শেষ মুহূর্তে – ২

পরদিন কল্যাণ বোস বললে, না দত্ত, আমার তা মনে হয় না। মগনলাল করছিল অশ্বিনী লাহার কেসের তদন্ত, সে—ব্যাপারে রবসন বা পল্টুর কোনো যোগাযোগ নেই বলেই জানি। অতএব মগনলালকে অশ্বিনীর লোকই খুন করেছে—এটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক।

মনসিজ বললে, তাহলে রবসনের দলের মেয়ে মহুয়ার সঙ্গে মগনলালজী সে—রাতে বেরিয়েছিলেন কেন? কি কারণে?

সেই কারণটাই আমাদের জানতে হবে।—কল্যাণ বললে, কিন্তু সেটা যথাসময়ে জানা যাবে। এখন অশ্বিনী লাহার কেস নিয়েই এগোতে হবে আমাদের।

কয়েকটা নামের লিস্ট বার করলে কল্যাণ। সব ক’টা নামই পয়সাওয়ালা পদস্থ ব্যক্তির।

মনসিজ প্রশ্ন করলে, এরা কারা?

যারা শেয়ারের দালাল অশ্বিনীর কেসের সঙ্গে জড়িত। এই নাম ক’টা মগনলালই সংগ্রহ করেছিল।

কল্যাণের টেবিলে ঝুঁকে পড়ে মনসিজ নামের তালিকা পড়লে :

১। মৃগাঙ্ক মজুমদার

২। রমনভাই দেশাই

৩। অবনীশ ভদ্র

৪। স্বরূপা ঘোষ

৫। নীলমাধব সামন্ত

কল্যাণ ২নং আর ৫নং নামের পাশে লাল পেন্সিলের চিহ্ন দিয়ে বললে, এই দুজনকে আপাতত বাদ দেওয়া যেতে পারে। কেননা, এদের দু’জনেরই জোরালো অ্যালিবাই আছে। খুনের ঘটনায় কিছুদিন আগে থেকেই এরা বিদেশে রয়েছে। এখন বাকি তিনজনের সঙ্গে দেখা করে, তাদের জবানবন্দি নেওয়া দরকার। দেখো তো দত্ত, ফোন—গাইডে এদের টেলিফোন নম্বর পাও কিনা।

পাওয়া গেল ফোন নম্বর। প্রথমে মৃগাঙ্ক মজুমদারের নম্বর ডায়াল করলে কল্যাণ।

মিস্টার মজুমদার আছেন?

টেলিফোনের ওপার থেকে পুরুষালি গলায় শোনা গেল : সাহেব এখন একজনের সঙ্গে কথা কইছেন।

বোঝা গেল, বাড়ির বেয়ারা। কল্যাণ বললে, তাঁকে বলো গোয়েন্দা—ইন্সপেক্টর কল্যাণ বোস তাঁকে চাইছেন।

বলছি। ধরুন।

একটু পরে ভারি মোটা গলা শোনা গেল : মৃগাঙ্ক মজুমদার বলছি। বলুন ইন্সপেক্টর?

কল্যাণ বললে, অশ্বিনী লাহার কেস সম্পর্কে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

ও। কিন্তু দুঃখিত, সকালে তো আমার ফুরসত হবে না! আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, এখুনি বেরোতে হবে।

বেশ তো, অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেরে একবার ডি.ডি. হেডকোয়ার্টার্সে আসুন না।

কখন?—বিরক্তিটুকু মৃগাঙ্কের গলায় চাপা রইল না।

অমায়িকভাবে কল্যাণ বললে, যখন আপনার সুবিধে।

বেলা তিনটেয় যাব আমি।

ধন্যবাদ মিস্টার মজুমদার।

লাইন কেটে দিলে কল্যাণ।

মনসিজ প্রশ্ন করলে, কি বুঝলেন স্যার? সত্যিই আসবে, না ব্লাফ?

দেখাই যাক।—কল্যাণ এবার ডায়াল করলে অবনীশ ভদ্রকে।

এবার মিহি মেয়েলি গলার সাড়া পাওয়া গেল : মিস্টার ভদ্র দারুণ ব্যস্ত। কে ফোন করছেন?

কল্যাণ নিজের পরিচয় দিলেন।

মেয়েলি কণ্ঠ বললে, কাইন্ডলি পরে রিং করবেন।

লাইন কেটে দেবার আগেই কল্যাণ একটু কড়া গলায় বললে, পরে নয়, তাঁকে এখুনি চাই। ব্যাপারটা জরুরি।

অ। আচ্ছা, দেখছি।

মিনিট তিনেক বাদে। আবার মেয়েলি গলার সাড়া পাওয়া গেল : সরি ইন্সপেক্টর, মিস্টার ভদ্র এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন।

সশব্দে রিসিভার রেখে দিলে কল্যাণ। মনসিজ বললে, লোকটা শক্ত বাদাম মনে হচ্ছে!

