শেষ মুহূর্তে – ৫

হেডকোয়ার্টার্স থেকে ক্যামাক স্ট্রিট যেতেই বা ক’মিনিট! আর, লিফটে পাঁচতলায় উঠতেই বা কতক্ষণ!

ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই রয়েছে। মনসিজকে নিয়ে কল্যাণ ঘরে পা দিয়েই থমকে দাঁড়াল। হ্যাঁ, এই আশঙ্কাই করেছিল সে।

ডিভানের ওপর স্থির হয়ে শুয়ে আছে স্বরূপা। রিসিভারটা হাত থেকে ছিটকে পড়েছে মেঝেয়। বাম স্তনের ওপর একটা বুলেটের ক্ষত। শাড়িতে, ডিভানে চাপ চাপ রক্ত। রক্তের ধারা এখনও চুঁইয়ে পড়ছে। দীর্ঘ—পলক চোখ দুটির পাতা আধখোলা। সে—চোখ কি কল্যাণকেই দেখছে? স্বরূপা কি এখনও বলছে, ‘পুরুলিয়ার রূপা অনেকদিন হল মরে গেছে! তবু তোমার অনিষ্ট সে কোনোদিন চায়নি—চাইতে পারে না!’

অথচ এই স্বরূপাকে কতখানি ভুল বুঝেছিল সে! জীবনটা বড় অদ্ভুত, তার চেয়েও অদ্ভুত মানুষের মন! একথা একদিন স্বরূপাই বলেছিল।

মনসিজ বললে, ফ্ল্যাটটা সার্চ করে দেখব স্যার?

একটু বিষণ্ণ হেসে কল্যাণ বললে, কি হবে? অশ্বিনী কি আমাদের জন্যে এখনও বসে আছে?

তারপর মনে মনে বললে, এই নিয়ে তিন তিনটে জীবন তুমি নষ্ট করলে অশ্বিনী! কিন্তু আর নয়!

মৃতদেহ নিয়ে যা কিছু পুলিশি কর্তব্যের ভার সার্জেন্ট দত্তকে দিয়ে, কল্যাণ নিচে নেমে গেল। জিপে উঠলে বললে, পাসপোর্ট অফিস।

.

ঘণ্টা দুই লাগল ফাইল ঘাঁটতে।

তারপর পাসপোর্ট অফিসার বললেন, না মিস্টার বোস, গত তিন বছরের মধ্যে আবু রশিদ বা অশ্বিনী লাহার নামে কোনও পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়নি।

হতাশ হল কল্যাণ। তবে কি স্বরূপার খবর ভুল? একটু ভেবে আবার সে বললে, আচ্ছা, দেখুন তো খুব সম্প্রতি—মানে দু’চারদিনের মধ্যে পাকিস্তানে যাবার জন্যে কি কি নামে পাসপোর্ট ইসু হয়েছে? কিছু মনে করবে না ট্রাবল দিচ্ছি বলে।

না, না, মনে করব কেন?—পাসপোর্ট অফিসার হেসে বললেন, পুলিশকে সাহায্য করা আমাদের ডিউটি।

আবার ফাইল নেড়েচেড়ে তিনি জানালেন, না, পাকিস্তানে যাবার জন্যে যারা হালে পাসপোর্ট পেয়েছে, তাদের মধ্যেও ওই দুটি নাম নেই।

কল্যাণের মুখখানা এবার সত্যিই নিভে গেল। কিছুক্ষণ, চুপ করে থেকে সে বললে, যারা পাসপোর্ট পেয়েছে, তাদের ফোটোগুলো একবার দেখতে পারি?

নিশ্চয়। এক তাড়া ফোটো অফিসার কল্যাণের সামনে মেলে দিলেন।

একটার পর একটা দেখতে লাগল কল্যাণ। দুই চোখে উৎসুক আগ্রহ নিয়ে। দেখতে দেখতে তার নিভে—আসা মুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এই তো সেই অদৃশ্য মেঘনাদ—যাকে সে আকাশে—পাতালে খুঁজে বেড়াচ্ছে! যাকে ধরবার জন্যে সে কবরে ঢুকতেও রাজি!

কল্যাণ বললে, এই ভদ্রলোকের পাসপোর্টে কি নাম লেখা আছে, দেখুন তো।

অফিসার দেখে বললেন, জ্যাক নিউম্যান। নেটিভ ক্রিশ্চান।

হাজার ধন্যবাদ!

