শেরা মন্দিরের সিংহ মানুষ – ৪

ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে প্রাচীন স্থাপত্যগুলোর ওপর। হাজার হাজার বছর ধরে এই প্রাচীন নগরী এমন কত সূর্যোদয় দেখেছে কে জানে! প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার কত উত্থান-পতনের সাক্ষী চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এই সব মূর্তি, স্তম্ভ, দেওয়ালগুলো! হাজার হাজার বছর আগে হয়তো সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কলতানে মুখরিত হয়ে উঠত এ নগরী। মন্দির থেকে ভেসে আসত মিশরীয় পুরোহিতদের মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ, শোনা যেত সৈনিকদের পদধ্বনি, রথের চাকার ঘড়ঘড় শব্দ। সোনার সর্পখোদিত ফারাওদের সোনার উষ্ণীষে, রানিদের অঙ্গ-আভরণে ঝিলিক দিত প্রভাতি সূর্য। কখনো কখনো নগরীর ভিতর থেকে ভেসে আসত খাঁচায় বন্দি পোষা সিংহ বা অন্তঃপুরে শিকলবন্দি রানিদের পোষা চিতাবাঘের ডাক, নতুন সূর্যের আলো ডানায় মেখে নেবার জন্য আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হত বাজপাখি। সেসব দিন এখন সুদূর অতীত। শুধু মহাকালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জীর্ণ পাথরগুলো।

নগরীর ভিতর এগোচ্ছিল সুদীপ্তরা। হুইল চেয়ারে ডক্টর টিউনিসকে নিয়ে এগোচ্ছিল মোগাবো। তার পাশাপাশি হাঁটছিল সুদীপ্তরা। এগোতে এগোতে ডক্টর বললেন, ‘রানি শেবা বা শিবার কথা হয়তো আপনারা জানেন। বাইবেলে বর্ণিত আছে তাঁর কথা। জ্ঞানী রাজা সলেমনের বুদ্ধিমত্তার ওপর পরীক্ষা নিয়েছিলেন। সলেমন ছিলেন ইজরায়েলের রাজা। কিন্তু রানি শেবা বা শিবার রাজ্য কোথায় ছিল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলেন শেবার রাজধানী ছিল লোহিত সাগরের তীরে আরবে। আবার কেউ কেউ বলেন তিনি ছিলেন মিশরীয়। রাজা সলেমনের প্রথম পত্নী ছিলেন মিশরীয় আরবি পুঁথিতে উল্লেখ আছে সলেমনের প্রথম স্ত্রী ছিলেন মিশরীয় এবং সেই স্ত্রী নাকি শেবা। প্রচুর ধন-সম্পত্তির অধিকারিণী ছিলেন তিনি। আরবীয়ন ও ব্যবলীয়ন পুঁথিতে আবার শেবাকে একজন জাদুকরী বা মায়াবী রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। যাই হোক অনেকে আবার মনে করেন ইয়েমেনের মতো এখানেও আস্তানা ছিল শেবার। তিনি এখানেই তাঁর সম্পত্তি অর্থাৎ সোনাদানা লুকিয়ে রেখে যান। এখানে পাথরের গায়ে খোদিত কিছু হিয়ারেগ্লিফিকেও ওই বক্তব্যের সমর্থনে ইঙ্গিত মিলেছে।’

কথা বলতে বলতে সুদীপ্তরা হাজির হল এক জায়গাতে। সে জায়গাতে একসময় সম্ভবত একটা তোরণ ছিল। তা আজ ভেঙে পড়েছে। দু-পাশের স্তম্ভ দুটোই শুধু দাঁড়িয়ে আছে। আর তার গায়ে দাঁড়িয়ে আছে দুটো প্রাচীন মূর্তি। অন্তত ত্রিশ ফুট উঁচু হবে মূর্তি দুটো। তাদের দেহ সিংহর, মুখ মানুষের। সিংহ-মানুষ! বা দণ্ডায়মান ফিংস। ডক্টর বললেন, ‘এই মূর্তি দুটো এই প্রাচীন নগরীর পাহারাদার। সিংহ-মানুষ। আপনাদের বলছিলাম না, প্রাচীন জনশ্রুতি একসময় সিংহ-মানুষরা এ নগরী পাহারা দিত!’

