শেষ চিৎকার – ১১

এগারো

মেঝেতে চোখ রেখে মাথা নিচু করে ছুটছে মুসা। ভয়ে, উত্তেজনায় ধড়ফড় করছে বুক। অজানা আশঙ্কায় কপালে চিকন ঘাম দেখা দিয়েছে।

ডানে তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে টানেল। তারপর একটু একটু করে উঠে গেছে ওপর দিকে। বাতাস গরম এখানে, বোটকা দুর্গন্ধযুক্ত। অক্সিজেনের পরিমাণ কম। অল্প কয়েক পা যেতে না যেতে হাঁপ ধরে গেল মুসার, জোরে জোরে দম নিতে হচ্ছে।

‘মামা!’ ডেকে উঠল ও। ‘মদিনা!’

মামা নিশ্চয়ই টানেলের সামনের বাঁকের ওপাশে, তাই ডাক শুনতে পাচ্ছেন না। মুসা নিজেকে বোঝাল। তা-ই হবে। জুতোর ফিতে বাঁধতে তেমন একটা সময় লাগেনি, কাজেই এর মধ্যে বেশি দূরে চলে যাওয়ার কথা নয়।

একটা শব্দ। শুনে থেমে পড়ল মুসা। কান পাতল। না, কোনও আওয়াজ নেই এখন।

তবে কী ও ভুল শুনেছে? মদিনা ওকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে না তো? সামনের বাঁকে লুকিয়ে মজা দেখছে?

হতে পারে। মদিনাকে চেনে মুসা, সুযোগ পেলে কৌতুক করতে ছাড়ে না। বিশেষ করে মুসার বেলায়। রসিকতা করে, ভয় দেখায়, তারপর নিজে নিজে হেসে অস্থির হয়ে যায়। মজা পায় ও এসব করে।

তাই হবে, আপনমনে মাথা দোলাল ও। আবার পা বাড়াল মুসা। জগিঙের মত দৌড়ে চলেছে। এক হাতে কোমরে ঝোলানো বীপারটা স্পর্শ করল।

সুইচ টিপে দেবে নাকি?

না, এখনই না। আরেকটু দেরি করে দেখা যাক।

মুসা বাঁক ঘুরল। সামনের পথ খুব সরু। দেয়াল চেপে এসেছে দু’দিক থেকে, সিলিঙও বেশ নিচু।

‘মামা!’ ডাকল ও। ‘মদিনা!’

জবাব নেই। টানেল অপ্রশস্ত বলে ডাকের প্রতিধ্বনিও উঠল না। মেঝেতে ধুলোবালি কম এখানে। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় দেয়ালের গ্র্যানেট পাথরের গায়ে সরু-চওড়া অনেক ফাটল দেখা যাচ্ছে। আঁকাবাঁকা ফাটল। আকাশে মেঘ করলে বিদ্যুৎ যেমন এঁকেবেঁকে চমকায়, ঠিক সেরকম দেখতে।

‘মামা! কোথায় আপনারা?’ গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল মুসা।

দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে টানেলটা ভাগ হয়ে দু’দিকে চলে গেছে। এখন কী হবে? কোনদিকে যাবে?

এবার সত্যি সত্যি ভয় পেল ও।

কোথায় মামা? মদিনা? ও যে সঙ্গে নেই, এখনও তা খেয়াল করেনি কেউ?

দুই মুখওয়ালা টানেলের দিকে তাকিয়ে থাকল ও। আলো ফেলে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করল।

কোনটায় ঢুকবে ও? হৃৎপিণ্ড ছট্‌ফট্ করছে বুকের মধ্যে।

কোনটায়?

বাঁ দিকেরটায় ঢুকে কয়েক পা এগোল ও। থেমে ডাকল জোরে।

সাড়া নেই।

দ্রুত পিছিয়ে এসে অন্য টানেলে ঢুকল। এটা একটু চওড়া। ছাদও উঁচু। মামাকে ডাকল ও, কেউ সাড়া দিল না।

নীচে টানেলের গোলকধাঁধা আছে, মামা ওদের সতর্ক করেছিলেন। শত শত টানেল। হয়তো বা হাজার হাজার।

সেই গোলক-ধাঁধায় পড়েছে ও? কীভাবে রেহাই মিলবে?

হাঁটো, নিজেকে নির্দেশ দিল মুসা। হাঁটতে থাকো।

মামা নিশ্চয়ই সামনে কোথাও আছেন। থাকতেই হবে। যাও, খুঁজে বের করো তাঁকে।

পা চালাল ও। আট-দশ পা এগিয়ে ডাকল।

জবাব এল না।

তবে অন্যরকম শব্দ উঠল

কী?

মুসা চট্ করে থামল। না, আর কোনও আওয়াজ নেই। একদম শান্ত, নীরব। নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক্ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। ভুল শুনেছে। যেই পা তুলতে গেল, অমনি উঠল আওয়াজটা।

দম বন্ধ করে কান পাতল ও।

হ্যাঁ, শোনা যাচ্ছে।

এক ধরনের মৃদু, ঘড়ঘড়-কড়কড় শব্দ। এ শব্দ মানুষের সৃষ্টি হতে পারে না। অন্য কিছুর। হয়তো পোকামাকড়ের। অথবা ইঁদুরের।

‘মামা! মদিনা!!’ নীরবতা।

মুসা সাহসে ভর করে আরও কয়েক পা এগোল। কান খরগোশের মত খাড়া করে শুনল আর কোনও আওয়াজ ওঠে কী না। না।

এবার বীপারের সুইচ টিপে দেয়া উচিত, ভাবল ও। দেরি করা ঠিক হচ্ছে না। অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।

সেই ভাল। বীপার টিপে দিলে কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে মামা এসে উদ্ধার করবেন। হাত বাড়াল ও যন্ত্রটার দিকে, পরক্ষণে জমে গেল খুব কাছেই জোর এক আওয়াজ উঠতে।

কাঠ বা দেয়াল ফাটার সময় এ ধরনের আওয়াজ হয়। চড়চড়! চড়চড়!

ঘাড়ের খাটো চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেল মুসার। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। টানেলের দেয়াল ফেটে যাচ্ছে? ধসে পড়বে ওর মাথার ওপর?

আওয়াজটা ক্রমেই বাড়ছে।

বাড়ছে, আরও বাড়ছে!

শব্দটা ঠিক মুসার পায়ের কাছে হচ্ছে। ভয়ে ভয়ে নীচের দিকে আলো ধরল ও। ব্যাপারটা দেখল ঠিকই, কিন্তু কী ঘটছে, বুঝতে কিছু সময় লাগল।

মেঝে ফেটে যাচ্ছে!

পিরামিডের পেটের ভিতরের সুপ্রাচীন টানেল-ফ্লোরে অসংখ্য চিড় ধরেছে। মাকড়সার জালের মত। মুসার চারদিকে চড়চড় শব্দে ফেটে যাচ্ছে। খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে ফাটলগুলো।

চড়চড়ে আওয়াজ ক্রমেই বাড়ছে।

বিপদ যখন টের পেল মুসা, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সতর্ক হওয়ার সময় পেল না।

পায়ের নীচের মেঝে নড়ে উঠল অলস পাইথনের মত, আড়মোড়া ভাঙল। পরমুহূর্তে অদৃশ্য এক শক্তি মুসার পা ধরে নীচের দিকে হ্যাঁচকা টান দিল। ফাঁক হয়ে গেল মেঝে।

পড়ছে মুসা।

পড়ছে আরও! আরও!

কালিগোলা কালো এক গহ্বর গ্রাস করছে ওকে।

হারিয়ে যাচ্ছে ও অতলে।

ভয়ে, আতঙ্কে চিৎকার করার জন্যে মুখ খুলল, কিন্তু ওই পর্যন্তই, গলা দিয়ে বিন্দুমাত্র আওয়াজ বেরল না।

মুসা মরিয়া হয়ে হাত ছুঁড়ে কিছু একটা ধরতে চাইল, কিন্তু পতন ঠেকাতে পারল না।

পাতালপুরীতে ওকে রক্ষা করার মত কোনও অবলম্বন নেই।

আপনাআপনি বুজে গেল মুসার দু’চোখ।

বারো

প্রথমে ফ্ল্যাশলাইটটা পড়ল ঠক্‌ঠক্ আওয়াজ তুলে। পরক্ষণে শক্ত মেঝেতে ধড়াস করে আছড়ে পড়ল মুসা।

কাত হয়ে পড়ল ও। প্রচণ্ড ব্যথায় চোখে পানি এসে গেল। সারা দেহে তীব্র যন্ত্রণার ঢেউ বইল। চোখের সামনে উজ্জ্বল লাল রঙের আলো দেখতে পেল, ক্রমেই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে। মনে হচ্ছে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে বুঝি।

ভয়ে চোখ বুজল মুসা। কিছু সময় পর মেলল, নেই আলোটা, অদৃশ্য হয়ে গেছে। ওটা তা হলে আছড়ে পড়ার ফল, ভাবল ও। মেঝের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে ঘটেছে।

মুসা বাঁ হাত ঝাড়া দিল। নাড়তে অসুবিধে হচ্ছে না, তার মানে হাড়গোড় ভাঙেনি। আরও জোরে জোরে ঝাড়া দিল। চোখের সামনের হলদে-ধূসর পর্দাটা একটু একটু করে সরে গেল।

কোথায় আমি? ভাবল ও।

বোটকা গন্ধে নাক কুঁচকে উঠল। পুরানো, বদ্ধ বাতাসের গন্ধ। প্রাচীন ধুলোবালির গন্ধ। মৃত্যুর গন্ধ।

ঘুরল ও। আছড়ে পড়া সত্ত্বেও কোনও ক্ষতি হয়নি লাইটের, মেঝেতে পড়ে এখনও জ্বলছে। আলোর মুখ দেয়ালের দিকে। সেদিকে তাকাল ও।

পরক্ষণে হৃৎপিণ্ড লাফ দিল।

একটা হাত দেখা যাচ্ছে সে আলোয়।

মানুষের হাত!

