ভোরবেলা বাইরে থেকে আসা লোকজনের কণ্ঠস্বরে ঘুম ভাঙল সুদীপ্তদের। পোশাক বদলে তারা বাইরে আসতেই দেখতে পেল বাড়ির ঠিক বাইরেই যেন উঠে এসেছে বুশম্যানদের গ্রামটা। হুইল চেয়ারে বসে আছেন ডক্টর টিউনিস, তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে মোগাবো। আর তাদের চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে নিজস্ব ভাষায় উত্তেজিতভাবে কী যেন বলে চলেছে বুশম্যানরা। ঠেলে ভিড় সরিয়ে ডক্টর টিউনিসের কাছে গিয়ে দাঁড়াল সুদীপ্তরা। হেরম্যান ডক্টর টিউনিসের কাছে জানতে চাইলেন, ‘ব্যাপারটা কী?’ তিনি বললেন, ‘সিংহ মানুষ নিয়েছে। ওই যে হুই বলে সেই ছেলেটাকে।’ ‘কীভাবে?’ সুদীপ্ত জানতে চাইল।
ডক্টর টিউনিস বললেন, ‘এদের যা বক্তব্য তা হল, ছেলেটা তার মার সঙ্গে একটা কুটিরে থাকে। কাল মাঝরাতে সে তার ঘরের পিছন দিকে শিয়ালের ডাক শুনতে পায়। এত কাছে শিয়ালের ডাক শুনে সে আর ঘরে থাকতে পারেনি। একটা চামড়ার খুব প্রয়োজন তার। অথচ সিংহর ভয়ে নগরীর ঘাসবনে ঢোকা যাচ্ছে না। কাজেই এ সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায়নি। ঘর ছেড়ে সে বর্শা হাতে বেরিয়ে পড়ে শিয়াল মারবে বলে। কিন্তু সে আর ফেরেনি। গ্রাম থেকে বেরিয়ে নগরীর দিকে যাবার একটা রাস্তা আছে, সেখানে তার বর্শা আর ছেলেটার রক্ত মিলেছে। তার সঙ্গে সিংহর পায়ের ছাপ ও ভারী কোনো জিনিস টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ। সম্ভবত সিংহটা তাকে টেনে নিয়ে গেছে প্রাচীন নগরীর ঘাসবনের মধ্যে।’
হেরম্যান জানতে চাইলেন, ‘এখন এরা কী বলছে?’
ডক্টর টিউনিস বললেন, ‘এখন এরা নগরীর ভিতর ঘাসবনে ঢুকতে চায় ওই ছেলেটাকে খুঁজতে। বলা ভালো তার দেহাবশেষ আনতে। এদের ধারণা, তার দেহ সৎকার না করলে তার আত্মা আবার সিংহ-মানুষ হয়ে গ্রামে হানা দেবে। এখন এদের দাবি, মোগাবোর কাছে যেহেতু বন্দুক আছে সেহেতু মোগাবোকেও যেতে হবে এদের সঙ্গে। ওকে পাঠাব কিনা ভাবছি।’
সুদীপ্ত বলল, ‘স্মিথ কোথায়? সেই তো সিংহ শিকার করতে এসেছে।’ ‘ওরা তো বলছে যে কাল বিকাল থেকে সে-ও বেপাত্তা। তারও কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এটাও আমাকে ভাবাচ্ছে। নগরীর ভিতর ঘাসবনে সিংহ ছাড়াও ভয়ংকর বিষাক্ত অ্যাডর সাপ আছে! স্মিথকে না পেয়েই তো ওরা মোগাবোকে যেতে বলছে।’ হেরম্যান বললেন, ‘গ্রামের লোকরা যদি নগরীর ঘাসবনে ঢোকে তবে সঙ্গে কোনো বন্দুকধারী থাকা অনেক বেশি নিরাপদ ব্যাপার। নইলে হয়তো আরো কারো জীবন যেতে পারে!’
