শ্যামনিবাস-রহস্য – ১

পাঁচ নম্বর পীতাম্বর চৌধুরি লেনের একতলার ভাড়াটে নকুলচন্দ্র বিশ্বাস যে খুন হয়েছে, বাড়িওয়ালা সদানন্দবাবুই সে-কথা প্রথম জানতে পারেন কি না, বলা শক্ত, তবে তার ডেডবডি যে তিনিই প্রথম দেখেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেসব কথা যথাসময়ে হবে। ভদ্রলোকের পরিচয়টা আগে দেওয়া দরকার। 

সদানন্দবাবুর পুরো নাম সদানন্দ বসু। সস্ত্রীক তিনি দোতলায় থাকেন। আগে একটা সওদাগরি কোম্পানির শিপিং ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন, বার দুয়েক এক্সটেনশান পাবার পরে রিটায়ার করেছেন। তা সেও প্রায় বছর দশেক হল। 

ভদ্রলোকের বয়স এখন বাহাত্তর। সন্তানাদি হয়নি, তবে তা নিয়ে তাঁর কোনও আক্ষেপ নেই। বরং অন্যেরা আক্ষেপ করলে বলেন, ‘রাখুন মশাই। ছেলে হলেই যে সেটা বনমানুষ না-হয়ে মানুষ হত, তার কোনও গ্যারান্টি আছে? গুন্ডার দলে নাম লিখিয়ে ব্যাটা হয়তো বোমবাজি করে বেড়াত, আর আমাকে তার হ্যাপা সামলাতে হত। না রে ভাই, তার চেয়ে এই দিব্যি আছি। 

সদানন্দবাবু সত্যিই যে ‘দিব্যি’ আছেন, এটা যে নেহাত কথার কথা নয়, সে তাঁর মুখ দেখলেই বোঝা যায়। পার্ক সার্কাস এলাকার যে বাড়িটাতে এর আগে আমি থাকতুম, বাড়িওয়ালা সেটা বিক্রি করে দেওয়ায় বছর দশেক আগে আমি এখানে উঠে আসি। পাড়াটা ঘিঞ্জি, প্রথম প্রথম তাই একটুও ভাল লাগত না। কিন্তু সবই তো আস্তে-আস্তে সয়ে যায়, আমারও গিয়েছে। তা ছাড়া সদানন্দবাবুর মতো একজন প্রতিবেশী যে পৈয়েছি, এটাকেও আমার মস্ত একটা সৌভাগ্য বলে মনে হয়। সদানন্দ সত্যিই সার্থকনামা পুরুষ। মুখ নাকি মনের আয়না। তা সদানন্দবাবুর ক্ষেত্রে সেই আয়নাটা আমি কখনও ঝাপসা হতে দেখিনি, প্রশান্ত হাস্যে ভদ্রলোকের মুখখানা একেবারে ঝকঝক করত। 

হালে অবশ্য সেই ঝকঝকে মুখেই একটু-একটু মেঘ জমতে শুরু করেছিল। কিন্তু সে-কথায় একটু পরে আসছি। 

সদানন্দবাবুর বয়স যে সত্তর ছাড়িয়েছে, সেটা আমি তাঁর কাছে শুনি। দেখে অবশ্য বয়া বুঝবার উপায় নেই। ভদ্রলোকের চুল এখনও পুরোপুরি পাকেনি, সাদার হামলার বিরুদ্ধে কালো এখনও সমানে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বছর দুয়েক আগে ছানি কাটিয়েছিলেন; দৃষ্টিশক্তি তার পরেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি বটে, তবে দেহযন্ত্রের অন্য কোনও কলকবজায় জং ধরেছে বলে মনে হয় না। শরীর মোটামুটি পোক্ত। উদরে মেদ জমতে দেননি, টান হয়ে হাঁটাচলা করেন। 

আমি রোগাভোগা মানুষ। একে তো খবরের কাগজে কাজ করি বলে স্বাস্থ্যের ব্যাপারে নিয়ম-টিয়ম মেনে চলার উপায়ই নেই, তার উপরে আবার নিয়ম-টিয়ম মেনে চলার উপায় থাকলেই যে মান্যি করতুম তাও নয়। বেশ কিছুকাল ধরেই আমাকে তার মাসুল গুনতে হচ্ছে। অম্বলের অসুখ তো আছেই, তার সঙ্গে জুটেছে গেঁটেবাতের যন্ত্রণা। শীত পড়লেই আঙুলের গাঁট ফুলে যায়, ভাল করে তখন কলমটা পর্যন্ত ধরতে পারি না, ব্যথায় যেন হাতখানা একেবারে ঝন্‌ঝন্ করতে থাকে। 

সদানন্দবাবু বলেন, “সিগারেট ছাড়ুন মশাই। চা অবশ্য আমিও ছাড়তে পারিনি, আপনিও পারবেন বলে মনে হয় না, তবে এই যে দিনের মধ্যে পনরো-বিশ কাপ চা খাচ্ছেন, এটা তো একেবারে সর্বনেশে ব্যাপার। মেরেকেটে তিন কাপ পর্যন্ত চলতে পারে। ঘুম থেকে উঠে এক কাপ, সকালে জলখাবারের সময় এক কাপ আর বিকেলে এক কাপ। ব্যস ওই হচ্ছে লিমিট। তাও দুধ নয়, চিনি নয়, স্রেফ হালকা লিকার। দেখবেন, অম্বলের অসুখ একেবারে বাপ-বাপ বলে পালাবে।” 

বেজার হেসে আমি বলি, “তা কি পারব?” 

“পারতেই হবে। নইলে বাঁচবেন কী করে? আর হ্যাঁ, মর্নিং ওয়াকটা ধরুন। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে, চোখমুখ ধুয়ে হালকা এক কাপ চা খেয়ে রোজ মাইল দুয়েক হেঁটে আসুন দেখি, স্রেফ মাসখানেকের মধ্যেই টের পেয়ে যাবেন যে, শরীরের কলকবজাগুলো আবার ঠিকমতো “লতে শুরু করেছে।” 

“আপনি রোজ মর্নিং ওয়াক করেন?” 

“করি বই কী।” একগাল হেসে সদানন্দবাবু বলেছিলেন, “ঘড়িতে রোজ দম দিতে হয় না? ‘চা এই মর্নিং ওয়াকটা হচ্ছে শরীরকে দম দেওয়ার ব্যাপার। দমটা নিয়মিত দিচ্ছি বলেই ঘড়িটা এখনও বন্ধ হয়নি, একেবারে কাঁটায় কাঁটায় কারেক্ট টাইম দিয়ে যাচ্ছে।” 

এ-সব কথা বছর দশেক আগেকার। সদ্য তখন আমি পার্ক সার্কাস থেকে মধ্য-কলকাতার এই গলিতে এসে ঢুকেছি। খবরের কাগজে কাজ করি, দুপুর এগারোটা বারোটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরোই, কাজ চুকিয়ে বাড়ি ফিরতে-ফিরতে রাত নটা-দশটা বেজে যায়। রবিবারটা ছুটির দিন, রাস্তায় কি বাজারে সে-দিন সদানন্দবাবুর সঙ্গে দেখাও হয়। দেখা হলে উনিও নমস্কার করেন, আমিও করি। কিন্তু কথাবার্তা বিশেষ এগোয় না। 

এই রকমই এক রবিবারের সকালবেলা। বাজার থেকে ফিরে রান্নাঘরে আনাজ আর মাছের থলি নামিয়ে রেখে বসবার ঘরে ঢুকে সদ্য সেদিনকার কাগজের উপরে চোখ বুলোতে শুরু করেছি, এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। দরজা খুলে দেখি সদানন্দবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। বললুম, “আরে কী আশ্চর্য, আসুন আসুন।” 

ভদ্রলোক হাসতে-হাসতে ঘরে ঢুকলেন, তারপর একটা সোফায় বসে হাসতে-হাসতেই বললেন, “আপনি নতুন এসেছেন, তাই খবর নিতে এলুম কোনও অসুবিধে হচ্চে কি না। অবিশ্যি আরও আগেই আমার আসা উচিত ছিল। কোনও ব্যাপারে যদি দরকার হয়, তো নিঃসংকোচে জানাবেন, যদি কিছু করতে পারি তো খুশি হয়ে করব। আমার বাড়িটা আপনি চেনেন তো?” 

বললুম, “চিনব না কেন? বলতে গেলে আমাদের প্রায় উল্টোদিকেই তো আপনারা থাকেন, তাই না?” 

সদানন্দবাবু বললেন, “হ্যাঁ, আমরা থাকি পাঁচ নম্বরে। দোতলায় থাকি।” 

“একতলায় কারা থাকেন?” 

“কেউ না। একতলাটা ফাঁকাই পড়ে আছে। ভাড়াটে বসাইনি, বসাবার ইচ্ছেও নেই।” 

“কেন?” 

“ও মশাই অনেক ঝঞ্ঝাট। আজ বলবে রান্নাঘরের কলের ওয়াশারটা কেটে গেছে, প্লাম্বার ডেকে সারিয়ে দিন, কাল বলবে শোবার ঘরের ছিটকিনিটা ঠিকমতো লাগানো যাচ্ছে না, ছুতোর ডেকে আনুন। ও-সব ঝঞ্ঝাট কে সামলাবে? এক-একটা ভাড়াটে এমন পাজি হয় যে, সে আর কহতব্য নয়।” আমার বাড়ি নেই, অন্যের বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে আছি, তাই সদানন্দবাবুর কথায় আমি প্রাণ খুলে হাসতে পারলুম না। কাষ্ঠ হেসে বললুম, “তা বটে।” 

সদানন্দবাবু বললেন, “ও কথা ছাড়ুন। এখন কী জন্যে এসেছি, তা-ই বলি। কাল বিকেলে আপনার মিসেস আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন।” 

বললুম, “ তাই বুঝি?” 

“হ্যাঁ। আমার গিন্নিরও তাই আসা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি বাতের রুগি, হাঁটাচলা করতে কষ্ট হয়, তাই আমাকে একাই আসতে হল। তা ছাড়া আরও এইজন্যে এলুম যে, আপনার অসুখের কথা আমি শুনেছি। ওটা আমি সারিয়ে দেব।” 

অবাক হয়ে বললুম, “আমার আবার কী অসুখ?” 

সদানন্দবাবু বললেন, “সে কী, আপনার হাইপার-অ্যাসিডিটি নেই? বুক-জ্বালা নেই? চোঁয়া-ঢেকুর ওঠে না? আপনার স্ত্রী তো আমার স্ত্রীকে কাল তা-ই বলে এলেন।” 

বাসন্তী এসে ঘরে ঢুকল। সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার গলা শুনে এলুম। এক্ষুনি চলে যাবেন না যেন। চা করে আনছি।” 

সদানন্দবাবু বললেন, “তা আনুন, তবে চায়ের সঙ্গে দুধ-চিনি চলবে না।” 

জিজ্ঞেস করলুম, “ডাক্তারের নিষেধ?” 

“ডাক্তারের নয়, গুরুর নিষেধ। গুরু মানে সাক্ষাৎ মহাগুরু, অর্থাৎ আমার পিতৃদেব। তিনি বলতেন, চা খাচ্ছ খাও, কিন্তু খবর্দার তার সঙ্গে দুধ-চিনি খাবে না। খেয়েছ কি মরেছ, সারা জীবন অম্বলের ব্যথায় কষ্ট পেতে হবে।” 

আমি বললুম, “তাই?” 

সদানন্দবাবু বললেন, “অফ কোর্স। সার পি সি রায় বলতেন, চা-পান মানেই বিষপান আর আমার স্বর্গত পিতৃদেব বলতেন, বিষপান তো বটেই, তবে কিনা দুধচিনি মিশিয়ে যদি খাই।” 

বাসন্তী বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, আপনার জন্যে স্রেফ লিকার, কেমন?” 

