শেরা মন্দিরের সিংহ মানুষ – ৬

বিকালবেলা রোদ একটু কমতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল সুদীপ্তরা। কথা বলতে বলতে তারা এগোল যে রাস্তাটা প্রাচীন নগরীর দিকে এগিয়েছে সেদিকে। মরু অঞ্চলে সূর্যাস্তের সময়টা বেশ মনোরম। সারা আকাশ জুড়ে রঙের খেলা শুরু হয়। তপ্ত দিনের শেষে মৃদুমন্দ বাতাস বইতে শুরু করে। দূরের মরুভূমি থেকে তেমনই একটা ঠান্ডা বাতাস এসে লাগছে সুদীপ্তদের গায়ে। দিনের শেষ আলো এসে পড়েছে। সুদীপ্তদের যাত্রাপথে এদিক-ওদিক দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন মূর্তি, স্তম্ভগুলোর গায়ে। অস্তাচলগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে তারা যেন নীরবে স্মরণ করছে হাজার বছরের প্রাচীন গৌরবোজ্জ্বল দিনের কথা। চারপাশের পরিবেশ খুব সুন্দর হলেও কেমন যেন বিষণ্নতা জেগে আছে তার মধ্যে। মহাকাল বড় নিষ্ঠুর।

গল্প করতে করতে হাঁটছিল তারা। হঠাৎ তারা দেখতে পেল উল্টোদিকের রাস্তা ধরে স্মিথ এগিয়ে আসছে। পরনে সেই একই পোশাক। কাঁধে বন্দুক। রাস্তার পাশে একটা মুণ্ডুহীন ফারাওয়ের মূর্তির সামনে এসে মিলিত হল তারা তিনজন। স্মিথের সারা দেহ ঘামে ভেজা। বোঝা যাচ্ছে সম্ভবত সে সারা দুপুর বাইরে কাটিয়েছে। সুদীপ্ত তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি সিংহর খোঁজে গেছিলে?’

সে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, আমি শেবার মন্দিরের ওদিকে গেছিলাম প্রাণীটার খোঁজে।’

হেরম্যান তাকে বললেন, ‘আচ্ছা, তোমরা তো তিন পুরুষ ধরে শিকারি। শিকারের খোঁজে বহু জায়গাতে তোমাদের যেতে হয়েছে। সিংহ-মানুষের অস্তিত্ব তুমি বিশ্বাস করো? এই যে হুই নামের ছেলেটা আজ যে কথা বলল?

স্মিথ প্রশ্নর জবাব না দিয়ে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনাদের একটা কথা জিজ্ঞেস করছি। আপনারা কি সত্যিই সাধারণ টুরিস্ট? ডক্টর টিউনিসের সঙ্গে আপনাদের কী সম্পর্ক?’

হেরম্যান সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন, ‘আমরা নিজেদের সম্বন্ধে যতটুকু পরিচয় দিয়েছি তার মধ্যে কোনো মিথ্যা নেই। টিউনিসের সঙ্গে হঠাৎই কাকতালীয়ভাবে আমাদের পরিচয়। তাঁর আমন্ত্রণেই আমরা এখানে এসেছি। তোমার সন্দেহের কারণ?’

স্মিথ বলল, ‘আমাকে মাপ করবেন। আসলে এখানে তো কোনো টুরিস্ট আসে না। একসময় শুধু ট্রেজার হান্টাররা আসত। তাই আপনাদের দেখে একটা সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল।’

হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো যে আমরা এখানে রানি শেবার গুপ্তধন খুঁজতে আসিনি।’

স্মিথ হেসে বলল, ‘আচ্ছা এবার বিশ্বাস করলাম। এবার আপনাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিই। একটা সংশোধন করে দিই। আমরা ঠিক তিন পুরুষ শিকারি নই। আমার ঠাকুরদা আর আমি শিকারি হলেও আমার বাবা কিন্তু তা ছিলেন না। তিনি ছিলেন মিশর-গবেষক। ঠিক এই জায়গাতে তিনি বেশ কিছুদিন কাটিয়েছেন। আর আপনাদের দ্বিতীয় প্রশ্নর উত্তরে বলি, সিংহ-মানুষের ব্যাপারটা আমি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝামাঝি একটা জায়গাতে রেখেছি। একটা অদ্ভুত ব্যাপার বলি আপনাদের। আমার বাবা এই শেবা মন্দিরেই সিংহর দ্বারা আক্রান্ত হন। তিনি এখানে রানি শেবার গুপ্তধন খুঁজতে এসেছিলেন। বছর কুড়ি আগের ঘটনা সেটা। তিনি সিংহর আক্রমণে মারাত্মক জখম হবার পর এক ইওরোপীয় পর্যটক দলের সহায়তায় লাক্সরে পৌঁছান। তিনি তখন অচৈতন্য অবস্থায় ছিলেন। মৃত্যুর আগে একবার তিনি চোখ মেলে দুটো কথা বলেন। একটা কথা, ‘খুঁজে পেয়েছি।’ আর দ্বিতীয় কথাটা হল ‘সিংহ-মানুষ!’ তারপরই মৃত্যু হয় তাঁর। আমি তখন নেহাতই ছোট। কিন্তু বাবার মৃত্যুশয্যার পাশে দাঁড়িয়ে এ কথা শুনেছিলাম আমি। আমার ধারণা, দুটো কথা বলতে চেয়েছিলেন তিনি। প্রথমত তিনি গুপ্তধন জাতীয় কিছু খুঁজে পেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত তিনি সিংহ-মানুষের আক্রমণের কথা হয়তো বলতে চেয়েছিলেন। যদিও সিংহ-মানুষের উপস্থিতি স্বাভাবিকভাবে বিশ্বাস করা একটু কঠিন।’