ডক্টর টিউনিস বললেন, ‘তা ঠিক।’ তারপর তিনি মোগাবোর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘গ্রামের লোকেরা যখন চাচ্ছে তখন তুমি ওদের সঙ্গে ঘুরে আসো। দেখো কিছু পা-ও কিনা। তাছাড়া বলা যায় না, শিকারি ছেলেটারও কিছু হতে পারে।’
ডক্টর টিউনিসের কথায় মোগাবো ঘাড় নাড়ল ঠিকই, কিন্তু তার চোখ-মুখ দেখে মনে হল, নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেন সে বন্দুক আনতে গেল।
রাইফেল কাঁধে বেরিয়ে মোগাবো বুশম্যানদের ইঙ্গিত করল এগোবার জন্য। তাদের মধ্যে যারা সক্ষম পুরুষ ও অস্ত্রধারী তারা অনুসরণ করল মোগাবোকে। হেরম্যান ডক্টর টিউনিসকে বললেন, ‘আপনি যে জায়গা আমাদের আজ দেখাবেন বলেছিলেন, সেখানে নিশ্চয় এখনই যাওয়া হচ্ছে না। আমরাও ওদের পিছন পিছন কিছুটা ঘুরে আসি।’ এই বলে হেরম্যানও সুদীপ্তকে নিয়ে তাদের অনুসরণ করলেন।
প্রথমে যাওয়া হল সে জায়গাতে যেখানে প্রথম চিহ্ন মিলেছিল। সেখানে ধুলো-মাটিতে বেশ অনেকখানি রক্ত কালো হয়ে জমাট বেঁধে আছে। ধুলোতে ধস্তাধস্তির স্পষ্ট চিহ্ন, ·আর সিংহর পায়ের ছাপ আঁকা। হেরম্যান জায়গাটা দেখে বললেন, ‘সম্ভবত লড়াই দেবার চেষ্টা করেছিল, ছেলেটা। সিংহ বা বাঘের শিকার ধরার কায়দা হল, তারা পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘাড়ে কামড় বসায়। দাঁত মাংসর মধ্যে যতক্ষণ গেঁথে থাকে ততক্ষণ বেশি রক্তপাত হয় না। সেজন্য শিকার ধরার জায়গার তুলনায় যেখানে তার শিকারকে নামায় সেখানেই বেশি রক্তের চিহ্ন পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে এখানেই যথেষ্ট রক্তপাত হয়েছে।’
মাটির মধ্যে দিয়ে ভারী জিনিস ঘষটে টেনে নিয়ে যাবার দাগ এগিয়েছে, সামনের দিকে। এদিক দিয়েও সেই প্রাচীন নগরীতে প্রবেশের একটা পথ আছে। নগরীর ভিতর প্রবেশমুখে দু’পাশে উঁচু ঢালযুক্ত বেদির ওপর দাঁড়িয়ে আছে মাথা-ভাঙা এক ফারাও মূর্তি। সেই বেদির ওপরও বেশ কিছু রক্ত পাওয়া গেছে। সম্ভবত সেই হতভাগ্য যুবকের দেহটা টানতে টানতে এখানে জিরোবার জন্য কিছুটা থেমেছিল সিংহটা। এ জায়গাটা অতিক্রম করলেই ঘাসজমিপূর্ণ নগরীর ভিতর প্রবেশ করবে সুদীপ্তরা। তারা কিন্তু থামল না, এরপরও দলটাকে অনুসরণ করতে দেখে মোগাবো বরং একবার থমকে দাঁড়িয়ে একটু বিস্মিতভাবে তাকাল সুদীপ্তদের দিকে। তার চোখে একটু অসন্তোষ ফুটে উঠলেও সে মুখে কিছু বলল না। হয়তো তার ধারণা ছিল যে সুদীপ্তরা এ পর্যন্ত এসে থেমে যাবে। নগরীর ভিতরে ঢুকবে না।
আবার এগোতে লাগল সবাই। সামনে শুরু হল ঘাসবন। অনুমানে সুদীপ্তরা বুঝতে পারল এই ঘাস-জমিটা অর্ধবৃত্তাকারে এগিয়েছে রানি শেবার মন্দিরের পেছনের দিকে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মন্দিরটা; যার সামনে উন্মুক্ত আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা থামগুলো।