হাতটা একটা বাহুর যুক্ত, বাহুর গোড়া একটা দেহের সঙ্গে। দাঁড়িয়ে আছে দেহটা। মাত্র কয়েক হাত দূরে!

পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠল মুসার। অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। কাঁপা হাতে আলোটা তুলে নিল ও, মুখ লক্ষ্য করে ধরল।

একটা মমি!

চোখহীন অক্ষি-কোটর ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। ওপরের চামড়াবিহীন মাঢ়িসহ দাঁত! লাশটা মুসাকে ভেঙাচ্ছে যেন!

ব্যাণ্ডেজ ফাঁক হয়ে আছে। মমিটার নাক একটা কালো গর্ত। ওদিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল মুসা।

কী ভয়ঙ্কর!

দেখে মনে হচ্ছে মমিটা ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে!

তেরো

ওটার ওপর থেকে আলো সরাতে সাহস হলো না মুসার। হাত কাঁপছে থরথর করে, আলো স্থির রাখতে কষ্ট হচ্ছে, তবু ধরেই থাকল।

পা দুটো যেন কেউ পেরেক দিয়ে গেঁথে দিয়েছে ওর, নড়তে পারছে না। ভীতিকর দেহটার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল ও কোঁৎ করে। খেয়াল হলো সশব্দে হাঁপাচ্ছে।

সব ভুলে ও গোমড়ামুখো মমিটার দিকে তাকিয়ে থাকল। ওটা কখন ঘাড়ে লাফ দেয়, কে জানে!

মুসা নিজেকে শান্ত, স্থির রাখার চেষ্টা করল। বুক ভরে বোটকা বাতাস টেনে নিয়ে দম বন্ধ করে রাখল।

মমির কালো অক্ষিকোটরের দিকে তাকাল। দম ছাড়ার ফাঁকে ভাবল, ওটা এখানে কেন? কফিন কোথায় ওটার? কেন দাঁড়িয়ে আছে? আক্রমণই বা করছে না কেন?

মামার কাছে শুনেছে প্রাচীন মিশরীয়রা পিরামিডে কখনও কফিন ছাড়া মমি স্থাপন করেনি, তা হলে?

যখন বোঝা গেল মমির কোনও বদ মতলব নেই, তখন একটু আশ্বস্ত হলো ও।

শান্ত হও, মুসা,’ শব্দ করে নিজেকে শোনাল। ভয়ের কিছু নেই! ওটা মমি, ভূত-প্রেত না! হাজার বছর আগের মৃত মানুষের কাঠ হয়ে যাওয়া হাড়গোড়। আর কিছু না।’

কেশে উঠল ও। বাজে গন্ধ বাতাসে। খুব বাজে।

ব্যথায় গোঙাতে গোঙাতে আলো এদিক-ওদিক ঘোরাল। প্রকাণ্ড এক কক্ষ। সিলিঙ অনেক উঁচু। মামা যে কক্ষে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করছেন, এ কক্ষ তার পাঁচগুণ বড়।

কক্ষটা খালি না। ভিতরে অনেক কিছু আছে। এবং ব্যাপারটা টের পেয়ে ফের ঘাবড়ে গেল।

একটা না, অসংখ্য মমি চার দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকগুলো। অগুনতি।

কাঁপা হাতে ধরা আলোয় দেয়ালে ওগুলোর বিকট ছায়া। কাঁপছে সব। ডানে বাঁয়ে দুলছে যেন।

মুসা শিউরে উঠল, অজান্তেই দু’পা পিছিয়ে গেল। রুমের চারদিকে আলো ঘোরাল।

এরমধ্যে ফ্ল্যাশলাইটের আলোর জোর কমে এসেছে। তীব্র নীলচে- সাদা আলো হলদেটে হয়ে গেছে।

হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে নিভে যাবে। তখন কী হবে? ভাবতে গিয়ে আবার আপাদমস্তক কেঁপে উঠল মুসা।

নিঝুম মৃত্যুপুরীর চারদিকে আলো বোলাল ও। মমিগুলো একেকটা একেক ভঙ্গিতে আছে। কোনওটা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, কোনওটা পাথরের প্যাডের ওপর বুকে হাত বেঁধে শুয়ে, কোনওটা ঝুঁকে বসে, হাঁটু গেড়ে-নানান ভঙ্গিতে। কোনও কোনওটার দু’হাত ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মত সামনে বাড়ানো। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলৈ গায়ের মধ্যে শিরশির করে।

মুসা একদিকের দেয়াল-ঘেঁষা কফিন দেখল। অনেক। ওগুলোর ঢাকনা খোলা। ওর পেছনে বড় একটা টেবিল, তার পাশে যন্ত্রপাতি রাখার একটা শেলফ। ওটায় অদ্ভুত সব লম্বা হাতলওয়ালা যন্ত্রপাতি আছে। আগে এসব কখনও দেখেনি মুসা।

আর আছে কাপড়ের রোল, দৈত্যাকার একেকটা চিনামাটির পাত্র, কাঁচের বয়েম ইত্যাদি। কাপড়গুলা পাতলা, ব্যাণ্ডেজের মত।

এসব এখানে কেন?

অস্বস্তি লেগে উঠল মুসার। নাকে বিশেষ এক গন্ধ এসে ঝাপটা লাগল। নানা ধরনের কেমিক্যালের মিলিত গন্ধ।

অদ্ভুত এক অনুভূতি ছেঁকে ধরল ওকে। কয়েকবার লম্বা করে দম টানল। ভেবেছিল বিশেষ গন্ধটা আসলে সত্যি পায়নি ও, নিজের কল্পনা। কিন্তু দেখা গেল ওর নাক ভুল করেনি, গন্ধটা সত্যিই আছে। ওষুধ ওষুধ গন্ধ।

পায়ে পায়ে শেলফের দিকে এগোল ও। আলো ফেলে কাপড়ের রোলগুলো ভাল করে দেখল। লিনেন! হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে!

প্রাচীন মিশরীয়রা এই কাপড় দিয়ে মমি মুড়ে সংরক্ষণ করত। গভীর সন্দেহের চোখে যন্ত্রপাতিগুলো দেখল ও। ছুরি, লম্বা হাতলওয়ালা স্টীলের সরু কী যেন একটা, আর চামচ। দীর্ঘ হাতল। সব ঝকঝকে পরিষ্কার। ফ্ল্যাশ লাইটের আলোয় চিকচিক করছে।

চোখ একটু একটু করে বিস্ফারিত হয়ে উঠল মুসার। এসবের মধ্যে কিছু একটা চোখে পড়েছে, যার সঙ্গে ওর জানা কীসের যেন মিল আছে, অথচ ধরতে পারছে না।

কী সেটা?

একটু পর জিনিসটার ওপর আপনাআপনি স্থির হলো ফ্ল্যাশলাইট। ভয়ে ঘাড়ের খাটো চুল তো বটেই, দেহের প্রতিটি পশম পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেল ওর।

চামচ!

এই সেই চামচ, যা দিয়ে নাকের ফুটো দিয়ে মগজ বের করা হত। আর ওই লম্বা কাঠিটা সেই জিনিস, যা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মগজ গলিয়ে ফেলত।

এসব এখানে কেন? অতীতে কি এই কামরায় মমি তৈরি করা হত? এসব যন্ত্রপাতি সে-জন্যেই পড়ে আছে?

এগুলো প্রাচীন আমলে ব্যবহার হত? তা হলে সব এত ঝক্‌ঝকে কেন? পুরানো হলে তো কবে মরচে ধরার কথা। পড়েনি কেন?

মুসা পিছিয়ে এল। মাথার মধ্যে আবোল তাবোল চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। চোখ বড় করে জিনিসগুলো দেখছে। অস্বস্তিকর অনুভূতি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল একটু পর। অনড় মমিগুলোকে দেখল আলো ফেলে।

কক্ষের ঠিক মাঝখানে কালোমত চৌকো কী একটা দেখতে পেল। সেদিকে পা বাড়াল ও। একজোড়া মমি। বুকে হাত বেঁধে পাশাপাশি শুয়ে আছে। তাদের চৌকো বিছানাটা কালো। মেঝে থেকে সামান্য নিচু।

কীসের ওপর শুয়ে আছে ওরা?

কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল। হ্যাঁ, কালো কী যেন আছে মেঝেতে। নরম, আঠাল। দেখতে আলকাতরার মত।

এটা সেই টার পিট, বুঝল মুসা, রবিনের বইয়ে এর কথা পড়েছে ও। মিশরীয়রা এধরনের আলকাতরার বিছানায় শুইয়ে মমি তৈরি করত।

আরেকটা ধাক্কা খেল মুসা। চার হাজার বছরের পুরানো আলকাতরা আজও নরম থাকে কী করে?