হুঁ, সহজে ভাঙা যাবে না। আচ্ছা!—কল্যাণ একটা সিগারেট ধরালে। তারপর নিঃশব্দে কয়েকটা টান দিয়ে আরেকটা নম্বর ডায়াল করলে।

হ্যালো!—মিষ্টি সুরেলা নারীকণ্ঠ শোনা গেল।

মিসেস স্বরূপা ঘোষ আছেন?

বলছি। আপনি কে?

কল্যাণ বোস, ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর।

উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল মিষ্টি সুরেলা গলা : কী আশ্চর্য! কল্যাণ! এতদিন পরে! একবার খোঁজও কি নিতে নেই?

ভয়ানক অবাক হয়ে গেল কল্যাণ। একটু থতমত খেয়ে বললে, আপনি—মানে, আমরা কি পরস্পরের পরিচিত?

উত্তরে চাপা হাসির সঙ্গে শোনা গেল, তাই তো মনে হয়। পুরুলিয়ার রূপাকে মনে আছে বোধ হয়?

এক পলকে কল্যাণ তার কিশোরবেলায় ফিরে গেল। কিশোরবেলা থেকে প্রথম যৌবনকাল অবধি কতকগুলো টুকরো টুকরো ছবি সিনেমার টুকরো টুকরো শট—এর মতো তার স্মৃতির পর্দায় প্রতিফলিত হতে লাগল। পুরুলিয়ার রাঙামাটি. . . শ্যামলা রঙের এক প্রতিবেশী মেয়ে. . . পিঠ ভরা প্রচুর এলো চুল. . . কারণে অকারণে কেবলই হাসত. . .

কল্যাণ বললে, নিশ্চয় মনে আছে। এবার চিনেছি।

যাক, তবু ভাল!—স্বরূপার গলায় ঠাট্টা না অভিমান ঠিক বোঝা গেল না।

শোন, তোমার সঙ্গে দেখা করা আমার বিশেষ দরকার। কবে সময় হবে?

একটু খুশির সঙ্গে শোনা গেল : কবে আবার কি! যেদিন তোমার ইচ্ছে। আজই এসো না, আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

কল্যাণ বললে, আজ নয়, কাল। বিকেল পাঁচটায়! গাড়ি পাঠাতে হবে না, আমি নিজেই যাব’খন।

আচ্ছা। পাঁচ তলার ফ্ল্যাট।

রিসিভার রেখে কল্যাণ চুপ করে বসে রইল। পুরুলিয়ার সেই রূপাই তাহলে আজকের স্বরূপা ঘোষ! কিন্তু অশ্বিনী লাহার কেস সম্পর্কে তার নাম জড়িয়ে পড়েছে কেন? মগনলাল খুনের সঙ্গেও কি তার—

ভাবতে গিয়েও কল্যাণ ভাবতে পারল না।

মনসিজ জিজ্ঞেস করল, এখন আমাদের নেক্সট প্রোগ্রাম কি স্যার?

মৃগাঙ্ক মজুমদারের জন্যে অপেক্ষা করা।

.

কাঁটায় কাঁটায় তিনটের সময় মৃগাঙ্ক কল্যাণের কামরায় পা দিল।

সাধারণ ভদ্রতার সঙ্গে কল্যাণ তাকে বসতে অনুরোধ করলে। মৃগাঙ্ক মজুমদারের বয়স মনে হয় ষাটের কোঠায় পৌঁছেছে। পাতলা লম্বাটে চেহারা, চোখা নাক, মাথার দশ আনা চুল সাদা। ধূসর ট্রাউজারের ওপর গলাবন্ধ কালো প্রিন্সকোট, হাতে রুপো—বাঁধানো মলাক্কা বেতের লাঠি। পরিষ্কার করে কামানো মুখে আভিজাত্যের চেয়ে পোড়খাওয়া জীবনের ছাপই বেশি।

মৃগাঙ্ক চেয়ারে বসেই নিজের পকেট—ওয়াচ দেখল। তারপর বললে, আমার অনুমান, আপনি অশ্বিনী লাহার কেস সম্পর্কে তদন্ত করছেন। তাই না ইন্সপেক্টর?

কল্যাণ জবাব দেওয়ার আগেই মৃগাঙ্ক বলে যেতে লাগল, কিন্তু আমি এ বিষয়ে বিশেষ খবরাখবর দিতে পারব বলে মনে হচ্ছে না কেননা, অশ্বিনী লাহার টিপস নিয়ে আমি কিছু কিছু শেয়ার কেনাবেচা করতাম বটে, কিন্তু তার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ আমার আদপেই ছিল না।

কথার মাঝে একটু ফাঁক পেয়ে কল্যাণ বললে, আমি কিন্তু অশ্বিনীর ব্যাপারে আপনাকে ডাকিনি মৃগাঙ্কবাবু।

তবে?

অশ্বিনীর কেসের তদন্ত যিনি করেছিলেন, সেই ইন্সপেক্টর মগনলাল খুন হয়েছেন। আমি সেই খুনের তদন্ত করছি।

মৃগাঙ্ক মজুমদারের মুখ ছায়াচ্ছন্ন হয়ে উঠল। থেমে থেমে বলল, কিন্তু খুন—টুনের বিষয়—আমি—কিছুই তো—

তার মুখের ওপর চোখ রেখে কল্যাণ প্রশ্ন করলে, ইন্সপেক্টর মগনলালকে আপনি চিনতেন। তাই না?