এগোতে থাকল সুদীপ্তরা। অসংখ্য প্রাচীন মূর্তি ছড়িয়ে আছে চারপাশে। মরুঝড়ে, কালের প্রকোপে তাদের অনেকেরই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খসে পড়েছে। তাদের মধ্যে কোনোটা ভেড়ার দেহঅলা হ্যাথোরের, কোনোটা বা সূর্যদেব ‘আমনের’, কোনোটা বা কুকুরমুখী দেবতা অনুবিসের। ডক্টর টিউনিস বুঝিয়ে দিতে লাগলেন সবকিছু। পাথুরে পথ সোজা এগিয়েছে খণ্ডহর নগরীর ভিতর। পাথুরে মাটিতে আজও জেগে আছে কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন ধাতুর বেড়ি পড়ানো রথের চাকার ঘষটানির দাগ! ডক্টর টিউনিস সেটা দেখালেন সুদীপ্তদের। একসময় সুদীপ্তরা দেখতে পেল ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট বড় এক প্রাচীন কাঠামো। রোদে পোড়া ধূসর রঙের ঘাসবন তার চারপাশে। মোগাবো এবার তার কাঁধ থেকে রাইফেলটা খুলে নিল। সুদীপ্ত খেয়াল করল হেরম্যান মুহূর্তের জন্য হাত দিলেন কোমরে। ওখানে জামার নীচে তাঁর রিভলভারটা রাখা আছে। ডক্টর টিউনিস আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, ‘ওই হল, রানি শেবার মন্দির।’

সুদীপ্তরা কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেল সে জায়গাতে। বিশাল পাথুরে চত্বরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরটা। বিরাট বিরাট থাম ধরে রেখেছে মন্দিরের ছাদটাকে। থামের গায়ে আঁকা আছে সিংহ-মানুষের মূর্তি। কালের প্রকোপে কিছুটা ক্ষয়ে গেলেও তাদের চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না। শেবার মন্দির থেকে আরও বেশ কিছুটা দূরে ঘাসবনের মধ্যে দূর থেকে চোখে পড়ছে আর একটা জীর্ণ মন্দির। সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল, ‘ওই স্থাপত্যটা কী?’

ডক্টর টিউনিস জবাব দিলেন, ‘ওটা দেবী থেট’ বা ‘থথের’ মন্দির। প্রাচীন মিশরীয়দের জ্ঞান ও জাদুবিদ্যার দেবী ছিলেন তিনি। তবে ওখানে এখন আর ঢোকা যায় না। একেবারে ধ্বংসস্তূপ। রানি শেবা দেবী থথ-এর উপাসক ছিলেন।’

শেবার মন্দিরের দিক থেকে মানুষ সমান ঘাসবন চলে গেছে থথ মন্দিরের দিকে। মোগাবো একবার সতর্কভাবে রাইফেল উঁচিয়ে দেখে নিল সেদিকটা। তারপর চত্বর পেরিয়ে তারা প্রবেশ করল মন্দিরের ভিতর। অসংখ্য স্তম্ভ ধরে রেখেছে বিরাট ছাদটাকে। ভাঙা ছাদের ছিদ্র গলে সূর্যকিরণ ঢুকছে, তবুও বিরাট বিরাট থামের আড়ালে অন্ধকার খেলা করছে। একটা বেশ গা-ছমছমে পরিবেশ মন্দিরের ভিতর। প্রথমে একটা বেশ বড় হলঘর। তার ঠিক মাঝখানে উঁচু বেদিতে পাশাপাশি বসে আছেন এক রাজা ও তাঁর রানি। আর সেই বেদির ঠিক নীচে নতজানু ভঙ্গিতে বসে আছে দু-জন সিংহ-মানুষ। ডক্টর টিউনিস বললেন, ‘অনেকের অনুমান এটা রাজা সলেমন ও রানি শেবার মূর্তি। লক্ষ করে দেখুন, রাজার মুকুটটা মিশরীয় ফারাওদের মতো নয়, অন্য ধরনের। এ জন্যই এমন ধারণা করা হয়।’

মন্দিরের ভিতর ঘুরতে করল সুদীপ্তরা। অস ঘর। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মূর্তি। নানা বিচিত্র ভঙ্গি তাদের। কেউ বসে, কেউ বা দাঁড়িয়ে। কোনোটা ফ্যারাওয়ের, কোনোটা পাথরের, কোনোটা আমনের। দেওয়ালে প্যানেলের গায়েও রয়েছে অসংখ্য চিত্রলিপি। সুদীপ্ত ক্যামেরা বার করে ছবি তুলতে শুরু করল। নানা ধরনের বিচিত্র সব ছবি। মিশরীয়দের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে, তাদের রাজসভা, বিচারসভা, মায় শেষযাত্রার দৃশ্য অব্দি। তাদের কিছু অংশ খসে পড়লেও বা বিবর্ণ হলেও মহাকাল তাদের সম্পূর্ণ গ্রাস করে নিতে পারেনি। হাত দিয়ে ঘষে ধুলোর আবরণ একটু সরালেই তার আড়াল থেকে ঝিলিক দিচ্ছে ছবির উজ্জ্বল সোনালি বা নীল রং। ছবি আঁকার সময় এ দুটো রঙের খুব বেশি ব্যবহার করত সে সময়ের মানুষরা।

হেরম্যান ডক্টর টিউনিসকে বললেন, ‘আপনি হিয়ারোগ্লিফিক পড়তে জানেন?’