ফোটোগুলো রেখে দিয়ে কল্যাণ উঠে পড়ল। জিপকে নির্দেশ দিলে, এয়ার—ওয়েজ অফিস।

.

হেমন্তের ছোটবেলা যেন কেরানির মাস—মাইনে! কতক্ষণ থাকে?

বি. ও. এ. সি—র অফিসে ইন্সপেক্টর কল্যাণ যখন ঢুকল, তখন সন্ধে হয়ে গেছে। নিজের আইডেন্টিটি কার্ড দেখালে সে।

ফ্লাইট—অফিসার প্রশ্ন করলে, বলুন, আপনার জন্যে কি করতে পারি?

কল্যাণ বললে, দু’একদিনের মধ্যে করাচিগামী কোন প্লেন ছাড়ছে কি?

আজই ছাড়ছে।

আজই!

হ্যাঁ। লন্ডনগামী একটা জেট বোয়িং করাচিতে থামবে।

সেই প্লেনে যেসব প্যাসেঞ্জার করাচি যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে জ্যাক নিউম্যান নামে কেউ আছেন?

কাগজপত্র দেখে অফিসার বললে, হ্যাঁ, এই যে—লিস্টে জ্যাক নিউম্যানের নামও রয়েছে।

প্লেন ক’টায় ছাড়বে?

সন্ধেবেলার ফ্লাইট। সাড়ে সাতটায় টেক অফ!

সাড়ে সাতটা! চমকে নিজের রিস্টওয়াচের দিকে তাকালে কল্যাণ। এখন সাতটা বাজতে দশ মিনিট। তার মানে চল্লিশ মিনিট সময় আছে হাতে। তারই মধ্যে এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাওয়া—না, অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু হেডকোয়ার্টার্স হয়ে যেতে গেলে হাতে সময় থাকবে কি? একটা মিনিট এখন একটা ঘণ্টার সমান।

কল্যাণ বললে, আপনার ফোনটা ব্যবহার করতে পারি?

অফিসার বললে, স্বচ্ছন্দে।

হেডকোয়ার্টার্সে যোগাযোগ করে কল্যাণ সার্জেন্ট দত্তকে চাইলে। দত্ত নেই, স্বরূপার ফ্ল্যাট থেকে এখনও ফেরেনি। সুরজিৎ গুপ্তকে ডেকে কল্যাণ বললে, মনসিজ ফেরা মাত্র যেন এয়ারপোর্টে চলে আসে। আমি এখান থেকে সোজা চলে যাচ্ছি।

গুপ্তসাহেব বললেন, কিন্তু সার্জেন্ট দত্ত যদি ঠিক সময়ে যেতে না পারে? এমন একটা অপারেশনে তোমার একা যাওয়াটা কি—

তাঁর কথার ওপরেই কল্যাণ বললে, আমাকে একাই যেতে দিন স্যার। এ সুযোগ আমি ছাড়তে পারি না।

ফোন রেখে আরেকবার হাতের ঘড়ি দেখলে কল্যাণ। সাতটা বাজতে পাঁচ। মাত্র পঁয়ত্রিশ মিনিট টাইম আছে। জিপে উঠে বললে, দমদম এয়ারপোর্ট। জলদি।

গর্জন করে উঠে জিপ ছুটল।

কিন্তু ছুটলে কি হবে? পায়ে পায়ে বাধা, পদে পদে বিঘ্ন। মহানগর কলকাতার রাজপথে শুধু গাড়ি, গাড়ি গাড়ি! রাস্তাগুলো উপচে পড়ছে ট্রাফিকের জোয়ারে। ট্রাম—বাস—ট্যাক্সি—লরি—প্রাইভেট তো আছেই, তার ওপর রিকশা—ঠেলা—স্কুটার। সব মিলিয়ে জট—পাকানো একটা জটিলতা! সবাই ব্যস্ত, সকলেই আগে যাবে।

তারই মধ্যে জিপ এগোতে থাকে। বাসের পাশ কাটিয়ে, ট্রামের গা বাঁচিয়ে, ট্যাক্সিকে বাঁয়ে চেপে, লরির ধাক্কা এড়িয়ে। এক ফার্লং ছোটে তো তিন ফার্লং বেতো রুগির মতো চলে। অ্যাক্সিলেটর চাপতে না চাপতেই ব্রেকে পা দিতে হয়। অস্থির হয়ে ওঠে কল্যাণ। বারবার ঘড়ি দেখতে থাকে, আর মনে মনে হিসেব করে এয়ারপোর্ট আর কতদূর! কল্যাণের যদি ক্ষমতা থাকত, আজ রাতের জন্যে শহরের সমস্ত ট্যাফিক সে অচল করে দিত!

