শেষ মুহূর্তে – ৩

পল্টুকে নিজের খাস কামরায় নিয়ে এল কল্যাণ। তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে প্রশ্ন করলে, আমার পিছু নিয়েছিলে কেন?

বেকায়াদায় পড়েছে পল্টু। তবু ঈষৎ উদ্ধত গলায় উত্তর দিলে, পাবলিক রাস্তায় সকলেরই চলবার রাইট আছে।

কল্যাণ বললে, পুলিশেরও রাইট আছে, তোমার মতো দাগী মাস্তানকে হান্টার মেরে শায়েস্তা করার। সেটা জানো?

পল্টু গুম হয়ে রইল।

আবার বললে কল্যাণ, সত্যি করে বলো, কেন আমাকে ফলো করেছিলে? কি মতলবে?

পল্টু বললে, মা কালীর দিব্যি—মতলব—টতলব কিছু নেই স্যার! একজন আমাকে ফলে ফলো করতে বলেছে, তাই।

কে বলেছে?—কল্যাণের ভুরু দুটো কুঁচকে গেল।

জানি না, স্যার। তাকে চোখেও দেখি নি।

চালাকি পেয়েছ?—ধমকে উঠল কল্যাণ, আনব হাণ্টার?

পল্টু এবার হাঁউমাউ করে উঠল : কী বলছেন স্যার? আপনার সঙ্গে যে চালাকি করবে, সে এখনো মায়ের গবভে!

তাহলে সত্যি কথা বলো। যাকে তুমি চেনো না, চোখে দেখোনি, অথচ তোমাকে আমার পিছু নিতে বলল কি করে? টেলিফোনে?

না স্যার, চিঠি দিয়ে।

কোথায় সে চিঠি?

পল্টু তার প্যান্টের হিপ—পকেট থেকে বাদামি রঙের একখানা খাম বার করলে, কিন্তু কল্যাণের হাতে দিলে না। বললে, আমি স্যার বাড়ির বাপে—খেদানো মায়ে—তাড়ানো ছেলে। তাই একতলার বাইরের ঘরে শুই। কাল ব্লু—ডায়মন্ড থেকে অনেক রাতে ফিরে দেখি, আমার বিছানার ওপর এই খামখানা পড়ে আছে। খোলা জানলা দিয়ে কেউ ছুড়ে দিয়েছে মনে হল। খাম খুলে দেখি, আই বাপ! একশো টাকার একখানা নোট আর চিঠি। দেখুন না।

কোনও ছাপ নেই খামটায়, শুধু পল্টুর নামটা টাইপ করা। খাম থেকে চিঠি বার করে দেখলে কল্যাণ। নীলচে রঙের কাগজে মোটা মোটা হরফে লেখা :

গোয়েন্দা কল্যাণ বোসের ওপর নজর রাখো। তার গতিবিধির খবর জানালে আরো টাকা পাবে। খবর পাঠাবার ঠিকানা—

বি. গুপ্ত, ২৭ সি, লেক টাউন।।

চিঠিখানা হাতে নিয়ে কল্যাণ স্থির হয়ে রইল কিছুক্ষণ। কে এই বি. গুপ্ত? নামটা ছদ্মনাম নিশ্চয়, কিন্তু কে সে? অশ্বিনী লাহার লোক? না, অশ্বিনী স্বয়ং?

একটু উসখুস করে পল্টু জিজ্ঞেস করলে, এবার যেতে পারি স্যার?

মেঘলা—করা মুখে কল্যাণ বললে, বোসো। আরও কথা আছে।

পল্টু উঠতে গিয়ে আবার বসে পড়ল।

কল্যাণ সরাসরি প্রশ্ন করলে, মীনা থাপার সঙ্গে তোমার আলাপ কি করে হল?

মীনার নামটা পল্টু আশা করেনি। একটু থতিয়ে গিয়ে বললে, আমার পিসতুতো বোন মীনার ক্লাস—ফ্রেন্ড। তার ওখানেই আলাপ।

হুঁ। কি মতলবে মীনার মতো মেয়ের সঙ্গে তুমি ভাব জমিয়েছ?

