শ্বেতপুরী আর লালপুরী

শ্বেতপুরী আর লালপুরী

 শ্বেতপুরীর রাজা আর লালপুরীর রাজা, দুজনের যেমন পাশাপাশি বাড়ি, তেমনি গলাগলি ভাব। শ্বেতপুরী বলে, “আমার ছেলে যখন বড় হবে, তখন তোমার মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দেব।” লালপুরী বলে, “আমার মেয়ের যখন বয়স হবে, তখন তোমার ছেলেকে আমার জামাই করব।” আর দুজনেই বলে, “আহা, রানীরা যদি বেঁচে থাকতেন!”

 এমনি করে দিন কেটে যায়। হঠাৎ একদিন কোত্থেকে এক শিকারি এসে রাজপুরীতে অতিথি হল। সে বলে এমন দেশ নেই যা সে দেখে নি। সেই সোনার দেশের কাজলি নদী, তার ওপারে রক্তমুখো অসভ্যেরা থাকে, সেখানে সে হরিণ মারতে গিয়েছে; নীল সাগরের মধ্যিখানে ছায়ায় ঢাকা রত্নদ্বীপ, সেখানে সে মুক্তো আনতে গেছে; ঐ যে পুরীর সামনে পৃথিবীজোড়া গভীর বন, সেই বনের ওপারে গিয়ে সে অদ্ভুত দৃশ্য দেখে এসেছে। সকলে বলল, “অদ্ভুত দৃশ্যটা কিরকম?” শিকারি বলল, “দেখতে পেলাম ঝরনাতলায় বনের বড়ি, মাথায় তার সোনার চুল। সেই চুল দিয়ে বুড়ি রপোর তাঁতে কাপড় বুনছে! চকচকে, ঝকঝকে, ফিনফিনে, ফরফরে চমৎকার কাপড়—তেমন কাপড় এ রাজ্যে নেই, ও রাজ্যে নেই, কোথাও নেই।”

 সে রাত্রে রাজাদের চোখে আর ঘুম এলো না। তারা শুয়ে শুয়ে কেবলই ভাবছে, ‘আহা! সে কাপড় যদি কিছু আনতে পারতাম। শেষটায় শ্বেতপুরীর আর সহ্য হল না—উঠে লালপুরীর ঘরে গিয়ে বলল, “লালপুরী ভাই, জেগে আছ?” লালপুরী বলল, “হ্যাঁ ভাই, সেই কাপড়ের কথা ভেবে ভেবে আমার আর ঘুম আসছে না।” শ্বেতপুরী বলল, “আমারও সেই দশা। চল না, দুজনে চুপচাপ বেরিয়ে পড়ি।” লালপুরী বলল, “বেশ কথা। দেখা যাক, সেই বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায় কি না।” শ্বেতপুরী চুপচাপ গিয়ে রাজভাণ্ডারীর কানে কানে বলল, “তদবির সিং, আমি কয়দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি, তুমি সাবধানে সব সামলে থেকো, আর রাজকুমারকে চোখে চোখে রেখো।” লালপুরী তার বাপের আমলের বুড়ো চাকরকে জাগিয়ে বলল, “নিমকরাম, আমি কয়দিন একটা ঘুরে আসছি, তুমি আমার মেয়েকে দেখো।”

 তারপর দুজনে বুড়ির খোঁজে বনের মধ্যে গেল। সেই যে গেল, আর তাদের খবর নেই। দুদিন যায়, দশদিন যায়, এমনি করে সাত মাস গেল। তখন দুষ্টু তদবির সিং নিমকরামকে লোভ দেখিয়ে বলল, “দাদা, বুড়ো হয়ে পড়লে, আর কয়দিনই-বা বাঁচবে। এখন এই বয়সে একটা জিরিয়ে নাও। তোমায় নদীর ধারে বাগান দিচ্ছি, ঘর দিচ্ছি, চাকর-দাসী সব দিচ্ছি—শেষ কটা দিন আরামে থাক। মেয়েটাকে দেখাশোনা, সে আমার গিন্নি করবে।” এই বলে নিমকরামকে ভুলিয়ে ভালিয়ে পাঠিয়ে দিল, পুরী থেকে অনেক দূরে।