“হ্যাঁ, স্রেফ লিকার, তাও খুব হালকা হওয়া চাই।” 

বাসন্তী চলে গেল। 

সদানন্দবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “দিনে আপনি ক’কাপ চা খান?”

হেসে বললুম “কী করে বলব? গুনে তো কখনও দেখিনি।” 

“তাও?” 

“তা পনরো-বিশ কাপ তো বটেই।” 

“দুধ-চিনি মিশিয়ে?’ 

“বিলক্ষণ।” 

“সিগারেটও পনরো-বিশটা?” 

“পনেরো-বিশটা কী বলছেন, চল্লিশ-পঞ্চাশটা তো হবেই।” 

কথাটা শুনে ভদ্রলোক কিছুক্ষণ স্রেফ হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন, “তা হলে মশাই আমি তো কোন্ ছার, বিধান রায় বেঁচে নেই, কিন্তু বেঁচে থাকলেই বা কী হত, তিনিও আপনাকে বাঁচতে পারতেন না। যদি বাঁচতে চান তো সিগারেট ছাড়ুন, আর চা’ও মাত্র তিন কাপ, তাও দুধ-চিনি না দিয়ে স্রেফ হালকা লি’র। পারবেন?” 

“পারা শক্ত। কিন্তু যদি পারি, মানে ধরুন যে, আমি পেরেই গেলুম, তা হলেই কি আর অম্বল আমাকে জ্বালাবে না?” 

চওড়া হেসে সদানন্দবাবু বললেন, “তবে আর বলচি কী! অম্বু কি আর আপনার একার অসুখ, এই কলকাতার অন্তত নাইনটি পার্সেন্ট লোক অম্বলে ভোগে। অঙ্ক আমার গিন্নিরও ছিল। কিন্তু এখন আর নেই। বেন নেই? না মাথার দিব্যি দিয়ে আমি তাঁর দুধ `নি দিয়ে চা খাওয়ার অভ্যেসটা ছাড়িয়েছি। বাতব্যাধিও সারিয়ে দিতে পারতুম। পারলুম না কে জানেন?” 

“কেন?” 

কাজের মেয়েটি এসে চা-জলখাবার দিয়ে গেল। সদানন্দবাবুর জন্যে স্রেফ হালকা লিকার। ভদ্রলোক তাঁর জলখাবারের প্লেটটা ছুঁলেন না পর্যন্ত। বললেন, “জলখাবার আমি খেয়ে এসেছি, এক সকালে দুবার জলখাবার খেতে পারব না। তবে হ্যাঁ, আপনাদের এখানে চা খেতে বলবেন, সেটা জানতুম তো, তাই বাড়িতে আর সেকেন্ড কাপ চা খাইনি।” 

ভদ্রলোক চায়ে চুমুক দিলেন, তারপর বললেন, “ কী কথা যেন হচ্ছিল?” 

“আপনার স্ত্রীর বাতব্যাধি কেন সারাতে পারলেন না, সেই কথা।” 

“ও হ্যাঁ, তা হলে শুনুন, রোজ যদি আমার সঙ্গে বেরিয়ে দু’মাইল মর্নিং ওয়াক করতেন তা হলে ওটাও সেরে যেত। তা ভদ্রমহিলা সকাল সাতটার আগে বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারেন না যে!” 

“মাথার দিব্যি দিয়েছিলেন?” 

“দিয়েছিলুম বই কী, কিন্তু তাও পারলেন না। আরে মশাই সাতটায় ঘুম থেকে উঠলে কি আর মর্নিং ওয়াক হয়? তখন রোদ্দুর উঠে যায়। হাঁটায় তখন আর মজা থাকে না।” 

নিজের চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে বাসন্তী ইতিমধ্যে ঘরে এসে ঢুকেছিল। বলল, “আপনি কখন ঘুম থেকে ওঠেন?” 

“সাড়ে চারটেয়।” 

“ওরে বাবা,” বাসন্তী যেন আঁতকে উঠল, “ওই সময়ে ওঠা যায় নাকি?” 

“কেন যাবে না, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেই তাড়াতাড়ি ওঠা যায়। আর্লি টু বেড অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ…..ছেলেবেলায় পড়া সেই ছড়াটা তো আর ভুলে যাইনি, তাই সাড়ে নটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি, আর উঠেও পড়ি কাঁটায় কাঁটায় একেবারে সাড়ে চারটেয়। হিসেব করে দেখুন ঝাড়া সাত ঘন্টা ঘুমোই। কম হল?” 

ঢোক গিলে বললুম, “না, তা হল না বটে, তবে অত সকাল-সকাল শুয়ে পড়ব কী করে? অফিস থেকে বাড়িতে ফিরতে ফিরতেই তো দশটা বেজে যায়। তারপর খাওয়া আছে, টুকটাক লেখাপড়ার কাজও থাকে, শুতে শুতে সেই বারোটা। সকাল সাতটার আগে তা হলে আর কী করে উঠব? মর্নিং ওয়াকই বা কী করে করব?” 

সদানন্দবাবুর চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। বাসন্তীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তা হলে আর আমার কিছু করার নেই। মর্নিং ওয়াক না করলে আপনার কর্তার ওই গেঁটে বাত সারবে না। তবে সিগারেটটা যদি ছাড়িয়ে দিতে পারেন, আর দুধ-চিনি বাদ দিয়ে আমি যে রকম চা খেলুম, কিরণবাবুর যদি তাতে আপত্তি না হয়…….তবে হ্যাঁ, তিন কাপের বেশি খাওয়া চলবে না……অম্বল তা হলে সারবেই।” 

বাসন্তী বলল, “ওষুধ খাওয়ার দরকার নেই?” 

“কিছু না। আজ তা হলে চলি। পরে আবার খবর নেব।” 

সদানন্দবাবু চলে গেলেন। 

তা এ হল দশ বছর আগের কথা। সদানন্দবাবুর কথামতো আমি মর্নিং ওয়াকটা ইতিমধ্যে ধরতে পারিনি বটে তবে চায়ের পেয়ালা থেকে দুধচিনি একেবারে বাদ দিয়েছি। সিগারেটটা অবশ্য অনেক চেষ্টা করেও ছাড়তে পারছি না, তবে আগের চেয়ে অনেক কম খাই। মেরেকেটে চার-পাঁচটা। তা দেখছি, ভদ্রলোক মোটেই বাড়িয়ে বলেননি। সত্যি আর এখন আমার অম্বল হয় না, বুকজ্বালা করে না, চোয়া ঢেকুরও ওঠে না। গেঁটেবাতের ব্যাপারটা অবশ্য এখনও আমাকে সমানে জ্বালাচ্ছে। তাই ভাবছিলুম যে, শিগগিরই তো রিটায়ার করব, তখন তো আর রাত দশটায় বাড়ি ফিরতে হবে না, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব, উঠেও পড়ব তাড়াতাড়ি, তারপরে সদানন্দবাবুর সঙ্গে রোজ বেরিয়ে পড়ব মর্নিং ওয়াক করতে। 

সদানন্দবাবুও আমাকে খুব উৎসাহ দিচ্ছিলেন। কথায় কথায় সেদিন বললেন, “দেখলেন তো, সিগারেটটা কমিয়ে দিয়ে শুধু যে অ্যাসিডিটির হাত থেকে বেঁচে গেলেন তা নয়, সর্দিকাশিও বলতে গেলে আর আপনার হয় না। তা ছাড়া দমও বেড়েছে। তা এখন ওই দমটাকে কাজে লাগান। মর্নিং ওয়াক করুন, রোজ শেষ-রাত্তিরে বেরিয়ে পড়ুন আমার সঙ্গে। মাইল দুয়েক হাঁটুন। ঘাম ঝরান। দেখবেন, অম্বল যেভাবে হটেছে গেঁটেবাতও ঠিক সেইভাবেই হটে যাচ্ছে। কী, বেরিয়ে পড়বেন আমার সঙ্গে?” 

বললুম, “এখন নয়। রিটায়ার করি, তারপর বেরুব।” 

সেই রকমই কথা ছিল, কিন্তু তা আর হল না। তার আগেই খুন হয়ে গেল নকুল বিশ্বাস। আর ভাড়াটে খুন হবার সঙ্গে-সঙ্গেই তার বাড়িওয়ালা সদানন্দ বসুও গ্রহের ফেরে পড়ে গেলেন। 

সদানন্দবাবুর মুখে যে কিছু-কিছু মেঘ জমতে শুরু করেছিল, সে-কথা আগেই বলেছি। ব্যাপারটা আমি প্রথম লক্ষ করি চার-পাঁচ বছর আগে। রবিবার। সকালবেলা। কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে বাজার করতে গিয়েছি, সেখানে ফলপট্টিতে হঠাৎ সদানন্দবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ভদ্রলোক আমাকে দেখে হাসলেন, দুটো-চারটে কথাও হল, কিন্তু লক্ষ করলুম। হাসিটা একটু শুকনো, কথাবার্তাতেও যেন আগেকার সেই প্রাণখো “ ভাবটা আর নেই। ভণিতা না করে জিজ্ঞেস করলুম, “ব্যাপারটা কী, বলুন তো?” 

“কীসের ব্যাপার?” 

“এই মানে কেমন যেন ঝিম মেরে রয়েছেন। মিসেসের সেই বাতের কষ্টটা আবার বেড়েছে নাকি?” 

ভদ্রলোক তাতে ক্লিষ্ট হেসে বললেন, “না মশাই, সে সব কিছু নয়, গিন্নি মোটামুটি ভালই আছে।” 

“তা হলে?” 

“তা হলে আবার কী, মাঝে-মধ্যে একটু গম্ভীরও হতে পারব না? ও কথা থাক, আপনি তো রোজ বৈঠকখানা বাজারে যান, আজ হঠাৎ এ-দিকে?” 

বললুম, “বৈঠকখানা বাজারে রবিবার বড্ড ভিড় হয়, তাই আর আজ ওদিকে যাইনি।” 

এর পরে আর কোনও কথা হল না। বুঝতে পারলুম কিছু একটা হয়েছে ঠিকই, তবে ভদ্রলোক সেটা চেপে যেতে চাইছেন। এ-সব ক্ষেত্রে বেশি-কিছু বলতে যাওয়াও ঠিক নয়, তাই আর কথা বাড়ালুম না, ফলপট্টিতে যা কেনাকাটা করার ছিল সেটা চুকিয়ে ফের বাজারে গিয়ে ঢুকলুম। 

বাড়ি ফিরে বাজারের থলি দুটো বাসন্তীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললুম, “সদানন্দবাবুর সঙ্গে দেখা হল।” 

“কোথায়?” 

“বাজারে। তা তুমি তো প্রায়ই ও বাড়িতে যাও, কিছু জানো?” 

অবাক হয়ে বাসন্তী বলল, কী জানব?” 

“এই মানে ভদ্রলোককে কেমন যেন বেজার ঠেকল।” 

বাসন্তী বলল, “এই ব্যাপার? আমি ভাবলুম কী না কী! তা একটু বেজার তো উনি হতেই পারেন।” 

“তার মানে?” 

 “মানে আর কী,” বাসন্তী বলল, “এই যে সারাজীবন আমরা ভাড়াবাড়িতে কাটিয়ে গেলুম, নিজের বাড়ি তৈরি করতে পারলুম না, এখন দেখছি একপক্ষে সেটা ভালই হয়েছে।” 

বাসন্তীর অনেক গুণের মধ্যে এই একটা মস্ত দোষ। সব কথাই সে ঘুরি-েপেঁচিয়ে বলে, ফলে কী যে বলছে চট করে সেটা বোঝা যায় না। 

বললুম, “কথাটা একটু বুঝিয়ে বলবে?” 