তবু ভাল যে পথে এখনও লাল বাতি চোখ রাঙায়নি। পরপর সবুজ বাতিই পেয়েছে কল্যাণ। সামনে একটা চৌমাথার মোড়। যাক, এখানেও সবুজ বাতি জ্বলছে। জ্বলদি পেরিয়ে চলো মোড়টা। কিন্তু পেরিয়ে চলো বললেই কি পার হওয়া যায়? সাঁ করে স্পিড নিতে না নিতেই নিভে গেল সবুজ সঙ্কেত, আর কল্যাণকে যেন ঠাট্টা করেই জ্বলে উঠল একচোখো লাল বাতি!

সশব্দে ব্রেক চাপলে গুর্খা ড্রাইভার বাজবাহাদুর। একটুখানি হকচকিয়ে গেল কল্যাণ। তারপরই চেঁচিয়ে উঠল, থেমো না বাজবাহাদুর—গুলি মারো ট্র্যাফিক সিগন্যালকে! চালাও তুমি—চালিয়ে যাও!

কিন্তু চালাও বললেই চালানো যায় না। জিপের আগে দু’সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে। পেছনে ব্যাক করবে, তারও জো নেই। পেছনেও গাড়ির লাইন। আশেপাশে অগুনতি গাড়ি! যেন ইঁদুরকলে আটকে পড়ে ছটফট করতে লাগল কল্যাণ। ঘড়ির কাঁটা এক একটা সেকেন্ড পার হয়, আর শরীরের স্নায়ুগুলো টনটন করে ওঠে।

এক মিনিট কাটল। লালের বদলে আবার দেখা দিল সবুজ ইশারা। হু হু করে বইতে লাগল থেমে—থাকা গাড়ির স্রোত। হাঁপ ছেড়ে কল্যাণ বললে, আর না বাজবাহাদুর। সময় একদম নেই—জলদি চলো!

কিন্তু না, আবার থামো! সামনে মিছিল, লাল ঝান্ডা, পরিচিত স্লোগান : ‘চলবে না, চলবে না!’ কল্যাণের ইচ্ছে হল, চিৎকার করে বলে ওঠে, কেবল চলবে না? চলতেই হবে—পৌঁছতেই হবে!

অস্থির হয়ে উঠেছে কল্যাণ। অধীর হয়ে উঠেছে। মিছিল কি ফুরোবে না? অনন্ত নাগের মতো এর কি শেষ নেই? ঘড়ির কাঁটা ঘুরে যাচ্ছে। সময় নেই, আর সময় নেই! তবে কি পৌঁছনো যাবে না? হাতের নাগালের মধ্যে এসেও পালিয়ে যাবে আসামি?

রাস্তা পার হয়ে চলে গেল মিছিল। এবার বেলেঘাটার রাস্তা ধরল জিপ।

ভি—আই—পি রোডে যখন এসে পড়ল, কল্যাণ ঘড়ি দেখলে, সওয়া সাতটা। প্লেন ছাড়তে মাত্র পনেরো মিনিট বাকি! হাওয়াকে সাথ সাথ চালাও!

তাই চালালে গুর্খা ড্রাইভার। চওড়া মসৃণ ভি—আই—পি রোড ফাঁকা। আর তাকে পায় কে? ঘষা পয়সার মতো তার নির্বিকার মুখের ফাঁকে হলদে দাঁতগুলো একবার দেখা গেল, তারপর স্পিড দিলে। জিপ ছুটল—হাওয়ার সাথে সাথে নয়, হাওয়ার আগে আগে।

স্পিডোমিটারের কাঁটা দ্রুত উঠছে। ষাট থেকে সত্তর—সত্তর থেকে আশি—নব্বই। শেষ অবধি একশোর ঘর ছুঁয়ে কাঁপতে লাগল। ঘন কুয়াশা—মাখা অন্ধকারে জ্বলন্ত চোখের হেডলাইট ফেলে একটা কালো নেকড়ে যেন ছুটে চলেছে শিকার ধরতে!