পল্টু এবার নিজেকে শক্ত করে বললে, আমরা বিয়ে করব ঠিক করেছি। মীনা আমাকে ভালোবাসে, আমিও বাসি।

চোপ!—কড়া গলায় কল্যাণ ধমক দিয়ে বললে, ওসব ধান্দাবাজি ছাড়ো হে ছোকরা! মীনাকে নিয়ে মগনলালজীর সঙ্গে তোমার বচসা হয়েছিল। তুমি তার লাশ ফেলে দেবে বলে শাসিয়েছিলে, আমার সাক্ষী আছে। তার কিছুদিন বাদেই মগনলাল খুন হয়। সেই খুনের চার্জে তোমাকে আমি এখুনি অ্যারেস্ট করতে পারি, খেয়াল রেখো।

আশ্চর্য, ছেলেটা একটুও ভয় পেল না। বুক টান করে কল্যাণের দিকে সোজা তাকিয়ে বললে, আপনি বড় পুলিশ—অফিসার, তা আপনি পাবেন। কিন্তু মগনলাল থাপাকে আমি রাগের মাথায় যাই বলি না কেন, খুন করতে যাব কেন? ইচ্ছে করলে মীনাকে নিয়ে আমি এনি মোমেন্টে পালিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু তা আমি করিনি। মীনাকে আমি কথা দিয়েছি ছোট কাজ আর করব না, রবসনের দল ছেড়ে দিয়ে ভাল হব।

কল্যাণ বললে, বটে! সাউথ ক্যালকাটার টপ মাস্তান পল্টু চ্যাটার্জির মুখে এই কথা! এ যে ভূতের মুখে রাম—নাম।

তিক্ত হাসির একটু আভাস পল্টুর ঠোঁটের কোণে দেখা দিল। বললে, বিশ্বাস করতে পারছেন না তো? কিন্তু ভাল যদি খারাপ হয়ে যেতে পারে, তবে খারাপই বা ভাল হতে পারবে না কেন বলতে পারেন? কিছু মনে করবেন না স্যার, ভাল হওয়ার চান্স পুলিশই আমাদের দেয় না। একটা ভদ্র কাজ আমাকে জুটিয়ে দিয়ে দেখুন না।

এমন টাইপের ছেলে কল্যাণ বোস তার পুলিশ—জীবনে অনেক ঘেঁটেছে। আজ কিন্তু পল্টুর কথাগুলোর মধ্যে একটা আন্তরিক সুর তার কানে বাজল। একটু নরম সুরে সে বললে, বেশ, তোমার জন্যে একটা ভদ্র কাজের চেষ্টা আমি করব। কিন্তু তুমি আমার একটা কাজ করতে পারবে কি?

বলুন।

টাকার জন্যেই তুমি ওয়াচারের কাজ—মানে, আমার ওপর নজর রাখছিলে তো? আমি তোমাকে টাকা দেব, ও—কাজটা এবার আমার জন্যে করো।

পল্টু বললে, আপনি টাকা না দিলেও আপনার কাজ করব স্যার। পল্টু চ্যাটার্জির এক জবান। বলুন, কার ওপর নজর রাখতে হবে?

কল্যাণ বললে, ক্যামাক স্ট্রিটের যে—বাড়ি থেকে আমাকে তুমি শ্যাডো করেছিলে, সেই বাড়িটায় কে আসছে যাচ্ছে, সেটা লক্ষ রাখবে। কিন্তু পল্টু, বি. গুপ্ত যেই হোক, তাকে জানাতে হবে যে তুমি তার কাজই করে যাচ্ছ। অতএব লেকটাউনের ঠিকানায় তুমি নিয়মিত খবর পাঠিয়ে দেবে—আমার সম্পর্কে যা হোক কিছু মনগড়া খবর। বুঝলে?

পল্টু হাসিমুখে বললে, আর বলতে হবে না স্যার। কিন্তু আপনাকে খবর দেব কিভাবে?

পাবলিক টেলিফোনে। বিশেষ খবর থাকলে এখানে এসো—ভোল পাল্টে।

.

আজ একবার ব্লু ডায়মন্ড বার ঘুরে এসো, মনসিজ।

বেশ তো, চলুন স্যার।

উঁহু, তুমি একাই যাও। তোমার মতো ইয়াং খদ্দেরকেই প্রেমলতা পছন্দ করে।

কী যে বলেন স্যার!—মনসিজ দত্তের কান দুটো লাল হয়ে উঠল।

হেসে কল্যাণ বললে, ঠিকই বলছি হে! তোমায় দেখা ইস্তক প্রেমলতার লতার ফুল ফুটব—ফুটব করছে। তারই সুযোগ নিয়ে দু’—একটা খবর জেনে এসো দেখি।

মনসিজ এবার সপ্রতিভ হয়ে বললে, বলুন কি জানতে হবে?

