শেষ দৃশ্য

শেষ দৃশ্য

পরদিন সকালে কর্নেলের ফ্ল্যাটের দরজায় ঘণ্টা বাজল।

 ষষ্ঠীচরণ এসে বলল–কে একজন দেখা করতে এসেছেন!

কর্নেল বললেন–পাঠিয়ে দে।

একটু পরেই ভদ্রলোক ঢুকলেন। খুব উদ্বিগ্ন, ব্যস্ত আর উত্তেজিত। কর্নেল বললেন–আসুন মিঃ ভরদ্বাজ, বসুন।

–আপনি আমাকে চেনেন?

–ছবি দেখেছিলুম। বসুন দয়া করে।

অবনীবাবু বললেন।– কী ব্যাপার কর্নেল সরকার? সেলিম ট্রাঙ্ককল করল– ওদিকে বোম্বে পুলিস গতকাল স্টেটমেন্ট নিল, আমি বোম্বে থেকে রওনা হওয়ার সময় থেকে বোম্বে ফেরা অব্দি কোথায় কোথায় গেছি বা কী করেছি! হরিবল্ ব্যাপার!

–উদ্বিগ্ন হবার কোন কারণ নেই মিঃ ভরদ্বাজ।

–অদ্ভুত ব্যাপার। সেলিম খুলে কিছু বলেনি। শুধু বলল–যদি স্ক্যান্ডালের হাত থেকে বাঁচতে চান অবনীদা, এক্ষুণি কলকাতা এসে কর্নেল সরকারের সঙ্গে দেখা করুন। ও আপনার ঠিকানাও জানিয়েছিল। আমি এইমাত্র দমদম এয়ারপোর্ট থেকে সটান আপনার কাছে চলে এসেছি।

–সেলিমকে আমিই কাল বিকেলে ট্রাঙ্ককল করতে বলেছিলুম।।

 –কিন্তু ব্যাপারটা কী?

কর্নেল ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বললেন–৮ই মার্চ বিকেলে ঠিক ক’টায় আপনি ব্যারাকপুর কুঠিবাড়িতে গিয়েছিলেন?

অবনীবাবু চমকে উঠে বললেন–আমি? আমি…

–প্লিজ, গোপন করবেন না।

হা। গিয়েছিলুম। মিলি আমাকে বলেছিল ওইদিন বিকেলে ওখানে যেতে।

মিলির সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল তাহলে?

–মোটেই না। হঠাৎ বোম্বেতে ওর চিঠি পেয়েছিলুম। দীর্ঘ চিঠি। রূপেশকে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং আদ্যোপান্ত সব লিখেছিল। ও নাকি এতদিনে ভুল বুঝতে পেরেছে। তাছাড়া খুব বিপন্ন হয়ে পড়েছে। মাসের পর মাস ওকে ব্ল্যাকমেইল করছে একজন। আমি গিয়ে যেন ওকে বাঁচাই। চিঠি পেয়ে খুব মায়া হল। ইতিমধ্যে কলকাতা যাবার প্রোগ্রাম ছিল আমার। এলুম–এসে ওর কথামতো ফোন করলুম। ও একটা জায়গার নাম বলল–দক্ষিণ কলকাতার একটা রেস্তোরাঁর। সেখানে দেখা হল। খুব কান্নাকাটি করল। ওকে বাঁচাতে হবে। ওকে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে অদ্ভুতভাবে।

–রাইট, রাইট। এমন আজব ব্ল্যাকমেইলের কথা শোনা যায় না! ওকে ব্ল্যাকমেলারের স্ত্রী সেজে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। নয়তো ফেরারি আসামীকে তক্ষুণি পুলিসের হাতে তুলে দেওয়া হবে।

-আপনি তাহলে জানেন!