 দিন যতই যায়, রাজকন্যা আর রাজপুত্রের ততই কষ্ট বাড়ে। ক্রমে এমন হল যে তারা ভালো করে খেতেই পায় না, ছেঁড়া ময়লা কাপড় পরে, নোংরা ঘরে মাদুর পেতে শোয়। ভাণ্ডারীটার ছেলেমেয়ে, ভাইপো-ভাগনে, ভাইঝি-ভাগনি, মাসি-পিসি আর মেসো-পিসে, তারা সব দলেবলে পুরীতে এসে থাকে। ভালো ঘর সব তারাই নেয়, ভালো কাপড় সব তারাই পরে, ভালো খাবার সব তারাই খায়। শেষটায় একদিন নিমকরামের গিন্নি এসে রাজপুত্র আর রাজকন্যাকে পুরীর বাইরে তাড়িয়ে দিলো। বলল, “যা, যা, বসে বসে আর খেতে হবে না; মাঠে গিয়ে শুয়োর চরা। যদি ভালো করে চরাস, আর একটাও শুয়োর না হারায়, তা হলে বিকেলে চারটি ভাত পাবি। রাত্রে ঐ হোগলার ঘরে শুয়ে থাকিস।”

 দুজনে বনের ধারে, মাঠের মধ্যে শুয়োর চরাতে গেল। একটা শুয়োর ভারি দুষ্টু, কেবলই পালাতে চায়। রাজপুত্র তাকে ধরে এনে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে বললেন, “খবরদার! এইখানে চোখ বুজে শুয়ে থাক; নড়েছিস কি মরেছিস!” তারপর দুজনে মিলে গল্প করতে লাগলো। দুঃখের কথা বলে বলেও ফুরোয় না: এদিকে বেলা যে শেষ হয়ে আসছে, তাদের সে খেয়ালই নেই। হঠাৎ রাজপুত্রে চেয়ে দেখে, দুষ্টু শুয়োরটা আবার কোথায় পালিয়েছে। কোথায় গেল? কোথায় গেল? চারদিক চেয়ে দেখে শুয়োর কোথাও নাই; পালের মধ্যে নাই, মাঠের মধ্যে নাই, পুরীতে যাবার পথেও নাই! তা হলে নিশ্চয় বনের দিকে গেছে, এই ভেবে তারা দুজনে গেল বনের মধ্যে খুঁজে দেখতে।

 খুঁজতে খুঁজতে, ঘুরতে ঘরতে, বেলাশেষে যখন তারা শ্রান্ত হয়ে পড়লো, তখন চেয়ে দেখে—কোথায় মাঠ, কোথায় পুরী, তারা গভীর বনে এসে পড়েছে। দেখে তাদের বড় ভয় হল, বনের মধ্যে কোথায় যাবে? এমন সময়ে আঁধার বন ঝলমলিয়ে বনের দেবী চন্দ্রাবতী তাদের সামনে এসে বললেন, “ভয় পেয়েছ? এসো, এসো, আমার ঘরে এসো।” তারা তাঁর সঙ্গে গেল।

 বনের মধ্যে প্রকাণ্ড যে বুড়ো বট, তার জটায় ঢাকা বিশাল দেহে চন্দ্রাবতী আঙুল দিয়ে ছুঁতেই গাছের গায় দরজা খালে গেল। সেই দরজা দিয়ে রাজপুত্র আর রাজকন্যা ভেতরে ঢুকে দেখলো, কি চমৎকার পুরী! সেইখানে হরিণের দুধ আর বনের ফল খেয়ে, তারা সবুজ চাদরঢাকা কচি ঘাসের নরম বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লো। ভোরের বেলা গাছের ফোকরের জানালা দিয়ে এক টুকরো দিনের আলো যেমনি এসে পুরীর মধ্যে পড়েছে, অমনি পাখিরা সব গেয়ে উঠলো; রাজার ছেলে আর রাজার মেয়ে অবাক হয়ে ডঠে বসলো। চন্দ্রাবতী বললেন, “এখন ভেবে বল দেখি, আমার কাছে থাকবে, না রাজপুরীতে ফিরে যাবে?”