“বুঝিয়ে বলার তো কিছু নেই। এ তো খুবই সহজ কথা। ধরো কলকাতা শহরে তোমার যদি একটা বাড়ি থাকত আর ভাড়াটে বসাতে চাও না বলে সেই বাড়ির একতলাটা যদি তুমি খালি ফেলে রাখতে আর পাড়ার ছেলেরা যদি এসে তোমাকে বলত যে, মেসোমশাই আপনার একতলাটা তো ফাঁকাই পড়ে রয়েছে, ওটা আমাদের দিয়ে দিন, আমরা ওখানে আমাদের ড্রামাটিক ক্লাব করব, তো তুমি বেজার হতে না?” 

“পাড়ার ছেলেরা সদানন্দবাবুকে তা-ই বলেছে বুঝি?” 

“কুসুমদি তো তা-ই বললেন।” 

কুসুমদি মানে কুসুমবালা বসু। সদানন্দবাবু স্ত্রী। ভদ্রমহিলার শুনেছি অনেক গুণ। ছেলেপুলে হয়নি বলে হাতে বিস্তর সময় ছিল, সেই সময়টাকে নষ্ট না করে তিনি রান্না, সেলাই, এমব্রয়ডারি ইত্যাদি হরেক বিদ্যার চর্চা করেছেন। দেশি বিদেশি নানান রকম রান্না জানেন, পাড়ায় মেয়ে-বউরা সে-সব তাঁর কাছে শিখতেও যায়। তা ছাড়া যায় ব্লাউজ পাঞ্জাবি শার্ট স্কার্ট ইজের প্যান্ট ফ্রক ইত্যাদির ছাঁটকাট আর সেলাইয়ের ব্যাপারে তালিম নিতে। বাসন্তীও যায়। 

বললুম, “ও বাড়িতে শেষ কবে গিয়েছিলে?” 

“পরশু দুপুরে।” বাসন্তী বলল, “সোয়েটার বোনার একটা নতুন প্যাটার্ন শিখতে গিয়েছিলুম। তা কথায়-কথায় কুসুমদি বললেন, এ’কী উৎপাত হল বলো তো ভাই, হইচই চিৎকার-চেঁচামেচি সহ্য হয় না বলে একতলাটা ভাড়া দিইনি, এখন পাড়ার ছেলেরা এসে বলছে যে, একতলাটা তাদের ড্রামাটিক ক্লাবের জন্যে ছেড়ে দিতে হবে।” 

“ওরেব্বাবা, সে তো আরও মারাত্মক ব্যাপার। ড্রামাটিক ক্লাব মানেই তো রিহার্সাল আর রিহার্সাল মানেই তো তুমুল হট্টগোল। বলতে গেলে আমাদের সামনেই তো ওদের বাড়ি। কান্ডটা কী হবে, সেট বুঝতে পেরেছ?” 

বাসন্তী বলল, “পারব না কেন। ওখানে যদি ড্রামাটিক ক্লাব হয় তো তার রিহার্সালের ঠেলায় শুধু সদানন্দবাবুদের কেন, আমাদের কানও ঝালাপালা করে ছাড়বে।” 

“এর চেয়ে ভাড়াটে বসানো অনেক ভাল ছিল।” 

“ছিলই তো। কুসুমদিও সে-কথা বুঝতে পেরেছেন। বলছেন যে ভাড়াটে বসালে আজ আর এই ঝঞ্ঝাটে পড়তে হত না।” 

“তা সেটা তো এখনও বসানো যায়।” 

“যায়ই তো। সদানন্দবাবু শুনলুম দালালও লাগিয়েছেন তার জন্যে। বলেছেন যে, সেলামি চাই না, ভাড়াও যা পারে দিক, তবে কিনা দেরি করা চলবে না, সামনের মাসের পয়লা থেকেই ভাড়াটে বসাতে হবে।” 

হেসে বললুম, “বোঝো ব্যাপার। কলকাতা শহরে আজকাল বাড়ি ভাড়া বলতে গেলে পাওয়াই যায় না, দুখানা ঘরের জন্যে লোকে মাথা খুঁড়ে মরছে আর এদিকে সদানন্দবাবুর অবস্থা দ্যাখো, না চান বেশি ভাড়া, না চান সেলামি, স্রেফ একটি ভাড়াটে পেলেই ভদ্রলোক এখন বর্তে যান।” 

একটু অপেক্ষা করতে পারলে নিশ্চয় মোটামুটি শিক্ষিত আর ভদ্র একটি পরিবারকে ভাড়াটে হিসেবে পাওয়া যেত। তাড়াহুড়োর ফলে সেটা পাওয়া গেল না। সদানন্দবাবুকে সেজন্যে দোষ দেওয়া অর্থহীন, ভদ্রলোকের সত্যিই তখন অপেক্ষা করবার অবস্থা নয়। একেবারে শিরে-সংক্রান্তি অবস্থা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভাড়াটে বাছাবাছি করতে গেলে যে কালক্ষেপ হবার সম্ভাবনা, একতলাটা তার মধ্যে হয়তো হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। 

তা নকুলচন্দ্র বিশ্বাস যে আজ থেকে মোটামুটি চার বছর আগে ৫ নম্বর পীতাম্বর চৌধুরি লেনের একতলার তাড়াটে হয়ে এই গলিতে এসে ঢুকেছিল এই হচ্ছে তার ইতিহাস। দিনটার কথা এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে। সেও ছিল এক রবিবার। অফিসে আমার অফ ডে। দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পাট ঢুকেছে। মে মাসের মাঝামাঝি। আষাঢ়স্য প্রথম দিনটিকে যদি বর্ষাকালের সূচনা-দিবস বলে গণ্য করি তো সেই হিসেবমতো বর্ষা নামতে এখনও অন্তত মাস খানেক বাকি, অথচ গত পনরো দিনের মধ্যে একটিবারও কালবৈশাখীর ঝড় ওঠেনি, ফলে তাপাঙ্ক যেন চড়চড় করে চড়ে যাচ্ছিল। রাস্তায় পিচ-টিচ গলে গিয়ে একেবারে একাক্কার। মনে হচ্ছিল দুপুরের গনগনে রোদ্দুরে গোটা শহর যেন ঝলসে যাচ্ছে। তার আঁচ থেকে বাঁচবার জন্যে জানলা-দরজা বন্ধ করে আমাদের শোবার ঘরটাকে একেবারে অন্ধকার করে নিয়ে, মেঝের উপরে একটা বালিশ ফেলে সদ্য তখন আমি দিবানিদ্রার উদ্যোগ করছি, এমন সময় বাসন্তী এসে বলল, “দেখে যাও।” 

রাস্তার দিকের বারান্দায় গিয়ে দেখলুম সদানন্দবাবুর বাড়ির সামনে একটা ঠেলাগাড়ি এসে থেমেছে। ঠেলার পাশে যারা দাঁড়িয়ে আছে, দেখলেই বোঝা যায় যে, তারা স্বামী-স্ত্রী। স্বামীটির বয়স বছর চল্লিশ, বউটির বয়স ত্রিশ-বত্রিশের বেশি হবে না। দুপুরের রোদ্দুরে দরদর করে ঘামতে ঘামতে তারা ঠেলাওয়ালার সঙ্গে ধরাধরি করে মালপত্রগুলিকে একটা-একটা করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে ঢোকাচ্ছে। সদানন্দবাবুও উপর থেকে নেমে এসে তাদের সাহায্য করছেন সাধ্যমতো। মিনিট পনরো-কুড়ির মধ্যে সবকিছু ভিতরে ঢুকে গেল। 

সদানন্দবাবু আমাদের দেখতে পেয়েছিলেন। যথারীতি হাসলেন। মনে হল, হাসিটা যেন আর তত ক্লিষ্ট নয়। আমিও হাসলুম। কিন্তু কোনও কথা হল না। 

ঠেলাওয়ালা ভাড়া নিয়ে চলে গেল। বউটি আগেই বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। এবারে ভাড়াটেকে নিয়ে সদানন্দবাবুও রাস্তা থেকে ভিতরে ঢুকলেন। সদর দরজা বন্ধ হয়ে গেল। 

ভাড়াটের নাম কী, আগে কোথা? থাকত, কাজকর্ম কী করে, সে-সব কথা তখনও আমি কিছুই জানি না। 

পরদিন জানা গেল। 

 মনে আছে যে, অন্যান্য দিনের তুলনায় সেদিন অনেক সকাল-সকাল আমাকে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তে হয়েছিল। বলতে গেলে প্রায় ভোরবেলাতেই বাসন্তী আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে বলেছিল যে, কাজের মেয়েটি আজ আর আসতে পারবে না বলে খবর পাঠিয়েছে, তাই আমাকেই যেতে হবে হরিণঘাটার দুধ আনতে। 

চটপট মুখ-চোখ ধুয়ে রাস্তায় বেরিয়েছি, সদানন্দবাবুর সঙ্গে দেখা। 

বললুম, “কোথায় গিয়েছিলেন?” 

“দুধ আনতে। রোজই তো এই সময়ে আমি দুধ নিয়ে ফিরি।” 

“তাই বুঝি? আমি দেখছি কিছুই জানি না।” 

একগাল হেসে সদানন্দবাবু বললেন, “কী করে জানবেন? আপনার ঘুমই তো মশাই সাতটার আগে ভাঙে না। তা আজ এত সকাল-সকাল উঠে পড়েছেন যে।” 

বললুম, “কাজের মেয়েটি আসেনি। তাই আমাকেই আজ দুধ আনতে হবে।” 

“ভাল ভাল, খুব ভাল।” সদানন্দবাবু বললেন, “কাজের মেয়েটি যদি মাঝে-মাঝেই এইরকম কামাই করে তো খুব ভাল হয়। রোজ না হোক, অন্তত মাঝে-মাঝে তা হলে আর আপনার সকাল-সকাল না উঠে উপায় থাকে না।” 

কথাটার উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলুম, পিছন থেকে সদানন্দবাবু আবার ডাকলেন। বললেন, “একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি। নকুল কিন্তু লোকটি নেহাত খারাপ নয়।” 

“কে নকুল?” 

“ওই কাল দুপুরে যাকে দেখলেন। নকুল বিশ্বাস… মানে একতলাটা যাকে ভাড়া দিলুম আর কি। ভাড়া অবিশ্যি খুবই কম, মাত্র একশো টাকা। তা কী আর করা যাবে, খুব তাড়াহুড়ো করে ভাড়াটে বসাতে হল তো, নইলে নিশ্চয় অনেক বেশি ভাড়া পাওয়া যেত।” 

বললুম, “তা যেত বই কী।” 

সদানন্দবাবু বললেন, “ তা হোক, আমি তো আর টাকার জন্যে ভাড়া দিইনি, ভাড়া না-দিলে গোটা একতলাটাই ওই বখাটে ছেলেগুলো দখল করে নিত, তাই দিয়েছি। ভাড়া নাহয় কমই পেলুম, হল্লাবাজির হাত থেকে বাঁচলুম তো, সে-ই ঢের।” তারপর একটু থেমে বললেন, আর তা ছাড়া একশো টাকার বেশি দেবেই বা কী করে?” 

আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল। এর পরে গেলে হয়তো শুনতে হবে যে, দুধ ফুরিয়ে গেছে। বললুম, “পরে কথা বলব, এখন চলি।” 

দুধ নিয়ে বাড়ি ফিরে বাসন্তীকে বললুম “শুনেছ?” 