–আমার ধারণা তাই। আপনি এবার বলুন।

–মিলির মতে, এতে একটা সুবিধে অবশ্য তার হচ্ছে। ব্ল্যাকমেলার মিঃ গুপ্টার আশ্রয়ে থাকায় পুলিসের দিক থেকে নিশ্চিন্ত থাকছে সে। বিনিময়ে বেচারাকে দেহটা ভোগ করতে দিতে হচ্ছে। কিন্তু এ তো বরাবর মানুষ পারে না। ও একটা মুক্তি খুঁজছে। আমি ছাড়া কেউ নাকি ওকে বাঁচাতে পারে না। যাই হোক, আমি উদ্বিগ্ন হলুম। আফটার অল, অমন চেহারা শিখিয়ে-পড়িয়ে ভবিষ্যতে স্টার করার সম্ভাবনা নিশ্চয় ছিল। আমি ভাবতে থাকলুম, কী করা যায়। ও আমার হোটেলের ঠিকানা নিল। পরদিন দুপুরে–৭ই মার্চ তারিখে ফের ফোন করবে বলল। তারপর ঠিকই ফোন করল। কিন্তু হঠাৎ নাকি মিঃ গুপ্টা ওকে ব্যারাকপুর বাগানবাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। অতএব আমি যেন ৮ই মার্চ বিকেলে ওখানে চুপি চুপি গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করি। মিঃ গুপ্টা ওসময় কলকাতায় থাকবে। মিলি জানে, গুপ্টাকে নাকি ওইদিন বিকেলে কলকাতায় থাকতেই হবে।

–আপনি তাহলে কথামতো গেলেন?

–হ্যাঁ। কিন্তু গেটের কাছে ট্যাকসি থেকে নামতেই দেখি এদিকের বারান্দায় একটি ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মিলি আমাকে উত্তর দিক ঘুরে যেতে বলেছিল। কঠোরভাবে নিষেধ করেছিল যে, যেন কেউ আমাকে না দেখতে পায়। কারণ, মিলির কাছে কে আসে–গুপ্টা তার কড়া খবর রাখতে অভ্যস্ত। সে জানতে পারলে মিলিকে মারধর করবে। অতএব উত্তর দিক ঘুরে ভাঙা পাঁচিল গলিয়ে ঢুকলুম। ঢুকে দরজায় কড়া নাড়লুম। কোন সাড়া পেলুম না। ঠেলতেই দরজা ফাঁক হল। তখন ঢুকে ওর নাম ধরে ডাকলুম। কানের ভুল হতেও পারে আবছা শব্দে মনে হল, ও আসছে। তখন নিশ্চিন্ত হয়ে বসার ঘরের সোফায় বসলুম। বসে আছি তো আছিই। তখন অবাক লাগল। হঠাৎ দেখি কে একজন সাঁৎ করে ঘর দিয়ে বেরিয়ে গেল। চেনা মনে হল। ওই ঘরটায় দেখেছেন নিশ্চয়, একেবারে আলো থাকে না দিনদুপুরেও। কিন্তু যেমনি ও বাইরের দরজার পর্দা তুলল, চিনলুম। তখন অজানা ভয়ে বুক কেঁপে উঠল। এ যে মিঃ গুপ্টার সেই জুটি! তখন বেডরুমে গিয়ে উঁকি দিলুম। তারপর যা দেখলুম, আমার দম বন্ধ হয়ে গেল।….

কিন্তু জুতো খুলে রেখে কেন?

–পায়ে হাল্কা স্লিপার ছিল। পা তুলেই বসেছিলুম। সেই অবস্থায় ব্যস্ত হয়ে উঠে গেছি।

–প্লিজ, গোপন করবেন না।

একটু ইতস্তত করে অবনীবাবু বললেন–মানে, আমার সাবকনসাস মনে হয়ত ধারণা হয়েছিল যে কোন ফাঁদে পড়ে গেছি। নির্ঘাৎ মিলিকে ব্যাটা খুন করেছে! জাস্ট ইনটুইশান! এ অবস্থায় আমার সতর্ক হওয়া দরকার মনে হয়েছিল।

 –আপনি বুদ্ধিমান, মিঃ ভরদ্বাজ। যাই হোক, গিয়ে দেখলেন দুটি মৃতদেহ পড়ে রয়েছে।

–হ্যাঁ। সে এক বীভৎস দৃশ্য! আমি জুতো আর পায়ে দিলুম না–পাছে জুতোর ছাপ পড়ে। অমনি বেরিয়ে সেই পাঁচিল ডিঙিয়ে পালালুম।

–আপনি কিন্তু ওই ঘরে বসে একটি সিগারেট খেয়েছিলেন।

–হ্যাঁ।

–দেখুন মিঃ ভরদ্বাজ, খুনীকে আপনি ছাড়াও আরো দু’জন দেখেছিল। তার আসার সময় দেখেছিল, যাবার সময় কিন্তু দেখতে পায়নি আর। কারণ, সে পালিয়েছিল সেই ভাঙা পাঁচিলের পথে। তার কাছে একটা গ্লাস ছিল আপনি দেখেননি নিশ্চয়?