 তারা দুজনেই মাথা নেড়ে বলল, “না, না, দুষ্টু পুরীতে আর কক্ষনো যাব না। তার চাইতে বনের পুরী অনেক ভালো।”

 সেই থেকে রাজপুত্র আর রাজকন্যা বনপুরীতেই সুখে থাকে। বনের যত পশুপাখি, চন্দ্রাবতীকে সবাই চেনে। তারা এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে, গল্প করে আর কত মজার মজার কথা বলে; দুজনে অবাক হয়ে সেই-সব শোনে। একদিন এক বুড়ো কাক, জানালা দিয়ে উড়ে এসে সিন্দুকের ওপর আরাম করে বসে বলল, “কাঃ কাঃ, ক্যায়া বাৎ!” চন্দ্রা বললেন, “এই যে, ভুষুণ্ডিদাদা যে! খবর-টবর কিছু আছে?” কাক বলল, “হ্যাঁ, খবর বেশ ভালোই। কাঠুরেরা সে বছর যত জঙ্গল কেটেছিল, সব আবার ভরিয়ে দেবার ব্যবস্থা হচ্ছে।” চন্দ্রা বললেন, “সে কিরকম?” কাক বলল, “শহরের মানুষ এসে সারাদিন খালি মাটি খুঁড়ছে আর বীজ লাগাচ্ছে, আবার নতুন বীজ খুঁজে আনছে।” চন্দ্রা বললেন, “তারা এরকম করছে কেন?” কাক বলল, “ওমা, তাও জান না? তোমার এই নন্দবন পার হলেই খণ্ডবন, তার পরে অন্ধবন। মানুষপুরের লোকেরা এসে সেই অন্ধবনের বড়-বড় গাছ কেটে নিয়েছে। তাই অন্ধরাজ দুটো জাঁদরেল মানুষ পাকড়াও করে তাদের দিয়ে বন সারাচ্ছেন।” চন্দ্রা বললেন, “আহা, তা হলে তো মানুষ বেচারিদের বড়ই কষ্ট।” কাক বলল, “তা, কষ্ট তো আছেই। ঘরবাড়ি, ছেলেপুলে, সব ছেড়ে বনের মধ্যে খাটছে, খাটছে, কেবলই খাটছে। যতদিন না কাটা জঙ্গলের সমস্ত জমিতে বীজ পোঁতা হয়, যতদিন না সেই বীজ থেকে চারা বেরোয়, যতদিন না সেই চারা বাড়তে বাড়তে গাছ হয়ে ওঠে, ততদিন তাদের ছুটি নেই।” বলে কাক উড়ে গেল।

 কাকের কথা শুনে রাজপুত্র আর রাজকন্যা কাঁদতে লাগলো। তারা বলল, “আমরা অন্ধবনে যাব, আমাদের পথ বলে দাও।” চন্দ্রা বললেন, “নদীর ধার দিয়ে দিয়ে উত্তরমুখী চলে যাও, তা হলেই অন্ধবন খুঁজে পাবে। তার কাছেই ভুষুণ্ডি কাক থাকে, সে তোমাদের পথ দেখাবে। সত্যি কথা ছাড়া আর কিছু বলবে না। নদীর জল

ছাড়া আর কোন জল খাবে না। কোন গাছের ফল ছিঁড়বে না, ফল পাড়বে না—তা হলেই তোমাদের কোন বিপদের ভয় নেই।”

 ভোরবেলা দুজনে একটি বনরেশমের কবল আর পুঁটলি ভরে খাবার সঙ্গে নিয়ে রওনা হল। দুপরেবেলা তারা শ্রান্ত হয়ে নদীর ধারে জল খেতে গেছে। তখন কোথা থেকে এক শিকারি এসে হাজির। সে বলল, “আরে ছি, ছি, ঐ নোংরা জল কি খেতে আছে? এই নাও, বরফ দেওয়া ঠাণ্ডা জল।” তারা বলল, “না, নদীর জল ছাড়া আর কোন জল আমরা খাব না।” শিকারি রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল।

 রাত্রি হলে শুখনো ঘাসের ওপর কম্বল পেতে দুজনে ঘুমিয়ে রইলো; পরের দিন ভোর না হতে আবার উঠে রওনা হল। সেদিনও যেই তারা নদীর ধারে খেতে বসেছে, অমনি এক শিকারি এসে তাদের বলছে, “আরে, ও-সব বাসি পিঠে খাচ্ছ কেন? চমৎকার ফল রয়েছে, যত ইচ্ছা পেড়ে পেড়ে খাও।” তারা বলল, “না, আমরা বনের ফল ছিঁড়ব না, বনের ফল পাড়ব না।” শিকারি রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল।

 পরের দিন আবার যেই তারা নদীর ধারে বসেছে, অমনি এক শিকারি এসে তাদের আদর করে, মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “তোমরা কোথায় যাচ্ছ?” রা বলল, “আমরা অন্ধবনে যাচ্ছি।” শিকারি বলল, “আরে চুপ চুপ, অন্ধরাজা শুনতে পেলেই সর্বনাশ! ওরকম বলতে নেই—কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে, ‘কোথাও যাচ্ছি না, এই নদীর ধারে বেড়াচ্ছি’।” তারা বলল, “না, আমরা সত্যি কথা ছাড়া আর কোন কথা বলব না।”

