শেষ মুহূর্তে – ১

শেষ অবধি জামিন পেয়ে গেল রতিকান্ত পাল। পুলিশের আপত্তি টিকল না।

চার্জটি সামান্য নয়। জাল চেক দিয়ে জড়োয়ার গয়না হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ। তবু, রতিকান্ত মোটা টাকা জামিন দিয়ে বেরিয়ে এল হাজত থেকে।

উপস্থিত আর কিছুই করবার নেই। সি—আই—ডি ইন্সপেক্টর কল্যাণ বোসও বেরিয়ে এল কোর্ট থেকে। পিছন পিছন এল সার্জেন্ট মনসিজ দত্ত। বললে, কি মনে হয় স্যার? রতিকান্তের অনেক টাকা, না?

কল্যাণ বোস হেসে বললে, তাই তো মনে হচ্ছে। অথচ—আশ্চর্য—মাস কয়েক আগেও রতিকান্ত ট্রেনে চানাচুরের প্যাকেট বেচত! আর, আজ সে এক কথায় দশ হাজার টাকার জামিন দিয়ে বসল! তাই ভাবছি—

কল্যাণ বোস থেমে গেল।

মনসিজ বললে, কি ভাবছেন স্যার?

চানাচুরওয়ালা রতিকান্ত আলাদিনের প্রদীপ পেয়ে গেল নাকি? যাকগে, কেস আমি সাজিয়ে দিয়েছি, আর কিছু করবার নেই।

পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরাল কল্যাণ বোস। শীতের রোদে ঝকঝকে দিন। ঝকঝকে কল্যাণের চেহারাও। মাঝারি লম্বা দেহ পিঠ অনেকখানি চওড়া। বয়স চল্লিশে পৌঁছলেও মজবুত দেহ যেন খোদাই করা। তবু, লক্ষ করলে দেখা যায়, রগের দু’পাশের চুলে অস্পষ্ট রূপালি ছোপ। মনসিজ দত্ত সাতাশ বছরের ছোকরা। ছিপছিপে লম্বা। চোখের তারা কুচকুচে কালো। মুখের হাসি দেখলে মনে হয়, পুলিশ—লাইনে তার আসাই উচিত হয়নি।

চলতি একখানা ট্যাক্সি থামিয়ে দু’জনে উঠে বসল। সি—আই—ডি হেডকোয়ার্টার্স।

কল্যাণ বললে, মগনলালের বাসাটা একবার ঘুরে যাব।

মগনলাল কল্যাণ বোসের সহকর্মী। একই পদে—গোয়েন্দা—ইন্সপেক্টর। সি.আই.টি রোডের একটা ফ্ল্যাটে থাকে। বার দুই বেল টিপতেই দরজা আধখানা খুলে গেল, একটা সুন্দর মুখ উঁকি দিল।

মগনলালজী আছেন?—কল্যাণ জিজ্ঞেস করলে।

আপনি?—পাল্টা প্রশ্ন করলে মেয়েটি।

আমি তাঁর বন্ধু। আমরা একই অফিসে কাজ করি।

ও!

মেয়েটি এবার দরজা পুরোপুরি খুলে আত্মপ্রকাশ করলে। বয়স আঠারো—উনিশের বেশি নয়। গোল মুখে ঈষৎ নেপালি ধাঁচ থাকলেও মুখখানা দেখতে মিষ্টি। নীল ঘাঘরার ওপরে হলদে জ্যাকেট পরা।

মুখে দুর্ভাবনার ছাপ নিয়ে মেয়েটি বললে, একটু আগে আপনাদের অফিসে আমি ফোন করেছিলাম—

কেন বলো তো?

দু’ সেকেন্ড চুপ করে থেকে মেয়েটি বললে, আজ দু’দিন হল বাবা বাড়িতে ফেরেননি। তাই—

কল্যাণ মেয়েটির দিকে একটু ঝুঁকে কথা বলছিল, এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। বললে, মগনলালজী দু’দিন বাড়িতে ফেরেনি!