–না। লক্ষ্য করিনি। কেন, গ্লাস কেন?

–পরে বলব’খন। গ্লাসটা কাল বিকেলে ফরেনসিক এক্সপার্টরা ভাঙা পাঁচিলের ইটের তলায় আবিষ্কার করেছে। আমি কাল সন্ধ্যায় আবার ওখানে গিয়েছিলুম। অবশ্য ছুরিটা পাইনি।

–কিন্তু আর কারা দেখেছিল ব্যাটাকে?

বাহাদুর দারোয়ান আর তার বউ। বাহাদুর তো বউকে ভীষণ ভয় করে। ওর বউ চেপে গিয়েছিল–পাছে পুলিসের হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়ে। কাল চাপে পড়ে বাহাদুরের বউ সব কবুল করেছে।

–কিন্তু কর্নেল সরকার, এখনও আমি বুঝতে পারছি না, কেন কুমারমঙ্গলম খুন করল গুপ্টা আর মিলিকে?

এ ব্যাপারটাকে বলব এ সার্কেল অফ ব্ল্যাকমেলিং! একটা বৃত্তের মতো। গুপ্টা ব্ল্যাকমেইল শুধু মিলিকেই করত না, কুমারমঙ্গলমকেও করত। কারণ রিভলভারটার মালিক ছিল কুমারমঙ্গলম। অস্ত্রটা মিলি স্যুটিংয়ের জায়গাতেই ফেলে রেখে আসে–তা আপনি নিশ্চয় জানেন! রীতিমতো লাইসেন্স ছিল কুমারমঙ্গলমের নামে। তাই তাকেও ফেরার হতে হয়। ঘুঘু প্রকাশ গুপ্টা কীভাবে জানতে পারে যে লোকটা কলকাতায় রয়েছে। সম্ভবত মিলি কুমারমঙ্গলমের সঙ্গে যোগাযোগ। রাখত।’সে রহস্য অবশ্য এখন আর জানা কঠিন। যদি কুমারমঙ্গলম কবুল করে, তবে অন্য কথা।

এইসময় ফোনে রিঙ বাজল। কর্নেল রিসিভার তুলে বললেন–হ্যালো, এন. এস. কথা বলছি।

কর্নেল! সত্যেন্দ্র বলছি। গুড নিউজ।

–পাখি ধরেছ?

–হ্যাঁ। চলে আসুন কর্নেল।

–অবশ্যই।

.

মিঃ কুমারমঙ্গলমকে তখন বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের বাড়ি থেকে লালবাজারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাহাদুর, তার বউ, অবনী ভরদ্বাজ–তিনজনেই সনাক্ত করেছে। আনন্দও একসময় এসে সনাক্ত করল। হা-এর কাছ থেকেই প্যাকেট নিয়ে যেত সে।

প্যাকেটে থাকত টাকা। কুমারমঙ্গলম কলকাতায় এসে চোরা নার্কোটিকসের ব্যবসা ধরেছিল। বেশ কামাচ্ছিল। কিন্তু মনে শান্তি ছিল না। প্রকাশ গুপ্টার চোখকে সে ফাঁকি দিতে পারেনি।

এমন ঢালাও অবাধ চোরাকারবারের জায়গা তো আর কোথাও নেই। টাকার লোভে কুমারমঙ্গলম চলে যেতে পারছিল না। অতএব ঠিক করল যে গুপ্টাকে, সরাতে হবে। তাই সে মিলির সঙ্গে যোগাযোগ করল। মিলি গুপ্টাকে অনেক আগেই জানে মেরে দিতে পারত। সাহস পাচ্ছিল না। এবার দোসর জুটে সাহস পেল। কিন্তু ক্যামাক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে কাজটা করার চেয়ে কোন নির্জন জায়গা সে খুঁজল। দানিয়েল কুঠি কিনতে চেয়েছিল গুপ্টা নিজে বড় বউয়ের দৃষ্টির আড়াল হবার জন্যে। মিলি প্ল্যানটা কাজে লাগাল। তবে গুপ্টা তড়িঘড়ি বাগানবাড়িতে চলে যাবার কারণ অবনী ভরদ্বাজের আবির্ভাব। মিলির ফোনে ট্যাপ ছিল। গুপ্টা সব টের পেয়েছিল তাই।