রান্নাঘর থেকে বাসন্তী বলল, “কী শুনব?” 

“সদানন্দবাবু তাঁর একতলাটা মাত্র একশো টাকায় ভাড়া দিলেন।” 

“শুনেছি।” 

বললুম “তুমি তো বলো কুসুমদির মতন মানুষ নাকি হয় না, অথচ কই, তোমাকে তো একবারও ওঁদের একতলাটা ভাড়া নেবার কথা বলেননি।” 

“বলেছিলেন তে।” 

“সে কী, এখানে আমরা তিনশো টাকা ভাড়া দিচ্ছি, তার জায়গায় একশো টাকাতেই হয়ে যেত। তবু রাজি হলে না?” 

কাজের মেয়ে না-আসার জন্যেই বোধহয় বাসন্তীর মেজাজ বিশেষ ভাল ছিল না। রান্নাঘর থেকেই চড়া গলায় বলল, “কেন রাজি হব? একে তো একটা বাড়ি করতে পারোনি, তার উপরে আবার দোতলার ফ্ল্যাট থেকে একতলায় নামাতে চাইছ। কিনা ভাড়া মাত্তর একশো টাকা! তোমার লজ্জা করে না?” 

ওরেব্বাবা, এ তো দেখছি রেগে একেবারে যজ্ঞিবাড়ির উনুন হয়ে রয়েছে। আর কথা না বাড়িয়ে বাইরের ঘরে এসে খবরের কাগজের হেডলাইনে চোখ বুলোতে লাগলুম। 

খানিক বাদেই সদানন্দবাবু এলেন। বললেন, “অসময়ে এসে বিরক্ত করলুম না তো?”

বললুম, “আরে না মশাই, কী যে বলেন। বসুন, চায়ের কথা বলে আসছি।” 

সদানন্দবাবু বললেন, “আপনার যদি খেতে হয় তো খান, আমি এখন চা খাব না। আমার সেকেন্ড কাপ অলরেডি খাওয়া হয়ে গেছে। আর থার্ড কাপ খাব সেই বিকেলবেলায়। আপনি তো জানেনই যে, তিন কাপের বেশি চা আমি খাই না, ‘ওটাই হচ্ছে লিমিট।” 

সত্যি কথা বলতে কী, সদানন্দবাবু যে এখন চা খাবেন না, এইটে জেনে ভারী স্বস্তি পাওয়া গেল। বাসন্তীর যা মেজাজ দেখলুম, তাতে তাকে চায়ের কথা বলতে বিশেষ ভরসা হচ্ছিল না। 

বললুম, “তখন দুধ আনতে যাচ্ছিলুম তো, তাই তাড়া ছিল, আপনার কথা ঠিকমতো শোনা হয়নি। তা ভাড়াটে তা হলে ভালই পেয়েছেন?” 

সদানন্দবাবু বললেন, “তা-ই তো মনে হচ্ছে। আমি মশাই শান্তিপ্রিয় লোক, আমদানি না হয় একটু কমই হল, লোকটা মোটামুটি ঠান্ডা স্বভাবের হলেই আমি খুশি। তা নকুলকে তো ঠান্ডা স্বভাবের লোক বলেই মনে হচ্ছে। এখন দেখা যাক।” 

“আগে ওঁরা কোথায় থাকতেন?” 

“শ্রীমানী মার্কেটের পাশের গলিতে। একটা মাত্তর ঘর নিয়ে থাকত। তাতে অসুবিধে হচ্ছিল। নকুলের কাছে লোকজন আসে, তা ঘর তো একটাই, বাইরের লোককে ঘরে ঢুকিয়ে কথাবার্তা বলতে হলে বউয়ের অসুবিধে হয় তাই দু-কামরাওলা ফ্ল্যাট খুঁজছিল। 

“কী করেন ভদ্রলোক?” 

“অর্ডার সাপ্লাই। ডালহৌসি-পাড়ার অফিসে-অফিসে ঘুরে খোঁজ নেয় কার কী দরকার, তারপর মাল সাপ্লাই করে। ওই আর কি সস্তায় মাল কিনে কিছুটা মার্জিন রেখে বিক্রি করার ব্যাপার। খুব একটা হাতিঘোড়া রোজগার করে বলে মনে হয় না, তবে চলে যায়!” 

ভাড়াটে হিসেবে নকুলের সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট যা বুঝলুম সেটা অবশ্য এই যে তারা লোক মাত্র দুটি। 

ণদানন্দবাবু উঠে পড়লেন। তারপর চলে যেতে-যেতে দরজা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে একগাল হেসে বললেন, “কী জানেন, সংখ্যাটা যে আর বাড়বে, তাও মনে হয় না। বউটির বয়েস অন্তত তিরিশ তো হবেই, তা এখনও যখন ছেলেপুলে হয়নি, তখন আর কবে হবে?” 

ভদ্রলোক বেরিয়ে গেলেন। খানিক বাদে বাসন্তী এসে ঘরে ঢুকল। বললুম, “সদানন্দবাবু এসেছিলেন।” 

“কী বললেন?” 

“বললেন যে উনি যেমন নিঃসন্তান, ওঁর ভাড়াটেরও তেমনি নাকি ছেলেপুলে হবার কোনও সম্ভাবনা নেই। ভদ্রলোককে খুব খুশি বলে মনে হল।” 

বাসন্তী হেসে বলল, “খুশি তো হবেনই। যেমন বাড়িওয়ালা, তেমনি ভাড়াটে। এ তো একেবারে সোনায় সোহাগা।” 

তা এও হল চার বছর আগের কথা। 

এই কাহিনীর শুরু হয়েছে একেবারেই দিন কয়েক আগের একটা ঘটনা দিয়ে। কিন্তু তার পরেই আবার পিছিয়ে গিয়েছি। কখনও বলেছি বছর দশেক আগের কথা, কখনও বলেছি বছর চারেক আগের। এমনটা কিন্তু মাঝে মাঝেই ঘটতে পারে। অর্থাৎ কখনও পিছিয়ে যাব, আবার কখনও এগিয়ে আসব। ঘটনাগুলিকে পর-পর সাজিয়ে দিতে পারতুম। কিন্তু এই কাহিনীর রস তা হলে জমত না। 

আমার মনে হয় আমাদের এই গলিটার একটা বর্ণনা এখানে দেওয়া দরকার। পীতাম্বর চৌধুরি লেন যে মধ্য-কলকাতার শেয়ালদা অঞ্চলে, সেটা অবশ্য আগেই বলেছি। এর একটা মুখ আপার সার্কুলার রোডে অর্থাৎ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোডে পড়েছে, আর অন্য মুখ পড়েছে হ্যারিসন রোডে অর্থাৎ মহাত্মা গান্ধী রোডে। এখান থেকে শেয়ালদা ইস্টিশানে হাঁটাপথে মাত্র তিন-চার মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায়, আর বাসে উঠে-রাস্তায় যদি না জ্যাম থাকে তো—হাওড়া ইস্টিশানে পৌঁছতে মিনিট পনেরোর বেশি সময় লাগে না। ইস্কুল-কলেজের সুবিধেও বিস্তর! রাস্তা পার হলেই রিপন কলেজ অর্থাৎ সুরেন্দ্রনাথ কলেজ। মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই বঙ্গবাসী। হিন্দু স্কুল, হেয়ার স্কুল, মিত্র মেইন, প্রেসিডেন্সি কলেজ, সংস্কৃত কলেজ, সবই হাঁটা পথের চৌহদ্দির মধ্যে। তা ছাড়া আপার সার্কুলার রোড ধরে রাজাবাজারের দিকে খানিকটা হাঁটলেই ভিক্টোরিয়া কলেজে পৌঁছে যাচ্ছেন। যেমন ছেলেদের তেমনি মেয়েদেরও লেখাপড়ার এত সুবিধে এই শহরের আর কোথাও আছে বলে জানি না। সেন্ট পলস কলেজও এখান থেকে মাত্র দশ মিনিটের হাঁটা পথ। 

হাট-বাজারেরও বিস্তর সুবিধে। যেমন এদিকে রয়েছে বৈঠকখানা বাজার আর কোলে মার্কেট, তেমনি ওদিকে রয়েছে কলেজ স্ট্রিটের বনেদি বাজার। বাস ট্রাম ইত্যাদিও একেবারে দোরগোড়ায়। সত্যি বলতে কী, এত সব সুবিধে পাচ্ছি বলেই পীতাম্বর চৌধুরি লেনের দোতলার এই ফ্ল্যাটটা আমার পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। 

বাসন্তীর পছন্দ হয়নি। ঠোট উল্টে বলেছিল, “কী যে তোমার পছন্দ, বুঝি না বাপু। এইরকমের ঘিঞ্জি জায়গায় মানুষ থাকতে পারে! আমার তো দম বন্ধ হয়ে আসছে।” 

তা পাড়াটা যে ঘিঞ্জি, তাতে সন্দেহ নেই। গলিটাও একে এঁদো, তায় সিধে-সরল নয়। এদিককার বড়রাস্তা থেকে শুরু হয়ে তিন-চারটে পাক খেয়ে তারপর ওদিকবার বড়রাস্তায় গিয়ে পড়েছে। লাঠির বাড়ি লাগলে সাপ যেভাবে মোচড় খায়, এও প্রায় সেই রকমের ব্যাপার। 

পীতাম্বর চৌধুরি লেনের যাঁরা বাসিন্দা, তাঁদের কেউই যে খুব অবস্থাপন্ন ব্যক্তি, এমন মনে হয় না। তাদের মধ্যে ছোটখাটো ব্যবসায়ী; দোকানদার ও দালাল-শ্রেণীর লোক জনাকয় আছেন বটে, তবে অধিকাংশই চাকুরে। পুরুষানুক্রমে তাঁরা সরকারি ও বেসরকারি অফিসে চাকরি করে যাচ্ছেন। সকাল ন’টা সাড়ে ন’টার মধ্যে তাঁরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন, তারপর সারাটা দিন অফিসে কাটিয়ে বিকেল ছটা সাড়ে-ছটা নাগাদ বাড়িতে ফিরে স্নান সেরে, কিঞ্চিৎ জলযোগ করে নিয়ে বাড়ির সামনের রোয়াকে বসে গল্প-গুজব করেন, আর কোঁচার খুট কি রুমাল ঘুরিয়ে হাওয়া খান। 

বাড়িগুলো যে তাঁদের বাপ-ঠাকুদার আমলে কি তারও আগে তৈরি হয়েছিল তা বুঝতে কারও অসুবিধে হবার কথা নয়। চুন-সুরকি দিয়ে গেঁথে তোলা মোটা-দেওয়ালের পেটাছাতের বাড়ি। সে কালের কর্তারা হয়তো মিস্ত্রি ডেকে মাঝে-মধ্যেই ছোটখাটো মেরামতি কি দাগরেজির কাজ করিয়ে নিতেন। এ-কালের কর্তাদের না আছে তেমন ট্যাকের জোর, না আছে ভাগের বাড়িতে পয়সা ঢালার উৎসাহ। ফলে মেরামতি যেমন হয় না, তেমনি জানলা দরজাতেও আর নতুন করে রঙের প্রলেপ পড়ে না। কোনও কোনও বাড়িতে বোধহর গত কুড়ি-পঁচিশ বছরের মধ্যে চুনকামের কাজও হয়নি। অধিকাংশ বাড়ির অবস্থাই অতি লঝড়। চৌত্রিশ সালে সেই যে একটা ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়েছিল, তার ধাক্কাটা যে এ-সব বাড়ি কী করে সামলে নিল তা কে জানে, তবে কিনা আবার যদি তেমন কোনও ভূমিকম্প হয় তো এ গলির প্রত্যেকটা বাড়িই নির্ঘাত হুড়মুড় করে ধসে পড়বে। আলসের বটগাছের চারা, বর্ষাকালে ফাটা রেনপাইপ দিয়ে ছড়ছড় করে চতুর্দিকে জল পড়তে থাকে। রাস্তা দিয়ে তখন খুব সন্তর্পণে চলাফেরা করতে হয়। একটু অসতর্ক হলেই পাইপের নোংরা জল পড়ে জামাকাপড় ভিজে যাবার আশঙ্কা। বাইরের দেওয়ালের পল তারা খসে পড়েছে, ফলে ভিতরকার গাঁথনির ইে এমনভাবে দাঁত বার করে রয়েছে যে, তার উপরে চোখ পড়বামাত্র অতিশয় অশ্লীল একটা উপমা অনেকের মাথায় আসবে। মনে হবে বাড়িগুলো যেন তাদের পরনের কাপড় তুলে উদোম হয়ে সর্বজনকে নিজেদের খোস-পাঁচড়া দেখাতে পারার একটা উৎকট উল্লাসে সারাক্ষণ নিঃশব্দে হেসে চলেছে। 