.

দেখতে দেখতে এয়ারপোর্ট এসে গেল। জিপগাড়িখানা ভাল করে থামতে না থামতেই লাফিয়ে নেমে পড়ল কল্যাণ। এদিকে ওদিক চেয়ে সার্জেন্ট দত্তকে দেখতে পেল না। সে হয়তো এখনও ক্যামাক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে।

দ্রুত পায়ে এয়ারপোর্টের ভেতরে চলে গেল কল্যাণ। চারদিকে সতর্ক চোখের নজর ফেলতে ফেলতে একেবারে লাউঞ্জে। নানা জাতের, নানা সাজের, নানা বয়েসের যাত্রীরা বসে আছে প্লেন ছাড়ার অপেক্ষায়। প্রিয়জনেরা এসেছে বিদায় দিতে। বিদায়—মুহূর্ত অসন্ন, চঞ্চল হয়ে উঠেছে সবাই।

কিন্তু সে কোথায়? যার জন্যে এত বাধার পাহাড় ঠেলে শেষ মুহূর্তে কল্যাণের এই অভিযান, কোথায় সে? একটি একটি করে যাত্রীর মুখ লক্ষ করতে লাগল কল্যাণ। না, নেই—এদের মধ্যে সে নেই! তবে কি সে আসেনি? করাচি যাওয়ার প্রোগ্রাম বাতিল করেছে? হতাশায় কল্যাণের উদ্যম ফুরিয়ে এল। তবু তার গোয়েন্দা—মন বললে, সে আছে—এখানেই সে আছে। আইনকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাবার এত বড় সুযোগ সে ছাড়বে না।

কল্যাণের চোখের সার্চ লাইট ঘুরে ঘুরে আবার যাত্রীদের লক্ষ করতে লাগল। সবাইকে দেখা হয়েছে, শুধু—হ্যাঁ, লাউঞ্জের ওই কোণে খবরের কাগজে মুখ ঢেকে, দামি টুইডের স্যুট—পরা যে প্যাসেঞ্জারটি তন্ময় হয়ে খবর পড়ছে, শুধু তাকেই এখনও দেখা হয়নি।

পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল কল্যাণ। লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে বললে, দেশলাই আছে মিস্টার?

খবরের কাগজের আড়াল থেকে বিশুদ্ধ ইংরেজি উচ্চারণে জবাব এল : দুঃখিত; নেই।

আপনি বুঝি স্মোক করেন না?

না।

কল্যাণ তবু দাঁড়িয়ে রইল। অমায়িকভাবে প্রশ্ন করলে, এই প্লেনে আপনিও যাচ্ছেন নিশ্চয়? কোথায়? করাচি, এডেন না লন্ডন?

খবরের কাগজের দেওয়াল তবু নড়ল না। নীরস গম্ভীর গলার জবাব শোনা গেল: আমার বিষয়ে অন্যের কৌতূহল আমি পছন্দ করি না।

একটু চুপ থেকে কল্যাণ বললে, মাপ করবেন। এইমাত্র একজন পাইলটের মুখে শুনলাম, বিদ্রোহী বালুচ সৈন্যেরা নাকি বোমা ফেলছে! তাই এ প্লেন করাচিতে নামবে না!

ঠিক চালই চেলেছে কল্যাণ। মুহূর্তে সরে গেল খবরের কাগজের আড়াল। সোজা হয়ে বসে লোকটা বিরক্তি আর বিস্ময় মেশানো গলায় বলে উঠল, সেকি!

আর, তার মুখের দিকে তাকিয়ে কল্যাণ যেন নিশ্বাস নিতে ভুলে গেল। দিল্লির পুলিশ—দপ্তর থেকে পাঠানো ফোটোখানা জ্যান্ত হয়ে উঠেছে তার চোখের সামনে! এই একই মুখ সে আজই দেখে এসেছে পাসপোর্ট অফিসে!

সৌজন্যের ভঙ্গিতে মাথা ঝুঁকিয়ে কল্যাণ চিবিয়ে চিবিয়ে বললে, গুড ইভনিং মিস্টার জ্যাক নিউম্যান, ওরফে আবু রশিদ, ওরফে মৃগাঙ্ক মজুমদার, ওরফে অশ্বিনী লাহা!