না।

আশ্চর্য! অফিসেও দু’দিন সে রিপোর্ট করেনি। আমি ভবেছিলাম, তার অসুখ করেছে হয়তো। আচ্ছা, কলকাতার বাইরে তার যাবার কথা ছিল কি?

জানি না তো। বাবা আমায় কিছু বলেননি।

মনে হল মেয়েটি ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়েছে, বিচলিত হয়েছে। নরম গলায় কল্যাণ প্রশ্ন করলে, কি নাম তোমার?

মীনা থাপা।

আশ্বাস দিয়ে কল্যাণ বললে, তুমি ভয় পেও না মীনা। মনে হচ্ছে, মগনলালজীকে একটা কেসের তদন্তে হঠাৎ শহরের বাইরে যেতে হয়েছে। খবর দেওয়ার সময় পায়নি। আজ—সকালের মধ্যেই এসে পড়বে।

ঈষৎ ছোট ছোট উজ্জ্বল সরল চোখ দুটো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। যেন ভরসা পেয়েই মীনা থাপা বললে, ঠিক বলেছেন! বাবা নিশ্চয় আজ—কালের মধ্যেই ফিরে আসবে!

বাড়িতে আর কে আছে?

বাহাদুর আর কাঞ্চী।

বেশ। তোমার কোনও দরকার পড়লে আমাকে অফিসে ফোন কোরো।

নিজের নামটা জানিয়ে কল্যাণ সার্জেন্ট দত্তের সঙ্গে অপেক্ষমাণ ট্যাক্সিতে ফিরে গেল।

.

হেডকোয়ার্টার্সে পৌঁছে কল্যাণ সবেমাত্র নিজের টেবিলে বসেছে, খবর এল গোয়েন্দা—বিভাগের ছোটকর্তা সুরজিৎ গুপ্ত তলব করেছেন। তলবটা জরুরি।

ছোটকর্তা তাঁর টেবিলে নেই, ঘরে পায়চারি করছেন। গুপ্তসাহেবের কামরায় পা দিয়ে কল্যাণ জানালে, রতিকান্ত পাল জামিন পেয়ে গেল স্যার। জামিনের টাকা সে নিজেই দিয়েছে। তবে তার বিরুদ্ধে এমন কতকগুলো মোক্ষম প্রমাণ আছে যে, জামিন পেলেও সে খালাস পাবে বলে মনে হয় না।

সুরজিৎ গুপ্তের বয়স হয়েছে। ষাটের কোঠায়। অনেক অভিজ্ঞতার রেখা মুখে আঁকা। অসিহিষ্ণু গলায় বললেন, চুলোয় যাক রতিকান্ত পাল! এদিকে আরেকজন যে খালাস পেয়ে গেল। দুনিয়া থেকে খালাস!

কে স্যার?

তোমারই কোলিগ—মগনলাল থাপা।

মগনলাল থাপা! পাঁচ সেকেন্ডের জন্যে কল্যাণের শরীরটা শক্ত হয়ে আস্তে আস্তে আবার শিথিল হয়ে গেল। মিনিট খানেক কথা বেরোল না তার মুখ দিয়ে। অল্প বাদামি চোখের তারা দুটো স্থির হয়ে রইল সুরজিৎ গুপ্তের মুখের ওপর। তারপর নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে কল্যাণ জিজ্ঞেস করলে, কোথায় পেলেন তাকে?

গুপ্তসাহেব বললেন, পশ্চিম পুঁটিয়ারিতে। খালের জলে তার ডেডবডি ভাসছিল, তোলা হয়েছে। বর্ণনা শুনে মনে হল মগনলাল। শনাক্ত করার জন্যে এখুনি যেতে হবে, চলো।

জিপে উঠে কল্যাণের কেবলই মনে পড়তে লাগল এইমাত্র দেখে আসা মীনা থাপার মুখখানা। ছোট ছোট উজ্জ্বল আর সরল চোখ দুটো আরও উজ্জ্বল করে মেয়েটা তাকে বলেছিল, ঠিক বলেছেন! বাবা নিশ্চয় আজ—কালের মধ্যেই ফিরে আসবে।

কল্যাণ বোসের নিজেরও মেয়ে আছে?

ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখা গেল, কিছু স্থানীয় পুলিশ মৃতদেহ ঘিরে রয়েছে। না, কষ্ট করে চিনতে হল না। কিন্তু চিনে কষ্ট হল। মগনলালই বটে! দু’দিন ধরে জলে ভিজে মগনলালের দেহ বিকৃত বীভৎস হয়ে উঠেছে। দু’চোখের শূন্য গহ্বর দুটো হ্যাঁ করে আছে। কোনও জলজন্তু বোধ হয় তারা দুটো খুবলে খেয়েছে। পিঠের বাঁ দিকে একটা ক্ষত। কল্যাণ বুঝতে পারলে বুলেটের ক্ষত। অর্থাৎ মগনলালকে আগে অতর্কিতে গুলি করে মেরে, পরে লাশটা খালের জলে ফেলে দেওয়া হয়।

পুলিশের ডাক্তার হাজির ছিল। বললে, মৃত্যুটা হয়েছে আন্দাজ বিয়াল্লিশ ঘণ্টা আছে। রিভলভারের একটা বুলেট পিঠের বাঁ দিকে ঢুকে ফুসফুস ফুটো করে বেরিয়ে গেছে। সঠিক রিপোর্ট পোস্টমর্টেমের পর জানা যাবে।

মৃতদেহ পোস্টমর্টেম পরীক্ষার জন্য আর মগনলাল পোশাক ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে পাঠাবার নির্দেশ দিয়ে গুপ্তসাহেব জিপে উঠতে যাচ্ছিলেন, তাঁর নজর পড়ল কল্যাণের ওপর। সে তখন মৃত মগনলালের পকেটগুলোতে হাত ঢুকিয়ে কি যেন খুঁজছে।

গুপ্তসাহেব বললেন, যা খুঁজছ, তা পাবে না হে। চলে এসো।

হেডকোয়ার্টার্সে ফিরতে ফিরতে কল্যাণ প্রশ্ন করলে, আমি কি খুঁজছিলাম, আপনি জানেন স্যার?

জানি বইকি!—গুপ্তসাহেব ক্ষীণ হেসে বললেন, ক্রিমিন্যাল চরিয়ে আমার মাথার বারো আনা চুল সাদা হয়ে গেছে। মগনলালের পার্সোনাল নোটবইখানা খুঁজছিলে তো?

কল্যাণ নিঃশব্দে ঘাড় নাড়লে।

গুপ্তসাহেব বললেন, যদি তোমার নোটবুকে আমার অপরাধ সম্পর্কে কোনো তথ্য বা প্রমাণের কথা লেখা থাকে, তবে কি করে তুমি আশা করো যে আমি তা হাতে পেয়েও ছেড়ে দেব? অশ্বিনী লাহার কেস নিয়ে মগনলাল তদন্ত করছিল তুমি জান। তার নোটবইয়ে নিশ্চয় এমন কিছু ছিল, যা অপরাধীর পক্ষে বিপজ্জনক। সুতরাং—

আপনি কি মনে করেন, মগনলালকে অশ্বিনী লাহাই খুন করেছে?—কল্যাণ প্রশ্ন করে উঠল।

অশ্বিনী নিজে অথবা তার দলের কেউ। তাই মনে হয় না কি? মগনলালের হাতে আর কোনো কেস তো ছিল না।

সুরজিৎ গুপ্ত পাইপ ধরাতে উদ্যোগী হলেন। কল্যাণ দেখল, তাঁর রাশভারি মুখখানা আজ বড় বেশি গম্ভীর! বার কয়েক ধোঁয়া ছেড়ে তিনি বললেন, শোন বোস, আমার ডিপার্টমেন্টে এই প্রথম একজন অফিসার খুন হল। এর চেয়ে আফশোসের কথা আর নেই। মগনলাল খুবই কাজের লোক ছিল, তাকে হারিয়ে বিশেষ ক্ষতি হল আমাদের। আরও বেশি ক্ষতি হল তার নোটবুক খোয়া গেছে বলে। এর মানে জান?