যে বাড়িতে আমরা আছি, সেটাও কিছু ব্যতিক্রম নয়, মোটামুটি এই একই রকমের। তিনতলা বাড়ি। মালিকের অবস্থা ভাল নয়। তিনি রিটায়ার করেছেন, কিন্তু তিনটে ছেলের একটাও মানুষ হয়নি, তা ছাড়া দুই মেয়ের বিয়ে এখনও বাকি। এদিকে ছেলে তিনটে যদিও কোনও কাজকর্ম করে না, তাদের মধ্যে বড় আর মেজো ইতিমধ্যে বিয়ে করে ফেলেছে। বাড়িওয়ালার পরিবারটি অতএব নেহাত ছোট নয়। তিনতলার তিনটে ঘর নিয়ে তিনি থাকেন। খুব যে হাত-পা ছড়িয়ে থাকেন না, সেটা সহজেই বুঝতে পারি। একতলার ভাড়াটেরা সম্ভবত গত পঞ্চাশ বছর ধরে এখানে রয়েছে। ভাড়া দেয় যৎসামান্য, তাও ঠিকমতো দেয় না শুনেছি, কিন্তু কিছু করারও নেই, মামলা করেও বাড়িওয়ালা তাদের তুলে দিতে পারছেন না। বাকি রইল দোতলা। সেখানে আমরা থাকি। আমরা মানে আমি বাসন্তী আর আমাদের ছোট মেয়ে। ছেলেকে কর্মসূত্রে বাইরে থাকতে হয়, বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, ছোট মেয়ে ব্রেবোর্ন কলেজে পড়ে, এখান থেকে বাসে উঠে চটপট কলেজে পৌঁছে যায়, কোনও অসুবিধে হয় না।

যা কিছু অসুবিধে ছিল তা এই পুরনো ভাঙাচোরা বাড়ির ফ্ল্যাটটা নিয়েই। তবে সেটাও আমি নিজের উদ্যোগে যতটা সম্ভব মিটিয়ে নিয়েছি। ফ্ল্যাটটা যখন দেখতে আসি, তখনই বুঝেছিলুম যে, দেওয়ালের পলস্তারা থেকে জানালা-দরজা অনেক কিছুই সারিয়ে সুরিয়ে নিতে হবে। বাড়িওয়ালাকে সেলামি-বাবদ পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়েছিল, কিন্তু মেরামতির বাবদে তা থেকে তিনি একটি পয়সাও খরচ করতে রাজি হলেন না। বললেন যে, অ্যাডভান্স বাবদ যদি আরও হাজার কয়েক টাকা দিই, তো তাই দিয়ে তিনি মেরামতি করিয়ে দেবেন। তা টাকাটা তাঁকে দিয়েওছিলুম, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি কিছুই করলেন না। বারকয় তাগাদা দিতে লজ্জিত গলায় বললেন যে, তিনি অভাবী মানুষ, টাকাটা খরচ করে ফেলেছেন। ফলে যা-কিছু মেরামতির কাজ ছিল, আবার কিছু গাঁটগচ্চা দিয়ে সেগুলি করিয়ে নিয়ে তারপর আমাকে এই নতুন আস্তানায় এসে উঠতে হয়। 

পাঁচ নম্বর বাড়িটার চেহারা কিন্তু এতসব পুরনো লজঝড় বাড়ির মধ্যেও একটু অন্যরকম। বয়স অবশ্য সেটারও কিছু কম হয়নি। সদর দরজার পাশে দেওয়ালের গায়ে বর্ডার-দিয়ে-বসানো শ্বেতপাথরের ট্যাবলেট পড়ে যেমন বোঝা যায় যে, বাড়িটার নাম শ্যামনিবাস, তেমনি সেই নামের নীচে ১৮৭০ দেখে মালুম হয় যে, আজ থেকে একশো বছরেরও বেশি আগে এ বাড়ি তৈরি হয়েছিল। তৈরি করিয়েছিলেন সদানন্দের প্রপিতামহ শ্যামানন্দ বসু। পাথরের ট্যাবলেটটা অবশ্য তাঁর লাগানো নয়। সদানন্দের পিতামহ দয়ানন্দ বসু ওটা এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে লাগিয়ে দিয়ে তাঁর পিতৃভক্তির প্রমাণ রেখেছিলেন। 

পীতাম্বর চৌধুরি লেনের বেশির ভাগ বাড়িই পার্টিশান হয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। কালক্রমে শরিকের সংখ্যা তো বেড়েই যায়, ছোটখাটো নানা ব্যাপার নিয়েও তখন ঝগড়াঝাঁটি লাগতে থাকে, যৌথ একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে চৌচির হয়, ফলে বাড়িটাও আর পার্টিশান না করে উপায় থাকে না। এখানেও সেই একই ব্যাপার হয়েছে। কিছু-কিছু বাড়িতে তো যত ঘর তত শরিক। পাঁচ নম্বর বাড়িটাও শরিকে-শরিকে ভাগ হয়ে যেতে পারত। তা যে হয়নি, তার কারণ আর কিছুই নয়, শ্যামানন্দের সময় থেকেই এ-বাড়ির মালিকদের কারও একাধিক পুত্র-সন্তান হয়নি। ব্যাপারটা পরিকল্পিত নয় নিশ্চয়ই, পরিবার পরিকল্পনা নেহাতই এ-কালের ব্যাপার, সদানন্দের পূর্বপুরুষেরা এতসব প্ল্যানিংয়ের ধার ধারতেন না। তবু যে তাঁদের প্রত্যেকেরই মাত্র একটি করে পুত্র, এটাকে একটা আকস্মিক ব্যাপারই বলতে হবে। শ্যামানন্দের একমাত্র পুত্রসন্তান দয়ানন্দ; দয়ানন্দের একমাত্র পুত্রসন্তান মহানন্দ; এবং মহানন্দেরও একমাত্র পুত্রসন্তান আমাদের এই সদানন্দ বসু। লাইনটা অবশ্য এখানেই শেষ। সদানন্দ যে নিঃসন্তান মানুষ, সে-কথা আগেই বলেছি। 

যা-ই হোক, যে-কথা বলছিলুম সেটা এই যে, পূর্বপুরুষদের কারও একাধিক পুত্রসন্তান না-হওয়ায় এই পরিবারের স্থাবর অস্থাবর কোনও সম্পত্তিই কখনও ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়নি। তা ছাড়া, সদানন্দবাবুর কাছেই শুনেছি, তাঁর পূর্বপুরুষদের কারও এমন কোনও বদ-খেয়ালও ছিল না যে, বাড়ি বন্ধক দিয়ে কি ঘটিবাটি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করবার দরকার পড়বে। নেশা বলতে যা বোঝায়, তা ছিল একমাত্র দয়ানন্দের। তা সে-নেশাও ঘোড়া কিংবা মদ-মেয়েমানুষের নয়, ঘুড়ি আর পায়রা ওড়ানোর, যাকে কিনা বৃহৎ কোনও বদ-খেয়ালের পর্যায়ে ফেলা যাচ্ছে না। 

জন্মসূত্রেই সদানন্দ তাই মোটামুটি সচ্ছল মানুষ। চাকরিটা খুব উঁচু দরের করেননি বটে, তবে মাঝে-মধ্যেই দু’চার টাকা উপরির ব্যবস্থা থাকায় তাঁর রোজগার নেহাত খারাপও ছিল না। ফলে বাড়িটা যতই পুরনো হোক বছরে অন্তত একবার মিস্ত্রি-মজুর লাগিয়ে তিনি তাতেই একটু চেকনাই ফুটিয়ে রাখতে পেরেছেন। 

বাড়িটা বিশেষ বড়ও নয়। দোতলা-একতলা মিলিয়ে ঘর মাত্রই চারটে। উপরের তলায় দুটো আর নীচের তলায় দুটো। তবে দুটো তলাই এমনভাবে তৈরি হয়েছিল, উপর-নীচে ভাগাভাগির দরকার হলেও যাতে কোনও তলার শরিকের কোনও অসুবিধে না হয়। উপরতলায় যেমন রান্নাঘর, একফালি ভাঁড়ার আর বাথরুমে আছে, তেমনি আছে নীচের তলাতেও। সদানন্দবাবুর অবশ্য চারটে ঘরের দরকারও হয় না। মানুষ তো এ-সংসারে দুটি মাত্র, দোতলার দুখানা ঘরেই তাই তাঁর দিব্যি চলে যায়। একতলাটা তবু যে তিনি ফাঁকা ফেলে রেখেছিলেন, তার কারণ তো আগেই বলেছি, ভদ্রলোক ঝুট-ঝামেলা পছন্দ করেন না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পাড়ার ছেলেরা বেদখল করে নিতে পারে, এই ভয়েই তিনি তাড়াহুড়ো করে ভাড়াটে বসিয়ে দিলেন। তবে সেটা বসাবার আগে, ভাড়ার ব্যাপারে মাথা না ঘামালেও, এই একটা ব্যাপারে তিনি একেবারে ষোলো-আনা নিশ্চিত হয়ে নিয়েছিলেন যে, ভাড়াটে হয়ে যারা আসছে, তাদের লোকসংখ্যা খুবই কম। 

পাড়ার ছেলেদের ভয়ে সদাহাস্যময় সদানন্দবাবুর মুখে তো মেঘ জমতে শুরু করেছিল। ভাড়াটে বসাবার পরে দেখলুম মেঘ কেটে গিয়েছে, সদানন্দবাবু আবার সেই আগের মতো হাসছেন। কথাবার্তাও বলছেন সেই আগের মতোই প্রাণ খুলে। দেখে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছিলুম। 

কিন্তু খুব বেশিদিন নিশ্চিন্ত থাকা গেল না। সে-কথায় একটু বাদে আসছি। তার আগে তাঁর দৈনন্দিন রুটিন আর ওই মর্নিং ওয়াকের কথাটা একটু বলে নেওয়া ভাল। 

