে এসে পৌঁছেছে, তো সে ভারী জমাট ব্যাপার হবে।” 

সামন্ত বললেন, “অর্থাৎ আমার থিয়োরিটা আপনার বিশ্বাসযোগ্য ঠেকছে না, কেমন?”

কৌশিক কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ভাদুডিমশাই এমন কটমট করে তার দিকে তাকালেন যে, সে আর মুখ খুলল না। 

ভাদুড়িমশাই তখন সামন্তের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এ-সব ছেলে-ছোকরাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কিছু যায়-আসে না মিস্টার সামন্ত। আপনি যা বলছেন বলুন। নকুল তো মেঝের উপর লুটিয়ে পড়ল। তারপর?” 

সামন্ত বললেন, “তারপর আর কী, যমুনা আর বিষ্টুচরণ যদি তখন জেগে থাকত, তা হলে মেঝের উপর নকুলের পড়ে যাবার শব্দ শুনেই তারা যে-যার ঘর থেকে ছুটে আসত নিশ্চয়। কিন্তু কপাল ভাল সদানন্দবাবুর। দুজনেই তখন ঘুমিয়ে ছিল। নকুলচন্দ্রের পড়ে যাবার শব্দ তারা শোনেনি, তাই ছুটেও আসেনি।” 

“তারপর?” 

“কাজ সমাধা করে সদানন্দ আবার নিঃশব্দে উপরে যান। উঠে গিয়ে বেশ-খানিকক্ষণ সেখানে কাটিয়ে তারপর রোজকার মতোই পাঁচটা বাজবার খানিক আগে আবার নীচে নেমে আসেন। চিৎকারটাও করে ওঠেন তখনই। এমন একটা ভাব দেখান, যেন ডেডবডিটা এই তিনি প্রথম দেখলেন। বুঝতেই পারছেন, সবটাই একেবারে প্ল্যান-মাফিক ব্যাপার।” 

কৌশিক বলল, “কিন্তু সদানন্দবাবুর হাত থেকে লাঠি আর টর্চ তো পড়ে গিয়েছিল। ও-দুটো জিনিস কখন পড়ল, সেটাও ভেবে দেখা দরকার। বিশেষ করে লাঠিটা। তার কারণ, ওটাকেই আপনি মার্ডার-ওয়েপন বলে সন্দেহ করছেন।” 

সাম বললেন, “সন্দেহ করবার কারণ নেই, তা তো নয়।” 

আমি বললুম, “কিন্তু সদানন্দবাবু তো বলছেন, কুসুমবালা যমুনা আর বিষ্টুচরণের সামনেই ওই লাঠি আর টর্চ তাঁর হাত থেকে খসে পড়ে গিয়েছিল।” 

সামন্ত বললেন, “যমুনা আর বিষ্টুচরণ কিন্তু সে-কথা বলছে না। তারা বলছে, চিৎকার শুনে তারা যখন বেরিয়ে আসে, তখনই তারা নকুলের ডেড-বড়ির পাশে টর্চ আর লাঠি পড়ে থাকতে দেখেছিল। কুসুমবালা অবশ্য সদানন্দের কথা সমর্থন করছেন। কিন্তু তিনি যে তাঁর স্বামীকে বাঁচাবার জন্যে সেটা করছেন না, এমন কথা কে বলবে।” 

ভাদুড়িমশাই চুপ করে আছেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে আমি বললুম, “আপনার ধারণাও কি তা-ই? অর্থাৎ স্বামীকে বাঁচাবার জন্যে কুসুমবালা মিথ্যে কথা বলছেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সে তো হতেই পারে। স্বামীকে বাঁচাবার জন্যে স্ত্রী একটা মিথ্যে কথা বলবেন, এ তো খুবই স্বাভাবিক।” 

আমি একেবারে নিবে গেলুম। দেখলুম সামন্তমশাই হাসছেন। বিজয়ীর হাসি। বললেন, “আপনি তা হলে আমার থিয়োরিটাই মেনে নিচ্ছেন তো?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তাও কিন্তু মেনে নিচ্ছি না।” 

এবারে সামন্তের নিবে যাবার পালা। বললেন, “কেন?” 

“কী করে মেনে নেব?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “একে তো ওই লাঠিটাই যে মার্ডার-ওয়েপন, এখনও সেটা নিশ্চিতভাবে আমরা জানতে পারিনি, তার উপরে আবার আপনার থিয়োরির মধ্যে অন্য একটা ফাঁক রয়েছে। 

“একটু বুঝিয়ে বলবেন?” 