এই কক্ষ, ভিতরের সব যন্ত্রপাতি, লিনেন, পিট, সব এত তাজা মনে হচ্ছে কেন? মমি বাদে আর কিছুতে পুরানো ভাব নেই! কেন? কেন?

মুসা বুঝল আজ ও ভাগ্যক্রমে হোক, বা দুর্ভাগ্যক্রমে, একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করে বসেছে। প্রাচীন মিশরীয়দের গোপন কর্মক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছে, যেখানে এককালে মমি তৈরি করা হত।

তবে, বুঝতে পারল না যন্ত্রপাতি সব এত নতুন দেখাচ্ছে কেন।

আগের সেই বোটকা গন্ধ আবার নাকে ঝাপটা মারল। মুসা দম বন্ধ করে রাখল। নইলে বমি হয়ে যেতে পারে। বুঝল, গন্ধটা আসছে মমির গা থেকে। এতদিন গন্ধটা বন্ধ কক্ষে আটকা ছিল, এখন ওপরের বাতাস পেয়ে নড়তে শুরু করেছে।

যথেষ্ট হয়েছে, মুসা ভাবল। এবার বীপারের বোতাম টিপতে হয়। এতক্ষণে মামা ওপরে ওকে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ওর অবস্থান তাঁকে জানাতে হবে।

এখানে এনে তাঁকে দেখাবে, ও কী আবিষ্কার করেছে। কোমরের বেল্ট থেকে টান দিয়ে বীপারটা তুলে নিল, খুদে যন্ত্রটা আলোর সামনে ধরল। মাঝখানে লাল রঙের একটা বোতাম, ওটা টিপে দিলেই জিনিসটা মামার রিসিভারে সঙ্কেত পাঠাবে। ব্যস, তিনি ছুটে চলে আসবেন।

মুখ নামিয়ে যন্ত্রটা দেখল মুসা, পরমুহূর্তে আঁতকে উঠল। নষ্ট হয়ে গেছে ওটা, চুরমার হয়ে গেছে বোতাম।

জিনিসটা জায়গামত নেই। ওখানটায় ছোট্ট গোল একটা ছিদ্র দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই আছড়ে পড়ার সময়…

আহাম্মকের মত ওটার দিকে তাকিয়ে থাকল মুসা। বীপার আর কোনও কাজে আসবে না।

স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল মুসা। প্রাচীন মমিগুলোর মত শক্ত, কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও।

নিজের পরিণতি কল্পনা করে ঘামছে।

চোদ্দ

একা।

সম্পূর্ণ একা।

কাঁপতে শুরু করল মুসা। ওর হাতের কাঁপুনির সঙ্গে ফ্ল্যাশ লাইটের হলুদ আলোর বীমটাও কাঁপছে।

হঠাৎ করে মনে হলো, চারদিকের সবকিছু যেন একটু একটু করে চেপে আসছে ওর দিকে। দেয়াল, সিলিঙ, অন্ধকার।

মমি।

মমি! সভয়ে এক পা পিছাল মুসা। তারপর আরেক পা।

এত জোরে মুঠোয় চেপে ধরেছে লাইটটা যে হাত ব্যথা করছে। ব্যাপার টের পেয়ে খানিকটা মুঠো আলগা করল ও।

ডানে-বাঁয়ে আলো বোলাল। না, ভুল। নড়ছে না মমি। যে-যার জায়গায় নীরবে দাঁড়িয়ে আছে।

তবু আরেক পা পিছাল। বোটকা দুর্গন্ধটা ক্রমে বাড়ছে। বাধ্য হয়ে দম বন্ধ করে রাখল ও। কিন্তু লাভ হলো না তাতে। বাজে গন্ধটা ঢুকে পড়েছে ওর নাকে, মুখের মধ্যে। চার হাজার বছরের প্রাচীন মৃত্যুর গন্ধ।

মুসা হাতের নষ্ট বীপারটা ছুঁড়ে ফেলে দিল, আরও এক পা পিছিয়ে গেল। মুখের মধ্যে কেমন যেন লাগছে। বাজে গন্ধ ভিতরে ঢুকেছে। খাইছে! কী বিচ্ছিরি!

‘ওয়াক থু!’

আলো ফেলে মমিগুলো দেখল। কী করবে এখন? কী করে উদ্ধার পাবে? কী করে মামাকে জানাবে ও এখানে?

মনস্থির করল মুসা। হাঁক ছাড়ল, ‘বাঁ-চাঁ-আ-ও!’

যত জোরে চেঁচাল, আওয়াজ তত জোরে হলো না। বরং অনেক ক্ষীণ, চাপা শোনাল।

‘কে আছ?’ আবার চেঁচিয়ে উঠল ও। ‘মা-মা-আ-আ!’ এবার একটু জোর হলো।

ফ্ল্যাশ লাইট বগলের তলায় চেপে ধরে দু’হাত মুখের সামনে জড় করে নতুন উদ্যমে হাঁক ছাড়ল। একসময় কাঁপতে কাঁপতে তার রেশ মিলিয়ে গেল, কিন্তু জবাব এল না।

তবু কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকল মুসা।

কোথায় মামা? কোথায় মদিনা? ওর ডাক শুনতে পাচ্ছে না কেউ। ওর খোঁজে কেন কেউ আসছে না!

‘বাঁচাও!!’

গলার সব শক্তি এক করে চেঁচাল। প্রতিবার হাঁক দিয়ে একটু বিরতি দেয় জবাবের আশায়। তারপর আবার ডেকে ওঠে। কিন্তু সাড়া আসে না।

নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না মুসা। ভিতরের আতঙ্কের কাঁপুনি ক্রমেই বাড়ছে। যেন বরফের শক্ত একটা মুঠো ওর হৃৎপিণ্ড চেপে ধরেছে, দম নিতে কষ্ট হচ্ছে।

হাত-পা জমে আসছে। আতঙ্কের শীতল ধারা মেরুদণ্ড বেয়ে ওঠানামা করছে। প্রায় পঙ্গু করে তুলেছে ওকে।

‘বাঁচাও! মামা-আ! মদিনা-আ!!’

আরও এক পা পিছিয়ে গেল মুসা, তখন ঠিক পায়ের তলায় মুড়মুড় করে কী যেন ভাঙল। আঁতকে উঠে সামনে লাফ দিল ও।

টের পেল, জিনিসটা যা-ই হোক, মেঝেতে ঘষা খেয়ে দূরে সরে যাচ্ছে।

আশ্বস্ত হতে যাচ্ছিল মুসা, কিন্তু পায়ে কী যেন ঘষা খেল। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল ও, হাত থেকে আলোটা পড়ে গেল। চুরমার হয়ে গেল কাঁচ। আলো নিভে গেল।

নিকষ অন্ধকারে চাপা পড়ে গেল সব।

ওর গায়ে আবারও একটা কিছু নিঃশব্দে ঘষা খেল।

শক্ত কিছু।

মেঝেতে মৃদু, খড়মড় আওয়াজ শুনতে পেল মুসা, পরক্ষণে কী যেন কুট্ করে কামড় বসিয়ে দিল পায়ে।

ও অদৃশ্য শত্রুর অবস্থান লক্ষ্য করে পা ছুঁড়ল। কিছুই বাধল না পায়ে, শূন্যে একটা পাক খেয়ে ফিরে এল ওটা।

দেখতে না পেলেও স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে মুসা, কী সব যেন নড়ছে ওর চারপাশে। পোকা-মাকড়! সাপ!

‘বাঁ-চা-আ-আ-ও!’

আবারও কিছু একটা চাপড় মারল পায়ে। উন্মত্তের মত লাথি চালাল ও। একই ফল হলো। পা কোথাও বাধল না।

ঝুঁকে বসে ব্যস্ত-এস্ত হাতে ফ্ল্যাশ লাইটটা খুঁজল ও। পাওয়া গেল না জিনিসটা। তার বদলে একটা শক্ত, গরম কিছু হাতে ঠেকল। মহাআতঙ্কে বিকট এক চিৎকার ছেড়ে হাত তুলে নিল।

বুঝে ফেলেছে, ওগুলো যা-ই হোক, পিঁপড়ের মত ছেঁকে ধরেছে ওকে। কক্ষের মেঝে জ্যান্ত হয়ে উঠেছে, ঢেউয়ের মত উঠছে আর নামছে। প্রতি মুহূর্তে মোচড় খাচ্ছে ওর পায়ের তলায়।

অনেকক্ষণ পর ফ্ল্যাশ লাইটটা খুঁজে পেল মুসা। সঙ্গে সঙ্গে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। ওটার সুইচ খুঁজতে খুঁজতে জায়গা ছেড়ে এক পা সরে গেল।

তখনই পায়ে আবার জোর এক ঘষা খেল। জিনিসটা শক্ত এবং কাঁটাওয়ালা।

অদৃশ্য পোকা-মাকড়ের দল ওর চারদিকে নানান শব্দ করছে। হুটোপুটি করছে। একটা আরেকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, কামড়াকামড়ি করছে।

মুসা ভয়ে উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে। আতঙ্কে কাঁপছে। কয়েক লাফে বেশ খানিকটা সরে গেল। অবশেষে খুঁজে পেল ফ্ল্যাশ লাইটের সুইচ।

টিপে দিল।

হলদেটে ম্লান আলোয় যা দেখল, তাতে অন্তরাত্মা ঝাঁকি খেল। শুকিয়ে গেল কলজের পানি

বৃশ্চিক!