মর্নিং ওয়াকটাও অবশ্য তাঁর দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যেই পড়ে। সবটা তো স্বচক্ষে দেখবার উপায় নেই, প্রায় বারো-আনাই শোনা-কথা। তা যে-সব কথা শুনি, তা যদি মিথ্যে না হয় তো বুঝতে হবে, সদানন্দবাবু প্রতিটি কাজ করেন একেবারে ঘড়ি ধরে, নির্দিষ্ট একটা রুটিন অনুয়ায়ী। কী শীত, কী গ্ৰীষ্ম, ভদ্রলোক ঘুম থেকে ওঠেন কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে চারটের সময়, চোখে-মুখে জল দিয়ে নিজের হাতে স্টোভ ধরিয়ে জল ফুটিয়ে এককাপ চা খান। চা মানে ওই হালকা লিকার। তাতে সব মিলিয়ে মিনিট পঁচিশেক সময় যায়। স্টোভে যখন জল গরম হচ্ছে, তার মধ্যেই পালটে নেন তাঁর জামাকাপড় তারপর চা খেয়ে যখন সদর-দরজা খুলে মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়ে পড়েন, ঘড়িতে তখনও পাঁচটা বাজেনি, মিনিট কয়েক বাকি। সদর দরজায় গোদরেজের টানাতালা বসিয়ে নিয়েছেন। তার একটা চাবি সদানন্দবাবুর কাছে থাকে, আর অন্যটা থাকে ভাড়াটেদের কাছে। দরজা বন্ধ করবার জন্যে কাউকে ডেকে তুলবার দরকার হয় না, স্রেফ পাল্লাটা টেনে দিয়ে বেরিয়ে পড়লেই হল। যখন বেরিয়ে পড়েন, তখন তাঁর হাতে থাকে একটা লাঠি আর এখটা টর্চ। লাঠিটা আমি দেখেছি। এই রকমের লাঠি বড় একটা দেখা যায় না। মোটা বেতের লাঠি, তার মাথায় একটা লোহার বল বসানো। 

কখনও আধা ঘন্টা হাঁটলেন, কখনও চল্লিশ মিনিট, সদানন্দবাবুর জীবনে এমনটা হবার উপায় নেই রোজ একেবারে নিয়ম করে তিনি ঠিক এক ঘন্টা হাঁটেন। শ্রদ্ধানন্দ পার্ক দূরে নয়, সে শনে গিয়ে গোটাকয় চক্কর মেরে একেবারে কাঁটায় কাঁটায় ছ’টায় তিনি বাড়িতে ফেরেন। ফিরে, দোলায় উঠে আবার স্টোভ ধরিয়ে চা বানাতে লেগে যান। এবারে বানান দুকাপ চা। গিন্নির ঘুম ভাঙিয়ে এককাপ তাঁর হাতে তুলে দেন, অন্য কাপ তাঁর নিজের জন্য। চা খেতে-খেতে গিন্নির সঙ্গে দুটো-একটা কথা হয়, তারপর বেরিয়ে পড়েন দুধ আনতে। দুধ এনে সাতটার সময় বেরিয়ে পড়েন বাজারে। বৈঠকখানা বাজারে রোজ যান না। বাজার আজকাল তার গন্ডি ছাড়িয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, হ্যারিসন রোডের দুধারেই সারে সারে আলু-পটোল-ঝিঙে-বেগুন আর মাছের ব্যাপারীরা বসে যায়, কিন্তু সদানন্দবাবুর কেনাকাটা তবু যে এক ঘন্টার আগে শেষ হয় না, তার কারণ তিনি ‘রেদস্তুর করতে ভালবাসেন, প্রতিটি জিনিস কেনেনও খুব বাছাই করে। বাড়ি ফেরেন আটটায়। তখন লেখাবার খান, কিন্তু তার সঙ্গে আর চা খান না। তৃতীয় কাপ চা খান বিকেল চারটেয়। 

তা এ হল সকালবেলার হিসেব। বাকি দিনটাও এইরকমের রুটিনে বাঁধা। কোথাও কোনও নড়চড় হবার উপায় নেই। এইভাবে চললে নাকি শরীর সজুত থাকে, আয়ুবৃদ্ধি হয়। হবেও বা 

সদানন্দবাবুকে আমি কখনও মর্নিং ওয়াকে বেরোতে দেখিনি, ফিরে আসতেও না। ওই স্বর্গীয় দৃশ্য কি আর আমার মতো অলস লোকের পক্ষে দেখা সম্ভব? রোজই যে আমি দেরি করে ঘুমোই তাই ঘুম ভাঙতে বেলা হয়ে যায়,তা অবশ্য নয়। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারলে, আর রাত জেগে যা শেষ করতে হবে এমন কোনও জরুরি কাজ হাতে না থাকলে, এক-একদিন তো দশটার মধ্যেই শুয়ে পড়ি। কিন্তু তাতেও দেখেছি সাতটার আগে ঘুম ভাঙে না। তা হলে আর সদানন্দবাবুর ভোর-পাঁচটার মর্নিং ওয়াক কী করে দেখব। 

আমার ছোট মেয়ে পারুল অবশ্য দেখেছে। সেও দেখত না, যদি না সামনের এপ্রিলেই বি. এ ফাইনাল পরীক্ষায় বসবার জন্যে তাকে আদাজল খেয়ে তৈরি হতে হত। পার্ট ওয়ানের ফল বিশেষ ভাল হয়নি, এখন ফাইনালটা ভাল করে দেওয়া দরকার, গত মাস তিনেক ধরেই সে তাই নাকি শেষ-রাত্তিরে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসে যাচ্ছে। 

সেদিন সকালবেলার জলখাবার খাবার সময় কথায়-কথায় সদানন্দবাবুর প্রসঙ্গ উঠেছিল। দিন কয়েক যাবৎ আমার গেঁটেবাতের যন্ত্রণা বড় বেড়েছে। বাসন্তীকে সে-কথা বলতে সে বলল, “দোষ তোমারও কম নয় বাপু, সদানন্দবাবুর পরামর্শ মতো এই যে দুধ-চিনি বাদ দিয়ে চা ধরেছ, এতে তোমার অ্যাসিডিটি যে অনেক কমে গেছে, সেটা তো স্বীকার করবে?” 

বললুম, “বা রে, তা আমি অস্বীকার করব কেন?” 

বাসন্তী বলল, “এবারে ওঁর মতো মর্নিং ওয়াকটাও ধরে ফ্যালো। ভদ্রলোক তো কতদিন ধরেই বলছেন, অথচ তুমিই গা করছ না। রোজ সকাল পাঁচটায় যদি ওঁর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে একটু ঘুরে আসতে, তো তোমার এই গেঁটেবাতের ব্যথাও নিশ্চয় খানিকটা অন্তত কমে যেত।” 

হেসে বললুম, “ওরেব্বাবা, ও-সব আমার দ্বারা হবে না।”

পারুল বলল, “না-হবার কিছু নেই বাবা। বোস-জেঠু তো দেখি রোজ সকালে একেবারে কাঁটায়-কাঁটায় পাঁচটার সময় বেরিয়ে পড়েন। তা তিনি যদি অত সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারেন তো তুমিই বা পারবে না কেন?” 

বললুম, “তুই কি সেই সময়ে ওঁকে দেখতে পাস নাকি? তুইও তো তখন ঘুমিয়ে থাকিস। 

পারুল তাতে রেগে গিয়ে বলল, “এই হচ্ছে তোমার মস্ত দোষ। বাড়ির কোনও খবরই তুমি রাখো না, এমন কী, তোমার মেয়ে কখন ঘুম থেকে ওঠে, তাও তোমার জানা নেই। তা হলে শুনে রাখো, গত ডিসেম্বর মাস থেকেই রাত চারটেয় ঘুম থেকে উঠে আমি পড়তে বসে যাচ্ছি।” 

“হঠাৎ এত সুমতি যে?” 

জলখাবার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। কাপ-প্লেট গোছাতে-গোছতেই বাসন্তী আমার দিকে অবাক চোখে তাকাল, তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে তেতো-গলায় বলল, “তা হলেই বোঝ যে, তোর বাবা কত দায়িত্বশীল মানুষ। সামনের মাসেই যে মেয়ের ফাইনাল পরীক্ষা, তা পর্যন্ত জানে না!” 

পারুল যেমন হঠাৎ-হঠাৎ রেগে যায়, তেমনি তার রাগটা আবার পড়েও যায় খুব তাড়াতাড়ি। বাসন্তীর কথায় আমি যে খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গিয়েছি এইটে বুঝে হেসে ফেলে বলল, “থাক, থাক, বাবাকে আর কিছু বোলো না মা। এমনিই তো বাতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে, বেশি যদি বকাঝকা করো তো ব্লাড প্রেশারও চড়ে যাবে।” 

বাসনপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাসন্তী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তখন পারুল বলল, “আমার পড়ার টেবিলটা তো জানলার ধারেই, রোজ পাঁচটায় সত্যি আমি বোস-জেঠুকে বেরিয়ে পড়তে দেখি। ডিসেম্বর মাস থেকেই দেখছি।” 

“সত্যি?” 

“তবে আর বলছি কী! এখন তো গরম পড়ে গেছে, শীতের সময়েও একেবারে কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটায় উনি মর্নিং-ওয়াকে বেরিয়ে পড়তেন। উঃ তখন যে ওঁকে কী অদ্ভুত দেখাত, সে আর কী বলব!” 

“অদ্ভুত দেখাত মানে?”

“যদি না বকো তো বলি। বলো, বকবে না তো?” 

“না, না, বকব কেন? আমি কি কখনও কাউকে বকি নাকি? ওটা তো তোর মায়ের ডিপার্টমেন্ট।”

পারুল হেসে বলল, “ওর বাড়ির সামনেই স্ট্রিট-লাইট তো, তাই দেখতে কোনও অসুবিধে হত না। পায়ে বুটজুতো, গায়ে বিশাল অলেস্টার, তার উপরে আবার মাথায় মাঙ্কি-ক্যাপ… ওই যা পরলে শুধু চোখ দুটো আর নাকের ফুটোটা বেরিয়ে থাকে, বাদবাকি সব ঢাকা পড়ে যায়। তখন না….. তখন না…..বলি বাবা?” 

বললুম, “অত কিন্তু-কিন্তু করছিস কেন, বলেই ফ্যাল না!” 

“তখন ওঁকে টিভিতে যে রামায়ণ চলছিল না, তার জাম্বুবানের মতন দেখাত বাবা!”

কথাটা বলেই ঘর থেকে পারুল ছুটে বেরিয়ে গেল। 

সদানন্দবাবুর মুখে যে আবার হাসি ফিরেছে, এইটে দেখে সত্যি আমি বড় নিশ্চিন্ত হয়েছিলুম। কিন্তু খুব বেশিদিন যে নিশ্চিন্ত থাকা যায়নি, আগের পরিচ্ছেদেই তা বলা হয়েছে। ভদ্রলোকের মুখটা আজ থেকে বছর তিনেক আগেই আবার মেঘলা হতে শুরু করে। তার মানে এ হল গিয়ে নকুলচন্দ্ৰ তাঁর বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে আসবার তা ধরুন বছর খানেক পরের কথা। রাস্তায় একদিন দেখা হয়ে যেতে সদানন্দবাবুকে তখন জিজ্ঞেস করেছিলুম যে, কী হল, আবার কোনও ঝামেলা বাধল নাকি। 

সদানন্দবাবু তাতে বললেন, “আরে মশাই, ঝামেলা কার নেই বলুন তো। বেঁচে থাকাটাই একটা ঝামেলা। বয়েস তো নেহাত কম হল না, এখন গেলে বাঁচি!”