মহুয়া নাগের সঙ্গে পল্টু চ্যাটার্জির সম্পর্কটা কেমন, এবং সোমবার রাতে মহুয়ার সঙ্গে মগনলাল কেন বেরিয়েছিল আর কোথায় গিয়েছিল? এই দুটো খবর তোমাকে জেনে আসতে হবে।

ঠিক আছে স্যার।

আর শোনো, তোমার এই সার্জেন্টের খোলস ছেড়ে, বেশ প্রেমিক—প্রেমিক সেজে যেও, বুঝলে?

প্রেমিক—প্রেমিক সেজে!—মনসিজ হেসে ফেললে।

হ্যাঁ হে, হ্যাঁ। কাজ আদায় করতে হলে গোয়েন্দাকে সব রকম সাজতে হয়, আর ফার্স্ট ক্লাস অ্যাকটিং করতে হয়। অনেকটা তোমাদের উত্তমকুমারের মতো।

আচ্ছা স্যার, তাই হবে।

ব্লু ডায়মন্ড বার—এ মনসিজ যখন ঢুকল, তখন রাত সাড়ে আটটা। মনসিজের পরনে ধবধবে পায়জামা, গায়ে ফিকে—গেরুয়া সিল্কের পাঞ্জাবি, পায়ে শৌখিন চপ্পল। চুলে বড় একটা তেল দেয় না সে, রুখু চুলগুলো সযত্নে এলোমেলো করা। প্রেমিক—প্রেমিক সাজই বটে!

পায়ে পায়ে এগিয়ে এল মনসিজ, একেবারে কাউন্টারের ধারে।

গুড ইভনিং!

প্রেমলতা যথারীতি হিসাবের খাতা দেখছিল। মুখ তুলে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে রইল। তারপর গোলাপি রঙ—করা ঠোঁটের ফাঁকে ঝকঝকে দাঁতের সারি দেখা দিল।

গুড ইভনিং মনসিজ! পথ ভুলে নাকি?

বাড়ি থেকে বেরোবার আগে মনে মনে রিহার্সাল দিয়েছে মনসিজ। জীবনে যতগুলো রোমান্টিক ফিল্ম দেখেছে, তার বাছা বাছা ডায়ালগগুলো মনে করার চেষ্টা করেছে। দেখা যাক, প্রেমলতার মন ভিজিয়ে কাজ হাসিল করা যায় কিনা। উঁচু টুলে বসে সে বললে, ঠিক তাই! দুনিয়ার সব পথ ভুলে গেছি। শুধু প্রেমলতার পথই মনে রয়েছে।

টলটলে কালো চোখে চেয়ে প্রেমলতা বললে, তামাসা?

একটা নিশ্বাস ছেড়ে মনসিজ বললে, তা বলতে পারো। আগুনের কাছে পতঙ্গের ছুটে আসাটাও একটা তামাসা!

খুব কথা শিখেছ দেখছি!—মুচকি হাসল প্রেমলতা; তারপর এক মগ ঠান্ডা বিয়ার এনে দিয়ে বললে, আছো কেমন? ভালো তো।

ভাল আর কোথায়?—মনসিজের গলাটা উদাস হয়ে উঠল।

কেন? কি হয়েছে?

বিয়ারে একটা চুমুক দিয়ে মনসিজ বললে, গোয়েন্দা—পুলিশের চাকরি দুনিয়ার সবচেয়ে ওঁছা কাজ। চাকরি আমার যায়—যায়! তুমি তো অনেক কিছু খবর রাখো প্রেম, দাও না দু’একটা খবর।

গোলাপি রঙ—করা ঠোঁটে হাসি নিয়ে প্রেমলতা বললে, তার বদলে আমি কি পাব শুনি?

কাউন্টারের ওপর ঝুঁকে মনসিজ বললে, গোটা মনসিজ দত্তকেই পাবে।

টলটলে চোখ আরও টলটলে করে প্রেমলতা বললে, তাই বুঝি! বেশ বলো কি খবর চাও? কার খবর?