লোকটাকে এতটুকু বিচলিত হতে দেখা গেল না। শান্তভাবে বললে, পাগলের মতো কী বকছ! জ্যাক নিউম্যান ছাড়া আমার দ্বিতীয় নাম নেই।

লাউঞ্জে তখন মাইকের ঘোষণা শোনা যাচ্ছে : বি.ও.এ.সির জেট বোয়িং এখনই লন্ডনের পথে রওনা হবে. . . প্যাসেঞ্জারদের নিজের আসনে বসতে অনুরোধ করা হচ্ছে. . . লন্ডনগামী এই প্লেন প্রথমে থামবে করাচি শহরে, তারপর. . .

ব্যস্ত যাত্রীরা যে যার জিনিস নিয়ে একে একে লাউঞ্জ ছেড়ে চলে যেতে লাগল। খবরের কাগজ রেখে জ্যাক নিউম্যানও উঠে দাঁড়াল যাবার জন্যে।

প্যান্টের পকেটে হাত ভরে কল্যাণ তার পথ আগলে দাঁড়াল। তার শরীরের পেশীগুলো শক্ত হয়ে উঠল। বললে, দাঁড়াও বন্ধু! যাচ্ছ কোথায়? তোমাকে হাতে পেয়ে আর কি ছাড়তে পারি?

জ্যাক নিউম্যানের বাদামি চোখ দুটোতে একবার আগুনের ফুলকি দেখা গেল। তারপরেই অস্বাভাবিক ঠান্ডা গলায় সে বললে, আবার বলছি—আমায় তুমি চিনতে ভুল করেছ! আমি শুধু জ্যাক নিউম্যান।

ভুল!—একটু তিক্ত হাসি মুখে নিয়ে কল্যাণ বললে, ক্রিমিন্যাল চিনতে কল্যাণ বোস ভুল করে না। দিল্লিতে তুমি ছিলে আবু রশিদ, দাড়ি রেখে কলকাতায় হলে অশ্বিনী লাহা আর মৃগাঙ্ক মজুমদার, আবার দাড়ি কামিয়ে তুমি হয়েছ জ্যাক—

মুখের কথা শেষ না হতেই কল্যাণের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। মোটা লোমশ হাতের একটা ঘুসি আচমকা এসে পড়ল তার চোয়ালে। ছিটকে পড়তে পড়তে একটা সোফা ধরে সে টাল সামলে নিলে। রিভলভারের জন্যে পকেটে আবার হাত দিতেই একটা নীরস গলার গুরুগম্ভীর আওয়াজ শোনা গেল, হাত তোলো!

কল্যাণ ফিরে দেখলে, আবু রশিদ ওরফে অশ্বিনী লাহার হাতের অটোমেটিক তারই দিকে তাগ করে রয়েছে! এতক্ষণে তার খেয়াল হল, অশ্বিনীর মতো ধূর্ত ক্রিমিন্যালের সঙ্গে একা মোকাবিলা করতে আসাটা নেহাত বোকামি হয়ে গেছে! সার্জেন্ট দত্তকে যখন পাওয়া গেল না, তখন আর কাউকে আনাই উচিত ছিল।

কল্যাণের হাত দু’খানা আস্তে আস্তে ওপরে উঠে গেল।

এয়ারপোর্টের লাউঞ্জ এখন প্রায় ফাঁকা। লন্ডনগামী হাওয়াই জাহাজ ছাড়বার অপেক্ষায় রানওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে। সিঁড়ি বেয়ে প্যাসেঞ্জারেরা একে একে উঠে যাচ্ছে ভেতরে। সকলেরই দৃষ্টি সেদিকে। নইলে লাউঞ্জের এক কোণে যে বিচিত্র নাটক শুরু হয়েছে, তার দর্শকের অভাব হত না।

হাতের অটোমেটিকটা নাচাতে নাচাতে অশ্বিনী এবার পরিষ্কার বাংলায় বললে, কল্যাণ বোস, ভারি চালাক গোয়েন্দা তুমি, না? এত চালাক যে, নিজের ফাঁদে নিজেই ধরা পড়লে। এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি গোয়েন্দাগিরি করো?

বিশ্রী আওয়াজ করে হেসে উঠল অশ্বিনী।

নিরুপায় আক্রোশে জ্বলতে জ্বলতে কল্যাণ বললে, শাট আপ! শয়তান জানোয়ার কোথাকার! তোমার খেলা আজই শেষ জেনো!