“বলছি। ফাঁকটা ছোট, কিন্তু ভাইটাল।” 

ভাদুড়িশাই আবার একটা সিগারেট ধরালেন। চুপচাপ ধোঁয়া ছাড়লেন কিছুক্ষণ। তারপর আধাআধি যখন খাওয়া হয়েছে, তখন সেটাকে অ্যাশট্রেতে পিষে দিয়ে বললেন, “মাত্র একটা কথাই আমরা নিশ্চিতভাবে জানি। সেটা এই যে, নকুলচন্দ্র মারা গিয়েছে মোটামুটি রাত তিনটের সময়। মাথায় আঘাত করা হয়েছিল, তাতেই তার মৃত্যু ঘটে। সে মেঝের উপর পড়ে যায়। পড়ে যাওয়ার ফলে একটা শব্দ হয়েছিল। শব্দ শুনে যমুনা আর বিষ্টুচরণ ছুটে আসতে পারত। কিন্তু আসেনি। কেন আসেনি? না শব্দটা শুনতেই পায়নি তারা। কেন শোনেনি? না যে-যার ঘরে তারা দুজনেই তখন ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু তারা না শুনলেও শব্দটা যে কেউই শোনেনি, তা কিন্তু নয়। সদানন্দবাবু শুনেছিলেন। নিজের থেকেই আপনাকে তিনি সেটা জানিয়েছেনও। তাই না?”

সামন্ত বললেন, “তা জানিয়েছেন বটে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সত্যি বলতে কী, তিনি এটা জানিয়েছেন বলেই আমি একটু ধাঁধায় পড়ে যাচ্ছি। ধরা যাক আপনি যা বলছেন, সেটাই ঠিক। অর্থাৎ সদানন্দবাবুই খুনি। তিনটের সময় নীচে নেমে এসে সিঁড়ির দু’ধাপ উপর থেকে তিনি নকুলচন্দ্রের মাথা ফাটিয়ে দেন। নকুলচন্দ্র মেঝেতে পড়ে যায়। শব্দ হয়। কিন্তু যমুনা আর বিষ্টুচরণ ছুটে আসে না। তাতেই সদানন্দবাবু বুঝে যান যে, তারা ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু তা-ই যদি তিনি বুঝে গিয়ে থাকেন, তা হলে আর এমন কথা তিনি বলতে যাবেন কেন যে, দোতলা থেকে শব্দটা তিনি শুনেছিলেন? কেউ যখন শব্দটা শোনেনি, তখন তাঁরও তো ব্যাপারটা চেপে যাবার কথা। কিন্তু তিনি চাপলেন না। বললেন যে, শব্দটা শুনেছিলেন তিনি। অর্থাৎ প্রকারান্তরে স্বীকার করে বসলেন বাড়ির মধ্যে সবাই যখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে, তখন একা তিনি জেগে ছিলেন। কখন জেগে ছিলেন? না, খুনটা যখন হচ্ছে, তখনই। এ যে আগ বাড়িয়ে ধরা দেবার ব্যাপার, এ তো সদানন্দবাবুরও না-বুঝবার কথা নয়। খুনি কি কখনও এ-ভাবে আগ বাড়িয়ে ধরা দেয়? না মশাই, তাঁকে যে খুনি হিসেবে সন্দেহ করা হতে পারে, এটা বুঝেও এই যে তিনি নিজে। থেকেই একটা ভাইটাল ইনফর্মেশন আপনাকে দিয়ে দিলেন, এতেই আমার একটু ধাঁধা লেগে যাচ্ছে। কী ানে হচ্ছে জানেন?” 

“কী মনে হচ্ছে?” 

“মনে হচ্ছে যে, ইউ আর বার্কিং আপ দি রং ট্রি।” 

“অর্থাৎ আপনি বলতে চান যে, সদানন্দবাবু খুনি নন?” 

“না, তাও আমি বলছি না। সদানন্দবাবুর মোটিভ ছিল, সুযোগও ছিল। সুতরাং তাঁকে তো আপনি সন্দেহ করতেই পারেন। কিন্তু আমার বলবার কথাটা এই যে, ও-দুটো জিনিস আর-কারও ছিল কি না, সেটাও আপনার খুব ভাল করে ভেবে দেখা উচিত। অস্ত্রবিদ্যা কে কেমন শিখেছে, তার পরীক্ষা দেবার সময় অর্জুন যেমন সব-কিছু বাদ দিয়ে শুধু পাখিটাকেই দেখছিলেন……ভুল বললুম, পাখিরও সবটা তিনি দেখছিলেন না, দেখছিলেন শুধু পাখির মুন্ডুটিকে, আপনিও তেমনি সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু সদানন্দবাবুকেই দেখছেন। কিন্তু আপনি তো অর্জুন নন, আপনি পুলিশ অফিসার গঙ্গাধর সামন্ত। আপনার উচিত তাই চারদিকে নজর রাখা। … না না, সদানন্দকে সন্দেহ করে আপনি কিচ্ছু অন্যায় করেননি, তবে কিনা সন্দেহের জালটাকে এবারে আর-একটু ছড়িয়ে দিন।” 