আর্টিস্টদের মডেল মহুয়া নাগের।

প্রেমলতা বললে, মহুয়া নাগ এখানে আসে বটে, তবে আগের মতো বেশিক্ষণ থাকে না। পল্টু চ্যাটার্জির খোঁজ নিয়েই চলে যায়। আজও হয়তো আসতে পারে।

মনসিজ উৎসুক হয়ে বললে, যদি আসে, তার কাছ থেকে দুটো খবর জেনে নিতে পারবে?

কোন খবর?

পল্টু চ্যাটার্জির সঙ্গে মহুয়ার কি রিলেশন, আর—

মনসিজকে থামিয়ে প্রেমলতা বললে, সেটা আমিই বলে দিচ্ছি। বেশ কিছুদিন থেকে মহুয়া রবসনের গার্ল—ফ্রেন্ড হয়ে আছে, অথচ মহুয়ার মনের মানুষ হচ্ছে পল্টু। রবসনের অজান্তে মহুয়া পল্টুকে চায়, কিন্তু পল্টু তাকে বিশেষ আমল দেয় না। হালে পল্টু তো দেখাই করে না মহুয়ার সাথে।

মনসিজ বললে, কিন্তু এই রোমান্টিক ত্রিভুজের মধ্যে ইন্সপেক্টর মগনলালজী এসেছিলেন কেন, সেটাই আসল রহস্য। কি কারণে তিনি খুন হওয়ার রাতে মহুয়া নাগের সঙ্গে বেরিয়েছিলেন? গিয়েছিলেনই বা কোথায়? এই খবরগুলোই আমার দরকার, প্রেম।

দেখি চেষ্টা করে।

হঠাৎ হলের কাচের দরজার দিকে চেয়ে প্রেমলতা ব্যস্ত হয়ে উঠল, ওই তো মহুয়া আসছে! কাউন্টারের ভেতরে এসো মনসিজ—ওই পর্দার আড়ালে চলে যাও—কুইক!

কাউন্টারের পিছন দিকে প্রেমলতার টেবিলের পাশে ব্লু ডায়মন্ড বারের স্টোর রুম। নানাবিধ মদের পেটি সাজানো থাকে। দরজায় ঝুলছে মোটা ভারী পর্দা। চোখের পলকে মনসিজ সেই পর্দার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

হলের ভেতরে এসে মহুয়া নাগ চারপাশের টেবিলগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলে। মহুয়ার পরনে আজ মিশকালো বেলবটের ওপর রক্ত—লাল টাইট গেঞ্জি। আর, টাইট গেঞ্জির আড়ালে উদ্ধত যৌবন যেন সঙিন উঁচিয়ে আছে পুরুষের কামনাকে খোঁচা মারবার জন্যে। মুখে সিগারেটের লম্বা পাইপ।

আশপাশের কয়েকটা টেবিল থেকে খুশি গলার ডাক শোনা গেল, হ্যালো মহুয়া! হ্যালো সুইটি! হ্যালো ডার্লিং!

কারও ডাকে সাড়া দিলে না মহুয়া। বব—করা ফাঁপানো চুলে একটা ঝাঁকি দিয়ে সে এগিয়ে গেল কাউন্টারের কাছে।

পল্টু এসেছিল প্রেম?

কই, দেখিনি তো!—প্রেমলতার জবাব।

দাঁতে দাঁত পিষে মহুয়া বললে, এখানে আসবে কেন সে? সেই কুত্তির বাচ্চচা মীনাকে নিয়ে বেরিয়েছে নিশ্চয়!—দাও, একটা ছোট হুইস্কি দাও।

গ্লাসে ছোট পেগ ঢালতে ঢালতে প্রেমলতা বললে, সত্যি, পুরুষের মন শক্ত ধাতু দিয়ে গড়া! যতই ভেজাও, গলতে চায় না।

নামমাত্র সোডা মিশিয়ে, হুইস্কিটুকু চোঁ করে মেরে দিয়ে মহুয়া। তারপর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে বললে, তুমিই বলো প্রেম, পল্টুর জন্যে লুকিয়ে—চুরিয়ে আমি কী না করেছি! রবসন জানতে পারলে চাবকে আমার পিঠের চামড়া গুটিয়ে দেবে না? আর, এই তার প্রতিদান! একবার দেখাও করে না! আচ্ছা, আমিও দেখব!