মৃগাঙ্কের মুখের রং ফিকে হয়ে গেল। একটু থেমে বললে, হ্যাঁ, অশ্বিনী লাহা সম্পর্কে আমার কাছে তিনি বার দুই গিয়েছিলেন।

গত সোমবার আপনার সঙ্গে মগনলালের দেখা হয়েছিল কি?

কই, না!

দেখা করার কথা ছিল?

তাও না।

সোমবার সন্ধ্যার পর আপনি কোথায় ছিলেন মৃগাঙ্কবাবু?

বাড়িতে। ইচ্ছে হলে আমার চাকরকে এখুনি ফোন করে জানতে পারেন।

কল্যাণ একটু হেসে বললে, কি দরকার? আপনার কথাই যথেষ্ট।—আচ্ছা মৃগাঙ্কবাবু, আপনি কি করেন, জানতে পারি?

কিছুই এখন করি না। বছর দুই হল রিটায়ার করেছি।

তবু, একটা কিছু তো করতেন।

সিঙ্গাপুরে আমার চায়ের ব্যবসা ছিল। আর কিছু জানতে চান ইন্সপেক্টর?

আপাতত না। আসুন, নমস্কার!

লাঠিসমেত হাত দু’খানা তুলে বেরিয়ে গেল মৃগাঙ্ক মজুমদার। কল্যাণ নিজের ঘড়ি দেখলে। পৌনে চারটে। বললে, ছ’টা নাগাদ আমরা অবনীশ ভদ্রের ডেরায় হাজির হব দত্ত।

অবনীশ ভদ্রের ঠিকানা নিউ আলিপুরে।

প্রকাণ্ড একটা পাঁচতলা বাড়ির তৃতীয় তলায় অবনীশের ডেরা। কল্যাণ আর মনসিজ যখন পৌঁছল, তখন ছ’টা বেজে গেছে। দিনের আলো কালো হয়ে এসেছে। কল্যাণ দেখলে, তিনতলার ফ্ল্যাটে রাস্তার দিকে একটা বড় জানলা খোলা, ঘরে বাতি জ্বলছে।

কল্যাণ তখনই সে—বাড়িতে ঢুকল না। উল্টো দিকে একখানা তিনতলা বাড়ি, একটা ব্যাঙ্কের শাখা—অফিস। অফিস তখন বন্ধ হয়ে গেছে। কল্যাণ তার সঙ্গীকে নিয়ে অফিস—বাড়িতে ঢুকে গেল, তারপর সিঁড়ি বেয়ে একেবারে ছাদে। অন্ধকার নেমেছে, কিন্তু ঘন হয়নি। আলিসার ধার থেকে নজর তীক্ষ্ন করে দু’জনে সামনের আলোকিত জানলার দিকে তাকাল। যে—ঘরটা নজরে পড়ল, সেটা বোঝা গেল ড্রাইংরুম। একটা সোফায় বসে মোটাসোটা খাটো এক ব্যক্তি কথা বলছে জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে। যার সঙ্গে কথা বলছে, সে লোকটা আর্ম—চেয়ারে বসে আছে জানলার দিকে পিছন করে। লোকটার ছোট—করে—চুল—ছাঁটা মাথা আর ঘাড়ে—গর্দানে বলিষ্ঠ পিঠের খানিকটা ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। দ্বিতীয় ব্যক্তির হাতের কাছে একটা গোল টেবিলে কয়েকটা বোতল, গ্লাস, বরফের পাত্র সাজানো। বোঝা গেল, গৃহস্বামী রসিক ব্যক্তি।

কিন্তু ওদের মধ্যে গৃহস্বামীটি কে? কে অবনীশ ভদ্র? যেই হোক না, কল্যাণ জানলা থেকে নজর সরাল না। ঘাড়ে—গর্দানে লোকটার বোধ করি সিগারেট ধরানো দরকার, মোটা লোকটা নিজের লাইটার জ্বেলে উঠে এগিয়ে এল ধরিয়ে দিতে। কিন্তু জানলার কাছে এগিয়েই থেমে গেল, তারপর চলে গেল সুইচবোর্ডের কাছে। উজ্জ্বল সাদা আলোর বদলে মিটমিটে নীল আলোয় ভরে গেল ঘরটা।

কল্যাণ বললে, লোকটা আমাদের লক্ষ করেছে। তাই ঘরটা আবছা করে দিলে।

কল্যাণ আর দাঁড়াল না, মনসিজকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ নিচে নেমে গেল। কিন্তু রাস্তায় এসে অবনীশ ভদ্রের বাড়িতে তখনই ঢুকল না। বাড়ির গা ঘেঁষে একটা সরু গলিমতো প্যাসেজ রয়েছে, সেইমুখে মনসিজকে পাহারায় রেখে কল্যাণ সদর ফটকে ঢুকে গেল। ভেতরে ঢুকতেই অটোমেটিক লিফট। সে সটান তিনতলায় উঠে সামনের দরজায় পুশ—বেল টিপল। বার তিনেক টেপার পর ধীরে—সুস্থে দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে একটা বাজখাঁই গলার আওয়াজ শোনা গেল : কে মশায়? কোত্থেকে আগমন?

