মাটির তলায় হলেও ঘরটা বেশ বড়। সিঁড়ি যেদিকে তার ঠিক উল্টোদিকের দেওয়ালের মাথার কাছে গোলাকার একটা গর্ত আছে। ফোকরটা সম্ভবত ঘরের বাইরে মাটির সমতলের কিছুটা ওপরে অবস্থিত। বাইরের পৃথিবীর আলো আসছে সেখান দিয়ে। ওই ফোকর দিয়ে মানুষ গলতে পারে ঠিকই, কিন্তু সেটা এতটাই ওপরে যে সুদীপ্ত বা হেরম্যান কেউ কারো কাঁধে চেপেও তার নাগাল পাবে না। মসৃণ দেওয়াল বেয়েও সেই ফোকরের কাছে পৌঁছানো অসম্ভব।
সিঁড়ির ধাপে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর নীচে মাটিতে নেমে সুদীপ্তরা ঘুরে ঘুরে ঘরটা দেখতে লাগল। নিরেট পাথুরে দেওয়াল, বাইরে যাবার কোনো পথ নেই। দেওয়ালের গায়ে চিত্রিত প্রাচীন ফিংসের মূর্তিগুলোর ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি। জোড়া জোড়া চোখ দিয়ে তারা যেন দেখছে সুদীপ্তদের। সুদীপ্ত বলল, ‘ডক্টর টিউনিস আমাদের এভাবে আটক করলেন কেন? ওঁর মতলবটা কী?’
হেরম্যান গম্ভীরভাবে জবাব দিলেন, ‘সঠিক ধারণা আমার নেই। তবে এই বিপদের মধ্যেও টিউনিসের কথা শুনে আমার একটা ধারণা হচ্ছে। সিংহ-মানুষের ব্যাপারে উনি নিশ্চিতভাবে কিছু জানেন। হয়তো বা এ তল্লাটে সত্যিই সিংহ-মানুষ আছে। জঙ্গলাকীর্ণ এই প্রাচীন নগরীর এই ভূগর্ভস্থ কুঠুরি যতটা অপরিচ্ছন্ন হবার কথা ততটা কিন্তু নয়।’ ঘরের এককোণে একটা লাঠির মাথায় আধপোড়া একটা মশাল পড়ে থাকতে দেখে সুদীপ্তরা বুঝতে পারল, এ ঘরে ডক্টর টিউনিস বা অন্য কারো যাওয়া-আসা আছে। মশালটা হাতে নিয়ে দেখছিল সুদীপ্ত, হঠাৎ হেরম্যান মাটির ওপর ঝুঁকে পড়ে সুদীপ্তকে বললেন, ‘আশ্চর্য ব্যাপার দেখো!’ মাটির ওপর যেখানে দেওয়ালের মাথার ফোকর গলে আলোকরশ্মি এসে পড়েছে। সেই আলোতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মেঝের নরম ধুলোর ওপর মানুষের পায়ের ছাপের পাশাপাশি জেগে আছে সিংহর থাবার দাগ!
সুদীপ্ত বলে উঠল, ‘এ ঘরে সিংহ আর মানুষ দু-ধরনের প্রাণীরই আনাগোনা আছে নাকি? নাকি এ একজনেরই পায়ের ছাপ! আফ্রিকানদের প্রবাদ সত্যি! সিংহ-মানুষ দুটো রূপই ধারণ করতে পারে!’