কাউন্টারের ওপর মদের দাম ফেলে দিয়ে মহুয়া চলে যাচ্ছিল, প্রেমলতা ডাকলে, একটা জরুরি কথা আছে মহুয়া।

ঘাড় ফিরিয়ে মহুয়া বললে, কি কথা?

সবার কান বাঁচিয়ে বলতে হবে। ভেতরে এস।

পাইপে একটা নতুন সিগারেট লাগিয়ে মহুয়া কাউন্টারের ভেতরে এসে দাঁড়াল। স্টোর রুমের দরজার কাছে। প্রেমলতা চাপা গলায় বললে, পুলিশ তোমাকে খুঁজতে এসেছিল।

পুলিশ!—তেতো মুখে মহুয়া বলে উঠল, জাহান্নমে যাক শুয়োরের বাচ্চচারা! মহুয়া নাগ আর্টিস্টদের কাছে নিউড পোজ দেয়, পুলিশের কাছে দেয় না—তাই তো ওদের এত গায়ের জ্বালা!

গলায় উদ্বেগ নিয়ে প্রেমলতা বললে, আজ কিন্তু অন্য কারণে তোমাকে ওরা খুঁজতে এসেছিল মহুয়া।

অন্য কারণ! কি কারণ?

পুলিশের ধারণা, তুমি নাকি ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মগনলাল খুনের রহস্য জানো।

ফাঁপানো চুলে ঝাঁকি দিয়ে মহুয়া বলে উঠল, কখনো না! আমি কিচ্ছু জানি না।

কিন্তু খুনের রাতে পুলিশ যে তোমাকে মগনলালের সঙ্গে এই ‘বার’ থেকে বেরোতে দেখেছে!

দেখলই বা!—বাগ—না—মানা ঘোড়ার মতো ঘাড় বেঁকিয়ে মহুয়া বললে, ফুঃ! আমি পরোয়া করি না! রাত সাড়ে ন’টা থেকে দশটা অবধি আমি মগনলালের সঙ্গে ছিলাম। তারপর আমাকে আর্টিস্ট অলক মজুমদারের স্টুডিওতে নামিয়ে দিয়ে সে চলে যায়। ইচ্ছে হলে পুলিশ অলক মজুমদারকে জিগ্যেস করতে পারে। তারপর মগনলাল কোথায় খুন হল, কেন খুন হল, আমি তার কি জানি! বুঝলে প্রেম, পুলিশগুলো নেহাত বোকাচন্দর! ফওঃ!

একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে মহুয়া বললে, দাও, আরেকটা ছোট পেগ দাও।

পেগ দিয়ে প্রেমলতা বললে, আচ্ছা মহুয়া, মগনলালের তো অল্প—স্বল্প ড্রিঙ্ক করা অভ্যেস ছিল, আর কোনও অভ্যেস—মানে তোমার ওপর তার ঝোঁক—

শব্দ করে হেসে উঠল মহুয়া। বললে, আরে দুর! মগনলাল ছিল পঞ্চাশ বছরের বুড়ো—যদিও বুড়োরাই মেয়েদের লোভে ছোঁক ছোঁক করে বেশি—তবু, ও—লোকটার সে—দোষ ছিল না। মগনলাল আমাকে নিয়ে বেরিয়েছিল তার ঘরের জ্বালায়!

ঘরের জ্বালায়! মানে?

মানে তার মেয়ে মীনা পল্টুর সঙ্গে লটকে গেছে, জানো তো? তাই মগনলাল আমাকে বললে, আমি যদি পল্টুর কোনও গুন্ডামির বা ওয়াগন ব্রেকিং বা অন্য কোনও অপরাধের খবর জানাই, তাহলে আমাকে সে মোটা টাকা দেবে, আর পল্টু হারামিকে পাঁচ বছরের জন্যে ঝুলিয়ে দেবে।

তুমি কি বললে?

কি আর বলব?—মহুয়ার গলা ভারি হয়ে এল : পল্টু আমার সাথে বেইমানি করেছে বলে, আমি তো বেইমানি করতে পারি না।

সোডা না ঢেলেই দ্বিতীয় পেগটা ঢক করে গিলে ফেললে মহুয়া।

প্রেমলতা সায় দিয়ে বললে, তা তো বটেই। কিন্তু পুলিশের কি অন্যায় দেখো! মগনলাল খুনের বিষয় তুমি কিছুই জানো না, অথচ—

হঠাৎ গলাটা একটু নামিয়ে মহুয়া বললে, জানি বইকি! চোখের সামনে দেখেছি যে!