সামন্ত বললেন, “কথাটা আপনি ঠিকই বলেছেন, কিন্তু সন্দেহ করবার মতো আর-কাউকে তো এ-ক্ষেত্রে পাচ্ছি না। নকুলকে খুন করবার সুযোগ হয়তো যমুনারও ছিল, বিষ্টুচরণেরও ছিল। কিন্তু শুধু সুযোগ থাকাটাই যথেষ্ট নয়, একটা মোটিভও থাকা চাই। তা সেটা না ছিল যমুনার, না ছিল বিষ্টুচরণের।” 

কৌশিক বলল, “কিরণমামার কাছে আজই দুপুরে শুনলুম যে, রাত দুপুরে বাড়ি ফিরে নকুল নাকি বউয়ের উপরে খুব চোটপাট করত।” 

সামন্ত আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এটা আপনি কোত্থেকে জানলেন কিরণবাবু?”

বললুম, “সদানন্দবাবুই বলেছেন। পাড়ার আর-পাঁচজনও যে ব্যাপারটা জানে না, তা নয়।”

কৌশিক বলল, “চোটপাট নাকি রোজই করত। তা মারধোরও কি মাঝে-মাঝে করত না?”

সামন্ত বললেন, “বাস, সেটাই অমনি খুন করবার মোটিভ হয়ে গেল? আর তা ছাড়া যেভাবে খুন করা হয়েছে তাতে মনে হয় না যে, এটা কোনও স্ত্রীলোকের কাজ।” 

ডাক্তার গুপ্ত বললেন, “তা হলে বাকি রইল বিষ্টুচরণ। তার কোনও মোটিভ থাকা সম্ভব নয়?”

একগাল হেসে সামন্ত বললেন, “আদৌ সম্ভব নয়। আরে মশাই, যে-গোরু দুধ দিচ্ছে, তাকে সে কেন মারতে যাবে? বিষ্টুচরণ গরিবঘরের ছেলে, চাকরি-বাকরি জোটাতে পারেনি, ভগ্নিপতির কাছে আশ্রয় মিলেছে, তাই দু’বেলা দুমুঠো খেতে পাচ্ছে। নকুল যে মরল, এতে সেই আশ্রয়টাই তার ঘুচে গেল। না মশাই, ভগ্নিপতির মৃত্যুতে বিষ্টুচরণের কোনও স্বার্থসিদ্ধি হচ্ছে না, বরং সে বেঁচে থাকলেই তার লাভ ছিল।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “একেবারেই কি স্বার্থসিদ্ধি হচ্ছে না? যমুনা কি তার স্বামীর ব্যাবসা সামলাতে পারবে? আর কমলি তো নেহাতই শিশু। খোঁজ নিয়ে দেখুন, বোন আর ভাগ্নির অভিভাবক সেজে সে তার ভগ্নিপতির মাছের ব্যাবসাটা হাতাতে চায় কি না।” 

গঙ্গাধর সামন্ত তাঁর দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটিকে দুদিকে আন্দোলিত করে বললেন, “সে-গুড়েও বালি। ব্যাবসার জমা-খরচের আর অন্য সব কাগজ।এ আটক করেছি তো। তা সেখানে দেখছি জমার ঘরে ঢুটু। পুরোটাই ধারের কারবার আর সেই ধারের পরিমাণ হাজার পনরো তো হবেই। আসলে নকুলচন্দ্রের মেজাজ যে ইদানীং খিঁচড়ে ছিল, সেটা এইজন্যেই। দেনার দায়ে লোকটার মাথার চুল পর্যন্ত বিকিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল। ও-ব্যাবসা কে হাতাতে যাবে?” 

ভাদুড়িমশাই একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “মার্ডার-ওয়েপনের কোনও হদিশ হল?” 

“পেয়েছি তো অনেক কিছুই। ইট, পাথর, নোড়া, হাতুড়ি, বাটখারা। অর্থাৎ কিনা যা দিয়ে মাথা ফাটানো যায়, এমন বিস্তর জিনিস। তার উপরে সদানন্দবাবুর ওই লাঠি তো আছেই। কালই সব পরীক্ষা করতে পাঠিয়ে দিয়েছি। মনে হয় আগামী কাল বিকেল নাগাদ রিপোর্ট পেয়ে যাব।” 

“পেলে আমাকে জানাবেন, কেমন?” 

“নিশ্চয় জানাব।” 

গঙ্গাধর সামন্ত উঠে পড়লেন। ডাক্তার গুপ্তকে বললেন, “আপনি চলুন। আপনাকে আপনার বাসায় নামিয়ে দিয়ে আমি থানায় ফিরব।”