কল্যাণ বললে, জানি স্যার। অশ্বিনী লাহা কেস সম্পর্কে আবার নতুন করে তদন্ত চালাতে হবে।

ঠিক তাই।—গুপ্তসাহেব বললেন, মগনলাল ছাড়া একমাত্র তোমারাই ওপরে আমি নির্ভর করি বেশি। আমি চাই, অশ্বিনী লাহার কেসটা তুমিই হাতে নাও।

একটু চুপ থেকে কল্যাণ বোস বললে, আপনি যখন বলছেন, তখন নিলাম। কিন্তু আমি ভাবছিলাম স্যার, মগনলাল—মার্ডার কেসটার তদন্ত—

আলাদাভাবে করার দরকার নেই। আমার অভিজ্ঞতা বলছে, অশ্বিনীর কেসটার তদন্ত করতে করতে একদিন ওটাও জানতে পারবে।

সুরজিৎ গুপ্ত পাইপে টান দিলেন।

 * * *

কেস হাতে নিয়ে বসে থাকা কল্যাণ বোসের স্বভাব নয়। পরদিন থেকেই তাকে অশ্বিনী লাহার কেসটার মোটা ফাইল নিয়ে বসতে দেখা গেল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গোটা ফাইলটা পড়ে কল্যাণ বুঝতে পারল, অশ্বিনী লাহা ক্ষণজন্মা ব্যক্তি।

পেশায় লোকটা শেয়ার মার্কেটের দালাল। সমাজের উঁচু মহলে সে শেয়ার—বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত। তার টিপস নিয়ে অনেকে অনেক টাকা ঢেলে বড় বড় কোম্পানির শেয়ার কিনে ফেলত; তারপর অশ্বিনী হঠাৎ খবর পাঠাত যে, অমুক কোম্পানির শেয়ারের দর পড়তির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। কারণ, হয় প্রোডাকশন কমে আসছে, নয় লেবার—ট্রাবলের দরুণ লক—আউট আসন্ন। অথবা অন্য কোনও কারণ। শেয়ার—হোল্ডাররা বেশি লোকসানের ভয়ে কিছু কম দামেই শেয়ারগুলো বেচে দিত। আশ্চর্য, তারপরেই কিন্তু সেই সব শেয়ারের দর নামবার বদলে চড়চড় করে উঠে যেত! এমনি করে কয়েকজন লক্ষপতি যেমন রাতারাতি ফকির হয়ে গেছে, তেমনি কয়েকজন ফকিরও রাতারাতি লক্ষপতি হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ফকির থেকে যারা লক্ষপতি হয়েছিল, তারা কারা? বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তারা অশ্বিনীর টাকা—খাওয়া লোক। তাদেরই নামে অশ্বিনী নিজেই কিনত সেই কম দামে বেচে দেওয়া শেয়ারগুলো।

এ কারবার চলেছিল বছর তিনেক! তারপরেই কয়েকজন ঘা—খাওয়া ফাটকাবাজের অভিযোগক্রমে পুলিশ নাটের গুরু অশ্বিনী লাহার খোঁজ করে। কিন্তু অশ্বিনী তার আগেই পাদপ্রদীপের সামনে থেকে নিঃশব্দে পর্দার আড়ালে সরে গেছে। কিন্তু পর্দার আড়ালে শুধুই অন্ধকার। মাস তিনেক ধরে সেই অন্ধকার হাতড়ে ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মগনলাল কিছুটা হদিস পাবার চেষ্টা করেছিল। বুদ্ধির চকমকি ঠুকে হয়তো বা কিছুটা আলো জ্বালাতেও পেরেছিল। কিন্তু মগনলালের জীবনদীপের সঙ্গে সঙ্গে সে—আলোও ফুস করে নিভে গেছে। সুতরাং দমে গেলে চলবে না, আবার গোড়া থেকে শুরু করো কল্যাণ বোস!