ভুরু দুটো কপালে তুলে প্রেমলতা বললে, বলো কী! যাঃ, ঠাট্টা করছ!

তোমার দিব্যি প্রেম, সত্যি দেখেছি। অলক মজুমদারের স্টুডিও পুরানো আলিপুরে। রাত ন’টা বাজলেই রাস্তা ফাঁকা হয়ে আসে। ট্যাক্সিটা খানিক তফাতে থামিয়ে মগনলাল আমার সঙ্গে নামল, তার কথাটা আমাকে ভেবে দেখতে বলল। আমি এগিয়ে গেলাম, স্টুডিওর দরজায় সবে পা দিয়েছি, অমনি একটা ভারী জিনিস পড়ার আওয়াজে চমকে ফিরে তাকালাম। দেখি, মগনলাল রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে, আর হাত কয়েক তফাতে একখানা কালো অ্যাম্বাসাডর দাঁড়িয়ে। ট্যাক্সিখানা হঠাৎ ঝড়ের বেগে পালিয়ে গেল। বোধ হয় ভয় পেয়েই।

তারপর?

ভয় আমিও পেয়েছিলাম। চট করে স্টুডিওতে ঢুকে দরজা একচিলতে ফাঁক করে দেখতে লাগলাম। কি দেখলাম জানো? কালো অ্যাম্বাসাডর থেকে দু’জন লোক নামল, মগনলালের দেহটা ধরাধরি করে গাড়ির পেছনের সিটে চালান করে দিলে। তারপর সাঁ করে চলে গেল।

প্রেমলতা বললে, লোক দু’জনকে স্পষ্ট করে দেখতে পেয়েছিলে?

নাঃ, রাস্তায় তেমন জোরালো আলো ছিল না। তবু দেখতে পেলাম, একজনের মাথায় ছোট করে ছাঁটা চুল, মোটার ওপর দারুণ মজবুত শরীর, ঘাড়ে—গর্দানে। আরেকজনের বেশ লম্বা পাতলা চেহারা। সে—রাতে স্টুডিও থেকে আর নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে যেতে সাহস হয়নি আমার। দেখো ভাই প্রেম, ঝোঁকের মাথায় বলে ফেললাম বলে, তুমি যেন কাউকে—

না, না, আমি কখনো বলতে পারি? তোমাদের নিয়েই যে আমার কারবার।

আচ্ছা, বাই—বাই!

চলে গেল মহুয়া। মনসিজও বেরিয়ে এল পর্দার আড়াল থেকে।

প্রেমলতা বললে, শুনলে তো সব?

শুনলাম। অনেক—অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।

টলটলে চোখ আরো টলটলে করে প্রেমলতা বললে, আমার বখশিস কিন্তু পাওনা রইল। আবার এসো।

 * * *

পল্টু বললে, না স্যার, লেক টাউনের ঠিকানায় বি. গুপ্ত বলে কেউ থাকে না। গিয়ে দেখলাম, একখানা খোলার ঘর, খালিই পড়ে থাকে, রাতে জনকয়েক রিকশাওয়ালা শোয়।

কল্যাণ বললে, মিথ্যে সেখানে গেলে কেন? বি. গুপ্ত একটা ফলস নাম। ওই নামের আড়ালে যে ব্যক্তিটি আছে, সে ধরা—ছোঁয়া দেবে না বলেই তো চিঠি দিয়েছে।

মাথা চুলকে পল্টু বললে, ঠিক বলছেন স্যার। এ যুক্তিটা আমার মাথায় ঢোকেনি।

হাসি চেপে কল্যাণ বললে, কি করে ঢুকবে? একেবারে নিরেট যে! যাক, ক্যামাক স্ট্রিটের বাড়ির খবর কিছু আছে?