প্রথমে রাইফেল উঁচিয়ে এগোচ্ছে মোগাবো। আর তার ঠিক পিছনেই সুদীপ্তদের ঘিরে একটা অর্ধবৃত্তাকার ব্যূহ রচনা করে একটু ঝুঁকে হাতের বর্শা একটু তুলে ধরে চলছে জনা কুড়ি বুশম্যান। কখনো ঘাসজমি সামান্য নড়ে উঠলেই অথবা কোনো প্রাচীন মূর্তি বা স্থাপত্যের পিছনে সিংহর আত্মগোপন করার সম্ভাবনা থাকলেই সঙ্গে সঙ্গেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছে সবাই। তারা যে ঠিক পথে এগোচ্ছে তার প্রমাণ এ পথে ঘাসবন লম্বা ফালির মতো নুইয়ে পড়েছে। এ পথেই শিকারকে টেনে নিয়ে গেছে সিংহ। মাঝে মাঝে হয়তো বুশম্যানদের তীক্ষ্ণ নজরে ধরা দিচ্ছে ধূসর ঘাসের গায়ে কালচে হয়ে যাওয়া এক ফোঁটা রক্ত। যা সঠিক পথ নির্দেশ করছে। মন্দিরের পিছনে বেশ কাছাকাছি পৌঁছে ঘাসজমিতে একছড়া হার কুড়িয়ে পেল একজন। বুশম্যানরা সেই পাথরের হারটাকে হতভাগ্য সেই যুবকেরই হার বলে শনাক্ত করল। বাগদানের সময় এই হারটাই তাকে পরিয়েছিল তার হবু বউ। এর পরিবর্তে তার একটা শিয়ালের চামড়া পাবার কথা ছিল।
শেবা মন্দিরের পিছনে এসে পৌঁছল সবাই। কিছুটা তফাত থেকে সুদীপ্তরা দেখতে পেল সেই খাঁচার মতো জায়গাটাকে। ডক্টর টিউনিসের বক্তব্য অনুযায়ী সেখানে রাখা হত সিংহ-মানুষদের।
শেবার মন্দিরের পিছনটা ঘাসে পরিপূর্ণ। বুক সমান উঁচু ধূসর ঘাস। তার মাঝে মাঝে কিছুটা তফাতে তফাতে দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট নানা ভগ্নপ্রায় স্থাপত্য, কিছু ঘর, ছাদহীন স্তম্ভ, দেওয়াল ইত্যাদি। টিউনিস বলেছিলেন, গুহার পরিবর্তে ওইসব ভগ্নপ্রায়, ধসে পড়া ঘরগুলোকেই সিংহরা গুহা হিসাবে ব্যবহার করে। এইসব ধূসর ঘাসবন সিংহর লুকিয়ে থাকার পক্ষে আদর্শ জায়গা। মন্দিরের পিছনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। কারণ ঘাসবন ভাঙার চিহ্ন এ জায়গাতে আর নেই। সম্ভবত মৃত শিকারকে এ পর্যন্ত ঘষটে টেনে আনার পর সে তাকে পিঠে তুলে এগিয়েছে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন স্থাপত্যগুলোর কোনো একটার ভিতর। এবার আরও সতর্ক হতে হবে। ওই ভাঙা ঘরবাড়িগুলোর কোনো একটার ভিতর থেকে আকস্মিক আবির্ভাবের সম্ভাবনা আছে পশুরাজের। ‘ক্যান!’ একটা ধাতব শব্দ হল। রাইফেলের সেফটি ক্যাচ খুলে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত হল মোগাবো। বুশম্যানরাও সামনে এগোবার আগে শক্ত মুঠিতে বর্শাগুলো ধরল। হেরম্যানের হাতও চলে আসে কোমরে। তার পরক্ষণেই চাপা স্বরে সুদীপ্তকে বললেন, ‘একটা ভুল হয়ে গেছে। তাড়াহুড়োতে বেরোতে গিয়ে রিভলভারটা বালিশের তলায় রেখে এসেছি! আমরাই এখন শুধু নিরস্ত্র!’