সুদীপ্তরা বেশ অবাক হয়ে গেল তার কথা শুনে। হেরম্যান স্মিথকে কিছু একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই স্মিথ একটা প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, সিংহর মাংস কেউ খায় বলে শুনেছেন??

হেরম্যান বললেন, বুরুন্ডিতে আমি মাসাইদের সিংহর হৃৎপিণ্ড খেতে দেখেছি। সুদীপ্ত সে ঘটনা তোমারও নিশ্চয়ই মনে আছে। আফ্রিকান ওঝা বা জাদুকররা সিংহর গোঁফ, নখ, হৃৎপিণ্ড তাদের কাজের জন্য সংগ্রহ করে।’

স্মিথ একটু কী যেন ভেবে নিয়ে বলল, ‘আমি যতটুকু জানি, বুশম্যানরা সিংহর মাংস খায় না। তাহলে?’

সুদীপ্ত বলল, ‘ব্যাপারটা কী খুলে বলো তো?’

স্মিথ বলল, ‘একটা অদ্ভুত ব্যাপার। হুই বলে ছেলেটার কথা শোনার পর আমি সেই গাছটার কাছে যাই। সত্যিই মাটিতে সিংহর থাবার দাগ, আর গাছের গুঁড়িতে তার থাবার আঘাতে ক্ষতচিহ্ন দেখতে পাই। সিংহটা যে পথ ধরেছিল তা অনুমান করে সেদিকে এগোই। পথটা একটু ঘুরপথে গেছে শেবা মন্দিরের পিছনে দিকে। সেখানে একটা ঘাসজমির মধ্যে একটা মৃতদেহ আবিষ্কার করি আমি। তবে সেটা সিংহর নয়, সিংহীর। দেহটা দেখে আমার অনুমান পরশু রাতে মারা হয়েছে তাকে। যার জন্য সেদিন রাতে তার জুড়িদার সিংহটা ডেকে বেড়াচ্ছিল। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হল সে দেহ সম্পূর্ণ নয়, অর্ধেক। কেউ যেন নিপুণভাবে তার দেহের কোমর থেকে কেটে নিয়ে গেছে!’

সুদীপ্ত বলল, ‘ব্যাপারটা সত্যি বড় অদ্ভুত তো!’

বেলা পড়ে আসছে। স্মিথ বলল, ‘সাথীহারা সিংহ খুব মারাত্মক প্রাণী। সন্ধ্যা নামবে একটু পর। ওদিকে আর এগিয়ে আপনাদের দরকার নেই। এবার ফিরে চলুন।’

তার কথামতো তিনজন মিলে ফেরার পথ ধরল। হাঁটতে হাঁটতে স্মিথ একসময় বলল, ‘আপনারা ডক্টর টিউনিসের আতিথেয়তায় আছেন তবুও একটা কথা বলি। এই যে টিউনিস এতদিন ধরে এই পাণ্ডববর্জিত জায়গাতে বাস করছেন, এটা কি খুব স্বাভাবিক ব্যাপার?’

হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক ঠিকই। তবে অনেক পণ্ডিতমানুষ নিরিবিলিতে থাকতে ভালোবাসেন। তাতে জ্ঞানচর্চার সুবিধা হয়।’

স্মিথ কী একটা ভেবে নিয়ে বলল, ‘হয়তো তাই হবে। তবে একটা অনুরোধ, আমাদের তিনজনের কথাবার্তা আশা করি গোপন থাকবে।’

হেরম্যান বললেন, ‘এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই টিউনিসের বাড়ির কাছাকাছি চলে এল সুদীপ্তরা। স্মিথ তাদের থেকে বিদায় নিয়ে গ্রামের দিকে এগোল, আর সুদীপ্তরা বাড়ির ভিতর ঢুকল। ঠিক সেই সময় দূরে শেবার মন্দিরের আড়ালে সূর্য ডুবল।

কাজের ঘরে বসে মোমের আলোতে দুপুরবেলার মতোই একটা হিয়ারোগ্লিফিক পরীক্ষা করছিলেন ডক্টর টিউনিস। সুদীপ্তদের দেখে তিনি বললেন, কোন দিকে বেড়াতে গেছিলেন?’

হেরম্যান বললেন, ‘যে রাস্তাটা নগরীর দিকে গেছে সেটা ধরে কিছুটা গেছিলাম।’ ডক্টর টিউনিস জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্মিথ বলে ওই শিকারি ছেলেটার সঙ্গে দেখা হল? কিছু বলল সে?’