বেশ, তাই হোক! অশ্বিনী লাহার কেসটার সঙ্গে আরও কয়েকটা নাম—ঠিকানা জোগাড় করেছিল মগনলাল। ফাইল থেকে নিজের নোটবইয়ে টুকে নিয়ে কল্যাণ রেকর্ড—রুম থেকে বেরিয়ে এল। বেরিয়ে আসতেই মনসিজ দত্তের সঙ্গে দেখা।

কেসটা তা হলে আপনি নিলেন?—মনসিজ প্রশ্ন করলে।

পাল্টা প্রশ্ন করলে কল্যাণ বোস, কোন কেসটার কথা বলছ?

মগনলাল—মার্ডার কেস।

ওটা তো অশ্বিনী লাহা কেসের লেজুড়। অশ্বিনী—রহস্য ভেদ করতে পারলেই জানা যাবে কোন মেঘনাদ মগনলালকে খুন করেছে। যাই হোক, এ ব্যাপারে আমি তোমার সাহায্য চাই দত্ত। অলরেডি গুপ্তসাহেবের কাছ থেকে তোমাকে চেয়ে নিয়েছি।

হাসিমুখে মনসিজ বললে, আপনাকে সব রকমে সাহায্য করতে আমি তৈরি স্যার।

তার পিঠ চাপড়ে কল্যাণ বললে, খুশি হলাম। তাহলে এসো, কাজ শুরু করে দিই।

নিজের কামরায় এসে কল্যাণ একটা সিগারেট ধরালে। তারপর বললে, সবার আগে আমাদের জানতে হবে খুন হওয়ার দিন মগনলাল কোথায় কোথায় গিয়েছিল এবং কার কার সঙ্গে দেখা করেছিল। কারণ তদন্তের কাজ যে অবধি এসে থেমে গেছে, সেখান থেকেই আমাদের শুরু করতে হবে।

রাইট স্যার।—সার্জেন্ট দত্ত বললে, ফাইলের রিপোর্টে নিশ্চয় জানা গেছে মগনলালজী খুন হওয়ার আগে কোথায় ছিলেন এবং কার সঙ্গে দেখা করেছিলেন?

না। মগনলালের নিয়ম ছিল সারাদিন কাজের পর রাতে ডেইলি রিপোর্ট লিখে ফাইলে রাখা। কিন্তু সোমবার দিন—মানে তার পরমায়ুর শেষ দিন, সে আর অফিসে ফিরে আসেনি। তার নিজের নোটবুকে সম্ভবত সে কিছু লিখে রেখেছিল, কিন্তু তাও বেহাত হয়ে গেছে।

তাহলে সোমবারের খবর জানা তো সম্ভব নয় স্যার!

কল্যাণ বললে, গোয়েন্দার অভিধানে ‘অসম্ভব’ শব্দটা থাকতে নেই দত্ত। শুধু গোটাকতক শূন্য দিয়ে অঙ্ক মিলিয়ে দেওয়াই গোয়েন্দার কাজ।

জ্বলন্ত সিগারেটে বড় করে একটা টান দিলে কল্যাণ। তারপর হঠাৎ হেসে প্রশ্ন করলে, বিয়ার—টিয়ার খাওয়া অভ্যেস আছে তো?

একটু থতিয়ে গিয়ে মনসিজ বললে, না স্যার।

সেকি হে!—হালকা গলায় কল্যাণ বললে, আজকালকার ছেলে তুমি, হুইস্কি নয়, ব্র্যান্ডি নয়, সামন্যে বিয়ার—তাও খাও না! লোকে নাবালক বলবে যে! চলো, আজ সন্ধের পর ব্লু ডায়মন্ড বার—এ যাই, তোমার হাতেখড়ি দিয়ে দিই।

মনসিজ বুঝতে পারল, বিয়ার খাওয়াটা উপলক্ষে মাত্র। ব্লু ডায়মন্ড—এ যাবার পেছনে নিশ্চয় কোনও ধান্দা আছে কল্যাণ বোসের।

হাসিমুখে বললে, রাইন স্যার।

.