ঘাসবনের ভিতর দিয়ে এগোতে লাগল তারা। একসময় দলটা পৌঁছে গেল সেই ধসে পরা ঘরগুলোর কাছে। মাঝখানে বেশ কিছু ফাঁকা জায়গা, তাকে ঘিরে বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়িয়ে আছে বেশ বড়বড় ঘরগুলো। ঘর নয়, আসলে এগুলো প্রাচীন মন্দির। প্রত্যেকটা মন্দিরের প্রবেশমুখের ঠিক পাশেই উঁচু বেদিতে দাঁড়িয়ে আছে নানা মিশরীয় দেবদেবীর এক-একটা মূর্তি। আমন, হোরাস, আনুবিস…
হেরম্যান ঘরগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এগুলো সম্ভবত এক-একটা দেবতার মন্দির অথবা তাদের উপাসনা কক্ষ ছিল। আমরা যে ঘাসজমিতে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে সম্ভবত চাতাল ছিল, এবং তাকে ঘিরেই মন্দিরগুলো।’ এ জায়গাতে পৌঁছবার পর সবাই একটু ধন্দে পড়ে গেল। দেহটাকে সিংহটা কোথায় নিয়ে গেল? ওই মন্দিরগুলোর কোনোটার মধ্যে! ওপর থেকে পাথর খসে পড়ে বেশ ক’টা মন্দিরের মুখ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু ছোট গুহামুখের মতো ছিদ্র আছে ভিতরে ঢোকার জন্য। সিংহ ওসব ঘরের কোনো একটার ভিতর দেহটাকে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু ওখানে ঢোকা মানে সিংহর গুহায় প্রবেশ করা। যে করবে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। এবার কী করা উচিত তা নিয়ে চাপা স্বরে আলোচনা শুরু করল বুশম্যানরা। মোগাবোকেও একবার তারা কী কথা বলাতে সে ঘাড় নাড়ল। সম্ভবত সে জানিয়ে দিল, সে ওই ঘরগুলোতে ঢুকবে না। তারপর পিছন দিকে হাত দেখিয়ে বুশম্যানদের ফেরার ইঙ্গিত দিল।
আর কিছু করার নেই, সম্ভবত এবার ফিরতেই হবে। সেই সিদ্ধান্তই এবার নিতে হবে। আলোচনা শেষে ব্যর্থ মনোরথে বুশম্যানরা সেই সিদ্ধান্তই নিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘তোমরা যেটা খুঁজছ সেটা এখানেই আছে।’
সুদীপ্তরা অবাক হয়ে দেখল, একটা মন্দিরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আনুবিসের মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে তাদের হাত নেড়ে ডাকছে স্মিথ!
তাকে দেখামাত্রই সবাই এগোল তার দিকে। মন্দির চাতালে ওঠার পর সে ইশারায় দেখিয়ে দিল আনুবিসের পিছনটা। মূর্তি বেদি আর মন্দিরের দেওয়ালের মধ্যে একটা খাঁজ। সেখানে পড়ে আছে হতভাগ্য যুবকের দেহটা। তার সারা শরীর কেউ যেন ছুরি দিয়ে ফালা ফালা করে দিয়েছে। সিংহর দাঁত-নখের চিহ্ন।
সুদীপ্ত স্মিথকে বলল, ‘তুমি কাল বিকালে গ্রামে ফেরোনি?’
স্মিথ বলল, ‘না, তোমাদের সঙ্গে কথা বলে ফেরার পর, আমি আর গ্রামে না ঢুকে
এখানে চলে এসেছিলাম। সারা রাত সিংহটার ডাক অনুসরণ করেছি।’ হেরম্যান জানতে চাইলেন, ‘প্রাণীটা শিকার ধরে যখন এখানে এল তুমি দেখেছ তাকে?’
স্মিথ জবাব দিল, ‘না দেখিনি। তবে আমার ধারণা প্রাণীটা কাছাকাছি কোনো মন্দিরের মধ্যেই আছে।’
এরপর সে বলল, ‘তবে একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলাম! ছেলেটার দেহের ক্ষতচিহ্নগুলো আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। সিংহ তার নখ দিয়ে ফালা ফালা করে চিরেছে দেহটাকে। পেটের নাড়িভুঁড়িও বেরিয়ে এসেছে নখের আঘাতে। কিন্তু শিকারের ঘাড়ে বা দেহে দাঁত বসাবার কোনো চিহ্ন নেই। এ ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত!’ এরপর কী এটা যেন বলতে গিয়েও সামনে তাকিয়ে থেমে গেল স্মিথ। কিছুটা তফাত থেকে
তাদের দিকে তাকিয়ে আছে মোগাবো। তার চোখে কেমন একটা সন্দিগ্ধ ভাব। কিছুক্ষণের মধ্যে মৃতদেহটাকে তুলে নিয়ে গ্রামে ফেরার জন্য প্রস্তুত হল বুশম্যানরা। সুদীপ্ত স্মিথকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কী করবে এখন?’
সে জবাব দিল, ‘আমি এখন এখানেই থাকব। মন্দিরগুলোর ভিতর থেকে বা অন্য কোনো গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে সিংহটা রাতে নিশ্চয়ই তার ফেলে যাওয়া শিকারের খোঁজে এখানেই আসবেই। আর তখন…।’
এরপর সে জানতে চাইল, ‘ডক্টর টিউনিস কোথায়?’