বটে!—অশ্বিনীর বাদামি চোখে আরেকবার আগুনের ফুলকি দেখা গেল। বললে, খেলা শেষ কার? আমার, না তোমার? আমার সঙ্গে শত্রুতা করার সাজা কি, মগনলাল, রতিকান্ত আর স্বরূপা নিশ্চয় তোমাকে জানিয়ে দিয়েছে?

কল্যাণ বললে, তাহলে স্বীকার করছ, রতিকান্ত আর স্বরূপাকেও তুমি খুন করেছ?

আমর কাছে বেইমানির ক্ষমা নেই।—নিজের রিস্টওয়াচের দিকে একবার তাকালে অশ্বিনী। তারপর বললে, প্লেন ছাড়তে আর এক মিনিট বাকি। নিজের জান বাঁচাতে চাও তো সরে দাঁড়াও!

অদ্ভুত একটা মরিয়া ভাব কল্যাণকে পেয়ে বসল। দাঁতে দাঁত চেপে বললে, পালাতে তোমায় দেব না অশ্বিনী—মরে গেলেও না।

অশ্বিনীর তামাটে মুখ লাল টকটকে হয়ে উঠল। অস্বাভাবিক ঠান্ডা গলায় বললে, তোমার মতো একটা ইঁদুর—বাচ্চচার জন্যে একটা টোটা নষ্ট করব কিনা ভাবছিলাম এতক্ষণ। কিন্তু না—আর দেরি করা চলে না। ঈশ্বর নামে কোনো আত্মীয়—টাত্মীয় যদি তোমার থাকে তো তাকে ডাকতে পারো।

হাতের অটোমেটিকটা কল্যাণের বুকের লেভেলে তুলে ধরলে অশ্বিনী। আর, সেই মুহূর্তে—ঠিক সেই মুহূর্তে একখানা চেয়ার সবেগে এসে পড়ল অশ্বিনীর ডান হাতের মুঠোর ওপর। ছিটকে পড়ল অটোমেটিক রিভলভার।

সার্জেন্ট দত্ত কখন এসে দাঁড়িয়েছে, কল্যাণ বা অশ্বিনী কেউ দেখেনি।

রিভলভারটা কুড়িয়ে নেওয়ার জন্যে দু’জনে দু’দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু অশ্বিনী হেঁট হয়ে হাত বাড়াতেই, কল্যাণ তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রচণ্ড এক ঘুসি ঝাড়লে অশ্বিনীর থুতনি লক্ষ্য করে। বক্সিং—শেখা হাত কল্যাণের, একটা ঘুসিতেই অশ্বিনীর ঘাড়ে—গর্দানে ভারি দেহটা উল্টে পড়ে গেল।

অস্ত্রটা কুড়িয়ে নিয়ে ইন্সপেক্টর কল্যাণ চেয়ে দেখলে, মেঝের কার্পেটে বসে আহত অশ্বিনী বুনো মোষের মতো হাঁপাচ্ছে। থুঁতোনির রক্ত গড়িয়ে সাদা টেরিলিনের শার্ট লাল হয়ে গেছে।

ততক্ষণে সুরজিৎ গুপ্তের পাঠানো আর্মড ফোর্স আর এয়ারপোর্টের জনতা ভিড় করে দাঁড়িয়েছে লাউঞ্জে। কল্যাণ কাছে গিয়ে বললে, গেট আপ অশ্বিনী—উঠে দাঁড়াও!

টলতে টলতে দাঁড়িয়ে উঠল অশ্বিনী। মনসিজ হ্যান্ডকাপ নিয়ে এগিয়ে এল।

লন্ডনগামী জেট বোয়িং তখন দমদমের মাটি ছেড়ে করাচির পথে উড়ে চলেছে।

.

মনসিজ বললে, এবার কিছুদিন ছুটি নিন স্যার। যে ধকলটা গেল।

কল্যাণ হেসে বললে, হ্যাঁ, বীথিরও তাই ইচ্ছে। তবে তার আগে একটা কাজ বাকি আছে।

আবার কি কাজ?

পল্টু ছোকরাকে একটা ভাল চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়ে, মীনা থাপার সঙ্গে ওর বিয়ের ব্যবস্থা করা। অন্তত একটা জীবন ক্রাইমের রাস্তা ছেড়ে সুস্থ সুন্দর হয়ে উঠুক।

সমাপ্ত