শেরা মন্দিরের সিংহ মানুষ – ৫

লোকটাকে দেখে অবাক হয়ে গেল সুদীপ্তরা। সে-ও মনে হয় তাদের দেখে অবাক হল। তাকে যুবকই বলা যায়। গায়ের সাদা চামড়া রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। পরনে খাকি শার্ট আর হাফপ্যান্ট। পায়ে হাই হিল রাবার সোলের বুট, মাথায় শোলার টুপি। বুকে আড়াআড়ি কার্তুজের বেল্ট ঝুলছে।

ঘাসবন ছেড়ে চাতালে উঠে সোজা সুদীপ্তদের সামনে উপস্থিত হয়ে সে টিউনিসের উদ্দেশে বলল, ‘আপনি তো ডক্টর টিউনিস? গ্রামের মানুষদের মুখে আপনার কথা শুনলাম। কাল বিকালে আপনার প্লেনটাকেও নামতে দেখেছি।’

লোকটার কথা শুনে টিউনিস বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিই টিউনিস। আপনার পরিচয়টা?’ লোকটা টুপি খুলে জবাব দিল, ‘আমার নাম স্মিথ। পেশায় শিকারি, লাক্সরে থাকি। কাল সকালেই এখানে এসেছি। যদিও আমার পূর্বপুরুষরা ছিলেন ইউরোপীয় কিন্তু আমার জন্ম ইজিপ্টেই। শিকারের সন্ধানে আমার পিতামহ এদেশে এসেছিলেন। তারপর এদেশেই রয়ে গেছিলেন।’

ডক্টর টিউনিস তাকে বললেন, ‘কী শিকার করতে এসেছেন, সিংহ? কিন্তু নিশ্চয়ই জানেন সিংহ শিকার নিষিদ্ধ?’

স্মিথ জবাব দিল, ‘সিংহ শিকার নিষিদ্ধ, কিন্তু সিংহ-মানুষ তো নয়? গ্রামের লোকেরা তো বলছে এটা সিংহ-মানুষের কাজ!’ এরপর সে ঘামে ভেজা খাকি পোশাকের ভিতর থেকে একটা কাগজ বার করে হেসে বলল, ‘আমি জানি সাহারার এই সিংহ অত্যন্ত দুর্লভ প্রাণী। কিন্তু মানুষের জীবন সবচেয়ে দুর্লভ। ইতিমধ্যে দুজন লোক সিংহর আক্রমণে মারা গেছে। সরকার থেকে সিংহটাকে মারার অনুমতিপত্র দেওয়া হয়েছে।’

ডক্টর টিউনিস এবার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘বুঝলাম। তবে নরখাদক সিংহ খুব ধূর্ত প্রাণী। এই ধূসর ঘাসের জঙ্গলে এমনভাবে মিশে থাকে যে বোঝাই যায় না। এর আগেও বেশ কয়েকজন শিকারি নিজেরা শিকার হয়ে গেছিল শিকার করতে এসে। রানি শেবার আশীর্বাদ নাকি শিকারিদের হাত থেকে সিংহদের রক্ষা করে। সিংহটা খুব কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছে মনে হয়।’

স্মিথ বলল, ‘হ্যাঁ, কাল রাতে আমি তার ডাক শুনেছি। বাইরে বেরিয়ে এসেছিল সে।’

হেরম্যান বললেন, ‘হ্যাঁ, আমরাও শুনেছি।’

স্মিথ তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনারা

হেরম্যান বললেন, ‘আমরা ট্যুরিস্ট।’ তারপর দুজনের পরিচয় দিয়ে এখানে কীভাবে?’