হেরম্যান বললেন, ‘কে জানে! তবে আপাতত আমাদের ডক্টর টিউনিসদের পুনঃআগমনের প্রতীক্ষা করা ছাড়া কোনো কাজ নেই। তবে রিভলভারটা সঙ্গে আছে। সেটার উপস্থিতি ওদের জানা নেই। আমার ধারণা যে এখানে আমাদের আটকে রেখে তিলে তিলে মারার জন্য সে আমাদের বন্দি করেনি। সে বা মোগাবো আসবে। তখন একটা লড়াই দেওয়া যাবে।’
সুদীপ্তরা নিজেদের পূর্ব অভিযানের অভিজ্ঞতায় দেখেছে যে বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হলে অন্য প্রসঙ্গে আলোচনা করলে কাজ দেয়। এর আগে বেশ কয়েকবার ‘ক্রিপটিড’ বা ‘গল্পকথার প্রাণীর’ খোঁজে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে হেরম্যানের সঙ্গী হয়েছিল সুদীপ্ত। অনেক বিপদের সাক্ষীও থেকেছে। এবারই বরং নিছক মিশর ভ্রমণে এসে বিপদে জড়িয়ে পড়ল তারা। কখনো তারা গেছে নেপাল-হিমালয়ের প্রাচীন বৌদ্ধমঠে ‘বরফদেশের ছায়া মানুষ’ বা ‘ইয়েতি’র খোঁজে, কখনো ইন্দোনেশিয়ায় ‘সুলাদ্বীপের সোনার ড্রাগন’কে খুঁজতে, আবার টাঙ্গানিকার তীর ধরে গ্রেট রিফট্ অতিক্রম করে অভিযানে সামিল হয়েছে শ্বাপদসঙ্কুল আফ্রিকার গহীনতম প্রদেশে ‘বুরুন্ডির সবুজ মানুষ’-এর খোঁজে। এসব অভিযান সুদীপ্তদের শিখিয়েছে প্রচুর। কতবার যে তারা দুজন মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়েছে তার হিসাব নেই। সেসব ঘটনা ভবিষ্যতে মনকে আরও দৃঢ় করেছে। মাটির নীচের প্রাচীন কুঠুরিতে বসে সে সব গল্পই করে চলল তারা। বাইরে সময়ও এগিয়ে চলল তার সঙ্গে।
দুপুর আর বিকালে পালা করে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নিল দুজন। সুদীপ্ত যখন ঘুম থেকে উঠল তখন ঘরটা প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। বাইরের পৃথিবীতে সূর্য ডুবছে। সারা দিন তারা কাটিয়ে দিল মাটির নীচে। হেরম্যান বললেন, ‘রাতটা সতর্ক থাকতে হবে। হয়তো তারা আসবে। সঙ্গে দেশলাই আছে। মশালটা জ্বালানো যেতে পারে, তবে এখন নয়। কারণ, মাটির নীচে বাতাস ভারী হয়ে যেতে পারে তাতে। শ্বাস নিতে সমস্যা হবে।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরে সূর্য ডুবে গেল। ঘরটা ঢেকে গেল অন্ধকারে। এক দুঃসহ অন্ধকারে চুপচাপ বসে রইল দুজন। সুদীপ্তর মনে হতে লাগল, এ অন্ধকার যেন কোনোদিন কাটবে না! অন্তহীন এ অন্ধকারে ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাবে তারা। একএকটা মুহূর্ত যেন এক-একটা ঘণ্টার মতো ভারী। পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন নগরীর মৃত্যুকূপে আটকে পড়েছে তারা।
কিন্তু একসময় আবার অন্ধকার ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করল। বাইরে চাঁদ উঠছে। সেই আলো ঢুকছে ঘরেও। মিশরীয়দের স্থাপত্য-কৌশল সত্যিই আশ্চর্য ছিল সে সময়। নইলে মাটির নীচে চাঁদের আলো ঢোকার কথা নয়। ঘরের ভিতরটা মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গেল। ফোকরের আলোক উৎসর দিকে তাকিয়ে হেরম্যান বললেন, ‘আজ বোধ হয় পূর্ণিমা!’ পাথুরে মেঝেতে বসে, সিঁড়ির মাথার পাথর সরানোর কোনো শব্দ বা টিউনিসের ফেরার কোনো শব্দর প্রতীক্ষা করতে লাগল তারা।
ঘণ্টাতিনেক নিস্তব্ধভাবেই কেটে গেল। তারপর একটা অস্পষ্ট খসখস শব্দ শোনা গেল। সুদীপ্তরা বুঝতে পারল শব্দটা আসছে সিঁড়ির মাথা থেকে নয়, দেওয়ালের মাথার ফোকর থেকে। সম্ভবত বাইরে ওখানে কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কে ও? সুদীপ্তরা উঠে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল সেই ফোকরের দিকে। হ্যাঁ, শব্দটা হচ্ছেই!