কাঁকড়ার মত দাঁড়াওয়ালা, ভয়ঙ্কর। এবং বিষাক্ত।

নিশ্চয় অন্ধকারে ওদের বাসা মাড়িয়ে দিয়েছে। ‘খাইছে রে, আল্লাহ!’ শিউরে উঠল ও।

আলো ভয়ঙ্কর প্রাণীগুলোর ওপর দিয়ে নেচে বেড়াচ্ছে।

কয়েকটার লেজ খাড়া ওপরে উঠে আছে, দুই মজবুত দাঁড়া বাড়ি খাচ্ছে পরস্পর। ওরা আক্রমণ চালাতে প্রস্তুত। ভঙ্গিটা তারই পূর্বাভাস। ওরা একটা অন্যকে ডিঙিয়ে আসছে। ব্যস্ত।

পিছাতে শুরু করল মুসা, চিৎকার করল, ‘বাঁ-চা-ও! বাঁ-চা-আ-আ- ও!!‘

একটা বৃশ্চিক তীর বেগে ছুটে এল, দাঁড়া দিয়ে কুট্ করে কামড়ে ধরল ওর প্যান্ট। আরেকটা লেজ দিয়ে টুকটুক্ করে কেডসের পেছনে আঘাত করছে।

বিষাক্ত প্রাণীগুলোর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে পা ছুঁড়ল মুসা। একইসঙ্গে চেঁচাচ্ছে গলা ফাটিয়ে, গোঙাচ্ছে, ফোঁপাচ্ছে।

হঠাৎ দেহের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। পড়ে যাচ্ছে!

কিছু একটা ধরে পতন ঠেকাতে চাইল। হলো না। ধরার মত কিছুই নেই!

এখনই হুমড়ি খেয়ে পড়বে শত শত বৃশ্চিকের মধ্যে।

‘না-আ-আ-আ-আ-আ!’ প্রাণপণে চিৎকার করে উঠল।

ঠিক সেই মুহূর্তে একজোড়া হাত পেছন থেকে ওর কাঁধ চেপে ধরল। পতনের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল।

পনেরো

নিশ্চয়ই কোনও মমি!

নইলে আর কে হতে পারে? কে আছে এখানে ওকে বাঁচাবার মত? ওদিকে তখন আরও কয়েকটা বৃশ্চিক ওর পা বেয়ে উঠে আসছে। উন্মুক্ত জায়গা পেলেই হুল ফুটিয়ে দেবে।

বিষ ঢেলে দেবে!

হাত দুটো টেনে ওকে দূরে সরিয়ে আনল। এরমধ্যে ফ্ল্যাশ লাইট দিয়ে পিটিয়ে বৃশ্চিকগুলোকে গা থেকে খসিয়ে দিয়েছে মুসা।

একটু পর সামলে নিয়ে ঘুরল ও। এবং ভীষণভাবে চমকে উঠল। ‘মদিনা!’ অবিশ্বাসে ছানাবড়া হয়ে উঠল চোখ। ‘তুমি?’

‘হ্যাঁ, আমি,’ বলল সে।

‘কিন্তু… কী করে…’

মদিনা হাত ধরে টানতে টানতে ওকে কক্ষের মাঝখানে, টার পিটের কাছে নিয়ে এল। ‘পরে বলব তার আগে তুমি সরে এসো এদিকে।’

‘কিন্তু… কিন্তু এখানে এলে কী করে তুমি?’ এখনও কাঁপছে মুসা। বিষাক্ত প্রাণীগুলো দেখে নিল একবার। আগের জায়গায় ঘুরঘুর করছে ওগুলো। বোধহয় ভাবছে, শিকারটা গেল কোথায়?

—তুমি এখানে কীভাবে এলে তা-ই বলো আগে,’ মদিনা কপাল কোঁচকাল। ‘আমি আর বাবা সেই কখন থেকে তোমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। আর তুমি…

‘তুমি কোন্ পথে এখানে এলে?’ বাধা দিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল মুসা। মনে হলো বোনের প্রশ্ন শুনতে পায়নি।

মদিনা নিজের আলো ঘুরিয়ে কক্ষের এক কোনায় একটা টানেল দেখাল। আগে ওটা চোখে পড়েনি মুসার। ‘তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে বাবা আর আমি কখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি, টেরই পাইনি,’ ঝাঁঝাল গলায় বলল সে। ‘বাবা কোথায় গেছেন জানি না। ঘুরতে ঘুরতে এদিকে আলো দেখে ভাবলাম বাবাই হবেন। কিন্তু দেখি তুমি।’

মুসা কপালের ঘাম মুছল। তুমিও পথ হারিয়ে ফেলেছ?’

‘তোমাকে খুঁজতে এসে সেটাই হয়েছে,’ বলল মদিনা। ‘জানো, তোমার খোঁজে বাবা পাগলের মত ছোটাছুটি করছেন? এখন যদি দেখেন আমিও নেই, কী অবস্থা হবে কল্পনা করো!’

‘আমার কী দোষ! জুতোর ফিতে বাঁধতে থেমেছিলাম। কত ডেকেছি, তোমরা শুনলে না, হেঁটে চলে গেলে। কেন একটু দাঁড়ালে না আমার জন্যে?’

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ওকে দেখল মদিনা। মাথা দোলাল। ‘আমরা তোমার ডাক শুনতে পাইনি। শুনলে অবশ্যই দাঁড়াতাম।’ আবার মাথা দোলাল। ‘ইস্! কী বিচ্ছিরি কাণ্ড হয়ে গেল!’

বোনকে পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছে মুসা। স্বস্তি পাচ্ছে। কিন্তু মামা হারিয়ে গিয়েছেন শুনে মন খারাপ হলো ওর।

‘বাবা বারবার বলেছেন আমাদের তাঁর কাছে থাকতে। তারপরও কেন তুমি…’

‘বলেছি তো জুতোর ফিতে বাঁধতে গিয়ে পিছিয়ে পড়েছি,’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ‘কেন এক কথা বারবার বলছ?’

ভ্রূ কুঁচকে ওকে দেখল মদিনা। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা দোলাল। ‘এতক্ষণে বাবার মাথা খারাপ হওয়ার দশা হয়েছে। রেগে আগুন হয়ে গেছেন।’

দাঁড়াও, দাঁড়াও! আমি এখানে যা আবিষ্কার করেছি, দেখলে সব ঠিক হয়ে যাবে। মামার রাগ পানি হয়ে যাবে।’

চোখ সরু হয়ে এল মদিনার। ‘কী এমন আবিষ্কার করলে তুমি?’

‘দেখো!’ ফ্ল্যাশ লাইটের আলো ঘুরিয়ে মমিগুলো দেখাল ওকে মুসা। কফিন দেখাল।

‘বাপরে!’ রুদ্ধশ্বাসে মদিনা বলে উঠল। ‘এসব… এসব…’

‘হ্যাঁ। এটা হচ্ছে প্রাচীন আমলের মমি তৈরির ঘর। ওই কাজে যেসব যন্ত্রপাতি, ব্যাণ্ডেজ ব্যবহার হত, সব এখানে আছে।’

‘অ্যাঁ!’ চোখ কপাল পেরিয়ে চাঁদিতে উঠে গেল মদিনার।

‘হ্যাঁ,’ মুসার ঠোঁটে হাসি ফুটল।

‘এটা মমি তৈরি করার ঘর?’

‘দেখে তা-ই তো মনে হচ্ছে।’

‘তা হলে… তা হলে মমিগুলো দাঁড়িয়ে কেন? কফিনে কেন রাখা হয়নি এদের?’

‘আমিও তা-ই ভাবছি,’ মুসা বলল।

পায়ে পায়ে শেলফটার কাছে গিয়ে যন্ত্রপাতিগুলো দেখল মদিনা। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল লিনেন। তারপর রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘অবিশ্বাস্য!’

মাথা দোলাল মুসা। ‘আমি যদি দল থেকে আলাদা না হয়ে পড়তাম, তা হলে এই রুমের কথা অজানাই থাকত।’

মদিনার মুখে হাসি ফুটল, ‘সত্যি। বড় একটা কাজের কাজ করেছ তুমি।’

ওর জবাবের আশায় না থেকে সামনে থেকে সরে গেল মদিনা ‘সত্যি, বাবা দেখলে খুব খুশি হবেন।’

‘মামাকে জানাতে হবে আমরা এখানে আছি,’ মুসা বলল। ‘মদিনা, তোমার বীপারের সুইচ অন করো।’

‘কেন, তোমারটা করো।’

‘আমারটা নষ্ট হয়ে গেছে।’

‘ও,’ কোমরের বেল্ট থেকে নিজের বীপার তুলে নিল মদিনা। সুইচ অন করে দিল। ‘বাবা মনে হয় আশপাশেই কোথাও আছেন। পৌঁছতে বেশি সময় লাগবে না।’

ঠিক তা-ই। একটু পরে টানেলে একজোড়া ভারী পায়ের আওয়াজ উঠল। আসছেন মামা।

‘মামা!’ উত্তেজিত গলায় ডেকে উঠল মুসা। ‘জলদি! দেখুন কী সব আবিষ্কার…’ চট্ করে থেমে গেল ও। হাঁ হয়ে গেল। কে লোকটা? মামা তো না!