হেরম্যান বললেন, ‘উনি বাড়িতেই। তিনি তোমার অনুপস্থিতি নিয়ে বেশ চিন্তিত।’ স্মিথ বলল, ‘আমার আজ এখানে রাত্রিবাসের খবরটা ওনাকে জানিয়ে দিও।’ সুদীপ্তরা যখন ডক্টর টিউনিসের আস্তানায় ফিরে এল তখন মাঝ দুপুর। ডক্টর টিউনিস তাদের জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। হেরম্যান আর সুদীপ্ত বিস্তৃতভাবে সব কথা জানাল তাঁকে। সিংহর সন্ধানে স্মিথ যে সে জায়গায় রাত্রিবাস করবে তা-ও জানানো হলো। ডক্টর টিউনিস এ কথাটা শুনে বেশ চিন্তান্বিতভাবে বললেন, ‘সিংহ বা অন্য যা কিছুর খোঁজেই হোক ও জায়গাতে রাত্রিবাস করা খুব বিপজ্জনক। প্রাচীন নগরীর মধ্যে ওই জায়গাটাই সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর। ওই ভাঙা মন্দিরগুলোই এখন সাহারার সিংহদের মূল আস্তানা। ওর মধ্যেই বাচ্চাকাচ্চাও দেয় তারা। যেসব গুপ্তধন-সন্ধানী এখানে এসে সিংহর হাতে মারা গেছেন তাঁরা ঠিক ওখানেই সিংহর আক্রমণের শিকার হয়েছেন। আরও সিংহ আছে ওখানে। শিকারি না শেষে শিকার হয়ে যায়! যাই হোক, এটা স্মিথের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আমার দুশ্চিন্তা ছাড়া কিছু করার নেই।’
এরপর তিনি বললেন, ‘আজ তো হতভাগ্য ছেলেটার ঝামেলায় আপনাদের যেখানে নিয়ে যাব ভেবেছিলাম সেখানে যাওয়া হল না। কাল সকালে ঘুরিয়ে আনব। আর একটা কথা, এখান থেকে আপনাদের কষ্ট করে দশ মাইল দূরে ট্রেন ধরতে যেতে হবে না। মোগাবোকে একটা কাজে আমাকে কাল কায়রো পাঠাতে হবে। আপনারা ওর সঙ্গেই প্লেনে ফিরবেন।’
হেরম্যান তাঁকে বললেন, ‘এর জন্য অনেক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে। আপনার আতিথেয়তা আমরা মনে রাখব।’
ডক্টর টিউনিসের সঙ্গে কথা বলে ঘরে ফিরে খাওয়া সেরে বিশ্রাম নিয়ে বিকালের দিকে বেরোল সুদীপ্তরা। প্রাচীন নগরীর দিকে নয়, তারা গেল মরুভূমির দিকে সূর্যাস্ত দেখতে। মরুভূমির বুকে অপূর্ব, অবর্ণনীয়, আশ্চর্য সুন্দর রঙের খেলা প্রত্যক্ষ করল তারা দুজন। তারপর ঘরে ফিরে এল।
সন্ধ্যাবেলায় নিজেদের ঘরে বসে গল্প করতে করতে সুদীপ্ত হেরম্যানকে বলল, ‘কালই তো আমরা চলে যাচ্ছি। যাবার বেলায় ডক্টর টিউনিস আমাদের কী দেখান দেখি? আপনি যার খোঁজ পাবেন বলে এখানে এসেছিলেন সেই সিংহ-মানুষ হয়তো আমরা পেলাম না। কিন্তু এখানে যা আমরা দেখলাম, এই প্রাচীন নগরী, মরুভূমির বুকে সূর্যাস্ত, এসব দেখার সৌভাগ্যই বা সাধারণ টুরিস্টদের ক’জনের হয়?’
হেরম্যান হেসে বললেন, ‘ঠিক তাই। এসবই বা কম কী? তবে আজকের একটা ঘটনায় একটা খটকা লাগছে!’
‘কী ঘটনা?’ জানতে চাইল সুদীপ্ত।
হেরম্যান প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, ‘আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। কাল আবার ফেরার ধকল আছে।’
মোগাবো খাবার দিয়ে গেল আটটা নাগাদ। খাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছিল দুজনেই। খোলা জানলা দিয়ে বাইরের চাঁদের আলোর সঙ্গে গ্রামের দিক থেকে ভেসে আসছিল দ্রিমি দ্রিমি ঢাকের শব্দ আর সম্মিলিত করুণ বিলাপের অস্পষ্ট শব্দ। সেই হতভাগ্য যুবকের শেষকৃত্য পালন করছে বুশম্যানরা। সেসব শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল সুদীপ্ত আর হেরম্যান।