করিডরে তখন বাতি জ্বলছে। কল্যাণ দেখলে সেই মোটাসোটা খাটো লোকটা। গোল মুখে পুরু ঠোঁট, থুতনিটা দু’ভাঁজ।

কল্যাণ তার আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়ে বললে, ডিটেকটিভ হেড কোয়ার্টার্স থেকে আসছি।

লোকটা বিন্দুমাত্র ঘাবড়াল না। তেমনি রুক্ষভাবে বললে, অ! টিকটিকি! তা এখানে কি মনে করে?

ভেতরে চলুন, বলছি।

ভেতরে? বেশ, চলে আসুন। কিন্তু চা—টা চাইবেন না মশায়। এ সময় আমি চা খাই নে।

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কল্যাণ বললে, সে তো দেখতেই পাচ্ছি।

তার সজাগ নজর প্রথমেই গিয়ে পড়ল সেন্টার টেবিলের ওপর।

দুটো কাচের গ্লাস, বরফ রাখার গামলা, সোডার বোতল আর দামি বিলেতি হুইস্কি ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটের আধা—ভর্তি একটা বোতল। সেন্টার টেবিলের সামনের আর্ম—চেয়ারটা কিন্তু খালি। নিচে মেঝের ওপর ইন্ডিয়া কিংস সিগারেটের একটা শূন্য বাক্স। তার মানে সেই জার্মান—ছাঁট মাথা, ঘাড়ে—গর্দানে লোকটা গা ঢাকা দিয়েছে! যুগল মৌমাছির একটি এই মধুচক্র থেকে হাওয়া!

কল্যাণ মনে মনে আফশোস করে উঠল। আরেকটু আগে এলেই লোকটার সঙ্গে মোলাকাত হত। কিন্তু পালাবে কোথায়? বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে যদি পালায়, নিচে সার্জেন্ট দত্ত রয়েছে, নিশ্চয় আটকাবে।

অবনীশ ভদ্র কার নাম?—কল্যাণ প্রশ্ন করলে।

কেন? কি ব্যাপার?

আগে বলুন, অবনীশ ভদ্র কোথায়?

তেমনি রুক্ষভাবে জবাব এল, আপনার সামনে।

শূন্য সোফাটার দিকে তাকিয়ে কল্যাণ জিজ্ঞেস করলে, ওখানে বসে যিনি ড্রিঙ্ক করছিলেন, তিনি কে?

আমার মক্কেল।

মক্কেল!— করা হয় কি? আপনার পেশা?

মোটাসোটা লোকটা পকেট থেকে উইলসের প্যাকেট নিয়ে, ফস করে একটা ধরিয়ে বললে, আমি একজন অ্যাডভোকেট।

বলে কি! ছিরি—ছাঁদ দেখে তো মনেহয় চিৎপুরে মাংসের দোকান আছে। বিতৃষ্ণা চেপে কল্যাণ বললে, আপনার মক্কেলটি কে? নাম কি?

ধোঁয়া ছেড়ে অবনীশ ভদ্র নিতান্ত অভদ্র ভাবে বললে, নাম—টাম বলতে পারব না মশায়।

কল্যাণের ভ্রু—দুটো কুঁচকে গেল। বললে, কারণ?

অবনীশ বললে, কারণ আমার এখানে কোন কোন মক্কেল আসে প্রাইভেটে। তাদের পরিচয়, তাদের মামলার ব্যাপারে—সবই প্রাইভেট। সেক্ষেত্রে আমি তাদের নাম—ধাম ফাঁস করতে পারিনে। আমার পেশার বদনাম হয়ে যাবে যে মশায়!

অবনীশ তার নিজের গ্লাসটা মুখে তুলে খালি করে ফেলল।

কল্যাণ এবার পুরোদস্তুর পুলিশি মেজাজে বললে, পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা না করলে নিজের বিপদ আপনি নিজেই ডেকে আনবেন কিন্তু। বলুন, আপনার মক্কেলটি কে?

অবনীশ খ্যাঁকশেয়ালের মতো খ্যা খ্যা করে খানিকটা হাসলে। হেসে বললে, আমার বিপদ নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না টিকটিকিবাবু। মনে রাখবেন, আমিও আইনের কারবার করি।

তাহলে বলবেন না?

আজ্ঞে না। ভরসন্ধেবেলা কেন ঝামেলা করছেন মশায়?

দাঁতে দাঁত চেপে কল্যাণ নিজেকে সামলে নিলে। না, মাথা গরম করলে চলবে না। একটু থেমে আচমকা প্রশ্ন করলে, আচ্ছা অবনীশবাবু, অশ্বিনী লাহার সঙ্গে আপনার কদ্দিনের আলাপ?