ব্লু ডায়মন্ড বার ওয়েলেসলি অঞ্চলে।

নামটা জমকালো হলেও এটা একটা সাধারণ পানশালা। পার্ক স্ট্রিটের বার—রেস্তোরাঁগুলোর মত খুব আধুনিক ধাঁচে সাজানো না হলেও ব্লু ডায়মন্ডের নাম—ডাক আছে। বছর কয়েক পূর্বে উজাগর সিং নামে এক পাঞ্জাবি এই পানশালাটি খুলেছিল। লোকে বলত, উজাগর সিংয়ের আসল কারবার ছিল স্মাগলারদের সঙ্গে এবং পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে যাতে চোরাই কারবারের লেনদেনের সুবিধে হয়, সেই উদ্দেশ্যেই পার্ক স্ট্রিট ছেড়ে উজাগর ওয়েলেসলিতে পানশালাটি খোলে। কিন্তু উদ্দেশ্য যাই হোক, ব্লু ডায়মন্ড অল্পদিনেই জমে গেল। এর বারো আনা খদ্দের জাহাজি মাল্লারা, আর সমাজের চোরা—গলিতে যারা চলাফেরা করে, তারাই।

বছর দুই আগে শত্রুর ছুরি উজাগরের ভবলীলা সাঙ্গ করে। কিন্তু ব্লু ডায়মন্ডের দরজা বন্ধ হয়নি। উজাগরের স্ত্রী প্রেমলতা এখন পানশালা চালাচ্ছে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর সে নিজে এসে বার কাউন্টারে বসে।

কল্যাণের মুখে সার্জেন্ট মনসিজ মোটামুটি এই শুনেছে।

রাত আটটায় যখন দু’জনে কাচের দরজা ঠেলে ব্লু ডায়মন্ডের হলে পা দিল, তখনই পানশালা জমজমাট। ভেতরে ঢুকে কল্যাণ একবার চারধারে চোখ বুলিয়ে নিল। চেনা মুখ—হ্যাঁ, গোটা কয়েক আছে বইকি। এককোণে একটা একানে টেবিলে রতিকান্ত পাল। হলের মাঝামাঝি একটা বড় টেবিল ঘিরে জনকয়েক ছোকরার মধ্যে উঠতি মাস্তান পল্টু চ্যাটার্জি। কিন্তু তার গা ঘেঁষে বেলবটম প্যান্ট আর টাইট গেঞ্জি পরা যুবতীটি কে?

একজন ওয়েটার এগিয়ে এল।

আইয়ে সাব, কেবিন খালি হ্যায়।

কল্যাণ বললে, কেবিন দরকার নেই। আমরা বার—কাউন্টারে বসব।

রতিকান্ত আর পল্টু চ্যাটার্জির চোখ এড়িয়ে দু’জনে বার কাউন্টারের দিকে এগোল। কল্যাণ বললে, ওই প্রেমলতা!

মনসিজ দেখলে, কাউন্টারের ভেতরে একটা উঁচু টেবিলের সামনে একখানা উঁচু চেয়ারে বসে একটি মেয়ে বোধ করি কাস্টমারদের জন্যে বিল লিখছে। মুখের রঙটা উগ্র রকমের ফর্সা। হয়তো ম্যাক্স ফ্যাক্টরের গুণে। পরনে গাঢ় নীল সালোয়ার—কামিজ আর দুধ—সাদা দোপাট্টা। পিঠে লম্বা বেণী। মেয়েদের বয়সটা যদিও গোলমেলে, তবু মনসিজের মনে হল কুড়ি—বাইশের বেশি নয়।

কাউন্টারের ধারে এসে কল্যাণ বললে, হ্যালো।

প্রেমলতা চোখ তুলে তাকাল। বড় বড় কালো টলটলে চোখ। মিষ্টি করে হেসে বললে, হ্যালো বোস! গুড ইভনিং!

গুড ইভনিং টু ইউ প্রেম!