আছে স্যার।—পল্টু বললে, গত তিনদিন ধরে দেখছি রাত ন’টার পর একখানা কালো রঙের অ্যাম্বাসাডার গাড়ি ওই বাড়িটার দরজায় এসে থামে। থামামাত্র সদর দরজার মাথায় যে আলোটা জ্বলে, সেটা টুক করে নিভে যায়। আর, গাড়ি থেকে একটা স্যুট—পরা লোক নেমে অন্ধকারে ছায়ার মত ঢুকে যায় ভেতর! দেখে সন্দেহ হল। লিফটম্যানের হাতে দুটো টাকা গুঁজে দিয়ে জানতে পারলাম, লোকটা পাঁচতলার ফ্ল্যাটে আসে, আর সে—ফ্ল্যাটে থাকে—

বাধা দিয়ে কল্যাণ বললে, কে থাকে জানি। লোকটাকে দেখতে কেমন বলো।

পল্টু বলতে লাগল, অন্ধকারে দেখতে কি পেয়েছি? মক্কেল এলেই সদরের বাতি নিভে যায়! কাল এক প্যাঁচ করলাম স্যার। লোকটা তো এসে সট করে ঢুকে গেল, আমিও শালা ক্যাসাবিয়াংকার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম সদরের সামনে। রাত বারোটায় মক্কেল নামল। যেই সে কাছে এগিয়ে এসেছে, আমিও অমনি মুখে একটা চারমিনার গুঁজে ফস করে লাইটারটা জ্বেলেছি। মুখে আলো পড়তেই লোকটা থতিয়ে গিয়ে বললে, কৌন হ্যায়? আমি সেলাম ঠুকে বললাম, তিন নম্বর ফ্ল্যাটকা বাবুর্চি হ্যায় সাব! আর কিছু না বলে লোকটা চলে গেল। কিন্তু ওই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমি তাকে দেখে নিলাম স্যার। দেখলাম, ইয়া গাঁট্টাগোঁট্টা ঘাড়ে—গর্দানে—

কি দেখলে? কল্যাণ যেন দম বন্ধ করে প্রশ্ন করলে।

দেখলাম, ইয়া গাট্টাগোট্টা ঘাড়ে—গর্দানে চেহারা। মাথায় কদম—ছাঁট চুল, তামাটে মুখে কোঁকড়ানো দাড়ি, দাড়ি, লালচে চোখ দুটো চকচক করছে। মাল খেয়ে চুর!. . . কি ভাবছেন স্যার?

উঁ! না, কিছু না।—কল্যাণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল; সজাগ হয়ে বলল, বাঃ, মগজে তোমার বেশ খানিকটা বুদ্ধি আছে দেখছি। ওয়েল—ডান মাই বয়!

পল্টুর পিঠ চাপড়ে দিলে কল্যাণ। তারপর বললে, এবার কিন্তু আরো শক্ত কাজের ভার দিচ্ছি পল্টু। এরপর যখন ওই লোকটা ক্যামাক স্ট্রিটের ফ্ল্যাট থেকে বেরোবে, তুমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে ওর গাড়ির পিছু নেবে। ওর আস্তানাটা কোথায়, জেনে আসা চাই। পারবে না?

কেন পারব না স্যার?— পল্টুর চোখে—উৎসাহ।

ঠিক আছে।—পার্স থেকে খানকয়েক নোট বার করে কল্যাণ বললে, তোমার পাওনা।

দশ টাকার একখানা মাত্র নোট তুলে নিয়ে পল্টু বললে, অত টাকা নিয়ে কি করব? নেশা—ভাঙ আমি ছেড়ে দিয়েছি, শুধু মীনাকে নিয়ে মাঝে মাঝে কফি খেতে যাই। দশ টাকাই যথেষ্ট! চলি স্যার।

পকেট থেকে একটা গোঁফ বার বরে আবার সে নিজের নাকের নিচে আটকে দিলে। চোখে দিলে কালো চশমা। একগোছা চুল কপালের ওপর ফেলে, হেডকোয়ার্টার্স থেকে বেরিয়ে গেল পল্টু। ভোল পাল্টাবার কথাটা সে ভোলেনি।

নিজের ভাবনায় ডুবে গেল কল্যাণ। কাল রাতে মহুয়া নাগের মুখ থেকে মনসিজ যা শুনে এসেছে, তা থেকে একটা রহস্য পরিষ্কার হল। ব্লু—ডায়মন্ড বার থেকে সেই জার্মান—ছাঁট চুল, ঘাড়ে—গর্দানে লোকটাই মগনলালকে অনুসরণ করে, তারপর অলক মজুমদারের স্টুডিওর সামনে মওকা পেয়ে পেছন থেকে গুলি চালায়। তার রিভলভারে সাইলেন্সার লাগানো ছিল নিশ্চয়, নইলে মহুয়া গুলির আওয়াজ শুনতে পেত।