অবনীশ সোজা জবাব দিলে, একদিনেরও নয়।

আপনি তার কাছ থেকে শেয়ার কিনতেন না?

কিনতাম। তার অফিস থেকে টেলিফোনে খবর পেয়ে কিনতাম। চার চোখের মিলন হয়নি কখনও।

ও। যাকগে, আমি একটা খুনের তদন্তে এসেছি।

অবনীশের চর্বির আড়ালে প্রায়—ঢাকা গুলি গুলি চোখ দুটো চকচক করে উঠল। বললে, বুঝেছি, ইন্সপেক্টর মগনলাল—খুন তো? আমার কাছে কোনও সুবিধে হবে না মশায়, আমি ও ব্যাপারের কিসসু জানিনে। তার চেয়ে মাল—টাল খাওয়া অভ্যেস থাকে তো আসুন, এক পাত্তর খান, দুটো রসের কথা বলুন।

খ্যাঁকশেয়ালের মতো খ্যা খ্যা করে আবার হাসতে লাগল অবনীশ।

কল্যাণ বুঝলে, লোকটা অতিশয় ধড়িবাজ। বৃথা সময় নষ্ট না করে সে নিচে নেমে গেল।

গলির মুখে মনসিজ দাঁড়িয়ে। একা। কল্যাণ বললে, এদিকে কেউ আসেনি?

মনসিজ ঘাড় নেড়ে জানাল, না। কিছু না বলে কল্যাণ গলির মধ্যে দ্রুত ঢুকে গেল। তাকে অনুসরণ করলে মনসিজ। কিছদূর যেতেই দেখা গেল, গলিটা ব্লাইন্ড লেন নয়, এঁকেবেঁকে তার অন্য মুখটা আরেকটা বড় রাস্তায় গিয়ে পড়েছে। সুতরাং অবনীশ ভদ্রের মক্কেল কল্যাণকে বোকা বানিয়ে এই পথে সহজেই হাওয়া হয়েছে!

.

নিউ আলিপুর থেকে ট্যাক্সি নিয়ে হেডকোয়ার্টার্সের পথে।

কল্যাণ একটা সিগারেট ধরিয়ে বললে, নাগালের মধ্যে এসেও সাসপেক্ট পালিয়ে গেল!

মনিসজ বললে, লোকটা কে হতে পারে বলে মনে হয়?

নাটের গুরু স্বয়ং অশ্বিনী লাহা হতে পারে। অথবা তার হাতের লোক।

অশ্বিনী লাহার ফটো আছে অফিস—রেকর্ডে?

না, তা নেই। তবে লোকটা দাগি নিশ্চয়, নইলে তার মক্কেলদের সঙ্গে দেখা করত না কেন?

ট্যাক্সি গড়িয়াহাটায় এল। কল্যাণ বললে, একটু কফি খেয়ে যাই চলো।

একটা মাদ্রাজি রেস্তোরাঁর সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দু’জনে নামল। কল্যাণ কিন্তু জানত না যে তার জন্যে আরেকটা বিস্ময় অপেক্ষা করছে।

রেস্তোরাঁয় ঢুকতে গিয়ে সে হঠাৎ মনসিজের হাত ধরে থামালে। মনসিজ জিজ্ঞাসু চোখে ফিরে তাকাতেই সে ইশারায় ভেতরের একটা টেবিল দেখিয়ে দিলে।

দেখা গেল, মাদ্রাজি রেস্তোরাঁর ভেতরে ছোট ছোট অনেক টেবিল। প্রত্যেকটা দু’জনের বসবার মতো। একদম কোণের দিকে একটা টেবিলে দু’কাপ কফি নিয়ে মুখোমুখি বসে আছে মীনা থাপা আর পল্টু চ্যাটার্জি! রবসনের দলের উঠতি মাস্তান পল্টু! দুজনে মশগুল হয়ে কথা বলছে।

মনসিজের সঙ্গে কল্যাণ ফিরে গেল ট্যাক্সিতে। তার মনের মধ্যে একটা প্রশ্নই তখন ঘুরপাক খাচ্ছে, পল্টু চ্যাটার্জির মতো একটা লোফার গুন্ডা মীনা থাপার মতো একজন ভাল মেয়ের সঙ্গে এত ভাব জমিয়েছে কেন? কি মতলবে?

কল্যাণ হঠাৎ ড্রাইভারকে বললে, সি.আই.টি. রোড।

মগনলালের বাড়িতে এখন মীনার এক কাকা এসেছেন সদ্যপিতৃহীনা মীনার দেখাশুনোর জন্যে। পুরানো দাসী কাঞ্চী কাকাকে ডাকতে যাচ্ছিল, কল্যাণ নিষেধ করলে। জানালে, কাঞ্চীকেই তার দরকার, মীনা সম্পর্কে কিছু গোপন কথা জানবার আছে।

মীনার সঙ্গে একটি ছোকরার ভাব—সাব হয়েছে, তুমি কি জানো?

জী, জানি।

কতদিন ভাব হয়েছে?

তা মাস তিনেক হবে।

মগনলালজী এ—কথা জানতেন?