টেবিল ছেড়ে কাউন্টারের ওধারে এসে দাঁড়াল প্রেমলতা। এবার মনসিজের মনে হল, তার বয়সটা তিরিশের কাছাকাছি। তা হোক, আশ্চর্য রকম তার দেহের বাঁধুনি।

প্রেমলতা সাদা দাঁতের ঝিলিক ছড়িয়ে বললে, মগনলালের সঙ্গে বার কয়েক এসেছিলে তুমি, তারপর অনেকদিন আর দেখা নেই! আজ হঠাৎ যে?

কল্যাণ বললে, হঠাৎ তোমাকে মনে পড়ল, চলে এলাম।

তাই নাকি!—জোরে হেসে উঠল প্রেমলতা। বললে, কি দেব?

বিয়ার দাও। দাঁড়াও, তার আগে আলাপ করিয়ে দিই। আমার বন্ধু সার্জেন্ট মনসিজ দত্ত—বান্ধবী প্রেমলতা।

কি নাম বললে? প্রেমলতা জিজ্ঞেস করলে।

কল্যাণ পুনরাবৃত্তি করলে : মনসিজ দত্ত।

ম—নো—সি—জ! বেশ মিষ্টি নাম তো!

স্মার্ট মনসিজ তার পেটেন্ট লাজুক—লাজুক হাসিটি মুখে নিয়ে বললে, আপনার নামটাও তো কম মিষ্টি নয়। প্রেমলতা!

টলটলে কালো চোখ আরও টলটলে করে প্রেমলতা বললে, আমার নামটা আপনার মুখে শুনে তাই মনে হচ্ছে।

দু’মগ ঠান্ডা বিয়ার নিজেই নিয়ে এল প্রেমলতা। ইন্সপেক্টর আর সার্জেন্ট উঁচু টুলে চেপে বসল। দীর্ঘ একটা চুমুক দিয়ে কল্যাণ একটু চাপা গলায় বললে, মগনলালের খবর শুনেছ বোধ হয়?

প্রেমলতা বললে, শুনেছি। ভারি দুঃখের কথা। মগনলালজী আমার রেগুলার কাস্টমার ছিল।

জানি। আচ্ছা প্রেম, গত সোমবার দিনও কি মগন এখানে এসেছিল?

এসেছিল। ঠিক এইখানেই বসে পর পর তিন মগ বিয়ার খেয়েছিল সে।

ক’টার সময়?

রাত সাড়ে আটটা নাগাদ।

সেদিন তার মেজাজ কেমন ছিল? যেমন স্বাভাবিক ফুর্তিবাজ, তেমনি?

প্রেমলতা বললে, না, কেমন যেন গম্ভীর। আমার সঙ্গে কথাও বেশি বলেনি। মনে হচ্ছিল, তার ভেতরে একটা অস্বস্তি চাপা রয়েছে। আমি জানতে চাইলাম, কি হয়েছে? মগনলাল শুধু বললে, মেয়েটার জন্যে দুশ্চিন্তায় আছি। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কেসটা কদ্দুর এগোল? সে বললে, আজ এমন একটা জোরালো খবর পেয়েছি, যা নাকি রহস্যের চাবিকাঠি।

আচ্ছা!—কল্যাণের চোখ দুটো তীক্ষ্ন হল। প্রশ্ন করলে, তারপর?

কিছুক্ষণ পরে মহুয়া নাগ হলে ঢুকল। তাকে দেখে বিয়ারের মগটা শেষ না করেই মগনলাল হঠাৎ উঠে গেল তার কাছে।

মহুয়া নাগ! কে সে?

প্রেমলতা বললে, চেনো না? আর্টিস্টদের মডেল হিসেবে বেশ নাম করেছে। রবি সেনের দলে খুব ভিড়ছে আজকাল।

রবি সেন! মানে কুখ্যাত রবসন?

হ্যাঁ।

কিন্তু রবসনের দলের মেয়ের সঙ্গে মগনলালের কী এমন দরকার?

তা জানি নে। তবে দেখলাম, দু’জনে কিছুক্ষণ কথা হল। মনে হল প্রাইভেট। তারপর মহুয়া নাগের সঙ্গে মগনলাল বেরিয়ে গেল।

তখন রাত ক’টা?