তাঁরা এসে উপস্থিত হলেও তা-ও বললেন।

স্মিথ সুদীপ্তর সঙ্গে করমর্দন করে বলল, ‘তুমি ইন্ডিয়ান? আমার গ্র্যান্ডফাদার একবার আয়োধের দেশীয় রাজার আমন্ত্রণে ইন্ডিয়াতে বাঘ শিকারে গেছিল। সে বাঘের মাথাটা এখনও আমাদের বাড়িতে আছে।’

মাথার ওপর রোদ উঠতে শুরু করেছে চড়চড় করে। আফ্রিকার প্রখর রোদ গায়ে জ্বালা ধরাচ্ছে। ডক্টর টিউনিস বললেন, ‘আপাতত এবার আমাদের ফিরতে হবে।’ স্মিথ বলল, ‘চলুন, আমিও ফিরব। গ্রামে যেতে হবে।’

সুদীপ্ত বলল, ‘গ্রামটা কোথায়? এখনও তাদের একটা লোকও চোখে পড়ল না!’ ডক্টর টিউনিস হেসে বললেন, ‘গ্রামটা আমার বাড়ির পিছনে কিছুটা তফাতে। দেখবেন কী করে! সবে তো কাল সন্ধ্যায় এলেন। তারপর আজ সকালেই আবার এখানে চলে এলেন। গ্রামের লোকরা সিংহর ভয়ে আতঙ্কিত। তাই সম্ভবত বাইরে আসছে না।’

স্মিথ সুদীপ্তর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তো সেখানে যাচ্ছি, কিন্তু ইচ্ছা হলে তোমরাও আমার সঙ্গে যেতে পারো।’

ডক্টর টিউনিস বললেন, ‘হ্যাঁ, দেখে আসতে পারেন। তবে আমি ঘরে ফিরব। দীর্ঘক্ষণ হুইল চেয়ারে ঘোরাফেরা করা আমার পক্ষে সমস্যা। বেশ কষ্টকর।’

হেরম্যান সাদা আলখাল্লা ঢাকা তাঁর পায়ের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার পায়ে কী হয়েছে? পক্ষাঘাত?’

ডক্টর টিউনিস জবাব দিলেন, ‘পক্ষাঘাত নয়। মাস আটেক আগের ঘটনা। এই শেবার মন্দিরের এক জায়গাতে ছাদ থেকে বিরাট একটা পাথরের চাঙড় খসে পড়েছিল আমার ওপর। লাফিয়েও শেষরক্ষা হয়নি। পা চাপা পড়েছিল তার নীচে। পায়ের হাড় একদম ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছিল। নেহাত নিজে ডাক্তার বলে হয়তো বেঁচে গেছি।’ হেরম্যান আর সুদীপ্ত এবার তাঁর কথা শুনে বুঝল ‘ডক্টর’ মানে তিনি চিকিৎসক। তাদের ধারণা হয়েছিল যেহেতু টিউনিস অধ্যাপনা করতেন তাই ‘ডক্টর’ শব্দের অর্থ হয়তো ‘ডক্টরেট’ উপাধিপ্রাপ্ত।

সুদীপ্তরা এরপর ফেরার পথ ধরল। ডক্টর টিউনিস বাড়ির কাছে পৌঁছে কথামতো তাঁর বাড়িতে ঢুকে গেলেন। আর বাড়িটাকে বেড় দিয়ে স্মিথের সঙ্গে সুদীপ্তরা এগোল গ্রামের দিকে। টিউনিসের বাড়ি থেকে কিছুটা এগিয়েই এক জায়গাতে একটা বেশ উঁচু প্রাচীর দাঁড়িয়ে আছে। কোনো প্রাচীন স্থাপত্যেরই অংশ ছিল প্রাচীরটা। তার আড়ালেই গ্রামটা। গ্রাম মানে কিছু কুঁড়েঘর। তাদের মাথায় ঘাসের আচ্ছাদন। কয়েকটা গবাদি পশুও চোখে পড়ল। সুদীপ্তরা সেখানে উপস্থিত হতেই কুটিরগুলো থেকে লোকজনেরা একে একে বেরিয়ে এল। কাফ্রিদের মতো কালো না হলেও এদের গাত্রবর্ণও কৃষ্ণবর্ণ। তবে আকারে একটু খর্বাকায়। বুশম্যান, আফ্রিকার প্রাচীন জনজাতির লোক এরা। স্মিথের সঙ্গে সুদীপ্তদের দেখে মৃদু অবাক হল তারা। গায়ে পশুর চামড়া আর গলায় নানা রকমের মালা পরা একটা লোক এসে স্মিথের উদ্দেশ্যে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, ‘বাওয়ানা, হুই নামের একজন তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চায়। আমাকেও সে কথাটা বলতে চাচ্ছে না। তবে নাকি খুব জরুরি কথা সেটা। গ্রামের ভালোর জন্যই সে নাকি কথাগুলো তোমাকে জানাতে চায়।’