গোড়ার দিকে জানতেন না, খুন হবার দিন পনেরো আগে জানতে পেরেছিলেন। এই নিয়ে মেয়েতে—বাপেতে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি অশান্তি হত। ছোকরাকে মীনা শাদি করতে চায়, বাবুজি কিছুতেই রাজী নয়। ছোকরা নাকি ভারি বদ।

মগনলালজী ছোকরাকে গিরেফতার করে শায়েস্তা করে দিলেই তো পারতেন।

তা পারতেন, কিন্তু পাছে জানাজানি হয়ে নিজের লেড়কির বদনাম হয়ে যায়, তাই বাবুজি ছোকরাকে একদিন ডেকে শুধু শাসিয়েছিলেন। ছোকরাও তাঁকে শাসিয়ে বলে গিয়েছিল, মীনাকে আমি শাদি করবই। কেউ বাধা দিলে তার লাশ ফেলে দেব।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল কল্যাণ। তারপর বললে, আচ্ছা চলি। আমি এসেছি, মীনাকে বোলো না।

 * * *

স্বরূপা ঘোষের ফ্ল্যাট ক্যামাক স্ট্রিটে।

স্বরূপা অপেক্ষা করছিল। কল্যাণকে দেখে দু—হাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা করলে : এসো। কতকাল বাদে তোমায় দেখলাম বলো তো!

ঘরে পা দিতে দিতে কল্যাণ বললে, তা অনেককাল বাদে। উনিশ বছর হল।

একটা ডিভান দেখিয়ে স্বরূপা বললে, নিজের ঘর মনে করে বসো।

কল্যাণ বসে চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। সুন্দর সাজানো ফ্ল্যাট। সুখ আরাম বিলাসে পরিপূর্ণ। স্বরূপার চেহারাও বদলেছে। পুরুলিয়ার সেই পাতলা ছিপছিপে মেয়েটি এখন জোয়ার—আসা নদী। কল্যাণ মনে মনে হিসেব করে দেখলে, তার নিজের বয়স এখন যদি বিয়াল্লিশ হয়, স্বরূপার ছত্রিশ হওয়া উচিত। তবু দেহ—তটে তার ভাঙন ধরেনি এতটুকু। আগের চেয়ে রঙটা ফর্সাও হয়েছে বেশ খানিকটা।

কয়েক মুহূর্তের জন্যে কল্যাণ ভুলে গেল সে পুলিশ—অফিসার। একটু হেসে সে বললে, তোমায় দেখে মনে হচ্ছে জীবনটা ভারি সুখের।

স্বরূপা হাসিমুখে বললে, তোমাকে দেখেও তো জীবনটা দুঃখের মনে হচ্ছে না। আগের চেয়ে আরও পুরুষালী, দেখতে আরও ভাল হয়েছ তুমি। বিয়ে করেছ তো?

করেছি বইকি।

বউ খুব সুন্দরী নিশ্চয়?

হেসে ফেললে কল্যাণ। বললে, কি করে বলি? এখনো তো হিন্দি ফিল্ম থেকে তার ডাক পড়েনি! তা তোমার বিয়ের খবর বলো।

একটু ক্ষীণ হেসে স্বরূপা বললে, বিয়ে আমার সইল না।

মানে?

মানে যত সহজে আমরা কাছে এসেছিলাম, তত সহজেই একদিন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। ব্যস, দি এন্ড! যাক, কি খাবে বলো? পুলিশ—অফিসাররা তো শুনেছি একটু—আধটু ড্রিঙ্ক করে থাকে। একটু ড্রিঙ্কস দিই তোমাকে?

তোমার এখানে সে ব্যবস্থাও আছে নাকি?—কল্যাণ বললে।

স্বরূপা বললে, আমার স্বামী যে—সমাজে মেলামেশা করত, সেখানে মদ আধুনিক ফ্যাশান। সেই থেকে চা—কফির মতো এ জিনিসটাও আমার ঘরে থাকে।

তোমারাও অভ্যাস আছে বোধ হয়?

স্বরূপা বললে, আমিও তো ওই সমাজের।—তারপর গলা চড়িয়ে বেয়ারাকে ড্রিঙ্কস আনতে ফরমাস করলে।

একটু পরেই পাশের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেয়ারা একটা ট্রে এনে মাঝের টেবিলে রাখলে। ট্রেতে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট হুইস্কির একটা বোতল, দুটো সুদৃশ্য কাচের গ্লাস, স্টেইনলেস স্টিলের পাত্রে বরফকুচি, সোডা এবং ইন্ডিয়া কিংস সিগারেটের একটা সোনালি বাক্স। সেদিকে তাকিয়ে কল্যাণের গোয়েন্দা—মন সজাগ হয়ে উঠল। আশ্চর্য! ঠিক এই জিনিসই সে দেখে এসেছে গত সন্ধ্যায় অবনীশ ভদ্রের ফ্ল্যাটে! কিন্তু দেখলই বা, ওই ব্র্যান্ডের হুইস্কি একজন ছাড়া দুনিয়ায় আর কেউ খায় না? খেতে পারে, কিন্তু ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট হুইস্কির সঙ্গে ইন্ডিয়া কিংস সিগারেটই খেতে হবে, এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম তো নেই!