কিন্তু মানুষ নামে ওই জানোয়ারটা স্বরূপার বন্ধু! এত নিচে নেমে গেছে স্বরূপা! পুরুলিয়ার সেই শ্যামলা রঙের হাসি—খুশি বনহরিণী, তার প্রথম যৌবনকালের সহচরী। জীবনটা সত্যিই অদ্ভুত! নিদারুণ ঘৃণায় কল্যাণের মনটা কুঁকড়ে গেল। কিন্তু একটু পরেই সে অনুভব করলে, ঘৃণার সঙ্গে সঙ্গে একটা তীব্র ব্যথায় মনটা টনটন করছে।

টেলিফোনটা বেজে উঠল। হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে নিলে কল্যাণ।

হ্যালো! কল্যাণ বোস হিয়ার!

বেঙ্গল ব্যাঙ্ক থেকে বলছি। আপনি কি নিজের অ্যাকাউন্টে জমা দিতে এইমাত্র পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন?

সেকি! কল্যাণ স্তম্ভিত হয়ে বললে, না তো!

একটু আগে একটি লোক এসেছে আপনার নামে ওই টাকাটা জমা দিতে।

তাই নাকি!

ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হচ্ছে। আপনি কাইন্ডলি একবার আসবেন?

নিশ্চয়ই. . . এখুনি যাচ্ছি।

জিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল কল্যাণ। এমন দাতাকর্ণ কে আছে যে নগদ পাঁচ পাঁচ হাজার টাকা অযাচিতভাবে তার তহবিলে জমা দিতে চায়? তাজ্জব ব্যাপার! শুধু তাজ্জব নয়, দুরূহ অঙ্কের মতোই জটিল!

ব্যাঙ্ক—ম্যানেজারের ঘরে ঢুকতেই তিনি বলে উঠলেন, ব্যাপার কি বোস সাহেব? এমন লোককে টাকা জমা দিতে পাঠিয়েছেন, যে আপনার অ্যাকাউন্ট—নাম্বারই জানে না!

ঘটনাটা কি বলুন তো?—কল্যাণ প্রশ্ন করলে।

কিছুক্ষণ আগে আধাবয়সী একটি লোক এসে আপনার নামে পাঁচ হাজার টাকা জমা দেবার জন্যে জমার ফর্ম লিখে দেয়। ফর্মটা দেখে ডিপোজিট—কাউন্টারের অফিসার বলে, অ্যাকাউন্ট—নাম্বার ভুল লেখা হয়েছে, ঠিক করে লিখে দিন। লোকটা থতমত খেয়ে বলে, ঠিক মনে পড়ছে না, বলুন তো নাম্বারটা। অফিসারের কেমন সন্দেহ হয়, লোকটাকে আটকে রেখে সে এসে আমাকে রিপোর্ট করে। শুনেই আমি আপনাকে টেলিফোন করি।

কয়েক সেকেন্ড গুম হয়ে থেকে কল্যাণ বললে, লোকটা কোথায়?

ব্যাঙ্ক—ম্যানেজার বললেন, ডেকে পাঠাচ্ছি।

খানিক বাদে অফিসারের সঙ্গে যে ব্যক্তিটি ম্যানেজারের ঘরে ঢুকল, তার দিকে তাকিয়ে কল্যাণের চোখের পাতা পড়ল না।

লোকটি আর কেউ নয়, রতিকান্ত পাল!

তার দিকে তাকিয়ে কল্যাণ ভাববার চেষ্টা করলে, তার তহবিলে পাঁচ হাজার টাকা দান করে দাতাকর্ণ সাজতে রতিকান্তের হঠাৎ এত আগ্রহ কেন? কারণটা কি? ভাবতে ভাবতে দুরূহ জটিল অঙ্কটা এক নিমেষে সরল হয়ে গেল।

ম্যানেজার আর ডিপোজিট—কাউন্টারের অফিসারকে কল্যাণ বললে, অশেষ ধন্যবাদ আপনাদের। ইনি গুণী ব্যক্তি—জালিয়াতি মামলার আসামি। জামিনে ছাড়া আছে। একে হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে যাচ্ছি।

.