ষোলো

মামুন হাশমি এক পা এগিয়ে এল। হাতে একটা জ্বলন্ত মশাল। তার আলোয় মুখের একটা পাশ জ্বলজ্বল করছে। ওর চাউনি শান্ত, স্থির।

ঢোক গিলল মুসা-মদিনা। এক পা পিছিয়ে গেল। এ-ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে ঘন ঘন। লোকটা এখানে কী মতলবে এসেছে? সেটা যা-ই হোক, ভাল কিছু নয় নিশ্চয়ই!

‘মিস্টার হাশমি!’ সাহস সঞ্চয় করে বলে উঠল মদিনা, মুসার এক হাত মুঠো করে ধরে রেখেছে। ‘আপনি এখানে কেন এসেছেন?’

‘তোমরা কেন এসেছ?’ নরম কণ্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করল যুবক। মনে হচ্ছে যেন ওর ব্যক্তিগত ঘর এটা। আরও কয়েক পা এগিয়ে এসে দাঁড়াল। অনুসন্ধানী চোখে চারপাশ দেখল। যেন কিছু খোয়া গেছে কী না যাচাই করছে।

‘আমরা… আমরা বাবার সঙ্গে এসেছি।’

যুবকের চাউনি জ্বলে উঠল। ‘তোমার বাবাকে বারবার সাবধান করেছি আমি,’ বলল সে।

‘সাবধান করেছেন? কীসের ব্যাপারে?’

‘অভিশাপের ব্যাপারে,’ আরেকবার জ্বলে উঠল হাশমির চোখ। মশালের আলোয় মনে হচ্ছে তার মুখের একপাশে আগুন ধরে গেছে।

‘অভিশাপ!’ গলা কেঁপে গেল মদিনার। ‘কীসের অভিশাপ?’

‘মমির অভিশাপ,’ একঘেয়ে কণ্ঠে বলল সে।

মদিনার দিকে ফিরল মুসা। ‘হ্যাঁ, মামা কাল এ ব্যাপারে কী যেন বলছিলেন,’ নিচু কণ্ঠে বলল। ‘অবশ্য গুরুত্ব দেননি। উনি…’

‘গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল!’ প্রায় চিৎকার করে বলল মামুন হাশমি। ‘কারণ এর সঙ্গে জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত।’ থেমে আপনমনে মাথা দোলাল। ‘উচিত ছিল। গুরুত্ব দিলে তারই ভাল হত।

মুসা-মদিনার মুখে কথা জোগাল না। যুবকের চড়া গলা শুনে ঘাবড়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে টানেলের দিকে তাকিয়ে আছে ওরা।

মামা এখনও আসছেন না কেন? ভাবছে মুসা।

মদিনার মনেও একই প্রশ্ন।

‘আজ সময় এসেছে অভিশাপ বাস্তবায়ন করার,’ বলে উঠল হাশমি। ‘তোমরাই সে সুযোগ করে দিয়েছ। আমার কিছু করার নেই। সন্ন্যাসিনীর সমাধি কক্ষে পা রেখে তোমরা এর পবিত্রতা নষ্ট করেছ। তার পরিণতি তোমাদের ভোগ করতে হবে।’

‘সন্ন্যাসিনী!’ মদিনার মুঠো ওর কব্জি চেপে ধরায় ব্যথা পেল মুসা, হাতটা ছাড়িয়ে নিল। ‘সন্ন্যাসিনী কে?’

‘এটা যার সমাধি কক্ষ, সে,’ আরও দু’পা এগোল হাশমি। ‘সন্ন্যাসিনী খালা আফাফ। তোমরা এর পবিত্রতা নষ্ট করেছ।’

‘আমরা একথা জানতাম না, মিস্টার হাশমি,’ বলল মদিনা। ‘তা ছাড়া এখানে ইচ্ছে করেও আসিনি, এসেছি পথ ভুল করে।’

‘হ্যাঁ, সত্যি, মুসা সায় দিল। ‘আমরা কোনও কিছু ছুঁয়েও দেখিনি, বিশ্বাস করুন।’

‘চুপ করো!’ চেঁচিয়ে উঠল যুবক। ‘কোনও কথা শুনতে চাই না। এই কক্ষে পা রেখেই চরম অপরাধ করেছ তোমরা। কোনও ক্ষমা নেই তার।’

তার পেছনের অন্ধকার টানেলের দিকে তাকাল দু’ভাইবোন। ‘বাবা, যে-কোন মুহূর্তে এসে পড়বেন, মিস্টার হাশমি,’ মদিনা বলল। বীপারটা দেখাল। ‘আমি এটার সুইচ অন করে দিয়েছি।’

‘তোমার বাবা?’ মুখ বাঁকিয়ে হাসল যুবক। ‘মানুষটাকে বুদ্ধিমান ভেবেছি এতদিন। কিন্তু আমার সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করে চরম বোকামি করেছে সে।’

‘সতর্কবাণী?’ চোখ সঙ্কুচিত হয়ে উঠল মদিনার। ‘কীসের?’

‘এই পিরামিডে কাজ বন্ধ করার। দুই ওয়ার্কারকে ভয় দেখিয়ে তাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম খালা আফাফের অভিশাপ কাউকে রেহাই দেবে না।’

‘কী করে?’ মদিনা উত্তেজিত হয়ে উঠল। ‘আপনি লোক দুটোকে ভয় দেখিয়েছেন কী করে?’

মামুন হাশমির মুখে নেকড়ের হাসি ফুটল। ‘জ্যান্ত মানুষকে কী করে মমি বানানো যায়, তা দেখিয়ে,’ আঙুল তুলে কক্ষের মাঝখানের টার পিট দেখাল সে। ‘ভয় পেয়েছে, কারণ ওরা নিজের চোখে দেখেছে কীভাবে জ্যান্ত মানুষকে সেদ্ধ করে মমি করা যায়।’

তীব্র আতঙ্কে গলা-বুক শুকিয়ে উঠল মুসার। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে শোয়া দেহ দুটো দেখল। ও দুটো তা হলে প্রাচীন মমি নয়?

‘কিন্তু…’ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল মদিনা। হাশমিকে মশাল দুলিয়ে আরও এক পা এগোতে দেখল।

‘চার হাজার বছর আগে খালা আফাফ ডিক্রি জারি করে গেছেন, কেউ যেন তাঁর সমাধি কক্ষের পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ না করে,’ চেঁচিয়ে বলল যুবক। ‘তখন থেকে খালার বংশধররা এটার পাহারায় আছে। যে এর পবিত্রতা নষ্ট করেছে, তাকেই উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছে।’

‘আপনি…’

‘হ্যাঁ!’ ধমকে উঠল সে, মুসার কথা শেষ করতে দিল না। ‘আমি খালার বংশধরদের একজন। এ পবিত্র দায়িত্ব এখন আমাকে পালন করতে হবে।’ মুখ তুলে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে হাশমি, যেন বিদেহী সন্ন্যাসিনী খালা আফাফকে ওখানে দেখতে পাচ্ছে। ‘অপ্রিয় হলেও একাজ আমাকে করতেই হবে। কারণ আমি খালার বতর্মান প্রজন্মের পুরুষ। এই সমাধি কক্ষের পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব আমার ওপর ন্যস্ত। তাঁর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে।’

বাবা কেন আসছেন না এখনও? ভাবছে ভীত-কম্পিত মদিনা। কতক্ষণ লাগবে তাঁর পৌঁছতে?

মুসা ভাবছে অন্য কিছু। ভয় পেলেও সাহস হারায়নি ও। কী করে হাশমির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়, তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে।

‘যখন জানলাম তোমার বাবা এই পিরামিডে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করতে চলেছে,’ বলল যুবক। ‘কায়দা করে তার দলে ঢুকে পড়লাম। সে খালার কবরের পবিত্রতা নষ্ট করবে, তা তো হতে পারে না।

নীরবে তার দিকে তাকিয়ে আছে ওরা। মশালের আলো-ছায়ায় লোকটাকে ভয়ঙ্কর লাগছে।

‘সময় থাকতে খালার হুঁশিয়ারির ব্যাপারে জানিয়েছি। তোমার বাবা শুনল না। কিছুই কানে নিল না। তাই তাকে সতর্ক করার জন্যে দুই শ্রমিককে ভয় দেখিয়েছি। তোমাদের ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছি, যাতে ভয় পেয়ে কাজ বন্ধ করে।’ মশাল উঁচু করল হাশমি। ‘কাজ হয়নি। কাজেই আর কোনও উপায় নেই। আমার ওপর বংশানুক্রমে ন্যস্ত পবিত্র দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হবে।’

‘তার মানে?’ বলল মুসা। লোকটাকে কথায় ব্যস্ত রাখতে চাইছে ও, যাতে বেশি সময় পাওয়া যায়।

যুবকের মুখে কলজে হিম করা হাসি ফুটল। ‘তার মানে? এখনও বুঝতে পারছ না? চারদিকে তাকিয়ে দেখো।’

তাই করল ওরা। কিন্তু বুঝতে পারল না সে কী বোঝাতে চায়। চোখে প্রশ্ন নিয়ে ঘুরল হাশমির দিকে।

‘এখনও বোঝোনি?’ বাঁকা হেসে প্রশ্ন করল যুবক। জবাবে ওদের মাথা দোলাতে দেখে বলল, ‘মমিগুলো দেখো।’

‘মমি!’ মুসা বিস্মিত হলো। ‘মমি কী?’

‘এরা সবাই খালা আফাফের সমাধি কক্ষের পবিত্রতা নষ্ট করেছে।’

মদিনা চেঁচিয়ে উঠল, তার মানে! এরা… এগুলো প্রাচীন মমি না?’