দুটো গেলাসে দুটো পেগ ঢালল স্বরূপা। সোডা মিশিয়ে বরফকুচি দিয়ে, একটা গ্লাস তুলে দিলে কল্যাণের হাতে। সাধারণ আদবকায়দা অনুযায়ী গ্লাসটা মুখে তোলার অগে কল্যাণ বললে, চিয়ার্স!

এক চুমুক করে খাওয়ার পর স্বরূপা সিগারেটের বাক্স এগিয়ে দিলে কল্যণের দিকে। একটা তুলে নিয়ে কল্যাণ বললে, তুমি স্মোক করো না?

বাক্সটা রেখে স্বরূপা বললে, না, ধোঁয়া লাগলে আমার ফ্যারাঞ্জাইটিস হয়।

তাই নাকি?—স্বরূপার মুখের দিকে লক্ষ্য রেখে কল্যাণ বললে, তবে প্যাকেট অর্ধেক খালি কেন? কে খেয়েছে?

এক মুহূর্তের জন্য স্বরূপার মুখের ওপর দিয়ে একটা ছায়া সরে গেল। তারপরই সহজভাবে বললে, আমার এক বন্ধু মাঝে মাঝে আসে। সে—ই খায়।

সিগারেট ধরিয়ে কল্যাণ ধোঁয়া ছেড়ে বললে, ভারি শৌখিন লোক তো! যিনি ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট হুইস্কি আর ইন্ডিয়া কিংস সিগারেট খান, তাঁর রুচির তারিফ করতে হয়! কে তিনি? আমার সঙ্গে একদিন আলাপ করিয়ে দাও না স্বরূপা।

একটুখানি হাসি দেখা গেল স্বরূপার মুখে। বললে, বেশ তো, সুযোগ হলে দেব।

কল্যাণ এবার প্রসঙ্গ পাল্টালে। বললে, এবার কাজের কথায় আসি। তুমি তো বড় বড় কোম্পানির শেয়ার কিনে থাক, সম্প্রতি কোনো কোম্পানির শেয়ার তুমি কিনেছ?

ভারত টেক্সটাইল মিলের।

কবে কিনেছ?

গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে।

কল্যাণের দৃষ্টি একটু তীক্ষ্ন হল স্বরূপার মুখের ওপর। বললে, কিন্তু গতমাসের প্রথম সপ্তাহে ওদের মিলে হঠাৎ আগুন লেগে যাওয়ায় ওদের শেয়ারের দর হু হু করে পড়তে থাকে। শেয়ার—হোল্ডাররা তাদের শেয়ার বেচে দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। তুমি হঠাৎ কিনতে গেলে কেন?

মুচকে হেসে স্বরূপা বললে, শেয়ারের কারবার হচ্ছে স্পেকুলেশন—ফাটকাবাজি।

কল্যাণ বললে, তাই কি? না, তুমি গোপনে খবর পেয়েছিলে যে, ভারত টেক্সটাইল মিলে আগুন লাগাটা ইচ্ছাকৃত, তাতে মিলের বিশেষ ক্ষতি হয়নি? সুতরাং শেয়ারের দর সাময়িকভাবে পড়লেও দু’দিন বাদেই চড়চড় করে উঠে যাবে।

স্বরূপার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। বললে, যদি গোপনে খবর পেয়েই কিনে থাকি, সেটা কি বেআইনি কাজ?

এবার কল্যাণ মুখে হাসি নিয়ে বললে, তা তো বলিনি। আমি শুধু জানতে চাইছি খবরটা দিল কে?

স্বরূাপ বললে, তুমি যখন এত জানো, তখন এ কথাও তোমার জানা।

হুঁ। একটা খবর আমাকে বলবে? অশ্বিনী লাহা এখন কোথায়?

সে নিজে ছাড়া কেউ জানে না।

একটু চুপ করে থেকে কল্যাণ প্রশ্ন করলে, আচ্ছা, অশ্বিনী লাহার চেহারা কেমন?

স্বরূপা বললে, বেশ সুন্দর চেহারা, ফর্সা লম্বা—যাকে বলে হ্যান্ডসাম। কিছু মনে কোরো না কল্যাণ, একটা কথা বলি। অশ্বিনী লাহার কেসটা ছেড়ে দাও। লোকটা অসাধারণ চতুর, ওর সঙ্গে তুমি পেরে উঠবে না।

শান্ত গম্ভীর মুখে কল্যাণ বললে, তুমি কি আমাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছ?

বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, আমি তোমার ভাল চাই, কল্যাণ। ধন্যবাদ স্বরূপা। আজ উঠি।

সোফা ছেড়ে কল্যাণ ওঠবার আগে তার একখানা হাত ধরে স্বরূপা বললে, রাত তো বেশি হয়নি, আরো খানিকক্ষণ থাকো না। আরেকটা পেগ খাও।

আমি বেশি খাই না।—অল্প হেসে কল্যাণ বললে, কিন্তু আরো থেকে লাভ কি রূপা? পুরুলিয়ার সে—আমিও আর আমি নই, সে—তুমিও আর তুমি নও!