মিনিটখানেক মাত্র। হঠাৎই যেন ফোকরের আলোটা ঢেকে গেল। ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। বিস্মিত সুদীপ্তরা দেখল তার ভিতর দিয়ে ভিতরে উঁকি দিচ্ছে বিরাট বড় একটা মাথা! সিংহ! সিংহর মাথা! ওপর থেকে সে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে! প্রাণীটা একবার মুখটা ফাঁক করল। অন্ধকারের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠল তার হিংস্র দাঁতগুলো। তার মুখের জান্তব দুর্গন্ধ মাটিতে দাঁড়িয়েও টের পেল তারা। হতভম্ব সুদীপ্তরা দেখতে লাগল তাকে। কালো কেশরঅলা বিরাট একটা সিংহর মাথা! সিংহটা এরপর কয়েক মুহূর্তের জন্য মাথা সরিয়ে নিল। আবার আলোয় ভরে উঠল ঘর। সুদীপ্ত খেয়াল করল হেরম্যানের হাতে রিভলভার উঠে এসেছে।
দ্বিতীয়বার মাথা ঢোকাল সিংহটা। চোখে সেই জ্বলন্ত দৃষ্টি। টপ্ করে সুদীপ্তর হাতে একফোঁটা গরম জল পড়ল। সিংহর লালা। কী বীভৎস দুর্গন্ধ! সারা গা গুলিয়ে উঠল সুদীপ্তর। আর এরপরই সে খেয়াল করল পশুটা তার মাথার সঙ্গে সামনের থাবা দুটোও ভিতরে ঢোকাচ্ছে। হেরম্যান সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘ওর মতলব ভালো নয়। ও গুঁড়ি মেরে ফোকর দিয়ে নীচে নামার চেষ্টা শুরু করেছে! ও ভিতরে চলে আসতে পারে। ওকে থামাতে হবে।’ এই বলে হেরম্যান তাঁর রিভলভার তুললেন সেই জন্তুকে ” লক্ষ করে।
খট্! খট! ট্রিগার টানার দুটো ধাতব শব্দ হল মাত্র, গুলি বেরোল না! তেম্যান তাড়াতাড়ি রিভলভারটা পরীক্ষা করে বললেন, ‘সর্বনাশ! ডক্টর টিউনিস আমাদের চেয়ে অনেক বেশি চালাক। সকালে আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে তিনি রিভলভার থেকে গুলি সরিয়ে নিয়েছেন!’ সিংহটা একটা চাপা ‘গ-র-র’ শব্দ করল। হয়তো সে নিজের ভাষায় বিদ্রুপ করল সুদীপ্তদের অবস্থা দেখে। একটা পা-ও সে গলিয়ে ফেলেছে। হেরম্যান আর সময় নষ্ট না করে চিৎকার করে উঠলেন, ‘মশালটা জ্বালাতে হবে। ওটা দিয়ে ওকে ঠেকাবার চেষ্টা করতে হবে।’
সুদীপ্ত মশালটা উঠিয়ে আনল, সৌভাগ্যক্রমে সেটা জ্বলেও উঠল। সিংহটা গজরাতে শুরু করেছে, সম্ভবত সে বুঝতে পারছে মানুষগুলো তাকে আটকাবার কোনো বন্দোবস্ত করছে। সে-ও দ্রুত ফোকর দিয়ে তার দেহটাকে গলাবার চেষ্টা করতে লাগল।
বেশ জ্বলে উঠল মশালটা। আলোকিত হয়ে উঠল সারা ঘর। সেই আলোতে সিংহটাকে আরও হিংস্র দেখাচ্ছে। কুচকুচে কালো কেশর ফোলানো মাথা, হিংস্র সবুজ চোখ দুটো যেন প্রবল জিঘাংসায় মরকত মণির মতো জ্বলছে, তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মতো ভয়ংকর দাঁতগুলো যেন সেই মুহূর্তেই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে চাচ্ছে সুদীপ্তদের।
মশালটা ঠিকভাবে জ্বলে ওঠার পরই সুদীপ্তরা চোখের ভাষাতে নিজেদের কর্তব্য ঠিক করে ফেলল। হেরম্যান ঠিক ফোকরটার নীচে দেওয়াল ধরে মাটিতে বসে পড়লেন। সুদীপ্ত মশালটা ধরে হেরম্যানের কাঁধের ওপর উঠে দাঁড়াল। পাঁচ ফুট লম্বা লাঠির আগায় দাউ দাউ করে জ্বলছে মশালটা। সুদীপ্ত তাঁর কাঁধে পা রাখার পর দেওয়াল ধরে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াতে শুরু করলেন হেরম্যান। মশালের আলোতে সিংহটার মুখের ভিতর আল-জিভটা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে সুদীপ্ত। তার শ্বাসের গরম হলকা পর্যন্ত সে টের পাচ্ছে! লম্বা জিভ থেকে টপটপ করে লালা খসে পড়ছে সুদীপ্তর গায়ে। আর দেরি করা যাবে না। সিংহটা তার দ্বিতীয় পা’টা প্রায় গলিয়ে ফেলেছে ভিতরে। ওটা ভিতরে ঢোকাতে পারলেই দেহটা ভিতরে ঢোকাতে কোনো সমস্যা হবে না। সে নেমে আসবে নীচে। তারপর?