‘হ্যাঁ, কেউ কেউ!’ বাঁকা হাসি আরও চওড়া হলো হাশমির। ‘অনেকে প্রাচীনকালে পবিত্রতা নষ্ট করেছে। অন্যরা সম্প্রতি। দেখো, তাদের পরিণতি কী হয়েছে। এদের ধরে জ্যান্ত অবস্থায় মমিতে পরিণত করা হয়েছে।’

‘না!’ আঁতকে উঠল মদিনা।

‘হ্যাঁ,’ হাশমি হাসল। হাত বাড়িয়ে শেলফ থেকে বড় একটা ড্যাগার তুলে নিল সে। তৈরি হও। এখন তোমাদের মরতে হবে।’

পায়ে পায়ে এগোতে শুরু করল সে।

সতেরো

দ্রুত কয়েক পা পিছিয়ে গেল মুসা ও মদিনা।

‘কোনও লাভ নেই,’ যুবক বলে উঠল। ‘যত চেষ্টাই করো, পালাতে পারবে না তোমরা।’

‘মদিনা!’ ফিফিস্ করে মুসা বলল। টানেল লক্ষ্য করে দৌড় দাও। আমাদের দু’জনকে একসঙ্গে ধরতে পারবে না ও। কেউ না কেউ বেরিয়ে যেতে পারব। মামাকে নিয়ে ফিরে এসে…’

‘তোমরা খালার কবর কলুষিত করেছ। এর শাস্তি তোমাদের পেতেই হবে, কোনও উপায় নেই।’ ড্যাগার ধরা হাত ওপরে তুলল হাশমি।.

একই মুহূর্তে তার পেছনের টানেলে একটা আলো দেখা গেল। ডক্টর সায়েম মোর্শেদ এসে ঢুকলেন ভিতরে। ‘মুসা! মদিনা! তোমরা এখানে… হাশমি!’ যুবককে দেখে চমকে উঠলেন তিনি। ‘ওটা কী তোমার হাতে? এখানে কী করছ তুমি?’

নির্বিকার চেহারায় বিজ্ঞানীকে দেখল সে। ‘খালা আফাফের নির্দেশ পালন করার জন্যে প্রস্তুত ইচ্ছি।’

‘খালা আফাফ!’ কপাল কুঁচকে উঠল তাঁর। ‘মানে সেই সন্ন্যাসিনী?’

‘বাবা, ও আমাদের খুন করতে চাইছে!’ তীক্ষ্ণ, আতঙ্কিত গলায় বলল মদিনা। ‘আমাদের খুন করে…’

‘খুন নয়,’ শান্ত কণ্ঠে বাধা দিল যুবক। ‘খালার পবিত্র আত্মার সন্তুষ্টির জন্যে তোমাদের বলি দিতে চলেছি।’

হতভম্ব হয়ে গেলেন ডক্টর মোর্শেদ। ‘এসব… এসব কী বলছ তুমি?’ এগিয়ে এসে মেয়ে আর ভাগ্নের কাঁধে হাত রাখলেন।

‘যা করতে চলেছি,’ চেহারা গম্ভীর হয়ে উঠল তার, ‘তা-ই বলছি।’

‘হাশমি, মাথা ঠাণ্ডা করো। কী বলছ, তা তুমি বুঝতে পারছ না।’

‘ঠিকই বুঝতে পারছি আমি, প্রফেসর।’

যুবককে বোঝাবার ভঙ্গিতে এক হাত তুললেন তিনি। ‘শোনো, বাইরে চলো। বাইরে গিয়ে এ নিয়ে আলাপ করা যাবে।’

‘না। আপনিও ভিতরে ঢুকে অপবিত্র করেছেন খালা আফাফের সমাধি ক্ষেত্র। এখন ওদের সঙ্গে আপনাকেও মরতে হবে।’

তার দিকে এগোলেন ডক্টর মোর্শেদ। ‘আহ্, হাশমি! শোনো…’

‘আমার কাছে আসবেন না, প্রফেসর!’ হুমকি দিল সে। ‘খালার ইচ্ছে পূরণের পথে কোনও বাধা মানব না।’

তুমি একজন বিজ্ঞানী, হাশমি,’ থেমে দাঁড়িয়ে বললেন তিনি। ‘আমিও তা-ই। আমরা দু’জন আলোচনা করে এর একটা বিহিত করতে পারি।’

‘এ নিয়ে আলোচনার কিছু নেই, প্রফেসর। খালার ইচ্ছে পূরণ করতে হবে। চার হাজার বছর ধরে তা পূরণ করে এসেছে আমার পূর্বপুরুষ। এখন আমার পালা। তারা ব্যর্থ হয়নি। আমিও হব না।’

‘হাশমি, এসব কুসংস্কার। তুমি জানো অভিশাপের কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। সন্ন্যাসিনী বহু শতাব্দী আগে মারা গেছে। আর মৃত্যুর পর কোনও মানুষ তার ইচ্ছে পূরণ হলো কি না, তা দেখতে আসে না। কাজেই অনর্থক ব্যাপারটা জটিল না করে এসো, আলোচনার মাধ্যমে…’

কথা বলার ফাঁকে যুবকের দিকে বেশ কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। হাশমি সুযোগটা কাজে লাগাল, চট্ করে ড্যাগার ফেলে দু’হাতে মশাল দিয়ে বিজ্ঞানীর মাথায় আঘাত করল। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলেন তিনি।

অবিশ্বাসে চোখ বড় হয়ে উঠল। কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে থাকলেন তিনি, তারপর জ্ঞান হারিয়ে হুড়মুড় করে আছড়ে পড়লেন।

মদিনা ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল, ছুটে গিয়ে বাবার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। আঘাত লাগা জায়গায় হাত বোলাতে বোলাতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

আঠারো

রাগে জ্বলে উঠল মুসা, একলাফে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মামুন হাশমির ওপর।

লোকটা এক হাতে ওর গলা ধরল, জোর ধাক্কা দিয়ে পিছিয়ে দিল। প্রচণ্ড জোর আছে তার।

সামলে নিতে চাইল মুসা, কিন্তু তাল হারিয়ে ফেলল। পড়ে গেল মেঝেতে। ঠাস্ করে মাথা ঠুকে গেল। কিছুক্ষণ চোখে কিছু দেখতে পেল না। চুপ করে পড়ে থাকল ও। ভেবে দেখল, এরকম জটিল মুহূর্তে মাথা গরম করা ঠিক হচ্ছে না। মাথা ঠাণ্ডা না রাখলে উন্মাদ কুসংস্কারাচ্ছন্ন হাশমি সবাইকে খুন করবে।

শক্তি দিয়ে নয়, বুদ্ধি দিয়ে লোকটাকে পরাজিত করতে হবে।

কিন্তু মাথায় কোনও বুদ্ধি আসছে না। এরকম কঠিন সময়ে কী করার আছে? আস্তে করে উঠে দাঁড়াল মুসা।

‘আমাদের যেতে দিন, প্লিজ!’ ভেজা চোখে যুবকের দিকে তাকিয়ে মিনতি করল মদিনা। ‘যেতে দিন আমাদের।’

ওর কান্না দেখে মুসার চোখে পানি এসে গেল, কিন্তু হাশমির কঠিন মন একটুও নরম হলো না। টার পিটের মধ্যে ছুঁড়ে মারল মশালটা।

‘দাঁড়াও,’ বলল সে। ইঙ্গিতে পিট দেখাল। ‘ওটা গরম হোক, তারপর তোমাদের ছেড়ে দেব। জনমের মত ছেড়ে দেব।’

ভয়ে কলজে কেঁপে উঠল মুসার। বুঝতে পারছে এরপর কী করবে হাশমি। পিটের আলকাতরায় আগুন ধরেছে। এখনই টগ্‌বগ্ করে ফুটতে শুরু করবে। এবং হাশমি ওদের ওখানে ফেলে দেবে।

পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠল ওর তীব্র আতঙ্কে। আগুন ততক্ষণে পিটের সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। তাপে জমাট আলকাতরা নরম হচ্ছে, বুদ্বুদ উঠছে।

‘আলকাতরা না ফোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে,’ মৃদু হাসি দিল যুবক।

মুসা কেশে উঠল। কক্ষ ভরে উঠেছে কালো ধোঁয়ায়। বিষাক্ত, ঘন ধোঁয়া। মদিনাও কাশছে।

হাশমি কাছে এসে অজ্ঞান বিজ্ঞানীর হাত ধরল, মেঝের ওপর দিয়ে ঘষে টেনে নিচ্ছে।

‘ছেড়ে দিন!’ মদিনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল। ‘ছেড়ে দিন আমার বাবাকে! শয়তান! খুনি…’ বলতে বলতে লোকটার দিকে ছুটে যাচ্ছিল ও, পেছন থেকে হাত টেনে ধরল মুসা।

‘বোকামি কোরো না!’ চাপা গলায় মদিনাকে শান্ত করতে চাইল ও। ‘বাধা পেলে খেপে উঠবে লোকটা। ধৈর্য ধরো।’

পরিস্থিতি বুঝল মদিনা। নিজেকে ছাড়াবার জন্যে জোরাজুরি করল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকল।