স্বরূপা কিছু না বলে নিজের গ্লাসে আরও খানিকটা হুইস্কি ঢেলে, এক চুমুকে প্রায় অর্ধেক খালি করে ফেললে। তারপর কেমন একটা বিষণ্ণ হাসি ঠোঁটে নিয়ে বললে, বহুদিন বাদে তোমার মুখে ‘রূপা’ ডাক শুনলাম! পুরুলিয়ার সেই জীবন থেকে আজ কতদূরে সরে এসেছি, তবু তোমার মুখে পুরানো ডাকটা যেন হাতছানি দিয়ে পিছনে ডাকল! জীবনটা ভারি অদ্ভুত, তারও চেয়ে অদ্ভুত মানুষের মন, তাই না? যাকগে, তোমাকে আর আটকাব না কল্যাণ। এসো।

আস্তে আস্তে কল্যাণ উঠে চলে গেল।

রাস্তায় এসে ট্রাম—বাস—ট্যাক্সির চেনা আওয়াজে তার মন থেকে অতীতের আচ্ছন্নতা কেটে গেল। একটা তীব্র সংশয় কাঁটা হয়ে বিঁধতে লাগল। অবনীশ ভদ্রের মক্কেল আর স্বরূপা ঘোষের শৌখিন বন্ধু কি একই ব্যক্তি?

কে সে? সে কি অশ্বিনী লাহা?

.

ভাল লাগছিল হাঁটতে। ট্যাক্সির সন্ধান না করে কল্যাণ হেঁটেই চলল। নিজের ভাবনায় ডুবে গিয়ে।

রাত বেশি হয়নি। রাতের কলকাতা রঙ্গিনী নটীর মতো সবে সেজেগুজে দাঁড়িয়েছে। শহরের বড় রাস্তা জনজোয়ারে ভাসছে। বড় রাস্তা ছেড়ে কল্যাণ তাই শর্টকাট গলি—রাস্তা ধরলে। এ—গলি থেকে ও—গলি, ও—গলি থেকে সে—গলি।

মানুষের একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে। বিশেষত গোয়েন্দাদের সে—ইন্দ্রিয় বড় তীক্ষ্ন। সেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অন্যমনস্ক কল্যাণের কানে কানে বললে, কেউ তার পিছু নিয়েছে, হুঁশিয়ার! কিন্তু না, পিছন ফিরে দেখলে চলবে না।

সজাগ হয়ে উঠল কল্যাণের কান। হ্যাঁ, জনবিরল গলিতে একটা মৃদু পদশব্দ তাকে অনুসরণ করছে!

সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেশলাইটা হাত ফসকে পড়ে গেল। সেটা কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য কল্যাণ থামলে। পিছনে পদশব্দও থেমে গেল। দেশলাই কুড়িয়ে, সিগারেট ধরিয়ে কল্যাণ আবার হাঁটতে লাগল। পিছনের পদশব্দও শুরু হল আবার।

কল্যাণ এবার নিজের হাতখানা মুখের সামনে তুলে ঘড়ি দেখলে। তারপর হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে হনহন করে ডান দিকের গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল। গলিতে ঢুকেই একটা লাইট—বক্স। তারই আড়ালে কল্যাণ গা—ঢাকা দিলে।

মিনিট খানেক পরেই গলির মুখে এসে দাঁড়াল এক ছায়ামূর্তি। পথের আলো তার পিছনে থাকায় মুখখানা দেখা যাচ্ছে না। লম্বাটে পাতলা শরীর, প্যান্ট—শার্ট পরা। লোকটা বারকয়েক এদিক—ওদিক চেয়ে দেখল। কোথায় গেল কল্যাণ বোস? নিমেষে হাওয়ায় মিশে গেল নাকি? ডাইনের গলি ধরে দ্রুত পা চালিয়ে দিলে লোকটা। লাইট—বক্সটা সে পার হওয়া মাত্র আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কল্যাণ বোস, ঠান্ডা গম্ভীর গলায় বললে, দাঁড়াও!

চমকে ফিরে তাকাল লোকটা। আর সঙ্গে সঙ্গে কল্যাণ হুকুম করলে, হাত তোলো!

লোকটার হাত দু’খানা স্প্রিংয়ের মতো উঠে গেল। পথের আলো এখন তার মুখে পড়েছে। দারুণ অবাক হয়ে কল্যাণ দেখলে, পল্টু চ্যাটার্জি! আর, পল্টু দেখলে কল্যাণের হাতে রিভলভার! পল্টুর পকেটগুলো আর কোমর বাঁ—হাতে চাপড়ে দেখল কল্যাণ। না, কোনো অস্ত্র নেই।

কড়া পুলিশি গলায় কল্যাণ নির্দেশ দিলে, আগে আগে চলো।

পল্টু বাধ্য ছেলের মতো হুকুম তামিল করলে।

.