পটাসিয়াম সাইনায়েড কুমারমঙ্গলম দিয়েছিল মিলিকে। গুপ্টার সেদিন টাকা আনতে যাবার কথা ওর কাছে। কিন্তু মনে সন্দেহ। তাই থেকে গেল সেদিনটা। নড়ল না। মিলি ওকে আদর করে মদ দিল। গুপ্টা কিন্তু এদিকটা ভাবেনি কখনও। মদে চুমুক দিয়েই পড়ে গেল। মিলি তখন ছটফট করছে। পালাতে হবে। কুমারমঙ্গলমের অপেক্ষা করছে সে। অবশেষে কুমারমঙ্গলম এল। লাশের কাছে দাঁড়িয়ে কিন্তু হঠাৎ ভয় হয়ে গেল তার।

কর্নেল বর্ণনা করছিলেন কেসটা। এবার থামলেন একটু। তারপর বলেন, এটা অদ্ভুত হিউম্যান সাইকলজি। কুমারমঙ্গলম কোনদিন মহিলাদের প্রতি আসক্ত ছিল না। একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল টাকা গুপ্টার লাশের কাছে দাঁড়িয়ে হঠাৎ তার প্রচণ্ড ভয় হল মিলিকে। এই যুবতী সুন্দরী মেয়েটি টাকার লোভে একদিন নির্দোষ নিরীহ একটি ছেলেকে গুলি করতে পেরেছিল। এবার অক্লেশে গুপ্টাকেও বিষ দিয়ে মারতে পারল। এপর যদি কেউ ওকে কুমারমঙ্গলমকে খুন করতে বলে–সে চোখ বুজে তাই করবে–একটুও হাত কাঁপবে না। অতএব সে তীব্র ঘৃণায় উত্তেজিত হয়ে পড়ল। এ একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত মাত্র। এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল ওর পক্ষে। ও সুযোগ খুঁজল। মিলির হাতে তখনও মদের গ্লাস। মিলি নির্বিকার। ওর মতো ঠাণ্ডা নির্বিকার মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। ও হাসতে হাসতে বলল– এবার তুমি মনের আনন্দে ফিল্ম করতে পারবে। অবনী ভরদ্বাজকে আমি. আসতে বলেছি এখানে। ও আসুক। ও খুব প্রভাবশালী লোক। পুলিশকে ম্যানেজ করে দেবে। তারপর আমরা ফিল্ম প্রডিউস করব। তোমার তো অনেক টাকা এখন।

কুমারমঙ্গলম অমনি ভড়কে গেল আরও। নাঃ, এক্ষুণি পালাতে হবে এই ডাইনীর হাত থেকে। কিন্তু পালানোর আগে তাকে শেষ করে যেতে হবে। সঙ্গে ছোরা ছিল। কিন্তু এ কাজে সে আনাড়ি। সে নার্ভও নেই। তখন ও চালাকি করল।–মিলি, আমার মনে হচ্ছে, কে যেন এসেছে বা আসছে। পায়ের শব্দ পেলুম। দেখে এস তো, মিঃ ভরদ্বাজ এলেন নাকি? মিলি ব্যস্ত হয়ে অপেক্ষা করছিল। বেরিয়ে গেল তক্ষুণি।

মদের গ্লাসটা রেখে গিয়েছিল মিলি। ছোরা মারার চেয়ে বিষ প্রয়োগ নিরাপদ নিঝাট। কুমারমঙ্গলমের পকেটে পটাসিয়াম সাইনায়েডের পুরিয়ে ছিল–যা থেকে খানিকটা সে গুপ্টাকে আগে দিয়েছিল।

ব্যস, মিলি ফিরে এসে ‘কেউ আসেনি’ বলল এবং নির্ধিধায় নিজের গ্লাসে চুমুক দিল। বিছানাতে ঢলে পড়ল। বিছানাতে পা ঝুলিয়ে বসে চুমুক দিয়েছিল সে। তারপর….

তারপর কুমারমঙ্গলম ভাবল, সে এবার মুক্ত। কিন্তু পাপী নিজের অলক্ষ্যে ফাঁদে গিয়ে পড়ে এবং ধরা দেয়।…..

কর্নেল চুপ করলেন। চুরুট ধরালেন। তারপর সত্যেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন–চলি, সত্যেন্দ্র।

আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার রাস্তায় নামলেন। আকাশ দেখলেন। চমৎকার আজ মার্চের সকালবেলাটা। আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকলেন। এখন কিছুক্ষণ হাঁটতেই ভাল লাগবে।…