মোড়ল এরপর গলা তুলে হাঁক দিতেই একটা কুটির থেকে বেরিয়ে সুদীপ্তদের সামনে এসে দাঁড়াল একজন তরুণ। তার হাতে একটা বর্শা ধরা। ছেলেটা আসতেই প্রথমজন কাছ থেকে সরে গেল। একটু ভয়ার্তভাবে দুর্বোধ্য ভাষায় সে কী যেন বলতে লাগল স্মিথকে। তারপর তার পোশাকের ভিতর থেকে ধূসর রঙের ক’টা লোম বার করে স্মিথকে দিল। মোড়ল অথবা ছেলেটার ভাষা অবশ্য বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারেনি সুদীপ্তরা। ছেলেটার কথা শেষ হবার পর হেরম্যান স্মিথের কাছে জানতে চাইলেন, ‘ও কী বলছে তোমাকে?’

স্মিথ একটু গম্ভীরভাবে জবাব দিল, ‘ওর দাবি, কাল রাতে ও সিংহ-মানুষকে দেখেছে! ক’দিন পর ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। কিন্তু তার আগে ওর হবু পত্নীকে একটা শিয়ালের চামড়া যৌতুক দিতে হবে। এটাই তাদের প্রথা। বিকালে কিছু দূরে ঘাসবনে সে একটা গাছের নীচে শিয়ালের গর্তর পাশে একটা ফাঁদ পেতে এসেছিল। বিয়ের ব্যাপার বলে কথা। রাত গভীর হতে হঠাৎ তার মাথায় খেয়াল চাপে যে ফাঁদে শিয়াল পড়ল কিনা দেখে আসে। কিন্তু সে জায়গার কাছে পৌঁছতেই দূর থেকে সে দেখতে পায় গাছের নীচে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে একটা পা তুলে গাছের গায়ে ঘষছে! হুইকে সে দেখতে পায়নি। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সেই ছায়ামূর্তি ঘাসবনের মধ্যে দিয়ে মন্দিরের দিকে অদৃশ্য হয়ে যায়। হুই নামের এই ছেলেটা তারপর উপস্থিত হয় সেই গাছের নীচে। চাঁদের আলোতে সে দেখতে পায় ফাঁদ পাতার জন্য সে যে মাটি খুঁড়েছিল তার ওপর জেগে আছে সিংহর পায়ের টাটকা ছাপ। গাছের গুঁড়িতেও লেগে আছে থাবা ঘষার চিহ্ন। তখনও গাছের গা থেকে রস বেরোচ্ছে নখের আঁচড় লাগা জায়গা থেকে। আর এই সিংহর লোমগুলোও লেগেছিল গাছের গায়ে। ভয় পেয়ে এরপর ছেলেটা আর সেখানে দাঁড়ায়নি। লোমগুলো নিয়ে একছুটে গ্রামে চলে আসে। তবে এ ব্যাপারটা গ্রামে সে এখনও কাউকে জানায়নি। আমিও ওকে জানাতে বারণ করলাম। নইলে গ্রামে আরও আতঙ্ক তৈরি হবে।’

হেরম্যান শুনে বললেন, ‘অদ্ভুত ব্যাপার!’

এ গ্রামে দেখার মতো তেমন কিছু নেই। হুই বলে ছেলেটা চলে যাবার পর স্মিথের সঙ্গে সামান্য কিছু কথাবার্তা বলে সুদীপ্তরা ডক্টর টিউনিসের বাড়ির পথ ধরল। বাইরের ঘরে হুইল চেয়ারে বসে কোলের মধ্যে একটা হিয়ারোগ্লিফিকের প্যানেল নিয়ে আতস কাচ দিয়ে সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন ডক্টর টিউনিস। সুদীপ্তরা ঘরে ঢুকতেই তিনি বললেন, ‘বসুন। গ্রাম দেখলেন? কী বলল গ্রামবাসীরা?