প্রশ্নটা শুনে মুহূর্তর জন্য দৃষ্টি বিনিময় হল সুদীপ্ত আর হেরম্যানের মধ্যে। হেরম্যান কৌশলে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ হল, ওদিক থেকেই আসছিল সে। তবে কথাবার্তা তেমন বিশেষ কিছু হল না। সে শুধু বলল, সে সিংহর সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’

ডক্টর টিউনিস, তাঁর হাতের হিয়ারোগ্লিফিকের প্লেটটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে বললেন, ‘ছেলেটার গতিবিধি বেশ সন্দেহজনক। সে দুপুরবেলা শেবা মন্দিরের দিকে গেছিল ঠিকই তবে সম্ভবত সিংহর সন্ধানে নয়। ধুলো সরিয়ে টর্চের আলো ফেলে সে মন্দিরের দেওয়ালে আঁকা ছবি দেখছিল। সকালে গিয়ে আমি লক্ষ করেছি। মন্দিরের গায়ের থেকে একটা ছোট হিয়ারোগ্লিফিক প্যানেল খসে পড়ে আছে। ওটা ওখানে পড়ে থাকলে নষ্ট হয়ে যাবে বলে সেটা আমার এখানে আনার জন্য মোগাবোকে মন্দিরে পাঠিয়েছিলাম। তখনই মোগাবোর চোখে পড়ে ব্যাপারটা। তাকে অবশ্য সে দেখতে পায়নি। আমার ধারণা সে এখানে অন্য কিছু খুঁজতে এসেছে। শিকার করতে আসা একটা অজুহাত মাত্র।’

হেরম্যান জিজ্ঞেস করলেন, ‘সে কী খুঁজতে এসেছে? গুপ্তধন?’

ডক্টর টিউনিস জবাব দিলেন, ‘আমার ধারণা তাই। অথবা প্রাচীন কোনো পুরাকীর্তি সংগ্রহ করতে এসেছে সে। জানেন তো এসব প্রাচীন হিয়ারোগ্লিফিক প্যানেল, ছবি বিদেশের বাজারে চড়া দামে বিক্রি হয়। এভাবে আমাদের দেশের কত অমূল্য সম্পদ যে বিদেশে পাচার হয়েছে তার হিসাব নেই। ছেলেটার কথায় সন্দেহজনক কিছু পেলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবেন। এ সব সম্পদ রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।’

সুদীপ্ত বলল, ‘তেমন কিছু বুঝলে নিশ্চয় জানাব।’

ডক্টর টিউনিসের সঙ্গে কথা বলে নিজেদের ঘরে ফিরে এল দুজন। তারপর হেরম্যান সুদীপ্তকে বললেন, ‘স্মিথ আর টিউনিসের কথা শুনে বুঝতে পারছি তারা দুজনেই এখানে একে অন্যের উপস্থিতি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে! ব্যাপারটার মধ্যে কোনো গূঢ় কারণ আছে।’

ডক্টর টিউনিস আর স্মিথকে নিয়ে, এ জায়গা নিয়ে নানা কথা আলোচনা করতে লাগল দুজন। রাত আটটা নাগাদ মোগাবো খাবার দিয়ে গেল। লোকটা কেমন যেন নিশ্চুপ ধরনের। শুধু ঝকঝকে সাদা দাঁত বার করে নিঃশব্দে হাসে। কোনো কথা বলে না। খাবার বলতে রুটি আর মুরগির ঝোল। খেতে শুরু করল দুজন। খেতে খেতে হেরম্যান হঠাৎ মুখ বিকৃত করলেন। তারপর আঙুল দিয়ে মুখ থেকে সুতোর মতো কী যেন বার করলেন। গ্লাসের জল দিয়ে সেটা ধুয়ে হাতের চেটোতে রেখে সেটা মেলে ধরলেন মোমবাতির সামনে। কালচে খয়েরি রঙের সুতোর মতো দেখতে কয়েকটা জিনিস।

সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল, ‘কী এগুলো?’

হেরম্যান গম্ভীরভাবে জবাব দিলেন, ‘লোম, আমার ধারণা সিংহর লোম!’

‘সিংহর লোম খাবারের মধ্যে কীভাবে এল?’

খাওয়াটা এরপর আর ভালো করে শেষ হল না। এর উৎস কী হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করতে করতে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল তারা। কিন্তু ঘুম আসছে না। রাত বারোটা নাগাদ প্রথমে শিয়ালের ডাক কানে এল তাদের। গ্রামের দিক থেকে বারকয়েক ডেকে উঠল প্রাণীটা। তারপর সামান্য কিছু সময়ের জন্য নিস্তব্ধতা। এরপর সেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে দূর থেকে ভেসে এল একটা শব্দ—‘আউং-হন্-ন্-ন! হ!’ সিংহর ডাক! এরপর ডেকেই চলল শ্বাপদটা। স্মিথের কথা যদি সত্যি হয় তবে সাথীহারা সিংহটা

খুঁজে বেড়াচ্ছে তার সঙ্গিনীকে। সেই শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল সুদীপ্ত।