ওরা যা আশঙ্কা করেছিল, তা ঘটল না। মামাকে টার পিটের দিকে নয়, মামুন হাশমি একটা খালি কফিনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা দু’ভাইবোন কিছুটা স্বস্তি পেল। হাশমি প্রচণ্ড শক্তি রাখে। মামাকে প্রায় অনায়াসে কোলে তুলে নিল, কফিনের ভেতর শুইয়ে ওটার ডালা বন্ধ করে দিল।

আশ্চর্য! একটুও হাঁপাচ্ছে না সে। ঘুরে দাঁড়াল। ‘এবার তোমরা,’ বলল লোকটা। আঙুল তুলে প্ল্যাটফর্মের ওপর শোয়ানো বড় এক কফিন দেখাল সে। ‘ওটার মধ্যে ঢোকো।’

বিশাল কফিন। শোয়ানো অবস্থাতেই প্রায় মুসার সমান উঁচু। লম্বায় দশ ফুট। ওটা নিশ্চয় মৃতকে তার যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তিসহ কবর দেয়ার জন্যে তৈরি করা হয়েছে।

‘আমাদের ছেড়ে দিন!’ মদিনা এখন আর কাঁদছে না। ‘বাবাকে বের করুন ওটার ভেতর থেকে, প্লিজ! যেতে দিন আমাদের।’

‘কফিনে ঢুকে পড়ো, সময় নষ্ট কোরো না,’ দু’পা এগোল মামুন হাশমি। ‘জলদি করো! জলদি।’

‘না!’ অজান্তেই বলে উঠল মুসা। ‘যাব না আমরা।’

ভয়ে সারাদেহ কাঁপছে ওর। প্রচণ্ড উত্তেজনায় কপালের দু’পাশে শিরা দপদপ করছে। এমনই অবস্থা, ও যে কিছু বলেছে, তা নিজের কানেই ঢোকেনি।

আড়চোখে মদিনাকে দেখল মুসা। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও। মাঝে মাঝে ওর বাবাকে যে কফিনে রাখা হয়েছে, সেটার দিকে তাকাচ্ছে।

‘কফিনে ঢোকো!’ কর্কশ গলায় নিৰ্দেশ দিল হাশমি। ‘সময় হয়ে এসেছে। খালা আফাফের ইচ্ছে পূরণে দেরি হলে পরিণতি আরও ভয়ঙ্কর হবে। জলদি!’

‘না!’ আবার বলল মুসা। বেশ তেজের সঙ্গেই বলল এবার। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁকি মেরে কফিনের ভেতরটা দেখল ও। এটা কাঠের তৈরি। ভিতরে ডজনখানেক বড় পোকা ঘুরছে।

ওদিকে মামুন হাশমি নিচু হয়ে মেঝে থেকে ড্যাগারটা তুলে নিল। ওটা কাঁধের ওপর তুলে ভয় দেখাল ওদের।

‘ঢোকো! এক্ষুণি!!’

উনিশ

মদিনা নড়ে উঠল। জানে, হাশমিকে ঠেকানোর উপায় নেই, বাধা দিলে লোকটা বরং খেপে যাবে। কফিনের কিনারায় গিয়ে দাঁড়াল সে। কিনারা ডিঙিয়ে ঢুকে গেল ভিতরে।

মুসা অনুসরণ করল ওকে। কফিনের কিনারা ধরে একটু ইতস্তত করল, মামার কফিনটার দিকে তাকাল। ওটা পাথরের। ভিতরে বাতাস ঢুকছে কী না কে জানে! মামা কী দম নিতে পারছেন?

নাকি… ভয়ে দম আটকে এল। যদি অজ্ঞান অবস্থায় অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু হয় মামার?

পরক্ষণে ভাবল, কী আসে যায় তাতে? এখন না মরলেও একটু পর তো হাশমির হাতে মরতেই হবে। ওদেরও মরতে হবে। হয়তো বহু হাজার বছর এই কক্ষে অনাবিষ্কৃত থাকবে ওদের দেহ।

যদি আবার কেউ কোনওদিন এ কক্ষের হদিস পায়, ওদের দেখে হয়তো ভাববে, ওগুলো প্রাচীন মিশরীয় মমি I

হাশমি খেঁকিয়ে উঠল। ‘ভেতরে ঢোকো!’

‘আমরা ছোট,’ মুসা বলল। ‘না জেনে ঢুকে পড়েছি এখানে, আপনি বুঝতে চাইছেন না কেন?’

ও নিজেদের উদ্ধার করার কোনও পথ দেখতে পাচ্ছে না, আরও কিছু সময় নষ্ট করতে চাইছে। যদি মাথায় কোনও বুদ্ধি এসে যায়?

‘সন্ন্যাসিনী খালা আফাফ ছোটদের বেলায় বিশেষ কিছু করার নির্দেশ দিয়ে যাননি,’ বলল হাশমি। ‘কাজেই ছোট-বড় সবার শাস্তিই এক। কোনও ক্ষমা নেই। যাও ভিতরে।’

মুসা পরাজয় মেনে নিল। আর লোকটাকে ঠেকানোর উপায় নেই। শেষবারের মত আরেকবার মামার কফিনটা দেখে নিল ও। এক পা ভরে দিল কফিনের মধ্যে, তারপর অন্য পা। ভিতরে দু’চোখ বুজে বসে আছে মদিনা। ঠোঁট নড়ছে ওর।

মনে হলো বুঝি দোয়া দরুদ পড়ছে। মুসা ওর মুখোমুখি বসল। এক হাত রাখল মদিনার কাঁধে। কিন্তু চোখ মেলল না সে। হাশমি এগিয়ে এসে কফিনের ঢাকনা বন্ধ করে দিল। গাঢ় অন্ধকার গ্রাস করল ওদের।

‘মুসা!’ একটু পর মুখ খুলল মদিনা। কাঁপা গলায় বলল, ‘আমার খুব ভয় করছে।’

অবাক হলো ও। জীবনে এই প্রথম মদিনা স্বীকার করল ওর ভয় করছে। অদ্ভুতরকম সহজ-সরল স্বীকারোক্তি।

‘আমারও,’ বলল ও, ‘খুব ভয় করছে।’

হাত বাড়িয়ে মুসার হাত ধরল মদিনা। ‘হাশমি লোকটা উন্মাদ। বাবাকে কী জোরে মারল, উফ্!’

‘সত্যি,’ মুসা বলল। ‘আরেকটু জোরে লাগলে মামার মাথা ফেটে যেত। জানোয়ার!’

কিছুক্ষণের মধ্যে কফিনের ভিতরের বাতাস গুমোট হয়ে গেল। ওদের শ্বাস নিতে অসুবিধে হচ্ছে। তারওপর বাতাস গরম

গরম ও দুর্গন্ধযুক্ত। উস্ শুরু করল মুসা-মদিনা।

‘মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে মরব আমরা,’ বলল মদিনা।

‘তার আগেই ফুটন্ত আলকাতরার পিটে ফেলবে ও আমাদের।’

‘উফ্! মা গো! কী এটা?’

কয়েকটা চাপড়ের শব্দ শুনল মুসা। ‘মনে হয় ছারপোকা। ঢোকার আগে ভিতরে অনেকগুলো দেখেছি আমি। কয়েকটা গুবরে পোকার মত বড়।’

মদিনা কিছু বলল না। মাঝে মধ্যে দেহের এখানে ওখানে চাপড় মারছে, উহ্!’ ‘আহ্!’ করছে।

‘আমাদের চুপ করে বসে থাকা ঠিক হচ্ছে না,’ মুসা বলল। ‘একটা কিছু করা উচিত।’

‘কী করব?’

‘এসো, দু’জনে মিলে ঢাকনি উঁচু করে দেখি হাশমি কী করছে,’ মুসা প্রস্তাব দিল। ‘যদি দেখি ও নেই, পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।’

খুব উৎসাহের সঙ্গে এগিয়ে এল মদিনা। দু’জনে মিলে প্রাণপণে চেষ্টা করল। কিন্তু লাভ হলো না। একচুল নড়ল না ডালা।

মুসা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘মনে হয় হাশমি বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়েছে।’

‘তাই হবে,’ হতাশ শোনাল মদিনার কণ্ঠ

সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, বাইরে কোনও নড়াচড়ার আওয়াজ নেই। হতাশায়, ক্লান্তিতে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে মুসার। কিন্তু ছারপোকার ভয়ে সে সাহসও হচ্ছে না।

হঠাৎ একটা ঘড়মড় ধরনের আওয়াজ শুনতে পেল ও। মনে হলো মদিনা করছে আওয়াজটা। কিন্তু মদিনার কথা শুনে ভুলটা ভাঙল ওর। দু’জন তো আর একসঙ্গে ভুল শুনতে পারে না।

‘কীসের শব্দ, মুসা?’

‘বুঝতে পারছি না,’ রুদ্ধশ্বাসে বলল ও।

কান খাড়া করল দু’জন।

ফের উঠল আওয়াজটা

খুব কাছে। মনে হলো যেন ওদের কফিনের ভিতরেই।

গুঙিয়ে উঠল মদিনা। ‘মুসা! ভিতরে কী যেন একটা…’ কথা শেষ না করে থেমে গেল।

‘মমি না তো?’ আঁতকে উঠল মুসা।

বিশ

না, মমি হতে পারে না, ভাবল ও। নিশ্চয়ই আর কিছু। হয়তো ছারপোকা। খুব বড় ছারপোকা। সেই মুহূর্তে খুব পরিচিত গলাটা কানে এল। ‘মদিনা! মুসা!’ কণ্ঠটা ফিফিস্ করে ডাকল। ‘তোমরা কোথায়?’