প্রায় সাড়ে ন’টা।

নিজের আঙুলে—ধরা সিগারেটের নীলচে ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে কল্যাণ মৃদু স্বরে বললে, হুঁ। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, সোমবার রাত সাড়ে ন’টার পরেও কিছুক্ষণ বেঁচে ছিল মগনলাল। থ্যাঙ্ক ইউ প্রেম। অ্যান্ড গুড নাইট!

বিয়ারের দাম মিটিয়ে উঠে পড়ল কল্যাণ বোস।

লাজুক হেসে মনসিজও বলল, গুড নাইট।

টলটলে কালো চোখে মাদকতা এনে প্রেমলতা বললে, আবার আসবেন।

চলে যেতে গিয়ে কল্যাণ হঠাৎ ফিরে এল। কাউন্টারের ওপর ঝুঁকে প্রশ্ন করলে, ওই মেয়েটি কে প্রেম? ওই যে পল্টু চ্যাটার্জির পাশে!

প্রেমলতা জবাব দিলে, ওই তো মহুয়া নাগ।

.

ব্লু ডায়মন্ড বার বন্ধ হবার মিনিট পনেরো আগে কাচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল পল্টু চ্যাটার্জি। পেছনে পেছনে মহুয়া নাগ।

ফুটপাথের ধারে গোটা দুই খালি ট্যাক্সি সওয়ারির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। তারই একটায় পল্টু আর মহুয়া উঠে পড়তেই মিটার ডাউন করে ড্রাইভার স্টার্ট দিলে। কাছেই একটা অন্ধকার গাড়ি—বারান্দার তলা থেকে দ্রুত বেরিয়ে এল সার্জেন্ট দত্ত। অন্য ট্যাক্সিটাতে উঠতে উঠতে সে ড্রাইভারকে বললে, ট্যাক্সিটার পিছু নাও—জলদি!

পঞ্চাশ—ষাট গজ ব্যবধানে দু’খানা গাড়ি ছুটতে শুরু করল। ইলিয়ট রোড দিয়ে লোয়ার সার্কুলার রোড। তারপর বেকবাগানের মোড়ে এসে প্রথম ট্যাক্সিখানা থামল একটা তিনতলা বাড়ির সমুখে। মনসিজের ট্যাক্সি অল্প তফাতে একটা গাছের ছায়ান্ধকারে ব্রেক কষল।

নামল মহুয়া একা। কিন্তু তখুনি বাড়ির ভেতরে গেল না। ট্যাক্সির পাশে দাঁড়িয়ে পল্টুকে নিয়ে যেন বলতে লাগল। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই পল্টুর ট্যাক্সি হুস করে বেরিয়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে একটা কুৎসিত গাল দিলে মহুয়া।

আর, ঠিক সেই মুহূর্তে একটা প্রাইভেট ফিয়াট মহুয়ার পাশে এসে দাঁড়াল। চালকের আসন থেকে নামল অত্যন্ত বলিষ্ঠ আর অত্যন্ত শৌখিন পোশাক পরা এক ব্যক্তি। মুখে লম্বা সিগারেটের পাইপ।

মনসিজ চিনল, শহর কলকাতার ডাকসাইটে টপ মাস্তান রবি সেন ওরফে রবসন।

চাঁছা গলায় রবসন জিজ্ঞেস করলে, ট্যাক্সিতে কে? পলটে শালা বুঝি?

মহুয়া একমুখ হেসে বললে, না, না, ড্রাইভারটাকে গাল দিলাম। এসো।

দুজনে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল।

মনসিজ বাড়িটাকে ভাল করে দেখে ট্যাক্সিকে বললে, চলো। তার মনের মধ্যে তখন একটা চিন্তাই পাক খাচ্ছে। গত সোমবার রাত সাড়ে ন’টার পর মগনলাল বেরিয়েছিল মহুয়া নাগের সঙ্গে, তারপর আর তাকে জীবিত দেখা যায়নি। তবে কি মহুয়াই মগনলালকে ফাঁদে ফেলেছিল? কিন্তু তাকে খুন করল কে? পল্টু চ্যাটার্জি? না রবসন? —

 * * *