সুদীপ্ত মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে প্রস্তুত হল ঘটনাটা ঘটাবার জন্য। তারপর হাত উঁচু করে জ্বলন্ত মশালের আগাটা ঢুকিয়ে দিল সিংহর করাল মুখগহ্বরে।
প্রচণ্ড গর্জনে থরথর করে কেঁপে উঠল সারা ঘর। মাথার ওপর থেকে পলেস্তরা খসে পড়ল। সিংহটা মুহূর্তের মধ্যে সেই ফোকর থেকে টেনে হিঁচড়ে নিজের দেহটাকে বাইরে বার করে নিল। তার ক্রুদ্ধ গর্জনে বাইরেটাও যেন কেঁপে উঠল বেশ কয়েকবার। পাতালঘরে দাঁড়িয়ে সুদীপ্তরা শুনল সে শব্দ। তারপর একসময় সব কিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে হেরম্যান বললেন, ‘ইতে পারে এটা সেই সাথীহারা সিংহটা। আবার এমনও হতে পারে এটা হয়তো ডক্টর টিউনিসের পোষা কোনো সিংহ। ঘরে সিংহ ঢুকিয়ে তিনি মারতে চেয়েছিলেন আমাদের। হয়তো প্রাচীনকালে এই গুপ্ত কুঠুরিতে ওই ফোকর দিয়ে এভাবেই সিংহ ঢুকিয়ে মারা হত বন্দিদের। তারপর কফিনের পাথরটা সরিয়ে আবার প্রাণীটাকে বাইরে বার করে নিয়ে যাওয়া হত। হতভাগ্য বন্দির পরিণতি কেউ জানত না। শুধু জিভ চাটতে চাটতে সিংহটা মন্দির ছেড়ে বেরোত।’ এরপর কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে হেরম্যান বললেন, ‘আমার প্রথম অনুমানটাই ঠিক। ওটা সাথীহারা সিংহটাই। ডক্টর টিউনিস আমাদের খুন করতে চাইলে সিংহ পাঠিয়ে খুন করতেন না। ওই ফোকর দিয়ে মোগাবো তার রাইফেলের নলটা ভিতরে ঢোকালেই কাজ মিটে যেত। তবে সিংহটা নিশ্চয়ই আর দ্বিতীয়বার ওপথে ফিরে আসবে না। আগুনকে শ্বাপদ প্রাণীরা এমনিতেই ভয় পায়। তারপর আগুনের আঘাতে সে নিশ্চয়ই কম-বেশি আহত হয়েছে। সিংহর ভয় থেকে আপাতত আমরা নিরাপদ। আপাতত ডক্টর টিউনিস কখন আসে দেখা যাক। মশালটা আপাতত নিভিয়ে দাও। কার্বন ছড়াচ্ছে। শেষকালে না এর জন্য মরতে হয়!’
মশাল নিভিয়ে দিল সুদীপ্ত। আবার চাঁদের আলোতে আলোকিত হল ঘর। সিংহর ঘটনার আকস্মিকতা একটু স্তিমিত হবার পর একসময় হেরম্যান বললেন, জানো, পিরামিডের নীচেও প্রাচীন গুপ্তকক্ষে সারকোফেগাস অর্থাৎ কফিন রাখার পাথরের আধারের ওপরও এমনই পূর্ণিমার চাঁদের আলো এসে পড়ত। অথচ বাইরে থেকে দেখে তা বোঝার উপায় ছিল না। রানি হাটশেপমুট, বা বালকরাজা তুতেনখামেনের সমাধিতেও নাকি এ ব্যবস্থা ছিল। দেবীমায়ের উপাসকদের ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞান কত উন্নত ছিল ভাবো!
একসময় পুরো চাঁদটাই তারা দেখতে পেল সেই গহ্বর দিয়ে। সোনার থালার মতো, ছবির বইতে দেখা প্রাচীন মিশরীয় রানিদের সোনার মুকুটে বসানো স্বর্ণবলয়ের মতো চাঁদ। সুদীপ্তরা তাকিয়ে রইল সেদিকে।