তিনি হেসে জবাব দিলেন, ‘কিছুটা পারি। সবটা নয়। কারণ এই চিত্রভাষা এক এক সময় এক এক ভাবে লেখা হয়েছে। ফরাসি পণ্ডিত শ্যাপলিয় প্রথম এই বর্ণমালার পাঠোদ্ধার করেন ‘রোসেটা স্টোন’ থেকে। ওই পাথরটা নেপোলিয়নের মিশর অভিযানের সময় তাঁর এক সেনাপতি কুড়িয়ে পেয়েছিলেন।’

কথা বলতে বলতে ডক্টর টিউনিসের হুইল চেয়ার দাঁড়িয়ে পড়ল এক জায়গাতে। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘ওই ছবিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, ওটা দেখুন।—’

একদিকে দেওয়াল জুড়ে বিরাট একটা ছবি। এক রাজা ও তার রানি তাঁদের ভৃত্য পরিবৃত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের একজন ভৃত্যের হাতে শিকল বাঁধা বেশ কয়েকটা ছোট ছোট প্রাণী। কুকুরের মতো তারা বসে আছে পায়ের কাছে। একজন রানির পা চাটছে। তাদের দেহ সিংহর, মাথাটা বাচ্চা ছেলের!

ছবিটা দেখার পর ডক্টর টিউনিস বললেন, ‘এই সিংহ-মানুষরা সম্ভবত দেবতা ছিল না। তাহলে এদের হীনভাবে চিত্রিত করা হত না। কারণ, মিশরের রাজা-রানিদের মধ্যেও ধর্মভাব প্রবল ছিল। এ ধরনের প্রাণীর নিশ্চিত উপস্থিতি ছিল সে সময়। কল্পিত প্রাণী ছিল না তারা। আপনাদের অন্য একটা জায়গাতে এবার নিয়ে যাব।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি এরপর হাজির হলেন মন্দিরের পিছন দিকে। জায়গাটা প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আশেপাশে ঘাসের জঙ্গল। একটা ছাদহীন কাঠামো শুধু দাঁড়িয়ে আছে। অদ্ভুত কাঠামো। তার দেওয়ালের পরিবর্তে রয়েছে পাথরের লম্বা লম্বা শিক বা দণ্ড। ঠিক যেন এটা ছিল পাথরের তৈরি বিরাট খাঁচা বা গরাদ ঘর। মাথার ওপরটাও পাথরের শিকের ছিল। সেগুলো অবশ্য খসে পড়েছে। ঘরটাতে সুদীপ্তদের নিয়ে ঢুকলেন ডক্টর। তাঁর ইঙ্গিতে মোগাবো মেঝের ওপর এক জায়গাতে ধুলো সরাতেই সেখানে ফুটে উঠল বেশ কিছু পায়ের ছাপ। আরও এক জায়গার ধুলো সরাতেই একই রকম ছাপ বেরিয়ে এল। থাবাঅলা পায়ের ছাপ। পাথর খোদিত ছাপ। হেরম্যান নীচু হয়ে বসে সেই প্রাচীন ছাপগুলো পরীক্ষা করে বললেন, ‘সিংহর পায়ের ছাপ!’

টিউনিস হেসে বললেন, ‘সিংহ নয়, সিংহ-মানুষের পায়ের ছাপ। এই মন্দির পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন। ঘরের মেঝেতে নরম স্যান্ডস্টোনের গুঁড়োর প্রলেপ দেওয়া হত। সেই নরম কাঁচা মেঝেতে আঁকা হয়ে গেছিল তাদের পায়ের ছাপ। সিংহর পরিবর্তে সিংহ-মানুষ বলছি কারণ, ঘরের কোনায় মাটিতে গাঁথা ওই পাথরের জলের পাত্রটা দেখুন। সিংহ শ্রেণির প্রাণীরা সাধারণত জল চেটে খায়। ওই পাত্রে মুখ ডুবানো যেত না, জল অন্য কোনো ছোট পাত্রে তুলে পান করতে হত, নিছক সিংহর পক্ষে যা সম্ভব নয়। এ মন্দিরের একটা ঘরে ঠিক এ জায়গায় ছবি আছে। যেখানে দেখানো হয়েছে এখানে এই ঘরে বেশ কয়েকটা সিংহ-মানুষ বসে আছে।’

কথা বলছিলেন মিস্টার টিউনিস। কিন্তু হঠাৎ একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে তাঁর কথা থেমে গেল। কিছুটা তফাতে একটা থামের গায়ের ঘাসের বন যেন দুলে উঠল। মোগাবো সঙ্গে সঙ্গে রাইফেল তাগ করল সে দিকে। কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। ঝোপটা আবার দুলে উঠল। আর তারপরই থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একটা লোক। তার কাঁধে রাইফেল।