কথাটা আর-কেউ বললে অবাক হতুম না। সদানন্দবাবু বলছেন বলেই অবাক হতে হল। শরীরের কলকব্জাগুলোকে ঠিক রাখবার জন্যে যাঁর চেষ্টার অন্ত নেই, আর সেই চেষ্টার কথাটা যিনি সগর্বে ঘোষণা করে থাকেন, বলেন যে, তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করলে আয়ুবৃদ্ধি একেবারে অবধারিত, সেই লোক বলছেন কিনা গেলে বাঁচি। এ-সব কথা আর-যাঁরই মুখে মানিয়ে যাক, সদানন্দবাবুর মুখে একেবারেই মানায় না। 

কিন্তু তবু সে তাঁকে সেদিন আর এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করিনি, তার কারণ আর কিছুই নয়, তাঁর উত্তর দেবার ধরন দেখেই আমি বুঝে গিয়েছিলুম যে, প্রসঙ্গটা তিনি এড়িয়ে যেতে চাইছেন। 

দু’চার দিনের মধ্যেই অবশ্য ব্যাপারটা বোঝা গেল। এক রবিবার সকালে আমাদের বাড়িতে এলেন সদানন্দবাবু। যথারীতি হাল্কা এক কাপ লিকার খেলেন। তারপর অন্যান্য প্রসঙ্গে দু’চার কথা হবার পরে বললেন, “না মশাই, ভাড়াটে বাছতে ভুল করেছি, নকুলচন্দ্র লোকটা বিশেষ সুবিধের নয়।”

আমি বললুম, “বাছাবাছি আর করলেন কোথায়। পাড়ার ছেলেদের কথায় ঘাবড়ে গিয়ে হঠাৎ ঠিক করলেন যে, একতলাটা ভাড়া দেবেন, আর তার দুচার দিনের মধ্যেই তো নকুলচন্দ্র এসে গেল। সেই যে এক রাজার গল্প শুনেছি, রাত্তিরে ঠিক করলেন যে, সকালে ঘুম থেকে উঠে রাজবাড়ির বাইরে বেড়াতে বেরিয়ে প্রথম যার মুখে দেখবেন, তার সঙ্গেই মেয়ের বিয়ে দেবেন, আপনারও তো দেখলুম সেই ব্যাপার।” 

সদানন্দবাবু বিমর্ষ মুখে বললেন, “সেইটেই বড্ড ভুল করে ফেললুম। নকুলটা মশাই অতি নচ্ছার লোক। যাদের কথার ঠিক নেই তাদের আমি মানুষ বলেই মনে করি না। নকুলটা মানুষ নয়।” 

বললুম, “কথার ঠিক নেই বললেই তো আর হল না, বেঠিকটা কী দেখলেন?” 

“তা হলে শুনুন মশাই, বাড়িতে যখন ভাড়াটে হয়ে ঢোকে, নকুল তখন আমাকে বলেছিল যে, স্রেফ ওরা স্বামী-স্ত্রী থাকবে, আর কাউকে এনে ঢোকাবে না। তা এক বছর পার হতে-না-হতেই দেখছি শ্বশুরবাড়ি থেকে একটি শালাকে এনে ঢুকিয়েছে। বলেছিল, হপ্তাখানেক থেকেই চলে যাবে, কিন্তু কই, শালাবাবুটির তো নড়বার কোনও লক্ষণই দেখছি না।” 

পাঁচ নম্বরের একতলায় যে নতুন একজন লোক কিছুদিন ধরে রয়েছে, এ৩। ‘মামিও লক্ষ করেছি। বাসন্তীকে জিজ্ঞেসও করেছিলুম যে, লোকটা কে? তা বাসন্তী বলল, ও হচ্ছে নকুলের বউ যমুনার দাদা। মানে আপন দাদা নয়, মামাতো দাদা। গ্রামে থাকত, সেখান থেকে বোনের বাড়িতে এসে উঠেছে। এখন কিছুদিন কলকাতায় থেকে যা-হোক কিছু একটা কাজকর্ম জুটিয়ে নেবে। 

তা সদানন্দবাবুর তাতে এত আপত্তি কেন, বোঝা গেল না। বললুম, “কাজকর্মের সন্ধানে এসেছে একটা কিছু জুটে গেলেই চলে যাবে নিশ্চয়। সব বাড়িতেই আত্মীয়স্বজনেরা এমন এসেই থাকে, চিরকালের জন্যে তো আর কেউ আসে না। ও নিয়ে আপনি এত ভাবছেন কেন?” 

সদানন্দবাবু বললেন, “ভাবনার কারণ আছে বলেই ভাবছি। আপনি বলছেন, একটা কাজকর্ম জুটে গেলেই চলে যাবে। আরে মশাই কাজকর্ম কি মামার বাড়ির ক্ষীরের নাড়ু নাকি যে দিনরাত্তির আমি বিছানায় পড়ে রইলুম, আর আদর করে দিদিমা আমার মুখের মধ্যে গুঁজে দিয়ে গেল। কাজকর্ম জোটাতে হলে হাঁটাহাঁটি করাই যথেষ্ট নয়, রীতিমত দৌড়ঝাঁপ করা দরকার। তা বিষ্টু হতচ্ছাড়া সে-সব করছে কোথায়?”

“ওর নাম বুঝি বিষ্টু?” 

“হ্যাঁ। বিষ্টুচরণ দাস।” 

“সারাদিন বিছানায় পড়ে-পড়ে ঘুমোয় বুঝি?” 

“যখন ঘুমোয় না, তখন হেঁড়ে গলায় যাত্রার গান গায়। আমার মশাই একটুও পছন্দ হয় না।” সদানন্দবাবু আর বসলেন না, বেরিয়ে গেলেন। 

.

বাড়িওয়ালার সঙ্গে ভাড়াটের সম্পর্ক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাল হয় না। তার উপরে আবার বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটে যখন একই বাড়িতে থাকে, সম্পর্কটা তখন প্রায়ই অতি তেতো হয়ে ওঠে। আমার বাড়িওয়ালার সঙ্গেও আমার সম্পর্ক বিশেষ মধুর নয়। মোটামুটি দশ বছর এখানে আছি, তার মধ্যে দুবার আমার ভাড়া বেড়েছে, তা নিয়ে আমি কোনও আপত্তিও তুলিনি, রেন্ট কন্ট্রোলে যাবার ভয় দেখানো তো দূরের কথা, মুখেও কখনও বলিনি যে, এইভাবে ভাড়া বাড়ানোটা মোটেই উচিত-কাজ হচ্ছে না, তবু দেখছি আমার বাড়িওয়ালাটি প্রায়ই ঠারেঠোরে এমন সব উক্তি করছেন, যাতে মনে হয়, আমি উঠে গেলেই তিনি বাঁচেন। 

ভাড়াটে উঠে গেলেই যে বাড়িওয়ালার সুবিধে সেটা অবশ্য আমি অস্বীকার করি না। আর কিছু না হোক, নতুন ভাড়াটের কাছ থেকে ফের নতুন করে পাঁচ-দশ হাজার টাকা সেলামি আদায় করা যায়। সেটাই তো মস্ত লাভ। সম্ভবত সেই জন্যেই আমার বাড়িওয়ালা কিছুদিন যাবৎ গাইতে শুরু করেছেন যে, তিনতলায় আর তাঁর কুলোচ্ছে না, দোতলাটা যদি এবারে ছেড়ে দিই তো তাঁর বড্ড উপকার হয়। 

কথাটা তিনি যেমন আমাকে বলেন, তেমনি বাসন্তীকেও বলেন। আমি বলি, “খোঁজাখুঁজি তো করছি, নতুন একটা ফ্ল্যাটের সন্ধান পেলেই এটা ছেড়ে দেব।” বাসন্তীও মোটামুটি সেই কথাই বলছিল। কিন্তু দিন কয়েক আগে বাড়িওয়ালা ফের যখন কাঁদুনি গাইতে শুরু করেন, বাসন্তী তখন দুম করে রেগে গিয়ে তাঁকে বলে বসে, “আপনার কুলোচ্ছে না তো আমরা কী করব? মেয়ে দুটোর বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিন, তা হলেই দেখবেন দিব্যি কুলিয়ে যাবে।” 

বাস সেই যে বাড়িওয়ালা আমাদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করেছেন, এখনও তিনি স্পিকটি নট্। দেখা হলেই মুখ ঘুরিয়ে নেন। বাক্যালাপ বন্ধ হওয়ায় অবশ্য আমাদের বিশেষ অসুবিধে হচ্ছে না, তবে ভয় হচ্ছে যে, এবারে হয়তো জল বন্ধ হবে। তা হলে মুশকিলে পড়ব। 

জল বন্ধ হওয়ার এই ভয়টা শুরু হয়েছিল বছর তিনেক আগেই। বাড়িওয়ালার সঙ্গে আমার সম্পর্ক মোটামুটি তখন থেকেই খারাপ চলছে। ব্যাপারটা সেইসময়ে সদানন্দবাবুকে আমি জানিয়েওছিলুম। বলেছিলুম, আপনার সমস্যা ভাড়াটেকে নিয়ে, আর আমার সমস্যা বাড়িওয়ালাকে নিয়ে। কী যে করব, বুঝতে পারছি না। জল বন্ধ হলে তো বিপদে পড়ব, মশাই।” 

শুনে জিভ কেটে সদানন্দবাবু বলেছিলেন, “ছি ছি, জল আবার কেউ বন্ধ করে নাকি। ও তো একটা ক্রিমিন্যাল অফেন্স।” 

তা বছর তিনেক আগে যা-ই বলে থাকুন মাস ছয়েক আগে নিজের বাড়িতে কিন্তু সদানন্দবাবু সেই ক্রিমিন্যাল অফেন্সটাই করে বসলেন। প্রথমে তিনি নকুলচন্দ্রের জলের সাপ্লা২ + ন্ধ করলেন, তার পরে কাটলেন ইলেকট্রিক। 

অর্থাৎ সদানন্দবাবু একেবারে তিতিবিরক্ত। তাঁর একতলার ভাড়াটেদের তিনি তাড়াতে চাইছেন। . তাড়াতে চাইবার কারণ মাত্র একটি নয়, অনেক। তাঁর কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারছি যে, নকুল- পরিবারের বলতে গেলে প্রায় কোনও কিছুই তিনি পছন্দ করতে পারছেন না। 

নকুলচন্দ্রের শালাবাবু বিষ্টুচরণের চেহারা যে খুব বদখত তা নয়, তা ছাড়া সদানন্দ নিজেও স্বীকার করেন যে, কথাবার্তায় লোকটা খুব বিনয়ীও বটে। কিন্তু ওই যে সে কাজকর্মের জন্যে দৌড়ঝাঁপ না করে গোটা দুপুরটা স্রেফ ঘুমিয়ে কাটায়, আর যখন জেগে থাকে, তখন মাঝে-মাঝেই হেঁড়ে গলায় যাত্রার গান গায়, এটা তাঁর পছন্দ নয়। নকুলচন্দ্রের বউ যমুনাকে কেউ কচিখুকিটি বলবে না, তার বয়েস নিশ্চয় তিরিশ পার হয়ে গেছে, অথচ এখনও সে যে চোখে পুরু করে কাজল দেয়, ঠোঁটে লিপস্টিক ঘষে, হাতকাটা ব্লাউজ পরে, আর কথাও বলে ‘ন্যাকা ন্যাকা’, এটা তাঁর পছন্দ নয়। এই বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে আসবার বছর দুয়েক বাদে যে যমুনার একটি মেয়ে হয়েছে, ফলে বিষ্টুচরণকে হিসেবের মধ্যে ধরলে—ভাড়াটেদের লোকসংখ্যা যে মাত্র দুবছরের মধ্যেই সেন্ট পার্সেন্ট বেড়ে গিয়ে এখন দুয়ের জায়গায় চার হয়েছে, এটাও তাঁর পছন্দ নয়। 

কিন্তু তাঁর সবচেয়ে অপছন্দের ব্যাপার হল নকুলচন্দ্রের ব্যাবসা। 

নকুলচন্দ্র যখন ভাড়াটে হয়ে আসে, তখন সে অর্ডার সাপ্লাইয়ের কাজ করত। তাতে সুবিধে না হওয়ায় সে জমি কেনাবেচার লাইন ধরে। কিন্তু তাতেও সে চোট খেয়ে যায়। ফলে বছর খানেক হল সে মাছের ব্যাবসা ধরেছে। আর এই মাছের ব্যাবসা নিয়েই সদানন্দের ঘোর আপত্তি। 

আপত্তি হত না, নকুল যদি না বাড়ির মধ্যে তার পাইকারি ব্যাবসার আড়ত বসিয়ে দিত। দুটো ঘরের একটায় তারা স্বামী-স্ত্রী আর বাচ্চাটি থাকে। অন্য ঘরটায় বিষ্টু থাকত। এখনও থাকে, তবে কিনা ঘরের বেশির ভাগটাই ভর্তি হয়ে থাকে মাছের ঝুড়িতে। 

সদানন্দবাবু যে প্রথম-প্রথম এই নিয়ে খুব আপত্তি করেছিলেন, তা নয়। শুধু একদিন হাসতে-হাসতে আমাকে বলেছিলেন, “বিষ্টুকে এবারে পালাতে হবে মশাই।” 

আমি বলেছিলুম, “কেন?”