 তার পরের দিন তারা অন্ধবন দেখতে পেল। বনের মধ্যে অনেকখানি জায়গা ময়দানের মতো খোলা—কাঠুরেরা সেখানে জঙ্গল কেটে সাফ করেছে। সেই খোলা ময়দানে শ্বেতপুরী আর লালপুরীর রাজা শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। তাদের দেখতে পেয়েই রাজপুত্র আর রাজকন্যা ‘বাবা, বাবা’, বলে দৌড়ে গেল। কিন্তু রাজারা তাদের দিকে ফিরেও চাইলো না। ছেলে আর মেয়ে কত বলল, কত বোঝালো, তারা সে-সব কথা কানেও নিলো না। তারা কেবল মাটি খুঁড়ছে আর নিজেরা বলাবলি করছে যে, এই জমিটা শেষ হলেই আবার বীজ আনতে যেতে হবে।

 রাজপুত্র আর রাজকন্যা অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো, তারপর বিষণ্ণমুখে নদীর ধারে এসে বসলো। এমন সময়ে বুড়ো ভুষুণ্ডিকাক এসে তাদের সামনে ঘাসের ওপর বসে বলল, “কঃ কঃ,—ভাবনা কিসের, কও না শুনি।” তারা সব কথা খুলে বলল। কাক বলল, “এরই জন্য এত ভাবনা? তা হলে বলি শোন। যখন ঐ পাহাড়ের ওপর রাঙা সূর্য ডুবে যাবে, তখন মানুষেরা তাদের কাজকর্ম রেখে বিশ্রাম করবে। তখন যদি চটপট গিয়ে শাবলদুটোকে নদীর মধ্যে ফেলতে পার, তা হলেই তারা কাজের কথা সব ভুলে যাবে। তারপর তাদের সামনে গিয়ে বলবে—‘ঝরনাতলায় আপনমনে, কোথায় বুড়ি কাপড় বোনে? রুপোর তাঁতে সোনার চুল, সব কি ফাঁকি, সব কি ভুল?’ বললেই সব কথা তাদের মনে পড়ে যাবে। যা দেখছো এ-সমস্তই অন্ধরাজের ফাঁকি—সেই শিকারি সেজে তোমাদের পুরীতে গিয়েছিল, আর বনের পথে তোমাদেরও ভোলাতে চেয়েছিল। যাও, সন্ধ্যা হয়ে এলো, এখনই দৌড়ে যাও।” তারা দুজনে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দেখলো সূর্য্য অস্ত যায় যায়। একটু পরেই রাজারা যেমন শাবল রেখে বিশ্রাম করতে বসেছে, অমনি তারা

 শাবলদুটো নিয়ে এক দৌড়ে গিয়ে নদীর মধ্যে ফেলে দিল। তারপর ফিরে এসে যেই তারা সেই ভুষুণ্ডির শেখানো কথাগুলো বলেছে, অমনি লালপুরী আর শ্বেতপুরী লাফিয়ে উঠে বলল, “আরে এ কি! তোমরা কোত্থেকে এলে? বনের মধ্যে আসলে কি করে? এত রোগা হয়ে গেছ কেন? তোমাদের সঙ্গে লোকজন কোথায়? আমাদের খবর পেলে কার কাছে?” তারা একে একে সব কথা বলল। তারপর তারা চারজনে মনের আনন্দে হাসতে হাসতে, কাঁদতে কাঁদতে পুরীতে ফিরে চলল।

 তারপর কি হল? তারপর সবাই পুরীতে ফিরে এলো, আমোদ-আহ্লাদ, ভোজ, উৎসব লেগে গেল। তারপর? তারপর একদিন লালপুরীর রাজকন্যার সঙ্গে শ্বেতপরীর রাজপুত্রের ধুমধাম করে বিয়ে হল—বনের দেবী চন্দ্রাবতী নিজে এলেন বিয়ে দেখতে। আর হতভাগা তদবির সিং-এর কি হল? তাকে অন্ধবনে পাঠিয়ে দেওয়া হল—আজও সেখানে সে তার গিন্নির সঙ্গে কেবল মাটি খুঁড়ছে আর বীজ পুঁতছে, আর বনে-জঙ্গলে বীজ খুঁজে বেড়াচ্ছে।

সন্দেশ—১৩২৮