হেরম্যান বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তারপর হুই নামের যুবকের সঙ্গে কথোপকথনের ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলেন, ‘আপনি ঘটনাটা বিশ্বাস করেন?’

ভক্টর টিউনিস জবাব দিলেন, দেখুন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি একসময় সিংহ-মানুষ ছিল। তবে এখন তার উপস্থিতি অসম্ভব বললেই চলে। হয়তো লোকটা গ্রামের অন্য কাউকে দেখেছে। আর সে লোকটার আগে সিংহ সেখানে উপস্থিত হয়েছিল। সিংহর ভাক তো অনেকেই শুনেছে গত রাতে।’

সুদীপ্তর এরপর নজর পড়ল ডক্টর টিউনিসের হাতে ধরা হিয়ারোগ্লিফিকের প্লেটটার ওপর। সে হেসে বলল, ‘রানি শেবার মন্দিরে গুপ্তধনের প্রবাদের কথা আপনি বলছিলেন। আপনি তো এসব হিয়ারোগ্লিফিক নিয়ে কাজ করেন, কোনো গুপ্তধনের ইঙ্গিত পাননি এ সবের মধ্যে?

ভক্টর টিউনিস জবাব দিলেন, ‘পেয়েছি তো।’

‘পেয়েছেন?’ বিস্মিতভাবে একসঙ্গে বলে উঠল সুদীপ্ত আর হেরম্যান।

ভক্টর টিউনিস হেসে বললেন, ‘যা পেয়েছি তা সোনাদানার থেকেও মূল্যবান।’ ‘কী সেটা?’ প্রশ্ন করল সুদীপ্ত।

টিউনিস জবাব দিলেন, ‘আমি সেটা এখন বলব না। কাল আমি শেবার মন্দিরে আবার আপনাদের নিয়ে যাব। তখন বলব। ওটা সারপ্রাইজ হিসাবে থাক।’

, টিউনিস এরপর চলে গেলেন প্রাচীন মিশরের ইতিহাস সংক্রান্ত আলোচনায়। ফারাও, খুফু, তুতেন খামেন, মেনকুরু, রানি নেফারটিটি, হাটশেপসুট, ক্লিওপেট্রা থেকে শুরু করে আলেকজান্ডার, জুলিয়াস সিজার, নেপোলিয়ন কত নাম উঠে এল আলোচনাতে। এঁদের কেউ এই পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার শাসক ছিলেন, কেউ কেউ আবার সুদূর রোম বা ফ্রান্স থেকে এই নীলনদের দেশে ছুটে এসেছিলেন সোনার খোঁজে। কত গল্প লুকিয়ে আছে এ দেশের ইতিহাসে! এসব আলোচনা করতে করতে অনেকটা সময় কেটে গেল। সুদীপ্তরা তারপর নিজেদের ঘরে ফিরে এল। ঘরে ঢুকে একটু বিমর্ষভাবে হেরম্যান বললেন, ‘টিউনিস কিন্তু আজ বেশ দৃঢ়ভাবেই এখানে সিংহ-মানুষের অস্তিত্ব অস্বীকার করলেন। কিন্তু সারা আফ্রিকা জুড়ে চলে আসা প্রাচীন মানুষদের এই যে প্রবাদ তা কি মিথ্যা হতে পারে? তিনি জোর দিয়ে বলছেন একসময় তারা ছিল। সাহারার সিংহদের মতো তারাও তো আজ কিছু টিকে থাকতে পারে?

সুদীপ্ত হেসে বলল, ‘সিংহ-মানুষ এখানে থাক বা না থাক একটা অচেনা জায়গা তো ঘোরা হচ্ছে আমাদের। কত কিছু জানাও হচ্ছে।’

হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘তা ঠিক। দেখি ডক্টর টিউনিস আমাদের আগামীকাল নতুন কী দেখান।’