“যতই হোক, মানুষ তো। গন্ধের দাপটেই পালাতে হবে।” 

বললুম, “তা বটে। বিষ্টুকে যে মাছের ঘরে থাকতে হয়, সেটা আমার মনেই ছিল না।” 

বিষ্টু কিন্তু পালাল না। নকুলচন্দ্রের মাছের ব্যাবসাও সমানে চলতে লাগল। সকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ নাকি বাজারের খুচরো ব্যবসায়ীরা পাঁচ নম্বর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়, মাছ দেখে, পছন্দ হলে দামদস্তুর করে, দামে পোষালে মাছ ওজন হয়, তারপর পাওনাগন্ডা মিটিয়ে দিয়ে মাছের ঝুড়ি রিকশায় তুলে তারা ছ’টার মধ্যেই বাজারে চলে যায়। আমি তো অত সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠি না। তাই স্বচক্ষে এই কেনাবেচার ব্যাপারটা কখনও দেখিনি। তবে যেমন বাসন্তী আর পারুলের কাছে, তেমনি পাড়ার অন্য দুচারজন লোকের মুখে শুনেছি যে, গলিটা তখন আঁশটে গন্ধে ভরে ওঠে। 

যে ঘরে মাছের আড়ত তারই একপাশে বিষ্টুর শোবার জায়গা। মাঝে-মধ্যে সদানন্দবাবুর বাড়িতে যাই। দোতলায় উঠবার সময় সিঁড়ি থেকে উঁকি মেরে দেখতে পাই, ঘরের মধ্যে পরপর মাছের ঝুড়ি আর সেই ঝুড়ির পাশে নোংরা একটা বিছানা। বিষ্টুচরণকেও দেখতে পাই। দিব্যি সে তার বিছানায় শুয়ে ঘুম লাগাচ্ছে। সদানন্দবাবু আশা করেছিলেন, বিষ্টু এবারে পালাবে, ওই আঁশটে গন্ধের মধ্যে সে টিকতে পারবে না। কিন্তু যেভাবে তাকে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে দেখি, তাতে আমার মনে হয় না যে, মাছের গন্ধে বিষ্টুর কোনও অসুবিধে হচ্ছে। 

আসলে অসুবিধেটা যে সদানন্দবাবুরই হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারলুম, যখন এর মাস ছয়েক বাদে তিনি আবার এক রবিবারে আমার বৈঠকখানায় এসে ঢুকলেন। সাধারণত একটা ভূমিকা করে নিয়ে তারপরে তিনি আসল প্রসঙ্গে আসেন। সেদিন কিন্তু কোনও ভূমিকার মধ্যে তিনি গেলেন না। ঘরে ঢুকেই হতাশ গলায় বললেন, “আর তো পারছি না মশাই।” 

একটা বই বেরুবে, তার প্রুফ দেখছিলুম। সেটাকে সরিয়ে রেখে বললুম, “কেন, আবার কী হল?”

“হবে আবার কী, গন্ধে একেবারে পাগল হয়ে গেলুম!” 

“রোজই কি গন্ধ ছড়ায় নাকি?” 

“রোজ। তার উপরে আবার এক-একদিন এমন উৎকট গন্ধ ছড়ায় যে, সে আর কী বলব, গোটা শরীরটা যেন গুলিয়ে ওঠে। কী করি বলুন তো?” 

জীবনে আমি মাছের ব্যাবসা কেন, কোনও ব্যাবসাই করিনি। তবে কিনা যেখানে মাছের আড়ত খোলা হয়েছে, সেখানে যে আঁশটে গন্ধে বাতাস সারাক্ষণ ভরাট হয়ে থাকবে, এটা বুঝবার জন্যে আলাদা কোনও ব্যাবসাবুদ্ধি থাকার দরকার হয় না, অল্পবিস্তর কান্ডজ্ঞান থাকাটাই যথেষ্ট। নকুলচন্দ্ৰ মাছের ব্যাবসা করে, বাড়িতেই তার মাছের আড়ত, খুচরো ব্যবসায়ীরা তার কাছ থেকে মাছ কেনে, কিন্তু তার আড়তের সব মাছই কি আর সঙ্গে-সঙ্গে বিক্রি হয়ে যায়? তা নিশ্চয় হয় না। স্টকের কিছুটা মাছ নিশ্চয় পড়ে থাকে। ঠিকমতো যদি না বরফ-চাপা দিয়ে রাখা হয়, তা হলে সেগুলো পচতে শুরু করে। তার গন্ধ তো তখন উৎকট হয়ে উঠবেই। আর তা যে উঠবে, সদানন্দবাবুর সে-কথা আগেই বোঝা উচিত ছিল। 

বললুম, “কী আর করবেন। ভাড়াটে নেবার আগে একটা কনট্রাক্ট করে নিয়েছিলেন?”

“তা তো করিনি।” 

“করা উচিত ছিল। তাতে এইরকম একটা শর্তও আপনার রাখা উচিত ছিল যে, একতলাটাকে শুধু রেসিডেন্সিয়াল পার্পাসেই ব্যবহার করা চলবে, ওখানে গোডাউন করা চলবে না। তা তেমন কোনও কনট্রাক্ট যখন নেই, তখন আর আপনি কী করবেন?”

“সে কী মশাই”, সদানন্দবাবু বললেন, “বাড়ি তো আর নকুলের নয়, বাড়ি আমার। নাকি তাও আপনি স্বীকার করবেন না?” 

“তা কেন করব না?” হেসে বললুম, “বাড়ি আপনারই।”

“আর সেই বাড়িটাকে যদি কেউ নরককুন্ড বানিয়ে তোলে, তাও আমি কিছু করতে পারব না? বাড়ি ভাড়া দিয়ে কি আমি চোর-দায়ে ধরা পড়েছি নাকি?” 

বললুম, “নিয়মিত ভাড়া দেয়?” 

“তা দেয়।” 

“তা হলে মামলা-টামলার মধ্যে যাবেন না, গিয়ে কোনও লাভ হবে না। বরং এক কাজ করুন। ওকে বুঝিয়ে বলুন যে, বসতবাড়ির মধ্যে এই যে ও মাছের আড়ত করেছে এটা ঠিক হচ্ছে না। তাতে যদি কাজ না হয় তো তার পরের কথাটা তখন ভাবা যাবে।” 

সদানন্দবাবু বুঝিয়ে বলতে গিয়েছিলেন। তাতে কাজ হয়নি। মাছের আড়ত অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে হবে, এই প্রস্তাব শুনে নকুলচন্দ্র নাকি হাত কচলে বলেছিল, “কোথায় সরাব মেসোমশাই? আমি রইলুম এখানে আর আড়ত রইল আর-এক জায়গায়, এই করে কি ব্যাবসা চলে?” 

সদানন্দবাবু বলেছিলেন, “অন্যেরা চালায় কী করে?” 

তাতে নকুল বলেছিল, “তারা পারে। তাদের পয়সা আছে। তারা মাছ পাহারা দেবার জন্যে দরোয়ান রাখে, মাছ বিক্রি করবার জন্যে আলাদা কর্মচারী রাখে। আমি ও-সব কী করে পারব?” 

সদানন্দবাবুর কাছে সব শুনে আমি বললুম, “তা হলে ওকে উঠে যেতে বলুন। পাড়ার দু’চারজন ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে ওর কাছে যান। গিয়ে বলুন যে, এখানে ওর থাকা চলবে না।” 

তা-ই বলা হল। নকুলচন্দ্র তাতে কাতর গলায় বলল, “কোথায় যাব মেসোমশাই? এত কম ভাড়ায় আর কোথায় দু’খানা ঘর পাব আমি?” 

অগত্যা কী আর করেন, যে কাজকে নিজেই একদিন ক্রিমিন্যাল অফেন্স বলেছিলেন, উপায়ান্তর না-থাকায় হঠাৎ একদিন সেটাই করতে হল সদানন্দবাবুকে। ভাড়াটের জলের সাপ্লাই তিনি বন্ধ করে দিলেন। 

কিন্তু তাতে কোনও লাভ হল না। এমন নয় যে, জল বন্ধ হবার ব্যাপারটা নিয়ে নকুল একটা হইচই বাধিয়ে দিল। তা সে করল না। এমনকি সদানন্দবাবুর কাছে এই নিয়ে কোনও প্রতিবাদও জানাল না সে। স্রেফ একজন ভারী লাগিয়ে রাস্তার কল থেকে সে জল আনিয়ে নিতে লাগল। 

সদানন্দবাবু বুঝে গেলেন যে, শুধুই জল বন্ধ করে নকুলচন্দ্রকে জব্দ করা যাবে না। তখন তিনি লাইটের কানেকশনও কেটে দিলেন। 

তার পরের দিনই আবার আমার ফ্ল্যাটে এসে কড়া নাড়লেন সদানন্দবাবু। থমথমে গম্ভীর মুখ; হাসির লেশমাত্র নেই। 

বললুম, “ব্যাপার কী মশাই, আবার কী হল?” 

“হপ্তাখানেক ধরে যে ওকে জল দিচ্ছি না সেটা জানেন তো?” 

“জানতুম না। কাল রাত্তিরে বাসন্তীর কাছে শুনলুম।” 

“তিনি কী করে জানলেন?” 

“কাল বিকেলে কী একটা কাজে যেন আপনার মিসেসের কাছে গিয়েছিল, তাঁরই কাছে শুনেছে। কাজটা ভাল করেননি।” 

“তা হয়তো করিনি,” সদানন্দবাবু বললেন, “কিন্তু এ ছাড়া উপায়টাই বা কী ছিল?” 

“তা এতে কোনও কাজ হল?” 

হতাশ গলায় সদানন্দবাবু বললেন, “কিসসু না। ভেবেছিলুম বাছাধন এবারে পথে আসবে। কিন্তু কোথায় কী, ভারী দিয়ে জল আনিয়ে নিচ্ছে। কাল রাত্তিরে তাই লাইটের কানেকশনও কেটে দিলুম।”

বললুম, “এটা আরও খারাপ করলেন। মামলা-টামলা যদি হয়ই, তা হলে এই দুটো ব্যাপারই কিন্তু ওর ফেভারে যাবে। আর মামলা তো পরের কথা, এক্ষুনি গিয়ে ও যদি থানার ডায়েরি লিখিয়ে আসে তো আপনি বিপদে পড়ে যাবেন মশাই। 

সদানন্দবাবু বললেন, “বিপদে আমি অলরেডি পড়েছি।” 

“তার মানে? নকুল কি এরই মধ্যে থানায় গিয়ে ডায়েরি করেছে নাকি?” 

“না মশাই, বিপদ একেবারে উল্টো দিক থেকে এসেছে।”