‘মামা!’ ধড়মড় করে উঠে বসল মুসা।

‘বাবা!’ মদিনা কেঁদে ফেলল। ‘বাবা, কোথায় তুমি?’

‘এই যে, মা, ডক্টর মোর্শেদ তেমনি ফিফিস্ করে বললেন। ‘তোমাদের কফিনের বাইরে।’

‘কী করে, মামা? আপনি কফিন থেকে বের হলেন কী করে?’

‘আস্তে, মুসা। চেঁচিয়ো না, হাশমি শুনে ফেলতে পারে।’

অন্ধকারে বিজ্ঞানীর গলা আন্দাজ করে এগোল ওরা।

‘কী করে বের হলে তুমি, বাবা?’

‘প্রাচীন মিশরীয়রা কোনও কোনও কফিনে পেছন-দরজা রাখত। আমার ভাগ্য ভাল, ওটায় সেরকম একটা ছিল। এটাতেও আছে।’

‘পেছনে কেন দরজা বানাত ওরা?’ মুসার প্রশ্ন।

‘মৃতের আত্মা যাতে ওপথে বেরিয়ে স্বর্গে যেতে পারে, তাই।’

‘হাশমি কোথায়, বাবা?

‘আমাদের বলি দিতে তৈরি হচ্ছে। একটু আগেও খালার বেদীতে পুজো দিচ্ছিল। এখন নেই, বাইরে কোথাও গেছে। হয়তো এক্ষুণি চলে আসবে। জলদি এসো!’

কফিনের তলায় একটা চৌকো অংশ খুলে গেল। ফাঁক দিয়ে মামা হাত বাড়িয়ে দিলেন। ‘এসো।’

বেরিয়ে এল ওরা। কক্ষে হাজার বছরের গুমোট, তবু কফিনের বাইরে তো, বুক ভরে দম নিল ওরা।

আলকাতরার পিট দাউদাউ করে জ্বলছে। পট্পট্ শব্দে বুদ্বুদ ছাড়ছে।

মামুন হাশমিকে দেখা গেল না। ‘চলো!’ মামা বললেন। ‘ও ফিরে আসার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে।’

মদিনার ঠোঁট কাঁপছে। চেহারা ফ্যাকাসে। ‘পথ কই, বাবা?’

‘টানেল দিয়ে। ওটা ছাড়া আর পথ নেই।’

সবাই নিঃশব্দ পায়ে টানেলের দিকে ছুটল। মামার দু’চোখ হাশমিকে খুঁজছে। দশ-বারো পা যেতে না যেতে মুসা হোঁচট খেল।

জুতোর ফিতে খুলে গেছে। কিন্তু কিছু করার নেই, এখন ওটা বাঁধার সময় নেই। এক টানে জুতোটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল। প্রাণ না বাঁচলে জুতো দিয়ে কী হবে? আগে এখান থেকে বেরতে হবে। তারপর অন্য কথা।

টানেলের কয়েক গজ দূরে রয়েছে ওরা, এমন সময় মামুন হাশমি হাজির হলো। ফিরে এসেছে সে! এক হাতে নতুন একটা মশাল। অন্য হাতে সেই ড্যাগার। তাকে আগের থেকে অনেক দৃঢ় দেখাচ্ছে।

মুসা-মদিনা তাকে দেখে আঁতকে উঠল। চট্ করে সায়েম মোর্শেদের গা ঘেঁষে দাঁড়াল ওরা।

ডক্টর মোর্শেদের চোখে চোখ রেখে মৃদু কণ্ঠে বলল হাশমি, ‘পালাবার পথ নেই, প্রফেসর। যারা সন্ন্যাসিনী খালা আফাফের সমাধি ক্ষেত্র অপবিত্র করে, তাদের মরতে হয়।’

মশালটা মামার মুখের সামনে দোলাল সে। দ্রুত মাথা পিছিয়ে নিলেন তিনি। আগুনের আঁচ লাগছে। মশাল ফত্‌ত্ আওয়াজ তুলে সরে গেল।

হাশমির মুখে হাসি ফুটল। ‘আপনি আমাকে রাগিয়ে তুলেছেন, প্রফেসর। কাজেই রেহাই নেই আপনার। আপনি তো মরবেনই, আপনার মেয়ে আর ভাগ্নেও মরবে।’

‘শোনো, হাশমি…’

হাশমি মশাল দিয়ে খোঁচা মারতে চাইল। মামা কোনও মতে সরে গেলেন।

‘কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, প্রফেসর,’ ইশারায় জ্বলন্ত পিট দেখাল সে। আপনাদের শাস্তির আয়োজন প্রস্তুত, ওদিকে যান।’

সায়েম মোর্শেদ মুসা আর মদিনার কাঁধ আঁকড়ে ধরলেন। বোঝা গেল ভয় পেয়েছেন। হাশমি শক্ত-সমর্থ যুবক, তার সঙ্গে শক্তিতে পারবেন না তিনি

‘হাশমি, বিষয়টা ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখো,’ অনুযোগের ভঙ্গিতে বললেন তিনি। ‘তুমি যা করতে চলেছ তা সোজা কথায় খুন। তুমি বিজ্ঞানী। তুমি উপযুক্ত কারণ ছাড়া মানুষ মারবে?’

‘বলেছি তো কথা বাড়িয়ে লাভ নেই,’ যুবক পনি টেইল করা বেণী দোলাল। ‘হাঁটুন! সোজা পিটের দিকে!’

‘হাশমি… ভেবে দেখো!’

পাত্তা দিল না যুবক। মশাল তুলে ঝাঁকি দিল, বিজ্ঞানী দু’পা পিছিয়ে গেলেন।

হাশমি বলল, ‘মাত্র তিনটে কেন, খালাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্যে হাজারটা বলি দেব। একে খুন বলে না। এ তো অপরাধীর পাপের সাজা!’

মশাল ও ড্যাগার দিয়ে ভয় দেখাল যুবক। ওদের নিয়ে গিয়ে পিটের কিনারায় দাঁড় করাল।

ভেতরের আলকাতরা টগবগ করে ফুটছে। বুদ্বুদ ছাড়ছে সশব্দে। ধোঁয়ার বিশ্রী গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে। গরম ধোঁয়ায় নাক জ্বলছে।

‘এক এক করে লাফিয়ে পড়বেন,’ মামার চোখের দিকে তাকাল হাশমি। ‘প্রথমে আপনি, প্রফেসর। কারণ আপনিই আসল অপরাধী।’

‘হাশমি…’

‘থামুন!’ গর্জে উঠল সে। ‘কোনও কথা শুনতে চাই না।’ কয়েক মুহূর্ত নীরবে মদিনা ও মুসাকে দেখল। দৃষ্টি নরম হলো। ‘দুঃখিত। প্রফেসরের সঙ্গে তোমাদেরও মরতে হচ্ছে। এই কক্ষে পা রেখে তোমরা খালার আত্মাকে ক্রুদ্ধ করে তুলেছ। তোমরা তাঁর সমাধি কক্ষ অপবিত্র করেছ। আমি খালার কক্ষের পবিত্রতা রক্ষা করার ভারপ্রাপ্ত পুরুষ, তাই কাজটা না করে পথ নেই।’

পোড়া আলকাতরার দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে মুসার। ভয় হচ্ছে, জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে। ঝিঝিম্ করছে মাথার মধ্যে। মনে হলো ভেতরটা ফাঁকা।

নিজেকে স্থির রাখার জন্যে প্যান্টের দুই পকেটে হাত ভরে দিল মুসা। ডান হাতে শক্ত কী যেন একটা ঠেকল, জিনিসটা আঙুল দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল। বুঝল ওটা কী।

সামোনার!

সেই ছোট্ট মমির হাতটা।

মাথা ঠিকমত কাজ করছে না, পরিষ্কার কিছু ভাবতে পারছে না, তবু কী ভেবে ওটা বের করে আনল মুসা।

হাতটা উঁচু করে ধরল।

মনের মধ্যে কী চলছে বুঝতে পারছে না ও, কেন সামোনারটা ওপরে তুলল, তা-ও জানে না। শুধু বুঝল, ওর নিজের ভিতরের কোনও শক্তি ওকে দিয়ে কাজটা করাচ্ছে। হয়তো ও আশা করছে ওটা দেখলে হাশমির মন বদলে যাবে, রাগ উবে যাবে।

মুসা অবচেতন মনে সামোনারের অদ্ভুত যে ক্ষমতার কথা ভাবে, সেটাই ওকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে। কারণ যা-ই হোক, না বুঝেই ওটা মাথার ওপর তুলে ধরেছে মুসা।

‘টেকী কাহরু! টেকী কাহরু! টেকী কাহরু!’ মুসা আনমনে বিড়বিড় করে মমি জীবন্ত করার প্রাচীন মন্ত্রটা আওড়াল। গতবার যখন এসেছে মুসা জেনেছে এই প্রাচীন মন্ত্রটা। পরপর পাঁচবার আওড়ালে মমি জীবন্ত হয়ে ওঠে।

মুসা মাথার ওপরে সামোনারটা দোলাল, মন্ত্রটা পরপর পাঁচবার আওড়াল।

তারপর অপেক্ষা করল। আশা করল, কিছু একটা ঘটুক।

থমকে গেল হাশমি। সামোনারের দিকে তাকিয়ে থাকল।

কিন্তু কিছুই ঘটল না।